অথবা তারা এসব জানলেও যে দুনিয়ার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো তাও তো সত্য না। বরং ক্ষতিটা একান্তই তাদেরই ছিল এবং এ বিষয়ে তারা কেউ অবগত ছিল না--না তারা, না মোহনপুরের অন্য কেউ--কেউই জানত না মোহনপুরের মোহনরূপ অচিরেই বিধ্বস্ত হতে চলেছে।
ফলে ঢিবির ওপর নাসু মিয়ার বোকা বলদটা ঘাসই চিবাতে থাকল আর নাসু মিয়া তার উঠানে পা ছড়িয়ে, সদ্য শুকিয়ে আসা উরুর ঘা নখ দিয়ে খোঁচাতে থাকল। তাতে কিছু রক্তাভ পানি নখে উঠে আসলে নাসু মিয়া সেটার ঘ্রাণ নিতে থাকল বারবার!
এসব এলানো জীবন যখন চলছে তখন মোহনময়ী হাইস্কুল কিন্তু ভরে উঠেছে পশতু ভাষায়। গালির ছররার সাথে অস্ত্রের ধাতব এমন কিছু শব্দ মিশতে শুরু করেছে বাতাসে যার সাথে মোহনপুরের পরিচয় আগে ঘটে নি। মিলিটারিদের দৈহিক আকার, তাদের কেতা, চাহনি আর ভাষা সব কিছুর দিকেই মোহনপুরের মানুষ থ হয়ে তাকিয়ে থাকে। যেন সাক্ষাত ফেরেশতা দেখছে চোখের সামনে!
অবশ্য ভুল ভাঙতে খুব তো দেরি হয় না তাদের।
রাত হলে ঘর জ্বলে, কাঁথায় মুড়ে উঠে আসতে শুরু করে মেয়েমহল, পুরুষ পালায়, মিল্লাত ভাইয়ের হাত কাটা পড়ে। মানুষ ফেরেশতা দেখলে বিস্মিত হতে পারে কিন্তু শয়তানের মুখোমুখি হলে স্রেফ বলদ হয়ে যায়। মোহনপুর গ্রাম তিনটা রাতের মাথায় এক অতিকায় বলদে পরিণত হয়।
ফলে তারা লাকড়ি যোগাড় করে দেয় মিলিটারিদের। তারা মুরগি ধরে দেয় মিলিটারিদের। তারা আরো স্ফিত মাংস ধরে দেয় মিলিটারিদের। আর এমন অবস্থায় কে জানত… গ্রামের সবচেয়ে বোকা বলদটাই, যার বলদামির দৃষ্টান্ত দিয়ে ফিরত দশগ্রাম, এমন চতুর হয়ে উঠবে?
মুরগি আর ছাগল খেতে খেতে অরুচি হয়ে গিয়েছিল মিলিটারিদের।
সব হাতের নাগালে পেয়ে যাওয়ায় কামনার উদগ্রতাও অনুভব না করে করে কেমন যেন সব ঝিমিয়ে যাচ্ছে এমন ভেবেই গাড়ি নিয়ে ওরা বেরিয়েছিল। খানাখন্দ পেরিয়ে যখন তারা গ্রামের ভেতরে ঢুকল, ঢুকেই দেখল ডোবার পাশের ঢিবিতে নাসু মিয়ার বলদা দাঁড়িয়ে বড় স্বস্তির সাথে ঘাস চিবাচ্ছে। মাংসের লোভে নাকি নির্লিপ্ত শান্তিময় বোকামী কোনটা দেখে কে জানে ক্যাপ্টেন হুঙ্কার দিয়ে ধরতে গেল বলদটাকে--আর তখনই বলদটা, অতি আশ্চর্যই বটে, শিং ঘুরিয়ে দিলো ক্যাপ্টেনের দিকে। আর তারপরই চতুর বাজের মতো লাগালো ছুট! ধুলো উড়িয়ে বিকালের কুয়াশা চিরে, ছুটতে ছুটতে, নিমিষে, পেরিয়ে গেল গ্রাম।
মোহনপুরে টিকে থাকা মানুষদের জন্য বিষয়টা ছিল অকল্পনীয়। যে বলদ কোনোদিন চোখ তুলে তাকাতো না পর্যন্ত কারো দিকে, সেই বলদই ক্যাপ্টেনকে শিঙের গুঁতোয় কিনা ডোবায় ফেলে দিলো? ক্যাপ্টেন সাঁতার জানতো না বলে আতঙ্কিত হলো, নাকি নিতম্বের ওপর ব্যথাটা ভীষণ ছিল বলে কাদার ভেতর কাতরাতে থাকল কেউ তা বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু ডোবার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বলদ বলদ চোখগুলো দেখে ক্যাপ্টেনের রাগ হলো। ভীষণ রাগ।
সেই রাগে বলদ না, ধরা পড়ল, নাসু মিয়া।
বলদটা যেহেতু নাসু মিয়ার, সেহেতু বলদের জিম্মাও তো তার।
মোহনময়ী হাইস্কুলের মাঠে একটা শ্যাওড়া গাছ ছিল। তাতে নাসু মিয়াকে উল্টো করে বাঁধা হলো। নাসু মিয়ার লুঙ্গি উল্টে লজ্জা বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু তাতেও নাসু মিয়ার খুব যে লজ্জা হচ্ছিল তা না। কারণ লুঙ্গিটা উল্টে আসলে তার মুখই ঢেকে রেখেছিল। লজ্জা পাবার মতো দৃশ্য নাসুর চোখের সামনে ছিল না।
কিন্তু লজ্জা কিছু বোধহয় মোহনপুরের টিকে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে হলো। তারা নাসুকে দেখতে এসে ঠিকমতো দেখতে না পেরেই ফিরে যেতে থাকল। আর সন্ধ্যার দিকে গ্রাম বিদীর্ণ করা নাসুর চিৎকার তারা শুনতে পেলো। জানতে পেলো বলদ বাঁধার দড়িটা ক্যাপ্টেন নাসুর মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে নাকের ফুটো দিয়ে বের করে নিয়ে এসেছে। তাতে নাকের দুই ফুটো হয়ে গেছে একটা এবং বর্ষার খালের মতো তার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্ত । ক্যাপ্টেন দড়িটা দিয়ে আরো কী কী করা যেতে পারে তাই ভাবছে কারণ দড়িটা নাসু মিয়া সঠিকভাবে ব্যবহার করলে বলদটা বাঁধাই থাকত এবং ক্যাপ্টেনকে এমন অপদস্ত করতে পারত না!
এমন না যে অন্য মিলিটারিটা তখন বসে ছিল।
তারা বেরিয়ে পড়েছিল বলদটাকে খুঁজে বের করতে। মোহনপুরের টিকে থাকা মানুষেরা ভেবেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে বলদটা ধরা পড়ে যাবে এবং কে জানে তাকে হয়ত ক্যাপ্টেন আস্ত চিবিয়ে খাবে। (এর আগে একটা আস্ত মুরগী রান্না ছাড়াই চিবুতে দেখেছিল বলে এমন ধারণা তাদের মধ্যে হয়ে থাকতে পারে।) কিন্তু সন্ধ্যা পার করেও এক প্লাটুন মিলিটারি বলদটাকে খুঁজে পায় না। তাদের পোশাক ধুলোয় ধূসর হয়ে ওঠে, তারা খালের কাদাপানির মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আলের পাশে মানুষের হাগার ভেতর লেপ্টালেপ্টি খেয়ে ফিরে আসে আর হাইস্কুলের মাঠ গুয়ের গন্ধে ম ম করে ওঠে। ক্যাপ্টেন বমিও করে।
এত অপদস্তের একটাই সমাধান বের করে ক্যাপ্টেন। এবং সেটি অবশ্যই বলদবাঁধা দড়ি নয়। ক্যাপ্টেন লোহার শিক গরম করে এবং নাসু মিয়ার সাথে যেন আলাপচারিতায় বসে। এ আলাপচারিতা মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। ততক্ষণে নাসু মিয়া আর কথা বলার মতো অবস্থায় থাকে না। ফলে হঠাৎ মিটিং ফুরানোর বেদনা নিয়েই যেন ক্যাপ্টেন নাসু মিয়াকে গুলি করে। মোহনপুরের টিকে থাকা মানুষেরা সে গুলির শব্দ শোনে। খুব মৃদু আর্তিও শোনে নাসু মিয়ার। তারা আটকে দেয়া ঘরের দরজা উঠে আবার আটকে দেয়। তারা চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে, কিন্তু বুঝতে পারে তাদের চোখ বারবার খুলে খুলে যাচ্ছে। শুধু চোখ না, তাদের মনে হয়, তাদের কানও খুলে যেতে শুরু করে। এবং তারা প্রতিটা ঘরের ভেতরের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন শুনতে পাচ্ছে। তারা এমনকি শুনতে পাচ্ছে খেজুর পাতা ছুঁয়ে পড়া শিশিরের শব্দও। তারা খালে পানি ঢোকার কুলকুল শব্দও যেন নিজেদের পিঠের তলায় অনুধাবন করতে শুরু করে। আর তারা চোখ বন্ধ কান বন্ধ করে ফেলে বারবার, কিন্তু তখনই যেন তাদের চোখ খুলে আসে কান খুলে আসে।
ভোরের আলো ফোটারও আগে, মতি মোয়াজ্জিন পালিয়ে না গেলে যে সময়ে আজান দিতো, তেমনই একটা সময়ে তারা শুনতে পায় একটা টুংটাং শব্দ। টুংটাং শব্দটা যেন ক্রমশ তাদের দিকে আসতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারে গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে নাসু মিয়ার বলদটা ফিরে এসেছে। তারা ভয় পায় খুব। কিন্তু তারা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। তারা বলদটাকে দেখতে পায় না, কিন্তু তারা নিজেদের দেখে। দেখে চোখ বন্ধ করতে চেয়েও তারা চোখ খুলে রেখেছে। কান বন্ধ করতে চেয়েও প্রত্যেকে তাদের কান খুলে রেখেছে। তারা শব্দ শুনছে এবং তারা দেখতে পাচ্ছে। তারা জমা হতে হতে এগিয়ে যেতে থাকে মোহনময়ী হাইস্কুলের দিকে। এবং সেখানে গিয়েও তারা বলদটাকে দেখতে পায় না, কিন্তু নিজেদের তারা দেখে। দেখে তারা আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে হাতে হাতে। তারা আবারও বলদটাকে খোঁজে কিন্তু শুধুই নিজেদের দেখতে পায়। দেখে তারা আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে কেরোসিন ঢেলে ঢেলে। আর তারা দেখে হাইস্কুলের দালান, দরজা, জানালা, ক্যাম্প দাউদাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আর সমস্ত আগুনের ভেতর দিয়ে একটা কমলা সূর্য উঠে যাচ্ছে। যেন আগুনটাই সূর্য হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আর তারা সবাই মিলে খেয়াল করে বলদটা ফিরে এসেছে রাজ্যের ধুলো মেখে ভীষণ পরিশ্রান্ত। তার মুখ দিয়ে গলে পড়ছে ক্লান্তির ফেনা। কিন্তু তার চোখের টুকরো টুকরো আগুনে হাইস্কুলের দালান, দরজা, জানালা, ক্যাম্প পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে।
মোহনপুরের মানুষেরা খেয়াল করে বলদের গলায় কোনো ঘণ্টা নেই, আসলে ছিল না কখনো।
-----------
লেখক পরিচিতিঃ
আহমেদ খান হীরক
গল্পকার।
ঢাকায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ