প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের দিক থেকে আসা কবির অনুরাগী তরুণ কবি সেলিম মল্লিক বলল, বাকি জমিতে কী হত ?
পড়ে থাকত বললাম না।
সে তো জঙ্গল হয়ে যাবে।
কবি বললেন, জঙ্গলই হত, জঙ্গলে কত রকম পাখি এসে বাসা বাঁধত, আরে পাখিদের থাকার জায়গা দিতে হবে তো, জঙ্গল পুড়িয়ে দিলে হবে না, গাছ কেটে দিলে হবে না, সব রেখে দিতে হবে।
পাখিরা তো গাছের ডালে বাসা বাঁধে, আকাশে উড়ে বেড়ায়, মাটিতে কী থাকত ?
কেন হরিণ, কেঁচো, ব্যাঙ, সাপ, বন বিড়াল, বাঘ ডাঁশা, হুড়াল, প্রজাপতি, জোনাকি, কত কী...।
আপনি দেখেছেন ?
কবি বললেন, দেখিনি আবার, এক রাত্তিরে চাঁদের আলোয় দেখি, আমাদের উঠোনে দুটো হরিণ বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছে।
তারপর ?
বলল, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন ?
তারপর ?
আমি বললাম জঙ্গলে কি জলপাই গাছ নেই ? শুনে হি হি করে হাসতে লাগল হরিণ আর হরিণী। হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগল। বলল, সুকুমার রায়, কিশলয় বইয়ে পড়েছি। তারপর থেমে বলল, অনেক দিন বৃষ্টি হয়নি কি না, তাই জল খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এসেছিলাম।
জল দিলেন ?
দিলাম, গামলা করে জল দিলাম, তার তেষ্টা মেটাল, তখনই গুরুগুরু মেঘ ডাকতে শুরু করল।
বৃষ্টি হলো ? সেলিম জিজ্ঞেস করল।
ওরা তো হরিণ না, ওরা ছিল, মেঘ দেবতা, আর দেবতি।
তবে যে বললে হরিণ ? সেলিম জিজ্ঞেস করল।
উঁহু, ভুল বলেছি, ওরা কালো হরিণ, মেঘের মত রঙ , গামলা ভরে জল খেয়ে ওরা অন্ধকারে ছুটে গেল,
তারপর মেঘের ডাক উঠল, গাই গরুর যখন প্রসব বেদনা ওঠে, তেমনি ডাক, শোনো সেলিম তুমি যদি মানুষকে জল দাও তেষ্টায়, মেঘ হবে আকাশে, তুমি যদি পাখিদের খাবার দাও, পাউরুটি বিস্কুট, আকাশে মেঘ হবে, ফলন ভালো হবে, তুমি যদি দেখ প্রজাপতি ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে, তাঁদের তেমনি উড়ে বেড়াতে দাও, শুনবে দূর আফ্রিকার সোমালিয়া দেশে দু’বছর বাদে বৃষ্টি নেমেছে, দুর্ভিক্ষ চলে যাবে।
কবি এমনি। তাঁর একটি কুঁড়ে ঘর। ঘরের ভিতরে বাঁশের মাচায় বই খাতা। আর একটি দড়ির খাটিয়ায় তার শোয়া। একটি কাঁথা খাটিয়ার উপর পাতা, আর একটি কাঁথা বর্ষার দিনে শীতের দিনে গায়ে দিতে লাগে। মাদুর আছে একটি। সেটি বাইরে হাতনেতে পেতে একটি জল চৌকিতে খাতা রেখে কখনো পেনসিল কখনো কালির পেন, কখনো ডট পেন দিয়ে তিনি কবিতা লেখেন। সেই কবিতা এসে নিয়ে যায় যুবক কবিরা। কবি তাদের সঙ্গে কলকাতা যান, হলদিয়ায় কবি সম্মেলনে যান, কবিতা শুনে আসেন। পাঠ করেন না নিজে। ইচ্ছে হলে এখানে ওখানে যান। না গেলে বাড়িতে থাকেন, নদীর ধারে যান। নৌকোর মাঝিদের বলেন, সমুদ্দুরে তাঁর একটা দ্বীপ আছে।
জোয়ান মাঝি জিজ্ঞেস করে, কোন সমুদ্দুরে ?
কেন পূর্ব সমুদ্দুরে।
পূর্ব সমুদ্দুর কোথায় ?
বায়ু বয় পূর্ব সমুদ্র হতে, পূর্ব সমুদ্দুর রবি ঠাকুরে আছে আর কালিদাসে আছে, আগে এই সমুদ্দুরকে তাইই বলা হত, তবে সেই সমুদ্দুর হেথায় না হোথায়, আট ঘন্টা দিনে যাও, আধ ঘন্টা গাঙের ধারে নোঙর ফেলে থাকো, আট ঘন্টা রাতে যাও, পৌঁছে যাবে বড় গাঙের ভিতরে গুড়গুড়ি দ্বীপে।
গুড়গুড়ি দ্বীপ, সে কেমন দ্বীপ, শুনিনি তো তার কথা। জোয়ান মাঝি তার ঠাকুরদা এক বুড়ো মাঝিকে জিজ্ঞেস করে। বুড়ো মাঝি বলে, গুড়গুড়ি দ্বীপ ছিল হয়ত, এখন নেই।
কবির কানে যায় কথাটা, কবি বলেন, নেই মানে, কাল রাত্তিরেও ছিল , আজ নেই ?
না নেই। বুড়ো মাঝি যার কিনা তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, সে মাথা নাড়ে। সে এখন হাল ধরতেও পারে না, বৈঠা মারতেও পারে না। কিন্তু বড় নাওয়ে সে থাকে। তার চোখ ঠিক আছে, আন্দাজ ঠিক আছে, সে যেন কম্পাস, অকুল সমুদ্দুরে জলের গতি দেখে, হাওয়ার রকম দেখে, আকাশের তারা দেখে নিখুঁত দিক ঠিক করতে পারে, কোন হাওয়া পুরির জগন্নাথ দেবের উদ্দেশে রওনা হয়, কোন হাওয়া কপিলমুনির দিকে বয়ে যায়। জোয়ার ভাটা হিশেব করে বদর পীরের নাম করে নাও ছাড়তে হবে কখন তা সেই বুড়ো ঠাকুরদাই বলতে পারে। বুড়ো কত দ্বীপ জানে। মানুষ থাকে না, পাখিরা থাকে আর গাছ-গাছালি থাকে, সাপ, ব্যাঙ থাকে, পোকা মাকড় থাকে। গুড়গুড়ি দ্বীপ ছিল, কিন্তু নেই। কিন্তু সেই দ্বীপের নাম গুড়গুড়ি তা তো ওই লোক বলছে। বলছে সেই দ্বীপ তার, না থেকে যাবে কোথায় ? কবি বলছে গুড়গুড়ি দ্বীপ থেকে তাঁর কাছে খবর আসে ডেইলি, গুড়গুড়ি পাখি খবর নিয়ে কাল রাত্তিরেও এসেছিল, এবার নাকি আপনাআপনি আঙুর আর লঙ্কা হয়েছে খুব। গুড়গুড়ি পাখি আঙুর খায় আর বনটিয়া লঙ্কা খায়।
বুড়ো বলল, সেই দ্বীপ আর সেখানে নেই।
কবি হেসে বলল, ঘুরতে বেরিয়েছে, আবার ফিরেও আসে জায়গায়।
জোয়ান মাঝি বলল, দ্বীপ কি ঘুরতে বেরোয় ?
ভেসে বেড়ায় গুড়গুড়ি পাখির দ্বীপ, এক জায়গায় কি মন বসে ?
জোয়ান জিজ্ঞেস করল, গুড়গুড়ি পাখি কেমন ?
ইয়া বড়। দুহাত দুপাশে বাড়িয়ে ধরে কবি বলল, এক একটা পাখি হাঁসের মতো বলতে পার।
মাথা নাড়ল বুড়ো, মোটেই না, এইটুকুন-টুকুন সেই পাখি, চড়ুই পাখির চেয়েও গুড়গুড়ি।
তা হবে হয়ত, আমি তো হাঁস পাখির কথা বললাম।
কবি তাঁর দ্বীপের কথা বলেন তাঁর অনুরাগী কলকাতার আর এক কবি অভিজিৎকে। অভিজিৎ তাঁর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে। তা ছাপা হয়েছে একটি বইয়ে। সেই বই বিলেত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কবি বলেন, তিনি তাঁর গুড়গুড়ি দ্বীপে ভেসে বিলেত ঘুরে এসেছেন। বিলেত, বাকিংহাম প্যালেস, রানি কুইন ভিক্টোরিয়ার ঠাকুমা কিংবা দিদিমা, টেমস নদী, অ্যাভন নদী, সেক্সপীয়রের সঙ্গে দেখা হয়নি, তিনি প্রায় এক মহামারী পার করে মারা গেছেন তখন।
সে তো ৪০০ বছর আগের কথা।
কবি বললেন, তা হতে পারে, মোট কথা সেক্সপীয়রের সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর। দেখা হবে কী করে, তখন তিনি বেঁচে নেই, ধরো তুমি ৪০০ বছর বাদে এলে, আমাকে কি পাবে, আমি মরে গিয়ে গুড়গুড়ি পাখি হয়ে গেছি তখন, সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছি, আমার দ্বীপটা ভেসে বেড়ায়, তুমি সেই দ্বীপ ছুঁতে পারবে না।
তরুণ কবি অভিজিৎ বলল, তুমি একবার কলকাতা চল।
যাব, লালবাজারে যাব, আমার একটা কবিতার খাতা কেড়ে নিয়েছিল ওরা, ফেরত আনতে যাব।
কবিকে লালবাজারে খুব মারা হয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বল, লম্বা না গোল।
কবি বলেছিল, কমলা লেবুর মতো।
তখন রুলের বাড়ি, বল, সূর্য কোন দিকে ওঠে।
গুড়গুড়ি দ্বীপে।
না আমেরিকায়।
কবি মনে মনে বলেছিল, পুলিশ মানেই ফুলিশ।
বল হরিলাল রায় কোথায় ?
বে অফ বেঙ্গলে, গুড়গুড়ি দ্বীপে।
সে কোথায় ?
সমুদ্রের ভিতর ও বাহিরে। কবি বলেছিল। হরিলাল ছিল রাষ্ট্রদ্রোহি, কবি তাঁর পত্রিকার লেখক ও প্রকাশক। কবিতায় তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে এক হাত নেন। কী করে নেন, লিখেছিলেন, আমার এই দেশ মানে আমি নই...লা লা লা লা, পিক পিক পিক, ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম...। ওসব কথার মানে কী ? কবির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, গুড়গুড়ি পাখি জানে। গুড়গুড়ি পাখির জন্ম হলো তখন। সেই পিটানি সেলে। কবিকে চোরের মার দিয়েছিল পুলিশ, কিন্তু কথা বের করতে পারেনি, এক কথা, হরিলাল থাকতে পারে গুড়গুড়ি দ্বীপে। গুড়গুড়ি দ্বীপেরও জন্ম হলো তখন। সেই লালবাজার পিটানি সেলে। মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন হরিলাল সাত সাগর তের নদীর পারে, আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে নিউইয়র্ক সিটিতে থাকেন। কবি জানতেন তাঁর গুড়গুড়ি দ্বীপে ভেসেই হরিলাল অতদূরে চলে গেছে। তাকে নামিয়ে দিয়ে দ্বীপ আবার ভেসে গিয়েছিল হাডসন নদী দিয়ে সমুদ্রে। নইলে আমেরিকান পুলিশ আটক করত গুড়গুড়ি দ্বীপকে। আমেরিকান পুলিশ ভয়ানক। সব দেশের পুলিশই ভয়ানক। তারা প্রকাশ্য রাস্তায় গলা টিপে মানুষ মেরে দেয় কেউ, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে লাশ গায়েব করে দেয়। আমেরিকান পুলিস গুড়গুড়ি পাখিদের মেরে ঘিয়ে ভেজে খেয়ে নিত।
তরুণ কবি সেলিম জিজ্ঞেস করে, লীলাবতীদির কথা মনে পড়ে আপনার?
কবি বলে, পড়ে, সে দূর দ্বীপবাসিনী, আমাদের কবিতা চালাচালি হয়।
লীলাবতীও এক কবি। কবি তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। লীলাবতী কবির সমাদর করতেন খুব। কবিকে তাঁর বাড়িতে রেখেছিলেন কিছুদিন, সেই যখন তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়েছিলেন। লীলাবতী ও তাঁর স্বামী কবিকে খুব যত্ন করেছিলেন সেই সময়। কবির কাজ ছিল কবিতা লিখে ঘুমিয়ে পড়া, লীলাবতী নাকি সেই কবিতা নিয়ে যেতেন নিজের কাছে, আর নিজের কবিতা রেখে যেতেন কবির শিয়রে। যতদিন তিনি সেখানে ছিলেন, তাঁদের এমন কবিতা বিনিময় হত। লীলাবতীর কবিতা কবির নামে ছাপা হতে লাগল, কবির কবিতা লীলাবতীর নামে। তারপরও বহুদিন , সেই জরুরি অবস্থা, লালবাজার, কেটে যাওয়ার পর কবি বলতেন লীলাবতী তাকে কবিতা দেয়। লীলাবতী আর তার কবিতা নেয় না। আসলে লীলাবতীও বিদেশ চলে গিয়েছিল তার ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে। লীলাবতী আর কবিতা লেখে না সেই বিদেশ-বিভূঁয়ে থেকে। কবি বলেন, না লীলাবতী তাকে এখনো কবিতা দেয়। তাঁর কবিতা লীলাবতীর কবিতা। এই নিয়ে প্রশ্ন চলে না। কবি যা বলবেন, তাইই সত্য। কবির মানসভূমিতে রাম জন্মেছিলেন যেমন, মহাকাব্যও জন্মেছিল। কবি লীলাবতী নয়, নিজেকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন,
রিম রিম রিম কবি তোমার সে রয়েছে দূরে,
সমুদ্দুরে পাহাড়ে বনের ভিতর খেতের ভিতর
পেয়ারা ফুলের গন্ধ ভুরভুরে।
কবি আমি তোমার পরশ শ শ শ শ…
শ শ শ শ শ
শ শ শ শ শ
কবি বলেছিলেন, লীলাবতী তাঁকে নিয়ে লিখেছে, লীলাবতীর নামে ছাপা হোক।
কবির নামেই ছাপা হয়েছিল লীলাবতী কথা।
লীলাবতীর কবিতা ছিল সব পাখির কবিতা। গাছের কবিতা। প্রজাপতির কবিতা। মাটির কবিতা। হাওয়ার কবিতা। মেঘের কবিতা। বৃষ্টির কবিতা। রোদের কবিতা। নিচু আকাশ দিয়ে মেঘ উড়ে যেতে থাকলে ছায়া যখন ছুটে যেত, কৃষ্ণকান্ত কবি, সেই ছায়ার সঙ্গে ছুটে যেতেন, এই দাঁড়া এই দাঁড়া করতে করতে।
আপনি ছুটে যেতেন ?
আমি নই, আমার ঠাকুরদা পূর্ণচন্দ্র কবি।
তিনি কবি ছিলেন ?
ছিলেন, জমিতে লাঙল ঠেলে চাষবাস দেখে দুপুরে ফিরে এক পেট ভাত খেয়ে ঘুম, বিকেলে উঠনে বসে কবিতা লিখতেন মনে মনে, আবার ধান উঠলে সন্ধ্যেয় তিনি ধানের গন্ধ কবিতায় মাখিয়ে দিতেন, সেই কবিতাই আসল কবিতা, কবি পূর্ণচন্দ্র কবির কবিতা।
কিন্তু কবি, রিম কে ? সেলিম জিজ্ঞেস করেছিল।
কবি হেসে বলেছিলেন, ২৪ দিস্তেয় এক রিম, কাগজ ছাড়া কবিতা রাখব কোথায়, আমার ঠাকুরদা পূর্ণ কবি কোনো কবিতাই রেখে যেতে পারেনি, সেই যে সন্ধেবেলায় বাবুদের বাগানে হাজার রকম কবিতা ছড়িয়ে যেতে থাকে, পূর্ণ কবি সেই বাগান থেকে কত কবিতা পেয়েছে, আসলে মানুষের কিছুই নেই, যা কিছু আছে তা পাখিদের, পাখিরাই কবিতা লেখে, সেই কবিতাকে কোরাসে গায়। এই ধর, আমি তো লিখি না, পূর্ণ কবি আমাকে দিয়ে লেখায়, শ শ শ শ… আমি কোথায় পেলাম বা লীলাবতী কোথায় পেল, পাখির কাছ থেকে পেল, জ্যোৎস্না রাতে লক্ষ্মী পেঁচার ডাক শুনে পূর্ণচন্দ্র কবি মনের ভিতরে তা লিখে রেখেছিল, তা থেকে আমি পেলাম, আমার থেকে লীলাবতী, লীলাবতী তা আবার আমাকে ফিরিয়ে দিল, জ্যোৎস্না রঙের লক্ষ্মী পেঁচার ডাক অমনি, যে কান দিয়ে শুনেছে সে জানবে, শ।
পূর্ণ কবি শেষ রাতে উঠতেন পাখিদেরও আগে, পাখিরা কখন কবিতার গান শুরু করবে, তিনিও তাদের সঙ্গে গলা মেলাবেন, ভোরে প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু হত এই ভাবে।
কবি এক এক জ্যোৎস্না রাতে বেরিয়ে পড়েন চাঁদের আলো সেবন করবেন বলে। তাঁর মনে হয় চাঁদের আলোয় যদি কবিতা লেখা যায় সে কবিতা অমরত্ব পায়। তিনি লিখতে পারেননি। লীলাবতীর ছায়ায় ঢেকে যায় কবিতার খাতা। লীলাবতী চায় না কিছু, শুধু দিয়ে যায়, কবি দিতে পারেন না, লীলাবতী কবিকে দেন।
এক জ্যোৎস্না রাতে কবি একা একা বেরিয়ে পড়েন তাম্রলিপ্ত বন্দরের উদ্দেশে। বর্গভীমা মন্দির, বন্দরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন সেলিমের বাড়ি, গিয়ে তার জানালার ধারে গিয়ে কুব কুব কুব ডাকতে লাগলেন। যেন চাঁদের আলোকে দিনের আলো ভেবে কুবো পাখি ডাকছিল তার সঙ্গীকে। সেলিমের ঘুম ভেঙে যায় সেই ডাকে। দ্যাখে জানালার বাইরে কবি। মধ্যরাত। নিঃঝুম মহাপৃথিবী। সেলিম বাইরে গিয়ে কবির হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসে। তুমি কিছু খাবে দাদা ?
জ্যোৎস্না পান করলে আর কিছু লাগে না সেলিম, জল দাও।
ঢোক ঢোক করে জল খেয়ে শান্ত হলো কবি। বলল, চাঁদের আলো পান করলে তেষ্টা পায়, সবই তো সূর্যের
আলো, যেমন সব কবিতাই পাখিদের, লীলাবতীর।
লীলাবতী কি পাখি ? সেলিম জিজ্ঞেস করল।
হুঁ, মনে হয় তা, মনে নেই সব, ভুলে যাচ্ছি, লীলাবতী হয়ত পাখি, হয়ত নয়।
কী বলেন কবি তা তিনিই জানেন। সেলিমের পাশে শুয়ে পড়লেন কবি। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ভিতরে পাখির ডাক ডাকতে লাগলেন। মুখ দিয়ে যেসব আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল, তা পাখিদেরই হতে পারে। সেলিমের ঘুম বারে বারে ভেঙে যায়। সে উঠে উঠে দ্যাখে কবি ঠিক আছে্ন কি না। ভোরে ঘুম ভেঙেছে কবির। তখন সেলিমকে ডেকে লীলাবতীর দেওয়া কবিতা শোনাতে লাগলেন। আসলে তা নানা রকম পাখির ডাক। শব্দ। শব্দই কবিতা। সেলিম মুগ্ধ হয়ে শুনল। মনে হচ্ছিল চাঁদের আলোর স্রোত বয়ে গেল একবার, একবার দ্বিপ্রহরের রোদ ঝনঝন করতে লাগল। কখনো পাখির কাকলিতে ভরে উঠল ঘর। কবির ভিতরেই অনেক পাখির ডাক ছিল। তারপর বাড়ির সকলে উঠতে তিনি জনে জনে পরিচয় করলেন, বললেন, সেলিম তাঁর চাষের পার্টনার, তাঁরা দুজনে মিলে গুড়গুড়ি দ্বীপে কবিতা এবং লঙ্কার চাষ করেন, আঙুরের চাষ করেন, লঙ্কায় খুব ঝাল, এত ঝাল যে বেচাই যায় না, আঙুর ফ্রি দিতে হয় তখন, কিন্তু গুড়গুড়ি পাখিরা আঙুর ভালোবাসে, তাই সব ঝাল লঙ্কা আকাশে ছুঁড়ে দিতে হয় অন্ধকার রাতে, তাই আকাশের তারাদের অত ঝাঁজ।
কাকা বললেন, তরমুজ চাষ করতে পারলে ভালো হত।
কবি বললেন, আপনাকে দুশো বিঘে দিচ্ছি, চাষ করুন গুড়গুড়ি দ্বীপে, কিন্তু দ্বীপটা ভেসে বেড়ায়, ধরা কঠিন, ধরুন তরমুজ সমেত চলে গেল পর্তুগালে, তখন সেখানে বেচতে হবে, কিন্তু পর্তুগালের টাকা এদিকে চলে না, জলে যাবে সব, তার চেয়ে লঙ্কা ভালো।
কাকা বললেন, দ্বীপটা বেচে দিন নাহলে হারিয়ে যাবে এক দিন।
দ্বীপ আমার ঠাকুরদা পূর্ণচন্দ্র কবির, আমি বেচে দিলে আমার পাপ হবে, আমার অসুখ হবে। কবি আরো বললেন, দ্বীপ হলো পারিবারিক সম্পত্তি, বেচা যাবে না, পর্চা খতেন সব জলে ভেসে গেল সেবার, ঠাকুরদা বলল, যাক ভেসে যাক, তাহলে কাগজ দেখিয়ে কেউ জমি বেচতে পারবে না। মাটি মানে দেশের মাটি। সেই মাটি বেচা পাপ। পুরোন গাছ বেচা পাপ। লোকে নিজের গাঁ গঞ্জে থেকে চাষবাস, দোকানদানি করুক, বাইরে গেলে হারিয়ে যাবে।
কবির খুব ভালো লেগেছিল সেলিমের বাড়ি। বলেছিলেন, তিনি সন্ধ্যার সময় তাঁর বাড়ির উঠনে তুলসিতলায় প্রদীপ দেবেন, মগরিবের নমাজের আজানের সময়, মিলিয়ে, তাঁরাও যেন সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়ার সময় আজান দেন, আজানের ডাক তাঁর কাছে শঙ্খধ্বনি মনে হয়, তাঁরাও যেন শঙ্খধ্বনিকে আজান দেওয়া মনে করেন। চলে আসার সময় কবি বলেছিলেন, গরু বাছুরের যত্ন নিতে, চাষবাসে মন দিতে, বোশেখ মাসে গাছের গোড়ায় জল দিতে, তাহলেই কবিতা লেখা হবে। লীলাবতী কবিতা দেবে, বিনিময়ে কিছুই নেবে না।
লালবাজার কবির কবিতার খাতা নিয়ে নিয়েছিল। তার ভিতরে লীলাবতীর দেওয়া কবিতা ছিল। জীবনে একটাই আফশোস, কবিতার খাতাটি খোয়া গেল। অভিজিৎ বলেছিল, খোঁজ নেবে। খোঁজ পায়নি। সেলিম গিয়েছিল পুলিশ কমিশনারের কাছে। তাঁদের গো ডাউন খোঁজা হয়েছিল, পাওয়া যায়নি। সে তো ৪৫ বছর আগের কথা। কিন্তু কমিশনার বললেন, খুবই অন্যায় হয়েছিল, তাঁরা কবির কাছে গিয়ে মার্জনা চেয়ে আসবেন।
সমস্তটা শুনে কবি বললেন, পুলিশে তাঁর খুব ভয় করে, আমেরিকায় কী হয়েছে, একটা লোকের গলা টিপে বুকের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সব গুড়গুড়ি পাখিকে মেরে দিয়েছে, পাখিরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল, ইণ্ডিয়ায় এক কবিকে কতদিন ধরে আটক করে রাখা হয়েছে জেলখানায়।
সেলিম বলল, যদি পুলিশ কমিশনার ক্ষমা চাইতে আসেন ?
আমি বলব জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে কবিকে, তাঁর মুক্তি চাই… বলতে বলতে কবি মুখ দিয়ে অবোধ্য সব আওয়াজ করতে লাগলেন। সেলিম এসেছিল জেলবন্দি কবি, লেখক, সমাজ কর্মীর মুক্তির জন্য একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে। কবি বললেন, মানুষের ভাষা অকেজো হয়ে গেছে সেলিম, মানুষের ভাষায় কবিতা হবে না, মুক্তিও হবে না, পাখির ভাষা চাই…, এরপর তিনি সন্ধ্যার সময়, আজানের সময়, শঙ্খধ্বনির সময় পাখির ভাষায় তাঁর প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। রাত পাখিরা কবির ভাষা নিয়ে উড়ে গেল দেশ-দেশান্তরে, ছড়িয়ে দিতে লাগল একটাই কথা, মুক্তি চাই, কবিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নাহলে আমাদের ভাষায় কথা বলবে কে ?
13 মন্তব্যসমূহ
অপূর্ব। মনুষ্য ভাষার অতীত এ-ই যে কবির ভাষা যাকে টিকিয়ে রাখতে চায় পাখি ও প্রকৃতি, তা আমাকে ভারভারা রাওয়ের কথা মনে পড়িয়ে দিল !
উত্তরমুছুনভারভারা রাওকে মনে রেখেই লেখা। আজকাল শারদীয়তে তিনি সরাসরি আছেন পরে মনে হল সার্বিক করে তুলতে এবং ইঙ্গিতবাহী করতে নামটি বাদ রাখি। দেখি পাঠক আন্দাজ করতে পারেন কি না। আপনি ঠিক ধরেছেন। আমার সংশয় মিটে গেল। সার্থক মনে হলো লেখা।
মুছুনধন্যবাদ অমরদা। সার্থক পাঠক যেন হতে পারি।
মুছুনমুক্তির ভাষা...পাখির ভাষা।.. কল্পনা না করতে পারলে, কবিতায় না পৌঁছালে আমাদের মুক্তি নেই... সময়ের বন্ধ গড়ে বসে এ লেখা পাখির ভাষা শিখতে আকুল করে...। বড়ো শক্ত কথা কী মায়াময় করে বলা, শেষে পৌঁছে তাই কবির কাছে পৌঁছানোর আর্তি বুকে বাজে। গল্পটি আমাদের সমবেত প্রার্থনার কথা বলে দেয় যেন। আপনি বলে দেন আসলে। আমার শ্রদ্ধা নেবেন।
উত্তরমুছুনহৃদয়গ্রাহী লেখা। লেখক কবি ভারভারা রাও কে স্মরণে
উত্তরমুছুনরেখে লিখলেও লেখনী কখন অজান্তে তার নিজের ও আমাদের সকল সৃজনশীল মানুষদের মর্মকথা লিখে ফেলেছে। যে কোন প্রকারে দ্বীপ টাকে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে না হলে বাইরে বাঁচবো অন্তরে মরবো। ধন্যবাদ লেখককে।
হৃদয়গ্রাহী লেখা। লেখক কবি ভারভারা রাও কে স্মরণে
উত্তরমুছুনরেখে লিখলেও লেখনী কখন তার নিজের ও আমাদের সকল সৃজনশীল মানুষদের মর্মকথা লিখে ফেলেছে। যে কোন প্রকারে দ্বীপ টাকে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে না হলে বাইরে বাঁচবো অন্তরে মরবো। ধন্যবাদ লেখককে।
কী অসম্ভব সুন্দর ভাষা! মুগ্ধ হতে হতে পড়তে হয়; পড়ে মুগ্ধ হতে হয়।
উত্তরমুছুনকী অসম্ভব সুন্দর ভাষা! মুগ্ধ হতে হতে পড়তে হয়; পড়ে মুগ্ধ হতে হয়।
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হয়ে পড়লাম...পড়তে পড়তে পাখি হয়ে গিয়েছিলাম...চেতনা শাণিত হয়ে উঠল দাদা
উত্তরমুছুনপড়তে পড়তে কোনো এক অজানা দেশে হারিয়ে গেলাম....
উত্তরমুছুন"মানুষের ভাষা অকেজো হয়ে গেছে সেলিম, মানুষের ভাষায় কবিতা হবেনা, মুক্তিও হবেনা, পাখির ভাষা চাই"
উত্তরমুছুনমেঘ-হরিণ, আছে-নাই ভাসমান গুড়গুড়ি দ্বীপ, লীলাবতীর পাখি, প্রজাপতি, গাছ, মাটি, মেঘ ও হাওয়ার কবিতা, লাঙল ঠেলা সব কবির চেয়েও মহান কবি পূর্ণচন্দ্র ইত্যাদির কত বাঁক, কত মেটাফোরের ল্যাবিরিন্থ ঘুরিয়ে দক্ষ যাদুকরের মত লেখক উচ্চারণ করেছেন এই শক্তিশালী কথাগুলো। প্রতিবাদের এক অনবদ্য স্টাইল উন্মোচিত হয়েছে এই গল্পে। ভাষাহীন।
কিছু তার দেখি আভাস কিছু পাই অনুমানে । ভাববিমুগ্ধ
উত্তরমুছুনকী সুন্দর!
উত্তরমুছুন