পুরুষোত্তম সিংহ
আমাদের সময়টা নষ্ট হয়ে গেছে। অতীতে কি ভালো ছিল? হয়ত ছিল। নইলে রামেশ্বর ভট্টাচার্য লিখলেন কেন—‘ভব-ভাব্য-ভদ্র-কাব্য ভণে রামেশ্বর’ । মধ্যযুগ ছিল ধর্মাচ্ছন্ন। মানুষ সভ্য হতে ধর্মের মোহ কেটে গেল। বিজ্ঞান এসে ধর্মকে দূরে সরিয়ে দিল। কিন্তু অতি সভ্য হতে ( প্রকৃতপক্ষে বর্বর) আবার ধর্মের মোহে আকৃষ্ট হল। বিশেষ করে বাঙালি। একুশ শতকের বাঙালি। দেশভাগ হল। যেকারণেই হোক না কেন সুপ্ত কারণটা কিন্তু ভুলে থাকতে পারতো! ইতিহাস বিস্মিত জাতি হিসেবে পরিচিত বাঙালি এক্ষেত্রে ইতিহাসটা মনে রাখলো। মনে রাখার প্রয়োজন হল। কেননা মুনাফা আছে। সেই মুনাফার সন্ধান মানুষ দেশভাগের সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে করে যাচ্ছে। এযেন—অল্পতে খুশি না হওয়া দামোদর শেঠ (রবি ঠাকুর)। নইলে NRC করতে গেল কেন? NRC যে দেশভাগের ফলশ্রুতি তা স্পষ্ট করেছেন মধুময় পাল ‘মনসার গান অথবা অনুপ্রবেশ’ আখ্যানে। সচেতন পাঠক ইচ্ছা হলে পড়ে নিতে পারেন। এক পচা ঘুণধরা সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে দেশভাগ পরবর্তী সময়ের বাঙালি। বিশেষ করে ওপার বাংলার হিন্দু বাঙালি। ওপার বাংলার হিন্দু বাঙালির কথাই বিশেষ করে বলব, কেননা আমরা যে লেখায় প্রবেশ করব সেখানে হিন্দু বাঙালির নাকানি-চোবানি অবস্থা অক্ষরে অক্ষরে স্পষ্ট হয়েছে। লেখিকা স্পষ্ট করতে বাধ্য হয়েছেন। কেননা সময়ের কাছে একজন প্রকৃত কথাকারের সেটাই দায়।
লেখিকা স্মৃতি ভদ্র (লেখক বললেও ক্ষতি ছিল না, সবক্ষেত্রে লিঙ্গ বিভাজন বাঙালির এক বিশেষ দোষ, ভদ্র বাঙালি এটা ভালো করে বোঝে ও পারে)। পদবি ভদ্র হলেও নজর অভদ্র জীবনের প্রতি। সময়কে যেমন ছোট সময়, বড় সময় হিসেবে ভাগ করা যায় তেমনি আমরা সময়কে দুটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছি—ভদ্র সময় আর অভদ্র সময়। ভদ্র জীবনের আখ্যান তারা লিখবেন যারা সুখে আছেন। বাস্তব জীবন, জীবনের জটিলতা, রাজনীতির ভণ্ডামি, শাসকের অপদার্থতা, রাষ্ট্রীয় শোষণ দেখতে পান না তিনি তো ভদ্র জীবনের গপ্প লিখবেন, প্রেমের কেচ্ছা কাহিনি ফাঁদবেন, যৌননতার সুরসুরি দেবেন, নায়ক-নায়িকার আবেগ সর্বস্ব রোমান্টিক প্রেমে ভেসে যাবেন। মুখে কদাচিৎ বললেন—রাজনীতি বিশেষ পছন্দ করি না। রাজনীতির মধ্যে যে বিরাট সময়, ধাপ্পাবাজির দখলদারি লুকিয়ে আছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু সময় সচেতন লেখককে তো অভদ্র জীবনের আখ্যান লিখতেই হবে। নিজের জন্মভূমির বীভৎস অবক্ষয়িত রূপ দেখে কীভাবে চুপ করে থাকবেন সময় সচেতন লেখক? সচেতন ভাবেই স্মৃতি ভদ্রের আখ্যানে ভয়ংকর সময় উঁকি দেয়। ‘পার্পল জলফড়িং’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লেখেন—“ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়া সময় বা অনাগত অপার সম্ভাবনাময় সময়—যার পরতে পরতে জমে থাকা মুহূর্তগুলোই গল্প হয়ে উঠেছে।“ প্রবাহিত সময়কেই (অভদ্র সময়) তিনি আখ্যানে যে রূপদান করতে চান গল্পপাঠে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সে কাজটি লেখিকা নিজেই করে রেখেছেন গ্রন্থের ভূমিকা অংশ—
“অনেক রকমের দিন ভিড় করে এখানে। ধুলো ওড়ানো শূন্য দিন, গতি হারানো মন্থর দিন, আকাশ ফুরোনো মিথ্যে দিন কিংবা ছায়া হারানো নির্লিপ্ত দিন। সেসব দিন বুকের ভিতর অবিরত পুড়িয়ে চলে সুগন্ধি ধূপ। খাগের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে সময় বসে রচনায়, মহাকাল রচনায়। তানপুরার তারে ওঠে আশাবরির সুর। সে সুর ওক, বার্চের শুকনো ডালে জীবনের চরকি কাটে। সে সুর থেকেই আমি বুনে চলি জীবনের গল্প। বুনে চলি সময়ের গল্প। জীবন আর সময়ের সেরকমই নয়টি গল্পের সংকলন এই বই।
অদ্ভুত এক সময়ে আমাদের বাস। যে-সময় ভুলিয়ে দিতে চায় মানুষের স্মৃতি, সীমাবদ্ধ করে দিতে চায় ইতিহাস, গণ্ডিবদ্ধ করে দেয় মানবিক অধিকারবোধের জায়গাগুলো। নির্ধারিত কিছু স্মৃতি আর ইতিহাসের অ্যাকুরিয়ামে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে মানুষ ক্রমশ। এমন এক অদ্ভুত সময়ের কোলে বসেই সৃষ্টি হয়েছে এই বইয়ের গল্পগুলো। সময়ের পরতে জমে থাকা মুহূর্তগুলোই গল্প হয়ে উঠেছে এই বইয়ের।“ (ভূমিকা, পার্পল জলফড়িং, পৃ. ৭)
‘পরি ও একজন মালতি দি’ অদ্ভুত গল্প। প্রথমেই তিনি জানিয়েছেন যে সময়ের গল্প লিখতে চান বা লিখতে বসেছেন। কিন্তু গল্পের তো একটা শরীর বা অবয়ব গড়া চাই। ফলে গল্পে পরি নামিয়ে আনতে হয়। বাস্তব ভূমি থেকে দূরে যেতে হয়। এক ফ্যান্টাসির জগতে বিচারণ করেন। কিন্তু গল্পের পরতে জড়িয়ে থাকে ঘটমান বাস্তব। মুক্তিযুদ্ধের অত্যাচার। পাক সেনার হাতে যতীন কাকার মৃত্যু। মালতি দি’র অস্থিরতা। গল্পবলয়ে আছে মমিন সাহেব ও কল্পনার কথা। মমিন সাহেব পরি দেখেন। পরি দেখতে দেখতেই তিনি যেমন মুগ্ধ হন তেমনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির রহস্য নিকেতনের ওপর। এজন্য লেখিকাকে এক আশ্চর্য জাদুময় ভাষা আয়ত্ত করতে হয়েছে। নবীন শিক্ষিক মমিন সাহেব ছাত্রী মালতির রূপে মুগ্ধ হয়েছিল। বধূ করেও নিয়ে আসা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সব এলোমেলো হয় যায়। হারিয়ে যায় মালতি। মমিন সাহেবও পাগল হয়ে যান। গল্পের বয়ানে পাই—
“শরীরের রুগ্নতায় এখন বিরক্তি অনেক কম হয় মমিন সাহেবের। পরি এসে তার সব মলিনতা সারিয়ে দিয়েছে। মমিন সাহেবের শরীরের এই দুর্যোগের সঙ্গে দেশের দুর্যোগের এক অদ্ভুত মিল আছে। সেই দুর্যোগের বছরেই মমিন সাহেবের প্রথম হাঁপানির টান ওঠে।“ ( পরি ও একজন মালতি দি, পার্পল জলফড়িং, পৃ. ১৯)
এরপর থেকেই মমিন সাহেব শুধু পরি খুঁজে চলেন বা পরি এসে ধরা দেয়। রাতের অন্ধকারে তিনি অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে বিরাজ করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গল্প প্রেমেরও। প্রেমিকাকে ভুলতে পারেননি অবসরপ্রাপ্ত মমিন সাহেব। কীভাবেই বা ভুলবেন প্রথম প্রেমকে? মানুষ কি প্রথম প্রেম ভুলতে পারে? উত্তর হয়ত না! কিন্তু স্মৃতিতে তো ধুলো জমা হয়। মানুষ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। তবে কিছু কিছু স্মৃতি ধুলো মুছে দিয়েও জীবন্ত হতে চায় বা হয়ে ওঠে। মমিন সাহেবের কাছে মালতি পরি হয়েই ফিরে আসে। গোটা গল্প জুড়েই ফ্যান্টাসির প্রাধান্য। লেখিকা অনবদ্য মুন্সিয়ানায় গল্পের ক্যানভাস গড়ে তুলেছেন। দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে ‘গোঁসাইবাড়ির বীথিলতা’ গল্পটি। লেখিকা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেশভাগ ও নোয়াখালি দাঙ্গার অত্যাচারের সত্য গল্প শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। গল্প পড়তে পড়তে পাঠক প্রকৃত সত্য আবিষ্কার করেছে। বলা ভালো লেখিকা পাঠককে গল্প পড়াতে পড়াতে নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। পরাগ পিসি ঠাকুমার বাক্সে একটি চিঠি পেয়েছিল। এই চিঠির সূত্র ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে নোয়াখালির দাঙ্গায় মুসলিমের অত্যাচার, ধর্ষণ ও নারী লুঠের প্রসঙ্গ। পরাগ চব্বিশ পরগনার ছেলে। দেশভগে দুই দেশের মধ্যে প্রাচীর উঠে গেছে। তবুও চিঠিকে সামনে রেখে সে সত্য আবিষ্কারে এগিয়ে গেছে। গোটা গল্প জুড়েই রয়েছে ছমছমে পরিবেশ, বাক্যের আপাত কৌতূহল। হিন্দু বিধাবা বীথিলতা ১০ অক্টোবর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে (পাঠক ইতিহাস মনে রেখে পড়বেন) লুট হয়। তবে ধর্ষিত হয়নি। বীথিলতার অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে হার মানে যুবকের ক্রোধ। বীথিলতাকে বিবাহ করতে চায় মুসলিম যুবকটি, এমনকি করেও। হিন্দু বিধবার জাতি রূপান্তর ঘটে। কিন্তু নিয়তি বিরূপ। দুই দিনের কলেরায় মৃত হয় নতুন বধূ। এই গল্পে দাঙ্গার অত্যাচারের প্রসঙ্গ আছে ঠিকই তেমনি আছে মানবিক বোধের জাগরণ। তালেব আলী ফিরিয়ে দিয়েছে লক্ষ্মীমূর্তি তেমনি কাশেম ফৌজের যুবকটি ধর্ষণ করেনি বীথিলতাকে। প্রবৃত্তি সর্বস্ব মানুষের নানা সত্তা। তেমনি ক্রোধের উত্তেজনায় মানুষ কখন কী করে নিজেই জানে না। পরে অনুতাপ প্রকাশ করে। তেমনি এই গল্পে রয়েছে দুটি দিক। অত্যাচারের নির্মমতা ও মানবিক বোধ। মানবিক বোধ অপেক্ষা হয়ত অত্যাচারের সত্যই বড় হয়ে উঠেছে। আসলে একটি সত্য তো অপর সত্যকে সর্বক্ষণ চাপা দিতে চায়। কণ্ঠরোধ করতে চায়। তবে কণ্ঠরোধ করতে চাইলেও তো আর সর্বদা সব কিছু চাপা পড়ে থাকে না। প্রকাশ পেয়ে যায় কিছু সত্য। উঠে আসে বীথিলতাদের নির্মম ইতিহাস।
জয়-পরাজয়ের জুয়া খেলায় বন্দি জীবন। জীবনে জয়ের আনন্দ যেমন আছে তেমনি আছে পরাজয়ের গ্লানি। মধ্যবিত্ত বাঙালি জয়ে যতটা আনন্দিত হয়, পরাজয়ের বেদনা ততাধিক বেশি বহন করে। তেমনি আছে অহংকার, আসুয়াবোধ ও আত্মঅহমিকা। অপরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার এক সচেতন প্রয়াস। এক ঈর্ষাবোধই একশ্রেণির মানুষকে চিরকাল বেদনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বনানী ইসলামকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘পরাজয়’ গল্পটি। সংগীতে পারদর্শী বনানী নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতো। যখনই কেউ তাঁর থেকে এগিয়ে গেছে সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে, পরাজয়ের বেদনা গ্রাস করেছে। মনের কোনে জমা হয়েছে এক ঈর্ষাবোধ। তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন কোন কাজে এগিয়ে যায় তখন পিছিয়ে থাকে মানুষগুলিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। বনানীও করেছে। নিম্নমধ্যবিত্তের জামিলকে কোন পাত্তা দেয়নি। নিয়তির এমনই পরিহাস জামিল বিবাহ করেছে বনানীর থেকে সেরা সংগীত শিল্পীকে, এমনকি জামিলের কন্যা মিথিলা চৌধুরী ছাড়িয়ে গেছে বনানীকে। বনানীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে লেখিকা এই গল্পে জোর দিয়েছেন। বনানী আত্মঅহংকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। এই শ্রেণি অপরের ভালো বিশেষ সহ্য করতে পারে না। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার আছিলায় নিজেই চোরাবালিতে ডুব দেয়। হারিয়ে যায় জীবন থেকে। সময় যত এগিয়ে গেছে জীবন তত জটিল হয়ে পড়েছে। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নানা বাঁক, চোরাবালি, হিংস্রতা, শয়তানি ও ঈর্ষাবোধ। সে জটিল জীবন ফুটিয়ে তুলতেই লেখিকা বদ্ধপরিকর হয়েছেন।
এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সেই সম্প্রীতি কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে গেল। বেরিয়ে পড়ল হিংস্র রূপ। গভীর আক্ষেপ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থ। প্রথমেই শুরু হয় হিন্দু তোষণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘু তোষণ চলে কমবেশি। তবে বাংলাদেশে যেন মাত্রাধিক। তারপরই শুরু হয় মুক্তচিন্তার মানুষদের ধ্বংস করার পালা। সে হিন্দু হোক বা মুসলিম। বাংলাদেশ ক্রমেই মৌলবাদীদের দেশে পরিণত হয়ে চলেছে। বিধর্মীর প্রতি ক্রমাগত হিংসা দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে। নইলে স্মৃতি ভদ্ররা ‘এবং অপেক্ষা’ গল্প লিখত না। লেখার মালমশলা পেত না। বাংলাদেশ তা নিজেই জোগান দিয়েছে। বাংলাদেশের ভয়ংকর পরিবেশ এইসব গল্প লিখতে বাধ্য করিয়েছে। সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর কীভাবে অত্যাচার নেমে এসেছিল তা লেখিকা দেখিয়েছেন। শুধু সংখ্যালঘু নয় মৌলবাদ বিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে মুসলিম সালাম তালুকদারকেও। সালাম তালুকদার ও মমিনুন্নেসার একমাত্র সন্তান চন্দন। আগে কালীমন্দিরে কীর্তন হত, ভোটের পর তা বন্ধ হয়ে গেছে। সালাম রাজনীতিতে যুক্ত হলেও সন্তানের জন্মের পর পিছিয়ে এসেছে। বলা ভালো সন্তান স্নেহই তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছে। সালামের বন্ধু গণেশ বসাক। গণেশের মাতা সরজুবালা ও সালামের মাতা গোলনূর বেওয়া দুই সই। এঁদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, ছিল না হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ। মুসলিম অত্যাচারের হাত থেকে গণেশকে বাঁচাতে গিয়ে সালাম প্রাণ দেয়। এমনকি গণেশেরও মৃত্যু ঘটে। সন্তানের মৃত্যুতে সরজুবালা দেশ ত্যাগ করে আর সেই রাতেই মৃত্যু ঘটে গোলনূর বেওয়ার। নিয়তির কী অনন্ত পরিহাস। আসলে সত্তা যখন ছিঁড়ে যায় দোসর থেকে কী করবে। তবুও তো মানুষকে বাঁচতে হবে। নতুন সূর্যের অপেক্ষা করতে হবে। বড় হয়ে ওঠে সন্তান চন্দন। চন্দনের দোসর হিসেবে পিতা লাগিয়েছিল কাঁঠালচাঁপা গাছ। কাঁঠালচাঁপা গাছে ফুল এসেছে চন্দনও যৌবনে প্রবেশ করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে নির্বাচন। চলছে অবৈধভাবে ছিনিয়ে নেওয়ার পালা। মৌলবাদীদের হাতে নিহত হয়েছে হিন্দু ছেলে কনক। পুত্র চন্দন হয়ে উঠেছে পিতা সালামের দোসর। চেতনায় প্রবেশ করেছে প্রতিবাদের বীজ। মাতা জানেন এদেশে প্রতিবাদ করলে পরিণাম কী হতে পারে। সন্তানের খোঁজে তিনি যান বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু পান না। সন্তান কখন ফিরবে এর উত্তরে নানা কথা আসে। কেউ বলে পিসি বাড়ি গেছে, সেখানে গিয়ে শুনতে পান বাড়ি গেছে। বাড়ি ফিরেও দেখেন সন্তান ফেরেনি। এক ব্যথাতুর মন নিয়ে বসে থাকতে হয়। অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। গল্প শেষে চন্দন কোথায় গেল তা আমরা জানি না। দেশের যা পরিস্থিতি সেখানে মৃত্যু ঘটলেও ঘটতে পারে! কিন্তু দোসর কাঁঠালচাঁপা গাছ তো বেঁচে আছে। তাই আমরা ধরে নেব চন্দন বেঁচে আছে। গল্প শুরু হয়েছিল শুক-সারির গানের প্রসঙ্গ দিয়ে। গোটা গল্প জুড়েই যেন গানের রেশটা থেকে গেছে। ঘটনার পর ঘটনা বুনে লেখিকা বাংলাদেশের অবস্থা পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেছেন। বলা ভালো গল্পটি দুটি প্রজন্মের গল্প—পিতা সালাম তালুকদার, পুত্র চন্দন তালুকদার। এই প্রজন্মের মধ্যে বন্ধনসূত্রটি গড়ে দিয়েছে কাঁঠালচাঁপা গাছ। তবে দুই প্রজন্মের ব্যবধানেও বাংলাদেশের অবস্থা পাল্টায়নি। বরং ক্রম অবনতি ঘটেছে। হত্যাকাণ্ড মন্দির থেকে পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঠক বোধহয় বাংলাদেশের অবস্থা অনুমান করতে পেরেছেন! এখানেই লেখিকার জয়।
‘শূন্য সময়’ গল্পের প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ পরবর্তী সময়। কীভাবে বাংলাদেশের চিত্র পাল্টে যাচ্ছিল তা লেখিকা এই গল্পে স্পষ্ট করেছেন। সময় যত এগিয়ে যায় মানুষ তত মুক্তচিন্তার খোঁজে অগ্রসর হয়। হয়েও ছিল তাই। কিন্তু বাধ সাধল। রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হয়েও তমাল রেনুরা মুক্তচিন্তার স্বপ্ন দেখেছিল। নতুন সময়, নতুন সমাজের কথা মনে মনে ভেবেছিল। কিন্তু রক্ষণশীল সময় পরিবেশ বাধ সাধল। পরাজিত হল মুক্ত চিন্তা। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হলেও মুসলিম তমাল, হিন্দু রেনুর মুক্তচিন্তায় কোন বাধা আসেনি। আসলে বাংলাদেশের জনজীবন এমনই ছিল। হিন্দু-মুসলিম পৃথক ধর্মের মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবেনি। ধর্মীয় সত্তা অপেক্ষা বাঙালি সত্তাই বড় ছিল। ৪৭ সালের পরেও এই সত্তা বেঁচেছিল। কিন্তু কিছু ধর্মীয় মানুষ বিভেদের বীজ বুনে দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। শান্ত, স্বাভাবিক বাগাতিপাড়ায় ধর্মের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। আব্বা পুত্র তমালকে বাঁচাতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়, রেনুরাও দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মানবিকবোধ, প্রীতি, স্নেহ, ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। একটি দেশ কীভাবে ধর্মীয় অন্ধকারে ডুবে গেল, মানবিকবোধগুলি কীভাবে ছিন্ন হয়ে গেল, সম্পর্কের বন্ধনজাল কীভাবে আলগা হয়ে গেল তা লেখিকা দেখাতে চেয়েছেন। মুক্তচিন্তার মানুষকেই মৌলবীশ্রেণি বড় টার্গেট করেছে। সার্ত্র, মার্ক্স পড়া তমালরা নতুন সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি—
“ওদের কাছে ধর্ম আর সমাজ ছিল ব্যবধানহীন। মুক্ত পাখির প্রশস্ত দুডানায় ভর করে উড়ে যাওয়ায় মুগ্ধ চোখ রেখে রেনু আর তমাল লোভ দেখতো এক নতুন সমাজের, এক নতুন পরিবারের।
‘আমাদের পরিবারে উৎসব লেগেই থাকবে। ঈদের সেমাই শেষ হতেই পুজোর নাড়ুতে বয়াম ভরেব’। তমালের একথায় আলো খেলে যেতো রেনুর চোখে।“ (শূন্য সময়, তদেব, পৃ. ৬৮)
স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই অভেদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নতুন সূর্য ওঠেনি। প্রতিরোধ গড়ে তুললে হয়ত তমালকে প্রাণ দিতে হত। রক্ষণশীল পরিবার তা বুঝতে পেরেছিল। হিন্দুরাও সেদেশকে আর নিজের দেশ ভাবতে পারল না। বলা ভালো ভাবতে দেওয়া হল না। মৌলবাদীরা নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করতে চাইল। এমনকি প্রতিষ্ঠা পেয়েও গেল। রাষ্ট্র কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করল না। হিন্দুরাও দেশত্যাগ করল। রেনুর মার্ক্স, সার্ত্র পড়া কোন কাজে এল না। শেকড়চ্যুত হতেই হল। ছিন্ন হয়ে গেল সৌভ্রাত্বের বন্ধনজাল। বদলে গেল সংস্কৃতি। রেনুদের তুলসী মঞ্চে আজ মুরগি ডাকে। লেখিকা বাংলাদেশের সামজিক পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের সামাজিক পরিমণ্ডল ও সময় কাঠামো কীভাবে বদলে গেল তা উপলব্ধি করেছেন। সেই পরিবর্তিত সময়কে বুননের জন্য তাঁকে কাহিনির অবতারণা করতে হয়। ফলে কাহিনি অপেক্ষা সময় সরণি বড় হয়ে ওঠে। গল্পের মধ্যে একাধিক বার সময়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পাঠকের কাছে তা আরও স্পষ্ট করে তোলেন।
‘আবর্ত’ গল্পের মমিন আমাদের নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে সেই রয়েছে। যদি প্রশ্ন ওঠে কিসের আবর্ত? ভালোবাসার আবর্ত। সময়ের আবর্ত। সময় সরণি ধরে ভালোবাসা এগিয়ে গেছে। নুরীকে নিজের থেকে ছিন্ন ভেবে চেয়ারম্যান সহ নুরীকেও খুন করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু নুরীর স্নেহমাখা কণ্ঠ ভেসে আসতেই সব ভুলেছে। গল্পের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের গ্রামজীবন। জনজীবনের স্নেহমাখা উত্তাপ, অনুভূতি মিশে আছে এই গল্পে। নুরী এবাড়ি এসে জঙ্গল পরিষ্কার করে দোআঁশ মাটিতে সবজি চাষ করেছিল। আসলে সে ভালোবাসার চাষ করেছিল। বেকার মমিন জড়িয়ে পড়ে ভোটের রাজনীতিতে। সাইফুল মোল্লার সাইকেল পার্টির হয়ে টাকার বিনিময়ে ভোটের প্রচারে অংশ নেয়। সাইফুল মোল্লার গোডাইনে আগুন ধরাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। সাইফুল মোল্লাই পুলিশে ধরিয়ে দেয় ও ছাড়িয়ে আনে। জেলে থাকার ফলে মমিনের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। নুরী মমিনকে বারবার বাধা দিয়েছিল ভোটের প্রচারে যেতে। মমিনের ইচ্ছা ছিল ভোট প্রচারের টাকা পেয়ে তাঁত চালানোর যন্ত্র বসাবে। জেলে থাকতে চেয়ারম্যানই নুরীর উঠোনে তাঁত বসিয়ে দেয়। জেল থেকে এসে এই দৃশ্য দেখতেই মমিন আরও পাগল হয়ে যায়। ভবে নুরী বোধহয় দূরে চলে যাচ্ছে। মমিনের পাগলামি একমাত্র নুরীর কথাতেই থেমে যেত। ভালোবাসার এক নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছিল নুরীর প্রতি। মমিন আজ ক্রমাগত গাছ কেটে চলে। নুরী জঙ্গল কেটে দোআঁশ জমি তৈরি করেছিল। সেই জমিতেই হয়েছে তাঁত। গাছকেই হয়ত মমিন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। এক অদ্ভুত চরিত্র মমিন। পিতামাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে নুরীকে পেয়েছিল। এবার ভাবে নুরীর স্নেহ থেকেও বুঝি বঞ্চিত হবে। ভালোবাসার অভাববোধ তাঁকে পাগল করে তোলে। ভালোবাসা পেতেই আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
‘ডিজ্যাবল লাইফ’ অস্থির সময়ের আখ্যান। আমাদের সময়টা নষ্ট হয়ে গেছে। নর্দমার পাঁকে পরিণত হয়েছে। সৎ প্রবৃত্তি, মুক্তচিন্তা, পরিচ্ছন্নতা, আদর্শবোধ বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশের অবস্থা আরও ভয়ংকর। মুক্তচিন্তার মানুষকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। মুক্তচিন্তাকে ধর্মের পক্ষে বিপদজনক মনে করেছে। মুক্তচিন্তার মানুষের প্রতি নানা অত্যাচার নামিয়ে এনেছে। বিগত কয়েক বছরেই আমরা দেখেছি মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদ কীভাবে ধ্বংস করেছে। এবার প্রসঙ্গ হল বিভিন্ন গল্পে মুক্তচিন্তা ধ্বংসকারী এই ভয়ংকর সময়কে লেখিকা কেন তুলে আনলেন? বাংলাদেশের বহু মানুষ দেশভাগে উদ্বাস্তু হয়নি। স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে না পারায় (হিন্দু+মুসলিম) চলে গেছে বিদেশে। যেতে বাধ্য হয়েছে। নইলে অবধারিত পরিণাম হিসেবে মৃত্যুকে বরণ করতে হত। ফলে স্মৃতি ভদ্রদের আখ্যানে এই অভদ্র সময়, অভদ্র জীবন বারবার এসে হানা দিয়েছে। এই আখ্যানে আছে তিয়াসার কথা। যে মুক্তচিন্তার মানুষ। নিজস্ব বোধ, বিবেক, মস্তিস্কজাত সত্য এবং ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে লেখক, দার্শনিকদের মত সে ফেসবুকে শেয়ার করে। অ্যাকাউন্ট ব্লক হয়ে যায় মৌলবাদীদের রিপোর্টে। শুধু অ্যাকাউন্ট ব্লক নয় প্রাণে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। বাড়ি ছাড়তে হয়। গ্রাম থেকে শহরের নিভৃতে আশ্রয় নেয়। এখানেও মুক্তি পায়নি। মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। হারিয়ে গেছে পিতামাতা। শহরে সঙ্গী হয় কল্লোল। সেও মুক্তচিন্তার মানুষ। কিন্তু একটু আড়ালে, আবডালে। কল্লোল ও তিয়াসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিয়াসা এখানেও প্রতারিত হয়। তিয়াসা সেদেশ ছেড়ে জার্মানিতে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কল্লোল ভিসা করলেও তিয়াসার করেনি। একটি নারীর সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এক ভয়ের মধ্য দিয়ে, আতঙ্কের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষকে বসবাস করতে হয়েছে। মৃত্যুকে বাজি রেখে, মৃত্যুকে সঙ্গী করে ভাবতে হয়েছে, জীবনধারণ করতে হয়েছে। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? যা চাইনি তাই হয়েছে। আর হয়েছেই যখন স্মৃতি ভদ্রদের তখন এমন নির্মম আখ্যান গড়তে হয়। সময়ের দাবিই এইসব আখ্যান লিখিয়ে নেয় কথাকারকে দিয়ে।
‘রাতুলের জুতো’ও অস্থির সময়ের আখ্যান। গল্পের শেষবাক্যে গিয়ে একটা খবর শুনি—“আত্মঘাতী বোমা হামলায় শিশুসহ ১৫৭ জন নিহত হয়েছে।“ (পৃ. ১১৬) সন্ত্রাসবাদ গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। কায়েমিতন্ত্র সমস্ত দখল করে নিতে চাইছে। ইতিহাসের হিংস্র দখলদারি পুনরাবৃত্তির সম্মুখীন আমাদের বারবার হতে হয়েছে। অপর দেশের সীমানা কীভাবে দখল করা যায় সেদিকে লোভ শক্তিশালী দেশের। ইন্ধন সঞ্চার করেছে গলায় গলায় পিরিত করা দেশগুলি। সন্ত্রাসবাদই আজ আমাদের বড় শত্রু। জুতোর প্রসঙ্গ দিয়ে গল্প শুরু হলেও জলের প্রসঙ্গ বড় হয়ে ওঠে। আসলে বাংলাদেশ জলাভূমির দেশ। খাল বিল, নদী নালার দেশ। সেদেশের গল্প তো জলকেন্দ্রিকই হবে। আসলে তিনি জীবনের গল্প লিখতে চেয়েছেন। জলের সঙ্গে জড়িয়ে যে জীবন তা নির্মাণ করতে চেয়েছেন। বলা এটি ভালো পিতা-পুত্রের গল্প। গল্পের মূল সত্যে পৌঁছতে লেখিকাকে বারবার গল্পের আখ্যানকে পাল্টাতে হয়েছে। সামান্য শুরু করেই পাঠককে সরিয়ে এনেছেন। এক সত্য থেকে অন্য সত্যে নিয়ে গেছেন। আখ্যানের কাছে পাঠক তো অন্ধযাত্রী। অনেকটা যেন –‘সকলই তোমার ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী ‘লেখিকা’ তুমি / যেমন চালাও তেমনি চলি আমি’। এই চলতে চলতেই শেষ সত্যে উপনীত হতে হয়। যেখানে রয়েছে সন্তান রাতুলের মৃত্যু। সন্ত্রাসবাদ কেড়ে নিয়েছে পুত্রকে। নীরব মেরি মূর্তি। গল্পের ক্যানভাসে রয়েছে পিতা-পুত্রের স্নেহময় জীবন, ঈশ্বরের প্রসঙ্গ, জলের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ। আসলে সব মিলিয়ে লেখিকাকে আখ্যানটি গড়তে হয়েছে। কিন্তু তিনি পরিণতি জেনেই গল্পটি লেখা শুরু করেছেন। তাই ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচন করতে করতে প্রকৃত সত্যের জানান দিয়েই বিদায় নিয়েছেন।
‘পদ্মপুকুরে রানি ভিক্টোরিয়া’ অসাধারণ গল্প। বিস্তৃত সময়ের গল্প। গ্রন্থের ভূমিকায় লেখিকা জানিয়েছিলেন তিনি সময়ের গল্প লিখতে চান বা সময় এই গল্পগুলিতে বিশেষভাবে উঁকি দিয়েছে। বাংলাদেশের এক ক্ষতবিক্ষত সময় পর্ব এই আখ্যানে উঠে এসেছে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের সমাজচিত্র, অত্যাচারের চিত্র, হিন্দুদের দেশত্যাগের চিত্র উঠে এসেছে। তেমনি আছে দুই প্রজন্মের সময়। দেশভাগের পূর্বে হিন্দু মুসলিমের কোন পৃথক সত্তা ছিল না। দেশভাগ হতেই ওপারের মুসলিম হিন্দুকে আর নিজের দেশের মানুষ বা প্রতিবেশী ভাবল না। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ কি অত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে? না যায় না। কেউ কেউ মানবিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে চায়। শেরপুরের পোদ্দারবাড়ি তখনও উজ্জ্বলতা নিয়ে বিরাজ করছে। পোদ্দারবাড়ির ভাষচাষি মুসলিম সাত্তার হোসেন সহযোগিতা করে এসেছে তাদের। পূজার অনেক কাজই সাত্তার করে। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু টিকিয়ে রাখা যায়নি পোদ্দারবাড়ির মানুষদের। উত্তাল পরিস্থিতি বাধ্য করেছে দেশত্যাগ করতে। বাড়ি নিয়েছে সাত্তার হোসেন। সাত্তার হোসেন থেকে সে হয়েছে হোসেন মঞ্জিল। লেখিকা আখ্যানে উত্তাল সময়ের প্রবাহ নিয়ে আসেন এভাবে—
“একথা অবশ্য ষাটের দশকের। তখনো এ-বাড়ির নাম ‘হোসেন মঞ্জিল’ হয়নি। এক অদ্ভুত সময় তখন। দেশের ভেতরে ঘটে যাচ্ছে অনেক কিছু। কিছু সরবে, কিছু নীরবে।
ততদিনে যোগেন মণ্ডল পালিয়ে গেছেন ওপারে। জিন্নাহর উর্দুকে চাপিয়ে দেবার কৌশল ব্যর্থ হয়ে গেছে। আবুল কাশেম ফজলুল হক তখন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলছেন। আর ওদিকে নীরবে তৈরি হচ্ছেন আর এক নেতা। বাঁওড়ের দেশে।
ঠিক এমন সময়েই একদিন এ-বাড়ির ফটকে নামফলক বসে। হোসেন মঞ্জিল। শাদা পাথরের ওপর কালো রঙে বাংলা আর উর্দু হরফে লেখা।“ (পদ্মপুকুরে রানি ভিক্টোরিয়া, তদেব, পৃ. ১২১)
বাড়ি দখল করলেও সাত্তার হোসেনের ভদ্রতা ছিল পোদ্দারবাড়ির প্রতি। নিয়মিত চিঠি দিতেন। মুসলিম বাড়িতে যেহেতু রাধাগোবিন্দের পূজা চলে না তাই তিনি দেবতা পুরোহিত দীনেশ ভাদুরীকে দিয়ে দেন। সাত্তার হোসেনের সন্তান সোবাহান। সোবাহানের নজর পড়েছে এই রাধাগোবিন্দের মূর্তির প্রতি। সাত্তার হোসেনের যে কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল তা নেই পুত্র সোবাহানের। প্রজন্মের ব্যবধানে, সময়ের ব্যবধানে সে মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কেননা এক উত্তাল সময় তরঙ্গের মধ্য দিয়ে সেদিন বাংলাদেশের জনজীবন এগিয়ে গিয়েছিল। সেই উত্তাল তরঙ্গের ঢেউয়ের ছাপ পড়েছিল এইসব চরিত্রে।
এইগল্পের ভিন্ন একটা দিক আছে। বলা ভালো সেটাই লেখিকার উদ্দেশ্য। পোদ্দারবাড়ির পুরোহিত দীনেশ ভাদুরী ও তাঁর নাতি আলোরানি। পোদ্দারবাড়িতে দক্ষিণা হিসেবে তিনি একটি মুদ্রা পেয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার আমলের। তা দিয়েছিলেন আলোরানিকে। আলোরানি অসম্ভব সুন্দরী, যেন রাধারানির মতো। সময় অনেক এগিয়ে গেছে। আলোরানির পিতা-মাতার মৃত্যু হয়েছে। আজ বৃদ্ধ দীনেশ ভাদুরী ও আলোরানির সংসার। সাবাহান চেয়েছিল কষ্টি পাথরের রাধাগোবিন্দের মূর্তি। একজন হিন্দু পুরোহিত হয়ে মুসলিমের হাতে কীভাবে মূর্তি তুলে দেবন? এমনকি সে মূর্তিকে আলোরানি নিত্যপূজা করে। উত্তাল সময়ে আলোরানি যেকোন মুহূর্তে ধর্ষিত হতে পারে। এমনকি হুমকিও এসেছে। দীনেশ ভাদুরীকে বিকল্প পথ খুঁজতে হয়—
“সুনসান সময়ের পরতে পরতে তখন কেবল তাদের শ্বাসের শব্দ। দীনেশ ভাদুরী একঝলক ফিরে দেখেন নিজের ভিটে। কিছু একটা ভাবেন। এরপর হঠাৎই গতি বাড়িয়ে দেন। দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন তিনি।
আশি ঊর্ধ মানুষটি নিজের দ্রুততায় নিজেই খেই হারান। হাত ফস্কে পড়ে যায় রাধাগোবিন্দের মূর্তিটি পদ্মপুকুরে। নীরবতা বিসর্জন হয় জলের শব্দে।
আলোরানি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পদ্মপুকুরের দিকে। ডুবে যাওয়া মূর্তিটির চারপাশে তখনো জলের আলোড়ন।“ (তদেব, পৃ. ১৩৫)
দীনেশ ভাদুরী নাতিকে সীমানা পাড় করে দেন। কিন্তু নিজে দেশত্যাগ করেনি। এদেশ তাঁর। এদেশের মাটিকে তিনি অন্তর থেকে ভালোবাসেন। তাই মৃত্যু এখানেই হবে। এক অনমনীয় জেদ দীনেশ ভাদুরীকে স্বদেশে রেখে দেয়। তবে ভিক্টোরিয়ার মুদ্রাটি পুকুরে ফেলে দেন। সেই পুকুর পদ্মে ভরে যায়। একদিকে কন্যা বিসর্জন অন্যদিকে ফুল ফুটে ওঠা। জীবন-মৃত্যুর দোলায় তিনি আখ্যানকে দুলিয়েছেন। গল্পের ভাষা বড় মায়াবী। দ্রুত ঘটনার বিবরণের পর বিবরণ এনে তাঁকে ছুটতে হয়েছে শেষ বিন্দুতে। যেহেতু দুই দশকেরও বেশি সময়কে তিনি আখ্যানে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তাই দ্রুত চল ছাড়া ভিন্ন উপায় ছিল না। লেখিকার লক্ষ্য ছিল দেশভাগ পরবর্তী উত্তাল সময়। উত্তাল সময় তরঙ্গে ভেসে যাওয়া মানুষের জীবনবীণা তিনি বাজিয়েছেন। সে বীণা রুক্ষ নয় একটা সুরেলা ভাব মিশে থাকে। শুধু এই গল্প নয় স্মৃতি ভদ্রের সব গল্পেই একটা স্নিগ্ধতা থাকে। যে স্নিগ্ধতায় তিনি পাঠককে ডুবিয়ে দেন, ইচ্ছা মত ভাসিয়ে নিয়ে যান। এখানেই তার সফলতা।
এক সহজাত প্রবণতা নিয়েই তিনি গল্পে প্রবেশ করেছেন। গল্পকে কখনো কৃত্তিম বা জটিল করে তোলেন না। দ্রুত ধবমান গদ্যে আখ্যান এগিয়ে নিয়ে যান। এগিয়ে যেতে যেতে চারপাশের খবর দিয়ে যান। আবার কখনো নিজেই আখ্যান ভেঙে দেন। সোজা পথ থেকে ভিন্ন পথে যাত্রা করবেন বলেই এই পদযাত্রা। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা তাঁর গল্পে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। যা ছিল আমার দেশ আর যা হয়েছে আমার দেশ। এই দুই সময়ের ব্যবধান তিনি স্পষ্ট করে তোলেন। কোন আবেগ বা রোমান্টিকতা নয় নির্মম, নির্বেদ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তা ফুটিয়ে তোলেন। কিন্তু ভাষার জাদুতে তা কখনোই রুক্ষ হয়ে ওঠে না।
লেখক পরিচিতি
পুরুষোত্তম সিংহ
প্রবন্ধকার। গবেষক। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
প্রবন্ধকার। গবেষক। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ