পুরুষোত্তম সিংহ
শিপা সুলতানা সিলেট থেকে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছেন। পাড়ি দেওয়ার কালে সিলেটের আঞ্চলিক কথ্যভাষা ঝুলি ভরে নিয়ে গেছেন। যে ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি মানুষের বড় হয়ে ওঠা তা কি অত সহজে ভোলা সম্ভব? দেশভাগে উদ্বাস্তু মানুষ নিজের বলতে শুধু ভাষাটিকেই ওপার থেকে এপারে আনতে পেরেছিল। কর্মের তাগিদে, জীবনের তাগিদে বাংলাদেশের বহু মানুষ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। শিপা সুলতানার ‘পালকের ব্লাউজ’ গল্পগ্রন্থটি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
অদ্ভুত, অলৌকিক, অতিলৌকিক ভাবনা প্রাধান্য পেয়েছে ‘পালকের ব্লাউজ’ গল্পে। ফ্যান্টাসি, রোমান্সের জগতে ভেসে গেছেন লেখিকা গল্পের আখ্যানে। গল্পটি প্রেমের গল্প। কিন্তু সেই প্রেমকে মায়ার আবরণে ঢেকে ফ্যান্টাসির জগতে দুলিয়ে এক ঘোর সৃষ্টি করে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছেন। গল্প আখ্যানে রয়েছে কমল ও আফিয়ার প্রণয়। কমল পাখির পালক সংগ্রহ করে। ভাবে এই পালক দিয়ে আফিয়া ব্লাউজ তৈরি করবে। সেই ব্লাউজে লেগে থাকবে কমলের সংগৃহীত পালকের স্পর্শ। নিজের প্রেমের, ভালোবাসার বার্তাবাহক হিসেবে, ভালোবাসার স্পর্শ হিসেবে পালকগুলি দিতে চেয়েছিল। পাঠক মনে করতে পারেন রবিঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনীর নীলকণ্ঠ পাখির পালক পড়িয়ে দেওয়ার কথা। এই আখ্যানে আছে ডাহুকের পালকের কথা। অন্য পালকের কথাও এসেছে প্রসঙ্গক্রমে কিন্তু ডাহুকের পালক যেন বেশি। পাঠক মনে করে দেখুন বিদ্যাপতির পদাবলির কথা—‘মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহূকী / ফাটি যাওত ছাতিয়া’। কিন্তু কমলের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সমস্ত পালক প্রত্যাখ্যান করে আফিয়া। রঞ্জন কিন্তু নীলকণ্ঠ পাখির পালক প্রত্যাখ্যান করেনি। যখন রঞ্জন মৃত হয় তখন দেখা যায় নীলকণ্ঠ পাখির পালক খসে গেছে। আসলে প্রেম মরে গেছে, ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনে প্রেম হারিয়ে গেছে। ব্যক্তিপ্রেমের মূল্য ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আফিয়ারা তাই প্রত্যাখ্যান করে পালক। তবে অনুশোচনা আছে, বেদনাবোধ আছে। গল্পে এক রহস্য বাতাবরণ রয়েছে, আঞ্চলিক সংলাপে তা আরও মায়াময় হয়ে ওঠে।
‘পত্রসখা’ গল্পটি প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বীণা। বিভিন্ন পাতা নিয়ে তাঁর ভাবনা, আনাগোনা। পাতার সাম্রাজ্যেই যেন তার যাবতীয় চিন্তা-চেতনা। জীবনের সখা হিসেবে সে পাতাকেই বেছে নিয়েছে। গল্প শরীরের জন্য একটা অবয়ব লেখিকাকে তৈরি করতে হয়েছে। আছে মাস্টার মশাই, বলাইদার কথা। আছে আলো-অন্ধকারের খেলা। মানুষকে কখনো পাতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন। আখ্যানের প্রয়োজনে এসে উপস্থিত হয় পরি। আজ আর লক্ষ লক্ষ পাতা জমে না। হারিয়ে যাচ্ছে সব রহস্য। পাতা ছাড়া অন্য কোন সঙ্গীকে তার ভালো লাগে না। তাই জলে পা ডুবিয়ে রাখে—
“অনেক্ষণ পানিতে ভেজানো পা আসড় হয়ে ছিলো, হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছড়ার পানিতে, আবার উঠে দাঁড়ায়। বনের ভেতর যাবে না পাহাড়ের ভেতর! পাহাড়ের ভেতর না বনের! মেঘলা মেঘলা আলোয় বীণা দেখে বনের মাথায় মাথায় চেনা চেনা মুখগুলো আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, একসাথে কথা বলছে সবাই, হাসি হাসি মুখগুলো দেখতে দেখতে বনের ভেতর ঢুকে পড়ে বীণা।“ (পত্রসখা, পালকের ব্লাউজ, চন্দ্রবিন্দু, চট্টোগ্রাম, প্রথম প্রকাশ ২০২০, পৃ. ২৫)
বাংলা গল্পের চিরাচরিত ধারার সঙ্গে শিপা সুলতানকে মেলানো যায় না। চিরাচরিত ধারার সঙ্গে তিনি নিজেকে মিলিয়ে নেননি। আপাত অর্থে তৃতীয় বিশ্বের যে কাহিনি তা তার গল্পে অনুপস্থিত। প্রবাসে থাকার ফলে গল্পের আদলকেও তিনি পাল্টে নিয়েছেন। তবে ভাষাগত দিক থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন। ‘কালঘুম’ বোধের গল্প। সময়ের গল্প। ব্যক্তির নিঃসঙ্গতার গল্প। জীবন থেকে যে সময় হারিয়ে গেছে তার অনুসন্ধানের গল্প। সময় চলে নিজের বেগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু হারিয়ে যায়। ব্যক্তিকেও খাপ খাইয়ে নিতে হয় পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে। আপাত অর্থে এই আখ্যানে কোনো কাহিনি নেই। দ্রুত কিছু ঘটনার বিবরণ এনে তিনি আখ্যান শেষ করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের গল্প বলতে আমরা যা বুঝি সেই কাহিনি থেকে শিপা সুলতানা সচেতনভাবেই দূরে সরে গেছেন। বাংলা গল্প বহু পথ এগিয়ে গেছে। প্রত্যেক লেখক নিজস্ব একটি পথ করে নিতে চেয়েছেন। শিপা সুলতানা স্বতন্ত্র পথে এগিয়ে গেছেন। কাহিনি অপেক্ষা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এনে অন্তিমে উপস্থিত হন। চিরচারিত বাঙালি পাঠক তাই শিপা সুলতানার গল্প পড়তে গিয়ে একটু হোঁচট খেতে পারেন। এই গল্পের সূচনাতেই রয়েছে কিছু কাহিনি সংবাদ—
“আমি তাকে বলেছিলাম শৈশবের সব খেলা শেষ হলে যেন আমার কাছে ফিরে আসে। তারপর নিয়াতি পাহাড়ের মেঘ উড়ে গেছে কোহেকাফের দেশে। ডানকিনে মাছের গর্ভ ভরে উঠেছে অফুরন্ত স্বর্ণবিন্দুতে। পাঁচ পীরের মাজারের পথে উড়ে গেছে বড় পোতার বক। রাখাল বৈরাগীর ভাবে ভর করেছে নিধুরাণী বৈষ্ণবী। এক জোড়া চড়ুই ঘর বেধেছিলো টিমটিমে এক মনগাছে, এবার তাদের কোল ভরে বালবাচ্চা এসেছে।
আর আমি তাকে বলেছিলাম খেলনাগুলো পরিপাট করে যেন আমার কাছে ফিরে আসে সে।“ (কালঘুম, তদেব, পৃ. ২৬)
জীবন থেকে সময় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। অথচ হারিয়ে যাওয়া সময়ের প্রতি অনন্ত মায়া। এযেন বিদ্যাপতির বয়ঃসন্ধির পদের খেলা। মন যৌবনকে স্বাগত জানিয়েছে তবে শৈশব যাচ্ছে যাচ্ছে করেও বিদায় নিচ্ছে না। কিংবা জীবনানন্দের সেই ‘বোধ’ কবিতার নায়কের মতো—“সকল লোকের মাঝে ব’সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?/ আমার পথেই শুধু বাধা?” মানুষ একা হয়ে যায়। অন্তরচৈতন্যের এক নিগূঢ় বোধ মানুষকে একা করে দেয়। সে মানুষ খুঁজে চলে পরশপাথের সন্ধান। এই গল্পের কথকও খুঁজে চলেছে ফেলে আসা সময়কে।
আসলে নিজের অস্তিত্বকেই আবার সে নির্মাণ করে নিতে চাইছে। এই বোধের মধ্যেও লেখিকা রাষ্ট্রের খবর দিয়ে যান। নদী চুরি হয়ে যাচ্ছে, পোস্ট অফিসের কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। কেন বিদায় নিল সুন্দর পৃথিবী থেকে তার বিস্তৃত বিবরণ এনেছেন। আমরা সামান্য উল্লেখ করি—“পুরোনো নামগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে, তরকারিতে লবণ বাড়ছিলো, অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছিলো জোরসে। পাঠশালার বন্ধুদের নাম মনে করতে পারছিলাম না। প্রিয় উপন্যাসের অক্ষরগুলো ছোট হয়ে আসছিলো, পুরনো ভিখারি লবঙ্গ বেঁচতে আসছিলো না আর, জুতো জোড়া ঢিলে লাগছিলো হঠাৎ।“ (তদেব, পৃ.৩০) এই বোধ নিয়ে গেছে মৃত্যুচেতনায়। চেতন বিশ্ব যখন নিজের সত্তায় কোন আলোড়ন তোলে না তখন সব শূন্য মনে হয়। শূন্যের ভিতর আরও এক শূন্য ডাক দেয়—‘চিতা কাঠ ডাকে আয় আয়’।
‘উলুধ্বনি’ গল্পে রয়েছে অত্যাচারের চিত্র। তবে তা সূক্ষ্ম ভাবে। এ গল্পও অন্তরচেতনার গল্প। কেবল গল্পের নামকরণের কথা ভাবলে অত্যাচারের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সব ছিনিয়ে নেওয়া, অত্যাচারে দেশত্যাগ করা, শেকড় সন্ধান সব লেখকই করেছেন। শিপা সুলতানা সে অত্যাচারের কথা সামান্য রেখে মগ্নচৈতন্যের জগতে চলে যান। ব্যক্তির অন্তঃসত্তা কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হয় তা তুলে ধরেন। বাইরের জগত অপেক্ষা শিপা সুলতানার লক্ষ্য ব্যক্তির ভিতরের জগত। তাই তাঁর আখ্যানে কাহিনি অনুপস্থিত। যে আব্বাস লেখার জন্য প্রতিনিয়ত টেবিলে বসে, কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করে সেই আবাসকে বিমূঢ় করে দিয়েছে অত্যাচারের চিত্র। অন্তরমননে এক বিধ্বস্ত চিত্র এঁকে দিয়েছে। যা তার পক্ষে ভোলা সম্ভব হবে না। বিক্ষিপ্ত কতগুলি ঘটনা নিয়ে তিনি গল্পের অবয়ব গড়ে তোলেন। বুবলি থেকে লোকমানের মা, বরিশ মাস্টারের উপস্থিত ঘটিয়ে পোঁছে যান প্রকৃত সত্যে। সেই সত্যে পৌঁছনোর পূর্বে একটা আভাস দিয়ে যান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘মধুমতি’ নারীর জীবন যন্ত্রণার ভাষ্য। নারীর জীবন সংগ্রামের লড়াই। এর মধ্যে মিশে আছে সংস্কার, লোকাচার। আছে নারীচেতনাবাদ। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই নারীচেতনা প্রতিষ্ঠা পায় না। পাওয়া সম্ভব হয় না। নারীরাই পরাজিত করে দেয়। কোন ঈর্ষা নয় আসলে সংস্কার, ভয়। আখ্যানের দুটি প্লট। মাঘাই আর কৃষ্ণার কাহিনি বলতে বলতেই লেখিকা প্রবেশ করেছেন মধুমতির জগতে। মধুমতি মাঘাইয়ের মাতা। তিনি পরি হতে পারেন, এমন এক জাদুবিশ্বাস বহন করে চলতেন। সেই জাদুবিশ্বাসই তার জীবনের ট্র্যাজেডি ডেকে এনেছিল। গল্পের বয়ানে পাই—
“মধুমতি যাদুও জানে। কথাটা দাবানলের আগে আগে চলে। মধুমতি পুরুষকে ভেড়া বানিয়ে বনে চরতে পাঠাতে পারে, গাছের পক্ষি হাতের গাতায় এসে বসে। সে কামরূপ কামাক্ষ্যার কোন নারী না জানে, মধুর দাদুর বাড়িই তো সেই দেশে, সেই নেংটা হয়ে স্নান করা রানীর দেশে। তাই বলে বাঘ বানিয়ে দেয়া?
পাড়ার নারীদের ঘুম আসে না। তাদের এতো বড় সংবাদে তাদের পুরুষদের হেলদোল হয় না দেখে ক্ষেপতে থাকে তারা। কেবল পুরুষেরাই বড় বড় কাণ্ড ঘটায়! তারাই কেবল চোখ কপালে তোলা সংবাদ বয়ে আনে?” (মধুমতি, তদেব, পৃ. ৪৪)
এই জাদুই তার জীবনে পতন ডেকে আনে। জাদু দেখাতে গিয়ে মহিলাদের বলে মধুমতি থেকে ভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয়ে গেলে বাটির জল দিলেই আবার মধুমতি ফিরে আসবে। সব মহিলা ভয়ে, আতঙ্কে বাটির জল অসচেতনভাবে ফেলে দেয়। পাগল হয়ে যায় মধুমতি। অন্ধ ননদ মধুমতির সেবা করতে গিয়ে নিজেই নাজেহাল। প্রতিবেশী বাড়িতে খাবার চাইতে গেলে জোটে শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া ভাতের গরম মাড়। স্বামীও ফেরে না। সন্তান মাঘাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। নচেৎ ভিন্ন উপায় ছিল না। মাতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও অত্যাচার সহ্য করতে হত। গল্পের প্রথম অংশে আছে বনে বনে ঘোরা মাঘাইয়ের কথা। সে কথা বলতে বলতেই লেখিকা মধুমতির গল্পে প্রবেশ করেছেন। সন্তান থেকে মাতার চেতনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। অবচেতনে মাঘাইয়ের সত্তায় বেজে ওঠে মাতার কথা—
“শরশর শব্দ পেলো মাঘাই। মায়েরই তো শব্দ। তবু রাতের বেলা বুক ধ্বক করে উঠে তার। দুপুরে যেমন দুদণ্ড বেশি বসে যায়, রাতে পাত পেতেই নেমে আসে ঢিবি থেকে, তখন যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস শুনে সে প্রতিদিন, প্রতিদিনই ইচ্ছা করে এখান থেকে এক দৌড়ে দেশ মহাদেশ পেরিয়ে আরো দূর কোথাও চলে যায়...” (তদেব, পৃ. ৪৪)
তিনি গল্পে পরি নামিয়ে আনেন। চরিত্রকে দূর থেকে বহুদূর দেশে নিয়ে যান। বন-বাদরে ঘুরিয়ে এক রহস্য নিকেতন গড়ে তোলেন। মাঝে মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত হিউমারের প্রয়োগ ঘটান। কখনো ইচ্ছাকৃত রাত্রি নামিয়ে আনেন। চরিত্রকে অন্ধকারের আড়ালে নিয়ে যান। অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ ঘটান। আসলে জীবনের অর্থ চরিত্রকে দিয়ে উপলব্ধি করেন। ‘রাজবংশ’ ঐতিহ্যের গল্প। জাতি চেতনার আখ্যান। রাজা গৌড় গোবিন্দ বিদেশী আক্রমণে পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে পরবর্তী প্রজন্ম আর সমতলে নেমে আসেনি। আখ্যানে রয়েছে দিনেশ ও এক বৃদ্ধের কথা। পাহাড়ে খাদ্যের অভাব। বৃদ্ধ তাই সমতলে নেমে আসতে চেয়েছিল। নবীন প্রজন্মের দিনেশের ছিল প্রবল জাত্যাভিমান। ভেবেছিল এক সময় বৃদ্ধকে পাহাড় থেকে ফেলে দেবে। শেষ তা হয়নি। বৃদ্ধ দিনেশকে দিয়ে যায় বংশের ঐতিহ্য কষ্টি পাথরের রাধাকৃষ্ণ। বংশের নিয়ম অনুসারে বৃদ্ধরা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে এই রাধাকৃষ্ণের মূর্তি তুলে দিয়ে যায়। আখ্যান পাঠে স্পষ্ট বোঝা যায় তা ছিল ধর্মীয় অত্যাচার। গৌড় গোবিন্দ নিজের কূলদেবতাকে রক্ষা করতে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই ঐতিহ্যকেই রক্ষা করে আসছে পরবর্তী প্রজন্মরা। তেমনি আছে প্রবল অভিমান। ক্ষুধার তাড়নায় কেউ কেউ যে সমতলে নেমে যায়নি তা নয়। কিন্তু কেউ কেউ তো ঐতিহ্যকে নিয়ে বাঁচে। প্রচলিত স্রোতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের বিশ্বাসেই বাঁচতে চায়, দিনেশরা সেই ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
ময়নার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ময়না ভাই’ গল্পটি। শিপা সুলতানার বেশিরভাগ গল্পের পটভূমি পার্বত্য অঞ্চল। পার্বত্য অঞ্চলের মতোই তাঁর গল্পগুলি বন্ধুর। বারবার কাহিনি ভেঙে দেন। আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগ ও কথ্যভাষার ব্যবহারে গল্পকে রসোত্তীর্ণ করে তোলেন। ময়নার নানা কার্যকলাপের বিবরণ আছে গল্পে। পরোপকারী ময়না সর্বদা মানুষের কাজে এগিয়ে গেছে। রাগ-অভিমানও আছে। শেষে ‘ময়না কুকুর? ডাকের কুকুর?’ সম্বোধন শুনে আর মন চায়নি এদেশে থাকার। বিদায়ও নিয়েছিল। কিন্তু পথই যেন বাধা দিল। পথে দেখা অমরনাথ সাহার সঙ্গে। সে যাচ্ছে এয়ারপোর্টে নাতিকে আনতে। বৃদ্ধের অসহায়তাই তাঁকে আটকে দিয়েছে। সমস্ত অভিমান পরাজিত হয়েছে। মানুষ নিঃস্বার্থভাবে যে কাজ করে সেখানে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এলে অভিমান হয়। অভিমানই মানুষকে নিয়ে যায় দূর দেশে। সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। আবার ভালোবাসাই সম্পর্ক বেঁধে দেয়। অঞ্চলের প্রতি ভালোবাসাই আটকে রেখেছে ময়নাকে। অমরনাথের আহ্বানের কাছে ময়নার সমস্ত অভিমান পরাজিত হয়েছে। ‘বাড়ি’ গল্পহীনতার গল্প। প্রতিটি লেখকই গল্পের মূল ঘটনায় প্রবেশের আগে একটা প্রেক্ষাপট গড়ে তোলেন। একটা পরিবেশের বাতাবরণ তৈরি করেন। পাঠককে প্রস্তুত করে পরে নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছে যান। শিপা সুলতানা এই আখ্যানে গল্পের প্রেক্ষাপটকেই গল্পে রূপান্তরিত করেছেন। লেখিকা একটি বাড়ির গল্প শোনাতে চেয়েছেন। গ্রামের সেই বাড়িতে প্রবেশ করতে যাত্রাপথের যে বিবরণ তাই গল্প হয়ে উঠেছে। তবে বর্ণনা পৃথক। এখানেই তিনি অন্য গল্পকারদের থেকে দূরে চলে যান। বক্তা লেখিকা, শ্রোতা হিসেবে একজনের উপস্থিতি রয়েছে। যেহেতু প্রশ্নবোধক বাক্যে আখ্যান এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাই শ্রোতার প্রয়োজন হয়েছে। ক্রমাগত প্রশ্নবোধক বাক্যে, সংশয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় ভর করে আখ্যান এগিয়ে যায়। গ্রামের চিত্র যেভাবে উপস্থাপিত হয়, গ্রাম সম্পর্কে সত্য-মিথ্যার যে লোকপরম্পরা তা স্পষ্ট-অস্পষ্টের মাঝখানে রেখে আখ্যান তীব্র গতি লাভ করে। ধারণা স্পষ্ট করতে পাঠককে সামান্য গল্পের স্বাদ দেওয়া যেতে পারে—
“অত যে ক্ষেপেছেন বলুন খেয়েছেন কোনদিন দেবীর প্রসাদ? ভাঙা ফাটলে লুকোচুরি? খেলেছেন লুকোচুরি? বলেন বলেন? ওখানের মসজিদ বলুন, মন্দির বলুন, হেরেম খানা, বাইজীখানা বলুন, নাট মন্দির, শিব মন্দির, আমার কী? বলুন আমার কী? দিত শিব মন্দিরে বাতাসা নিমকি? দিত সোনার তাজ বাবরি মসজিদে গেলে? হ্যাঁ হ্যাঁ সোনার তাজ! তা আর বলছি কী! চাতালে প্রতিমার বস্ত্রহরণ, বাটিলুট, ঘটিলুট, হারচুরি, গনেশের ফাটামাথা দেখলাম না? নিজ চক্ষেই দেখলাম, বলি কিছু বলছেন না যে হঠাৎ? ঘুমুলেন? ঘুমুলেন নাকি? শুনছেন না যে বড়ো! আচ্ছা আচ্ছা তো, কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ বামের কথা, পথের বাম, ডানে হেললে তো দিঘিতে পড়ে যেতো!।“ (বাড়ি, তদেব, পৃ. ৬২)
এই যাত্রাপথের বিবরণে বিচ্ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সন্ত্রাসের খবর লিপিবদ্ধ হয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে ওপারে মন্দির ধ্বংস হয়। শেষে পৌঁছেছেন বাড়িতে। যেখানে রয়েছে যন্ত্রণার চিত্র। প্রেমে দ্বগ্ধ হওয়ার চিত্র। আখ্যানের শেষে এসে জানিয়েছেন—“চলুন বাড়ি ফিরি, ফিরতে ফিরতে এক গপ বলি, এই গপ না শুনলে ষোলো আনাই মিছা! আমি চাক্ষুষ? বলছেন এই কথা? ছাড়েন, সব ঘটনার চাক্ষুষ হতে হয় না! আমি চাক্ষুষ হলে আপনার-ই বা শোনার কী দায় ছিলো, গল্পের চাক্ষুষ হতে হয় না, বাবা বললেন বলেই তো আপনাকে শোনাতে পারছি, বাবা চাক্ষুষ কিনা দাদা জানেন! তার চেয়ে পথে নামি।“ (তদেব, পৃ. ৬৫) এই গপ্পই আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। তা শোনানোর জন্য তিনি বাতাবরণ তৈরি করেছেন। কখনো গল্পে পরি নামিয়ে আনেন। তাঁর গল্পের নারীরা পরি হয়ে উড়ে যায়। ভাতের হাঁড়িতে চাপা পড়েছে প্রেম। প্রেম যেন মুক্ত। বাঁশির সুর যেন বদ্ধ পরিসরে বাজানোর স্থান নয়। অথচ একদিকে বাঁশির সুর, অন্যদিকে ভাতের হাঁড়িকে চাপা দেওয়া। অমবস্যা, প্রেম, ভাতের হাঁড়ি। অন্ধকার, আলো, ক্ষুধা। এই নিয়েই তো জীবন। এই নিয়েই তো গোটা পৃথিবীর গল্প। লেখিকা যেন সে সত্যই জানান দিয়ে যান।
শিপা সুলতানার একটি নিজস্ব গদ্য আছে। সে গদ্যটিই তার জাদু। গদ্য আরও মাধুর্য লাভ করে আঞ্চলিক রঙে, সংলাপে। পড়তে গিয়ে কোন কোন পাঠক হয়ত হোঁচট খেতে পারেন। কেননা সিলেটের সে সংলাপের সঙ্গে এবাংলার পাঠকের তেমন পরিচয় নেই। তেমনি এপারে সাহিত্যে সিলেটের আঞ্চলিক কথ্যভাষা তেমন উঠে আসেনি। ‘পালকের ব্লাউজ’ গল্পগ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পের প্রেক্ষাপট পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো গদ্য দ্রুত থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। যতিচিহ্নের ক্রমাগত ব্যবহারে তা ভিন্নমাত্রা লাভ করে। এক পরিসর থেকে ভিন্ন পরিসরে যাত্রা করতে পরি নামিয়ে আনেন। নারীদের পরি করে গল্পবলয়ে এক রহস্য বাতাবরণ সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশের অবক্ষয়িত অবস্থা, রাষ্ট্রের ভণ্ডামি তেমন তার গল্পে প্রাধান্য পায়নি। আসলে তিনি মগ্নচৈতন্যের গল্প লিখতে চেয়েছেন। মানুষের যে বিবিধ সত্তা, সেই সত্তার বহুমুখী কার্যকলাপের নানা রঙ, রূপের সন্ধান দিতে অগ্রসর হয়েছেন।
লেখক পরিচিতি
পুরুষোত্তম সিংহ
প্রবন্ধকার। গবেষক। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
পুরুষোত্তম সিংহ
প্রবন্ধকার। গবেষক। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ