কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘তিসিডোর’ - একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া: হারুন রশীদ



 
যে কোন সাহিত্যকর্মকে তখনই সফল বলে ধরে নেয়া হয় যখন সেটা পাঠকের মগজে দীর্ঘ সময় ধরে ঠাঁই করে নিতে পারে। ভাবনার জগতকে আলোড়িত করতে পারে। তেমন সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা পাঠকের জন্য যেমন সুখকর- লেখকের জন্যও তেমনি সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিটি নতুন গ্রন্থ পাঠকের জন্য নতুন একটি অভিজ্ঞতার জানালা খুলে দেয়।  

কেতকী কুশারী ডাইসন লিখিত ‘তিসিডোর’ পড়তে শুরু করার আগে তেমন একটি অভিজ্ঞতা লাভের আকাঙ্ক্ষা দানা বেঁধেছিল। বইটি পড়ার জন্য প্রাথমিক আগ্রহ তৈরী হয়েছিল যখন শুনেছিলাম এই গ্রন্থটিতে বুদ্ধদেব বসু এবং জীবনানন্দ দাশের তুলনামূলক কিছু আলোচনা আছে। বুদ্ধদেব বসু এবং জীবনানন্দ দাশ দুজনই আমার প্রিয় সাহিত্যিক। দুজনের সাহিত্য এবং জীবন সম্পর্কে আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। তাই আরেকটি চমৎকার গ্রন্থ পাঠের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবার আশায় তিসিডোর পড়তে শুরু করলাম।

৯৪ পৃষ্ঠায় এসে জীবনানন্দ দাশের নামটা প্রথমবারের মতো উপস্থিত হয়। আশা করা গিয়েছিল এবার জীবনানন্দের কাব্য সাহিত্য নিয়ে আলোচনা আসবে। কিন্তু সেসব কিছুর নজির দেখা গেলো না। আরো কিছুদূর পড়ার পর বোঝা গেল এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য বিষয় জীবনানন্দের একটি অপ্রচারিত উপন্যাস - ‘সফলতা নিষ্ফলতা’। 

আমরা জানি জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ তাঁর কোন উপন্যাস প্রকাশ করেননি। তিনি হয়তো সেগুলোকে ঠিক প্রকাশযোগ্য ভাবেননি। মৃত্যুর কয়েক দশক পর তাঁর ব্যক্তিগত ট্রাংক থেকে বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্ম আবিষ্কার করেন তাঁর স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা। সেগুলো একে একে প্রকাশ পেতে থাকলে জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে নতুন করে আলো ছড়াতে শুরু করে। 

‘সফলতা নিষ্ফলতা’ উপন্যাসটি লোক চক্ষুর অন্তরালে ট্রাংকের ভেতর পাণ্ডুলিপি অবস্থায় ৭২ বছর ঘুমিয়ে ছিল। প্রকাশিত হবার বিশ বছর পরও উপন্যাসটি ভূভারতে সুলভ নয়। বইটির নামই শোনেনি অধিকাংশ বাঙালি। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হবার পরও পড়েছেন হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষ। 

বিলম্বে প্রকাশিত উপন্যাসটি কেতকী কুশারী ডাইসনের হাতে পৌঁছানোর পর তিনি পড়ে ভীষণ মর্মাহত হন। এতই মর্মাহত হন যে তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বৃহৎ সমালোচনা পুস্তক ‘তিসিডোর’ রচনা করেন। বিচিত্র কারণে তিনি পুস্তকটিকে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যে কোন বিচারেই তিসিডোরকে উপন্যাস হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা কঠিন। 

উপন্যাসটি শুরু হয়েছে লেখিকার নিজের পরিবার ও প্রতিবেশিদের কিছু স্মৃতিচারণ দিয়ে। ৯৪ পৃষ্ঠায় এসে জীবনানন্দের ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ নিয়ে আলোচনা(নিন্দা বলাই শ্রেয়) শুরু হয়। দীর্ঘ সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার নিন্দালোচনা চলার পরে আবারো লেখিকার ব্যক্তিগত পারিবারিক স্মৃতিচারণ চলে দুশো পৃষ্ঠার মতো। কিছু অংশে আবার ইজরায়েল প্যালেস্টাইন ইস্যু এবং বিশ্বরাজনীতির আলোচনা যুক্ত হয় যার সাথে জীবনানন্দের কোন সম্পর্ক নেই। পাঁচশো পৃষ্ঠার পর আবারো জীবনানন্দ আলোচনা(নিন্দা বলাই শ্রেয়) পুনর্বহাল হয় এবং উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে ৮৫৫ পৃষ্ঠায় গিয়ে। 

বইটির এই পর্বগুলোর মধ্যে মূল অংশ হলো তিসি ও তিল নামের দুই বোনের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ নিয়ে আলোচনা এবং এই উপন্যাসের মধ্যেকার সংলাপ ও ঘটনাবলী থেকে জীবনানন্দের কুৎসিত মানসিকতা, ব্যর্থতা, হীনম্মন্যতা আবিষ্কার (!)। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি হলো বুদ্ধদেব বসুর প্রতি জীবনানন্দ দাশের তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ। জীবনানন্দ দাশের সেই গোপন ঘেন্না বিদ্বেষ গুলো খুঁজে খুঁজে তাঁর চরিত্রের অন্ধকার দিকটাকে জনসমক্ষে তুলে ধরাই তিসিডোরের মূল উপজীব্য বিষয়। এটা আমার অনুমান নয়, লেখিকা নিজেই তিসিডোর লেখার পেছনে প্রধান এই কারণটি উল্লেখ করেছেন। 

‘সফলতা-নিষ্ফলতা’র রচনাকাল ১৯৩২ সাল। যখন কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনের কঠিনতম একটি অধ্যায় অতিক্রম করছিলেন। যে সময়টায় তিনি প্রায় কয়েক বছর কবিতাশূন্য সময় কাটিয়েছেন। সেই অকেজো সময়ে পাতার পর পাতা গদ্য রচনা করে বস্তাবন্দী করে ফেলে রেখেছিলেন, যার কিছু উপন্যাস, কিছু গল্প। সেসব কোথাও প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি, যতটা জানা যায় কারো সাথে আলোচনাও করেননি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর অর্ধশত বছর পর ২০০৪ সালে ভূমেন্দ্র গুহের সম্পাদনায় ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ নামের ১২৩ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি প্রকাশ পায়। উপন্যাসটির সম্পাদকীয় অংশটি বিপুলায়তন এবং সেই অংশে সম্পাদক ভূমেন্দ্র গুহ অনুমান করছেন যে উপন্যাসের দুটি প্রধান চরিত্রের একটি হলেন বুদ্ধদেব বসু(বানেশ্বর) এবং অন্যটি জীবনানন্দ দাশ(নিখিল)। 

ভূমেন্দ্র গুহের নানান বিষয়ে কেতকীর ব্যাপক আপত্তি আছে। তার অনেক কথাই তিনি মানতে রাজী নন। কিন্তু এই উপন্যাসটির দুই চরিত্রকে নিয়ে ভূমেন্দ্রর অনুমানকে ভিত্তি করে তার উপর তিনি নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা চড়িয়ে মূল ঘটনার তিলটিকে তাল বানিয়ে ‘তিসিডোর’ নামের ৮৫৫ পৃষ্ঠার বিপুলায়তনের গ্রন্থ লিখে ফেলেছেন। 

বুদ্ধদেব বসু নিজেও কখনো জানতেন না জীবনবাবু তাঁকে কতখানি ঘেন্না করেন। এই অজ্ঞতার ফলে বুদ্ধদেব বসু সবসময় জীবনানন্দ দাশের প্রশংসায় ডুবে ছিলেন, সাহিত্য আসরের নানান কুটিল জায়গায় তিনি জীবনানন্দ দাশকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু জীবদ্দশায় যেহেতু জানতে পারেননি তাঁকে মনে মনে অসম্মান করতেন জীবনবাবু, তাই বুদ্ধদেব বসুর মরনোত্তর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন কেতকী কুশারী ডাইসন। কথিত উপন্যাসের খসড়া বাক্যগুলো দিয়ে বুদ্ধদেব বসুকে উপরে তুলে জীবনানন্দ দাশকে নীচে নামিয়ে নিজস্ব বিদ্বেষকে সাহিত্যায়িত করার চেষ্টা চালিয়েছেন ‘তিসিডোর’ নামের কথিত উপন্যাসে। কাঠগড়ায় তুলেছেন বাংলা সাহিত্যের নিভৃততম কবি জীবনানন্দ দাশকে। 

তিসিডোরের কুৎসাকর্মের ছোট্ট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসে ডিমের অমলেটের কথা আসছে বেশ কয়েকবার। এটা নিয়ে তিসিডোরে ৬ পাতা ব্যাপী ব্যাঙ্গ রচনা করা হয়েছে। কবির কাছে ডিম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেইকালে ডিম দুর্লভ ছিল কিনা, ডিম নিয়ে আহ্লাদ করার কী আছে, বড়লোকেরা ব্রেকফাস্টে ডিম খায়, ডিম খাওয়া বড়লোকী, জীবনানন্দ জানতো না ডিমে কোলেস্টেরল আছে, শরীরে ক্ষতি করে, জানলে উপন্যাসে ডিম আনতো না এত, ইত্যাদি বিদ্রুপ করেছেন।  

জীবনানন্দ দাশ আর্থিকভাবে দরিদ্র মানুষ ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি সাহিত্য খ্যাতি যেমন পাননি, তেমনি স্বচ্ছলতার মুখও দেখেননি। ডিম জিনিসটা তাঁর কাছে গুরুত্ব পেলে অবাক হবার কিছু নেই। যে মানুষটা জীবনভর কষ্ট করে পার করেছেন তাঁকে নিয়ে এমন ব্যঙ্গ, এমন অপ্রয়োজনীয় ব্যবচ্ছেদ সহ্য করা কষ্টকর। জীবনানন্দ দাশের তুলনায় বুদ্ধদেব বসু হাজারগুণ বেশী সুখী স্বচ্ছল, সমৃদ্ধ, সফল জীবন কাটিয়েছেন। তবু সেই বুদ্ধদেব বসুকে তথাকথিত অপমান থেকে বাঁচাবার জন্য লেখিকা জীবনানন্দ দাশকে নিষ্ঠুরতার সাথে আক্রমণ করে গেছেন। মজার ব্যাপার হলো যে অপমান বুদ্ধদেব বসু কখনো অনুভব করেননি, যে বই সম্পর্কে তিনি কখনো জানেননি, সেই বইটি নিয়ে এমন সপ্তকাণ্ড রচনা!

 বস্তুতপক্ষে ভূ-ভারতে আর কেউ বোধহয় মনে করেননি জীবনানন্দ দাশ ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ দিয়ে বুদ্ধদেব বসুকে অপমান করার চেষ্টা করেছেন। যে উপন্যাস তিনি কখনো প্রকাশ করেননি, সেই উপন্যাস কী করে অপমানের হাতিয়ার হতে পারে সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। বরং তিসিডোরই সেই অপ্রকাশিত অঘটিত ঘটনাটিতে ঘষে ঘষে তাদের দুজনের মরণোত্তর সম্পর্কে আগুন দেবার চেষ্টা করে গেছে। জীবনানন্দ মুখে না বললেও মনে মনে বুদ্ধদেব বসুকে ঈর্ষা করতেন, ঘৃণা করতেন, তাচ্ছিল্য করতেন, খুঁড়ে খুঁড়ে কেবল এই তথ্যগুলো আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে তিসিডোরে। চেষ্টাটি খুব হাস্যকর। এতে জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসুর কোন লাভ ক্ষতি না হলেও তিসিডোর লেখকের ছিদ্রান্বেষী মানসিকতার রূপটাই পাঠকের চোখে বারবার প্রকাশ পেয়েছে। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক।

 এই দুজনকে কেউ কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে কিনা জানা নেই। দুজনের অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। সাহিত্য রসিকগণ দুজনের কাছ থেকেই রস আস্বাদন করেন। কেতকী চেষ্টা করে গেছেন সেই রসের ভেতর বিষ দিয়ে জীবনানন্দের প্রতি পাঠকের মনকে তিক্ত করে তুলতে। সেই চেষ্টা বোধকরি শতভাগ বিফলে গেছে। কেননা তিসিডোর প্রকাশের পর জীবনানন্দের বইয়ের বিক্রি কমেছে বলে শোনা যায়নি। জীবনানন্দের বাজার তৈরীর জন্য বিজ্ঞাপন লাগেনি। সময়ই তাঁকে তুলে এনেছে। রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরী হয়নি এখনো পর্যন্ত। আধুনিক বাংলা কাব্যের বিরাট একটা অংশ গড়ে উঠেছে তাঁকে ভিত্তি করে। উপন্যাসের নামে কুৎসা রচনার মাধ্যমে জীবনানন্দের সুনাম ধ্বংসের প্রাণপণ চেষ্টাকে মিলাকরুণাই করতে হয়।  

‘তিসিডোর’কে কেন উপন্যাস বলা হয়েছে আমার জানা নেই। তিসিডোরের গঠন প্রকৃতি চরিত্র কিছুর মধ্যেই উপন্যাসের কোন উপাদান নেই। সাধারণত একটি উপন্যাসের মধ্যে চারটি মৌলিক উপাদান থাকে। কাহিনী, চরিত্র, পরিণতি, বক্তব্য। উপন্যাসের এই চারটি মূল উপাদানের মধ্যে তিসিডোরে শুধু একটি উপস্থিত। তা হলো বক্তব্য। একজন লেখকের চরিত্রহনন বিষয়ক বক্তব্য। যে বক্তব্যকে নিন্দাসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কিন্তু কিছুতেই উপন্যাস হতে পারে না এই গ্রন্থ।

 তবু কেন এটাকে উপন্যাস বলা হয়েছে? একটি কারণ হতে পারে জীবনানন্দ দাশের সম্মানহানি করার মামলা এড়ানো। অপ্রকাশিত একটি উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে যদি তিনি বুদ্ধদেব বসুর চরম অপমান এবং অবমাননা আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে তিনি সরাসরি জীবনানন্দের নাম উল্লেখ করে যেসব কুৎসিত অমূলক অভিযোগ করেছেন তা নিয়ে যে কেউ মামলা করতে পারে তাঁর বিরুদ্ধে। কেননা তিনি কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ করে অনুমানের ভিত্তিতে একজন লেখকের সুনামহানির চেষ্টা করেছেন। ‘তিসিডোর’ গ্রন্থটি যদি উপন্যাস হয়ে থাকে তাহলে সাহিত্যের অভিধান থেকে উপন্যাসের সংজ্ঞাটিই তুলে দিতে হবে। 

কোন যুক্তি না থাকলেও তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া গেল- জীবনানন্দ দাশ সত্যি সত্যি বুদ্ধদেব বসুকে মনে মনে হিংসে করতেন। সেই ঈর্ষা তিনি গোপনে একটি খাতায় লিখে রাখতেন উপন্যাসের আকারে। মুখে কখনো বলতেন না। কেউ জানে না তাঁর হিংসা বিদ্বেষমূলক মনোভাব। সাথে এটাও ধরলাম যে জীবনানন্দ দাশ নামক ব্যক্তিটি কখনোই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হননি। কয়েকটি কবিতা ছাপিয়ে জীবনভর ব্যর্থ হয়ে সাধারণ এক বরিশাইল্যা সাহিত্যিক হিসেবে ইহলোক ত্যাগ করলেন ১৯৫৪ সালে। তাঁর প্রয়াণের অর্ধশত বছর পর তাঁর কোন বংশধর খাটের নীচে একটা খাতা পেয়ে গেল। তারপর সে ‘সফলতা নিষ্ফলতা’ নাম দিয়ে একটা বই ছাপালো। সেই বইটি কেতকী কুশারী ডাইসনের হাতে গিয়ে পড়লো। তখন তিনি কী করতেন? কোন এক অখ্যাত বরিশাইল্যা জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস পড়তেন? মনে হয় না। যদি পড়তেন তবুও কী তিনি ‘তিসিডোর’ নামের ঢাউশ একটি বই লিখে জগতকে জানাবার চেষ্টা করতেন যে জীবনানন্দ নামের এক বরিশাইল্যা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে মনে মনে অপমান করেছিল বাহাত্তর বছর আগে?  

কষ্টকল্পনা ছাড়াই বলে দেয়া যায়, তিনি তা করতেন না।  

কিন্তু এখন জীবনানন্দের সেই তুচ্ছ পুস্তকটি নিয়ে তিনি অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন কেন? কারণ জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় তেমন খ্যাতির নাগাল না পেলেও মৃত্যুর পর মহীরূহ হয়ে উঠেছিলেন। এতই বিশাল সেখানে বুদ্ধদেব বসুর মতো অনেক বড় বড় কবিকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী কবি হিসেবে তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাঁকে বড় করে তোলার এই কাজটা করেছে সময়। জীবনানন্দ নিজেও পারেননি নিজেকে এতখানি তুলে ধরতে। কেতকী নিজেও জানতেন তাঁর এই বইটি বিক্রি হবে ‘কেতকী কুশারী ডাইসন’ নামের কারণে নয়, এই বইয়ের সাথে ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামটি জড়িত বলে। তিনি জীবনানন্দ দাশকে অখ্যাত এক উপন্যাসের জন্য নিন্দাঝড়ে ধুয়ে দিলেও তাঁর নামের কাছে নিজেকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু একজন অখ্যাত বরিশাইল্যা জীবনানন্দ হলে পুরো বাংলা সাহিত্যের সব দিকপালকে প্রকাশ্যে বই ছাপিয়ে গালি দিলেও তিনি কিছু বলতেন না। জীবনানন্দ দাশের মরণোত্তর খ্যাতি প্রাবল্য কারো কারো গায়ে এত জ্বালা ধরিয়েছিল। 

প্রিয় কেতকী কুশারী ডাইসন, আপনি বুদ্ধদেব বসুকে ভালোবেসে স্বতঃপ্রণোদিত এই কাজটি করেছেন বলে জানিয়েছেন। যাকে ভালোবাসি তাকে আমরা রক্ষা করার চেষ্টা করি। আপনিও তাঁকে রক্ষা করার চেষ্টাতে এই উপন্যাসটি লিখেছেন। তাই আমরা জেনেছি আপনার বাণী থেকে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু কে রক্ষার প্রয়োজন পড়লো কেন? বাংলাসাহিত্যে তিনি তো তাঁর নিজস্ব খ্যাতির বৃত্তেই অবস্হান

করছেন! প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক তিসিডোর প্রকাশের পেছনে আপনার গূঢ় উদ্দেশ্যটা কী? আপনি কিংবা আপনার রচিত ‘তিসিডোর’ এর আগে কেউ বলেননি বুদ্ধদেব বসু কখনো অপমানিত হয়েছেন জীবনানন্দের কাছে। বরং অন্যদের চেয়ে জীবনানন্দের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ভালো ছিল একটা পর্যায় পর্যন্ত। একটা সময়ে দূরত্ব এসেছিল ঠিক, কিন্তু তাতে কোন বিদ্বেষ কিংবা বৈরিতা আছে বলে জানা যায় না। দুজনকে নিয়ে তুলনা করার মত কোন বিষয়ও ছিল না। সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক মাত্রেই জানে যে বুদ্ধদেব এক জাতের সাহিত্যিক, জীবনানন্দ আরেক ঘরাণার সাহিত্যিক। কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বীও নন। আপনি জোর করে টেনে দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করাবার কাজটি কেন করলেন! আর এমন সময় করলেন যখন দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে বহুবছর আগে। আপনার এই কাজটা বুদ্ধদেব বসুকে বিন্দুমাত্র উপকৃত করেনি, কিন্তু জীবনানন্দের সম্মানহানি করেছে। মাঝখানে আপনি তিসিডোর লিখে, অনাকাঙ্ক্ষিত একটা বিতর্ক উস্কে দিয়ে নিজের প্রজ্ঞা-মেধা এবং রুচিবোধকে বরং প্রশ্নবিদ্ধ করলেন।

আপনার ‘তিসিডোর’ বাংলা সাহিত্যের কোন উপকার করেছে বলে মনে হয় না। যা উপকার হয়েছে তার ভাগ আপনি আর আনন্দবাজার দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আপনাদের দু’পক্ষের আর্থিক লাভ হয়েছে বইপত্র বিক্রি এবং রয়েলটি দিয়ে। 

আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে জীবনানন্দ দাশ এবং বুদ্ধদেব বসু, দুজনের সৃষ্টিকর্ম নিজ নিজ মহিমা নিয়েই বেঁচে থাকবে। জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আপনার এই অপ্রয়োজনীয় ব্যবচ্ছেদ শুধুমাত্র সাহিত্যিক কুৎসার উদাহরণ হয়ে থাকলো। জীবনানন্দ দাশের ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ পড়ে আপনি যেমন অনেক রাত ঘুমোতে পারেননি, আপনার ‘তিসিডোর’ পড়েও আমার কয়েক রাত নির্ঘুম কেটেছে। নিরীহ এক কবিকে নির্দয় আক্রমণের আঘাত আমার বুকেও গভীরভাবে আঘাত হেনেছিল। তারই সামান্য প্রতিক্রিয়া এই আলোচনা।

---------------



লেখক পরিচিতি:

হারুন রশীদ

গল্পকার। অনুবাদক। ইতিহাস লেখক

চট্রগ্রামে বসবাস করেন।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ