কবিতার কাছে আত্মসমর্পণ করা মানুষ যখন গল্পকে কাছে ডাকেন তখন গল্পের মাধুরী যেন সানন্দেআত্মসমর্পণ করে সেই মানুষের কাছে। কবিতার মখমলী ডানা আর বৃষ্টি ঝরোঝরো অনুভবের নির্যাস মিলেমিশে তখন কবির হাতে তৈরি হতে থাকে আশ্চর্য সব গল্প।
বহুবিধ ঘটনার অভিঘাত আর মানবিক সম্পর্কের বৈচিত্রের সমন্বয়ে কোনোপ্রকার বাহুল্য ছাড়াই কবি সুমী সিকানদার লিখেছেন এমন আশ্চর্য সব অপরের গল্প।‘সব গল্প অপরের’ গল্পগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি গল্পের প্রথম বাক্যটিই একধরনের আকর্ষণ তৈরি করে তারপর তরতরিয়ে এগিয়ে চলে সুরেলা সব শব্দের চাকায়। একসময় বুক হুহু করা সমাপ্তিতে পৌঁছে যায় গল্পের রথ। নিজের নয় অপরের গল্পগুলোই তখন পাঠককে ভাবায়, গ্লানিতে আহত করে, বেদনায় বিদ্ধ করে।
১৩৫ পৃষ্ঠার এই গল্পগ্রন্থটি ২০১৮ সালে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত। এর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।
সুমী সিকানদারের ‘সব গল্প অপরের’ কিছু গল্প পড়তে পড়তে আক্রান্ত হয়েছি বিষণ্নতায়। এই বিষণ্নতা যেমন মানব আচরণের বৈচিত্রের জন্য তৈরি হয়েছে তেমনি সুখের জৌলুশে ঢেকে থাকা মানুষের গোপন দহনের জন্যও তৈরি হয়েছে। পাঠের সময়কালে মানুষের পলকা সম্পর্কযাপন, নগ্ন, নিষ্ঠুর বাস্তবতার জন্য কাতরও হয়েছি। নির্লিপ্তভাবে বলে যাওয়া কিছু গল্প স্তব্ধ করেছে। আবার জীবনের বহুমাত্রিকতা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে নিয়েছে।
একজন মায়ের দিনলিপির গল্প ‘কাঁটাছেঁড়া পাতা’র পাতাগুলো জোড়া দিতে দিতে মাটি, মীরা সুলতানা, মৈনাকের জীবনের ভয়ংকর সব গল্প বেরিয়ে আসতে থাকে। মানুষের ন্যাক্কারজনক রিপুতে মুখে ঘৃণার ক্লেদ থুতুর মতো জমা হয়। গল্পের ফ্রেমে আটকে যাই, দেখি কী করে ‘এক ভুল ঠেকাতে অজস্র ভুলের আঠা’ মীরার জীবনে পর পর জুড়ে গেছে যা শোধরানোর আর কোনো উপায় নেই। তাই হয়তো মীরার দিনলিপিতে বাড়তে থাকে কাঁটাছেঁড়া পাতার সংখ্যা।
‘প্রেমে প্রেমে বাজে’ গল্পটি শুরু হয়েছে শব্দের মূর্ছনায়। পড়তে পড়তে দগদগে হলদে সরিষা ক্ষেত, ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা মর্মর, একজন কিশোরের কোঁকড়া জীবন ফুটে উঠছিল চোখের সামনে। কিন্তু
আকাশজুড়ে মেঘ করে গল্পের বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে নামার আগেই কিশোরটি তার কাঁধে শান্তিনিকেতনী পাটের ঝোলার ভেতরে সব মেঘ পুরে মায়ের কাছে ছুটলো। আর হুট করে ফুরিয়ে গেল গল্পটি, মনও যেন ভরলো না তাই।
মায়াবৃক্ষের শেকড় কি খুব গভীরে থাকে? চাইলেও কি উপড়ানো যায় না? সংসার কি এই মায়াবৃক্ষের কুহক? নাকি লোভের ঝকমারি পাতায় সাজানো কোনো কৃত্রিম গাছ? পার্লারে কর্মরত মায়াবী আর তার সেবাগ্রহীতা আধুনিক তরুণী মিমির গল্প ‘জার্নি’ পড়তে পড়তে এই প্রশ্নগুলোই উঁকি দিচ্ছিল মনের ভেতরে।
উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ‘শাঁসহীন নারিকেলের বীভৎস ক্ষতবিক্ষত’ বহিরাংশের মতো উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ওদের দুজনের সংসারের গল্প যা কঠিন আর নির্মম।
‘একাকী আম্পায়ার’ অটিস্টিক বাচ্চার মা নীনার একা লড়াই করে যাবার গল্পই শুধু না, বন্ধু মিলা আর
শিমুলের বিশ্বাসহীনতার গল্পও। সন্তানের ফিকে হয়ে যাওয়া শৈশবের মতো নীনার দাম্পত্যের আলো ক্রমশ নিস্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। একটা সময়ে সন্তানের পিতা আর প্রিয় বন্ধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে নীনা একাকী আম্পায়ারের মতো।
নারী ও পুরুষের মাঝে এমনও সম্পর্ক হয় যা গন্তব্যহীন, হয়তো এ সম্পর্ক একদিন ‘কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে খেয়ে নিচে নামতে থাকে।’ তপন আর বিপাশার সম্পর্কটা এমনই তবু একদিন বিপাশা হেঁয়ালিভরে তপনকে বলে ফেলে, ‘আপনাকে ভালোবাসি খুব।’ বিপাশা জানে, যার সন্তান অটিস্টিক, স্বামী আরেক সংসার করছে, রাতে যাকে একা একা ফিরতে দেখে প্রতিবেশীরা আড়ে-ঠাড়ে তাকায় এই সংসারে তার এইরকম গন্তব্যহীন ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। তবু ‘শুকতারা’ গল্পের বিপাশা নকল একটা সম্পর্ক গড়ে তপনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।
‘কান্নার নাম নেই’ গল্পের প্রিয়া আর অমিতের সম্পর্কও এমন লক্ষ্যহীন। অনাগত সন্তান আর দাম্পত্যের বেড়াজালে বাঁধা পড়ে থাকলেও প্রিয়া কেন যেন অমিতের সঙ্গ থেকে ছাড়াতে পারে না নিজেকে। তাই নামহীন কান্নায় গোপনে কেঁদেই চলে সে।
‘সাবিরা নামের মেঘ’ গল্পের দিয়া বিকেলের ফুলটোক্কা রোদে ঈষৎ লম্বা ফর্সা কারো ছায়া খোঁজে অফুরান। ভিন্নধর্মাবলম্বী দুটি কিশোরকিশোরীর মেঘ অনুভব ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে রাখে একটা লাল জ্যামিতি বক্স ঠাসা চিঠি। তবু কী করে যেন একদিন লম্বা ছায়ার ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে যায়। গল্পকার অবশ্য শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ঠিক নিখোঁজ বলা যাবে না। বরং আত্মগোপনকারী বললেই এ শব্দের প্রতি সুবিচার করা হয়।’
‘কোনো চিরকুট নেই’ গল্পের জিনাত ছয় মাসের মেয়েকে রেখে চলে যায় কোনো চিরকুট না রেখেই। খুব
সাদামাটা মেয়ে জিনাত যে কাপড়ে ব্লক করতো, কুরুশ-কাঁটায় কভার সেলাই করতো, রাত জেগে নোট করতো, বাংলা ছায়াছবি দেখে ফোঁসফোঁস করে কাঁদতো সেই জিনাত মায়ার পৃথিবী ছেড়ে যায় বিনা নোটিশেই। অন্তঃসত্ত্বা জিনাতের শরীর থেকে সভ্যতার কাপড় সরিয়ে নিয়েছিল একজন কদর্য পুরুষ। জিনাতের এভাবে চলে যাওয়াটাই বাস্তবের মতো ধ্রুব সত্যি তাই হয়তো গল্পের সমাপ্তিতে অবাস্তব কোনো সমাধান আনেননি গল্পকার।
‘সব গল্প অপরের’ গল্পগুলো খুব বেশি দীর্ঘ নয়। স্বল্প পরিসরে গল্প বলার ক্ষমতা আছে কথাশিল্পী সুমী সিকানদারের। তাই এই বইয়ের গল্প পাঠ করতে করতে ক্লান্তি জাগেনি বরং প্রতিটা গল্পের ছকে এমনভাবে আটকে গেছি যে সমাপ্তি পর্যন্ত যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আবার কিছু গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছেও অতৃপ্ত থেকেছি, মনে হয়েছে লেখক আরেকটু উদার হলে আরও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যেতো গল্পের রস। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই জীবনের বহুখুপি বাকশে বন্দি গভীর-গোপন গল্পগুলো প্রকৃতঅর্থে নগ্নভাবেই ধরা দিয়েছে ‘সব গল্প অপরের’ পাতায় পাতায়। তাই গল্পগুলো আর অপরের থাকেনি, হয়ে গেছে পাঠকের একান্ত নিজের।
0 মন্তব্যসমূহ