সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা : গল্প লেখার গল্প



'সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা' বইটিতে গল্প রয়েছে মোট ১৪টি। এবং সময়কাল ধরলে প্রায় দশ বছর ধরে এই গল্পগুলো লেখা হয়েছে। লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে; এখন খেয়াল করলে দেখা যায় বেশিরভাগ গল্পই লেখা হয়েছে আত্মসংকটকালে।

লেখাই আমার পেশা বলে প্রায় সব সময়ই আমাকে লেখার ভেতরে থাকতে হয়। তা টিভি ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য হোক কিংবা সিনেমার গল্প। ফিকশন-ননফিকশনের জনপ্রিয়ধারার শ্বাসরোধী চাপে কখনো কখনো নিজের কণ্ঠস্বর হারাতে বসে। মনে হয় আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, বলার জন্য তৈরি হয়েছিলাম তা এখনো বলে উঠতে পারছি না। কিংবা পারলেও যেভাবে বলা উচিত তা হয়ে উঠছে না। তখন নিজের বিরুদ্ধে একটা শরীর দাঁড়িয়ে যায় সামনে। সেই ছিপছিপে মফস্বলী শরীরটাকে আমি ভয় পাই। শরীরটা থেকে এড়াতেই লিখতে বসতে হয়। কখনো কখনো দারুণ 'অন্যান্য' কাজের ভেতরেই। কখনো কখনো দিনশেষে রাজ্যের ক্লান্তির মধ্যে। কখনো কখনো সকালের প্রিয় ঘুমটাকে হত্যা করে কাকেদের সাথে।
আমাকে তখন লিখতে হয় নিজের ভেতর থেকে নিজেকে মুক্ত করার চাহিদা থেকে। এই অবস্থাটি আনন্দদায়ক না। এই অবস্থার ভেতর পড়লে চেষ্টা করলেও ভালো থাকা যায় না। বাস্তবিক থাকা যায় না। আশে-পাশের মানুষেরা বুঝতে পারে আমার ভেতর 'ঝামেলা' চলছে। তারাও তখন আমাকে এড়িয়ে চলে; বা এমন হতে পারে, আমিই তখন তাদের এড়িয়ে চলি।

এমন সংকট মুহূর্তে লেখা কিছু গল্প এই বইটিতে রয়েছে। নাম গল্পটি… অর্থাৎ 'সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা' বা 'বাইলা মাছের কারি' বা 'অবিশ্বাস্য অগ্নিবন্ধ্যাকালে' গল্পগুলোর কথা মনে করতে পারি। এগুলো লিখতে হয়েছে অস্তিত্বসংকটকালীন অবস্থায়। বারবার মনে হয়েছে এমন কিছু না লিখতে পারলে নিজেকে আর কোনোভাবেই শান্ত রাখতে পারব না। একটা ঘোরের ভেতর থাকতে হয়েছে তখন।

'অবিশ্বাস্য অগ্নিবন্ধ্যাকালে' লেখাটি লিখে যদিও ভুলে গিয়েছিলাম যে ওটি লিখেছি। এবং লিখেছিলাম এ কারণে যে আমার কাছে তখন মনে হচ্ছিল, আসলে এখনো মনে হয়, আমরা আসলে আদিম যুগে প্রবেশ করেছি। অথবা আদিমতারও আদিম কোনো সভ্যতা আমরা গঠন করে চলেছি প্রতিনিয়ত। একটি শিশু আগুন আনতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় এবং তার গুম-হত্যা-ধর্ষণ নিয়ে খুবই সহজে আমরা ধারণা শুরু করতে পারি… এ আমাদের এই সময়টাকে নির্দেশ করে যে আমরা আসলে বরফ হয়ে গেছি। শীতলে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে শিশুটি বা শিশুটির মতো কেউ যখন আগুন নিয়ে ফেরত আসে তখন আমরা না আগুনকে, না শিশুটিকে, কাউকেই আর গ্রহণ করতে পারি না। আমি মনে করি আমরা এখন নির্লিপ্ত গ্রহণহীনতার সময়ে আছি। এই সময়টা সম্ভাবনাহীন। নিকষ। এবং অবশ্যই হতাশাব্যঞ্জক।

‘বাইলা মাছের কারি' লেখার আগে আমার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করি। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার সময়টাকে বলছি না। নানা কারণে এড়িয়ে যাচ্ছি। মিথ্যা খুশির দিন হিসেবে প্রতিটা দিনকে পালন করছি। ফেসবুক করছি, সিনেমা দেখছি, স্ট্যাটাস লিখছি… কিছু গল্পও লিখছি, কিন্তু কিছুতেই রাষ্ট্রের অনুবাদ করছি না। কেন করছি না? অথচ আমার প্রায় প্রতিটি লেখাতেই রাষ্ট্রই তো প্রতিপক্ষ। রাষ্ট্রকে আমি ভালোবাসি তাই রাষ্ট্র আমার প্রতিপক্ষ নাকি রাষ্ট্রকে আমি এড়াতে পারি না তাই আমার প্রতিপক্ষ এ বিষয়ে এখনো যদিও নিশ্চিত হতে পারি নি। কিন্তু রাষ্ট্র যে আমাদের মৃত বানিয়ে ফেলেছে তা তো অস্বীকার করার কোনো জো নেই। এবং আমরা যে মৃত সে সম্পর্কেও আমাদের খুব বেশি সুবিধার ধারণা যে আছে তাও অবশ্য নেই। কারণ আমাদের মনে হচ্ছে. বা আমাদের মনে করতে সাহায্য করা হচ্ছে যে, আমরা ভালো আছি। সুখে আছি। ক্রসফায়ার হচ্ছে, গুম হচ্ছে, হত্যা হচ্ছে… আমরা খবর দেখছি, ঘুমাচ্ছি, জাগছি, আমড়ায় লবণ লাগিয়ে খাচ্ছি, ঠেকুর তুলছি এবং ভাবছি যে বেঁচে আছি। কিন্তু তলিয়ে ভাবতে গেলে এখন কারই না এমন একটা সংকট দাঁড়িয়ে যায় যে আসলেই কি আমরা বেঁচে আছি? নাকি মারা গেছি? নাকি বাঁচা আর মরার এক অদ্ভুত সংকটের ভেতর রয়েছি? এরচেয়ে ভালোমতো মরে যাওয়াই কি ভালো ছিল না!

‘সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা' গল্পটি আমার দৃষ্টিতে প্রচণ্ড নারীবাদী একটি গল্প। আমার প্রিয় গল্প। কীভাবে এ গল্প লেখা হয়েছে তা আগেও কয়েকবার বলেছি। মূলত আত্মসংকট আর সময়ের নির্যাসের রসায়নে বেরিয়ে আসা এই গল্পটি আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছিল। শুনেছি লিওনার্দো ভিঞ্চি যেখানে যেতেন সেখানেই তিনি তাঁর 'মোনালিসা'কে নিয়ে যেতেন। সবাইকে বলতেন এটিই তাঁর সেরা শিল্পকর্ম। কেউ কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতেন, মৃদু হেসে লিওনার্দো তর্কটাকে পাশ কাটাতেন। একরৈখিক না হওয়ার কারণে এবং ভেতরে আরো অনেক লুকানো সংকেত থাকার কারণে 'সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা'কেও আমি আমার সাথে সবসময় রাখি। নিজের কোনো লেখা পড়তে না বললেও এই গল্পটিকে আমি পাঠ করতে বলি। ওপরের দুটি গল্পের গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমি বারবার 'সময়'কে উল্লেখ করেছি। তাকে ধরতে পারা না-পারার কথা বলেছি; কিন্তু সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরাকে আমি শুধু সময়ে আটকে রাখতে চাই না। এটিকে আমি কালের প্রবাহে দেখার অনুমান করি। মনে হয় এ গল্পটি দিয়ে আমি সময়কে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি।

আত্মসংকট এবং সময়কে ধারণ ইত্যাদি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গল্প লেখা যখন এতই দুরূহ-বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে তাহলে কেন গল্প লিখছি এমন একটা প্রশ্ন আসতে পারে। জবাবটা খুব ছোট… লেখা শেষে যে আনন্দময় পরিস্থিতি তৈরি হয় তা আর কিছুর সাথে তুল্য না। শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছিপছিপে শরীরটাও তখন ঝুঁকে একটা সালাম দেয় অথবা বুকে লাগায় অথবা মিষ্টি হেসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। মনে হয়, যাক তাহলে বেঁচে আছি! তাহলে বেঁচে আছি! বেঁচে আছি!

তবে গল্প লেখা সব সময় এমন সংকট ও উত্তরণের পরিস্থিতিতে আবদ্ধ থাকে না।
কখনো কখনো এটি 'রানার' এর কাজ। সূর্য ওঠার আগে লিখতে হবে! আবার কখনো এটা ভীষণ চ্যালেঞ্জেরও। বিষয় নির্ধারিত… এমনকি শব্দ সংখ্যাও। আপনাকে লিখতে হবে তার মধ্যেই।
এভাবে কি লেখা সম্ভব?

আমার কাছে মনে হয়েছে সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জটা নিতেও আমার খুব ভালো লাগে। পত্রিকা থেকে যখন ফোন আসে বুঝতে পারি 'বিষয়'ভিত্তিকই কিছু চাইবেন তারা। কখনো কখনো শব্দ সংখ্যা এবং দিন-তারিখও বেঁধে দেয়া হয়। আর আমি, অদ্ভুতভাবেই, নিজের ভেতর একটা টগবগে কিশোরের উলম্ফন দেখি। একদা সে ব্রিজ থেকে পুনর্ভবায় ঝাঁপিয়ে পড়ত, ক্ষেতের টমাটো চুরি করে খেতো, রেলের পাথর কুড়াতে কুড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে যেত ভিনদেশে… আমি একটা চ্যালেঞ্জ একটা থ্রিলের ভেতর প্রবেশ করি লহমায়। সব কিছু দ্রুততার মধ্যে… কিন্তু নতুন কিছু…! শব্দসংখ্যাও জানেন আপনি কিন্তু তার ভেতরেই তৈরি করতে হবে ঘোর! সব কিছু আখ্যায়িত করতে পারবেন না আপনি কিন্তু তার ভেতরেই আপনাকে রচনা করতে হবে অবিস্মরণীয় কিছু। লিখতে হবে প্রিয়তম লাইন। লিখতে হবে আপনার মনের মতো গল্প।

এমন কিছু গল্পও আছে এই বইটিতে। পেছন ফিরে দেখলে মনে করতে পারি 'শোনো গো দখিনও হাওয়া' বা 'বলদ' বা 'একটি রাতের গল্প' আসলে এমনই গল্প।

একদিন সম্পাদক সাহেবের ফোন… শোনেন, আমাকে একটা প্রেমের গল্প দিন।
আমি জীবনেও প্রেমের গল্প লিখি নি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে প্রেমের গল্প লেখা ভীষণ কঠিন একটা ব্যাপার। অনেক তলোয়ারের ওপর হাঁটার মতো। একটু এদিক-ওদিক হলে পিছলে রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণ রক্তপাত সামলে নেয়া গেলেও সাহিত্যিক রক্তপাত সামলানো কঠিন। আমি তাই বললাম, আমি তো প্রেমের গল্প লিখতে পারি না ভাই। কোনোদিন লিখিও নাই।
সম্পাদক নাছোড়—পারবেন পারবেন। আপনি লেখেন না, ঠিকই পারবেন!

সম্পাদক ফোন কেটে দিলেন। আমি চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে অনুধাবন করলাম আমার ভেতর থেকে আমার কৈশোর বেরিয়ে আসছে। সে ব্রিজ থেকে লাফ দিতে চায়, লুকিয়ে সিগারেট খেতে চায়, সে স্বকল্পিত প্রেমিকার বাড়ির সামনে সন্ধ্যা কাটাতে চায়…

আমি প্রেমের গল্প লিখতে বসলাম। লিখতে লিখতে যে লেখাটি দাঁড়ালো শেষ পর্যন্ত তা আমার প্রেমের গল্প মনে হলো না। মনে হলো সম্পর্কের সংকটের গল্প… এবং ওই ঘুরে-ফিরে আত্মসংকটেরই গল্প। আমি ভয়ে ভয়ে লেখাটা পাঠিয়ে সম্পাদককে বললাম, ভাই গল্প হয়েছে। কিন্তু গল্পটা ঠিক প্রেমের হয় নি।
সম্পাদক দীর্ঘক্ষণ পর জানালেন… আচ্ছা কী জানালেন সেটি এখানে নাইবা বলি!

এমন আরেক পরিস্থিতি ছিল 'বলদ' গল্পটা নিয়ে। সম্পাদক বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো গল্প পাঠাতে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখাতেও আমার বিশেষ ভীতি। এই ভীতি নতুন কিছু লিখতে না পারার ভীতি। এই ভীতি অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার ভীতি। যে ঘটনাকে আমি চাক্ষুষ করি নি তার প্রতি সৎ থেকে কীভাবে বয়ান করি? এছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু লেখার আরেকটা কঠিন ব্যাপার রয়েছে। তা হলো ক্লিশে হওয়ার ভয়। অনেক লেখা হয়েছে… এবং এও ঠিক যে একই রকম অনেক লেখা হয়েছে। ভিন্নভাবে দেখার ইচ্ছা যেমন অনেকের ছিল না; কেউ কেউ দেখতে চাইলেও প্রকাশ করতে পারেন নি বলেই আমার ধারণা। 'বলদ' গল্পটা তাই লেখার সময় এই রকম দুটো পরিস্থিতি এড়ানোর উপায় খুঁজেছিলাম আমি। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে সেটা পাঠকের বিবেচনা।

একটি রাতের গল্প…
এবং এটিও সম্পাদকের ফোনকল। বেঁধে দেয়া সময় ও শব্দসংখ্যা। এবং অবশ্যই বেঁধে দেয়া বিষয়। কী বিষয়? বিষয় হলো ভৌতিক। অর্থাৎ ভূতের গল্প লিখতে হবে। একটা লম্বা সময় আমি নিজে ভূতে বিশ্বাস করি না বলে ভূতের গল্প কখনো লিখব না এমন এক আদর্শিক অবস্থান নিয়েছিলাম। পরে সে অবস্থান থেকে সরেও এসেছিলাম। পৃথিবীময় এত ভৌতিক গল্প… ভূত না থাক ভূতের অনুভূতি তো অন্তত আছে। এই অনুভূতিকে উপেক্ষা করার দায় আমি নিজে নিজে মাথা পেতে নিচ্ছি কেন? নিজের আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে এসে ভূতের গল্প লিখেওছিলাম আমি। কিন্তু যা হয়… হঠাৎ করে একটা বিষয় মাথার ওপর এসে পড়লে চ্যালেঞ্জে টগবগ করে ফোটাও যেমন সত্যি তেমন সত্যি এও যে, কখনো কখনো, চোখে সর্ষেফুলও দেখতে হয়। তা সর্ষের ভেতরেই নাকি ভূত থাকে--প্রবাদ তো তাই বলে। আমি তাই চোখের সর্ষে মোবাইল ফোনের বোতামে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। এবং লিখতে লিখতে বুঝতে পারি আমি আসলে ভূতের গল্প লিখছি না। আমি অন্য কিছু লিখছি। বিষয় থেকে কবেই আমি বেরিয়ে গেছি। আমি আসলে লিখছি ঢাকার বাইরে থেকে আসা কিন্তু ঢাকায় বসবাস করা মানুষের সংকটের কথা।

আমি নিজে মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করা মানুষ। ঢাকা আমাকে গ্রহণ করে নি বলেই আমার মনে হয়; ঢাকাকে আমিও যে দারুণ ভালোবেসেছি সেটিও মনে হয় নি। অথচ নিজের মফস্বলে গেলে, পুনর্ভবার কাছে গেলে, এখন আাবার ঢাকার জন্যও প্রাণকে কাঁদতে দেখি। উদ্বেগ দেখি। সব মিলিয়ে মনে হয়েছে আমরা এক উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছি। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের লাইন ঋণ করলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে ঝর্ণা থেকে নদী আমরা ঠিকই হয়েছি… কিন্তু না এখন সমুদ্রে মিশতে পারছি, না ফিরে যেতে পারছি ঝর্ণার কাছে। অথচ দুই জায়গায় যাওয়ার আকুতি আমাদের আছে। দুই স্থানের প্রিয় হবার বাসনাও হয়তো আছে। কিন্তু বাস্তবতা তো এই আমাদের শুধুই বয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

গল্প পাঠালাম। এবং দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। সম্পাদক মহোদয় আর কিছু বলেন না। এর মাঝে কয়েক দিন পার হয়ে গেল। বুঝলাম সম্পাদক ভূতের গল্প চেয়ে অদ্ভুত সংকটের গল্প পেয়ে যারপরনাই তিতিবিরক্ত হয়েছেন। যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। তবে চতুর্থ দিনের শেষেই সম্পাদকের ফোন--
: এইটা ভূতের গল্প হয় নাই।
: হ্যাঁ হয় নাই।
: কিন্তু এটা গল্প হয়েছে।
: আচ্ছা।
: এই গল্প আনন্দ নিয়ে প্রকাশ করছি। ভালো থাকবেন।

তা গল্প লিখতে গিয়ে এইসব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভালো থাকা যায়। কিন্তু গল্পই আবার ভালো থাকতে দেয় না। গল্প অস্থির করে তোলে। গল্প না বলে বলা ভালো ফিনিক দেয়া দৃশ্য বা জলজ কোনো বোধ অথবা বিশেষ কোনো চিন্তা অস্থির করে তোলে। পিতার শবদেহ কবরে নামাতে নামাতে তাই চোখ চলে যায় চারপাশে। নিজেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করি এই দৃশ্য লিখতে গেলে কীভাবে লিখবে তুমি? সন্তান-সম্ভাবা স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে শূন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে হয় এখানে কি তাহলে একটা গল্প রয়েছে? আর এসব ভাবতে ভাবতেই গল্প ডালপালা মেলে… চরিত্র এসে দাঁড়ায়। নিঃসঙ্গ একটা চরিত্র। এবং সেই চরিত্রকে বলার জন্য আরো কিছু চরিত্র। একটা রেখা থেকে বিনুনীর মতো আরো সব রেখার পাত জড়াজড়ি হয়ে উঠতে থাকে। তৈরি হতে থাকে 'নার্গিসের কয়েকটি মৃত্যু' বা 'পরিপাথর' বা 'বিশ বছর পরের একদিন'। অন্যদিকে 'পিশাচদিন' গল্পটি অবধারিতভাবে করোনা, লকডাউন এবং তাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন অফিসে কর্মচারী ছাঁটাইকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। করোনা আমাদের শুধু জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে তা তো না, আমাদের যাপনকেও করে তুলেছে অনিশ্চিত। কাজ হারানোর ভয় নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে চাকরিজীবীদের। জীবনের যে মান উন্নয়ন করে চলেছিল মানুষেরা সেখানে এসেছে বাধা। 'পিশাচদিন' তেমন সময়ের গল্প। অন্যদিকে 'রমজানের পিশাচ বাপ' বা 'বিদ্যুতের দৌড়' আমার পুনর্ভবা আমার রহনপুর এবং আমার কৈশোরকে বিদ্ধ করার গল্প। সেই সময়টাকে তুলে নিয়ে আসার গল্প। সেই সময়ের মানুষগুলোকে এই সময়ের আলোয় ফেলে দেখার গল্প। এই গল্পগুলো লিখতে আমার আনন্দ হয়। নিজের সাথে আরো বেশি ঘনিষ্ট হওয়া যায়। পাঠককেও একদম সামনে বসিয়ে যেন গল্পটা শোনাচ্ছি এমন অনুভূতি হয়। ফলে এই নিদারুণ সময়েও একটা দারুণ আড্ডা আমার হয়ে যায়।

একেক গল্পের একেকটা অবস্থাই থাকে আসলে। কোনোটা যেমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচানোর জন্য লেখা, কোনোটা আবার উড়ে আসা চ্যালেঞ্জকে জিততে চাওয়ার জন্য লেখা আবার কোনোটা নিজেরই ফেলে আসা টুকরো স্মৃতিকে সময়ের মখমলে সাজানোর চেষ্টায় লেখা… কিন্তু যেটাই লিখি না কেন, আমার মনে হয়, আমি আসলে, আমাকেই লিখে যাই। আমার সময় ও স্মৃতির নির্যাস লিখে যাই। এবং লিখে যাই এ কারণেই যে যে কোনো পরিস্থিতিতেই লেখার পর ব্যক্তিগত আনন্দকে ছড়িয়ে দিতে চাই সবার মধ্যে।

আপনাদের, আমার এই, আনন্দভুবনে স্বাগতম॥




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ