সার সার লোহার খাট। তাতে বসতেই “কেউউওও…উক” করে সমস্বরে মুচড়ে উঠল খাটগুলো। প্রজাপতির মত তিনটে মেয়ে একে অপরের সাথে লেপ্টে বসে আছে। ছয় সাতটা গ্রাম্য সরল মুখ ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রত্যেকের নাকেই একাধিক নাকফুল। প্রত্যেকেই কানে পরেছে অধিক প্রচলিত ডিজাইনের গ্রাম্য কারিগরের বানানো সোনার কানপাশা । কারো কারো মাথায় আধা ঘোমটা। কেউ কেউ আবার ওদের দেখে বয়সের ভারে ঝুলে পড়া বুকে একটুখানি শাড়ি টানতে গিয়েও থেমে যায়, তারারা দেহি আমরার নাতনি গো লাহান ! আইছ গো বুনেরা, বোওহান তুমরারা।
একজন নীলফুল শাড়িপরা মহিলা সাইনির ঝাকড়া হলুদ কালো চুলে হাত দিয়ে অবাক হয়, হায় হায় ও ছেড়ি তোমরার চুল দেখতারি পাক ধরছুইন !
সাইনি বিব্রত হাসিতে মাথা সরিয়ে নিতে চায় । চুলে কাউকে হাত ছোঁয়াতে দেয় না ও । হস্টেল খরচের টাকা দিয়ে চুলে হলুদ রঙ করেছে। কালো চুলে ঝিলিক দিচ্ছে গোছা গোছা হলুদ ডোরা দাগ।
বন্ধুমহলে এমনকি ওর থিসিস পেপারের শিক্ষক পর্যন্ত ঈগল চোখে ঝাড়া দু মিনিট তাকিয়ে থেকে রঙ্গনকে জিগ্যেস করেছিলেন, ওর মাথামুথো ঠিক আছে তো রে ?
রঙ্গন মাথা নাড়তেই ম্যাম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শখের দাম লাখ টাকা। মানুষ যদি জন্তুর চেহারা চায় তো অন্য মানুষের কি!
ল্যাপটপে চার্জার লাগিয়ে সাইনির দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়েই ম্যাম বলেছিলেন, বাহ! বেশ লাগছে তোকে ! মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা জেব্রা আমার ক্লাশ করতে এসেছে ! আয় বোস।
২
নীলফুল মহিলা বালিশের পাশে রাখা রঙিন কাপড়ের ব্যাগের দিকে সরে যায়। অসংখ্য শিরাযুক্ত হাতে ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে আনে কতগুলো সোনালি আঁচ ধরা চিড়ামুড়ির মোয়া। অন্য ব্যাগের অতল ভান্ডারে হাত ঢুকিয়ে বের করে পাকান পিঠা ।
দু চোখে খুশি ছড়িয়ে মেয়েদের সামনে তুলে ধরে, খাওগো ছেড়িরা, আহনের সুময় বানায় আনছি। টেস খারাপ না। খাডি গুড়ে বানানো পিডা খাওছুইননি কুনোদিন !চকচকে চোখে রঙ্গন একসাথে দুটো পিঠা তুলে নেয়। সাইনি মোয়া হাতে দ্রুত হিসেব করতে থাকে, একাত্তরে এদের সবার বয়েস যদি ষোলো, কুড়ি একুশ, পঁচিশ হয় তো এখন কত হবে ?
হাভাতের মত খাচ্ছে রঙ্গন। মোটুদের ক্ষুধা একটু বেশিই থাকে। তাই বলে এভাবে কেউ খায় !
চোরা কনুই মেরে দেয় উর্মি। ওর হাতে অনেকক্ষণ ধরে রাখা একটা মোয়া। ভেঙ্গে ভেঙ্গে একটা মুড়ি বা চিড়ে খুলে খাচ্ছে। যখন তখন যে কোনো খাবার খেতে পারে না উর্মি। মেপে খায়। খেয়ে খেয়ে অযথা মোটা হওয়ার কোনো পিতলে সখ ওর নেই।
এমনিতেই মোটা মানুষ দেখলে বিষ বিষ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধুমছে গালাগাল দেয়। একসাথে খেতে বসলে ওর ভাগের বেশিটা খাবারই চলে যায় রঙ্গনের পেটে। উর্মি তাই হাসায়, অই মুটকি লেইখ্যা রাখোস, তোমার ও মোটু শরীরে বন্ধু আমারও মূল্য আছে !
কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে পিঠা আটকে যায় রঙ্গনের গলায়। করুণ চোখে ঊর্মির দিকে তাকায়। দুই গাল ফুলে ব্যাঙ। তড়িঘড়ি মলিন রঙের একটি শীর্ণ হাত রঙ্গনের পিঠে জোরে জোরে চাপড় দিয়ে বলে, হায় হায় রে কুত্তা মরুক, শেয়াল মরুক, আমার খোকা বাঁচুক। ষাট ষাট ষাট, অস্তে অস্তে খাও গো ছেড়ি। অস্তে অস্তে খাও।
৩
ছয় সাতজন মহিলা শিশুর মত হেসে উঠে , তুমরা একজনও আমরার জিলার ছেড়ি না। তা এহন কও গো ছেড়িরা কি জানতে আইছ তুমরা ?
সাইনি বোঝে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে বলতে এরা বুঝে গেছে যারা আসে তারা জানতে আসে, একাত্তরে তারা কিভাবে ধর্ষিত হয়েছে, কতজন পাকিস্তানী আর্মি ধর্ষণ করেছে, রাজাকাররা তাদের চেনা ছিল কিনা, তাদের বাপ, স্বামী, ভাইদের কি অবস্থা করেছিল আর্মিরা, ধর্ষণের ফলে তাদের কি কারো কোনো সন্তান হয়েছিলো, সেই সন্তান কোথায়, তাদের বাপ ভাই স্বামিরা কি তাদের সহজভাবে গ্রহন করেছিল, কারো কারো যে বিয়ে হয়েছে সেই স্বামি কি কখনো দুর্ব্যবহার করেছে তাদের সাথে ? এই যে দেশ বিদেশে ধর্ষিতা হিসেবে তাদের ছবি, পরিচয় পত্র পত্রিকা, টিভিতে প্রচার হচ্ছে তাতে তাদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজনের পরিবার, পাড়াপড়শী সমাজ কিভাবে নিচ্ছে? সরকার কি কি সুবিধা দিয়েছে তাদের? আদৌ কি দিয়েছে ?
প্রশ্নপত্রের খাতা খুলে মেলে ধরে রঙ্গন, উর্মি রেকর্ড করবে বলে রেডি।
সাইনি উঠে দাঁড়ায়, এই তোরা ইন্টাভ্যু নিতে থাক। আমি অন্যরুমের ওদের সাথে কথা সেরে ফেলি। তাড়াতাড়ি করিস।
মূলত কাউকে কিছু না বলেই ওরা চলে এসেছে এদের ইন্টারভ্যু করতে। সরকারি দলের উদ্যোক্তারা সাহায্য সম্বর্ধনা দিতে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে এই নারীদের।
এরা একাত্তরের বীরাঙ্গনা। দু একজন আবার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে। পথে পুলিশ পাহারা থাকলেও আপাতত ধারে কাছে সাথে আসা আত্মীয়স্বজন ছাড়া কেউ নেই। এই সুযোগ নিয়েছে তিন ডানপিটে মেয়ে।
৪
সাইনি পাশের রুমে কাউকে খুঁজে পায় না। আশ্চর্য তো। হিসেবে আরো ছয় সাতজন থাকার কথা। তারা কোথায় ?
মোট কুড়িজনের ভেতর বেঁচে আছে এই কজনা। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, আগামি কয়েক বছরে বীরাঙ্গনারা বেঁচে থাকে কিনা সেই আশংকা থেকেই ওরা এভাবে ছুটে এসেছে। কিছুটা অন্তত যদি সত্যি ঘটনা জানতে পারে!
আজকাল তো অনেকেই বলছে একাত্তরে ধর্ষণ ফর্ষণ সব ফালতু কথা। প্রমাণ দেখাক দেখি পাকিস্তানীরা ধর্ষণ করেছে কাকে?
সাইনি জানে ধর্ষণ হয়েছিলো। ইতিহাস মিথ্যে বলে না ।
কিন্তু বাঙালি মানসিকতায় সেগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল অসন্মানের ভয়ে। যুদ্ধশিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিদেশে। ফলে ধর্ষিতা মেয়েদের অধিকাংশ তাদের পরিবারের সাথে সমাজের মূল স্রোতে মিশে গেছে। কেউ কেউ আত্মপরিচয় লুকিয়ে পরবাসী । তাই বলে পাকিস্তানীদের নারী নির্যাতন, ধর্ষণ তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। ট্রুথ ইজ অলওয়েজ ট্রুথ।
সরকারী দলের লোকেরা এই কাজটা বেশ ভালো করেছে। সাইনি মনে মনে তারিফ করে আন্দালিবদের। অবশ্যই এই মূহূর্তে এই প্রজন্মের বাঙ্গালীদের জানা উচিত একাত্তরের যুদ্ধে কি কি হয়েছিল বাঙালীদের সাথে।
যদিও সাইনির সাথে সরকারি দলের কারো কারো সাপে নেউলে সম্পর্ক। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিল পরিমাণ সুযোগ পেলেই সাইনি ধুয়ে দেয় সরকারি দলের বিভিন্ন অসাধু নেতা আর তাদের কর্মকান্ডকে। তবে অধিকাংশ বড়ভাই সাইনিকে যথেষ্ট স্নেহ করে। তাদের অনেকটা প্রশ্রয়ও পায় সে । ফলে যেখানে মার খাওয়া একান্ত হয়ে দাঁড়ায় সেখান থেকে গলে বেরিয়ে আসতে পারে ও।
কারণ মতের অমিল হলেও সাইনির সমর্থন সবসময় স্বাধীনতার সপক্ষশক্তির পক্ষে। আর বঙ্গবন্ধু ওর হিরোদের একজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যুক্তিহীন খারাপ কিছু বললেই ও তাকে মেরে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
তবু উদ্যোক্তারা টের পেলে নিশ্চিত ধাওয়া দেবে ওদের। কিন্তু গেলো কোথায় বীরাঙ্গনারা!
৫
কাউকে না পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল সাইনি, এসময় একজন মহিলা এসে রুমে ঢোকে, আপনি কেডা ? সাম্বাদিক?
মিথ্যে কথার মা বাপ সাইনি । যে কোনো মুহূর্তে চোখে মুখে মিথ্যে বলতে পারে ও । তবে “হ্যা সাংবাদিক” কথাটা মুখে এসেও এবার ছররা ছড়ায় না । সত্যি করেই বলে, আমি ছাত্রি।
এবার গুছিয়ে বসে মহিলা। বেশ গোছানো গিন্নিবান্নি চেহারা, এই ইম্বারছিটির ?
মাথা নাড়ে সাইনি।
“বওহায়েন গো ছেড়ি। আমার ছেলেও এইহানে পড়তেছে।
এ সময় একজন ফর্সা লম্বা মহিলা খাটের মাথার কাছে এসে বসে। সাইনিকে দেখেও দেখে না। দীঘল হাঁটুর উপর হাত রেখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে । বাইরে রেলিং জুড়ে পায়রারা নির্ভয়ে ওড়াওড়ি করছে । তাই দেখে একা একাই হাসে মহিলা।
কপালের ডানদিকের ঘূর্ণিতে ছলছল করছে জল। কাঁচাপাকা একবোঝা কার্লি চুল। চোখে মুখে অদ্ভুত কৌতুহল। যেনো এই প্রথম জালালি কবুতর দেখেছে সে। কবুতরগুলোর নীলচে কালো পালকে এত কি আছে দেখার!
সাইনির বুক ধ্বক করে উঠে।
বড়নানু বলত এই নীল কবুতরগুলো নাকি হযরত শাহজালাল রাঃ এর সাথে প্রথম সিলেটে এসেছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে। মাঝে মাঝে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় দূরে। কখনো উড়ে এসে বসে গৃহস্থের উঠোন বা গাছে।
তবে কি ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে কাউকে?
ভালো করে দেখার জন্যে ঘূর্ণিচুলো মহিলার কাছাকাছি গিয়ে বসে সাইনি, উনি--উনাকেও?
হ্যা, সদ্য পরিচিত সায়রাবানু পানের গায়ে চুন লাগিয়ে মুখের একপাশে ঠেসে দিয়ে জানায়, ওর নাম পারভিনবানু। আগে হিন্দু আছিল। বাপ ভাইরা ঘরে নেয়নি। কেমনে নেয় কও ত মাইয়ে! তারার মাইয়ে যে মিলিটারি ছোঁয়া। তারারা আবার আইবোনে, তোরে নিয়ে যাইবোনে এই মিথ্যে বইলা এজম্মের মত ইন্ডিয়া চলে গেছে।
পারভিনবানু ঘাড় ঘুরিয়ে হাসে, আমি বাঁইচা আছি জানলে মা আমরারে সাথে করে নিয়ে যাইতো গো বুন ! বাবা দাদা যে মিথ্যে কইছিল, তোমার পারুল মইরে গেছে গা ! মা তাই চলে গেছে আমরারে ফেইলে। সায়রাবানু গল্প করার মত করে বলে, মিথ্যে বলিস না পারু। তুই যে টেরেনের সাথে সাথে ছুটে গেছিলি, জানালা দিয়ে মা মা করে কতবার কানলি, তোর মা কি একবারও ফিরে তাকাইছিলো তোর দিকে ?
ধরা পড়া চোখে হাসে পারভিনবানু। দু হাঁটুর উপর মাথা রেখে রোদ্দুর দেখে। রোদ্দুর ধুয়ে দিচ্ছে রেলিঙে রাখা লাল গামছা। একটি শিশু গেঞ্জি, মাটির দিকে নত হয়ে থাকা জাতীয় পতাকার রঙচটা পিঠ।
পায়রাগুলো একে অন্যের সাথে খুনসুটি করছে। কি যেন গুনগুন করে উঠে পারভিনবানু । কান্নার মত। দুঃখের মত সুরে। অপরিমেয় স্নেহমাখা গলায় সায়রাবানু বলে, আমার বড়ভাইজান ওরে বিয়ে করে নেছিল তহন। ওর দাদার বন্ধু ছেলো যে। পারুল হল আমার পারভিনভাবি। আমরার মিতে নয়নমণি।
তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে, ওর মাথাটা আইজকাল ঠিক নাই গো ছেড়ি। তাই সাথে আইছি। স্বামি মরে গেছে। ওর মাইয়ারাও পরের ঘরে। মৃত্যুপানা বয়েস হয়ে যাচ্ছে ! বাপমাকে মনে করে আইজকাল খুব কান্দে গো। সায়রাবানুর দরদি চোখে জল ভাসে। আঁচলে চোখ মুছে সরে আসে পারভিনবানুর কাছে, ভাবি আহো দেহি, চুল আঁচড়ায়ে দিই তোমারার।
৬
সাইনির বুকের ভেতর পাথর ভাঙ্গার শব্দ বেজে উঠে । ওর মোবাইলের গ্যালারিতে আঠারো বছরের এক মেয়ের ছবি আছে। পুরনো ছবি থেকে নানাভাবে শুধু মুখটা নেওয়া। তারও কপালের ডানদিকে ঘন গভীর ঘূর্ণি ছিল। হাওড়া জেলার কোনো গ্রামে ছিলো সেই মেয়ের বাড়ি। বাড়ির উঠোনে পাশের বাড়ির আসগরচাচার জালালি কবুতরগুলো উড়ে উড়ে এসে বসত।
একবার একঝাঁক কবুতর সদ্য নেড়ে দেওয়া ধানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কি দুদ্দাড় করে তারা তিনবোন কবুতর তাড়িয়েছিল। সেই সময় কি কারণে যেনো বাপেরবাড়ি বেড়াতে আসা বড় বাজির হাতের লাঠিতে কপাল কেটে গেছিল সেই চুলে চুলে ঘুর্ণি মেয়েটার। সেকি কান্ড !
সাতদিন পরে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ। ছেলের বাড়ি মালদা। তবে গোপন কথা, বিয়ের পরেই তারা চলে যাবে পুর্বপাকিস্তান। মালদার অইপারে মহানন্দা। মহানন্দার অই পারে রাজশাহী জেলা। রাজশাহী দিয়ে শুরু পূর্বপাকিস্তানের। অই দেশের সবাই বাঙ্গালী। ওদেরকে সবাই বলে বাঙ্গাল। কি তাদের কথার ছিরি ! কিন্তু ভারি তেজ তাদের। আগুনে প্রতিবাদি তারা। মুসলিম লীগের যড়যন্ত্রকে লাথি মেরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে প্রাণ দিয়েছে ওদেশের সাহসি ছাত্ররা।
হাওড়ার বাড়ির বারান্দায় খইদুধ খেতে খেতে মেয়েটার আব্বু, আসগরচাচা, জিতেন কাকা, সনাতন কাকা, রহম মুন্সি আহা আহা করে গল্প করত বাঙ্গালদের, ইসস্ যদি সাতচল্লিশে এমন একটা প্রতিবাদ করা যেতো ! শালার দেশ কি আর ভাগ হতে পারত তখন! কি কপাল মাইরি ! আমাদের দেশ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু প্রতিবেশি জমিজমা সব আমাদের, ভাগ করল কিনা শূয়োরের জাত অই ফিরিঙ্গিরা !
ব্যান্ডেজ বাঁধা কপাল দেখিয়ে ঘূর্ণিচুলো মেয়েটা হেসেছিল, ভালোই হলো বাজি। আমার কপালের লেখা মুছে গেলো। এবার নতুন করে লেখা হবে। নতুন লেখা। নতুন দেশ। নতুন করে বাঁচা।
ভেতরে ভেতরে মেয়েটার বাবা ভাইও গুছিয়ে নিয়েছিলো। পুর্ব পাকিস্তানেই চলে যাবে তারা। এখানে হ্যাটা খাচ্ছে রোজ রোজ। আগে আকার ইঙ্গিতে। এখন সামনা সামনি। সেদিন ধানী জমির দুই হাত ভেতরে লাঙ্গল চালিয়ে দিয়েছে রূপসাধন, যাশ্লা ন্যাড়া , কি করবি কর দেখি !
মেয়েটার আব্বু মুখ কালো করে ফিরে এসেছে। পাড়ার মধুসূদন, জিতেন, রাধুরমণরা মিটমাটের অনেক চেষ্টা করে হতাশ হয়ে বলেই দিয়েছে, চলে যা রে তুই। আমরা আর পারছিনে তোদের পাহারা দিতে।
পাকিস্তানে মার খাচ্ছে হিন্দুরা, ইন্ডিয়ায় মার খাচ্ছে মুসলিমরা। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব যেনো আরো বেড়ে গেছে। দুই দেশের কোথাও কোথাও রায়ট হয়ে গেলো। অথচ যুদ্ধ হয়েছে সেই কোথায় কোন ভারত আর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে।
ঘুর্ণিচুলো মেয়েটার বাবার দু একঘর আত্মীয় সাতচল্লিশে চলে গেছিল পূর্ব পাকিস্তান। তারা ডাকছে, চলে আয়। আগে জান ইজ্জত, পরে জমিজমা, ধন সম্পদ। ভাগ তো হয়েই আছে। হিন্দুর জন্যে হিন্দু দেশ, মুসলমানের জন্যে মুসলিম দেশ। অযথা নোক্তা করে কি হবে আর !
৭
বিয়ের দুদিন পরে ঘুর্ণিচুলের মেয়েটা চলে যায় স্বামির সাথে। তাদের শেষ দেখেছিলো সবাই, ট্রেনে। লাল বেনারসিতে তাজা ফুলের মালা গলায় বর কনে সালাম করে উঠে গেলো ট্রেনে। তারপর কেবল চলন্ত ট্রেন থেকে হাত নাড়া। ট্রেনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটার মায়ের ফুঁপিয়ে উঠা, আয়শা মা আমার পৌঁছে চিঠি দিও আম্মু। চিঠি দিও জামাইবাবা।
তারপর দুজনেই হারিয়ে গেছে অনন্ত গতির পথে। মাঝ রাস্তায় চেন টেনে কারা যেনো নিয়ে গেছে আয়শাকে। কেবল মেয়েজামাইয়ের কম্পার্টমেন্টেই ডাকাতি হলো! কেবল মেয়েজামাইকেই তুলে নিয়ে গেলো কারা যেনো। ডাকাতদের ভেতর কাকে দেখে আয়শা চেঁচিয়ে উঠেছিল ! জামাইয়ের গায়ের রক্তমাখা চাদর পড়েছিল লাইনের উপর। আরো কিছু দূরে জামাইয়ের শেরওয়ানী পরা লাশ। কিন্তু আয়শার কোনো চিহ্ন নেই। বছর বছর পেরিয়ে গেছে আয়শা ফিরে আসেনি। ভাইবোনদের নিয়ে আয়শার বড়বাজি মানে সাইনির বড়নানু চলে এসেছিলো পূর্ব পাকিস্তান। তখন উত্তাল উনসত্তর। বাবা মা থেকে গেছিল হাওড়ায়। যদি ফিরে আসে আয়শা !
পারুললতার কাছে গিয়ে বসে সাইনি। সুরটা চেনা, নজরুলগীতি, তুমি আমার সকাল বেলার সুর। এই প্রথম স্বেচ্ছায় কোনো অপরিচিতের মাথায় হাত রাখে সাইনি।
ভ্রুর ভাঁজে ভাঁজে কিছু পাকা চুল, অশ্রুসিক্ত ঘোলা চোখ, নাকফুলহীন অপরূপ সুন্দর নাক, ঠোঁটের পাশে জমে থাকা বয়সি মেঘপুঞ্জ আর চোখের পাশে জেগে থাকা কতগুলো সচল নদীরেখা !
সাইনির হাত গলে যাচ্ছে আরেকটি হাতের ভেতর।
মধুমতি পেরিয়ে রূপসা, গড়াই, পুনর্ভবা, মহানন্দা, পদ্মা, গঙ্গা, সরস্বতী, যমুনা, ঝিলম, বিপাশা, সিন্ধুর সাথে কেঁদে উঠছে নিখিল ভারত, দাদা আইছিলো আমরারে দেইখতে। ডাক্তার, নার্স, বিদেশিরা কত করে বুঝালো ওরে বাড়িত নিয়ে যান। বাচ্চাডা ত মরে গেছে। ও এখন ফ্রি।
দাদা বইল্ল, আইচ্ছা, অশৌচকাল কাটুক তহন আইসবোনে। আমি বললাম, কবে দাদা, ও দাদা কবে আইসবা তুমি? ইন্ডিয়া থে তোমরা কবে আইছ গো আমার সোনা দাদা ? বাবায় কি আইছে তোমার লগে? রন্টু,মন্টু বকুল শিমুল ভালো আছে ত সবাই ? দাদারে দাদা, মায়েরে বড় দেখতে মন পুড়ে রে দাদা ! যুদ্ধের আগুনে জ্বইলে যাওয়া শিরিষগাছের দিকে তাকায়ে দাদায় কইছিল, সবাই ঠিক আছে রে বুইন। তুই ভাল থাকিস।
সাইনির হাত বুকের উপর রেখে ফুঁপিয়ে উঠে পারুললতা, আমারে থুয়ে ওরা চলে গেলো। জম্মের মত চলে গেলো সবাই। শুনতারেছেন বুইনগো আমার বুকের ভিতরি খালি টেরেনের কান্দন ! এই যে কানতেরাছে যাই যাই, যাই যাই, তুই থাক পারু ! যাই যাই, যাই যাই থাক তুই পারু! যাই যাই ---
সাইনির মনে হয় পারুললতাই তার হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজন। সেই বয়েস সেই চুল। ও দুহাতে জড়িয়ে ধরে পারুললতার শুকনো শরীরটাকে। স্বজনের উষ্ণতায় মিশে যায় দুটি প্রাণ।
৮
ম্যামকে এতখানি রাগতে কখনো দেখেনি ওরা। উর্মির অসহায় লাগে। শালা বান্দর এই সাইনির জন্যে এতসব। সব সময় একটা খ্যাচ বাঁধানো ওর জন্মগত স্বভাব। রঙ্গনের আর কি ! ওর তো যাহা বাহান্নো তাই তেপ্পান্নো। নিজেও গড়ায়, পড়াশুনা আরো দু চার বছর গড়ালেও ওর কিচ্ছু আসে যায় না। খাবে আর গড়াবে, ঘড়িয়াল একটা ! ওয়েট টিস্যুতে ঠোঁট মোছে উর্মি, ম্যাম সাইনিকে একটা টাইট দাবড়ানি দিয়ে দেখেন না প্লিজ !
আগুন আগুন চোখে রাজী হয় ম্যাম, এ ছাড়া উপায়ও তো কিছু দেখছি না। আচ্ছা তোমরা সিওর সেদিন সাইনি তোমাদের সাথেই ফিরে এসেছিলো ?
মুখের একপাশে চুইংগাম সরিয়ে রঙ্গন মাথা নাড়ে, একদম ম্যাম। আমরা আসার সময় আন্দালিবভাইয়া চার্জ করছিলো। সাইনি এমন খেউ মারছিল যে আন্দালিব ভাইয়া আর কিছু বলার সাহস পায়নি।
কলমের মুখ এঁটে চিন্তিত হয়ে পড়েন শিক্ষক নাজমা আক্তার। সাইনি হস্টেলে থাকে। সরাসরি রাজনীতি করে না। তবে টান আছে। স্পষ্টত বামপন্থায়। উর্মির বাবা অন্যতম একজন পোশাকশিল্প মালিক। লভ্যাংশ না দিয়ে শ্রমিককে শোষণ করাই মালিকের আসল লক্ষ্য, এই কথা বলে উর্মিকে প্রায়ই ক্ষেপিয়ে দেয় সাইনি, বুঝলি উমু প্রতিটি মালিকই একেক জন রক্তচোষা জোঁক। তা তারা বাবা, চাচা, ভাই স্বামি যেই হোক না কেনো।
উর্মি ক্ষেপে উঠলে একচোখ বন্ধ করে অনিন্দিত মুখে বলে ওঠে, ক্ষেপোস ক্যান তুই! ইডা কি আমি কইছি ? কইছে তো মার্কসদাদু থুক্কু মনে কয় লেনিনমামু । আরেযযা, ডাবল থুক্কু, হইতে পারে মাওচাচা।
উর্মি প্র্যাক্টিকাল মেয়ে। ওর বাবাও। এখনই ছেলেমেয়েকে অফিস করতে বলেছে। দু ছেলেমেয়েকে সমান সম্পত্তি আর দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে নব্য শিল্পপতি সাহেব। কে কেমন কত বেটার পরিচালনা করতে পারে তাই যাচাই করছে। সন্তানদের বিয়েও ঠিক করা আছে দু শিল্পপতির সন্তানদের সাথে। থিসিস শেষ হলেই বিয়ে। উর্মির তাই এত তাড়া।
নাজমা আক্তার খেয়াল করে দেখেছেন, আজকাল ধনীঘরের ছেলেমেয়েরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ভাল স্টুডেন্ট, শিক্ষক, ক্যাডার চাকরিজীবি বিয়ে করতে চায় না। তারা নিজেদের গন্ডির ভেতরেই সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্ভবত পুঁজি হারানোর সম্ভাবনা নেই আর চেনা জানা পরিবেশ বলেই। ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার একেবারে পূর্ণরূপ।
উর্মি নিজেও ভালো স্টুডেন্ট, সুন্দরী, অসম্ভব স্ট্যাটাস সচেতন। ওর ব্যাগ বয়ে আনে একজন সার্বক্ষণিক লোক। চাপা কম্যান্ডিং ভয়েস, কাজ করিয়ে নেওয়ার সূক্ষন দক্ষতায় মুগ্ধ হতে হয়। রঙ্গনকে একেবারে সাধারণ মনে হলেও মোটেও সে সাধারণ মেয়ে নয়। অদ্ভুত ভালোবাসা আছে মেয়েটার বুকের ভেতর। সাইনিকে অন্ধের মত ভালোবাসে। সারাক্ষণ সাইনির অপকম্মগুলো ঢাকতে থাকে আর কিছু না কিছু চিবুতে থাকে। সাইনির জন্যে ওই বেশি বকা খায়। তাতে ওর ছাই হয়। কোনো হেলদোলের বালাই নেই রঙ্গনের মনে।
মুখের খাবার পেটে চালান করে রঙ্গন বলে, স্যরি মিস স্যরি। এই তো এখুনি সাইনি এসে পড়বে। আমরা তো কতদিনই ক্লাশ করিনা। এই তুই যখন ডিজনিল্যান্ড ঘুরতে গেলি আমরা কিন্তু ক্লাশ করিনি উমু। নাজমা আক্তার ভাবে, কথাটা মিথ্যে নয়। অই একমাস ওরা উর্মির জন্যে স্যাক্রিফাইস করেছে। প্রথম কদিন এসেই গল্প জুড়ে দিত। পরে নাজমা আক্তার নিজেই আদিবাসীদের জন্যে একটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রঙ্গন সাইনি এটা নিয়ে কখনো অনুযোগ করেনি। বরং অনেক সময় টুকটাক কাজ করে দিয়েছে।
সাইনি এক্সট্রা ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। চলন্ত জ্ঞানবৃক্ষ। মাঝে মাঝে কি যে হয়। রিফিউজি শব্দটার উপর ওর অসম্ভব ক্রাশ। এই তো সেদিন কোন এক দেশে রিফিউজিদের বেধড়ক মারপিট করছে দেখে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে গেছিল। দেশ মানে কি ম্যাম? একটুকরো মাটি? সবুজতা ? হ্রদ নদী নাকি পাহাড় ? বাঘ, পদ্ম, সূর্য, তরবারি, সেঞ্চুরিপাতা, ঈগল নাকি শাপলা ? দেখুন দেখুন ম্যাম এই বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি দেশ কাঁটাতারে ঘিরে ফেলেছে তাদের দেশকে। দেশ কি খাঁচা ম্যাম ?
নাজমা আক্তারের মনে একবিন্দু দুশ্চিন্তা জমে উঠে সাইনির জন্যে। কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, আরেকবার ফোন কর তো রঙ্গন। এবার যদি ফোন না ধরে তো ওকে বাদ দিয়েই তোদের ক্লাশ নেবো।
ঘাম ছাড়াচ্ছে মেয়েটা। আন্দালিবের সাথে কোথাও গেলে খবর হয়ে যাবে। আন্দালিব ক্যাডার। উপরে ছুপা মাস্তান, ভেতরে নকশা করা মন। ওর উঠাবসাও ক্রিমিন্যাল ক্যাডারদের সাথে। বাহারি চুল আর হলুদ পাঞ্জাবীতে ডিপার্টমেন্টে হিমুভাই বলে বেশ প্রভাব । ফার্স্ট সেমিস্টারের মেয়েরা ক্রাশ খায় ওকে দেখে । প্রায় ডজনখানেক মেয়ে ঝুলে থাকে আন্দালিবের দুই পাশে। কবিতাও লেখে। স্বজনপ্রীতির জোরে তা ছাপাও হয় বড় বড় পত্রিকায়।
সাইনির উপর মনে মনে প্রচুর রাগ আন্দালিবের। ওরাও ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছে। ওদের পার্ক সার্কাসের দোতলা বাড়িটা চলে গেছে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে। রাখঢাকহীন প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষী আন্দালিব।
সাইনি আন্দালিবের তর্কের শুরু হয় ডিবেট ক্লাশে। নাজমা আক্তারই ডিবেটের বিষয় চূড়ান্ত করে দিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বর্তমান প্রজন্মের ভাবনা।
দুই গ্রুপের ভেতর তখন থেকেই কথা কাটাকাটি। তারপর প্রায় মারামারি হাতাহাতি অবস্থা। ডিবেটের নিয়ম কানুন সব ভুলে যায় দুই পক্ষ। সাইনি চেঁচায়, তুই পাকিস্তানের দালাল, পাকিস্তান চলে যা।
আন্দালিব ক্ষেপে উঠে, তুই হিন্দুর দালাল, ইন্ডিয়া চল-- সে কি প্রাণান্তকর অবস্থা। পরবর্তীতে কায়দা করে সাইনি আর আন্দালিবকে আউট করে দিয়েছিল বিচারকরা।
আন্দালিব সরকারি দল করে। বর্তমানে দলটি ঘোর সাম্প্রদায়িক। কেবল নীতি কাঠামোতে অসাম্প্রদায়িক কথাগুলো ম্যাড়ম্যাড় করছে। সুযোগ পেলে এক মূহুর্ত দেরি করে না সাইনি। একবারে ধুয়ে মুছে দেয় কড়া কড়া অকথা কুকথা বলে।
নাজমা আক্তারের কেনো যেনো মনে হয়, আন্দালিব কিছুতেই সাইনিকে ছেড়ে দেবে না। একাত্তরের ঘাতক দালালরা মিশে গেছে দলটির সাথে। আন্দালিব রঙচোরা কুহক নয় তো ? বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠে নাজমা আক্তারের। আন্দালিব কোথায় ? ফোন ধরছে না কেন ! ডিপার্টমেন্টের পিয়নকে তক্ষুণি ডেকে আনে, জালাল আন্দালিবকে খুঁজে আনো। এক্ষুণি এই মূহূর্তে। যাও। ছুটে যাও।
৯
সাইনির মাথা, হাত, পা ব্যন্ডেজে মোড়া। এত কেবল শরীরের বাইরের ক্ষত। যা আশংকা করেছিল সবাই, তাই হয়েছে। সাইনি ইজ ক্রুয়েলি গ্যাং রেপড।
গত তিনদিন সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষক, বন্ধু্রা হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে। সাইনির বাবা মা ভাই এসেছে খুলনা থেকে। কে বা কারা করল এই জঘণ্য অপরাধ ? আন্দালিব জান দিয়ে দিচ্ছে সাইনির জন্যে। ওর দু চোখে কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে রাগী সতেজে, ম্যাম সাইনিকে বাঁচাতেই হবে। ওকে মরতে দেওয়া চলবে না। কিছুতেই না। ওকে আমরা বাঁচাবোই ম্যাম।
নাজমা আক্তার চমকে ওঠেন, আন্দালিবের গলায় কি সমুদ্রের গর্জন! ডাক্তার, নার্স, পুলিশের শত বাঁধা পেরিয়ে কখনো কখনো ও সাইনির পাশে গিয়ে বসে থাকছে। মাথার মোটা ব্যান্ডেজের উপর হাত রেখে ডেকে যাচ্ছে, সাইনি ওয়েক আপ। ওয়েক আপ চ্যালেঞ্জার। তোকে না বলেছিলাম ভৌগোলিক স্বাধীনতা ইজ নট এনাফ ফর হিউম্যান বিয়িং। মানুষের সবচে আগে দরকার মানসিক স্বাধীনতার । এগ্রি ? নো ? ওয়াই নট ? যুক্তি দে। এখুনি যুক্তি দে ! এই তুই কথা বল! কথা বল সাইনি!
ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি, ওষুধের গন্ধ, হাসপাতালের আশাহীন সাদা দেয়াল ছাপিয়ে এক নতুন আন্দালিবকে দেখে স্বস্তি পান নাজমা আক্তার। মানুষের সব ধারণাই সবসময় সঠিক হয় না। অই অসহায় মুমূর্ষু সময়েও এটা ভেবে মনে মনে আনন্দিত হয়ে উঠেন কম্পারাটিভ পলিটিক্সের শিক্ষক নাজমা আক্তার।
আন্দালিবদের পুরো গ্রুপ ছুটছে, ডাক্তার ধরে আনছে, ঘন্টায় ঘন্টায় সাইনির শারীরিক রিপোর্ট নিয়ে স্বজনদের জানাচ্ছে। মুখের রক্ত সরে গেছে রঙ্গন, উর্মিদের। থম মেরে গেছে রঙ্গন, দুবার সেন্সলেস হয়ে গেছে ।
উর্মি আর ওর হবু বর আশ্চর্য দক্ষতায় হ্যান্ডেল করছে সবকিছু। এমনকি ওরা ওদের ড্যাডির সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে ছুটছে থানা, হাসপাতাল, প্রেস মিটিংএ। আইনি সাহায্যের জন্যে ধরে এনেছে নামকরা ব্যারিস্টার।
আর দেশ বরেণ্য সাইকোলোজিস্ট মেহফুজ মান্নান নিজেই ছুটে এসেছেন। অনেকের কাছেই সাইনি শাহাবুদ্দীন একজন প্রিয় বিতার্কিক । বিতর্কে পক্ষে বিপক্ষে সাইনি আর আন্দালিব থাকলে গ্যালারিতে জায়গা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাইনি যখন এক চোখ ছোট করে, কলম তুলে আন্দালিবদের গ্রুপের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তখন গ্যালারি থেকে আওয়াজ ওঠে আসে, ভিভা,ভিভা চ্যালেঞ্জার।
বিতর্ক শেষে প্রতিবার দু একজন মার খায় আন্দালিবের হাতে। মার খেয়েও দাঁত বের করে হাসে, কি করি য্যান হয়ি যায় ভাইয়া। কেমনে জানি সাইনি আপুরে সাপোর্ট করি ফেলাই বুঝতিই পারি না । স্যরি ভাইয়া—
বয়সের ভারে ন্যুব্জ মেহফুজ মান্নান সূতোয় বোনা লেসের সাদা রুমালে মুখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ান, প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারলে বাদবাকি হার্ডলস সাইনি একাই পেরিয়ে যেতে পারবে। আসল কথা হচ্ছে ওর পাশে স্বাভাবিক থাকা। তোমরা ওকে ঘিরে থাকো।
সেন্স ফিরেছে সাইনির। ভেজা টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে যেনো কিছুই হয়নি এভাবে রঙ্গন, আন্দালিব, উর্মিরা কথা বলছে সিরিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া কেমিক্যাল বোমায় শিশুসহ কতজন মারা গেলো, বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে সরকারের ভুমিকা, মাথা চাড়া দিয়ে আবার ওঠা সেই পুরানো গল্প গেলো গেলো ! নদী গেলো, জল গেলো, এবার ভারতের কাছে দেশটাও বিক্রি করে দিলো শেখের বেটি শেখ হাসিনা।
গভীর অতল থেকে ভেসে ভেসে উঠছে সাইনির চেতনা। এরা কারা ? সে তো ট্রেনেই ছিলো। অনুষ্ঠান শেষে সেদিন সন্ধ্যায় সে পারুললতাদের সাথে উঠে পড়েছিলো বাসে। কাউকে জানায়নি। এই তো কাছেই সোহাগপুর । একটা দিন বীরাঙ্গনাদের সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে আসবে ঢাকা। পরেরদিন সকাল এগারোটায় ক্লাশ। কিছুতেই মিস করা যাবে না এই ক্লাশ।
তারপর কি হলো ?
ট্রেনে উঠে চোখ উপচে জল বেরুচ্ছিল ওর। একটা দিনের ভালোবাসায় সাইনির রুক্ষ কর্কশ মন নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। জানালার বাইরে মুখ রেখে অন্ধকারে ছুটে ছুটে যাওয়া গাছগুলো দেখছিলো আর মুছে নিচ্ছিল ঝরে পড়া চোখের জল।
চীৎকার করারও সুযোগ পায়নি সে। জনবিস্ফোরণুন্মুখ দেশে ওর কম্পার্টমেন্টে কজন যাত্রী ছিল একবারও তাকিয়ে দেখেনি। হিসেব ছিলো মনে, দেড় ঘন্টার পথ না হয় দুঘন্টাই লাগবে। টুক করে নেমে যাবে তেজগাঁ ষ্টেশনে। ব্রীজ পেরিয়ে রিকশা বা বাস ধরে চলে আসবে হস্টেলে। এখুনি কাউকে বলবে না এই এডভেঞ্চারের কথা।
আর বোধহয় বলাও হলো না।
মুখের ভেতর গুঁজে দেওয়া কাপড়ে ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কতজন ছিল তাও মনে নেই। কেবল প্রথম দিকের কিছু কথা মনে আছে, শালীরে রেপ বোঝা। আসলি রেপ। পাকিস্তানি স্টাইলে। তারপর লাইনে ফেলে দিবি। বডি হয়ে যাবে শালী।
একটা জোনাক আলো থেকে থেকে নিভে যাচ্ছে মাথার ভেতর। সাইনি বুঝতে পারে ঘন আঠালো এক অন্ধকার ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাইনি ভেসে যাচ্ছে সীমানা বিহীন এক মহাজলস্রোতে। পৃথিবীর দেশ নামের খাঁচাগুলো ছেড়ে ওর আত্মা উড়ে যাচ্ছে কোন মহাশূন্যে।
এইই বুঝি মৃত্যু! কই খারাপ লাগছে না তো। নরম অন্ধকার ঘুম গভীর মায়া ফেলে ওকে তুলে নিচ্ছে কোলে ! রেণু রেণু হয়ে গলে যাচ্ছে সাইনি। কি যে ভালো লাগছে ! শুধু একা যাচ্ছে বলে বন্ধুদের জন্যে কেমন যেনো মায়া লাগছে ওর মনে।
১০
নাজমা আক্তার নতুন উপলব্ধিতে আপ্লুত হতে থাকেন। ক্রমশ ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে হিংসা, বর্বরতা, ঘৃণাকে ছুঁড়ে ফেলে আশাগাছের উদ্বাহু আহবানে এক হয়ে যাচ্ছে লক্ষ কোটি প্রাণ।
সাইনি যেনো এক অমর বন্ধনে বেঁধে দিয়ে গেলো সবাইকে। মৌন মিছিল বড় হচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে মুখবইয়ের অলিগলি রাজপথে। অসংখ্য প্রাণ মিশে যাচ্ছে সে মিছিলে। একাত্মতার যৌথ প্রতিজ্ঞায় দুলে উঠছে প্রতিটা মন।
ভয় নেই বুড়ি পৃথিবী । ভয় নেই।
সাইনির কবরে ফুল রেখে আনন্দে বিষাদে কেঁদে উঠেন নাজমা আক্তার, ভয় নেই ? সত্যিই কি ভয় নেই !
লেখক পরিচিতি:
রুখসানা কাজল
গল্পকার। প্রাবন্ধিক। অনুবাদক।
ঢাকার কলাবাগানে বসবাস করেন।
0 মন্তব্যসমূহ