বাবা বলল, কতবার বললাম, বুড়ির লাল চেলিটা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আয়। চোখের সামনে ওটা আর সহ্য হয় না। ঘরে বসে বসে সারাদিন কী যে ভাবিস। বেরোতে পারিস তো একটু । ডাক্তারবাবুও গালে হাত দিয়ে আমাকে বেশি ভাবতে বারণ করেছেন।
রুটের বাসটা একটু ফাঁকাই ছিল। কিন্তু খালি সিট একটাই। অগত্যা সপ্তাশ্বর পাশে গিয়েই বসতে হোল। জড়তা অবশ্যই ছিল। সেই সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছা করছিল না। অনেকদিন ধরেই এটা আমার ব্যামো হয়ে দাঁড়িয়েছে । তা নিয়ে কথাও শুনতে হয় অনেক। শুনে শুনে ক্লান্ত লাগে। বাসে যেহেতু প্যাসেঞ্জার কম তাই প্রায় সবারই টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কন্ডাক্টার আমার দিকে এগিয়ে এসে ভাড়া চাইল। আমি গন্তব্য বলে ভাড়া দিলাম। ব্যাটা এমনই কালা ,আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব। জবাব দিলাম না। কী বুঝে হাতে একটা টিকিট গুঁজে দিল। এরমধ্যে সপ্তাশ্বর যে দু একবার ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখেছে তা টের পেয়েছি। আমি কথা বলিনি। আমার এই উদাসীনতা হয়তো ও আশা করেনি। কারণ একসময় আমাদের যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। ও ছিল ক্লাশের ফার্স্ট বয়। আর আমি সাপ লুডোর মতো পাঁচ থেকে দশের মধ্যে। এবার বহুদিন বাদে দেখা। আমাদের ছাড়াছাড়ির গল্পটাও অন্যরকম। যা হোক , খানিক উশখুশ করে সপ্তাশ্ব আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, কীরে , চিনতে পারছিস না? ওর প্রশ্নে ভেতর ভেতর বরফ গলার একটা কুলকুল আওয়াজ স্পষ্ট অনুভব করলাম আমি। তাই ঘাড় নেড়ে সায় জানালাম।
-তাহলে কথা বলছিস না যে?
-ভালো লাগে না ।
অভিমান মেশানো স্বরে ও বলল, কাকে ,আমাকে?
-না, কথা বলতে।
-কেন কষ্ট হয় ?
উত্তর না পেয়ে ওই বলল, ডাক্তার দেখাচ্ছিস? অসুখটা এখনো সারেনি তাহলে?
কথাগুলো বলতে বলতে ও খুব তীক্ষ্ণভাবে নজর করছিল আমায়। কিন্তু কথার ঢঙে সহানুভূতির ঘাটতি ছিল না কোন। মনে হলো, আমার সমস্যায় ও সত্যিই দু;খিত। এবং এই সুযোগে পুরোনো স্মৃতিটাও একটু ঘেঁটে নিতে চাইছে। স্মৃতিই তো মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার কাছেও স্মৃতি খুব দামি। আর ডাক্তারি মতে আমি ওই দামি বস্তুটির গাড্ডায় পড়েছি। নইলে কবেই তো বুড়ি চলে গেছে। হ্যাঁ মানছি, মৃত্যুটা ওর স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ওরকম তো কতই ঘটে ! বোনের শ্বশুরবাড়ির লোক খারাপ হয় । তাকে পুড়িয়ে মারে। তা-বলে কি সবাই আমার মতো ? ছেলেটার নাকি একটা অন্য সম্পর্ক ছিল। অবৈধ সেই সম্পর্কের জেরেই বোনের সঙ্গে খিটিমিটি। তার পরিণতি আমার একমাত্র বোনের মৃত্যু। পুলিস আদালত হৈ চৈ সবই হলো। কিন্তু যে যায়, সে কি আর ফিরে আসে? আবার কেউ কেউ চলে গিয়েও যায় না। বুড়ি যাওয়ার পর হাওয়ায় ভাসতে লাগলো কতরকম কথা। সমস্ত ঘটনার জন্য নাকি আমিই দায়ী। সবচেয়ে খারাপ লাগে বাবা যখন বলে, আচ্ছা সোমেশ, তোর সেই বন্ধুটি এখন কোথায় ? তাকে কিন্তু বুড়ি খুব পছন্দ করত। আসলে ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে না ওঠার পেছনের কারণ যে আমিই , বাবাও আমাকে সেটাই বোঝাতে চায়।
সপ্তাশ্ব প্রায়ই আসত আমার কাছে। একসময় রোজই। আমার বোন বুড়ির সঙ্গে ভাব হলো ওর। ধীরে ধীরে ওদের চোখের ঈশারায় বুঝতে পারলাম, ওরা একসঙ্গে ডুব সাঁতার দিচ্ছে। খুব হিংসে হত আমার। এত সহজে সপ্তাশ্ব তার প্রেমিকা পেয়ে যাবে? আমিও তো কতদিন ধরে স্বাতীকে ভালবাসি। বুড়িও জানে সেকথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে তার বন্ধুকে জানতে দেয়নি। অথচ আমার বন্ধুর সঙ্গে হাবুডুবু।
একদিন ওরা যখন ঘরে বসে হাসাহাসিতে মেতে উঠেছে , চোখ বুজে আমিও তখন স্বাতীকে নিয়ে নিজে নিজে একটা ছবি রচনার চেষ্টা করলুম। হঠাৎ ওদের যৌথ হাসির ঘায়ে মিলিয়ে গেল আমার সেই ছবি। সারা শরীর রাগে কেঁপে উঠল । নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সপ্তাশ্বর ওপর সেই রাগ তৎক্ষণাৎ উগরে দিলাম। অপ্রস্তুত হয়ে উঠে পড়ল সে। যাওয়ার সময় রোজকার মতো বলে গেল না। কিন্তু পাগুলো এমনভাবে মাটিতে ফেলল, যে সে দিকে তাকিয়ে বুড়ি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তাতেও আমার হিংসে। শাসনের অজুহাতে ধমকে বুড়িকে ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। আমাকে পাশ কাটিয়ে মা চলল সপ্তাশ্বর পেছন পেছন । ওকে ঘরে ডেকে এনে বোঝাতে লাগলো-- ওর বাবার গুষ্টিতে অনেক পাগল আছে। তুমি কিছু মনে করো না বাবা।
এখন আমি চোখ বুজেই আমার সব ইচ্ছে পূরণ করি। সাদা চাদরের ওপর স্বাতীকে শুইয়ে ক্ষুধার্ত প্রেমিকের ইচ্ছে মেটাই। অনেকটা ‘এ ‘ মার্কা ছবির মতো। এজন্য সিঁড়ির চাতালই ছিল আমার প্রিয় জায়গা। বইপত্র নিয়ে সেখানেই উঠতাম। মা মাঝেমাঝে হাঁক পাড়ত। কিরে সোম, গলা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বলতাম, অঙ্ক কষছি। গুপ্তচরের ভূমিকায় একদিন বুড়ি গিয়ে হাজির। সেসময় আমার দুচোখের পাতা স্বাতীর নগ্নতায় মাখামাখি। এক হাতের সবল মুঠোয় আত্মরতির টানাহ্যাঁচড়া। স্বপ্ন ও বাস্তবের অমিল ঘোচাতে একক যুদ্ধ।
হঠাৎ, চোখ খুলে দেখি, লজ্জা ,ভয় কৌতূহল নিয়ে বুড়ি দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই সে দৌড়ে পালায়। অজ্ঞাতে হলেও বোনের সামনে নিজের গোপন অঙ্গ ও ইচ্ছে প্রকাশের সেই জ্বালায় আজও আমি ক্ষতবিক্ষত। তার চেয়েও বড় কথা, আমার ধারণা, বুড়ি নিশ্চয়ই তার বন্ধু স্বাতীকে দাদার ওই কীর্তি শুনিয়েছে। নইলে কেন সে আজকাল দেখা হলেও ভদ্রতা করে একটু হাসে না। ভাবুন তো, দাদার ভালবাসার কথা জনাতে লজ্জা পেল। অথচ কেমন দিব্যি তার গোপন অসভ্যতার কথা জানিয়ে দিল। এইসব কারণেই আত্মীয় বা বন্ধু শব্দের মানেটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। জানাবার মতো কথা তো বুড়ির কম ছিল না। এই যেমন ওকে আমি কত কবিতা লিখে শোনাতাম। মজার মজার কথা বলতাম। অবশ্য এও সত্যি যে এসবের পেছনে আসল উদ্দেশ্য থাকত, বুড়ি যেন স্বাতীকে গিয়ে দাদার গুণগান গায়। যাতে আমার সম্পর্কে স্বাতীর মধ্যে একটা আকর্ষণ তৈরি হয়।
যা হোক, সেদিনের পর থেকে বুড়ির কাছে আমার জড়তা ক্রমশ বেড়েই চলল। ওকে দেখলেই লজ্জায় সিঁটিয়ে যাই। এমনকী বাড়ি থাকলে নিজের জায়গা করে নিলাম সিঁড়ির চাতালে। মা বাবা দুজনেই অবাক। সে কি ! ঘরে জায়গা থাকতে...। কারণ হিসেবে বুড়িকে দিয়েই অজুহাত খাঁড়া করলাম। বললাম, ও বড্ড জোরে জোরে আর দুলে দুলে পড়ে। সামনে পরীক্ষা। আমার অসুবিধা হয়।
সপ্তাশ্বর আসা যাওয়া আগের চেয়ে বেড়েছে। ও কড়া নাড়লেই মা ঠিক বুঝতে পারে। বলে, বুড়ি,অ্যাাই বুড়ি দেখ কে এসেছে। সপ্তাশ্ব তার বাহারি জুতো খুলে ঘরে ঢোকে। এখন সে আর ততটা আমার বন্ধু না, যতটা বুড়ির। টেনে শালার পাছায় এক লাথ মারতে হয়। যার হাত ধরে এ বাড়ি ঢুকলি, এখন সেই বেপাত্তা। মায়েরও আসকারা আছে ষোল আনা। ভাল ছেলে, ভাল ঘর। মেয়ের ভবিষ্যৎ বলে কথা। তাই ও ঢুকলেই মায়ের তৎপরতা যায় বেড়ে । ঘিয়ে ভাজা লুচি আর সাদা আলু চ্চচড়ি নিয়ে দাঁড়ায়। একটু পরেই যথারীতি ওদের হাসির শব্দ এই চাতালেও উঠে আসে । কান চেপেও সে আওয়াজ বিঁধে যায় মগজে। এক এক সময় ইচ্ছে হয় ছুট্টে গিয়ে গলা টিপে ধরি। কিন্তু লজ্জা, পরমুহূর্তেই লজ্জা যায় বেড়ে। বুড়ির সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি না যে।
সপ্তাশ্বর বাবা খুব বড় চাকুরে। রোজ অফিসের গাড়ি আসে নিতে। ওরাও তাতে চড়ে বেড়াতে যায় মাঝেমাঝে। বেড়াল কুকুর মানুষ সবই চাপা পড়ে চাকার তলায়। চোখ বুজলেই আমি সে রক্ত দেখতে পাই। সেদিন ক্লাসে রচনা লিখতে দিলেন বাংলার স্যার। “রক্তদান শিবির”। বললেন, দেখি কুড়ির মধ্যে কে কত পাস। মাত্র দুই দিলেন আমায়। লেখাটা পড়ে বললেন, কী সব যা তা লিখেছিস? গাড়ির চাকা, রক্ত ! তাছাড়া শিবিরে গিয়ে রক্ত দিলে তা আবার কারোর নামে দেওয়া যায়?
-কেন যাবে না স্যার ? আমার রক্ত আমি যাকে খুশি দেব। ওরা যাকে খুশি চাপা দিতে পারে, আর আমরা যাকে খুশি রক্ত দিতে পারি না? সপ্তাশ্বর বাবার গাড়ির তলায় চাপা পড়া লোকটাকেই রক্ত দেব আমি।
প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। ক্লাসের সবগুলো চোখ তখন ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে আছে। সবার দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি, তাদের কারোর চোখে মজা, কারোর চোখে কৌতুহল। সিটে বসে চোখ ঢেকে ফেললাম হাত দিয়ে। আগেই কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছিল স্কুলে যে আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ না। গুটিগুটি এগিয়ে এল স্যার। পেছনে সপ্তাশ্ব । ও স্যারকে বলল, ওকে বাড়ি নিয়ে যাব স্যার?
-তুই চিনিস ওর বাড়ি ?
-হ্যাঁ স্যার। আমি তো প্রায়ই যাই ওর কাছে।
কথাটা কানে ঢোকা মাত্র চিৎকার করে উঠলাম।
-না স্যার, ও শুধু আমার বোনের কাছে যায়। আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করে না।
সারা ক্লাস জুড়ে হাসির ফোয়ারা তখন। সপ্তাশ্বর মুখ মাটির দিকে।
এতক্ষণে শরীর মন জুড়ে যেন একটা ঘুম ছেয়ে ফেলছে আমায়।
মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে মা খুব কাঁদছিল। বুড়িও। বাবা শুধু শক্ত করে ধরে ছিল আমাকে। বোধহয় সেভাবেই নিজেকেও। অনেকদিন থাকতে হয়েছিল। চিকিৎসায় খরচাও হলো প্রচুর। শেষমেশ বাড়ি ফিরে এলাম একদিন। শুনলাম, সপ্তাশ্ব আর এমুখো হয়নি। ইতিমধ্যে আমার জন্য খরচের বন্যায় ঘরের চেহারাটাও যেন ভাসমান। সবচেয়ে খারাপ লাগলো বুড়ির চেহারাটা ভালো করে লক্ষ্য করে। এরপর প্রায় শূন্য হাতে বাবা তাঁর দায়িত্ব পালনের উদ্দেশে একটি সমত্ত মেয়েকে পার করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। বুড়ির বিয়েও হলো। কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া হয়নি ঠিকমতো। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বউকে পাগল প্রমাণ করে ছাড় পেয়ে গেল। আমার চেয়ে বয়সে ছোট আমার একমাত্র বোন এখন ফটো হয়ে চোখের সামনে ঝুলছে।
বাসের জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে সপ্তাশ্বর গা থেকে। ভালো রোজগেরে লোকদের গায়ে থাকে ওই গন্ধ। নিশ্চয়ই কোন বড় চাকরি করে। বেশ সুন্দর চেহারা হয়েছে। বিদেশটিদেশ থাকে শুনেছি। ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কোনো মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হতে পারে। অথচ একই ক্লাশের ছাত্র হয়ে এ পোড়া দেশে একজন শ্রমিক হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাও বিলাসিতা। সব কলকারখানাই বন্ধ প্রায়। আমাদের পাড়ারটারও একই হাল। কারখানার গেট পেরিয়ে লোকজন দেওয়ালে পেচ্ছাপ করে বেরিয়ে আসে। গেট বরাবর লম্বা পিচের রাস্তা চলে গেছে গোডাউনের দিকে। সামনে ফাঁকা জমি। তার মাঝখানে বড় বড় শেড। মাথার চালগুলো ফাঁকা। রাতে সমাজবিরোধীদের আঁখড়া । বিশাল অঞ্চল জুড়ে পরিত্যক্ত লোহালক্কড় ইতিহাসের সাক্ষী। অদৃশ্য শক্তির কোপে অচল।
আমাদের ছাদের ওপর থেকে পাঁচিলের ভেতর কারখানার অনেকটা দেখা যায়। একদিন দেখি, একটি ছেলের সঙ্গে স্বাতী ওই কারখানার ভেতরে ঢুকছে। তারপর কিছুটা এগিয়েই দুজনে দুজনের হাত ধরল। কৌতূহলে ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত চলে গেলাম। হঠাত্ চোখটা বুজে এক্কেবারে নিচে। চেঁচামেচিতে ছুট্টে এল সবাই। স্বাতীরাও আছে ওই ভিড়ে। আমার রক্ত দেখে খুব কান্নাকাটি জুড়ল স্বাতী। শাড়ির আঁচল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে সঙ্গী ছেলেটাকে বলল,ট্যাক্সি ডাকতে। বিরক্ত হয়েই সে ডাকতে গেল কিন্তু আর ফিরল না। আমি স্বাতীর কোলে মাথা দিয়ে রাস্তার ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। অন্যেরা ছোটাছুটি করছে খুব। অমন নরম কোলে শুয়ে আমার কিন্তু একটুও কষ্ট নেই আর। এরইমধ্যে একজন ট্যাক্সি নিয়ে এসে হাজির। স্বাতীর শরীর আঁকড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পেছনের সিট জুড়ে শুধু আমরা দুজন। আর দুজন অচেনা লোক কোনরকমে সামনে ড্রাইভারের সঙ্গে। কোন হাসপাতাল গেলে ভাল হয়, তা নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা চলছে। এদিকে আমার শরীরটা রক্তাক্ত অবস্থায় স্বাতীর কোলে আধশোয়া। সামান্য ব্রেক কষলেই ওর নরম বুক স্পর্শ করছে আমার মাথা। মাঝে একবার ওর চোখের জলও ছুঁয়েছে আমার কপাল। আহ্ ,সারা শরীরে যন্ত্রনার লেশমাত্র নেই। যন্ত্রনা শুধু একটাই। স্বাতী যেন বড্ড বেশি উতলা হয়ে পড়ছে। আমার এই কষ্ট ওকেও বিদ্ধ করছে একইভাবে। ট্যাক্সিওয়ালাকে জোরে চালাতে বলছে। যদিও সামনের সিটের লোকদুটো তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কোথায় যাওয়া উচিত। ট্যাক্সিটাও তাই চলছে তো চলছেই। আমি কিন্তু ওই শরীর নিয়েও কান খাঁড়া করে আছি ,পাছে না ওরা কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কারণ এই মুহূর্তটাকে আমি আরও কিছুটা উপভোগ করতে চাই। যা আমার জীবনে একান্ত কাম্য। এবং এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অধরা।
হঠাত্ অসময়ে অনেকগুলো বৃষ্টির ফোঁটা আমার শরীর ভিজিয়ে দিয়ে গেল। চোখ খুলতেই আবার সেই পুরোনো পৃথিবীর ম্লান আলো। দেখি, কার্নিশের একেবারে ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আর বৃষ্টি বাঁচাতে স্বাতী ও তার সঙ্গী ছেলেটি কারখানার ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসছে।
বাসটা ব্রেক কষতেই ছিটকে যাচ্ছিলাম প্রায়। ভাগ্যিস সপ্তাশ্ব আমার কাঁধে হাত রেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ পর্যন্ত ও শুধু বাবা মায়ের খোঁজ নিয়েছে। নামার আগে ভীষণ জড়তা নিয়ে জানতে চাইল, বু….ড়ি ভালো আছে? মাথাটা নামিয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। গলার কাছে একটা কান্না দলা পাকিয়ে আছে। কোনরকমে সামলে বললাম, হ্যাঁ, আছে। তোর কথা খুব বলে।
কথাটা শেষ হতেই সপ্তাশ্ব জানলার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দিল।
আমার স্টপে পৌঁছে গেছি। রাস্তায় নেমেই পেছন ফিরে হাত নাড়লাম ওকে। চেঁচিয়ে বললাম, বাড়ি আসিস একবার। গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে বাসটা এগোতে লাগলো। চোখে মুখেও ঢুকল সেই ধোঁয়া। তবু চোখ বন্ধ না করে দু পায়ের গোড়ালি তুলে ডান হাতটা সমানে নাড়িয়ে যাচ্ছি ,পকেট থেকে ডান হাতের মুঠোয় কখন যে বুড়ির লাল চেলিটা উঠে এসেছে, খেয়াল করিনি। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে সেটা। দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় বাসটাও ছুটে চলল ঝড়ের গতিতে। সেই চলন্ত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়। যতক্ষণ না বাসটা চোখের আড়াল হয়।
লেখক পরিচিতি:
অমিত ভট্টাচার্যগল্পকার। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্কার
কলকাতায় থাকেন।
প্রকাশিত দুটি গ্রন্থ: "রক্ত মাংসের ক্যানভাস" এবং "আলোছায়া"।
6 মন্তব্যসমূহ
দারুণ দারুণ দারুণ ...
উত্তরমুছুনএ তো পড়া গল্প
উত্তরমুছুনমানষিক ভারসাম্যহীনতার উপর দারুন গল্প।
উত্তরমুছুনএকটি মানসিক বৈকল্যকে আখ্যানের কেন্দ্রে রেখে তার বৃত্তের মানুষজনের পায়ের নিচের মাটি কিভাবে সরে গেছে দেখে পাঠক নিজেও অনুভব করেন বিপন্ন বিস্ময়। গল্পের গহন বিন্যাসে যেন সক্রিয় থেকেছে গ্রীক ট্র্যাজেডির ফ্যাটালিজম বা নিয়তিবাদ।
উত্তরমুছুনমন ই সব, সেই মন যখন সত্যিই সমস্যায় থাকে তার নিদারুণ কষ্ট অমিতের মর্মস্পর্শী লেখায় খুবই জীবন্ত হয়েছে...সব মিলিয় গল্পটি সার্থক....
উত্তরমুছুনKhub bhalo
উত্তরমুছুন