অ্যালিস ওয়াকার'এর গল্প: আটপৌরে






অনুবাদ: সুমু হক

গতকাল দুপুরে আমি আর ম্যাগি মিলে যে উঠোনটাকে ঝেড়ে পরিষ্কার করে একেবারে ঝকঝকে আর ঢেউ খেলানো করে তুলেছি, সেখানটাতেই আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করবো। আসলে এমন একটা উঠোন কতটা আরামদায়ক হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই।

অনেকেই বোঝেন না এমন একটা উঠোন কতটা আরামদায়ক স্হান।

এ তো আর শুধুমাত্র একটা উঠোন নয়! এটা আমাদের বসবার ঘরেরই একটা অংশ। উঠোনের শক্ত কাদাঁমাটিটুকুর ওপরের অংশটা ঝেড়েপুছে ঘরের মেঝের মতোই তকতকে করে তোলার পর যখন উটকো ধূলোকণাগুলো উঠোনের কোণায় কোণায় নানারকম এলোমেলো নকশার আল্পনা তৈরী করে তখন সেই উঠোনে বসে উপরের এল্ম গাছগুলোর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যে অপূর্ব বাতাসের প্রতীক্ষা করা যায়, যা কখনোই ঘরের ভেতরে বসে পাওয়া সম্ভব নয়!

বোন বাড়ি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত ম্যাগি এখন এরকম ভয়ে ভয়েই থাকবে: নিজের সাদামাটা চেহারা আর হাতে-পায়ের পোড়া দাগগুলো নিয়ে বিব্রত ও লজ্জিত অবস্হায় কেমন অসহায়ের মতো এককোণায় দাঁড়িয়ে থেকে বোনকে খানিকটা ঈর্ষা আর সমীহের চোখে দেখে যাবে। ও ভাবে যে সমস্ত পৃথিবীটাই বোধহয় ওর বোনের একেবারে হাতের মুঠোয় , এবং ‘না’ এমন একটি শব্দ জীবন যা তাকে বলতেই শেখায়নি।

আপনারা টেলিভিশনের ওই অনুষ্ঠানগুলো নিশ্চয়ই দেখেছেন, যেখানে উপস্থাপক হঠাৎ খুব সফল "হয়ে ওঠা" কোন একটা বাচ্চার মুখোমুখি হয়, তারপর হঠাৎ তাকে চমকে দেবার জন্যে আস্তে আস্তে মঞ্চের পেছন থেকে তার বাবা-মাকে ডেকে আনা হয়. (চমকটা অবশ্যই সুখকর: নইলে একবার ভাবুন তো, কখনো যদি এই বাবা-মা এবং সন্তানটি পরস্পরকে শাপান্ত করতে করতে কি অপমান করতে করতে অনুষ্ঠানটিতে আসতো, তখন ওরা কি করতো ?) টেলিভিশনের পর্দায় মা এবং সন্তান একে ওপরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবে এবং পরস্পরকে জড়িয়ে ধরবে। কখনো কখনো আবার বাবা-মা একটুখানি কাঁদবে, আর সন্তানটি দুজনকে দুদিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে টেবিলের ওই দিক থেকে সামনে একটুখানি ঝুঁকে পৃথিবীকে জানাবে যে এই বাবা-মায়েরা না থাকলে সে এই পর্যন্ত পৌঁছতেই পারতো না। এই অনুষ্ঠানগুলো আমিও দেখেছি।

কখনো সখনো আমি স্বপ্নে দেখি যে ডি আর আমাকে একসাথে হঠাৎ এই ধরনের একটা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদেরকে বেশ একটা গাঢ় রঙের নরম গদির লিম্যুজিন থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো উজ্জ্বল একটা ঘরে, অজস্র লোকের মাঝখানে।

সেখানে আমাদের জন্যে হাস্যোজ্জ্বল, সুরসিক, বেশ বয়ষ্ক অনেকটা জনি কারসনের মতো একটা লোক অপেক্ষা করছে, যে কিনা এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বলছে, কি চমৎকার একটা মেয়েই না আমার আছে। তারপর স্টেজে চোখে জল, ডি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমার জামায় সে একটা অর্কিড লাগিয়ে দিচ্ছে, যদিও ও আমায় একবার বলেছিল যে ওর মতে অর্কিড নাকি একটা ভীষণ ক্যাটকেটে ধরনের ফুল।

এমনিতে আমি বেশ দশাসই, গাট্টাগোট্টা, রুক্ষ পুরুষালি ধরনের খেটে খাওয়া দেহাতি মানুষ। শীতকালে আমি ফ্লানেলের রাতপোষাকে বিছানায় যাই, আর সারাদিন ওই ওভারঅল পরেই কাটিয়ে দিই। যে কোন ব্যাটাছেলের মতোই আমি নির্দ্বিধায় একটা শুয়োর মেরে পরিষ্কার অবধি করে ফেলতে পারি। শরীরের মেদ আমাকে শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও বেশ গরম রাখে। আমি যেমন সারাদিন বাইরে কাজ করতে পারি, তেমনি আবার শীতকালে বরফ গলিয়ে ধোয়াধুয়ির জন্যে প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থাও করে নিতে পারি; সদ্যমৃত শুয়োরের ধোঁয়াওঠা শরীর থেকে বেরোনো কলিজাকে খোলা আগুনে পুড়িয়ে কয়েক মিনিটের ভেতর সাবাড় করে দিতে পারি। একবার শীতকালে একটা ষাঁড়ের বাছুরের দুচোখের ঠিক মাঝখানটায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে মগজ অবধি গেঁথে দিয়ে শিকার করেছিলাম, তারপর ওটার মাংসকে ঠান্ডা করবার জন্যে ঝুলিয়েও রেখেছিলাম রাত নামার আগেই। অবশ্য, টেলিভিশিনের পর্দায় কিন্তু এর কোনকিছুই দেখানো হয় না। সেখানে আমাকে দেখানো হবে মেয়ে যেমনটা দেখতে চায় ঠিক সেভাবে। সেখানে যাকে দেখানো হবে তার ওজন শ’খানেক পাউন্ড কম, গায়ের রং হালকা বাদামি এবং পেলব। আমার চুলগুলো ঘরের উজ্জ্বল আলোর রোশনাই পরে পিছলে যাবে। আর আমার বাক্যবাণে সুরসিক জনি কারসন মহাশয়কে পর্যন্ত রীতিমতো পর্যুদস্ত হতে হবে।

কিন্তু ঘুম ভাঙার আগেই টের পেয়ে যাই, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তা নইলে কে কবে শুনেছে জনসনেরা এতটা বাকপটু? আর আমি একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত সাদা লোকের চোখে চোখ রেখে কথা বলছি, একথাই বা কার পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব? আমার তো মনে হয় আমি চিরটাকালই ওদের সাথে কথা বলবার সময় দৌড়ে পালাবার জন্যে এক পা প্রস্তুত রেখে আর মাথাটা ওদের দিকে থেকে যত দূরে সম্ভব ঘুরিয়েই কথা বলে এসেছি। ডি কিন্তু বলেছে। ও যে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে। দ্বিধা বস্তুটি ওর স্বভাবেই নেই।

"আমায় কেমন দেখাচ্ছে, মা?" দরজার পেছন থেকে গোলাপি রঙের একটা স্কার্ট আর লালরঙের ব্লাউজে মোড়ানো শুকনো শরীরটার সামান্য অংশমাত্র দেখিয়ে নিজের উপস্থিতিটুকু জানান দিয়ে ম্যাগি জিজ্ঞাসা করলো।

“উঠোনে বেরিয়ে আয়,” আমি বললাম।

আপনারা কখনো একটা পঙ্গু হয়ে যাওয়া জানোয়ারকে দেখেছেন? যেমন ধরুন, গাড়ি কেনার মতো পয়সাওয়ালা একটা লোক গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেছে এমন একটা কুকুর, বোকার মতো কেউ তার দিকে একটু মায়া মায়া ভাব করে তাকালেই হলো, দিব্যি তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়? ম্যাগি ঠিক সেইরকম করে হাঁটে। বাড়িটা পুড়ে যাবার পর থেকেই ম্যাগি ওরকম, চিবুকটা বুকের ওপর ঝুঁকে থাকে, চোখ দুটো মাটির দিকে স্থির, আর চলার ভঙ্গিতে কেমন ত্রস্ততা।

ডির গায়ের রংটা ম্যাগির থেকে উজ্জ্বল, চুলগুলো অনেক বেশি সুন্দর, শরীরটাও ভরন্ত। ও এখন পুরোদস্তুর একটি ভদ্রমহিলা, যদিও মাঝেমধ্যে আমার সেটা মনেই থাকে না। কত বছর আগে যেন বাড়িটা পুড়ে গিয়েছিলো? দশ, বারো বছর হবে? মাঝে মাঝে এখনো আমি আগুনের শব্দ শুনতে পাই, টের পাই ম্যাগির হাতগুলো আঁঠার মতোন আমার সাথে সেঁটে যাচ্ছে, ওর চুল থেকে ধোয়া উড়ছে, ওর গায়ের জামাটা খসে পড়ছে টুকরো টুকরো পোড়া কাগজের মতো। ওর চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কেউ সেগুলোকে জোর করে টেনে খুলে ধরে রেখেছে, আর সেগুলোতে গনগনে আগুনের শিখার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আর ডি। দেখতে পাচ্ছি, যেই মিষ্টি আঁঠা গাছ থেকে খুঁচিয়ে আঁঠা বের করতো, সেই গাছটার নিচেই ও দাঁড়িয়ে আছে; খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে, যতক্ষণ না বাড়িটার শেষ মলিন দেয়ালটা পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেলো আর বাড়িটা গনগনে লাল ইটের চিমনিটার গায়ে এলিয়ে পড়লো। তারচেয়ে তুমি বরং এই ছাইস্তূপের চারপাশে নেচে বেড়ালেই পারো? খুব ইচ্ছে করেছিল ওকে একথাগুলো বলি। প্রচণ্ড বিরাগ ছিল বাড়িটার প্রতি তার।

আমার মনে হতো ও ম্যাগিকেও অপছন্দ করতো। তবে সেসব গির্জা আর আমি চাঁদা তুলে ওকে অগাস্টা স্কুলে পড়তে পাঠানোর আগেকার কথা। তখন ও বিন্দুমাত্র করুণা না করে আমাদেরকে পড়ে শোনাতো; আমাদের দুজনের ওপর চাপিয়ে দিতো কথার বোঝা, মিথ্যে, অন্য লোকের স্বভাব, এমনকি গোটা জীবন পর্যন্ত, সবটাই কেমন অজান্তেই ওর কণ্ঠস্বরের নিচে চাপা পড়ে যেত। ও আমাদেরকে কল্পনার নদীতে স্নান করাতো, এমন অনেক জ্ঞানের বোঝায় আমাদেরকে পুড়িয়ে দিতো যা না জানলেও আমাদের দিব্যি চলে যেতো। আর যেই না আমরা খানিকটা কেবল বুঝে উঠতে শুরু করেছি, ওর পড়ে শোনাবার গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদেরকে মুহূর্তেই ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতো, ঠিক যেন আমরা কোথাকার কোন ডাঁহা মূর্খের দল!

ডির সবসময় সুন্দর সুন্দর সব জিনিসের প্রয়োজন ছিল। হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের সময় ওর প্রয়োজন হলো একটা হলুদ রঙের অর্গ্যান্ডি জামার; আমায় কেউ একবার উপহার দিয়েছিল, এমন একটা স্যুট কেটে নিজের জন্যে বানানো সবুজ স্যুটের সাথে পরবার জন্যে কালো রঙের জুতো। আর এইসব জিনিস পাবার পথে কোন বাধাই সে মানতে রাজি ছিল না। মাঝে মধ্যে আমার ইচ্ছে হতো, ওকে খুব করে একটা ঝাঁকুনি দিই। সেই ষোল বছর বয়সেই ওর নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল; তখনই ও জানতো স্টাইল কাকে বলে।

আমার নিজের পড়ালেখা বিশেষ ছিল না। সেকেন্ড গ্রেডের পরেই স্কুলটা উঠে যায়। কে জানে কেন: সেই ১৯২৭ এ কালোকুলো লোকেরা আজকের মতো এতসব প্রশ্ন করতে শেখেনি। ম্যাগি কখনো সখনো আমাকে পড়ে শোনায়। ও যথেষ্ট আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু চোখে খুব ভালো দেখতে পায় না। ও জানে যে ও খুব তুখোড় নয়। চেহারা আর টাকাপয়সার মতো, চটপটে ভাবটাও ওর ভাগ্যে জোটেনি। ও অবশ্য জন টমাসকেই বিয়ে করবে (জনের আন্তরিক চেহারা হলেও দাঁতগুলো কেমন শ্যাঁওলা পড়া) আর তারপর আমি ঝাড়া হাত-পা হয়ে এইখানে একাকী বসে আপন মনে গির্জার গানগুলো গাইবো। অবশ্য আমি তেমন ভালো গাইয়ে নই। গলায় সুর বলতে কিচ্ছু নেই। আমি বরং চিরকালই পুরুষালি কাজগুলো ভালো সামলাতে পারি। সেই ৪৯ সালের দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত আমি দুধ দোয়াতে রীতিমতো ভালোবাসতাম। আসলে কি জানো, গরুগুলো ততক্ষণ পর্যন্তই শান্ত আর ধীরস্থির, যতক্ষণ না তুমি ওদের ঘাটাচ্ছো, একটু বেকায়দায় দুধ দোয়াতে গিয়েছো কি ব্যস!

আমি নিজেই বাড়িটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। এ বাড়িতেও পুড়ে যাওয়া বাড়িটার মতোই তিনটে ঘর, ছাদটা কেবল টিনের, এইটুকুই যা তফাৎ, আজকাল তো কেউ আর টালির ছাদ বানায় না। সত্যিকারের জানালা বলতে যা বোঝায়, সেগুলো এখানে নেই, যা আছে সে হলো দেয়ালের গায়ে কাটা কতগুলি গর্ত অনেকটা জাহাজের পাশে যে জানালাগুলো দেখা যায়, সেগুলোর মতো দেখতে, না গোল, না চৌকো। চামড়ার পর্দা বাইরের একদিক থেকে জানালার পাল্লাটাকে আটকে রেখেছে। আগের বাড়িটার মতো এটাও গরু চড়ানোর মাঠের মাঝখানেই। আমি নিশ্চিত যে এই বাড়িটাকেও দেখামাত্রই ডির ইচ্ছে হবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। ও একবার আমাকে লিখেছিল যে আমরা যে জায়গাকেই থাকার জন্যে "বেছে " নেই না কেন, ও সেখানেই আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু ও কখনোই ওর বন্ধুদেরকে সেখানে নিয়ে আসবে না। ম্যাগি আর আমি অবশ্য এটা শুনে খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম, তাই খানিকক্ষণ পরে ম্যাগি জানতে চেয়েছিলো, "মা, ডির আবার কোন বন্ধু হলো কবে থেকে?"

তা, সে ওর দু'চারটে ছিল। স্কুলের পর যেদিন কাপড় ধোবার পালা আসতো, সেইসব দিনগুলোতে বেশ গোলাপি রঙের শার্ট পরে চোরের মতো ঘোরাফেরা করতো কয়েকটা ছোড়া। আর ছিল কয়েকটা গোবেচারা মেয়ে, যাদেরকে কোনদিন হাসতে অবধি দেখা যেত না। ওর প্রত্যেকটা গোছানো কথার প্যাঁচ, ওর সৌন্দর্য আর ওর ফুটন্ত চুনের ভেতরকার বুদ্বুদের মতো ঝলসে দেয়া ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ ওদের মন্ত্র-মুগ্ধ করে রাখতো। ওদেরকেও ও পড়ে শোনাতো।

তারপর যখন ও জিমি টির সাথে প্রেম করতে শুরু করলো, তখন তো আর আমাদের জন্যে ওর কোন সময়ই রইলো না, তখন ওর সমস্তটা খুঁত ধরার অভ্যেস পড়লো গিয়ে জিমির ঘাড়ে। সে বেচারা তখন শহরের কোন একটা অল্প শিক্ষিত, রুচিহীন পরিবারের সস্তা মেয়েকে বিয়ে করে পালিয়ে বাঁচলো। ডি এমনকি নিজেকে গুছিয়ে নেবার সময়টুকুও পায়নি। এইবার ও এলে আমি ওর এখনকার... এই তো, ওরা এসে গেছে!

ম্যাগি ওর স্বভাবজাত হতচকিত ভঙ্গিতে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়তে চাইলো, কিন্তু আমি হাত দিয়ে ওকে আটকে দিলাম। “এদিকে এসে চুপচাপ দাঁড়া” আমি বললাম। এবার ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বালির ওপর গর্ত তৈরী করতে লাগলো।

সূর্যটা এমনভাবে চোখে লাগছে যে ওদেরকে ঠিক স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবুও, গাড়ি থেকে প্রথম পাটা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, এ ডি ছাড়া আর কেউ নয়। ওর পাজোড়া বরাবরই খুব সুন্দর ছিল, ঠিক যেন ঈশ্বর নিজের হাতে একটি বিশেষ ছাদে ওদেরকে গড়েছেন। গাড়ির অন্যদিকে থেকে বের হলো বেঁটেখাটো অথচ বেশ গাঁট্টাগোট্টা একটি লোক। একমাথা অগোছালো চুল এক হাত লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে আর দাঁড়িটিও চিবুক থেকে বেশ কেমন একটি গাধার কোঁকড়ানো ল্যাজের মতোন হয়ে ঝুলছে। আমি শুনতে পেলাম, ম্যাগি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ধরে রাখলো, অনেকটা "উঁহহ..." এইরকম একটা শব্দ করে। পথের ওপর, পায়ের সামনে হঠাৎ একটা সাপের মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তার শরীরটা মোচড়ানোর দৃশ্য দেখলে ঠিক যেমন অনুভূতি হয়, অনেকটা সেইরকম। "উঁহহ...।"

তারপর ডি। এই ভীষণ গরমেও পা অবধি লুটিয়ে পড়া একটা জামা। এমন ক্যাটকেটে একটা জামা যে আমার চোখ রীতিমতো জ্বলতে লাগলো। সূর্যের দিকে প্রতিফলিত হবার মতো যথেষ্ট পরিমাণে হলুদ আর কমলা রঙের সমারোহ আছে তার মধ্যে। টের পাচ্ছি, ওর জামার ছুঁড়ে দেয়া উষ্ণতায় আমার সমস্ত মুখচোখ অবধি গনগন করে উঠছে। তার ওপর আছে সোনার কানের দুল। হাতের গয়নাগুলো ঝমঝমিয়ে রীতিমত শব্দ করে হাতের নিচে কুঁচকে যাওয়া জামাটাকে টেনে টেনে ঠিকঠাক করলো সে। জামাটা বেশ ঢোলাঢালা আর সুন্দর, ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে, কাছে এগিয়ে আসতে আমারও বেশ পছন্দই হলো। আমি শুনতে পেলাম ম্যাগি আবার সেই "উঁহহ..." শব্দটা করলো। এবার বোধহয় ওর বোনের চুলগুলো দেখে। ভেড়ার পশমের মতো বেশ খাড়াখাড়া হয়ে আছে। রাতের মতো ঘন কালো সেই চুলের শেষ মাথায় আবার বেশ লম্বা দুটো ঝুঁটি বাঁধা, দুটো ছোট টিকটিকির মতো সে দুটো ওর কানের পেছন দিকে চলে গেছে।

“তা তোমরা করছো টা কী!” ও বলে, ওই জামাটার কারণে মনে হয় ও যেন ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে, হেঁটে নয়। ওই নাভি অবধি চুলসমেত গাঁট্টাগোঁট্টা লোকটাও দিব্যি হাসিমুখে ওর পেছন পেছন এসে বলে, “আসালামালাকিম, আম্মা, আপা!” ও ম্যাগিকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ম্যাগি পেছন দিকে পরে যায়, একেবারে আমার চেয়ারের গায়ের ওপর। আমি টের পাই ও কাঁপছে, মুখ তুলে দেখতে পাই, ওর চিবুক বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।

“একটু অপেক্ষা করো, এখুনি উঠো না,” বললো ডি। আমি মোটাসোটা বলে উঠে দাঁড়াতে বেশ জোরই দিতে হতো। সুতরাং আমি উঠে দাঁড়াবার দুয়েক সেকেন্ড আগে থেকেই টের পাওয়া যায় যে এইবার আমি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছি। ও গাড়ির দিকে ফিরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই আমি এবার স্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে ওর ফর্সা গোঁড়ালি দুটোকে দেখতে পেলাম। ও একটা পোলারয়েড ক্যামেরা নিয়ে ফিরে এলো। এবার খুব দ্রুত ঝুঁকে বসে বাড়ির সামনে বসা আমার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো আমার পেছনে লুকিয়ে বসে থাকা ম্যাগিসহ। প্রত্যেকটা ছবি তোলার আগে নিশ্চিত হয়ে নিলো যে ছবিতে বাড়িটা ঠিকঠাকমত দেখা যাচ্ছে কি না। একটা গরু জাবর কাটতে কাটতে উঠোনের কাছ ঘেঁষে এসে পড়লে ও সেটারও একটা ছবি তুলে নিলো, সাথে রইলাম আমি, ম্যাগি আর রইলো বাড়িটা। এবার ও ক্যামেরাটা গাড়ির পেছনের সিটে রেখে এসে আমার কপালে একটা চুমু খেলো।

ইতিমধ্যে “আসালামালাকিম” ম্যাগির হাতটা নিয়ে হাত মেলানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে। ম্যাগির হাতটা যদিও মাছের মতোই পেছল হয়তোবা ঘামতে থাকা স্বত্ত্বেও, সেরকমই ঠান্ডাও, আর তাছাড়া ও ক্রমাগত হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছিলো। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিলো, “আসালামালাকিম” কোন বিশেষ কায়দা করে হাত মেলাতে চাইছিলো। কিংবা হয়তো সে আদৌ হাত মেলাতেই জানে না। সে যাই হোক, তাকে অচিরেই ম্যাগির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে হলো।

“বেশ ,” আমি বললাম। “ডি।”

“না, মা,” ও বলে উঠলো। “ডি " নয়,’ ওয়ানজেরো লিওয়ানিকা কেমানজো!”

“কেন, "ডি 'র কি হলো?" আমি জানতে চাইলাম।

“ও মরে গেছে,” ওয়ানজেরো বললো . “আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, আমাদেরকে যারা শোষণ করে এসেছে, সেইসব লোকেদের নাম বয়ে বেড়ানো।”

“তুমি খুব ভালো করেই জানো , তোমার নাম রাখা হয়েছো তোমার মাসি ডাইসির নামে,” আমি বললাম। ডাইসি আমার বোন। ডির নামটা ওই রেখেছে। ডির জন্মের পর থেকে ওকে আমরা বড় "ডি " বলে ডাকতে শুরু করি।

“তা, তাঁর নামটাই বা কোথা থেকে এলো?” ওয়ানজেরো জিজ্ঞাসা করলো।

“ঠাকুমা ডির নাম থেকে,” আমি বললাম।

“আর তাঁর নামটা কার কাছ থেকে এলো?” ওয়ানজেরো জানতে চাইলো।

“তাঁর মায়ের কাছ থেকে,” আমি বললাম। দেখলাম, এবার ওয়ানজেরো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। “আমি এই পর্যন্তই জানি,” বললাম আমি। যদিও সত্যি বলতে কি, চাইলে হয়তো বা আমি গৃহযুদ্ধের সময় পর্যন্ত এর সূত্রটি খুঁজে বের করতে পারবো।

“বেশ,” বললো “আসালামালাকিম”, “এবার বুঝলেন তো।”

"উঁহহ...,” ম্যাগিকে বলতে শুনলাম।

“না, বুঝলাম না,” বললাম আমি, “ডাইসি" নামটা যখন আমাদের পরিবারে প্রথম প্রচলিত হয় সেই সময়ে যখন আমি জীবিতই ছিলাম না, আমার কি দায় পড়েছে সেই কোন কাল অবধি এই নামের ঠিকুজী খুঁজে বার করবার?"

সে কেবল দাঁড়িয়ে হেসেই যেতে থাকলো, আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলো, ঠিক যেই দৃষ্টিতে লোকে গাড়ির কোন একটা নতুন মডেল পরীক্ষা করতে আসে। আর কিছুক্ষণ পরপরই আমার মাথার ওপর দিয়ে ওর সাথে ওয়ানজেরোর চোখাচোখি চলতে লাগলো।

“তা এই নামটাকে উচ্চারণ করতে হয় কীভাবে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“তোমার যদি ইচ্ছে না হয় তো তুমি আমায় এই নাম ডেকো না,” ওয়ানজেরো বললো।

“ডাকবো না কেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। “তুমি যদি চাও যে ওই নামেই আমরা তোমায় ডাকি, তো তাই ডাকবো।"

“তা প্রথম প্রথম একটু অদ্ভুত লাগবে বৈকি,” ওয়ানজেরো বললো।

“আমার অভ্যেস হয়ে যাবে,” আমি বললাম। “তুমি আরেকবার শুধু উচ্চারণটা শিখিয়ে দাও।”

নামের ব্যাপারটা বেশ দ্রুতই একটা নিষ্পত্তি হয়ে গেলো। "আসালামালাকিম" এর নামটা দেখা গেলো এর দ্বিগুণ লম্বা এবং তিন গুণ কঠিন। আমি সেটা উচ্চারণ করতে গিয়ে দু তিনবার হোঁচট খাবার পর সে আমায় বললো যে আমি তাকে কেবল হাকিম পরামানিক বলেই ডাকতে পারি। একবার মনে হলো ওকে জিজ্ঞাসা করি, যে ও কি সত্যি সত্যিই নাপিতের কাজ করে নাকি, কিন্তু দেখে যেহেতু তেমনটা মনে হলো না, তাই আর জিজ্ঞাসা করিনি।

“তুমি নিশ্চয়ই পথের শেষে ওই ওদিকটায় যারা গরুর পালের দেখাশোনা করে, ওদের লোক," আমি বললাম। ."ওরাও কারো সাথে দেখা হলে "আসালামালাকিম" বলে, যদিও ওরা অবশ্য কারো সাথে হাত মেলায় না। সবসময় ভীষণ ব্যস্ত; গরুকে খাওয়াচ্ছে, বেড়া ঠিক করছে, জানোয়ারদের জন্যে লবণের স্তূপ তৈরী করা, খড় ছড়ানো, আরও কত রকম কাজ। একবার যখন সাদা লোকেরা পালের কয়েকটা জানোয়ারকে বিষ খাওয়ালো, পুরুষগুলো সারারাত রাইফেল হাতে নিয়ে জেগে বসে পাহারা দিয়েছিল। আমি প্রায় দেড় মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম সে ঘটনাটা নিজের চোখে দেখবো বলে। হাকিম পরামানিক বললো, "আমি ওদের কায়দাকানুন কিছু কিছু মানি, তবে চাষবাস করা কিংবা গরুছাগল চড়ানো ঠিক আমার স্টাইল নয়।” ওরা আমায় বলেনি, আর আমিও জিজ্ঞাসা করতে যাইনি, ওয়ানজেরোর (ডি) সাথে ওর বিয়েটা আদৌ হয়েছে কিনা।

আমরা খেতে বসলাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাকিম বললো যে ও শাকসবজি বিশেষ খায় না আর শুয়োর হচ্ছে অপরিষ্কার জীব। ওয়ানজেরো কিন্তু নাড়িভুঁড়ি থেকে নিয়ে শুরু করে ভুট্টার রুটি অবধি সবটাই খেয়ে নিলো, এমনকি শাকসবজি সবসুদ্ধ। মিষ্টি আলু খাওয়া অবধি একেবারে নাকেমুখে তার কথা বলা চলতেই থাকলো। সবকিছুই সে দারুণ উপভোগ করছে। এমনকি এই যে আমরা চেয়ার কেনার সামর্থ্য নেই বলে খাবার টেবিলের সাথে চেয়ারের বদলে ওর বাবার হাতে তৈরী বেঞ্চগুলো ব্যবহার করছি সেটাও।

“ও মা!” ও চিৎকার করে উঠলো। তারপর হাকিম পরামানিকের দিকে ফিরে বলল, “আমি কোনদিন লক্ষই করিনি এই বেঞ্চগুলো এত সুন্দর। একবার বসলে পরে পেছনদিকটা যেন প্রায় ডুবে যায়,” নিজের হাতটা নিজের পেছন দিকটা আর বেঞ্চটার মাঝামাঝি বোলাতে বোলাতে ও বললো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতটা ঠাকুমা ডি'র মাখনদানীটার ওপর বোলাতে লাগলো। “এই তো!” বলে উঠলো সে। “আমি জানতাম যে এমন কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে যেটা আমি তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবো বলে চাইবো।" এবার সে এক লাফে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণায় রাখা দই পাতার ভাণ্ডটার দিকে এগিয়ে গেলো, সেটাতে দুধ এতক্ষণে প্রায় জমতে বসেছে। ভাণ্ডটার দিকে সে তাকিয়ে আছে তো আছেই।

“এই ভাণ্ডের চূড়োটা আমার চাই,” সে বললো। “এটা না বাডি মামা তোমাদের সেই গাছটার কাঠ থেকে বানিয়েছিলো?"

“হ্যাঁ,” আমি বললাম।

“আর হ্যাঁ,” খুশি মনে সে বললো, “আমার কিন্তু ওই মাখন তুলে নেবার হাতাটাও চাই।”

“ওটাও বুঝি বাডি মামার বানানো?” পরামানিক জানতে চাইলো।

ডি (ওয়ানজেররো) এবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো।

“ডি মাসীর প্রথম স্বামী ওটা বানিয়েছে,” ম্যাগি ফিসফিসিয়ে বললো, আরেকটু হলে প্রায় শোনাই যাচ্ছিলো না। “ওঁর নাম ছিল হেনরি, যদিও সবাই ওঁকে স্ট্যাশ বলেই ডাকতো।”

“ম্যাগির মগজটা, জানো তো, এক্কেবারে একটা হাতির মগজের মতন,” ওয়ানজেরো হাসতে হাসতে বললো। “ভাণ্ডের চূড়োটাকে আমি ওই কোণার টেবিলটায় একটা সেন্টারপিস হিসেবে রাখতে চাই,” ভাণ্ডটাকে একটা প্লেট দিয়ে ঢেকে দিতে দিতে সে বললে, “আর ওই মাখন তোলার হাতাটাকে দিয়েও বেশ শৈল্পিক কিছু একটা করে ফেলার কথা ভাবা যাবে। হাতাটা ও কাগজ দিয়ে মোড়ানোর পর দেখলাম হ্যাণ্ডেলটা বেরিয়ে আছে। সেটা মোড়াতে আমাকেই হাত লাগাতে হলো। একটু তাকালেই বোঝা যায় যে হাতটার কোথায় কোথায় হাতের ছাপ বহুব্যবহারে কাঠের গায়ে চিরকালের মত চিহ্ন রেখে গেছে। সত্যি বলতে কি, অনেকগুলো জায়গায় কাঠটা বেশ দেবে গেছে; লক্ষ করলে দেখা যায় কোথায় কোথায় আঙ্গুল আর বুড়ো আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। কাঠটা খুব সুন্দর হালকা হলুদ রঙের, বড় ডি আর স্ট্যাশ যেখানে থাকতো, সেই উঠোনেরই একটা গাছের কাঠ।

রাতের খাবারের পর ডি (ওয়ানজেরো) আমার বিছানার পায়ের কাছে রাখা ট্রাঙ্কটা খুলে ওর ভেতরকার জিনিসগুলো হাতড়াতে লাগলো। ম্যাগি তখনও রান্নাঘরে কাজ করছে। ওয়ানজেরো ট্রাঙ্ক থেকে দুটো নকশিকাঁথা বার করে নিয়ে এলো। ঠাকুমা ডি, বড় ডি আর আমি মিলে দাওয়ায় রাখা বড় কাঁথার ফ্রেমটাতে ঝুলিয়ে রেখে ওগুলো বানিয়েছি। তার একটা ছিল একাকী নক্ষত্রের নকশাওয়ালা। অন্যটা পাহাড় পরিক্রমণের। দুটোতেই ঠাকুমা ডি’র পঞ্চাশ বছর কি আরো পুরোনো বহু ব্যবহৃত জামার কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করা হয়েছিল। ঠাকুরদা জ্যারেলের কল্কিদার জামাটার টুকরো টুকরো অংশ। আর ছিল একটা রংচটা হালকা নীল টুকরো, ঠিক একটা দেশলাইয়ের বাক্সের সমান, সেটা ছিল ঠাকুরদার বাবা এজরার গৃহযুদ্ধের সময়কার সেনাবাহিনীর উর্দির একটা টুকরো।

“মা,” পাখির মতো মিষ্টি গলায় ওয়ানজেরো বললো। “আমায় এই নকশিকাঁথা দুটো দেবে, বলো?”

রান্নাঘর থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম, মিনিটখানেক পর রান্নাঘরের দরজাটা ঠাশ করে বন্ধ হয়ে গেলো।

“তুমি অন্য যেগুলো রয়েছে, তার থেকে দুয়েকটা নাও না কেন?” আমি বললাম। “এই পুরোনো দুটো আমি আর বড় ডি মিলে তোমার ঠাকুমার মৃত্যুর আগে তাঁর বানানো কিছু জামাকাপড় থেকে বানিয়েছিলাম।”

“না,” ওয়ানজেরো বললো। “আমি ওগুলো চাই না। ওগুলোর সবটুকু তো হাতের সেলাই নয়, বর্ডারে মেশিন দিয়ে সেলাই করা। ”

“সেজন্যেই তো ওগুলো আরো বেশি টেকসই,” আমি বললাম।

“ওটা কোন বিষয়ই নয়,” ওয়ানজেরো বললো। “এগুলো ঠাকুমার জামার টুকরো দিয়ে বানানো।আর এর সেলাইগুলোও তাঁর নিজের হাতে করা. ভাবা যায়!” এবার সে কাঁথাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে শক্ত করে বুকের কাছে ধরে রাখল।

“কোন কোন টুকরো, যেমন ধরো, ওই হালকা বেগুনি রঙেরগুলো, ওঁর মা ওঁকে দিয়েছিলেন,” কাঁথাগুলোয় হাত বুলিয়ে বললাম আমি।

ডি (ওয়ানজেরো) আমার থেকে খানিকটা দূরে সরে গেলো যাতে করে আমি কাঁথাগুলো ছুঁতে না পারি। ভাবখানা যেন ওগুলো ওরই হয়ে গেছে।

“ভাবা যায়!” ও কাঁথাগুলোকে জড়িয়ে ধরে আবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো।

“সত্যি বলতে কি,” আমি বললাম, “আমি ম্যাগিকে কথা দিয়েছি, ও যখন জন টমাসকে বিয়ে করবে তখন আমি ওকে ওগুলো দেবো।”

ওর গায়ে যেন ভোমরার হুল ফুটলো!

“ম্যাগি এসবের মূল্য বোঝে নাকি!” ও বললো। “ও হয়তোবা এগুলোকে রোজকার আটপৌরে ব্যবহারের কাজে লাগাবে।”

“হয়তো তাই,” আমি বললাম। “ঈশ্বর জানেন যে এতকাল আমি এগুলোকে বিনা ব্যবহারে বাঁচিয়ে রেখে এসেছি। আমি সত্যিই চাই এবার ও এগুলো ব্যবহার করুক!”আমি আর মনে করিয়ে দিলাম না যে ডি (ওয়ানজেরো) যখন কলেজে পড়বার জন্যে চলে যাচ্ছিলো, তখন আমি ওকে একটা কাঁথা সঙ্গে নিতে বলেছিলাম। তখন ওর মনে হয়েছিল, ওগুলো মান্ধাতার আমলের, মোটেও আধুনিক নয়।

“কিন্তু এগুলো যে অমূল্য!” এবার ও রীতিমত রেগে গেছে; যা বদমেজাজী স্বভাব! “ম্যাগি ওগুলোকে বিছানায় বিছিয়ে দেবে আর পাঁচ বছরের মাথায় ওগুলো ঘর মোছার ন্যাকড়া হয়ে যাবে! পাঁচ বছরও টিকবে না!”

“ও চাইলেই আরো বানিয়ে নিতে পারবে,” আমি বললাম। “ম্যাগি কাঁথা সেলাই করতে জানে।"

ডি (ওয়ানজেরো) এবার আমার দিকে ঘৃণার চোখে তাকালো। “সে তুমি বুঝবে না। আসল ব্যাপারটা হলো এই কাঁথাগুলো, ঠিক এই কাঁথাগুলোই আমার চাই!”

“বেশ,” আমি বললাম, খানিকটা ক্লান্ত হয়েই। “তুমিই বা এগুলো নিয়ে কি করবে?”

“বাঁধিয়ে রাখবো,” ও বললো। যেন একমাত্র বাঁধিয়ে রাখাটাই কাঁথার একমাত্র ব্যবহার!

ম্যাগি ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি কাঠের মেঝেতে ওর পা ঘষে ঘষে হেঁটে আসার শব্দটা ঠিকই শুনতে পেয়েছি।

“ওকে ওগুলো নিয়ে যেতে দাও, মা,” ও বললো, এমন একটা কণ্ঠে, যে আজীবন কেবল পরাজিত হতেই অভ্যস্ত, অথবা যার জন্যে কোনদিন কোন কিছু বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। “ওই কাঁথাগুলো ছাড়াও ঠাকুমা ডি’কে আমার দিব্যি মনে থাকবে।”

এবার আমি খুব খেয়াল করে ওর দিকে তাকালাম। ওর নিচের ঠোঁটে খানিকটা নস্যি ভরে নেয়ায় ঠোঁট, এমনকি সমস্তটা চেহারায় কেমন একটা ঝিমিয়ে পড়া, নেশাগ্রস্ত ভাব এসেছে। ঠাকুমা ডি আর বড় ডি নিজে ওকে কাঁথা সেলাই করতে শিখিয়েছিল। ও নিজের পোড়া হাতগুলোকে স্কার্টের ভাঁজে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বোনের দিকে ভয়ার্ত একটা দৃষ্টি মেলে ও দাঁড়িয়ে আছে, যদিও সে দৃষ্টিতে ক্ষোভ নেই। এইটুকুই ম্যাগির উত্তরাধিকার। এমন আচরণের ভেতর দিয়েই ও ঈশ্বরকে চিনে এসেছে।

ম্যাগির দিকে তাকাতেই ওর দৃষ্টির সেই অজানা আবেগটি সজোরে আমায় আঘাত করলো আর আমার মাথা থেকে পা অবধি যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। যেমনটা মাঝে মাঝে গির্জায় ঈশ্বরের আত্মা আমায় ছুঁয়ে গেলে হয়, আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠি! আমি প্রথমবার এমন কিছু করলাম, যা আগে কোনদিন করিনি; ম্যাগিকে জড়িয়ে ধরলাম, তারপর টেনে ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম, মিস ওয়ানজেরোর কাছ থেকে কাঁথাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে ওর কোলে তুলে দিলাম। ম্যাগি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়ে আমার বিছানাতেই বসে রইলো।

“অন্যগুলোর মধ্যে থেকে দুয়েকটা বেছে নাও,” আমি ডি’কে বললাম।

কিন্তু ও একটাও কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে হাকিম পরামানিকের কাছে গেলো।

“তুমি বুঝতে চাইছো না,” আমি আর ম্যাগি বের হয়ে গাড়ির কাছে আসতেই সে বললো।

“কি বুঝতে চাইছি না?” আমি জানতে চাইলাম।

“তোমার উত্তরাধিকার,” সে বললো। তারপর ম্যাগির দিকে ফিরে ওকে একটা চুমু খেয়ে বললো, “তোমার এবার কিছু একটা করা দরকার, ম্যাগি। আমাদের সবার জন্যেই একটা নতুন সময় এসেছে। অবশ্য তুমি আর মা যেভাবে বেঁচে আছো, তাতে করে তোমরা এর কিছু জানতেই পারলে না!”

এরপর ও কালো চশমা চোখে চাপালো, যাতে করে ওর চিবুক আর নাকের ওপর থেকে সবটুকুই লুকিয়ে রাখা যায়।

ম্যাগি এবার হাসলো; হয়তোবা কালো চশমাটার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু এটা একটা সত্যিকারের হাসি, বিন্দুমাত্র ভয়ের কোন লেশ তাতে নেই। গাড়িটার পেছনে উড়তে থাকা ধূলোগুলো দিগন্তে মিলিয়ে গেলে আমি এবার ম্যাগিকে বললাম আমাকে এক টিপ্ নস্যি এনে দিতে। তারপর দুজনে বসে খুব আরাম করে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘরে গিয়ে ঘুমোনোর সময় হলো, আমরা ততক্ষণ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম।





অনুবাদক পরিচিতি:

সুমু হক

অনুবাদক। প্রাবন্ধিক।

বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ