
সোমার মা একচোখো ছিল।
সোমার মা সোমারই মা বলে জানার আগের থেকেই উনি আমাদের মিস দাসগুপ্তা, ফিফথ গ্রেডের ক্লাস টিচার। মিসের সেই চোখটা আমার বেশ মনে আছে। বাঁ চোখ যেটা আসলে চোখ নয়। আমরা সবাই সেই চোখের কথা জানতাম প্রথমবার ওর ক্লাস করার অনেক আগেই।
ফিফথ গ্রেডের ক্লাসরুমে ডানদিকের ডেস্ক দখল করার জন্য সেদিন যে কি হুড়োহুড়ি! প্রথমদিন ক্লাসে এসে কল্কাপাড় গোধূলিরঙ্গা শাড়ির আঁচল টেনে শুরুতেই জানিয়ে দিলেন, আমি দুদিকেই দেখতে পাই কিন্তু রে। হেসেই বলেছিলেন। চোখও যে হাসিতে অংশ নেয় সেটা খুব ভাল করে বুঝেছিলাম সেইদিন। ডানদিকের ডেস্কে বসে ঠোঁটের হাসির সঙ্গে না মানানসই চোখের ভাষা খুব বিভ্রান্ত করেছিল আমাকে।
মিস দাশগুপ্তার বাঁ চোখটা ছিল কাঁচের। এমনিতে দেখতে তো একই। চোখের মনি তেমনি ঘন কালো, ফারাক করবার জো নেই। শুধু বাঁ চোখটার নড়াচড়া যেন কেমনধারা। ডান চোখের সঙ্গে সঙ্গে তাল দিয়ে চলার চেষ্টার কোন কসুর ছিল না, কিন্তু সেই হোঁচট খেয়ে চলায় যুগলবন্দী জমেনা। দুধ কে দুধ, জল কে জল।
আমার দাদু রাত্রে শোওয়ার আগে দাঁতের দুপাটি খুলে বিছানার পাশে গরম জলে ভিজিয়ে রাখতেন। খুব ছোটবেলায় এটা আমার জন্য খুব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। বাড়িতে যেই আসত আমি বলতাম দাদু হাসি খুলে রেখে স্বপ্ন দেখে। মিস দাশগুপ্তাও কি ঘুমোবার আগে চোখ খোলেন?
কথাটা ক্লাসে ফিসফিসিয়ে বলতেই আমাদের বন্ধু জিত বলেছিল মিসকে বললে উনি নাকি চোখ বের করে দেখিয়ে দেন। ওর দিদিদের ক্লাসে বছর কয়েক আগে এমন হয়েছিল। ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। চোখের মনি খুলে ফেললে কি থাকবে পিছনে? একটা সুরঙ্গ যেটা মাথার ঘিলু অবধি চলে গেছে? জিজ্ঞেস করা হয়নি কক্ষনো। কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। চোখটা কোকের বোতল খোলার মত পপিং শব্দে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই বুঝলাম ওটা আসলে মিসের ডান চোখ। মিসের বাড়িয়ে রাখা হাতে বসে ডান চোখটা নকল বাঁ চোখটাকে দেখছিল। আমি আর্ত চিৎকার করে বিছানা থেকে ধপাস।
চোখ কিভাবে দেখে সেটা জেনেছিলাম ক্লাস এইটে। মিস্টার পুতুতুন্ডুর লাইফ সায়ান্সের ক্লাসে। ছাত্রমহলে তার নাম ছিল থুতুকুন্ড, কারণ ক্লাস করানোর সময় তার মুখ দিয়ে খুব থুতু ছিটত। ওর ক্লাসে হঠাত করে ফার্স্ট বেঞ্চ খালি হয়ে যেতো ওই থুতুর ভয়ে। থুতুকুন্ড আবার ধরে ধরে সামনের বেঞ্চে লোক জোগাড় করে তবেই পড়াতে শুরু করত। থুতুকুন্ড বলেছিল কর্নিয়া আলোকে বেঁকিয়ে দেয় আর আইরিশ ছোটবড় হয়ে আলো কমবেশি করে। আরও বলেছিল রেটিনার কথা, যেখানে ইমেজটা উল্টো করে পড়ে। সেখান থেকে আবার মাথায় গেলে সেই ছবিই সোজা হয়ে যায়। এইসব শুনতে শুনতে আমার কষ্ট হচ্ছিল মিস দাসগুপ্তার বাঁ চোখটার জন্য। নকল চোখ দেখার জন্য তো নয়, ক্ষত লুকোনোর জন্য। এতসব কর্মকান্ডের কিছুই হয়না ওখানে, শীতল নিথর পড়ে থাকে। সব চাইতে বেশি খারাপ লাগছিল ব্রেনের সেই অংশটার জন্য যেখানে এই উল্টো ছবি পৌঁছানোর কথা। সে বেচারা বসে আছে কতকাল, কোন ছবি আসে না সেখানে। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলের মত। প্রজেক্টার আছে, কিন্তু কোন ফিল্ম রোল নেই।
অবশ্য থুতুকুন্ড সেই ভুলটা ভেঙ্গে দিলেন। আমাদের ক্লাসের প্রনমিতা বোধহয় প্রশ্নটা করেছিল। ও তো ক্লাসে ফার্স্ট হত, তাই সব ব্যাপারে ওকে প্রশ্ন করতেই হত। প্রনমিতা জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের দুটো চোখ থাকে কেন? আমরা কি দুটো চোখ দিয়ে আলাদা আলাদা দেখি আর তারপরে মাথার মধ্যে জুড়ে নিই?
খুব ভাল প্রশ্ন। খুশি হলে থুতুকুন্ডর আরও বেশি থুতু ছোটে। তৃপ্তির সঙ্গে অনেকটা থুতু ছিটিয়ে বললেন, আসলে দুটো চোখই একই সময়ে একই ছবি দ্যাখে। কিন্তু কি হয় জানিস, দুটো চোখের ছবি মিলেজুলে গেলে তবেই আমরা সবকিছুর গভীরতা বুঝতে পারি।
আর যদি কারো একটা চোখ না থাকে? তখন? প্রশ্নটা সোমা করেছিল। সোমার এই প্রশ্নটা চকের ধুলোর মত বাতাসে ভেসে রইল খানিক। স্যার তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, মানুষের এই শরীরটায় জানিস তো, ওস্তাদ কারিগরী। একটা সদাই চলমান যন্ত্র। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জানে। তাই যখন দুটো চোখ থাকে না, তখন ওই একটা চোখই সব কিছু সুসামঞ্জস করা শিখে নেয়।
জবাবটা জুতসই ছিল না, অনেকটা বড় হলে বুঝে যাবে টাইপের উত্তর। সোমার মুখ দেখেও বোঝা গেছিল ওর মাথার মধ্যে এই প্রশ্নটা ভেসে আছে, স্থান বদলায়নি একটুও।
কমিক্সে এক চোখঅলা দস্যুদের চোখটা কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। লোকগুলো হয়ও নিষ্ঠুর। সিনেমাতেও। মিস দাশগুপ্তা সেরকম ছিলেন না মোটেই। বেশ হাসিখুশি, সব সময়ে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পড়তেন। সবুজ, হলুদ, বেগুনি। সঙ্গে ম্যাচিং পাথরের গলার হার আর কানের টপ। আমাদের ইংরাজি আর ইতিহাস পড়িয়েছেন মিডল স্কুলে। মিস ইংরাজি পড়াতে পড়াতে ইতিহাসে চলে যেতেন আর ইতিহাস পড়াতে পড়াতে গল্পে। শুক্রবারের ক্লাসে ইতিহাসের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। সেইসময় ওর এক চোখ যে পাথরের সেটা ভুলেও যেতাম। অনেক সময় মিস নিজেই যেন মনে করিয়ে দিতেন। যেমন একবার বলেছিলেন স্প্যানিশ প্রিন্সেস আনা দে মেন্দোজার কথা, যার একটা চোখ ছোটবেলায় ফেন্সিং করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। মনে আছে এই গল্পটা শুনে ক্লাসে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল। মিসের চোখ কিভাবে নষ্ট হয়ে যায় সেই প্রশ্নটা নিশ্চয় ঘুরছিল সবার মনে। কিন্তু কেউ প্রশ্নটা করেনি। সেটা কি ছোটবেলায় বর্ণ পরিচয়ে কানাকে কান বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে? অথবা এই ভয়ে যে বললেই মিস টপ করে বাঁ চোখটা যদি হাতে নিয়ে নেন!
তাই বলে আমরা সুবোধ বালক বালিকা তো ছিলাম না কেউ। সামনে কানা না বললেও পিছনে বলতে কেউ ছাড়ত না। ওর নামই হয়ে গিয়েছিল কানারকলি। আসলে মিস দাসগুপ্তার নাম কাকলি ছিল তো, তার থেকে।বাচ্চারা কিছু কম নিষ্ঠুর হয়নাকি! যদিও সোমা আমাদের সেকশানে আসার পর আমাদের ক্লাসে মুখের উপর এই নামটা কেউ তুলত না। কিন্তু মিসের ক্লাসের সময় হলে একটা কানারকলি গুঞ্জন উঠত ঠিকই।
সোমা জানত, কাকিমাও।
সিক্সথ গ্রেডে পৌঁছে সোমার সঙ্গে আমি এক সেকশানে আসি। ওর কাছেই জেনেছিলাম কুড়ি বছর বয়সে কারো গুলতি থেকে ছুটে আসা পাথর লেগে বাঁ চোখটা নষ্ট হয়ে যায় কাকিমার। সোমার বাড়িতে গেলে আমি ওনাকে কাকিমা বলে ডাকতাম। স্কুলে মিস দাসগুপ্তা। স্কুলে সোমাও মাকে ডাকতো মিস বলে।
কাকিমা বেশ সুন্দরী ছিল, আনারকলির মতই হয়তো। ব্রাইট কালারের শাড়ি আর তার সঙ্গে মানানসই গয়না, বেশ যত্ন নিতেন নিজেকে নিয়ে। অথচ সোমাকে দেখে মনেই হত না ওই মায়ের মেয়ে। স্কুলে তো না হয় ইউনিফর্ম পড়ত সবুজ রঙের, কিন্তু তার বাইরে ওর সাজ পোশাক কেমন ম্রিয়মান ছিল। ঘিয়ে, আকাশি, বাদামী এইসব রং ছাড়া পড়তেই চাইত না। শুধু পোশাকের জন্য নয়, সাজগোজের দিকেও ওর নজর ছিল না তেমন। কোনমতে মাথার চুলটা দু বেনুনি সাদা ফিতে। ব্যাস, ওই অবধি। না একটা টিপ, না কিছু। কাকিমা যেমন চোখটানা সুন্দরী ছিলেন, সোমার চেহারা সেরকম নজরকাড়া ছিল না। কাকুকে দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম সোমা আসলে ওর বাবার মত দেখতে। কাকিমার পাশে ওনাকে মোটেই মানায় না। কিন্তু কাকুর দুটো চোখই ছিল, ওখানেই জিতে গেছেন।
নকল চোখ নিয়ে টাইগার পতৌদি কেমন শর্মিলা ঠাকুরকে বিয়ে করতে পারল, মিস দাশগুপ্তা এত সুন্দর দেখতে, আরও ভাল কাউকে বিয়ে করতে পারল না? এই প্রশ্নটাও আমার মাথায় অনেকবার ঘাই মেরেছে। তবে সেটা তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না, সোমাকে তো নয়ই। কিন্তু অনেকদিন পরে, যখন আমরা হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে দিয়েছি , একদিন আমি আর সোমা আমাদের খোলা ছাদে শতরঞ্চি পেতে আকাশ দেখছিলাম, সোমা বলল ভাল না বাসলে আমি কাউকে বিয়েই করবো না।
কেন বিয়ে করলেও তো ভালবাসা যায়।
সোমা অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, তারা গুনছিল হয়তো। আমি তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু হয়তো নয়। ফিসফিস করে একটু বাদে বলল, আমি যে কেন বাবার মত দেখতে হলাম!
কেন, এমন কেন বলছিস? আমি অবশ্য জানি ওর মায়ের মত দেখতে হলে অনেক সুন্দর মুখশ্রী হত সোমার, ঠিক ওর ভাইয়ের মত। তবে সোমারও দোষ আছে। নিজের একটু যত্ন করতে পারে না? চুলটা কেমন পুটুলির মত পাকিয়ে রেখেছে, মুখের তেমন যত্ন নেয় বলেও মনে হয় না। নিজেকে কেমন ছেড়ে দিয়েছিল।
কাকিমা কিছু বলেন না তোকে? একবার বোধহয় আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও ঠোঁট উলটে বলেছিল, মা করবে? নিজের সাজগোজ করে সময় পেলে তো! বরং বলে, ধিঙ্গি মেয়ে, নিজের চুলেও দুটো চিরুনি দিতে পারো না? সব কি একা এই মায়ের ঘাড়ে?
স্কুলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিসকে দেখেছি কি মিষ্টি করে হাসতেন, কোনদিন চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে হয়তো বললেন, এই মেয়েটা! আজকাল আর আমাদের বাড়ি আসিস না কেন রে?
আসবো মিস।
হ্যাঁ আসিস, আমাদের পাড়াটায় সোমার বয়সী কোন মেয়ে নেই তো, শনি রবিবার ও খুব মনমরা হয়ে থাকে।
আমি মিসের সঙ্গে সোমার বর্ণনার মাকে মিলাতে পারতাম না। সোমাকে বলেও ছিলাম সেটা কোন একদিন। শুনে ওর মুখটা কেমন একটেরে হয়ে গেছিল। হ্যাঁ, তোকে আসতে তো বলবেই। আমি তোর সঙ্গে থাকলে, মা ভাল করে ভাইয়ের দেখভাল করতে পারে।
অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়েছিলাম, ওর কষ্টটা কচুরিপানায় জলের মত টলটল করছিল চোখের মণিতে। সোমার চেহারায় ওর চোখটা ছিল সব থেকে বেশি আকর্ষণীয়, মুখের না যত্ন নেওয়া মরা ব্রণও সেই সৌন্দর্য লুকাতে পারত না।
ওর বাবাকেও দেখেছি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। হয়তো সোমা এইভাবে অগোছালো থেকে ওর অসুন্দর বাবাকে কাছাকাছি পেতে চাইত। মানুষের মনের খবর কে কতটা জানে।
সোমা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিস্তব্ধতার বেলুনটা আবার ফুটো করে দিল। মার চোখ নষ্ট হবার আগে বিয়ের কথা চলছিল, একরকম পাকাই হয়ে গিয়েছিল বলতে পারিস। অমনি সময়ে এই অ্যাক্সিডেন্টটা হল। মার বাঁ চোখটা নষ্ট হয়ে গেল।
তারপর?
তারপর আর কি? গেল ভেঙ্গে সেই বিয়ে ।
এমা, যার গুলতি থেকে ওই পাথরটা এসে লেগেছিল তাকে কেউ কিছু বলেনি? আমার কষ্ট আর রাগটা মনের ভিতর থেকে ছিল। মিস দাসগুপ্তা আমার ফেভারিট টিচার ছিলেন।
কে ছুঁড়েছে কে জানবে? মা দুপুর বেলা আম বাগানের পাশ দিয়ে ফিরছিল, কোথা থেকে কে মেরেছে! মাকে ছুঁড়ে তো আর মারেনি, হয়তো আম পাড়তে গিয়ে।
তাহলে গুলতি কি করে জানলি?
সবাই আন্দাজ করেছিল। ওই বাগানে গুলতি দিয়ে ছেলে ছোকরারা আম নাবাত কিনা।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটু বাদে সোমাই আবার গুনগুন করে উঠল। পরে মাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখান হল, এই কাঁচের চোখ লাগান হল। তারপর বিয়ে। কিন্তু মা বাবাকে কোনদিন সেভাবে ভালবাসতে পারেনি।
কেন?
বাবা মায়ের থেকে এক ইঞ্চি বেঁটে ছিল। আর ভাবসাবেও তো দেখেছিস, কেমন শান্ত নিরীহ। মার তুলনায় একদম অর্ডিনারি। বাবাকে এই নিয়ে যা তা বলে।
তুই কি করে জানলি?
খুব উদাস চোখে তাকাল সোমা। বাবা মায়ের মধ্যে কম কথা শুনেছি এই নিয়ে? আমাকে নিয়েও।
তোকে নিয়ে আবার কেন? আমি কানেকশানটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমি বাবার মত দেখতে যে। মা বাবাকে সহ্য করতে পারত না। আমি বাবার মতন দেখতে হওয়ায় আমাকেও না।
ধ্যাত! এরকম আবার হয় নাকি? তাছাড়া তোদের বাড়িতে যখন যাই কাকিমা কি মিষ্টি করে কথা বলেন। আমাকে এও বলেছেন সোমাটা অঙ্কে একটু কাঁচা, দেখিয়ে দিও তো।
তোকে বলেছে? কবে? অবিশ্বাস মিশে থাকায় গলাটা শিরিষ ঘষার মত খসখসে শোনাল।
টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হল, তারপর।
ও, এটা আসলে আমাকে ঘুরিয়ে বাজে বলা। মা তো খুব মিষ্টি কথার মানুষ, এমন তো বলতে পারে না যে সোমাটা কি বিচ্ছিরি, আবার দেখো অঙ্কেও এমন ঢেঁড়িয়েছে। সোমার কণ্ঠস্বরে নিশ্চিত করে জানার ভারসাম্য ছিল, কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না। ধ্যাত, তুই মিছিমিছি এরকম বলছিস।
বিশ্বাস না করতে হলে, করিস না। আমি তো রোজ দেখছি চোখের উপর। মার শুধু ভাই আর ভাই। যা আসবে বাড়িতে ভালটা আগে ভাইকে। মাছ হলে বড় টুকরোটা, পূজোর জামা আমার একটা হলে ওর ঠিক দুটো। বছরের পর বছর এমনি হতে দেখেছি।
সোমার ভাই সৌম্য ওর থেকে তিন বছরের ছোট ছিল। দেখলেই আমাকে কেমন দিদি দিদি করত। সেই ছোটবেলা থেকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ যে সব কিছু না চাইতেই পেয়ে যায় সে এমন আদিখ্যেতা করতে পারে। তোকে যদি প্রতিটা ইঞ্চিপাইয়ের জন্য লড়তে হত, তখন আর এভাবে বলতে পারতিস না। হিশহিস করে উঠল সোমা।
তোর বাবা কিছু বলে না?
বলার সাহস হবে? বললেই মা চুপ করিয়ে দেবে, তুমি আর মাঝখানে কোন কথা বলতে এসো না। এক তো আমার জীবনটা নষ্ট করে রেখেছো, এখন নাক গলাতে এসেছো ওদের জীবনে। অথচ দ্যাখ মা যখন চোখে গুলতির পাথর খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, বাবাই তো মাকে প্রথম ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেসলো।
কাকু তোর মাকে বিয়ের আগে চিনতো?
আহা, এক পাড়ার তো। বাবা যাচ্ছিল ওই রাস্তা দিয়েই সাইকেল করে। দেখতে পেয়ে –
সেই সময়েই কি তাহলে ওদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ছিল?
ভালোবাসা না কচু। পাড়ার ছেলে ওই অবধি। চোখ নষ্ট হওয়ায় মার সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেল, আর কিছু কথাও এগোচ্ছিল না, তখন বাবা এসে দাদুকে প্রস্তাবটা দিয়েছিল।
কারো বাবা মায়ের বিয়ে নিয়ে আলোচনাটা বোধহয় ঠিক না, কখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। আমি ওকে আর বেশি ঘাটাইও নি। তাছাড়া এরপর আমরা দুজনে আলাদা আলাদা কলেজে চলে গেলাম, আমি তো আবার কলকাতায় হোস্টেলে। দেখা হত কালে ভদ্রে।
তাই জানতামও না কাকিমা মারা গেছেন। আসলে কলেজের পর চাকরি বাকরি, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছিল। অনেক বছর বাদে আমাদের এক বন্ধু সুতপার বিয়েতে দেখা হল সোমার সঙ্গে। মভ কালারের একটা শাড়িতে ঝলমল করছিল সোমা। যেন গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে এসেছে। অনেক ব্যাপারে কাকিমার সঙ্গে ওর চেহারায় মিল আছে, সেটা আগে বোঝা যেতো না মোটেই।
তোকে কি লাগছে রে সোমা! দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমার ছোটবেলার বন্ধুকে।
বিয়েবাড়ির ভিড়, আরও অনেক বন্ধু বান্ধব , তাদের সঙ্গেও কতদিন বাদে দেখা। নিলীমা বলে আমাদের আরেক বন্ধু, সেই বলেছিল বোধহয় , জানিস তো মিস দাশগুপ্তা মারা গেলেন হঠাৎ?
শুনে চমকে উঠেছিলাম। সোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো। রাত্রে সুতপার বাসরঘরে আমরা ছিলাম, সেখান থেকেই আমাদের দুজনের কথা বলার একটা নির্জন মুহূর্ত বেরিয়ে এসেছিল।
তখনই নরম গলায় বললাম, শুনলাম কাকিমা আর নেই। এত খারাপ লাগছে শুনে।
সোমা কেমন চোখ ঝিকমিকিয়ে তাকাল আমার দিকে। সেটা চোখে জল অথবা চোখে ছিটকানো আলো হয়তো বা। তারপর ওর হলুদ চামড়ার ব্যাগ থেকে খুলে একটা বাক্স আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। একটা গয়নার বাক্স, আংটির বাক্স যেমন হয়। কিন্তু লাল ভেলভেটের মধ্যে আংটির জায়গায় একটা পাথরের মত। না পাথর নয় একটা ছাই রঙ্গা কাঁচের ঢ্যালা।
কি রে এটা?
মার চোখ।
মানে? আমি বিষম খেয়ে উঠলাম। ধরে দেখতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মাঝপথে আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো হাওয়ায় ভেসে রইল।
মাকে পোড়ানোর পরে সারা শরীর ছাই হয়ে গেলেও, চোখটা রয়ে গেছিল। কাঁচ গলতে আরও বেশি তাপ লাগে তো। নরম হয়ে শেপ বদলাতে শুরু করেছিল, কিন্তু গলে যায়নি।
অক্ষিকূট ছড়িয়ে পড়েছে, নয়নতারা ঝাপসা, আত্মার মুক্তি ঘটেছে।
তাই বলে, এটা নিয়ে ঘুরিস তুই? আমি আমার গলা থেকে বিস্ময়টা সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
বেঁচে থাকতে মা ভাইকে চোখে হারাত, সে চোখে আমার জায়গা ছিল কোথায় বল! মার চোখে পড়ার জন্য একসময় কম লড়েছি? এখন দ্যাখ, মার চোখটাকেই কেমন বন্দী করে ফেলেছি। এখন আমাকে ছেড়ে যাবে কোথায়? দেখতে হবে আমাকেই। একটা তৃপ্তির হাসিতে সোমার ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক চকচক করে উঠল।
মিস দাশগুপ্তার বাঁ চোখটা ছিল কাঁচের। এমনিতে দেখতে তো একই। চোখের মনি তেমনি ঘন কালো, ফারাক করবার জো নেই। শুধু বাঁ চোখটার নড়াচড়া যেন কেমনধারা। ডান চোখের সঙ্গে সঙ্গে তাল দিয়ে চলার চেষ্টার কোন কসুর ছিল না, কিন্তু সেই হোঁচট খেয়ে চলায় যুগলবন্দী জমেনা। দুধ কে দুধ, জল কে জল।
আমার দাদু রাত্রে শোওয়ার আগে দাঁতের দুপাটি খুলে বিছানার পাশে গরম জলে ভিজিয়ে রাখতেন। খুব ছোটবেলায় এটা আমার জন্য খুব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। বাড়িতে যেই আসত আমি বলতাম দাদু হাসি খুলে রেখে স্বপ্ন দেখে। মিস দাশগুপ্তাও কি ঘুমোবার আগে চোখ খোলেন?
কথাটা ক্লাসে ফিসফিসিয়ে বলতেই আমাদের বন্ধু জিত বলেছিল মিসকে বললে উনি নাকি চোখ বের করে দেখিয়ে দেন। ওর দিদিদের ক্লাসে বছর কয়েক আগে এমন হয়েছিল। ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। চোখের মনি খুলে ফেললে কি থাকবে পিছনে? একটা সুরঙ্গ যেটা মাথার ঘিলু অবধি চলে গেছে? জিজ্ঞেস করা হয়নি কক্ষনো। কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। চোখটা কোকের বোতল খোলার মত পপিং শব্দে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই বুঝলাম ওটা আসলে মিসের ডান চোখ। মিসের বাড়িয়ে রাখা হাতে বসে ডান চোখটা নকল বাঁ চোখটাকে দেখছিল। আমি আর্ত চিৎকার করে বিছানা থেকে ধপাস।
চোখ কিভাবে দেখে সেটা জেনেছিলাম ক্লাস এইটে। মিস্টার পুতুতুন্ডুর লাইফ সায়ান্সের ক্লাসে। ছাত্রমহলে তার নাম ছিল থুতুকুন্ড, কারণ ক্লাস করানোর সময় তার মুখ দিয়ে খুব থুতু ছিটত। ওর ক্লাসে হঠাত করে ফার্স্ট বেঞ্চ খালি হয়ে যেতো ওই থুতুর ভয়ে। থুতুকুন্ড আবার ধরে ধরে সামনের বেঞ্চে লোক জোগাড় করে তবেই পড়াতে শুরু করত। থুতুকুন্ড বলেছিল কর্নিয়া আলোকে বেঁকিয়ে দেয় আর আইরিশ ছোটবড় হয়ে আলো কমবেশি করে। আরও বলেছিল রেটিনার কথা, যেখানে ইমেজটা উল্টো করে পড়ে। সেখান থেকে আবার মাথায় গেলে সেই ছবিই সোজা হয়ে যায়। এইসব শুনতে শুনতে আমার কষ্ট হচ্ছিল মিস দাসগুপ্তার বাঁ চোখটার জন্য। নকল চোখ দেখার জন্য তো নয়, ক্ষত লুকোনোর জন্য। এতসব কর্মকান্ডের কিছুই হয়না ওখানে, শীতল নিথর পড়ে থাকে। সব চাইতে বেশি খারাপ লাগছিল ব্রেনের সেই অংশটার জন্য যেখানে এই উল্টো ছবি পৌঁছানোর কথা। সে বেচারা বসে আছে কতকাল, কোন ছবি আসে না সেখানে। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলের মত। প্রজেক্টার আছে, কিন্তু কোন ফিল্ম রোল নেই।
অবশ্য থুতুকুন্ড সেই ভুলটা ভেঙ্গে দিলেন। আমাদের ক্লাসের প্রনমিতা বোধহয় প্রশ্নটা করেছিল। ও তো ক্লাসে ফার্স্ট হত, তাই সব ব্যাপারে ওকে প্রশ্ন করতেই হত। প্রনমিতা জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের দুটো চোখ থাকে কেন? আমরা কি দুটো চোখ দিয়ে আলাদা আলাদা দেখি আর তারপরে মাথার মধ্যে জুড়ে নিই?
খুব ভাল প্রশ্ন। খুশি হলে থুতুকুন্ডর আরও বেশি থুতু ছোটে। তৃপ্তির সঙ্গে অনেকটা থুতু ছিটিয়ে বললেন, আসলে দুটো চোখই একই সময়ে একই ছবি দ্যাখে। কিন্তু কি হয় জানিস, দুটো চোখের ছবি মিলেজুলে গেলে তবেই আমরা সবকিছুর গভীরতা বুঝতে পারি।
আর যদি কারো একটা চোখ না থাকে? তখন? প্রশ্নটা সোমা করেছিল। সোমার এই প্রশ্নটা চকের ধুলোর মত বাতাসে ভেসে রইল খানিক। স্যার তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, মানুষের এই শরীরটায় জানিস তো, ওস্তাদ কারিগরী। একটা সদাই চলমান যন্ত্র। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জানে। তাই যখন দুটো চোখ থাকে না, তখন ওই একটা চোখই সব কিছু সুসামঞ্জস করা শিখে নেয়।
জবাবটা জুতসই ছিল না, অনেকটা বড় হলে বুঝে যাবে টাইপের উত্তর। সোমার মুখ দেখেও বোঝা গেছিল ওর মাথার মধ্যে এই প্রশ্নটা ভেসে আছে, স্থান বদলায়নি একটুও।
কমিক্সে এক চোখঅলা দস্যুদের চোখটা কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। লোকগুলো হয়ও নিষ্ঠুর। সিনেমাতেও। মিস দাশগুপ্তা সেরকম ছিলেন না মোটেই। বেশ হাসিখুশি, সব সময়ে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পড়তেন। সবুজ, হলুদ, বেগুনি। সঙ্গে ম্যাচিং পাথরের গলার হার আর কানের টপ। আমাদের ইংরাজি আর ইতিহাস পড়িয়েছেন মিডল স্কুলে। মিস ইংরাজি পড়াতে পড়াতে ইতিহাসে চলে যেতেন আর ইতিহাস পড়াতে পড়াতে গল্পে। শুক্রবারের ক্লাসে ইতিহাসের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। সেইসময় ওর এক চোখ যে পাথরের সেটা ভুলেও যেতাম। অনেক সময় মিস নিজেই যেন মনে করিয়ে দিতেন। যেমন একবার বলেছিলেন স্প্যানিশ প্রিন্সেস আনা দে মেন্দোজার কথা, যার একটা চোখ ছোটবেলায় ফেন্সিং করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। মনে আছে এই গল্পটা শুনে ক্লাসে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল। মিসের চোখ কিভাবে নষ্ট হয়ে যায় সেই প্রশ্নটা নিশ্চয় ঘুরছিল সবার মনে। কিন্তু কেউ প্রশ্নটা করেনি। সেটা কি ছোটবেলায় বর্ণ পরিচয়ে কানাকে কান বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে? অথবা এই ভয়ে যে বললেই মিস টপ করে বাঁ চোখটা যদি হাতে নিয়ে নেন!
তাই বলে আমরা সুবোধ বালক বালিকা তো ছিলাম না কেউ। সামনে কানা না বললেও পিছনে বলতে কেউ ছাড়ত না। ওর নামই হয়ে গিয়েছিল কানারকলি। আসলে মিস দাসগুপ্তার নাম কাকলি ছিল তো, তার থেকে।বাচ্চারা কিছু কম নিষ্ঠুর হয়নাকি! যদিও সোমা আমাদের সেকশানে আসার পর আমাদের ক্লাসে মুখের উপর এই নামটা কেউ তুলত না। কিন্তু মিসের ক্লাসের সময় হলে একটা কানারকলি গুঞ্জন উঠত ঠিকই।
সোমা জানত, কাকিমাও।
সিক্সথ গ্রেডে পৌঁছে সোমার সঙ্গে আমি এক সেকশানে আসি। ওর কাছেই জেনেছিলাম কুড়ি বছর বয়সে কারো গুলতি থেকে ছুটে আসা পাথর লেগে বাঁ চোখটা নষ্ট হয়ে যায় কাকিমার। সোমার বাড়িতে গেলে আমি ওনাকে কাকিমা বলে ডাকতাম। স্কুলে মিস দাসগুপ্তা। স্কুলে সোমাও মাকে ডাকতো মিস বলে।
কাকিমা বেশ সুন্দরী ছিল, আনারকলির মতই হয়তো। ব্রাইট কালারের শাড়ি আর তার সঙ্গে মানানসই গয়না, বেশ যত্ন নিতেন নিজেকে নিয়ে। অথচ সোমাকে দেখে মনেই হত না ওই মায়ের মেয়ে। স্কুলে তো না হয় ইউনিফর্ম পড়ত সবুজ রঙের, কিন্তু তার বাইরে ওর সাজ পোশাক কেমন ম্রিয়মান ছিল। ঘিয়ে, আকাশি, বাদামী এইসব রং ছাড়া পড়তেই চাইত না। শুধু পোশাকের জন্য নয়, সাজগোজের দিকেও ওর নজর ছিল না তেমন। কোনমতে মাথার চুলটা দু বেনুনি সাদা ফিতে। ব্যাস, ওই অবধি। না একটা টিপ, না কিছু। কাকিমা যেমন চোখটানা সুন্দরী ছিলেন, সোমার চেহারা সেরকম নজরকাড়া ছিল না। কাকুকে দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম সোমা আসলে ওর বাবার মত দেখতে। কাকিমার পাশে ওনাকে মোটেই মানায় না। কিন্তু কাকুর দুটো চোখই ছিল, ওখানেই জিতে গেছেন।
নকল চোখ নিয়ে টাইগার পতৌদি কেমন শর্মিলা ঠাকুরকে বিয়ে করতে পারল, মিস দাশগুপ্তা এত সুন্দর দেখতে, আরও ভাল কাউকে বিয়ে করতে পারল না? এই প্রশ্নটাও আমার মাথায় অনেকবার ঘাই মেরেছে। তবে সেটা তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না, সোমাকে তো নয়ই। কিন্তু অনেকদিন পরে, যখন আমরা হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে দিয়েছি , একদিন আমি আর সোমা আমাদের খোলা ছাদে শতরঞ্চি পেতে আকাশ দেখছিলাম, সোমা বলল ভাল না বাসলে আমি কাউকে বিয়েই করবো না।
কেন বিয়ে করলেও তো ভালবাসা যায়।
সোমা অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, তারা গুনছিল হয়তো। আমি তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু হয়তো নয়। ফিসফিস করে একটু বাদে বলল, আমি যে কেন বাবার মত দেখতে হলাম!
কেন, এমন কেন বলছিস? আমি অবশ্য জানি ওর মায়ের মত দেখতে হলে অনেক সুন্দর মুখশ্রী হত সোমার, ঠিক ওর ভাইয়ের মত। তবে সোমারও দোষ আছে। নিজের একটু যত্ন করতে পারে না? চুলটা কেমন পুটুলির মত পাকিয়ে রেখেছে, মুখের তেমন যত্ন নেয় বলেও মনে হয় না। নিজেকে কেমন ছেড়ে দিয়েছিল।
কাকিমা কিছু বলেন না তোকে? একবার বোধহয় আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও ঠোঁট উলটে বলেছিল, মা করবে? নিজের সাজগোজ করে সময় পেলে তো! বরং বলে, ধিঙ্গি মেয়ে, নিজের চুলেও দুটো চিরুনি দিতে পারো না? সব কি একা এই মায়ের ঘাড়ে?
স্কুলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিসকে দেখেছি কি মিষ্টি করে হাসতেন, কোনদিন চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে হয়তো বললেন, এই মেয়েটা! আজকাল আর আমাদের বাড়ি আসিস না কেন রে?
আসবো মিস।
হ্যাঁ আসিস, আমাদের পাড়াটায় সোমার বয়সী কোন মেয়ে নেই তো, শনি রবিবার ও খুব মনমরা হয়ে থাকে।
আমি মিসের সঙ্গে সোমার বর্ণনার মাকে মিলাতে পারতাম না। সোমাকে বলেও ছিলাম সেটা কোন একদিন। শুনে ওর মুখটা কেমন একটেরে হয়ে গেছিল। হ্যাঁ, তোকে আসতে তো বলবেই। আমি তোর সঙ্গে থাকলে, মা ভাল করে ভাইয়ের দেখভাল করতে পারে।
অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়েছিলাম, ওর কষ্টটা কচুরিপানায় জলের মত টলটল করছিল চোখের মণিতে। সোমার চেহারায় ওর চোখটা ছিল সব থেকে বেশি আকর্ষণীয়, মুখের না যত্ন নেওয়া মরা ব্রণও সেই সৌন্দর্য লুকাতে পারত না।
ওর বাবাকেও দেখেছি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। হয়তো সোমা এইভাবে অগোছালো থেকে ওর অসুন্দর বাবাকে কাছাকাছি পেতে চাইত। মানুষের মনের খবর কে কতটা জানে।
সোমা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিস্তব্ধতার বেলুনটা আবার ফুটো করে দিল। মার চোখ নষ্ট হবার আগে বিয়ের কথা চলছিল, একরকম পাকাই হয়ে গিয়েছিল বলতে পারিস। অমনি সময়ে এই অ্যাক্সিডেন্টটা হল। মার বাঁ চোখটা নষ্ট হয়ে গেল।
তারপর?
তারপর আর কি? গেল ভেঙ্গে সেই বিয়ে ।
এমা, যার গুলতি থেকে ওই পাথরটা এসে লেগেছিল তাকে কেউ কিছু বলেনি? আমার কষ্ট আর রাগটা মনের ভিতর থেকে ছিল। মিস দাসগুপ্তা আমার ফেভারিট টিচার ছিলেন।
কে ছুঁড়েছে কে জানবে? মা দুপুর বেলা আম বাগানের পাশ দিয়ে ফিরছিল, কোথা থেকে কে মেরেছে! মাকে ছুঁড়ে তো আর মারেনি, হয়তো আম পাড়তে গিয়ে।
তাহলে গুলতি কি করে জানলি?
সবাই আন্দাজ করেছিল। ওই বাগানে গুলতি দিয়ে ছেলে ছোকরারা আম নাবাত কিনা।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটু বাদে সোমাই আবার গুনগুন করে উঠল। পরে মাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখান হল, এই কাঁচের চোখ লাগান হল। তারপর বিয়ে। কিন্তু মা বাবাকে কোনদিন সেভাবে ভালবাসতে পারেনি।
কেন?
বাবা মায়ের থেকে এক ইঞ্চি বেঁটে ছিল। আর ভাবসাবেও তো দেখেছিস, কেমন শান্ত নিরীহ। মার তুলনায় একদম অর্ডিনারি। বাবাকে এই নিয়ে যা তা বলে।
তুই কি করে জানলি?
খুব উদাস চোখে তাকাল সোমা। বাবা মায়ের মধ্যে কম কথা শুনেছি এই নিয়ে? আমাকে নিয়েও।
তোকে নিয়ে আবার কেন? আমি কানেকশানটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমি বাবার মত দেখতে যে। মা বাবাকে সহ্য করতে পারত না। আমি বাবার মতন দেখতে হওয়ায় আমাকেও না।
ধ্যাত! এরকম আবার হয় নাকি? তাছাড়া তোদের বাড়িতে যখন যাই কাকিমা কি মিষ্টি করে কথা বলেন। আমাকে এও বলেছেন সোমাটা অঙ্কে একটু কাঁচা, দেখিয়ে দিও তো।
তোকে বলেছে? কবে? অবিশ্বাস মিশে থাকায় গলাটা শিরিষ ঘষার মত খসখসে শোনাল।
টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হল, তারপর।
ও, এটা আসলে আমাকে ঘুরিয়ে বাজে বলা। মা তো খুব মিষ্টি কথার মানুষ, এমন তো বলতে পারে না যে সোমাটা কি বিচ্ছিরি, আবার দেখো অঙ্কেও এমন ঢেঁড়িয়েছে। সোমার কণ্ঠস্বরে নিশ্চিত করে জানার ভারসাম্য ছিল, কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না। ধ্যাত, তুই মিছিমিছি এরকম বলছিস।
বিশ্বাস না করতে হলে, করিস না। আমি তো রোজ দেখছি চোখের উপর। মার শুধু ভাই আর ভাই। যা আসবে বাড়িতে ভালটা আগে ভাইকে। মাছ হলে বড় টুকরোটা, পূজোর জামা আমার একটা হলে ওর ঠিক দুটো। বছরের পর বছর এমনি হতে দেখেছি।
সোমার ভাই সৌম্য ওর থেকে তিন বছরের ছোট ছিল। দেখলেই আমাকে কেমন দিদি দিদি করত। সেই ছোটবেলা থেকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ যে সব কিছু না চাইতেই পেয়ে যায় সে এমন আদিখ্যেতা করতে পারে। তোকে যদি প্রতিটা ইঞ্চিপাইয়ের জন্য লড়তে হত, তখন আর এভাবে বলতে পারতিস না। হিশহিস করে উঠল সোমা।
তোর বাবা কিছু বলে না?
বলার সাহস হবে? বললেই মা চুপ করিয়ে দেবে, তুমি আর মাঝখানে কোন কথা বলতে এসো না। এক তো আমার জীবনটা নষ্ট করে রেখেছো, এখন নাক গলাতে এসেছো ওদের জীবনে। অথচ দ্যাখ মা যখন চোখে গুলতির পাথর খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, বাবাই তো মাকে প্রথম ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেসলো।
কাকু তোর মাকে বিয়ের আগে চিনতো?
আহা, এক পাড়ার তো। বাবা যাচ্ছিল ওই রাস্তা দিয়েই সাইকেল করে। দেখতে পেয়ে –
সেই সময়েই কি তাহলে ওদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ছিল?
ভালোবাসা না কচু। পাড়ার ছেলে ওই অবধি। চোখ নষ্ট হওয়ায় মার সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেল, আর কিছু কথাও এগোচ্ছিল না, তখন বাবা এসে দাদুকে প্রস্তাবটা দিয়েছিল।
কারো বাবা মায়ের বিয়ে নিয়ে আলোচনাটা বোধহয় ঠিক না, কখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। আমি ওকে আর বেশি ঘাটাইও নি। তাছাড়া এরপর আমরা দুজনে আলাদা আলাদা কলেজে চলে গেলাম, আমি তো আবার কলকাতায় হোস্টেলে। দেখা হত কালে ভদ্রে।
তাই জানতামও না কাকিমা মারা গেছেন। আসলে কলেজের পর চাকরি বাকরি, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছিল। অনেক বছর বাদে আমাদের এক বন্ধু সুতপার বিয়েতে দেখা হল সোমার সঙ্গে। মভ কালারের একটা শাড়িতে ঝলমল করছিল সোমা। যেন গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে এসেছে। অনেক ব্যাপারে কাকিমার সঙ্গে ওর চেহারায় মিল আছে, সেটা আগে বোঝা যেতো না মোটেই।
তোকে কি লাগছে রে সোমা! দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমার ছোটবেলার বন্ধুকে।
বিয়েবাড়ির ভিড়, আরও অনেক বন্ধু বান্ধব , তাদের সঙ্গেও কতদিন বাদে দেখা। নিলীমা বলে আমাদের আরেক বন্ধু, সেই বলেছিল বোধহয় , জানিস তো মিস দাশগুপ্তা মারা গেলেন হঠাৎ?
শুনে চমকে উঠেছিলাম। সোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো। রাত্রে সুতপার বাসরঘরে আমরা ছিলাম, সেখান থেকেই আমাদের দুজনের কথা বলার একটা নির্জন মুহূর্ত বেরিয়ে এসেছিল।
তখনই নরম গলায় বললাম, শুনলাম কাকিমা আর নেই। এত খারাপ লাগছে শুনে।
সোমা কেমন চোখ ঝিকমিকিয়ে তাকাল আমার দিকে। সেটা চোখে জল অথবা চোখে ছিটকানো আলো হয়তো বা। তারপর ওর হলুদ চামড়ার ব্যাগ থেকে খুলে একটা বাক্স আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। একটা গয়নার বাক্স, আংটির বাক্স যেমন হয়। কিন্তু লাল ভেলভেটের মধ্যে আংটির জায়গায় একটা পাথরের মত। না পাথর নয় একটা ছাই রঙ্গা কাঁচের ঢ্যালা।
কি রে এটা?
মার চোখ।
মানে? আমি বিষম খেয়ে উঠলাম। ধরে দেখতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মাঝপথে আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো হাওয়ায় ভেসে রইল।
মাকে পোড়ানোর পরে সারা শরীর ছাই হয়ে গেলেও, চোখটা রয়ে গেছিল। কাঁচ গলতে আরও বেশি তাপ লাগে তো। নরম হয়ে শেপ বদলাতে শুরু করেছিল, কিন্তু গলে যায়নি।
অক্ষিকূট ছড়িয়ে পড়েছে, নয়নতারা ঝাপসা, আত্মার মুক্তি ঘটেছে।
তাই বলে, এটা নিয়ে ঘুরিস তুই? আমি আমার গলা থেকে বিস্ময়টা সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
বেঁচে থাকতে মা ভাইকে চোখে হারাত, সে চোখে আমার জায়গা ছিল কোথায় বল! মার চোখে পড়ার জন্য একসময় কম লড়েছি? এখন দ্যাখ, মার চোখটাকেই কেমন বন্দী করে ফেলেছি। এখন আমাকে ছেড়ে যাবে কোথায়? দেখতে হবে আমাকেই। একটা তৃপ্তির হাসিতে সোমার ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক চকচক করে উঠল।
লেখক পরিচিতি:
বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
কথাসাহিত্যিক।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে থাকেন।
2 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ লাগল এই বিচিত্র মানব মনস্তাত্ত্বিক গল্প, মানুষের অসহায়তার এ-ই কাহিনী।
উত্তরমুছুনঅনবদ্য
উত্তরমুছুন