সেসার আইরা'র গল্প: কুকুর


অনুবাদ: সুমু হক

রাস্তার দিকে চোখ রেখে বাসের জানালার সিটে বসে ছিলাম। হঠাৎ কাছেই কোথাও একটা কুকুর খুব জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। দেখতে চাইলাম কুকুরটা কোথায়। অন্য যাত্রীরাও ফিরে তাকালো। 
বাসটায় খুব বেশি ভীড় ছিল না; সিটগুলো সব ভরা থাকলেও অল্প ক'জন মাত্র যাত্রী দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো; কুকুরটাকে সব থেকে ভালোভাবে দেখতে পাওয়া ওই লোকগুলোর পক্ষেই সম্ভব ছিল, একে তো ওরা দাঁড়িয়ে থাকায় ওপর থেকে ভালো ভাবে সবটা দেখতে পাচ্ছিলো, তাছাড়া রাস্তার দুটো দিক দেখতে পাওয়া ওদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। অবশ্য আমার মতো কেউ বাসের ভেতর বসে থাকলেও উচ্চতার কারণে বেশ একটা ওপরতলা থেকে দেখার মতো অনুভূতি হয়, আমাদের পূর্বপুরুষদের বোধহয় ঘোড়ায় চড়লে এরকমটাই মনে হতো: যাকে বলে বেশ একটা ক্যাভেলিয়ের দৃষ্টিভঙ্গি। এই জন্যেই আমার গাড়ির চাইতে বাস অনেক বেশি পছন্দ, তা নইলে গাড়িতে চড়লে মাটির বড্ড কাছাকাছি, একেবারে নিচু হয়ে পথ চলতে হয়। কুকুরটার ডাক আমার এক পাশ থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছিলো, হিসেবমতো ফুটপাথের দিকটাই হবার কথা। তারপরও, আমি কুকুরটাকে দেখতে পেলাম না, আর তাছাড়া বাসটা যেহেতু বেশ জোরেই চলছিলো; আমি ভাবলাম, আমরা বোধহয় কুকুরটাকে পেরিয়ে এসেছি। রাস্তার ধারে ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটলে যতখানি কৌতূহল সৃষ্টি হয় কুকুরটা সেরকম সামান্যই কৌতূহল তৈরী করেছিল মাত্র, যদিও এক্ষেত্রে কুকুরের ডাকের শব্দের জোর আওয়াজটুকু ছাড়া আর কিছু যে ঘটেছে তার খুব অল্প চিহ্ন ছিল; শহরের লোকজনেরা যেসব কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরোয় সেগুলো সচরাচর অন্য কুকুর ছাড়া আর কাউকে দেখে খুব একটা ডাকে না। লোকজনের মনোযোগ তাই এর মধ্যেই সরে যেতে শুরু করেছিল ... এমন সময় হঠাৎ করেই সেটা আবার ফিরে এলো: কুকুরের ডাকটা আবার শুরু হয়েছে, আগের চেয়েও জোরে। তখনই কুকুরটাকে দেখতে পেলাম। ফুটপাথের ধার ঘেঁষে বাসটাকে লক্ষ করে ঘেউঘেউ করতে করতে দৌড়চ্ছে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আগেকার দিনে, মফস্বল শহর, কিংবা শহরতলির দিকে কুকুরগুলো গাড়ির পেছন পেছন দৌড়তো বটে, গাড়ির চাকার দিকে ঘেউঘেউ করতে করতে; প্রিঙ্গলসে কাটানো আমার ছেলেবেলার দিনগুলো থেকে এই ছবিটা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে। যদিও এখন আর তেমনটা দেখ যায় না; ব্যাপারটা যেন এরকম, যে কুকুরগুলো বিবর্তিত হতে হতে এখন গাড়ির উপস্থিতিতে রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর তাছাড়া, এই কুকুরটা ঠিক শুধু বাসের চাকাগুলোর দিকে লক্ষ করেও ডাকছিলো না, বরং খানিকটা মাথা তুলে বাসটাকে লক্ষ করেই ডাকছিল, জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। এতক্ষণে প্রায় সবগুলো যাত্রীর চোখই ঘুরে গেছে সেদিকে। তবে কি কুকুরটার মালিক বাসে উঠে পড়লো, কুকুরটাকে ভুলে ফেলে রেখে, কিংবা ইচ্ছে করেই ? অথবা ওর মালিককে আক্রমণ করেছে কিংবা ছিনতাই করেছে এমন কেউ ? কিন্তু না, বাসটাতো বেশ অনেক ক'টা ব্লক ধরে একটুও না থেমেই আভেনিদা ডিরেক্টরিওর ওপর দিয়ে সোজা চলছিল, আর কুকুরটাও পিছু নিয়েছে কেবল এই শেষ ব্লকটা থেকেই। আরো একটা ব্যাখ্যা হতে পারতো যদিও - যেমন ধরা যাক, বাসটা কুকুরটার মালিককে চাপা দিয়েছে, কিংবা আরেকটা কুকুরকে - সে সম্ভাবনাগুলোকেও বাদ দেয়া চলে, কেন না তেমন কিছুই ঘটেনি। আজকের রবিবারের এই বিকেলে রাস্তাঘাটও বেশ ফাঁকাই বলা চলে; কোন দুর্ঘটনা হলে সেটা কারো চোখ এড়ানো সম্ভবই ছিল না।

কুকুরটা বেশ বড়, ছাই রঙের, মুখের ওপর ত্রিকোণাকৃতির একটা মাজল পরানো, জাতিতে খাঁটি আর নেড়ি কুকুরের শঙ্করবিশেষ, যদিও অবশ্য বুয়েনোস আইরেসের রাস্তায় নেড়ি কুকুরের দেখা পাওয়াটা আজকাল ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে বললেই চলে, অন্তত এই মুহূর্তে আমরা যে এলাকাটি পার হচ্ছি সেখানে। কুকুরটা ভয় পাওয়ার মতো বিশালাকৃতির না হলেও, সে একবার রেগে গেলে ওকে দেখে ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ ছিল। আর এই মুহূর্তে সে বেশ রেগে আছে বলেই মনে হচ্ছিলো, কিংবা বলা ভালো মরিয়া আর উদ্বিগ্ন হয়ে আছে ( অন্ততপক্ষে এই মুহূর্তে)। যে আবেগ ওটাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছিলো সেটা (অন্ততপক্ষে, এই মুহূর্তে ) আগ্রাসন না হলেও বাসটাকে ধরতে পারার একটা তীব্র জেদ, বা থামাবার, অথবা… কে জানে ?

রেসটা চলতে লাগলো, আর তার সাথে সাথে চলতে লাগলো ঘেউ ঘেউ করা। এতক্ষণ ধরে আগের মোড়ে লালবাতিতে আটকে থাকা বাসটা এবার গতি বাড়ালো। এবার সেটা ফুটপাথের ধার ঘেঁষে চলতে লাগলো, কুকুরটা যার ওপর দৌড়চ্ছিল, দৌড়তে দৌড়তে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগলো। আমরা ততক্ষণে পরের মোড়টাতে পৌঁছে গেছি প্রায়, মনে হতে লাগলো, এবার বোধহয় রেসটা শেষ হতে চললো। কিন্তু হঠাৎ, আমাদেরকে চমকে দিয়ে, কুকুরটাও এক দৌড়ে পার হয়ে পরের ব্লকে চলে এলো এবং আবারও আমাদেরকে তাড়া করে চললো, সেইসাথে চললো গতি বাড়ানো আর চিৎকার করাও। ভাগ্যিস ফুটপাথে তখন খুব বেশি লোক ছিল না, তা নাহলে কুকুরটা ওদেরকে মাড়িয়ে চলে যেত, যেমন করে তেড়ে চলেছে, চোখদুটো স্থির বাসের জানালাগুলোর দিকে। ওর ডাকগুলো ক্রমশ জোরালো থেকে আরো জোরালো হয়ে উঠতে লাগলো; রীতিমতো কান ঝালাপালা হয়ে যাবার যোগাড়, এমনকি মোটরের আওয়াজ পর্যন্ত তার নিচে চাপা পরে গেলো, সমস্ত পৃথিবীতে যেন এই একটাই শব্দ কেবল। শুরু থেকেই বোঝা উঠিত ছিল এমন একটা বিষয় এতক্ষণে কেবল স্পষ্ট হতে শুরু করলো: কুকুরটা নিশ্চয়ই এমন কাউকে দেখেছে কিংবা এমন কারো ঘ্রাণ পেয়েছে যে এই বাসে করে চলেছে, ও ঠিক তার পিছু নিয়েছে।

কোন একজন যাত্রী, আমাদের মধ্যেই কেউ একজন … এই কথাটা নিশ্চয়ই অন্য সবার মাথাতেও এসেছে; লোকজন সবাই কৌতূহলী চোখে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো। কেউ কি কুকুরটাকে চিনতো ? ব্যাপারটা কি? আগের কোন মালিক, এমন কেউ যাকে কুকুরটা আগে কোন একসময় জানতো … আমিও চারদিকে তাকাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম, কে হতে পারে ? এই ধরনের ঘটনায় যা হয় আর কি, যার কথা একদম সব শেষে মনে পরে সে হলো তুমি নিজে! আমারও বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল বুঝে উঠতে। আর সেই উপলব্ধিটাও খুব সোজাসুজি হলো তাও নয়। হঠাৎ, কেমন একটা আবছা পূর্বাভাস আমাকে নাড়িয়ে দিতেই আমি যেন সামনের দিকে তাকালাম, উইন্ডস্ক্রিন পার করে। দেখতে পেলাম যে সামনের রাস্তাটা দিব্যি পরিষ্কার,: আমাদের সামনে আদিগন্ত সবুজ আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে, খুব দ্রুত, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে, এগিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি যেন। কিন্তু তারপরই, নিজের ভেতরে একধরনের অস্বস্তি টের পেলাম, যখন মনে পড়লো, আমি কোন ট্যাক্সির ভেতরে বসে নেই; প্রতি চার কি পাঁচ ব্লক অন্তর বাসের একটা করে নির্দিষ্ট স্টপ আছে কিনা। যদিও একথাও ঠিক, যে সেই বাস স্টপগুলোতে যদি কেউ দাঁড়িয়ে না থাকে, কিংবা বাস থেকে নামবার জন্যে কেউ যদি ঘন্টি না বাজায়, তবে বাসটা সেই স্টপগুলোতে না থেমে চলতেই থাকবে। এখন অবধি কাউকে বাসের পেছনের দরজার দিকে যেতে দেখা গেলো না। আর ভাগ্য ভালো থাকলে এর পরের স্টপটাতেও কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। এই সব ভাবনাগুলো একসাথে মাথার ভেতর খেলতে লাগলো।

আমার অস্বস্তিটা বেড়েই চললো আর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইলো। কিন্তু সমস্ত ঘটনা এতই দ্রুত ঘটে চলেছে যে তার জন্যেও যথেষ্ট সময় পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা, এমনটা কি হতে পারে না, যে ঘটনাচক্রে বাসটা না থেমে একটানা চলতে লাগলো ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না কুকুরটা ক্লান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছে ? এক মুহূর্তের জন্যে ওর থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে পরক্ষণেই আবার ওর দিকে তাকালাম। ও তখনও সমান তালে দৌড়ে যাচ্ছে, ভূতে পাওয়া কোন জন্তুর মতো একটানা ডেকেই চলেছে … আর এইবার ওর দৃষ্টির লক্ষ আমি। এবার আমি নিশ্চিত; ও আমাকে লক্ষ করেই ডাকছে, আমারই পিছু নিয়েছে। খুব অপ্রত্যাশিত কোন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে যে রকমটা হয়, সেই রকমের একটা আতঙ্ক আমায় ঘিরে ধরলো। কুকুরটা আমায় চিনে ফেলেছে, এবং আমাকেই ধরতে আসছে। এবং যদিও, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনার অপ্রত্যাশিত প্রত্যাঘাতে আমি সমস্ত বিষয়টাকে অস্বীকার করতে নিজেকে প্রস্তুত করলাম, এবং কিছুতেই কোন অপরাধ স্বীকার করবোনা বলে স্থির করলাম, মনে মনে নিশ্চিত জানি, কুকুরটি ঠিক জানে, আমিই দোষী। একদিন আমি ওর সাথে চরম দূর্ব্যবহার করেছিলাম; ওর সাথে আমি যা করেছিলাম, সেটা ছিল সত্যিই অবর্ণনীয়, অবমাননকর। একথা স্বীকার করতেই হয় যে আমি কোনকালেই ঠিক যাকে বলা যায় খুব একটা দৃঢ় নীতিবাগীশ কেউ ছিলাম না। তাই আমি নিজের পক্ষে সাফাই গাইবার চেষ্টাও করবো না, কিন্তু এই মূল্যবোধের অভাবটাকে বোধহয় আমার খুব অল্পবয়স থেকে চলে আসা অবিশ্রান্ত বেঁচে থাকার লড়াই দিয়ে খানিকটা হলেও ব্যাখ্যা করা যায়। এই লড়াইটা ক্রমান্বয়ে আমার ন্যায়-অন্যায়ের বোধটাকে অনেকটাই ভোঁতা করে দিয়েছিল। আমি নিজেকে এমন সব কাজ করতে দিয়েছি, যা কোন ভদ্র-সভ্য মানুষ কখনোই করবে না। করবে কি ? আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু লুকোনো দিক আছে। তাছাড়া, আমার অপরাধগুলো কখনোই খুব ভয়ংকর কোনকিছু ছিল না।আমি কোন সত্যিকারের অপরাধ করিনি। আর যা করেছি সেসব ভুলেও যাইনি, যেমনটা সত্যিকারের অপরাধীরা করে থাকে। নিজেকে চিরকাল বুঝিয়ে এসেছি, যে আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো, যদিও কখনো ভাবিনি, ঠিক কি করে সেটা করবো। পুরো ব্যাপারটাই এত অপ্রত্যাশিত: এমন অদ্ভূতভাবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া, যে অতীতকে বহুকাল আগে স্মৃতির অতীত করে সমাহিত করে দিয়েছি, তার মুখোমুখি হওয়া। 
 
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, মনে মনে আমি এতকাল ভেবে এসেছি এতকাল পর আমি নিশ্চিত ভাবে দায়মুক্ত হয়ে গেছি। আমার জায়গায় অন্য যে কেউ হলেও সেটাই ভাবতো, হাজার হোক, একটা কুকুর তো একটা কুকুরই, হাজার হাজার কুকুরের মাঝে ওকে কেই বা আলাদা করে চিনবে, ও ঠিক হারিয়ে যাবে। আর সেই হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমার অপরাধও। আমার ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতা কিছুক্ষণের জন্যে এই কুকুরটিকে একটা আলাদা সত্ত্বা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ওই কিছুক্ষণের জন্যেই। সমস্ত ভাবনাটার মধ্যে এমন একটা অতিলৌকিক এবং ভয়ানক ব্যাপার ছিল যে মনে হতে পারে ওই কয়েকটা মুহূর্ত কে মনে হচ্ছিলো অনেক অনেকগুলো বছরের সমান। কিন্তু, তারপর সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে যেই আরেকটু ভাবলাম, একটু আশার আলো দেখতে পেলাম, এবং সেটাকেই আঁকড়ে ধরলাম: অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। কুকুরেরা এত বছর বাঁচেই না। বছরগুলোকে যদি সাত দিয়ে গুণ করি তবে ... এই চিন্তাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো, আর চাপা থেকে ক্রমশ জোরালো হতে থাকা ঘেউ ঘেউ ডাকের সাথে মিলে মিশে যাচ্ছিলো। না, মোটেই খুব বেশি সময় পার হয়ে যায়নি; হিসেবে করে কেবল নিজেকেই চোখ ঠাড়া হবে। আমার শেষ ভরসা ছিল, সমস্ত বিষয়টাকে অস্বীকার করতে পারা, যে কোন দুর্বহ বিষয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের প্রথম যে মনস্তাত্বিক প্রতিক্রিয়া হয় আর কি; এ হতেই পারে না, এ কিছুতেই হচ্ছে না, আমি স্বপ্ন দেখছি, আমি নিশ্চয়ই সমস্ত বিষয়টার একটা ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছি। কিন্তু এবারে এটা শুধুমাত্র একটা মনস্তাত্বিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটা রীতিমতো বাস্তব। এতটাই সত্যি যে আমি কুকুরটার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিনা; আমি ভাবতেও ভয় পাচ্ছি যে ও ঠিক কি ভাবছে। কিন্তু আমি তো নিস্পৃহ ভাব দেখানোর পক্ষেও খুব বেশি ঘাবড়ে গেছি। আমি বোধহয় একমাত্র যাত্রী যে সোজা তাকিয়ে; বাকি সব যাত্রীরা রেসটাকে দেখছে, এমনকি ড্রাইভার অবধি, সে তো রীতিমতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে, অথবা রিয়ারভিউ মিররে, তার সাথে চলছে সামনে বসা যাত্রীদের সাথে ঠাট্টাতামাশা। আমার খুব রাগ হচ্ছে ওর ওপর: এদিকে মন দেয়াতে ওর বাসের গতি কমে যাচ্ছে; তা নাহলে দ্বিতীয় মোড়টা পার হয়েও কি কোনভাবেই কুকুরটা বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে পারতো? কিন্তু পাল্লা দিয়ে দৌড়তে পারলেই বা কি ? কুকুরটা আর কিই বা করতে পারতো, একটু ঘেউ ঘেউ করা ছাড়া ? ও তো আর বসে উঠতে যাচ্ছিলো না। প্রথম ধাক্কাটা পার হলে পরে, এবার আমি যৌক্তিকভাবে পুরো বিষয়টাকে ভাবতে চাইলাম। 
 
আমি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি কুকুরটাকে চিনি, সেটাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করবো। ও যদি আমাকে আক্রমণ করেই, যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম (যত গর্জে তত বর্ষে না), বরং আমাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তাতে করে আশেপাশের লোকেরা, এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বরং আমার সাহায্যেই আসবে। কিন্তু, অবশই, আমি ওকে সে সুযোগ দেবোই না। ও দৃষ্টির আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বাস থেকে নামছি না, একসময় না একসময় তো সেটা হতেই হবে। ১২৬ নম্বরটা একেবারে সেই রেটাইরো অবধি যায়, আভেনিদা সান হুয়ান পার হবার পর বেশ একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে, একটা কুকুরের পক্ষে সেই পর্যন্ত বাসটাকে অনুসরণ করে চলা অসম্ভব। এবার আমি সাহস করে ওর দিকে তাকালাম, কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। একবার আমাদের একে অন্যের চোখে চোখ পড়লো, ওর চোখে যা দেখলাম, সেটা ঠিক রাগ নয়, যা আমি প্রত্যাশা করছিলাম বরং কেমন একটা সীমাহীন যন্ত্রণা, যেটা মানবিক তো নয়ই, বরং যে কোন মানুষের সহ্যসীমার ঊর্দ্ধে। ওর প্রতি আমি যে অন্যায় করেছিলাম, সেটা কি তবে এতটাই ভয়ংকর ? কিন্তু এত গভীরভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে বসার সময় এটা নয়। আর তাছাড়া, ফলাফল একটাই হওয়া সম্ভব। বাসের গতি বেড়েই চললো। আমরা দ্বিতীয় মোড়টা পার হলাম, কুকুরটা, একটু পিছিয়ে পড়লেও, ঠিক পার হয়ে গেলো, ট্রাফিক লাইটে থেমে থাকা একটা গাড়ির সামনে; যদিও গাড়িটা চলতে থাকলেও ও হয়তো ঠিকই পার হয়ে যেত, এতটাই অন্ধ ভাবে দৌড়চ্ছিলো সে। 
 
আমার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে , কিন্তু আমি এমনটাও ভাবছিলাম, যে ও গাড়ি চাপা পড়ুক। এমন তো হরহামেশাই শোনা যায়; একটা ফিল্ম আছে যেখানে নিউ ইয়র্ক শহরে একজন ইহুদি চল্লিশ বছর আগে নাৎজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দেখা একজন প্রিজন গার্ডকে দেখে চিনতে পেরে যায়, এবং তাকে ধাওয়া করতে থাকে, আর তারপর গাড়িচাপা পড়ে মারা যায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এই কথাটা মনে পড়ে গিয়ে মনটা হালকা হবার বদলে, যেমনটা হবার কথা, আমি বরং বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম, কেননা গল্পে যা ঘটেছিল সেটা বরং আমার পরিস্থিতির বাস্তবতাটাকে আরও প্রকট করে তুললো। আমি আর কুকুরটার দিকে তাকাতে চাইলাম না, কিন্তু কুকুরটার ডাকের শব্দ শুনে মনে হলো, এবার বোধহয় ও খানিকটা পিছিয়ে পড়ছে। বাসের ড্রাইভার এবার ঠাট্টা মস্করা করে ক্লান্ত হয়েই বোধহয় এবার পাটাকে নিচে নামালো। আমিও এবার সাহস করে পেছন ফিরে তাকালাম। এবার আর আমার নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাবার কোন ভয় নেই, কেননা বাসভর্তি লোকেরা প্রত্যেকেই তাই করছে; অন্যদিকে, আমি ফিরে না তাকালেই বরং সেটা সন্দেহজনক হতো। তাছাড়া একবার ওকে শেষবারের মতো দেখবার ইচ্ছেটাও ছিল: এরপর আবার এরকম হঠাৎ করে দেখা তো আর হবে না কোনদিন। হ্যাঁ , এইবার ও ঠিক পিছিয়ে পড়েছে। ওকে আরো ছোট দেখাচ্ছিল, আরও করুণ, প্রায় হাস্যকর। অন্য যাত্রীরা এবার হাসতে শুরু করলো। ও একটা বুড়ো, ক্লান্ত কুকুর, মৃতপ্রায় হয়তোবা। পেছনের দিনগুলোর ক্ষোভ আর তিক্ততার ছাপ রয়ে গেছে আজকের এই পাগলামির ওপর। এই দৌড়টা ওকে প্রায় মেরেই ফেলছে নিশ্চয়ই। তবুও এই দিনটার জন্যে ও এতকাল ধরে অপেক্ষা করেছে যে, কিছুতেই হাল ছাড়বে না। আর তা সে ছাড়লোও না। যদিও ও জানে যে ও হেরেই গেছে, তবুও ও দৌড়তেই থাকলো আর চিৎকার করতেই থাকলো, দৌড়তেই থাকলো আর চিৎকার করতেই থাকলো। হয়তোবা, যখন বাসটা ওর দৃষ্টিসীমার একেবারে বাইরে চলে যাবে, ও তখনও নিরন্তর দৌড়তে থাকবে আর চিৎকার করতেই থাকবে, তার কারণ, এছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই। আমি যেন খুব চকিত একটা দৃশ্যে সেই অনন্ত একটা বিমূর্ত পটভূমিতে কুকুরের মূর্তিটাকে দেখতে পেলাম আর মনটা খারাপ হয়ে গেলো , যদিও এই মন খারাপ হওয়াটা ছিল বেশ একটা শান্তির, প্রায়, শৈল্পিক একটা অনুভূতি, ঠিক যেন আমি কুকুরটাকে দূর থেকে যেইভাবে দেখছি, আমার এই দুঃখটাও আমাকে অনেক দূর থেকে ঠিক সেইভাবে দেখতে পাচ্ছে। আচ্ছা, মানুষ কেন বলে যে অতীত কখনো ফিরে আসে না? সবটাই এত দ্রুত ঘটে গেলো, আমি একটুও ভাবার সময় পাইনি। 
 
আমি সবসময় বর্তমানেই বেঁচে এসেছি তার কারণ বর্তমানের সাথে লড়াই করতে করতেই আমার সমস্তটা শারীরিক এবং মানসিক শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। আমি কেবল তাৎক্ষণিকতায় বাঁচতে পেরেছি, শুধু এইটুকুইমাত্র। আমার কেবলই মনে হয়েছে চারিদিকে একসাথে অনেককিছু ঘটে চলেছে আর আমাকে অমানবিক শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে আর নিজের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়েছে শুধুমাত্র এই মুহূর্তের প্রয়োজনগুলো মেটাতে। এ কারণেই যখনই একটুখানি সুযোগ এসেছে নিজেকে সামান্য ভারমুক্ত করতে পারার, আমি ন্যায়নীতির ধার ধারিনি। শুধুমাত্র বাঁচার জন্যে যতটুকু অত্যাবশ্যক তার বাইরে আর সবকিছুকে ঝেড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি; আমাকে যে কোন মূল্যে একটুখানি জায়গা খুঁজে নিয়ে নিতে হয়েছে, একটুখানি শান্তি,যে কোন মূল্যে। তাতে আর কার কি ক্ষতি হলো সেটা যেহেতু ঠিক ওই মুহূর্তে চোখের সামনে দেখতে পাইনি, সেটা আমাকে একটুও ভাবায়নি। এই মুহূর্তেও বাস্তবতা আমাকে এই অস্বস্তিকর আগন্তুকের হাত থেকে মুক্তি এনে দিলো। যদিও মুখে কেমন একটা তেতোমিঠে স্বাদ লেগে রইলো: একদিকে, এত কাছে এসেও বিপদ থেকে রক্ষে পাওয়ার স্বস্তি; অন্যদিকে, এক ধরনের প্রত্যাশিত অনুশোচনা। কুকুর হয়ে জন্মানোটা আসলেই বড় দুঃখের। মৃত্যুর এত কাছাকাছি বেঁচে থাকা, আর কি নির্মম। আরও দুঃখের ওই কুকুরটি হয়ে জন্মানো, যে তার ভাগ্যের কাছে একরকম হেরেই বসে আছে, শুধুমাত্র তাকে দেয়া ভাগ্যের সেই একটি ক্ষত যা আজও শুকোয়নি, সেইটি দেখাবে বলে। বুয়েনোস আইরেসের রবিবারের সন্ধের আলোর বিপরীতে ওর দেহের ছায়াটি, ক্রমাগত অসন্তুষ্ট, দৌড়চ্ছে আর চিৎকার করছে, অনেকটা ভূতের মতো, মৃত্যুর পর কবর থেকে উঠে আসছে, কিংবা বলা যায়, জীবনের যন্ত্রনা থেকে ফিরে আসছে , দাবী করতে… কি ? খেসারত ? ক্ষমা ? একটুখানি পিঠ চাপড়ানি ? আর কিইবা ও চাইতে পারতো ? প্রতিশোধ নিশ্চয়ই নয়, তার কারণ এতদিনের অভিজ্ঞতায় সে নিশ্চয়ই এইটুকু অন্তত বুঝে গেছে যে মানুষের দুর্ধর্ষ পৃথিবীর মুখোমুখি সে একেবারেই অসহায়। ও কেবল নিজেকে প্রকাশ করতে জানে; আর সেইটুকুই ও করেছে, আর তাতে করে সে নিজের দুর্বল হৃৎপিন্ডটাকেই কেবল অনর্থক কষ্ট দিয়েছে। এই চলন্ত বাসের ধাতব, মূক অভিব্যক্তির কাছে, আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা একটি মুখের কাছে ও পরাজিত হয়েছে। আমায় ও চিনলো কি করে? আমিও নিশ্চয়ই অনেকটাই পাল্টে গেছি। ওর স্মৃতিতে আমি নিশ্চয়ই খুব জীবন্ত; হয়তোবা এই এতগুলো বছর ধরেই ওর মনে এই স্মৃতিটা জীবন্ত হয়ে রয়েছে, এক মুহূর্তের জন্যেও মুছে যায়নি।
 
 একটা কুকুরের মন কি করে কাজ করে তা তো আর কেউ জানে না। আর এটাও তো অসম্ভব যে ও আমার ঘ্রাণ চিনতে পারবে; যদিও জীবজন্তুদের ঘ্রাণশক্তি নিয়ে অদ্ভুত সব গালগপ্পো প্রচলিত রয়েছে। যেমন, একটা পুরুষ প্রজাপতি নাকি একটা নারী প্রজাপতির ঘ্রাণ কয়েক মাইল দূর থেকে পায়, তার মাঝখানে হাজাররকম অন্য ঘ্রাণ পথ আটকে থাকলেও পায়। আমি এবার বেশ একটু নিস্পৃহ, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভাবার চেষ্টা করলাম। কুকুরের ডাকটা তো এক ধরনের প্রতিধ্বণি, বিভিন্ন স্কেলে চলে, কখনো উঁচু, কখনো নিচু, যেন অন্য কোন একটা মাত্রা থেকে আসছে। হঠাৎ কেমন একটা অনুভূতি যেন আমার সমস্ত শরীরটাকে ভাবনা থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে গেলো। আমি টের পেলাম, আমি একটু আগেভাগেই স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে ফেলেছিলাম। বাসটা গতি বাড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এখন সেই গতি আবার কমে এসেছে: পরের স্টপটা কাছাকাছি চলে এলে ড্রাইভারেরা যেমনটা করে। গতিটাকে একটুখানি বাড়ায়, তারপর দূরত্বটাকে চোখ দিয়ে খানিকটা মেপে নিয়ে পাটাকে একটুখানি তুলে নিয়ে বাসটাকে আস্তে করে স্টপে নিয়ে গিয়ে থামায়। হ্যাঁ, বাসের গতিটা কমছে, ফুটপাথের ধারে গিয়ে থামলো। আমি সোজা হয়ে বসে বাইরের দিকে তাকালাম। একজন বৃদ্ধা আর একটা ছোট বাচ্চা বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। 
 
কুকুরের ডাকটা আবার জোরালো হয়ে উঠছে। কুকুরটা কি তাহলে ক্রমাগত দৌড়চ্ছিল? এখনও হাল ছাড়েনি তাহলে ? আমি তাকালাম না, কিন্তু ও নিশ্চয়ই খুব কাছে এসে পড়েছিল। বাসটা ততক্ষণে থেমে গেছে। বাচ্চাটা এক লাফে বাসে উঠে পড়লো, বৃদ্ধা একটু সময় নিচ্ছিলেন; এত উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ওঠা তাঁর মতো একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার জন্যে বেশ কষ্টের। আমি মনে মনে চিৎকার করছিলাম, তাড়াতাড়ি কর, বুড়ি, আর অস্থির হয়ে তাঁর প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছিলাম। যদিও আমি সাধারণত ওভাবে ভাবিনা, কিংবা কথাও বলিনা; এ কেবল আমার এই মুহূর্তের অস্থিরতার জন্যেই, কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। কুকুরটা একটুখানি পথ এগিয়ে গেলেও, আবার পিছিয়ে পড়বে। বড়জোর, কাছে এসে আমার জানালার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ করে সুনির্দিষ্টভাবে চিৎকার করবে, আর তাতে করে অন্য যাত্রীরা বুঝতে পারবে যে ও আমাকেই তাড়া করছিলো। কিন্তু তাতে করে আমাকে শুধু বলতে হবে যে কুকুরটাকে আমি চিনিই না, আর আমাকে কেউ ঘাঁটাবে না। এই প্রথম আমি ভাষার জন্যে এবং জানোয়ারের চিৎকারের তুলনায় তার শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। বৃদ্ধা এতক্ষণে তাঁর অন্য পাটিও সিঁড়ির ধাপে রেখেছেন; তিনি প্রায় ঢুকেই গেছেন। হঠাৎ কুকুরের চিৎকার যেন বিস্ফোরণ ঘটালো। আমি পাশের দিকে তাকালাম। দেখলাম ও আসছে, ছুটন্ত বুলেটের গতিতে, গায়ের লোমগুলো যেন উড়ছে, প্রচন্ড শব্দে। কি ভীষণ প্রাণশক্তি। এই বয়সে, অন্য সব বুড়ো কুকুরদের মতো, ওরও নিশ্চয়ই আর্থ্রাইটিস আছে। হয়তো এই ওর শেষ রাউন্ড বুলেট। সারা জীবন ধরে সব ক্ষোভ একত্রিত করে যদি এই মুহূর্তটিতে উগরে দেবার জন্যেই জমিয়ে রেখেছিলো, তখন আর এগুলোকে জমিয়ে রেখে কি হবে, এত বছর পর আমাকে যখন খুঁজে পেয়েইছে? প্রথমে ( সবটাই ঘটেছে কয়েকটা ঝড়ের তান্ডবের মতো বিস্ফোরক মুহূর্তের মধ্যে), আমি বুঝেই উঠতে পারিনি কি ঘটেছে, শুধু এইটুকু বুঝেছি যে খুব অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে। তারপরেই বুঝলাম; ও শুধুমাত্র আমার জানালার সামনে এসেই থামেনি, আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। ও কি করেছে ? ও কি তবে…? ততক্ষণে ও সামনের দরজাটার সমান্তরালে দাঁড়িয়ে গেছে, একটা পাঁকাল মাছের মতো চটপটে দ্রুত শরীরে, ঝট করে একটু পাশ ফিরে নিয়েই লাফ দিয়েছে। ও বাসে উঠতে চলেছে! না, ও ইতিমধ্যে বাসে উঠে পড়েছে, আর বৃদ্ধাকে না মাড়িয়ে—তিনি শুধু তাঁর পায়ের ওপর আলতোভাবে কোনকিছুর স্পর্শ পেলেন — ও শুধু আর একবার পাশ ফিরলো আর তারপর, সামান্য একটুমাত্র গতি কমিয়ে, ঘেউ ঘেউ করতে করতেই, বাসের আইল ধরে দৌড়ে আসতে লাগলো… ড্রাইভার কিংবা অন্য যাত্রীরা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবার সময়ই পেলো না; যে চিৎকারগুলো গলা অবধি উঠে এসেছিলো, সেগুলো বাইরে বেরোনোর সময় অবধি পেলো না। আমার উচিত ছিল ওদেরকে বলা; ভয় পেয়ো না, ও তোমাদের কাছে আসেনি, ও আমাকেই তাড়া করে এসেছে … 
 
কিন্তু আমিও কোনকিছু বলবার কিংবা করবার সুযোগ পেলাম না, শুধুমাত্র আতঙ্কে জমে যাওয়া ছাড়া। আমি ওকে আমার দিকে দৌড়ে আসতে দেখেছি, কিন্তু আর কিছুই দেখতে পাইনি। খুব কাছে থেকে, একেবারে মুখের ওপর থেকে, ওকে কিন্তু দেখতে অন্যরকম। মনে হচ্ছে যেন আগে যখন আমি জানালার ভেতর থেকে দেখেছি, আমার দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে ছিল অনেকগুলো পর্দা দিয়ে, আমার স্মৃতির ভাবনায়, ওর যে ক্ষতি আমি করেছি সেই ভাবনায়, কিন্তু এখানে, এই ধরাছোঁয়ার ভেতরে এসে, এইবার আমি ওকে সত্যি সত্যি দেখতে পেলাম। ও দেখতে অনেক অল্পবয়স্ক, সতেজ, কোমল: আমার চেয়ে অনেক বেশি কমবয়েসী আর অনেক বেশি জীবন্ত (যে জীবন আমার কাছ থেকে একটু একটু করে ঝরে গেছে এতগুলো বছর ধরে, চৌবাচ্চার জলের মতো করে), বাসের ভেতর ওর চিৎকার তখনও অবিশ্রান্ত গতিতে প্রতিধ্বণিত হয়ে চলেছে, ওর চোয়ালের ঝকঝকে দাঁতগুলো যখন আমার মাংসপেশীতে গেঁথে যাচ্ছে তখনও, ওর উজ্জ্বল চোখজোড়া এক মুহূর্তের জন্যেও আমার চোখ থেকে সরেনি।

মার্চ ১৬, ২০০৮






লেখক পরিচিতি:
সেসার আইরার জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩সে ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার কর্ণেল প্রিঙ্গলসে। তিনি একজন লেখক এবং সমসাময়িক আর্জেন্টাইন সাহিত্যের অনুবাদক। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা একশোরও ওপর ছোট গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ওপর বক্তব্য রেখেছেন। মৌলিক সাহিত্য, অনুবাদের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সমালোচনা, এবং আরো নানাবিধ সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখালেখি এবং গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকেন।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন সময়ে আইরা বলেছেন যে তিনি একধরনের AVANT-GARDE নান্দনিকতায় বিশ্বাসী, যাতে করে তিনি যা লিখেছেন তাকে সম্পাদনা না করে বরং যা লিখেছেন সেখান থেকে তার লেখার গতি দিয়েই তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যাবার এবং যে কোন জটিলতা থেকে লেখার সৃষ্টিশীলতা দিয়েই উত্তীর্ণ হওয়ায় বিশ্বাসী।

আইরা তাঁর নিজের কাজে এবং অন্যদের কাজেও, কাল্পনিক আখ্যানের এক ধরনের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা খোঁজেন এবং পছন্দ করেন। যে কারণে প্রায়শই দেখা যায় তাঁর গদ্যগুলো প্রায়ই নাটকীয়ভাবে এক ধারা থেকে অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে, এবং তিনি প্রায়শই পপ কালচার কিংবা পাল্প সায়েন্স ফিকশন কিংবা টেলিভিশন সোপ অপেরার মতো ধারা থেকেও অনায়াশে প্রয়োজনমতো গ্রহণ করে থাকেন। তিনি প্রায়ই উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত এবং সর্বজনগ্রাহ্য গঠনগুলোকে বর্জন করে নিজের মতো করে কাহিনীর বর্ণনা এবং বিবর্তনকে চালিয়ে নিয়ে যান এবং এ কারণে, তাঁর অনেক কাজের উপসংহারই অনেকটা সাধারণভাবে আমরা কাহিনীর যে স্থির উপসংহারের সাথে পরিচিত, তেমনটা নয়, অর্থাৎ অনেকটাই তিনি পাঠকের উপলব্ধির ওপর ছেড়ে দেন।

তাঁর লেখার বিষয়বস্তু পরাবাস্তবতা কিংবা দাদাইজম অথবা বুয়েনোস আইরেসের রাজপথে ঘটে চলা কল্পকাহিনী হলেও তাঁকে প্রায়ই আর্জেন্টিনার ইতিহাসের বিশেষ করে উনিশ শতকের দিকে ফিরতে দেখা যায়। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো দ্য হেয়ার, এন এপিসোড ইন দ্য লাইফ অফ আ ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার, এম, লা কটিভা, উনা নভেলা শিনা, এল ভয়ানতে, এল পেক্যুনো মন্যে বুদিস্তা ইত্যাদি।
 
 

অনুবাদক পরিচিতি:
সুমু হক
অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
কানাডায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ