সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত'এর গল্প: বর্ণিক

 
মাঝরাত হলেও গলিটা যে পুরোপুরি নিস্তব্ধ তা নয়। সকাল থেকে রাত এগারোটা অব্দির কোলাহলে ক্লান্ত আর ঝিমিয়ে পড়া, তাই মুখর নয়। কিন্তু এই সময়েরও এক নিজস্ব মিশ্র ধ্বনি আছে। খানিক শান্ত তা, হয়ত বা চাপা। কিন্তু নীরব কোনোমতেই নয়। বরং যে স্তিমিত আওয়াজগুলো দিনে শব্দ-দূষণের ডেসিবলের মাপকাঠিতে অনুত্তীর্ণ হয়ে থাকে, ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলে তারাই বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্তব্ধ পরিবেশের সংজ্ঞা বদলে দেওয়ার খেলায়।
 
দিনে বাইরের চেঁচামেচি যেমন ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর খোলা অলিন্দর পর্দা সরিয়ে, বন্ধ দরজার নিচের ফাঁক দিকে, মায় দেয়াল ভেদ করে, তেমনই মাঝরাতে ঘরের ভেতরের কোনো যুবতী বউয়ের আবেগহীন এক সংগমের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় পাশ ফেরার শব্দও গলির মুখটায় এসে ধাক্কা খায়। আর ঘুম না হওয়া মানুষগুলোর ছটফটানি তো বেশ জোরালো হয়েই ধরা পড়ে বাইরের বাতাসে। করালিবাবুও খানিক এই শেষের দলেই, যদিও তিনি ঘুমোচ্ছেন না স্বেচ্ছায়। চৌকিতে শুয়ে আছেন, চটকাও লাগছে বারবার। আবার চমকে উঠে একবার চারদিকটা তাকিয়ে নিচ্ছেন। স্ত্রী শুয়ে আছেন পাশের খাটে, হলদেটে মশারি দুলছে তার নিচে প্রতিমার নিঃশ্বাসের আওয়াজ বেশ স্পষ্ট। খাটের ওপরেই ঠিক সিলিং পাখাটি ঘুরছে জোরে। কিন্তু খাটের পাশে করালিবাবুর চৌকিতে তেমন হাওয়া আসছে না। তাই গলা আর ঘাড়ের খাঁজে ঘাম জমেছে করালিবাবুর। এতে অবশ্য উনি অভ্যস্ত। প্রতিমার গরমের কষ্ট বেশি, তার ওপর রাতের খাবারের পরেই ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। বারোমাসই খান আজ প্রায় সাত আট বছর। তার আগে করালিবাবু স্ত্রীর খাটেই শুতেন। তখন কোনো-কোনোদিন প্রতিমাও উঠতেন মাঝরাতে। করালিবাবুর ঘুম না ভাঙলে। হয়ত ওভারটাইম করে এসেছেন রাত করে। চট করে ঘুম ভাঙল না, তখন তাড়াতাড়ি প্রতিমাই জেগে গিয়ে খাট থেকে নেমে এসেছেন। তবে এই সাত আট বছর ধরে তো আর এসবের প্রশ্নই ওঠে না। বরং পাছে প্রতিমার ঘুম ভেঙে যায় একই বিছানা থেকে ওঠা নামা করলে, তাই করালিবাবু নিজের জন্য আলাদা এই চৌকির ব্যবস্থা করেছেন। আর আজকালকার সাত বাই ছয় খাট তো এটি নয়। আগেকার সিঙ্গল খাট। তাছাড়া প্রতিমা এখন খাটের ধারে শোন না, মাঝামাঝি শোন। করালিবাবুও সেটাই চান। দূরে যেন এবার মনে হল এক যান্ত্রিক আওয়াজ। করালিবাবুও কান দুটিকে সজাগ করে চোখ খুলে রাখলেন এবার। হ্যাঁ, কাছে এগিয়ে আসছে আওয়াজটা, করালিবাবুও উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে করে খিল খুলে ছিটকিনিতে হাত দিয়ে অপেক্ষা করলেন বাইরের সদর দরজা খোলার শব্দের।

‘তেরা পেয়ার পেয়ার পেয়ার হুক্কা বার ...তেরা পেয়ার পেয়ার পেয়ার হুক্কা বার’ গাইতে গাইতে চন্দ্রনাথ তার অতি প্রিয় বাইকটা সদর দরজা দিয়ে ঢুকে যে এক চিলতে সরু শান বাঁধানো জায়গা, সেখানে দাঁড় করালো। তারপর ঝুঁকে চকাস করে বাইকের হ্যান্ডেলে একটা চুমু খেয়ে করালিবাবুর খোলা দরজা দিয়ে এগিয়ে এল। করালিবাবু রোজই দরজা খুলে নিজেকে দরজার পাশের আলো-আঁধারি কোনাটায় প্রায় মিশিয়ে অপেক্ষা করেন চন্দ্রনাথের ঘরে ঢোকার। বেশিরভাগ রাতেই চন্দ্রনাথ সোজা ঘরে ঢুকে পাশের ঘরে চলে যায়। তোয়াক্কাও করে না যে কে দরজা খুললো বা কিভাবে দরজা খোলা আছে এই মাঝরাতে। যেন এটাই স্বাভাবিক। আবার কোনো রাতে সে ঘরে ঢুকে দরজার পাশে উঁকি মেরে করালিবাবুকে ‘টুকি’ ‘টুকি’ বলে রসিকতাও করে। করালিবাবু তখন নিজেকে আরো মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন দরজার পাল্লার সাথে। আজকেও চন্দ্রনাথ পাশের ঘরের দিকে প্রথমে চলেই যাচ্ছিল তারপরই ঘুরে দাঁড়াল, কি মনে হতে প্রতিমার খাটের দিকেও একবার তাকালো, এগিয়ে এসে করালিবাবুকে বললো,

‘বাবা চলো তোমার সাথে সেলফি তুলবো। আমার ঘরে এসো। ... ... কি হলো? এসো না, ও বাওয়া’।

করালিবাবু চোখ দুটি একেবারে নিচে নামিয়ে চুপ করে আছেন দেখে চন্দ্রনাথ আরো অধৈর্য হয়ে বাবার হাত ধরে টেনে বলে ওঠে, ‘এসো না বলছি তোমায়। ও ঘরে গিয়ে সেলফি তুলব... মোবাইলে দেব ... ফেসবুক, ফেসবুকে দেব... ও বাওয়া,’

করালিবাবু যে ভয়টা করছিলেন তাই-ই হলো। প্রতিমার ঘুম ভেঙে গেল এই কোলাহলে। ‘কে চাঁদু এলি? খেয়েছিস তো বাবা?’

চন্দ্রনাথ বাবার হাত ধরে টানতে টানতে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের মোবাইল বার করে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে কিসব ছবি তুলে বিছানায় কাত হয়ে পড়ল। করালিবাবু ধীর পায়ে নিজেদের ঘরে এসে বুঝলেন প্রতিমা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন।

****

চন্দ্রনাথ যখন করালিবাবুর গলা জড়িয়ে ছবি তুলছিল তখন ওর মুখের দেশি মদের গন্ধে করালিবাবুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। দেশির গন্ধ কোনোদিনই করালিবাবু সহ্য করতে পারেন না। স্টুডিওপাড়ায় কাজ সেরে মাঝে মধ্যে হুইস্কি পান করে করালিবাবুও ফিরতেন। আর নাইট-শিফটে কাজ থাকলে তো বেশ রাত হতো। কিন্তু কখনও মাতলামো করেছেন বলে মনে পড়ে না। সেসব রাতে হাতে করে প্রতিমার জন্য নিয়ে আসতেন ফাউল-কাটলেট বা ডিমের ডেভিল। কোনোদিন বা কাঁধের ঝোলায় থাকতো জুঁইয়ের গোড়ের মালা। সেই মালা প্রতিমার হাতে দিয়ে রঙ্গ করে বলতেন, আমার লক্ষ্মী পতিমের জন্যে নিয়ে এলেম গো, দেখি খোঁপায় জড়াও’। প্রথম প্রথম প্রতিমা রাগ করত ওই মালা দেখে, ভাবত বুঝি কারো পরা মালা তার স্বামী নিয়ে এসেছেন। ‘তোমার ওই হিরোইনদের ব্যবহার করা মালা আমি পরব কেন?’ মৃদু হেসে করালিবাবু অভিমানী স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতেন, না কারো ব্যবহৃত মালা এটি নয়। এ মালা বাড়তি ছিল। কেউই পরেন নি। কখনও বা নিজেই পরিয়ে দিতে চাইতেন স্ত্রীর খোঁপায়। কিন্তু প্রতিমা ছিটকে দূরে সরে যেত।

‘দেখো তুমি ওই সিনেমার মেয়েদের সাজিয়ে দাও, ঠিক আছে। কিছু বলব না। ওটাই তোমার রুজি। কিন্তু আমার চোখের সামনে তুমি স্নো, পাউডার বোলাবে । না না, সে আমার খুব খারাপ লাগবে বলে দিলাম’।

সেই থেকে করালিবাবু আর কিছু বলেন না। কিন্তু মনে মনে হাসেন। ভাবেন মেয়েমানুষের কথার কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? এই প্রতিমাই আবার যখন কোনো বিয়ে বাড়ি যায়, করালিবাবুর মেক-আপ বাক্সটি নিয়ে টানাটানি করে। তখন আবার ডাক পড়ে করালিবাবুরই, ছোট, বড় এত কৌটোর ভিড়ে বুঝতে পারে না যে কোনটা কার পরে লাগাবে। করালিবাবু খানিক শঙ্কিত হন নিজের মেক-আপ বাক্সটিকে নিয়ে, কিন্তু রাগ করেন না। তিনি চিরকালই ঠান্ডা রক্তের মানুষ। হালকা শেডের একটি ফাউন্ডেশনের কৌটো বের করে স্ত্রীর হাতে দেন। আর প্রতিমা তো গেরস্ত বউ, অনেক বছর ধরে ছবির শুটিং করা নায়িকারাই কিছু বুঝতেন না মেক-আপ সম্বন্ধে। মেক-আপ ঘরে এসে সোজাসুজি তাঁরা নিজেকে সারেন্ডার করতেন করালিবাবুর হাতে। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকতেন প্রথম থেকেই অথবা সিগারেটে টান দিতেন কেউ কেউ। সেসব কত কথা। বাইরে শুটিং থাকলে সেখানেও যেতে হত। তবে করালিবাবু বাইরে বিশেষ যেতে পছন্দ করতেন না। টাকা বেশি পেতেন তবু। চিন্তা হত প্রতিমা একা ছেলে নিয়ে থাকবে। খিদিরপুরের এই পাড়াটা তো তেমন ভালো নয়। চাঁদুও তখন বড় হচ্ছে, সারাদিন ফ্যান্সি মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে। আর ডক-চত্বরেও যাতায়াত সেই তখন থেকেই। এসব কারণেই করালিবাবু চাইতেন না কলকাতার বাইরে যেতে। আর একটা ছেলেমানুষি ভয় ছিল করালিবাবুর। হেয়ার-ড্রেসার বিনীতাকে। বড্ড গায়-পড়া মেয়ে। কাজের শেষে চলে আসত করালিবাবুর ঘরে। সে এক মহা বিপদ। তবে নিজের কাজটিকে করালিবাবু খুব ভালোবাসতেন। একটি সাধারণ মুখাকৃতির মেয়েকে আস্তে আস্তে অপরূপা বানানোর মধ্যে যে কি অদ্ভুত সৃষ্টির আনন্দ তা বলে বোঝানো যায় না।

কিন্তু করালিবাবুর কেমন যেন মনে হত প্রতিমা তাঁর এই পেশাকে সুনজরে দেখতেন না কোনোদিন। গরিব বাবা যেখানে বিয়ে দিয়েছেন প্রতিমাকে মেনে নিতে হয়েছে। এই মনোভাবই পেয়েছে ছেলেটাও। চন্দ্রনাথ তো উঠতে বসতে নিজের বাবাকে বিদ্রুপ করে। ষোল বছর হতে না হতেই সে করালিবাবুকে ধরেছিল একটা বাইক কিনে দেবার জন্য। না, করালিবাবু কিনে দিতে পারেন নি। তা নিয়ে চন্দ্রনাথ রাগ করে দু-দুটো দিন বাড়িতে খায়নি। আর তারপর থেকেই শুরু হল বাপের সঙ্গে দুর্ব্যবহার। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। মেকআপ বাক্স নিয়ে করালিবাবুকে বেরোতে দেখলেই সে মুখ নামিয়ে নিজের মাকে বলত, ওই চললেন মেয়েদের গালে রুজ আর ঠোঁটে লিপস্টিক বোলাতে’। করালিবাবু কোনোদিনই ওকে শাসন করতে পারেননি। বকাবকি বা গায়ে হাত তোলা এসব ওনার ধাতেই নেই। আর এও মনে হয় যে চাঁদুকে কিছু বললে যদি প্রতিমা অখুশি হয়! ছেলে যে পুরোপুরিই বখে গেছে তা বুঝতে আর বাকি ছিল না। চাঁদুর বন্ধু-বান্ধবরাও সব ছিল ওঁচাটে।

*****

সারারাত হাবিজাবি পুরনো কথা মাথায় আনাগোনা করায় ঘুম হয়নি। সকালে তাই দেরিতে ঘুম ভাঙলো করালিবাবুর, মাথাটাও খুব ধরেছে। উঠে সকালের কাজকর্মগুলো পর পর সারলেন। পাম্প চালিয়ে রিসার্ভয়ারে জল ভরে রাখেন রাতেই নইলে সকালে যদি চাঁদুর কাঁচা ঘুম ভেঙে যায় পাম্পের শব্দে তাহলে প্রলয়কাণ্ড হয়ে যাবে। একদিনের কাণ্ড মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন করালিবাবু। যাক গে! প্রতিমার কাজগুলো করাতে হবে এবার। নিজে তো কিছুই করতে পারে না বেচারা। গ্যাসে চা বসিয়ে ডাকলেন,

‘প্রতিমা ওঠো, মুখ ধোওয়ার জল এনেছি । বেলা হয়েছে’।

আনুষঙ্গিক সব কাজ সেরে নিয়ে মুখোমুখি বসেন চা খাওয়া্র জন্য। সেই বিয়ে ইস্তক সকালের চা একসাথে বসে খাবার অভ্যেস। তা প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ তো হলই। এইসময়েই দুজনে সাংসারিক কিছু কথাবার্তাও সেরে নেন ।

‘আজ রবিবারেও কি তোমার বেরনো?’ চায়ে চুমুক দিয়ে প্রতিমা জানতে চান।

‘হ্যাঁ, মিনুর মা এলেই আমি বেরোব’। স্ত্রীর প্লেটে দুটো বিস্কুট রেখে জবাব দেন করালিবাবু।

একটা টিভি চ্যানেলের অফিসে মাঝেমাঝে ডাক পড়ে করালিবাবুর। টালিগঞ্জে কাজের পাঠ তো কবেই শেষ হয়েছে। যাত্রাদল থেকে ডাক পড়ে প্রায়ই, সেখানে ওরা স্থায়ী চাকরির প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু করালিবাবু সে সুযোগ আর কি করে নেবেন? কটা যাত্রা আর কলকাতা শহরে হয়? সবই তো মফস্বল আর গ্রামে-গঞ্জে। প্রতিমাকে এই অবস্থায় রেখে তো করালিবাবু কলকাতার বাইরে কোথাওই যেতে পারেন না আর। দিনের বেলা কাজ থাকলে বেরনো মিনুর মাকে রেখে। এভাবেই চলে যাচ্ছে সংসার, দোতলায় দু-ঘর ভাড়াটে আছে। আর মেদিনীপুরের দেশের বাড়ির কিছু জমিজমা আছে। সেখান থেকে ধান-চাল বিক্রিবাটা করে কিছু আয় হয়। চাঁদু তো পড়াশুনো করলো না। কাজকর্ম যে কি করে ঠিক বোঝেন না করালিবাবু। তবে যে কাজই করুক সেটা কোনো সাদা কাজ নয় সে ব্যাপারে করালিবাবু নিশ্চিত। নেশার ঘোরে চাঁদু ‘বাবা বাবা’ করে কিছু বললেও স্বাভাবিক ভাবে বাপ-ব্যাটায় কথা নেই। করালিবাবুরই আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না সেই ঘটনার পর থেকে।

ভোরের ট্রেনে মেদিনীপুর গিয়েছিলেন করালিবাবু। ভাই খবর পাঠিয়েছিল, ‘দাদা, আম-কাঁঠাল খানিক এসে নিয়ে যাও’। জ্যোষ্ঠি মাসের গরম তায় দিনের দিন গিয়ে আবার ফিরে আসা। রাত দশটা নাগাদ ফিরে স্নান খাওয়া সেরে করালিবাবু শুয়ে পড়েছিলেন। প্রতিমা বসে টিভি’তে সিরিয়াল দেখছিল। আর কিছুই জানেন না করালিবাবু। মাঝরাতে চ্যাঁচামেচি আর কান্নাকাটির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। খাট থেকে নেমে দেখেন বাইরে প্রতিমা পড়ে আছেন আর তাঁর ওপরে চন্দ্রনাথের মোটর-সাইকেল, পাশে চন্দ্রনাথ একবার বাইক তুলতে চেষ্টা করছে আর একবার নিজের মা’কে। কিন্তু কিছুই সে করে উঠতে পারছে না। ওপরের ভাড়াটেদের ডেকে কোনোরকমে প্রতিমাকে বিছানায় শোয়ানো হয়েছিল। কোমর আর হাঁটু, দু-জায়গার হাড় ভেঙেছে । তারপর মাস তিনেক হাসপাতালে ছিল প্রতিমা। বাড়ি ফিরল কিন্তু ভারি শরীর নিয়ে প্রতিমা আর ওঠা-হাঁটা নিজে নিজে করতে পারল না। সে রাতে কী কুক্ষণে যে করালিবাবুর ঘুম ভাঙেনি আর প্রতিমাকে ছেলে ফেরায় দরজা খুলতে হল! চন্দ্রনাথ এসে নাকি তার বাইককে আদর করছিল আর চুমু খাচ্ছিল তখন প্রতিমা বাইরে বেরিয়ে চন্দ্রনাথের হাত ধরে টানতে যান আর মাতাল ছেলে বাইক সমেত পড়ে নিজের মায়ের ওপর। একধাপ সিঁড়ি থেকে বেকায়দায় পড়ে প্রতিমা সারা জীবনের মত পঙ্গু হয়ে থেকে গেল। সেদিন থেকেই করালিবাবুর ছেলের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। আর সত্যি কথা বলতে চন্দ্রনাথ এ-বাড়িতে না থেকে যদি আলাদা থাকত তাতেই করালিবাবু নিশ্চিন্ত হতেন। আমরণ এ এক জ্বালা।

******

‘করালিদা তুমি একটু তাড়াতাড়ি মেকআপটা করে দাও, আমি শাড়িটা ঠিক করে পরে আসছি, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে আসতে।’ বলতে বলতে সংবাদ সেকশনের ঋতব্রতা নিজের বড় ব্যাগটা সামনের খালি চেয়ারে রেখে পাশের পোশাক পাল্টানোর ছোট ঘরে ঢুকে ছিটকিনি দিল। করালিবাবু মেকআপ করছিলেন নতুন আসা একটি মেয়ের। মেয়েটিকে দেখেই বুঝেছেন একেবারেই আনকোরা। অবাক হয়ে সবাইকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল এতক্ষণ। ‘লিপস্টিক এনেছেন তো? দিন।’ করালিবাবু মেয়েটিকে বলে। মেয়েটি জানায়, সে কিছুই সঙ্গে করে আনেনি। এই পঞ্চাশজনের ঠোঁটে লাগানো লিপস্টিক থেকে যে কত অসুখ করতে পারে মেয়েটিকে করালিবাবু বলেন, এবার থেকে সাথে লিপস্টিক নিয়ে আসবেন। আপনি কোন অনুষ্ঠান করবেন?’

‘স্বাস্থই সম্পদ।’

‘তাহলে হালকা মেকআপেই হবে।’

করালিবাবুর দেরি দেখে ঋতব্রতা নিজেই মেকআপ শুরু করে দিয়েছে। আজ এই সময় আর দুজন মেকআপ কর্মীর থাকার কথা। তাঁরা স্থায়ী কর্মী। কিন্তু এখনও আসেননি। করালিবাবু দেখলেন ঋতব্রতা ভুরুতে টেনে পেনসিল চালিয়েছে। তুলোতে ক্লিনজার নিয়ে ভুরু মুছে করালিবাবু বলেন,

‘আপনাদের কতদিন বলি ম্যাডাম, ভুরুতে সোজাসুজি পেনসিল দিয়ে না টানতে, ব্রাশ বোলানোর মতো করে দেবেন, পরে আঙ্গুল দিয়ে ঘেঁটে দেবেন।’

সাজ শেষে ঋতব্রতা করালিবাবুকে অনুরোধ করে, শাড়ির আঁচলটা একটু বাঁ দিকে ব্লাউজে পিঠ ঘেঁষে লাগিয়ে দিতে। তারপর আবার ব্যাগ উঠিয়ে দ্রুত যেতে যেতে বলে, করালিদা সেদিন মহানায়কের গল্পটা কিন্তু শেষ হয়নি, পরে শুনব’।

করালিবাবু দেখেন নতুন মেয়েটি ---ঋতব্রতার চলে যাওয়া দেখে আয়নায় নিজের মুখ আর পোশাকের দিকে নজর দেয়। মাস-ছয়েকের মধ্যেই এই মেয়েও যে একেবারে চৌকশ হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক তো দেখলেন করালিবাবু। হ্যাঁ, উত্তমবাবুর মেকআপ টিমেও কাজ করেছেন দু’একবার, সেই টালিগঞ্জে চাকরি করার সময়। তবে সরাসরি ওনার মেকআপ করেননি। ছবির লাইনে নমস্য সেই যাদুকর। গাড়ি থেকে নামার পরে মেকআপ ঘরে ঢোকার পর থেকেই স্ক্রিপ্ট ছাড়া আর কিছুর দিকে খেয়াল থাকতো না মানুষটার, নিজের ছবির চরিত্রে যেন তখন থেকেই তিনি প্রবেশ করে যেতেন। তবে একবার, যতদূর মনে পড়ে ‘সন্ন্যাসীরাজা’ ছবির শুটিংয়ে উত্তমবাবুর নকল দাড়িতে টিকা ঘষেছেন। তখনকার দিনে নকল দাড়িতে ছিলিমের টিকা ঘষে ঘষে রঙ করা হতো, মসৃণ করা হতো ।

মেকআপ ঘরে সাজের জন্য এখন আর কেউ নেই দেখে করালিবাবু একটু ক্যান্টিনের দিকে চা খেতে এলেন। দু-পিস টোস্টও নিলেন। ক্যান্টিনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কিছু লোক খাচ্ছে। বেশিরভাগ লোকই ভাতের থালি নিয়েছে। করালিবাবু সামনের খোলা জায়গা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন খানিক। ক্লান্ত লাগছে, কাল রাতে ঘুমটা তো তেমন হয়নি। কবেই বা হয় ঘুম করালিবাবুর? গুণধর ছেলের দৌলতে? আবার মেকআপ ঘরের দিকে পা বাড়ালেন করালিবাবু। দেরি হলে মুসকিল। মিনুর মা সন্ধ্যে হয়ে গেলে বড্ড গজগজ করে। তবে চলে যায় না যতক্ষণ না করালিবাবু ফেরেন। শেষ পর্যন্ত আরো তিন জনের মেকআপ সেরে করালিবাবু অফিস থেকে বেরিয়ে খিদিরপুরের বাস ধরলেন চারটে বেজে চল্লিশে। প্রতিমা টিভি দেখছিল, আর মিনুর মা বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আজও করালিবাবু বাড়ি ফিরলে প্রতিমার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আগে বিয়ের পর পর সে চোখে যে ভাব থাকতো তা এখন অবশ্যই থাকে না। এখন থাকে অসহায় পঙ্গু মানুষটার নিজের কাছের লোকটা বাড়ি ফেরায় এক নিশ্চিন্ত হওয়ার দৃষ্টি। এবার ইতস্তত করতে হবে না যে কোনো ফরমাস করতে। প্রতিমার স্বামী একটিবারের জন্যেও কোনোদিন রাগ করে নি। মুখে হাসিটি রেখে প্রতিমার পাশে পাশে থাকেন এই এতগুলো বছর। তবে ছেলেকে পছন্দ করেন না, এটাই দুঃখ প্রতিমার।

খাটের সামনে ফোল্ডিং টেবিলটা রেখে রাতের খাবার খাচ্ছেন দুজনে। আগে প্রতিমাকে খাইয়ে করালিবাবু খেতেন। কিন্তু প্রতিমার ইচ্ছে দুজনে একসাথে খায়, তাই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু-বেলাই হালকা খাবার আর সহজ-পাচ্য খাবারই রান্না করে মিনুর মা। এই শরীরে প্রতিমার আর যেন কোনো অসুখ না করে সে ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হয়। ছেলের মুখে এই আলুনি খাবার রোচে না তাই সে বাড়িতে খায় না। বাইরে কোথায় খেয়ে আসে। করালিবাবু কানাঘুষোয় শুনেছেন যে ওয়াটগঞ্জে চাঁদু এক মহিলার বাড়ি যায়, মহিলা দেহোপজীবিনী। একথা করালিবাবু প্রতিমাকে জানাননি। সবে ভাত শেষ করে জলের গেলাসে মুখ ঠেকিয়েছেন, বাইরে খুট করে কিসের শব্দ হয়। দুজনেই বাইরের দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করেন। করালিবাবু ঘড়ি দেখেন, রাত সাড়ে নটা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন এই ভর সন্ধ্যেবেলায় চাঁদু ঢুকলো ? কিন্তু বাইকের আওয়াজ তো শুনলেন না।

চাঁদু ঘরে ঢুকে ঘরের ভেতর থেকে ছিটিকিনি দিয়ে আবার খিল তুলে দিল। চোখ মুখ দেখে করালিবাবু বোঝেন যে আজ চাঁদু নেশাগ্রস্ত নয়। কেমন উদ্ভ্রান্ত চেহারা তার। নিজের ঘরেও যাচ্ছে না, প্রতিমার খাটটায় বসে পড়ে। কেমন হাঁপাচ্ছে। প্রতিমা তো ভয় পেয়ে –ও চাঁদু কি হয়েছে? তোর কি হয়েছে বাবা?’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।

‘চুপ, চুপ করো’। বলে চাঁদু সন্ত্রস্ত হয়ে দরজার দিকে তাকায় একবার। এবার করালিবাবুর বুকের ভেতরও একটা ভয়ের সিরিসিরিনি নেমে গেল।

‘বাবা, মেকআপ বক্সটা আছে তো তোমার কাছে?’

চন্দ্রনাথের কথায় করালিবাবু অবাক হয়ে যান, যে বাক্সটার ওপর ছোটর থেকে ছেলের এত রাগ, যেটির জন্য এত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, যে বাক্সটি হাতে নিয়ে বাবাকে রাস্তায় দেখতে পেলে নিজের বন্ধুদের কাছে লজ্জার একশেষ হতে হয়, সেই তাঁর ছেলে চন্দ্রনাথের মুখে মেকআপ বাক্সের কথা!

‘তোর বাবার সাজের বাস্কো তো ঘরেই আছে, ও চাঁদু । কি হয়েছে? তোর বাইক কোথায়? বল আমাদের কি হয়েছে?’

করালিবাবু ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন, এখনও কিছু বলেননি। আস্তে আস্তে প্রতিমাকে মুখ ধুইয়ে দিয়ে, খাটের মাঝামাঝি বসিয়ে দেন। ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে যেতে, প্রতিমা বলেন তিনি ঘুমের ওষুধ খাবেন না আজ।

‘তুমি কী নিষ্ঠুর গো, আমাকে ওষুধ দিচ্ছো, চাঁদুর কি হলো দেখো। ওকে তোমার সাজের বাস্কোটা দাও, ও যে ওটা চাইছে’।

করালিবাবু দেওয়াল আলমারি খুলে মেকআপ বাক্সটি বার করে স্ত্রীর হাতের কাছে নামিয়ে রাখেন। আর রাখামাত্রই চাঁদু ওটাকে হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে করালিবাবুর কাছে এসে বলে, ‘বাবা, আমাকে পালটে দাও’। বলেই দাঁড়িয়ে থাকা করালিবাবুর সামনে মেঝেতে বসে কাঁদতে শুরু করে। করালিবাবু একবার ছেলের দিকে আরেকবার কাঁদতে থাকা স্ত্রীর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন।

‘বাবা, এক ঘন্টার মধ্যে ওরা নিশ্চয়ই আমার খোঁজে এসে পড়বে, তার মধ্যে আমায় এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। তুমি..., আমায় পালটে দাও। কেউ যেন আমায় চিনতে না পারে, বাবা। আমায় পালটে দাও’।

অনেকদিনের পুরোনো পরচুলা আর দাড়ি রাখা ছিল, আবার সে সব দেওয়াল-আলমারি খুলে বার করে আনলেন। এ ঘরের আলোটা তেমন জোরালো নয়, তবু বহুদিন ধরে ঢেকে রাখা স্ত্রীর ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার আবরণ সরিয়ে, সামনে একটা চেয়ার টেনে চন্দ্রনাথকে বসতে বললেন করালিবাবু। প্রতিমা কান্নাকাটি করতে করতে ছেলে কে জিজ্ঞেস করেই চলেছে ---কি হয়েছে? কেন চন্দ্রনাথ নিজেকে আড়াল করতে চাইছে? চন্দ্রনাথকে করালিবাবু মুখ বন্ধ রাখতে বলেছেন। বলেছেন এইটুকু সময়ে হয় কথা বলতে পারবে, নয় মেকআপ করতে পারবে। তাই চন্দ্রনাথ চুপ করে বসে আছে। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর করালিবাবু তাঁর মেকআপ বাক্সটি বন্ধ করে চন্দ্রনাথকে উঠে পড়তে বলেন। চন্দ্রনাথ উঠে নিজের ঘর থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে এসে আবার করালিবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আসলে বাবা...’

তাকে থামিয়ে করালিবাবু বলেন, ‘না না, কোনো কথা না। আমি কিছু জানতে চাই না। তুমি খুন না ডাকাতি কি করে এসেছো, তা আমি শুনতেও চাই না। ভেবো না বাবা হয়ে ছেলেকে পালানোর সুযোগ করে দিচ্ছি। আমি একজন প্রফেশনাল মেকআপ ম্যান। আমার কাজকে আমি ভালোবাসি তাই তোমাকে রুজ, লিপস্টিক না হলেও অন্যান্য রঙ, কালি দিয়ে সাজিয়ে দিলাম’।

করালিবাবুর দিকে একবার অবাক হয়ে তাকালো নকল চুল দাড়ি পরা চন্দ্রনাথ তারপর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। করালিবাবু সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দরজার খিল লাগিয়ে প্রতিমার বিছানার কাছে এসে স্ত্রীর মাথাটি নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রতিমাকে সামলানো যাচ্ছে না দেখে করালিবাবু বলেন ‘তুমি নিশ্চিন্ত হও প্রতিমা। আজ তোমার ছেলেকে যেভাবে সাজিয়েছি, এটাই হবে আমার জীবনে করা শ্রেষ্ঠ মেকআপ। চিন্তা করো না, ওকে কেউ চিনতে পারবে না’।
 
 
লেখক পরিচিতি:
সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত
গল্পকার। অনুবাদক। বাচিকশিল্পী
কলকাতায় থাকেন।






 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ