মোহিত কামাল'এর গল্প: জলবোমা


মাটির ঢেলাটা কপালে ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন রাজু চৌধুরী। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এভাবে মাটি কপালে ঠেকানো ঠিক স্বাভাবিক নয়। তবুও চৈত্রের রোদ, রোদের ভেতর থেকে ছড়িয়ে যাওয়া রূপোলী রোশনি চোখে পুরে আবার মুঠি ভরে তুললেন আরেক দলা মাটি।
 
স্মৃতির নদীজলে ডুবতে থাকা খরস্রোতা ইতিহাসের ভরদুপুর আর চৈত্রের কড়া রোদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে গেল নিজের অজান্তেই। সূর্যাস্তের সময় যেমন রক্তিম চোখ তুলে তাকায় ডুবতে থাকা সূর্য, তেমনি রক্তলাল স্মৃতির ঢাকনা খুলে গেল আচমকা। আর তখনই উদ্দেশ্যবিহীন হাতে তুলে নেওয়া মাটির ঢেলাটা ছুঁড়ে মারলেন পুকুরে। ঘোলাটে নিথর জলে তরঙ্গ তুলে ছড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই পাড়ের আমগাছের পাতার ঝাড়ের ভেতর থেকে উড়ে গেল কয়েকটা কাক। কাকের রঙ কালো হলেও গাছ সেজেছে নানা রঙের আলপনায়―লাল, হলুদ, কমলা আর পাতার সবুজের মহামিলনে চৈত্রের খরতাপের উষ্ণতার মাঝেও প্রাণকাড়া নির্মলতা আর সৌন্দর্যের ছটা আটকে গেল চোখের মণিতে। এ বোধের সুন্দর ঢিলটাও মাটির ঢেলার মতো আবার ঝাকি দিল খরস্রোতা ইতিহাসের সমুদ্রজলে। এবার তিনি ডুবে গেলেন স্বপ্নচোখের গভীরে।
কী কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন ভাবতে গিয়েও নিভে গেল ঘোরলাগা স্বপ্নচোখের আলো। পুত্রবধূ পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, ‘আব্বা, এই কড়া রোদে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন ? স্কুল থেকে ফুলকথাকে আনতে যাবেন না স্কুলে ?’

আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ থাকার কথা। বন্ধ নেই। লাগাতার অবরোধ আর মাঝে মধ্যে হরতাল ডাকার কারণে বন্ধের দিনও স্কুল চলছে। স্কুলে আনা-নেওয়ার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। একমাত্র নাতনি ফুলকথাকে ঘিরেই কাটে সময়। পুত্রবধুর কথা শুনে স্মৃতির খরস্রোতা উজান ঠেলে ফিরে এলেন বর্তমানে। তারপর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুল ছুটির সময় কি হয়ে গেছে ?’
 
‘জি! হয়ে গেছে। তাই মনে করিয়ে দিলাম আপনাকে। দূর থেকে দেখলাম কেমন যেন বেখেয়ালি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।’

‘ভুল দেখো নি তুমি। আজ পত্রিকায় দেখলাম অবরোধের ৭৪তম দিন চলছে। মোট নিহত ১২৩ জন। পেট্রোলবোমা ও আগুনে মারা গেছে ৬৭ জন, বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে ৩৭ জন; সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ লাশ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন। আর ১৩৮৮টি যানবাহনে আগুন-ভাঙচুর ঘটেছে। এ রকম ঘনঘটা দূর্যোগপূর্ণ অবস্থার জন্যই কি একাত্তরে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম আমরা ? ভেবে খারাপ লাগছিল। স্মৃতির সাগরে খাবি খাচ্ছিলাম। তবে ফুলকথার কথা কিন্তু ভুলি নি। ঠিক সময়ে তাকে নিয়ে আসব। তাছাড়া এখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সে। তার কথা কি মনে করিয়ে দেওয়া লাগবে আমাকে ?’

‘সরি আব্বা। আমি অবশ্য জানি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবু মন মানে না। আজ কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে মনে। স্বস্তি পাচ্ছি না কোথাও। কী করবো, বলুন ?’
 
পুত্রবধুকে দোষ দিতে পারলেন না রাজু চৌধুরী। হরতালের কার্যকারিতা হারিয়ে গেলেও প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে খবর আসছে পেট্রোলবোমা হামলার। গতকালও চাঁদপুরে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন একজন নিরীহ ট্রাকচালক। এমন চলতে থাকলে তো মানুষের মনে ভয় ওত পেতে থাকতেই পারে। প্রয়োজনের তাগিদও অস্বীকার করতে পারে না মানুষ। উপরে উপরে সাহসী কিন্তু ভয় মাথায় নিয়েই বের হই সবাই। তবে রাস্তায় এলে ভয়টা টের পাওয়া যায় না। এটুকুই সান্ত্বনা। বন্ধের দিনেও স্কুল খোলা রাখতে হচ্ছে। এখনো এসএসসির পরীক্ষা শেষ হয় নি। বন্ধের দিন তাই এসএসসির পরীক্ষা চলে অধিকাংশ স্কুলে। তবে পড়াশোনা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফুলকথাদের স্কুলে বন্ধের সময়ও পড়াশোনা চলছে। সমস্যার সামনে ন্যুয়ে পড়ে নি বিদ্যালয়-ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। বিকল্প উপায় বের করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। এরকম বিদঘুটে একটা অবস্থার মখোমুখি হবে দেশ, কখনই ভাবতে পারেন নি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজু চৌধুরী। ভেবেছিলেন শত্রুমুক্ত হয়েছে দেশ, স্বাধীন হলেও যে স্বপ্নপূরণ হয় নি সে-কথা আর ভুলতে পারছেন না তিনি। অসহনশীল সময়ে তাই পুরোনো স্মৃতির ঝাপি আবার ঢেকে ফেললেন। ফুলকথার স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন পায়ে হেঁটে।
 
হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন পথের ধুলোতেও ফুটে আছে ধুলোচিত্র, ফুলের আকৃতির ধুলোয় পা রাখতে গিয়েও রাখলেন না, খানিকটা সরে এলেন। সড়কের পাশে আমগাছের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কচি সবুজ পাতার ঝাঁকে ভরে গেছে নতুন সাজে সজ্জিত হলুদ পাতায়, আর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠেছে তুলতুলে নরম আর হালকা লালচে রঙের নতুন কচিপাতাও। প্রকৃতিতে জোয়ারের মতো ছুটে আসছে নবীনের জয়োচ্ছাস। নবীন পাতার নিখাদ নির্মলতা ছুঁয়ে দেখার আগ্রহে হাত বাড়ালেন সড়কের পাশের আমগাছের কচিপাতার ঝাঁকের দিকে। তখনি অন্য একটি ডাল থেকে উড়ে গেল তেলতেলে ডানার কুচকুচে একটা কালো কাক। ওড়ার সময় কা কা শব্দ করল কাক। চৈত্রের নিখাদ দুপুরে ছায়ায় বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে নীরবেই উড়ে যায় না, পুকুরের জলে ছায়া ফেলে উড়ে যায় তারা। একটা উড়লে আর বসে থাকে না সতর্ক চোখের অন্য কাকের ঝাঁক। অথচ এখন শব্দহীন উড়ে গেল একটি কাক। আচমকা কেঁপে উঠল শরীর। কেঁপে উঠল মাটি। 
 
ধুলোমাখা চিত্ররেখায় পরিবর্তন না-ঘটলেও ধুলোচিত্র পেতে চাইল যেন স্থায়ী মাটিতে আপন বসবাস। বুকের চোরা স্রোতে ভয় লুকিয়ে রইল না কেবল, ভয়ের ঢেউ উঠল চোখেমুখেও। আর তখনই দেখলেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা সিএনজি অটোরিকশা। দুঃস্বপ্নের ঝাঁপি আবার খুলে গেল। অটোতে উঠবেন কি উঠবেন না ভাবার সুযোগ পেলেন না রাজু চৌধুরী। ড্রাইভিং সিটে বসা চালক প্রশ্ন করল, ‘আপনি রাজু মুক্তিযোদ্ধা না ? রাজু কমান্ডার না ?’
 
বহুদিন পরে তিনি শুনলেন কমান্ডার শব্দটি। কিন্তু বালক-চালকের প্রশ্নের মধ্যে শ্রদ্ধা নয়, ওত পেতে আছে যেন তাজা পেট্রোলবোমা। মুহূর্তেই চিনে ফেললেন ওই বালককে। ও একাত্তরে তাদের এলাকার শান্তিবাহিনীর প্রধান রহমত আলীর বড় ছেলের ঘরের নাতি। এই ছেলেই কয়েক বছর আগে এক সন্ধ্যায় নির্জন সময়ে দুম করে সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আপনি নাকি একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে আমার দাদাজানরে খতম করবার লাগছিলেন ?’
 
স্পর্ধাপূর্ণ প্রশ্নটার জবাব দিতে গিয়েও দিতে পারেন নি তখন। সামনে তাকিয়ে দেখেছিলেন এককালের উর্বর জমির শস্যহীন খাঁ খাঁ মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে আছে। নতুন শস্য বোনার জন্য নেই জলধারা। মাটি খোঁজে জল অথচ জল নেই কোথাও। শীতল মাটি নেই কোথাও। পোড়া মাটির গন্ধভাসে চারদিক। সোনার বাংলার সোনা ফলানো মৃত্তিকার গলন পরশ পাওয়ার জন্য মুহূর্তেই মার্চপাস্টের লেফট-রাইট, ডান-বামের মতো বাঁ পা দিয়ে একবার সজোরের আঘাত হেনেছিলেন মাটিতে। ধুলো উড়ে গিয়েছিল চারপাশে। সেই তেজ তখনকার চৈত্রের খররোদের চেয়ে কড়া তাপ ছড়িয়ে দিয়েছিল। সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল রহমত আলির নাতি।
 
‘কমান্ডার স্যার আমি হুনবার পাইছি আফনার কারণে ওই সময়ে দাদাজানের জান বাইচ্যা গেছিল। যহন দাদাজানরে গুলি মারবার লইছিল এক তরুণ মুক্তি, তহন আমার বাবজান কোনহানথুন ছুইট্টা আইস্যা ঝাঁপাইয়া পড়েছিলেন দাদাজানের ওপরে। আপনার মায়া হইছিল। ছাইড়া দিছিলেন দাদাজানরে। আফনার আদেশে ছাড়া পাইছিলেন তিনি। আমারে এসব কথা কইছেন দাদাজান।’
 
রাজু চৌধুরীর ভেতর থেকে এখন কমান্ডারের তেজ ফুঁসে উঠল রহমত আলীর নাতির কথা শুনে। মনে মনে বললেন―ভুল করেছিলাম। ভুল করেছিলাম। ওই সময়ে তোমার দাদাজানের কারণে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের গ্রামের ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়েছিল, আর মা-বোনদের সঙ্গে যা করেছিল, সেই কথা ভুলি কীভাবে ? তাকে মেরে ফেলাই উচিত ছিল। শত্রুর বীজ রাখা ঠিক হয় নি। ভুল করেছিলাম মায়ার হাতে বন্দি হয়ে। এখন রহমত আলির প্রজন্ম স্বাধীনতা পক্ষের বিরুদ্ধে ভয়ালরূপে আবির্ভূত হয়েছে। জ্বালাপোড়াও করছে সর্বত্র।
 
মনের কথা রয়ে গেল মনে। চেতিয়ে ওঠা বুক আবার নেতিয়ে গেল রহমত আলির নাতির এ মূহূর্তের বিগলিত কথা শুনে―‘ওডেন আমার অটোয়। আফনার দেরি হইয়া গেল। স্কুল ছুডি হইয়া গ্যাছে। আপনার নাতনি ফুলকথা অপেক্ষা করব। ভয় পাইব। ওডেন তাড়াতাড়ি। আপনার উপকার করতে পারলে খুশি হমু। দেশের অবস্থা ভালা না।’

স্কুলের যাওয়ার সময় অটোরিকশায় ওঠেন না তিনি। ভেবেছিলেন রিকশায় যাবেন। রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। ফুলকথাকে স্কুলপ্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রাখাও শোভন নয়। তা ঠিক হবে না ভেবেই দ্রুত উঠে বসলেন অটোতে।
 
স্কুলে পৌঁছে দেখলেন একদম খালি হয়ে যায় নি স্কুলপ্রাঙ্গণ, ছুটির পর বাড়িগামী ছাত্রীরা এখনো মাঠের কোণে জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। দাদাজানকে দেখে ছুটে এসে ফুলকথা পাশে দাঁড়ানো সিএনজি অটো রিকশা দেখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘রিকশায় না এসে, অটোতে এলে কেন ?’

রাজু চৌধুরী জবাব দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। অটো চালক এবারও নরম ভাষায় বিগলিত ভঙিতেই বলল, ‘পথে ওনার দেরি দেইখ্যা আমিই তুইল্যা আনছি রাস্তা থেইক্যা।’

ফুলকথা বলল, ‘রিকশায় ফিরব। অটোতে না।’

‘খুব মন খারাপ হইল আমার। উপকার করলাম আমি, আর অপমান করলেন আফনি ?’ বলল অটো চালক।

রাজু চৌধুরী ফুলকথাকে থামিয়ে বললেন, ‘থাক না রিকশা। আজ না হয় অটোতেই যাই। ও যেহেতু নিয়ে এসেছে ফিরে গিয়ে একসঙ্গে ভাড়াটা দিব।’
 
এক পা পিছিয়েও দাঁড়িয়ে রইল ফুলকথা।
 
রাজু চৌধুরী মৃদু হাসলেন। উঠে বসলেন সিএনজি অটো রিকশায়। ইশারা করলেন ফুলকথাকেও। দাদাজানের আহ্বান অবহেলা করতে পারল না ফুলকথা। উঠে বসল সেও। আচমকা তার মনে হলো চৈত্রের রঙে রঙিন প্রকৃতির আদর আর সৌন্দর্যের জোয়ারের উল্টো দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। তার কচি মনে বেমানানভাবে হঠাৎ দার্শনিক প্রশ্নের উদয় হলো―শিকড়হীন শিকড়ের দিকেই কি এ যাত্রা ? একবার কেবল বলল, ‘দাদাজান, ভয় করছে। এসময় সিএনজিতে ওঠা কি ঠিক হলো ?’


॥ দুই ॥


অটোরিকশা এগিয়ে চলছে। ফুলকথা দাদার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘ও তো একটা মাস্তান। ওর অটোয় উঠলে কেন, দাদাজান ?’
 
একটা অচেনা আধ্যাত্বিকতায় ডুবে গিয়ে বিমূর্ত জগৎ থেকে মূর্ত জগতে ভেসে উঠে রাজু চৌধুরী জবাব দিলেন, ‘মাস্তানদের সিএনজিতে কেউ পেট্রলবোমা মারার সাহস পাবে না।’

‘তবুও ভয় করছে।’ বলল ফুলকথা।
 
‘ভয়ের কিছু নেই। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে শুনলাম। এখন হয়ত জ্বালাপোড়াও কমে যাবে।’

‘না। তোমার কথায় সাহস পাচ্ছি না। এ এলাকায় ওকে সবাই চন্ডাল মাস্তান বলে ডাকে। জানো তো তুমি ও হলো রহমত আলির নাতি। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের নাতির অটোরিকশায় উঠতে পারলে তুমি ?’
 
নাতনির কথার মধ্যে থেকে বোধের জগতে সাঁই করে আঘাত হানল নতুন বুলেট। এই বুলেটের উদ্বেগদহনকে অচেনা মনে হলো। এমন উৎকন্ঠার ঝাঁঝ কখনো আগে লাগে নি গায়ে। তবুও আশ্বস্ত করলেন নাতনিকে। আবারও বললেন,‘ভয় পেয়ো না, ফুলকথা।’
 
এবার রাজু চৌধুরীর কথাটা কিছুটা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হওয়ায় শুনে ফেলল চন্ডাল মাস্তান। ফিস ফিস করে বলা-কথাও শুনেছে অস্পষ্টভাবে। আপাতত তার লুকোনো মুখোশের ভেতর থেকে শুদ্ধ ভাষায় বেরোল জোরালো রাজনৈতিক কথার সুর, ‘সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলেই কি সব ঠান্ডা হয়ে যাবে ? কী বললেন এটা ?’
 
প্রশ্নটা রাজু চৌধুরীর মাথায় আরেকটা বুলেট হিসেবে আঘাত হানল। সরলভাবে যা তিনি চিন্তা করেন, তার আড়ালেও থাকে আরেক চিন্তা, সঠিক সময়ে সেই ধারণাটা অগ্রিম ধরতে পারেন না তিনি।
 
উত্তর না-পেয়ে চন্ডাল মাস্তান আবার বলল, ‘পেট্রলবোমা বন্ধ হবে কি হবে না নির্ভর করছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। ফলাফল গুম করলে, কেড়ে নিলে এগুলা আরও বাড়বে।’
 
শুনে ঘাবড়ে গেল ফুলকথা। চন্ডাল মাস্তান তো দেখছি কেবল সিএনজি চালিত অটোই চালায় না। রাজনীতিও করে। মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষায়ও কথা বলে! ভাবলেন রাজু চৌধুরীও। বুঝলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তির অঙ্কুরিত বীজ সুশোভিত হয়েছে, আরও নির্মম আরও হিংস্ররূপে ছড়িয়ে গেছে বর্তমানেও। তবে কি সত্যি সত্যিই একাত্তরে রহমত আলীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয় নি ? ইতিহাসের ভুলের বোঝা কি তবে বইতে হবে এখনো ?

দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছে ফুলকথা। বিকৃত ভঙ্গিতে সান্ত্বনার স্বরে চন্ডাল মাস্তান বলল, ‘আমার অটোয় পেট্রলবোমা মারবে না কেউ। এমন সাহস নেই কারুর। তবে বোমার কি অভাব আছে দুনিয়ায় ? এই যেমন ধরেন জলবোমা। সে ব্যাপারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নাই আমার হাতে।’
 
কথাটার অর্থ বুঝল না ফুলকথা। দাদার মুখের দিকে তাকাল প্রশ্নবোধক চোখে। জলবোমার কথা এর আগে শোনেন নি রাজু চৌধুরীও। তবে মিছিল ভঙ্গ করার জন্য ঢাকায় জলকামান ব্যবহারের কথা শুনেছেন। এই মফস্বল শহরে কখনো জলকামান দাগানো হয় নি, জলবোমার কথাও শোনেন নি কেউ।
 
জলবোমাটা দেখতে কেমন, কীভাবে বিস্ফোরিত হয় এ অচেনা বোমা, ফুলকথার জানার কথা নয়। তবুও কল্পচোখে মূর্ত হয়ে উঠল বিমূর্ত জলবোমার উৎসারিত জলাক্রমণ, জলের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে যেন সে চলেছে অজানা কোনো দেশের উদ্দেশে।


॥ তিন ॥


একটা বুনোফুলের গন্ধ নাকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অটোতে তীব্র ঝাকি টের পেলেন পেছনের সীটে বসা বদ্ধ দরজার ভেতর আটকে থাকা রাজু চৌধুরী আর ফুলকথা। কোত্থেকে এল এ গন্ধ ? হঠাৎ দেখা গেল সামনের দরজা খুলে চলন্ত অটো থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়েছে চন্ডাল মাস্তান। তারপর আর কিছুই দেখলেন না রাজু চৌধুরী, ফুলকথার ভাষাও চুপ হয়ে গেল। সড়কের পাশের বড় ঢোবার দিকে নেমে যাচ্ছে সিএনজি অটো। পেছনের সিটের দরজা খোলার কথা ভুলে গেলেন তারা। বিপদে নিজেদের রক্ষা করার বোধও হারিয়ে ফেললেন। সিএনজি অটো সরসর করে নেমে গেল খাদের গভীর জলে। চকিত ফুলকথার মনে হয়েছিল পেট্রলবোমা উড়ে এসে আঘাত হেনেছে অটোতে; দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনশিখায় এসে পড়েছে জলবোমা। জ্বলে ওঠা কল্পিত বারুদের স্ফুলিঙ্গ নিভে গেল মুহূর্তে। বারুদ ভিজে গেল জলে কিন্তু ভেজা বারুদ থেকেও বেরোচ্ছে আগুন। রাজু চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সে-আগুন স্পর্শ করল না চন্ডাল মাস্তানের বোধের জগৎ। ক্রুরতার আনন্দ নিয়ে একবার চিৎকার করল সে। তারপর নিরিবিলি সড়ক ধরে এগিয়ে আসতে থাকা অন্য একটা অটো রিকশার চালকের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘যাত্রীসহ আমার অটো ডুবে গেছে খাদে। আমার অটো উদ্ধার করুন, যাত্রীদের উদ্ধার করুন।’
 
চেতনার বারুদ ভিজে গেল নব প্রযুক্তির উদ্ভাবনী এ কৌশল, জলবোমার প্লাবনে। সবাই জানল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন রাজু চৌধুরী আর তার ফুলের মতো নাতনি, ফুলকথা।
-----------
 
 
লেখক পরিচিতি : 
মোহিত কামাল
কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি লরিয়েট, ২০১৮।
সম্পাদক, শব্দঘর।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

16 মন্তব্যসমূহ

  1. মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের সাথে বর্তমান সময়ের মিল,পার্থক্য,দেশের পট পরিবর্তন একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়েছে। রাজাকারদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষমা করে দেয়ায় রাজু চৌধুরীর মনে আক্ষেপের জন্ম হয়েছে। তাদের বংশধররা স্বাধীনদেশে এখনো যুদ্ধের সময়ের মতো নৈরাজ্য করে যাচ্ছে, যা তাকে মর্মযাতনায় ভুগাচ্ছে।সেই সময়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে গল্পের শেষে দেখতে পাই নির্মম পরিণতি রাজু চৌধুরী ও তার নাতনির। যা পাঠককে এক ধরণের হাহাকার, কষ্টের যাতনা তৈরি করে মনে।

    উত্তরমুছুন
  2. এ এইচ এম জহিরুল ইসলাম১৭ মে, ২০২১ এ ৩:৪৮ AM

    ক্ষমা মহৎগুণ ‍নিঃসন্দেহে। কিন্তু রহমত আালীর মতো ভুল মানুষদের ক্ষমা করা যায়ণা!

    উত্তরমুছুন
  3. আসারণ একটি গল্প পড়লাম

    উত্তরমুছুন
  4. জলবোমা
    জাকিয়া রহমান

    প্রায় আড়াইশো বছর পূর্বে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায় পরাধীন হয়েছিল। বিজাতীয় শাসকের শোষণে সংক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা মানুষ অচিরেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। বিশ্বাসঘাতক কালে কালে ছিল বর্তমানেও আছে। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ক্রমপরিবর্তনে আবাসযোগ্য পৃথিবী হওয়ার অনুরূপ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশও একবারের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এ প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ধাপেধাপে শত শত বছরের জ্বালাময়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। বাঙালি জাতিকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা, ভাষাকে রক্ষা করা, স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিকানা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বার বার বুকের রক্তে রাজপথ রাঙাতে হয়েছে। পলাশী প্রান্তরের বিশ্বাসঘাতকরা বিলীন হয়ে যায় না, কালের বিবর্তনে নতুন রূপে তাদের আবির্ভাব ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শোষকদের পৃষ্ঠপোষক বিশ্বাসঘাতকরা রাজাকার নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপক্ষ শক্তি রাজাকারদের দৌরাত্ম্যে হত্যা, যখম, ধর্ষণ, লুটতরাজ সংঘটিত হয়েছে। 'জলবোমা' গল্পে বংশানুক্রমিক ধারায় রাজাকারের নাতি চন্ডাল মাস্তানের হিংস্রতা দেখানো হয়েছে। রাজাকারের পরবর্তীকালের প্রজন্ম সুবিধাবাদী স্বার্থপর শ্রেনি তারা আজও রাজনীতির নামে হত্যাযজ্ঞ চালায়। মানুষের রক্তের হোলিখেলা তাদের নেশা। গল্পে বর্ণিত হয়েছে এ নেশা তারা পূর্ব পুরুষের কাছে থেকে পেয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  5. জাকিয়া রহমান

    শরীরে বহন করা বংশানুক্রমিক ডিএনএ-এর প্রকট জিনের কার্যকারিতা পরবর্তীকালের প্রজন্মের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। উত্তরাধিকারসূত্রে জিনগত স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা রক্তে মিশে থাকলেও সে বৈশিষ্ট্য হয়ত অনুকূল পরিবেশে অনেকটা মানবিক গুণসম্পন্ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। তা অসম্ভব থেকে যায় কেননা পারিবারিক হিংস্র বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠা রাজাকারের পরবর্তীকালের প্রজন্ম হয় মানবিকতার আলো বিবর্জিত। সঙ্গত কারণেই গল্পে ঘাতক চন্ডাল মাস্তানের বুকে লালিত রয়েছে সাংঘাতিক এক প্রতিশোধ স্পৃহা। এক নির্জন সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সামনে হাজির হয়ে বলা কথাতেই তার ভয়ঙ্কর হিংস্রতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। "আপনি নাকি একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে আমার দাদাজানরে খতম করবার লাগিছিলেন?"

    চন্ডাল মাস্তান চরিত্রটি হরতাল-অবরোধের বোমাহামলার ঘনঘটায় মনের মধ্যে পুষে রাখা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কার্যকর করতে সচেষ্ট থেকেছে। ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যার নীলনকশা প্রস্তুতই শুধু নয় মায়াকান্না করে সকলের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও সচেষ্ট থেকেছে । প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মায়াকান্নার অন্তরালে মনের মধ্যে রক্তপিপাসু বিজয়ী দানবের অট্টহাসিও থাকে যা পাঠক সমালোচকের নজর এড়িয়ে যায় না।

    উত্তরমুছুন
  6. জাকিয়া রহমান

    ২০১৩ সালের শেষার্ধ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় হরতাল-অবরোধে জনমনে আতংক সৃষ্টির অন্যতম উপায় ছিল গণপরিবহনে পেট্রলবোমা হামলা। নির্বাচন প্রস্তুতির পূর্ব মুহূর্তে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল সরকার বিরোধী গুপ্ত হামলাকারী। সেই সময় জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রসহ স্থানীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলা এবং সাধারণ যাত্রীদের আগুনে পোড়া ঝলসানো শরীর। গণপরিবহনে বোমা হামলার যৌক্তিকতা কী? রাজনৈতিক ইস্যুই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন থাকে- সাধারণ গণপরিবহনে কোন রাজনৈতিক নেতা-আমলা চলাচল করেন কি? নিরুপায় নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারী বা হত্যাকারী অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজাকারদের সমতুল্য। গল্পের অনুরূপ অবরোধকালীন সময়েও প্রতিটি হামলা পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সংঘটিত হয়েছে কেননা গুপ্ত হামলাকারীর তথ্যানুসন্ধান ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরিকল্পনামাফিক হামলা শেষে তারা আত্মগোপন করেছে। গল্পে ফুলকথাকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হওয়া মাত্রই ঘাতক অটোরিকশা নিয়ে হাজির হয়। বিষয়টি হামলাকারীর পূর্বপরিকল্পনা প্রমাণ করে। ফুলকথা অটোরিক্সায় উঠতে রাজি হয় না। অবশেষে দাদার আহ্বানে মনোসঙ্কা নিয়ে অটোরিক্সায় চেপে বসে।‌ বিপদের আশঙ্কা মুক্তিযোদ্ধার মনে ছিল না তেমনটিও নয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমিক ও মহৎ মনের অধিকারী। সংগত কারণেই মানুষের প্রতি সহজাত মমতাবোধে সহজেই শত্রুকেও বিশ্বাস করে ভালো হওয়ার তথা মানবিক হওয়ার সুযোগ দিতে চায়। মানবিকতার আলো বিবর্জিত জন্মান্ধ, স্বার্থপর এ শ্রেণি সুযোগকে হিংস্রভাবে কাজে লাগায়। বিশ্বাসকে পুঁজি করে সুযোগদাতার প্রাণ হরণ করে পৈশাচিক স্বস্তি লাভ করে, চন্ডাল মাস্তান তেমনি এক পূর্ব পুরুষের উত্তরসূরী।

    উত্তরমুছুন
  7. জাকিয়া রহমান

    পৃথিবীতে অমানবিকতা এক অশুভ শক্তি, বিধায় শুভ চেতনার প্রতি তাদের যাবতীয় প্রবল প্রতিহিংসা। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও বাংলাদেশে সে ভয়াল হিংস্রতার শেষ হয় না। কেননা সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। দেশের শত্রু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি রাজাকাররা সমাজে এখনো বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যুদ্ধ কি শুধুই পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে ছিল? প্রকৃত যুদ্ধ ছিল স্বজাতি ভাই এদেশের ভূমিমাতৃকায় লালিত রাজাকারদের সাথে! কেননা রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসর ও তাদের শক্তির উৎস। যুদ্ধে বিদেশি শক্তি পরাভূত হয়ে দেশ ছাড়লেও স্বজাতি মানবতার শত্রুরা দেশেই অবস্থান করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অগনিত নিরপরাধ মানুষ হত্যার হিংস্রতায় তারা মানুষ রূপী অমানুষে রূপান্তরিত হয়েছে।
    মুক্তিযুদ্ধের সমূহ শক্তিকে সমূলে বিনাশ করাই যেন এই অপশক্তির মূল লক্ষ্য। ঘাতক শুধু মুক্তিযোদ্ধোকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করতে পারত কিন্তু তা না করে ফুলকথা উপস্থিত থাকা অবস্থায় হত্যার পরিকল্পনা করেছে। তার এ পরিকল্পনায় প্রমাণ মেলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে রাজাকাররা সমূলে নিঃশেষ করার প্রত্যয় রাখে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাঙালি জাতির মুক্তির নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে বিরুদ্ধ শক্তির হাতে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল। অর্থাৎ একজন দেশ নায়ক তার পরবর্তী প্রজন্মসহ হত্যার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। আলোচ্য গল্পে মুক্তিযোদ্ধা রাজুও তার পরবর্তী প্রজন্ম ফুলকথাসহ হত্যার শিকারে পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। "জলবোমা" গল্পের মুক্তিযোদ্ধা রাজুও ঘাতক মাস্তানের দাদা রাজাকার রহমত আলীকে দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে রাজাকারকে ক্ষমা করে ভুল করা ও পরবর্তী প্রজন্মসহ হত্যার শিকারে পরিণত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার রাজু চরিত্রটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু চরিত্রের উদারতার সাযুজ্য মিলে।

    উত্তরমুছুন
  8. জাকিয়া রহমান

    প্রতিটি মানুষ তাদের বিশ্বাস ও সংস্কার নিয়ে বেড়ে ওঠে। মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিতে তাদের চেনা পরিবেশ ও সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলে। এক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়বোধ বিচারকে অবহেলা করে ধর্মীয়, নীতিগত, প্রথাগত, দলগত, গোষ্ঠীগত, চেতনাগত সকল ক্ষেত্রে এক অন্ধ বিশ্বাসে মানুষ পথ চলতে চায়। সংগত কারণেই তার মানবিক বিবেচনা বোধের শিথিলতায় সে সচরাচর সেই পথ অনুসরণ করতে চায়, যা তার পূর্বপুরুষ অনুসরণ করেছে। অনুরূপভাবে সেই বিশ্বাসকে ধারণ করেই পূর্বপুরুষের শত্রুকে শত্রু এবং বন্ধুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। যুক্তিবোধে স্বাধীনতার শত্রু রাজাকারের পরবর্তীকালের প্রজন্মের কাছে মানবিক আচরণের প্রত্যাশা ও বিশ্বাস অধিকাংশই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
    এলাকার পরিচিত চন্ডাল মাস্তানের অটোরিক্সাতে কেউ পেট্রোল বোমা ছোড়ার সাহস পাবে না। কেননা সে নিজেও ওই দলের সহচর। নিজেকে নিরপরাধ রাখতে ও ঘটনাকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে প্রচার করতে চন্ডাল মাস্তান চলন্ত অটোরিক্সাকে বিস্ফোরকসহ পানিতে ফেলে দেয়। বিস্ফোরকের বিষয়টি পরিস্কার ভাবে উল্লেখ না থাকলেও হঠাৎ বুনোফুলের গন্ধ ও তীব্র ঝাঁকুনি এবং উল্লিখিত জ্বলন্ত অগ্নিশিখা বিস্ফোরকের উপস্থিতির প্রমাণ দেয়। ঘাতক পানিতে ডুবিয়ে মারার এই নৃশংস পরিকল্পনার অস্ত্রের নাম দেয় জলবোমা। সরল মনের হতবিহ্বল মুক্তিযোদ্ধা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুনোফুলের গন্ধসহ অটোরিক্সা বিষ্ফোরিত হয়ে পানির দিকে গড়িয়ে গভীরে তলিয়ে যায়। ঘাতক বিস্ফোরকটি রেখে দরজা খুলে মুহূর্তে বের হয়ে আসে। লেখকের বর্ণনায়- "একটা বুনোফুলের গন্ধ নাকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অটোতে তীব্র ঝাকি টের পেলেন পেছনের সীটে বসা বদ্ধ দরজার ভেতরে আটকে থাকা রাজু চৌধুরী আর ফুলকথা। কোত্থেকে এল এ গন্ধ?... চকিত ফুলকথার মনে হয়েছিল পেট্রোলবোমা উড়ে এসে আঘাত হেনেছে অটোতে; দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা অগ্নিশিখায় এসে পড়েছে জলবোমা।"
    "জলবোমা" গল্পটি সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বাস্তব সত্যচিত্র। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-অবরোধের ৭৪ তম দিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী হতাহতের খবরে মুক্তিযোদ্ধা রাজুর মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। যেন আবারো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে পাপমুক্ত করার দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে গল্পে সূচনাতেই কপালে মাটির ঢেলা স্পর্শ করেছিলেন। গল্পের প্রথমাংশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্ণনা, উপমা ও রং এর ব্যবহার অত্যন্ত চমকপ্রদ নান্দনিকতার দাবি রাখে। ভাব প্রকাশের নান্দনিক উপমায় সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে পাঠকের চোখে মুক্তিযুদ্ধের বীভৎসতাও অবিকৃতভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে-"সূর্যাস্তের সময় যেমন রক্তিম চোখ তুলে তাকায় ডুবতে থাকা সূর্য, তেমনি রক্তলাল স্মৃতির ঢাকনা খুলে গেল আচমকা।" সহজ-সরল অথচ বলিষ্ঠ ভাষায় অখন্ড কাহিনিতে উপস্থাপিত হয়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, রাজাকারদের হিংস্রতা ও স্বার্থপরতার চিত্র। মুক্তিযোদ্ধা রাজু চৌধুরী যুদ্ধ পরবর্তীসময়ে ঘাতকের দাদাকে ক্ষমা করে ভুল করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ঘাতক চন্ডাল মাস্তানকে বিশ্বাস করে আবারও ভুল করলেন।

    মোহিত কামালের অন্যান্য গল্পকে ছাপিয়ে এ গল্পটি স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। 'জলবোমা' গল্পের কাহিনি শিথিল নয়। সমকালীন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সাথে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার চরিত্রের সংমিশ্রণে গল্পটিতে এক অনবদ্যতার করুণ সুর ধ্বনিত হয়েছে। গাড়িতে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনার সত্যতায় একটি বিশেষ সময়ের রাজনৈতিক ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনায় গল্পটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও থাকবে।

    উত্তরমুছুন
  9. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৭:৫১ AM

    সালমা আক্তার
    ▪▪▪▪▪
    (১) মানব জীবনে যুদ্ধ, প্রতিরোধ যুদ্ধ বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী যেকোনো ঘটনার প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। এসব ঘটনা চিরদিনই কালজয়ী ও মহৎ সাহিত্যের অনন্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এমন জটিল ও সংবেদনশীল সময়েই মানুষের মহত্তর ও গভীরতর পরিচয় উন্মোচিত হয়। 'ইলিয়াড' অথবা 'মহাভারত' এর মতো মহাকাব্য তার সমস্ত অবয়বে এই যুদ্ধকে ধারণ করেছে। বিখ্যাত রুশ কথাশিল্পী লিও টলস্টয়ের মহাকাব্যোপম উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড পিস' এর মূল উপাদান সংগৃহীত হয়েছে দিগ্বিজয়ী ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের সময়কার রুশ দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সূত্র থেকে। ইলিয়া এরিলবুর্গের 'প্যারীর পতন' এর আখ্যানভাগ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় ফরাসি সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মূল উৎসের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। স্পেনের গৃহযুদ্ধের একটি বিশেষ পটভূমিকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের 'ফর হুম দ্যা বেল টোলস' কিংবা বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রের বিখ্যাত ট্রিলজি 'দি এজ অবরিজন', 'দি রিপ্রিভ' ও 'আয়রন ইন দ্যা সোল' - এর বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধকালীন পটভূমি। একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও বহুদিক থেকেই আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃজন প্রয়াসে এক বিশেষ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যে উদ্ভাসিত। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল এই মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করেই তাঁর 'জলবোমা' গল্পে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। লেখক অন্তরঙ্গভাবে মুক্তিযুদ্ধের রাজাকারদের স্বরূপসত্য উন্মোচন করেছেন গল্পটিতে। স্বাধীনতা-উত্তরকালীন বিপন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেখক প্রতিবাদ ও জাগরণের মননসিদ্ধ শিল্প অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তাঁর গল্পে।

    উত্তরমুছুন
  10. সালমা আক্তআ২৩ মে, ২০২১ এ ৭:৫৪ AM

    (২) সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, "ঈশ্বরের ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম।" সংস্কৃত শ্লোকে আছে, 'জননী জন্মভূমিশ্চঃ স্বর্গাদপি গরীয়সী।' দেশপ্রেম মানুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এক মহৎ গুণ। এই বিশাল পৃথিবীর যে ভূখণ্ডে যে মানুষ জন্ম নেয়, সে দেশের আলো-বাতাস- ধূলিকণায় তার নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস, যে রাষ্ট্রের ধর্ম-ভাষা- সংস্কৃতিতে তার একাত্ম হওয়ার আকুতি সেই দেশই হলো তার স্বদেশ। সে কারণে, স্বদেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশের সঙ্গে একজন মানুষের যেমন শেকড়ের বন্ধন গড়ে ওঠে, তেমনই মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি সৃষ্টি হয় তার চিরায়ত ভালোবাসা। ভালোবাসার এই আবেগময় প্রকাশই হলো দেশপ্রেম। 'জলবোমা' গল্পে তেমনই এক দেশপ্রেমিক চরিত্র রাজু চৌধুরী।

    সমকালীন জীবনে অতীতের অশরীরী পদচ্ছায়া ও রাজু চৌধুরীর আত্মসম্মান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তা সন্ধানের পূর্বতন ধারায় প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছে। বর্তমানের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাসে এ পর্যায়ে তিনি আত্মসমিধ সংগ্রহে পরিভ্রমণ করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সঙ্ঘজীবনাবেগে। ষাটোর্ধ্ব রাজু চৌধুরী চৈত্রের তপ্ত রোদের মাটির ঢেলা কপালে ঠেকালেন, কিন্তু এ বয়সে তা স্বাভাবিক নয়। তার ভেতরের দেশপ্রেম বা তেজ যেন চৈত্রের রোদের ভেতর থেকে ছড়িয়ে যাওয়া রুপোলী রোশনিরই প্রতীক। যখন অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন ওঠে তখন সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় মানুষ। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনতে চায় মুক্তি। যুগ যুগ ধরেই মানুষ আন্দোলন করে আসছে। অতীতে সংঘটিত হওয়া আন্দোলন বর্তমান আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। রাজু চৌধুরীর অস্তিত্বে মিশে আছে সে আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদী চেতনা। আবার মুঠি ধরে তুললেন আরেক দলা মাটি। দেশকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে যেন আবার নতুনভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি।

    গল্পে রাজু চৌধুরীর চলমান জীবনরূপ আবেগময় শব্দ রূপায়ণের মধ্য দিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ময় বিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মন্থন জীবন স্রোতের মধ্যেও তরঙ্গায়িত হয়েছে মানবীয় আশা- আকাঙ্ক্ষা অচরিতার্থ বেদনার রূপবৈচিত্র্য। তাই তো স্মৃতির নদীতে ডুবতে থাকা খরস্রোতা ইতিহাসের ভরদুপুর আর চৈত্রের কড়া রোদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে নিজের অজান্তেই। সূর্যাস্তের সময় ডুবতে থাকা সূর্য যেমন রক্তিম চোখ তুলে ঠিক তেমনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ষাটোর্ধ্ব রাজু চৌধুরী ডুবতে থাকা সূর্যের মতো আবার নতুন করে তেজোদীপ্ত হতে থাকেন। যেন রক্ত লাল স্মৃতির ঢাকনা খুলে গেল আচমকা। মনে পড়ে গেল সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা।

    উত্তরমুছুন
  11. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৭:৫৬ AM

    (৩) রং আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি রঙই নিজের নিজের জায়গায় সুন্দর এবং তার নিদর্শন শক্তির জন্যই সুপরিচিত। রং দিয়ে সুখ, ভালবাসা এমন কী কষ্টও বোঝা যায় ৷ বিভিন্ন রং ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের প্রতীক এবং তাদের ব্যবহারও আলাদা। কাকের কালো রং অশুভর প্রতীক। কালো মানেই মৃত্যুর, বিশ্বাসঘাতকতার ও ভয়ের প্রতীক।

    শৌর্য, তেজস্বিতা, বিজয়, পরাক্রম, গৌরব ও যশের ধারক হলো লাল। হলুদ রং মহাকর্ষের, বুদ্ধি বা অনুভবের প্রতীক। যে কোনো অশুভত্বকে নাশ করে বলে সর্ববিঘ্নহন্তা গণপতির পরিচ্ছদ হলুদ বর্ণের। একই কারণে শ্রীবিষ্ণুও হলুদ পরিচ্ছদ পরেন। কমলা রং সৃজনশীলতা, বদল, শক্তি এবং ধৈর্যকে বোঝায়। সবুজ রং আসার প্রতীক, নতুন জীবনের, শক্তি, উর্বরতার এবং বৃদ্ধির প্রতীক। মানসিক শান্তি এনে দেয় সবুজ। তাই রাজু চৌধুরীর মনে হলো মাটির ঢেলা ছুড়ে মারতেই যেন সবুজ পাতা রূপী স্বদেশের মাঝ থেকে কাকরূপী রাজাকারদের কালো ছায়া পালিয়ে গেল।

    আর সঙ্গে সঙ্গেই নানা রঙের সমারোহে দেশটা যেন সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হলো। রঙের সমারোহ যেন যুদ্ধ জয়েরই ইঙ্গিত বহন করে। তাই বোধের সুন্দর ঢিলটাও মাটির ঢেলার মতো ঝাকি দেয় খরস্রোতা ইতিহাসের সমুদ্রজলে। এবার তিনি ডুবে গেলেন স্বপ্নচোখের গভীরে।

    কী কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তা ভাবতে গিয়ে নিভে গেল ঘোরলাগা স্বপ্ন চোখের আলো। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে একই সুতোয় গাঁথা দেশপ্রেমের আকুলতা। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে মহৎ করে। মানব-কল্যাণে আত্মনিয়োগে উৎসাহিত করে। দেশের স্বার্থে একজন দেশপ্রেমিক প্রাণ বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত হয় না। স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের হৃদয়কেই কাঁদায়, রাজু চৌধুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীনতা - উত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রত্যাশিত কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের সমাজচেতনা প্রবাহের পশ্চাদগতি রাজু চৌধুরীর প্রাগ্রসর মানসকে করেছে দ্বন্দ্বদীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত।

    হঠাৎ পুত্রবধূর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলেন। তার নাতনি ফুলকথাকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার কথা। এদিকে মায়ের উদ্বিগ্ন মন যেন আগে থেকেই সন্তানের জীবননাশের অশুভ বার্তা পেয়ে গিয়েছিল। তাই তো তাকে ফুলকথার জন্য দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে দেখা যায়।

    লাগাতার হরতাল অবরোধের কারণে শুক্রবারেও স্কুল কলেজ খোলা। প্রতিদিন পেপার পত্রিকায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কথা শুনে তিনি ভীষণ মর্মাহত হন। দেশ স্বাধীন করার যেন কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি ফুলকথাকে স্কুল থেকে আনার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

    হঠাৎ পথে ফুলের আকৃতির ধুলোচিত্র দেখে তিনি পা সরিয়ে নেন। দেশ তো একটা ফুলই। এই ফুলকে রক্ষা করার জন্যই একাত্তরে অস্ত্র ধরেছিলেন। তাই হয়তো ফুলের আকৃতির ধুলোচিত্রকে পা দিয়ে দলে যেতে পারেননি তিনি।

    উত্তরমুছুন
  12. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৭:৫৮ AM

    (৪) পথের পাশে আম গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কচি সবুজ পাতার ফাঁকে ভরে গেছে নতুন সাজে সজ্জিত হলুদ পাতা আর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠেছে তুলতুলে নরম আর হালকা লালচে রঙের নতুন কচি পাতা। প্রকৃতিতে ছুটে আসছে যেন নবীনের জয়োচ্ছ্বাস। যেন কোনো বিজয় গাঁথা দেশের প্রতিচ্ছবি। নবীন পাতার নির্মলতা ছুঁয়ে দেখার আগ্রহে হাত বাড়ালেন সড়কের পাশের আম গাছের কচি পাতার দিকে। উড়ে গেল তেলতেলে ডানার কুচকুচে কালো কাক। আজও সুন্দরের মাঝে অসুন্দরের নষ্ট কালো ছায়ার ছাপ সুস্পষ্ট।

    জাপানি সংস্কৃতিতে কাক নবজীবন এবং পুনর্জন্মের প্রতীক। জাপানের দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী উপজাতি আইনুদের মধ্যে কাক হলো একটি পাখি যা নিজেকে উৎসর্গ করেছিল যাতে মন্দটি সূর্যের ক্ষতি করতে না পারে এবং এর সঙ্গে পুরো পৃথিবী। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তাদের কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়। কাককে খারাপ, মৃত্যুর প্রতীক এবং নানা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। তাদের বেশিরভাগ কাল্পনিক উপস্থিতিতে তারা ডুবে যাওয়া ভয়ংকর পাখি এবং প্রচলিতভাবে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও সংস্কৃতিতে মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত। লেখকও গল্পে কাককে মৃত্যুর এবং দেশের কলঙ্কের প্রতীক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। পুকুরের জলে ছায়া ফেলে শব্দহীন উড়ে যায় একটি কাক। কিন্তু তারা তো একা উড়ে না বা দুপুরে ছায়ায় বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে নীরবে উড়ে যায় না। এ ভাবনায় আচমকা কেঁপে ওঠে শরীর, কেঁপে ওঠে মাটি। রাজু চৌধুরী ভাবেন, কাকের ছায়ার মতোই পাকিস্তানি আমলের আদর্শিক অপচ্ছায়ার ক্রমপ্রসার, রাষ্ট্র ও জনতার দূরতিক্রম্য ব্যবধান, জনকল্যাণের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় স্বার্থ সংরক্ষণ প্রয়াস, সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যবচ্ছেদে রাষ্টের হস্তক্ষেপ, প্রতিবাদের পরিণামে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা প্রভৃতি রাজনৈতিক মত প্রকাশের পথকে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত করে তোলে।

    ধুলোচিত্র রূপী দেশ যেন পেতে চাইল মাটিতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, পুরোপুরি স্বাধীনতার আস্বাদ। কিন্তু এক অজানা আশঙ্কায় তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হলেন আর সে ছাপ তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট।

    উত্তরমুছুন
  13. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৮:০০ AM

    (৫ ) সিএনজি চালককে দেখে তার দুঃস্বপ্নের ঝাপি যেন খুলে গেল। চোখেমুখে একধরনের আতঙ্ক খেলে গেল। সে তাকে রাজু কমান্ডার ডাকলেও তা উপলব্ধিহীন বুলির মতোই শোনাল। তাতে কোনো শ্রদ্ধা বা ভক্তির লেশমাত্র ছিল না। যেন তার কথায় লুকিয়ে আছে তাজা পেট্রলবোমা। বালক-চালক একাত্তরে শান্তিবাহিনীর প্রধান রহমত আলীর নাতি। একাত্তরের সেই রাজাকারদের থেকেই যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের জন্ম হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকেরা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা হীন কাজে লিপ্ত হয়েছে। কয়েক বছর আগে একবার সে রাজুকে প্রশ্ন করেছিল, "আপনি নাকি একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে আমার দাদাজানরে খতম করবার লাগছিলেন?" তবে সেদিন তার তেজদীপ্ত জৌলুশ দেখে পালিয়ে গিয়েছিল রহমত আলীর নাতি।

    একাত্তরে রহমতের ছেলেকে দেখে মায়া হওয়ায় বেঁচে গিয়েছিল রহমত। কিন্তু আজ বুঝতে পারেন কত বড় ভুল সেদিন তিনি করেছিলেন। শত্রুর বীজ রাখা ঠিক হয়নি। স্বাধীনতা বিরোধী এবং ওদের বংশধররা আজীবন এদেশের শত্রু। কারণ তারাই আজ দেশের বিরুদ্ধে ভয়ালরূপে আবির্ভূত হয়ে খুনের নেশায় বিভিন্ন জায়গায় জ্বালাপোড়াও করছে।

    কিন্তু রাজু চৌধুরী আবার সে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন রহমতের নাতির বিগলিত কথায় তার অটোতে উঠে। ফুলকথা স্কুলপ্রাঙ্গণে একা দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবেই তিনি উঠেছিলেন। ফুলকথা তাকে অটোতে দেখে মোটেই খুশি হয়নি। সে রিক্সায় ফিরে যেতে চাইলেও দাদার কথায় অনিচ্ছাকৃতভাবেই সেও অটোতে উঠে বসে। রাজু চৌধুরীর মনেও যে কোনো অজানা আশঙ্কা বা ভয় ছিল না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে বীরেরা শত্রুদের দেখে যেমন পালায়ন করে না, তিনিও পালাতে চাননি। কোথাও কোনো গোলযোগ দেখা দিলে সে খবর মস্তিষ্কে পৌঁছায় সবার আগে। তার প্রভাব পড়ে আমাদের মননেও। ফুলকথাও হয়তো তাই বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। হঠাৎ তার মনে হলো সমস্ত সৌন্দর্যের জোয়ারের উল্টো দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। যেন শেকড়হীন শেকড়ের দিকে তাদের এ অন্তহীন যাত্রা। যেন সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে অজানা কোনো অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। যেন সে যাত্রা লোক থেকে লোকান্তরের উদ্দেশ্যে।

    উত্তরমুছুন
  14. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৮:০২ AM

    (৬ ) মাস্তানের অটোতে ওঠাতে ফুলকথা ভয় পাওয়ায় তিনি আধ্যাত্মিকতায় ডুবে গিয়ে বলেন, "মাস্তানদের সিএনজিতে কেউ পেট্রলবোমা মারার সাহস পাবে না।"
    আর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
    ফুলকথা একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতনি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বদেশপ্রীতি তার হৃদয়ে ধারণ করেছে। সে তার দাদাকেও মনে করিয়ে দেয় সে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের নাতি এবং মাস্তানের অটোতে চড়ে কী করে! এ কথায় তার চেতনার জগতে যেন আঘাত হানলেও এই উদ্বেগদহনকে অচেনা মনে হলো।

    অটো চালক তাদের সব কথা শুনে ফেলে বলে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। ফলাফল গুম করলে বা কেড়ে নিলে বরং এগুলো আরো বেড়ে যাবে। রহমত আলীর মতো রাজাকারদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষমা করে দেওয়ায় রাজু চৌধুরীর মনে আজ আক্ষেপের জন্ম হয়েছে। তিনি ভাবলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তির অঙ্কুরিত বীজ সুশোভিত হয়ে আরো নির্মম ও হিংস্ররূপে ছড়িয়ে আছে বর্তমানেও। তারাই আজ নানা জায়গায় বোমা ফেলে অরাজকতা করছে। তাদের বংশধররা স্বাধীন দেশে এখনো যুদ্ধের সময়ের মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, যা তাকে প্রতিনিয়ত মর্মাহত ও যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত করছে। এটা ঠিক মাস্তানের গাড়িতে কেউ পেট্রলবোমা ফেলে না। কিন্তু তার মাধ্যমেই তারা প্রথম জলবোমার নাম শুনল। ফুলকথা যেন তার কল্পলোকে দেখতে পেল,সে জলবোমার স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো অজানা দেশ মানে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। হিংসা, ঘৃণা,স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা মানুষকে মানবিকতাশূন্য করে দেয়। যুদ্ধ, মারণাস্ত্র, প্রতিহিংসা এসবের মাধ্যমে পৃথিবী আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। চারিদিকে শুধু যুদ্ধ, অস্ত্রের ঝনঝনানি, আর মানুষের আর্তনাদ। মানুষের নিষ্ঠুরতা যেন আজ সবকিছুকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গল্পের অটো চালকও মানবিকতাশূন্য, হিংস্র, নিষ্ঠুর এবং বিবেকবর্জিত। তার কারণে আজ রাজু চৌধুরী এবং ফুলকথার জীবন বিপন্ন।

    উত্তরমুছুন
  15. সালমা আক্তার২৩ মে, ২০২১ এ ৮:০৬ AM

    (৭) অটোতে হঠাৎ তারা বুনো গন্ধ পেল। অটো জলে ফেলার আগে নিশ্চয়ই সেখানে কোনো বিস্ফোরক বা মানুষ মারার নিউট্রন বোমা রাখা হয়েছিল। যার বুনো ঝাঝালো গন্ধ তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। স্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও পাঠক বুনো ঝাঝালো গন্ধের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম। তারা দেখতে পেল অটো ঢাল বেয়ে নিচে নামছে আর অটোচালক সামনের দরজা খুলে নেমে গেছে। ফুলকথার কল্পনায় ধরা দিল কোনো পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে অটোতে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে জলবোমায় নিভে গেল কল্পিত বারুদের সে স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু বারুদ থেকেও বেরুচ্ছে আগুন। রাজু চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সে আগুন স্পর্শ করল না চন্ডাল মাস্তানের বোধের জগৎ। বুঝতে এতটুকু বাকি থাকে না, প্রতিশোধ স্পৃহার কারণে সে এ কাজটি করেছে। মিশন অব্যর্থ দেখে সে আনন্দ উল্লাস করে। তারপর নিরিবিলি সড়ক ধরে এগিয়ে আসতে থাকা অটোরিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে বলে, যাত্রীসহ অটো ডুবে গেছে। আত্মস্বার্থ চরিতার্থের জন্য মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নয় তার বংশধররাও এই রাজাকারদের বংশধরদের শত্রু। তাই তো শুধু রাজু চৌধুরীকে একা নয় তার বংশধরকেও সমূলে উৎপাটিত করেছে। চেতনার বারুদ নিভে গেল নব প্রযুক্তির উদ্ভাবনী কৌশল জলবোমার কাছে। সবাই জানলো দুর্ঘটনায় মারা গেছে রাজু চৌধুরী আর ফুলের মতন নাতনি ফুলকথা। সে দুর্ঘটনায় নব প্রযুক্তির উদ্ভাবনী নাম জলবোমা।

    মূলত রাজু চৌধুরীর আবেগের কারণে সেদিন তার দাদাকে ক্ষমা করায় আজ তার এবং ফুলকথার জীবনে এ নির্মম পরিণতি সাধিত হয়েছে। ক্ষমা মহৎগুণ হলেও রহমত আলীর মতো মানুষদের মায়া করে ক্ষমা করা যায় না। জলবোমার ঘটনা এ গল্পে ভাবনাবীজ হিসেবে কাজ করেছে মাত্র। কিন্তু লেখকের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় অস্তিত্বের লুপ্ত চেতনার পুনরুজ্জীবন। কিন্তু গল্প শেষে পাঠক হৃদয় যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত হয়।

    কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল 'জলবোমা' গল্পে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মানুষের সঙ্ঘশক্তির সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। গল্পের বিষয়ভাবনার কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সঙ্গজীবনাবেগ,সংগ্রামী জীবনচেতনা এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালীন বিপন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জীবনভাষ্য।

    দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অপরিমেয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মানচিত্র বাঙালি জাতির এক মহত্তম প্রাপ্তি। একজন মহৎ লেখক হিসেবে মোহিত কামাল অনুভবে সেই মানচিত্র বক্র ও সরল রেখায় অঙ্কিত কিছু ঘটনা বা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের সমষ্টি মাত্র নয়; বরং তা হয়ে ওঠে সামূহিক অস্তিত্বের বিরলদৃষ্ট সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, রক্তক্ষরণ এবং সাফল্যের চৈতন্যময় অভিব্যক্তি। পরীক্ষিত লেখকের মতো তিনি একটা প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তোজ্জ্বল চেতনার শিল্পরূপ নির্মাণ সফল করে তুলেছেন। সমগ্র জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দনকে তিনি শিল্পমণ্ডিত করে তুলেছেন গভীর জীবনীশক্তি ও শৈল্পিক নিরাসক্তিতে।

    উত্তরমুছুন