ফেরদৌস নাহার'এর গল্প: মাংসাশী



আকাশের চাঁদ, সূর্য, তারা কিংবা পাতালের জল জগতের পাহারা, বা আত্মহারা নিয়ে যত না গল্প, তারচে’ লক্ষ লক্ষ গুন বেশি মর্ত্যলোকের। গোপন গহীন প্রেম অপ্রেম, কিংবা তারও চেয়ে গভীর যন্ত্রণা নিষ্ঠুরতা ঘরের জানালা দরজা ভেদ করে, কখনওবা মাঠে ঘাটে প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে পড়ে! কী দেখে সে! 
এ-মুহূর্তে পর পর তিনজন ধর্ষণ করে যাচ্ছে। অবিরাম, একটানা। বিরতিহীন উল্লাসে তিনজনের আনন্দ তিনগুণ থেকে শতগুণ হয়ে থই থই নাচছে। এখন, অনড় অসাড় একটি মাংসের দলা পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। ওরা তিনজন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে। এ ওর দিকে তাকায়, শব্দহীন হাসে, হয়তো বাহবা বিষয়ক কিছু একটা বলতেও চায়, পারে না। কোন সুদূর থেকে একরাশ অন্ধকার এসে ঘিরে ফেলে, আপনা আপনিই কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। এই মুহূর্ত থেকে ওরা পরস্পরের চরম বন্ধু এবং হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বী।

তিনজন একসঙ্গে দেহটার কাছে ফিরে যায়। আবার কি কিছু শুরু করবে নাকি! ঠিক বোঝা যায় না। হাঁটু মুড়ে পাশে বসে, প্রথমে হাত ধরে টানে, কোনো সাড়া নেই! উলঙ্গ দেহটার গায়ে হাত রাখে, কোথাও এতটুকু উষ্ণতা নেই। হলো কী! ভালো করে উত্তাপ পরখ করে। ঠান্ডা! কী ভীষণ ঠান্ডা হয়ে গেছে! মনে হলো কতকাল দেহটি যেন বরফের নিচে চাপা পড়ে ছিল, এইমাত্র বরফ খুঁড়ে তুলে আনা হয়েছে। কী করে হলো! কখন হলো! কিছুই ঠাহর করতে পারছে না ওরা। কার দোষে এমন স্তব্ধতা নেমে এলো, তিনজনের কেউই অনুমান করতে পারে না। যে ব্যাপারটি এখন ঘটতে শুরু করেছে তা কিন্তু মাথায় ছিল না। আর ছিল না বলেই ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় প্রত্যেকে। দিশেহারা তো বটেই। মুখে না উচ্চারণ করলেও, মনে মনে পরস্পরকে দায়ী করে, এটা কী হলো!
 
মেয়েটাকে ওরা দালালকে পয়সা দিয়ে তুলে এনেছিল। বয়স ষোল সতেরোর বেশি হবে না। গরীব ঘরের সাধারণ একটি মেয়ে। মা-বাবা আছে কী নেই, কে জানে, কোথায় থাকে তাও নির্দিষ্ট করে জানে না। দালাল লাগিয়ে আগেই ঠিক করা ছিল, একটি মেয়েমানুষ চাই। দালাল হেসে জিজ্ঞেস করেছিল- এই প্রথম নাকি!

তিনজনেই প্রায় দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছিল- আরে না না…! কত বুলু ফিলিম দেখছি, কত করছি। আপনে পারবেন কিনা বলেন…

আচ্ছা আচ্ছা বলে, সায় দিয়ে পকেটে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে দালাল আশ্বাস দেয়- হয়ে যাবে, হয়ে যাবে! 
 
গার্মেন্টসের কাজ শেষ করে দলবেঁধে ঘরে ফেরে ওরা। অবশ্য একপর্যায়ে যে যার পথ নেয়, এই মেয়েটিও নিয়েছিল, শুধু জানত না তার জন্য আজ কী অপেক্ষা করে আছে! দালালের নানাবিধ প্রভাব ও ক্ষমতার কারণে, তুলে নেবার সময় তেমন কোনো ঝামেলা হয় না। বেশ সহজেই জোর করে তুলে, গাড়িতে চোখ মুখ হাত বেঁধে, সোজা নিয়ে এলো শহরতলির একটি নির্জন পোড়ো বাড়িতে। যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল তিনজন।

মেয়েটি খুব কাঁদছিল। অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল। বাঁধান খুলে দেবার পর তিনজনের হাতে পায়ে ধরে বহু অনুরোধ করেছিল, যেন তাকে ছেড়ে দেয়। প্রথমে খুব কঠিন কণ্ঠে সে তার প্রতিবাদ শুরু করলেও, আস্তে আস্তে তা নিস্তেজ হতে হতে শুধু মাত্র- আপনারা আমার ভাই, আপনারা আমার ভাই… এই এক কথা বলেই যাচ্ছিল সে। শুনে ওরা খুব বিরক্ত হয়, রেগে ওঠে,

শালা, সকলে বোন হইলে মজা দেবে কে? বলে একচোট হাসাহাসি।

তারপর মদ, রুটি, মাংসের বাজার খুলে লেগে গেল পুরো দমে। ছোট্ট একটি শরীর, তিনজন পরিপূর্ণ শক্ত-পোক্ত ক্ষুধার্ত যুবক। একের পর এক মচ্ছব চালিয়ে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। থামবে না, যেন থামবে না কোনোদিন, যেন থামার প্রশ্নই আসে না!
 
প্রিয় পাঠক, যে ঘটনাটির সঙ্গে আপনারা এখন আছেন, সেটি আশি দশকের মাঝামাঝি। মুঠো ভরে থাকা তো দূরের কথা, তখনও মোবাইল ফোন এদেশে এসে পৌঁছায়নি। হাজারো রকমের মিডিয়া চ্যানেল, ডিজিটাল ক্যামেরা! না না এসব শব্দ তখনও অচেনা। সবেধন নীলমণি ওই সরকারি একখানা টিভি চ্যানেল। তাও দূর মফস্বলগুলোতে তার ছবি পৌঁছায় না। আর পৌঁছালেই-বা কী! এসব খবর সেখানে পরিবেশিত হয় না। তাই বলে তো এসব থেমে থাকেনি। ধর্ষণ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে মনুষ্য জন্মলগ্ন থেকেই, কাজেই মানুষের জন্মের বয়সী এই বিনোদন, পুরুষের হাত-পা-জিব-দাঁত-কণ্ঠ ও নিম্নাঙ্গের ঝাঁ ঝাঁ করা আদিম গন্ধ নিয়ে ধেয়ে আসছে, ভেসে বেড়াচ্ছে…। 
 
না না কোনো অবাক হবেন না! বরং চলুন আবারও ফিরে যাই শহরতলির সেই পুরানো বাড়িটাতে। যেখানে একটি মেয়ের শরীর নিয়ে চরম মেতে উঠেছে তিনটি পুরুষ। তারপর! মেয়েটি পড়ে আছে, পড়ে আছে এবং পড়েই থাকে। নড়াচড়া, শব্দ কিছুই করছে না সে। হলো কী!
 
প্রথমজন ভয় পেয়ে পিছনে সরে যায়। নখের আঁচড়ে কেটে যাওয়া গলা শার্টের কলারে লুকাতে চেষ্টা করে। একবার আড়চোখে দ্বিতীয় ও তৃতীয়জনকে দেখে নেয়। দ্বিতীয়জন তখন অযথাই শার্টের বোতাম লাগাতে ব্যস্ত, আর তৃতীয়জন প্যান্টের চেইন পরখ করে নিশ্চিত হবার ভান করছে। এইতো সুযোগ! প্রথমজন ওখান থেকে পালাবার উপায় খোঁজে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্রের মাঝে নিজের কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা শেষবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। সে খুব দ্রুত দরজা পার হবার চেষ্টা করে। মুহূর্তে অন্য দুজন চিৎকার করে ওঠে,

দাঁড়াও! এটাকে ফেলে কোথায় পালাচ্ছো! 
 
আচমকা নিস্তব্ধতা ভাঙা এই চিৎকারে মনে হলো, মেঝের উপরে পড়ে থাকা দেহটাও বুঝি নড়ে উঠলো! প্রথমজন সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়িয়ে থাকে এবং তারপর সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, ভাই ভাই ডাকটা খুব কানে ধাক্কা দিচ্ছে। সহসা গ্রামে থাকা বিধবা মা ও একমাত্র বোনের কথা মনে পড়ে যায়। মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাতে চেষ্টা করে, পারে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে! এতক্ষণকার সমুদয় বীরত্ব শক্তি সাহস কোনো এক অজানা ব্লোটিং পেপার এসে শুষে নিতে শুরু করেছে, পা দুটি অবশ থেকে ক্রমশ আরও অবশ হয়ে আসছে। অনুভব করে, পাথরের মতো ভারী দুখানা পা যেন মেঝের সঙ্গে পেরেক দিয়ে কেউ লাগিয়ে দিয়েছে। সামনে কিংবা পিছনে কোনোদিকেই ইঞ্চি পরিমাণ নড়বার শক্তি নেই তার। আচমকা কোনো ঝড়ো বাতাসের ধাক্কাতেও পড়ে যাবার সম্ভাবনাও নেই এতটুকুন। 
 
দ্বিতীয়জন ভাবছে। ভেবে ভেবে তাৎক্ষণিক ফন্দি-ফিকিরের সন্ধানে বুদ্ধির চরকায় তেল দিতে চাইছে। কিন্তু এত বেশি ভাবনায় মাথার ভেতরটা ক্রমশ অবশ হয়ে আসতে থাকে। সে তার পারিবারিক পরিচয়ের গুরুত্বকে এসময় নতুন করে অনুভব করতে শুরু করে। সামাজিক ভাবে পিতার অবস্থান প্রতিপত্তি ও দৌরাত্ম্যর কথা মনে পড়লো। সম্প্রতি পিতা আবার রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। সামনে ইলেকশন। সেখানে পুত্রের এই অপকর্মটি জানাজানি হয়ে গেলে কতটা ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, সেটা ভেবে একধরনের অস্থিরতা বোধ করে। পাপ করার চেয়ে পাপ প্রকাশের ভয়টা যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা যেন আগে জানা ছিল না! অথচ ঘটনা ঘটাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এতসব কথা মাথাতেও আসেনি। শালা! আক্ষেপে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বিরোধীদলের অস্ত্র ও নব্য রাজনৈতিক পিতার মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ হবার চিন্তায় তার গা-হাত-পা শিরশির করতে থাকে। মাগিটা কি তাহলে মরে গিয়ে মহা-যন্ত্রণায় ফেলে দিয়ে গেল! সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। প্রথম ও তৃতীয়জন ততক্ষণে মেঝেতে বসে পড়েছে, সে-ই কেবল দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ তার মনে হলো, এই ভয়ঙ্কর মৌন সভায় সে একজন সভাপতি। আর এই অদ্ভুত সভাপতিত্বের কথা আগামীকাল চারদিকে রটে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রচণ্ড ভয় তাকে তাড়া করলো। সে পালিয়ে বাঁচার জন্য পা বাড়ালো, আর সাথে সাথে বাকি দুজন একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো, দাঁড়াও!

প্রথমজন দ্রুত উঠে আসে, পড়ে থাকা দেহটার দিকে আঙুল তুলে জোরে জোরে বলে,

এটার কোনো ব্যবস্থা না করেই এখন নিজে পালাচ্ছো?

দ্বিতীয়জন প্রতিবাদ করে, বাহ আমি একা করেছি নাকি যে আমাকেই ভাবতে হবে?

তৃতীয়জন এবার চিৎকার করে ওঠে, ভোগে ভাগ নিয়েছ আর এখন পালাতে চাচ্ছো?

দ্বিতীয়জন সে চিৎকারে আবারও কেঁপে ওঠে! তার অস্থির ছুটে চলা হঠাৎ করে চাবুক খেয়ে থমকে যায়! সে সহসা বলে ওঠে, চলো আমরা তিনজনই পালিয়ে যাই!

অন্য দু’জন অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে!

দ্বিতীয়জন বলে, কে জানবে যে এটা আমরাই করেছি।

প্রথমজন বলে ওঠে, একথা সবাই একসময় জেনে যাবে, ভুলে যেও না, দালালকে পয়সা দিয়েছ। পুলিশ যদি জানতে চায় ও-ই সব বলে দেবে! তাহলে, তাহলে...
 
তিনজনেরই মনে হতে থাকে, এতক্ষণে এই পাপগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
 
সমস্ত পরিবেশের উপরে বিরক্ত হয়ে তৃতীয়জন ডান হাত দিয়ে বাম হাতের তালুতে ঘুষি মারল। একবার! দুইবার! তিনবার! আর অন্য দুজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকে দেখছে। ওরা তিনজন বন্ধু, অর্থাৎ কিনা জানি দোস্ত। অথচ এখন পরস্পর কত অচেনা। যেন এই প্রথম পরিচয় হলো তিনজনার। যে দেহটা মাটিতে পড়ে আছে, এই কিছুক্ষণ আগেও তাকে নিয়ে নিজেদের ভেতর কত সখ্য, কত ঐক্য। যেন এই একটি বিষয়ে সাম্যবাদের চূড়ান্ত পাঠ মুখস্থ করে এসেছে তারা। কত হাসাহাসি, হাতাহাতি, মজা লুটে নেবার কী প্রচণ্ডতা! আর এখন সব কোথায় হারিয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সন্দেহ করছে, এবং চরম অবসাদগ্রস্ত অস্থিরতায় অজান্তেই পরস্পরকে তুমি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছে। এই নিষ্ঠুর খেলার অংশীদার হিসেবে ওরা নিজেরাই পরস্পরের সাক্ষী। কেউ যেন কাউকে রেখে এতটুকু ছাড় না পায় তারই চেষ্টা করছে। ছাড় পেলে তিনজনই পাবো, না পেলে কেউই না। প্রত্যেকে খুব সতর্ক হয়ে প্রত্যেককে পাহারা দিচ্ছে।
 
তৃতীয়জন সহসাই নিষ্প্রাণ দেহটার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করলো। অন্য দুজন ভয় পেয়ে যায়! বিস্ফারিত চোখে ভাবছে, আবারও কি তৃতীয়জন...! না, সে তা করে না। সমস্ত পাপ ও আগামী ভয়াবহতা মুছে ফেলার মতো অলৌকিক কিছু ঘটে যাক, এমন একটা কিছু পাবার আশায় সে হঠাৎ করে লাশের দু পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। বাকি দুজন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। তৃতীয়জন ক্ষমা চাইবার মতো করে মৃতের পা জড়িয়ে আছে। অনেকদিন পর তার স্কুল মাস্টার বাবাকে মনে পড়লো। সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না, চিৎকার করে কাঁদতেই থাকে। বাবার শেখানো দোয়া-দরূদ পড়ার চেষ্টা করলো। খুব ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে, সব কেমন তালগোল পাকিয়ে একাকার। এক পর্যায়ে লাশের পা ছেড়ে দরজার কপাট ধরে শক্ত হতে চেষ্টা করে। আর তখনই প্রথম ও দ্বিতীয়জন আচমকা চিৎকার করে দৌড়ে আসে,

দাঁড়াও পালাবে না বলছি! দরজার কাছ থেকে সরে এসো! 
 
সামনে পেছনে সজোরে লাথি খাবার মতো করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তৃতীয়জন। দরজার কপাট ধরে ঝুলতে থাকে সে। ছোট ছোট দম নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু একসময় প্রচণ্ড শ্বাস কষ্টে সেখানেই বসে পড়ে। তার মাথা বুকের কাছে ঝুঁকে আসে। 
 
রাত ক্রমশ গভীর হতে থাকে। শহর থেকে দূরে, শহরতলির এই পোড়ো বাড়িটির মাঝে যে ভয়ঙ্কর ছবি আঁকা হচ্ছে, তা আর কতক্ষণ চাপা থাকবে! তা কি এই তিনজন বাদে আর কেউই জানবে না? কী হবে তখন! একটি মৃত নারীর দেহ ও তিনজন ধর্ষক পুরুষের কাহিনি ভয়াবহ ভাবে হু হু করে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। চিত্রিত হবে কতশত দৃশ্যপট। মৃত মেয়েটির মৃত্যু ও তার পরবর্তী ব্যবস্থা নিয়ে যত না আগ্রহী হবে সবাই, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আলোচিত হবে মেয়েটির রূপ যৌবন ও দেহভোগের বর্ণনা জানতে। আর এ-ব্যাপারে কেউই ক্লান্ত হবে না। সমাজ কোরাস গেয়ে উঠবে নানা সুরে, হয়তো তিনটি পুরুষের স্পৃহা ও উত্তেজনাকে অনেকাংশেই জায়েজ করে সহানুভূতিও দেখানো হতে পারে। কারণ, মেয়ে মানুষ যেখানে, সেখানে এসব অঘটন তো ঘটবেই! এতসব ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা থাকার পরও, তিনজন ড্রাকুলা তিনজন ডাইনোসরের পাহারাদারিত্ব বজায় রেখে, পাশাপাশি অপেক্ষা করতে থাকে। 
 
রাতের অন্ধকারে সারাদিনের বদ্ধ জানালাটা খুলে দেয়া হলো। হঠাৎ একঝাঁক ঠান্ডা বাতাস এসে চোখে মুখে ঝাপটা লাগায়। ঘরের গুমোট ভাব কেটে যেতে শুরু করে। ওদের তিনজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই। এক অন্তহীন দুর্ভাবনার অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে বিবর্ণ মুখচ্ছবি ক্রমশ আরও বিবর্ণ হতে থাকে। ওরা তিনজন সিদ্ধান্তহীন বসে থাকে। ঘরের গুমোট ভারী পরিবেশ, একজন নারীর মৃত লাশ ও তিনটি কুঁচকানো পুরুষাঙ্গ পাপভারে আরও কুঁচকে প্রায় মিশে গেছে শরীরের সাথে। 
 
সব কিছুকে উপেক্ষা করে বাইরের মুক্ত বাতাস তার আপন খেয়ালে বয়ে যেতে থাকে। এভাবে আরও অনেকটা সময়, চাঁদ তখন আকাশে একাগ্র জ্যোৎস্নার আয়োজনে স্থির। বাইরে বিশাল প্রান্তর। যদিও এটাকে পোড়ো বাড়ির মাঠ বলেই ডাকে সকলে। ওরা খোলা জানালা দিয়ে মাঠের দিকে উঁকি দেয়। কেউকেই দেখা যাচ্ছে না। কেবল এক নিঃসীম অন্ধকার গুঁড়ো গুঁড়ো কালো পাউডার ছড়িয়ে দিচ্ছে সবখানে। সেই ভয়াল অথচ কী ভীষণ একাকীত্বের মাঝে প্রান্তর ডাক দেয়- আয়! চলে আয়! উন্মুক্ত আঁধার দুহাত তুলে ডাকে- আয়...আয়! 
 
সেই ডাক ওরা তিনজন ছাড়াও মৃতের কানেও পৌঁছে গেল। সেও যেন নড়ে চড়ে উঠলো। চাঁদের ঘোলা জ্যোৎস্নার জাল পৃথিবীকে আস্তে আস্তে ছেয়ে দিচ্ছে আপন মনে। মায়ারং মগ্নতা একটু একটু করে কাছে ডাকতে থাকে সবকিছুকে। যেখানে ভারী দীর্ঘশ্বাস আর জ্বলন্ত ভয় একে একে শিকলের শরীর নিয়ে পেঁচিয়ে ধরছে সমস্ত অবয়ব। যেখানে নিজেদেরকে চেনা অচেনার মাঝামাঝি অবশ কোনো অস্তিত্ব বলে মনে হচ্ছিল প্রত্যেকের। সেখানে সহসা ভয়হীন ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, একত্রে। চলে যেতে ইচ্ছে করে ওই উন্মুক্ত মাঠের দেশে। চাঁদের সঙ্গে সেই সন্ধ্যা থেকে বোঝাপড়া শুরু হয়েছে প্রকৃতির সবগুলো পর্বের। তারই হাওয়া ঢুকে পড়ে পোড়ো বাড়ির জানালা গলিয়ে ঘরের ভিতর।
 
সহসাই ওরা কেউ কাউকে কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো, এবং একই সঙ্গে শরীরের সমস্ত পোশাক একে একে খুলে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলো। তিনজোড়া চোখ কুণ্ডলী পাকানো এক নিশ্চিত নিষ্ঠুর আগুনে জ্বলতে থাকে। ওরা এখন সম্পূর্ণ উলঙ্গ। উলঙ্গ শরীরে পরস্পর কাছাকাছি আসে, তারপর পায়ে পায়ে মৃত মাংসপিণ্ডের কাছে এসে দাঁড়ায়। হাঁটু-মুড়ে বসে খুব যত্ন করে হাত ধরে টানে। না, কোনো সাড়াশব্দ নেই, তেমনই অসাড় অনড় স্তব্ধ, পড়ে আছে। এখন যেন সে আরও অনেক বেশি ঠান্ডা, অনেক বেশি শক্ত, টানলেও নড়ছে না এতটুকু। এক অন্তহীন অনিশ্চয়তার মাঝে সঁপে দিয়ে সে যেন এখন তিনজনের মজা দেখছে। 
 
ওরা হামা দিয়ে মেয়েটির মুখ দেখলো, চোখ দুটো এখনো খানিকটা খোলা বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো এতক্ষণ ধরে সবকিছু দেখেছে সে। হয়তো মনে মনে অনেক হেসেছে। হাত দিয়ে চোখের পাতা পুরোপুরি বুজিয়ে দিলো। ওরা ক্রমশ নিজেদের ভেতর থেকে নিজেরা বেরিয়ে পড়ছে। সেই আগের তিনজন অন্য তিনজন, একেবারে নতুন, অপরিচিত কেউ হয়ে উঠছে ক্রমশ। মনে হলো ভেতরের জানালা ধরে কে যেন এক অদৃশ্য নির্দেশ বয়ে এনেছে। তিনজন কেউ কাউকে না বলে, একত্রে, একই সময়ে, একই ভঙ্গিতে মাংসপিণ্ডটাকে শূন্যে উঠিয়ে, দরজা পেরিয়ে, বাইরের উন্মুক্ত মাঠের দিকে চলতে শুরু করে। কোনো কথা নেই। ওরা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে জন্ম জন্মান্তরের ভার। আহা, এত মায়া! এত প্রেম কোথা থেকে এলো! তিনজন অনেক যত্ন করে দেহটাকে কাঁধের উপরে তুলে এগুতেই থাকে। যেন কোনো রাষ্ট্রীয় শোভাযাত্রার কুচকাওয়াজে সামিল হয়েছে, মেপে মেপে পা ফেলছে। আর ওদের কাঁধের উপর চিত হয়ে আকাশমুখি দেহটা তখন, আকাশ দেখতে দেখতে এগুচ্ছে। চাঁদ আর সে আজ মুখোমুখি, চাঁদের চোখে বিস্ময়, জ্যোৎস্নাও কেঁপে কেঁপে উঠছে! মেয়েটি টানটান শুয়ে আছে তিনটি কাঁধে।
 
পৃথিবীর রাত আরও পুরানো হয়ে উঠেছে। মধ্য আকাশ থেকে চাঁদ কিছুটা হেলে পড়েছে। খুব সুন্দর আর জীবন্ত দেখাচ্ছে চারদিক। তারই আলোয় তিনটি উলঙ্গ পুরুষ মাঠের একেবারে মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। কাঁধ থেকে খুব যত্ন করে মাংসের পিণ্ডটি ঘাসের উপরে শুইয়ে দিলো। তারপর, তিনজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তার দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওদের ছায়াগুলো আড়াআড়ি মৃতদেহের উপর এসে পড়ছে। বড়ো নিঃশব্দে তিনজন এবার পরস্পরের হাত ধরে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের হাত ধরে আদিম মানুষের অনুকরণে দুলতে শুরু করলো। আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত সিটি বাজাতে বাজাতে দেহটি ঘিরে বৃত্ত রচনা করতে থাকে। তারপর কোনো এক ফিউনেরাল মন্ত্রের টানে নাচতে শুরু দেয় তারা। 
 
পোড়ো বাড়ির বিশাল মাঠে তখনো জ্যোৎস্নারা গলে গলে পড়ছে। কোটি বছরের প্রাচীন গুহাবাসীর অনুকরণে অবলীলায় নেচেই চলছে তারা। পৃথিবীর আকাশে পুরনো চাঁদ, ঘন সবুজ গাছপালা, বাতাসের অকৃত্রিম অনুদান সবকিছু সেই প্রথাগতই আছে। শুধু রাতজাগা পাখিরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটানোর শব্দ তুলে পাখা শাপটায়। আলো আঁধারি অস্থিরতার মাঝে ক্রমাগত সেইসব শব্দ একবার ভেসে ওঠে, আবার ডুবে যায়, আবার ভেসে আসে, মিলিয়ে যায়... এভাবে বারবার। আস্তে আস্তে তিনটি উলঙ্গ শরীর থেকে বন্য ঘ্রাণ বেরুতে থাকে। নাম না জানা কোনো ধুতরার বিষাক্ত পাত্রে চুমুক দিয়ে উন্মাদের মতো চক্রাকারে নেচেই চলছে তারা। আর, রাতের গভীর থেকে তিনজনের সম্মিলিত উগ্র হুইসিল তখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্‌বিদিক!


লেখক পরিচিতি:
ফেরদৌস নাহার
কবি। গল্পকার। প্রাবন্ধিক
কানাডায় থাকেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

13 মন্তব্যসমূহ

  1. স্তব্ধ করা গল্প । ঝিমিয়ে গেলাম বর্ণনার দাপটে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. ভাবালো, ভাবাচ্ছে, মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার কারণে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এক নিঃশ্বাসে লিখাটি পড়লাম আপু।
      " পাপ করার চেয়ে পাপ প্রকাশের ভয়টা যে এতো ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা আগে জানা চহিল না!"
      চরম সত্যি।

      মুছুন
  4. গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে আছি। একটা ঘোর লাগা ভয়,আক্রোশ কাজ করছে। বর্ণনার কারণে এক অন্যধারার গল্প পড়লাম। ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. পাঠ শেষে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য অশেষ ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

      মুছুন
    2. অসাধারণ বোধ, সময়ের তাপ,পূর্বপুরুষের ধারাবাহিক হিসেব,কোথাও যেন আমি,আমরা খুলছি মাংস,খুলছি পাপ।বারবার পড়েছি।

      মুছুন
    3. অসাধারণ বোধ, সময়ের তাপ,পূর্বপুরুষের ধারাবাহিক হিসেব,কোথাও যেন আমি,আমরা খুলছি মাংস,খুলছি পাপ।বারবার পড়েছি।

      মুছুন
  5. অসাধারণ বোধ, সময়ের তাপ,পূর্বপুরুষের ধারাবাহিক হিসেব,কোথাও যেন আমি,আমরা খুলছি মাংস,খুলছি পাপ।বারবার পড়েছি।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এমন চমৎকার সত্যাবদ্ধ অভিমতের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

      মুছুন