লেখক ওয়াসি আহমেদ আবিস্কৃত হন। বাজার কাটতি লেখক, যাকে আহ্লাদে "জনপ্রিয়" অভিধায় বিশেষায়িত করা যায়, যে লেখা অনেক হাত ঘুরে আপনি হাতে এসে পৌঁছেই যায়। চমকিত কিংবা বুদ্ধির তরঙ্গায়িত দোলায় ঝলকে ওঠে না,যেভাবে হাতে আসে ঠিক সেভাবেই আবার হয়তো বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়, ওয়াসি আহমেদের লেখা তার মধ্যে পড়ে না। ওয়াসি আহমেদকে অনুসন্ধান করতে হয়, খুঁজে হাতে নিতে হয়, খনি খোঁড়ার মতো সম্পদের সন্ধান করতে হয়। তাঁর সৃষ্টি সহজলভ্য নয় বরং দুর্লভ এবং খুঁড়ে বের করার পর আবিষ্কৃত হয় হীরা জহরত।
লেখক ওয়াসি আহমেদ তাঁর রচনা সমূহকে কি ট্রিটমেন্ট দিতে চেয়েছেন অর্থাৎ তাঁর লেখক সত্তার কী অভিপ্রায় ছিল কিংবা ভিন্নভাবে বললে "জনপ্রিয়" ধারার লেখা তাঁর আরাধ্য ছিলো কিনা প্রশ্নগুলো তাঁর জন্য মোটেই জরুরি নয়। তবে পাঠকের জন্য বিশেষ জরুরি এই কারণে যে ওয়াসি আহমেদকে পাঠের জন্য খুঁজে নিতে হয়। পাঠক কী উপায়ে সন্ধান পেতে পারে একজন ওয়াসি আহমেদের? উত্তরটি অমীমাংসিত রেখে কিছু দায় আমি সিরিয়াস পাঠককে দিতে চাই। ওয়াসি আহমেদকে পাঠক সকাশে তুলে ধরার দায় যতোটা লেখক ওয়াসি আহমেদের, তারচেয়ে বেশি তাঁকে আবিষ্কার করেছে এমন পাঠকের।
তাঁকে খুঁজে পাওয়া অতপর তাঁর ভাণ্ডারে আবিষ্কৃত হওয়া তাঁর সাহিত্য, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য একজন ওয়াসি আহমেদের নিজস্বতা, যাকে আমরা বলতে পারি তাঁর স্বাতন্ত্র্য। একেবারেই আলাদা এবং অন্য কণ্ঠে অনায়াস বলে যাচ্ছেন কিছু গল্প, যা মূলত গল্পের অধিক। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পর্যবেক্ষণে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মূহুর্ত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একটি নেপথালিনের গন্ধের পথ বেয়ে আসা লুকিয়ে রাখা অতীত কিংবা বাসস্ট্যান্ড এ ব্যাগের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়া হয়ে উঠে আগাম ভবিষদ্বাণী। মূলত বিষয়ে, বয়ানে, ক্রাফটে তিনি তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পে বিষয়ের অধিক অন্য বিষয় বলেন, এবং যে আঙ্গিকে বলেন আমরা পাঠক ততোটা বুদ্ধিমান হতে পারিনা যে তার গল্প বলার উদ্দেশ্যেটি শুরুতেই সনাক্ত করে ফেলতে পারবো। এতোটা সহজ পাঠ্য তিনি নন, এবং হয়তো তাই বাজার কাটতিও নন।
আমার হাতের কাছে, বইয়ের শেল্ফে টান দিতেই যে বইটি হাতে আসে "তেপান্তরের সাঁকো"। আটটি গল্পের সংকলন। প্রকাশনা ঐতিহ্য,প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০১। আজ সেটি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত।
১.খাঁচা ও অচিন পাখি,২.মেঘসাঁতার,৩.শেরশাহ ও তার অমোঘ পরিণতি, ৪.ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী,৫.অপুর ধর্মটিচার,৬.স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ,৭.আকাশমুখী,৮.তেপান্তরের সাঁকো।বইয়ে উল্লেখিত গল্পগুলোর রচনাকাল ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ কিনা আমার জানা নেই। লেখকের সাথে ব্যক্তিগত জানাশোনা নেই বলে তথ্যটি দিতে পারলাম না। কিন্তু তথ্যটি আমার জানা প্রয়োজন ছিলো তাঁর গল্পের মৌল প্রবণতা চিহ্নিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে।
অমীমাংসিত এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তাঁর স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা যায়। এই আটটি গল্প আমাদের সচকিত করে, আমরা অনেকটা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আবিষ্কার করি কাদের নিয়ে গল্প লিখছেন তিনি? কারা জুড়ে আছে তাঁর বিষয় ও নির্মাণের মনোযোগ? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা থেকে ষাড় শেরশাহ, ডলফিন গলির একদল কুকুর, একটা মুনিয়া পাখি, অদৃশ্য-অপ্রাণ গন্ধও তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠছে অবলীলায়। নির্মাণ কিংবা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মোটেই আখ্যানমুখী নন ওয়াসি আহমেদ। শুরুতে বলেছিলাম তিনি গল্পগুলোতে যা প্রকাশ্যে বলেন, মূলত তার অধিক কিছু বলতে চান অপ্রকাশ্যে। এবং সেই অপ্রকাশ্যকে আবিষ্কার করতে পারার জন্য পাঠকের কিছু প্রস্তুতি কিংবা মানস গঠন দরকার, যা হয়তো সাধারণ পাঠকের জন্য কখনো কখনো সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু এর দায় মোটেই লেখকের উপর বর্তায় না, কারণ তাঁর গল্প বলে, তিনি খুব সচেতনে বিষয় নির্বাচন করেন এবং তিনি সুস্পষ্টভাবেই তাঁর গল্পের গন্তব্য জানেন,হতে পারে তা আমার মতো কাঙ্ক্ষা ধারণ করে না,কিন্তু তা একান্তই আমার ব্যক্তি অভিপ্রায়। তিনি ভরসা করেন পাঠকের অন্তর্গত তৃষ্ণা আর অন্তর্গত আবিষ্কারের বুদ্ধিমত্তায়।
'তেপান্তরের সাঁকো' গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পের প্রতিটি গল্পই মূলত আলাদা করে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ প্রতিটি গল্পের ট্রিটমেন্ট প্রতিটি থেকে আলাদা।
প্রথম গল্প 'খাঁচা ও অচিন পাখি'র যুদ্ধাহত যে মুক্তিযোদ্ধা, পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাস আমরা তাঁর সত্যিকার নামটি তিনি প্রথমেই বলে দেননা এবং এই না বলা তাঁর কৌশল,নাম না বলার কাজটি তিনি করেন সচেতনে, এর সুযোগে তিনি অন্য অনেক কথা বলবেন বলে।
পূনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁকে পাই দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে কৌতুককর আচরণে। নাম বলায় কিংবা আচরণে সে দর্শনার্থী নয় পুরো যুদ্ধোত্তর বাস্তবতাকেই যেন আমাদের সামনে সপাট উন্মোচন করে দেয়। নেপথালিনের গন্ধের মতো মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় সমূহ যেনো মস্তিস্কের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করে আছে আর লোক সম্মুখে তা প্রদশর্নীর জন্য যখন অবমুক্ত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তখন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার আচরণের মতোই তা এক অর্থহীন উপহাসে পর্যবসিত হয়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার একেকজনকে একেক নাম বলার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা মেরুকরণকে ইঙ্গিত করে যান কৌশলে। কৌশলও এমন যে এই জার্মান ভেবে জনৈক নারীকে হিটলারের নাম বলা, কিন্তু যে নারী মূলত পোলিশ তার কাছে হিটলার নামের বীভৎস মানে বিপ্রতীপ দুই ইতিহাসকেই আমাদের স্মরণের ডোবায় ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গায়িত করে। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সুলেমান তাঁর যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হওয়া পা এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া যে হাতটির জন্য তীব্র বেদনাক্রান্ত হয়, এই হাত, এই পা যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক প্রত্যাশা আর অপ্রাপ্তির মেটাফর। আমাদের প্রত্যাশার বৃন্ত চ্যূত এক দেশ, অস্ত্র হাতে যুদ্ধের বিনিময়ে প্রত্যাশিত সকল প্রাপ্তি যেখানে অধরা, সেখানে যুদ্ধাহত সুলেমানের অভিধা হয় "বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা"।
সুলেমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্পটির যে উপসংহার টানা হয়, তা লেখকের এক ধরনের অসহায়ত্ব। যুদ্ধকে ঘিরে এই যে অপ্রাপ্তি আর হতাশার বহুমাত্রিক বিস্তার লেখক হয়তো জানেন না এর শেষ কী,তাই একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি গল্পের ইতি টানেন। মূলত এই গল্পগুলো রচনার যে সময়কাল তাতে লেখক কেন মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ও সপক্ষের সবার মধ্যেই এই অজানা ভবিষ্যতের আশংকা ক্রিয়াশীল ছিলো। কিন্তু লেখকের কাছে প্রত্যাশা থাকে তিনি কালকে অতিক্রম করে নতুন কোন সত্যের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করবেন।অত্যন্ত আমার মতো ব্যক্তি পাঠকের। কিন্তু এর উত্তরও আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এ শেষ পর্যন্ত আমারই ব্যক্তি অভিপ্রায়,লেখকের দায়িত্ব হয়তো নয়।
দ্বিতীয় গল্প 'মেঘসাঁতার' এক জটিল মনস্তত্বের গল্প। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, লড়াই-সংগ্রাম, অপ্রাপ্তি, হতাশা তাকে এক অদ্ভুত কাজে প্রবৃত্ত করে, সে আবিষ্কার করে এই অদ্ভুত কাজে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এই অদ্ভুত কাজটি তাঁকে এক অসহায় অবদমন থেকে মুক্তি দেয়। নিজেকে তার জীবনের অসহায়ত্বের পাথরভার মুক্ত তুলার মতো হালকা মনে হয়। এই ভারমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটির সে সন্ধান পায় একদিন মেয়ের জন্য ইলিশ মাছ না কিনতে পারার ঘটনা থেকে। তারপর একের পর এক ঘটনা সে ঘটাতে থাকে এবং তার কপাল বরাবর সিরসির কমে যায়। "অথচ এতো সত্যি, ভেতর থেকে কেউ তাকে দিয়ে খুব সংগোপনে, সাবধানী কায়দায় ঘটনাগুলো ঘটিয়ে চলেছে।আর ঘটনাগুলো ঘটার পরমূহুর্তেই সে অন্য মানুষ হয়ে উঠছে।" এর ধারাবাহিকতায় অতীতের সব অপমান, অপ্রাপ্তি তাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে ক্লান্ত করে এবং শেষ মূহুর্তে তাকে ছাদে নিয়ে যায় এবং আমরা নিশ্চিত হই আত্মহননের মধ্য দিয়েই হয়তো বা সে জীবনের চূড়ান্ত ভার মুক্তির দিকে যাচ্ছে। এই গল্পটিতেও লেখক মৃত্যুর মতো সমাধানহীন সমাধানে পাঠককে ছেড়ে দিয়ে লেখক মুক্তি নেন।
শেরশাহ। এর আগে বাংলা সাহিত্যে ষাড় নিয়ে এক হৃদয় বিদারক গল্প পড়ি আমরা শরৎচন্দ্রের রচনায়। গরীব গফুরের ষাড় মহেশ। ওয়াসি আহমেদের শেরশাহ পড়তে গিয়ে বারবার আমাদের মহেশের কথা মনে পড়ে। তবে এ গল্প ভিন্ন সময়ের গল্প। মহেশ কে কেন্দ্র করে তৈজস বন্ধক দেয়ার যে বাস্তবতা এই সময়ে এসে তা এন জি ও কিংবা সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বাস্তবতায় বদলে গেছে। মহেশকে ঘিরে কালের যে প্রয়োজন তার চামড়া, মাংসে সীমাবদ্ধ ছিলো, কালান্তরে শেরশাহের প্রয়োজন 'কৃত্রিম প্রজননে' উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এই নির্বাক ও নির্বোধ প্রাণীর পরিণতি কালের হিসাবে বদলায়নি, বরং একই করুণ মৃত্যুতেই শেষ হয়েছে।
এর পরের গল্প 'ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী'। যে কুকুরের ঘেউঘেউ উৎপাতে গলির মানুষ ঘুমাতে পারতো না, তখন সিটি কর্পোরেশন এক বীভৎস ভয়ংকর পদ্ধতিতে কুকুরগুলোকে তুলে নিয়ে রেহাই দিলো এলাকাবাসীকে। বহুদিন পর নির্বিঘ্ন ঘুমের নিশ্চয়তায় এলাকাবাসী যতোটা খুশি হয়, তারচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয় এই নিথর নীরবতায়ও তাদের ঘুমহীনতার কারণ আবিষ্কার করতে না পেরে। এবং তারা হতবিহবল হয়ে পড়লো এক অভ্যাসহীন জগতে নিজেদের অসহায়ত্বে। মূলত এই ঘেউঘেউ, ঘেউঘেউ করা কুকুরের দল এদের নৈমিত্তিক জীবনের অঙ্গ বৈ নয়, যাদের বিহনে তারা উপলব্ধি করলো তাদেরই অঙ্গহীনতার অপার বেদনা। এ গল্পে কুকুরের রূপকে লেখক আসলে অন্য এক গল্প আমাদের মস্তিস্কে প্রোথিত করেন। পাঠক হিসাবে আমি উপলব্ধি করি, মুক্তির অজুহাতে আমাদের জীবনাভ্যাস থেকে কী বিচ্ছিন্ন করা উচিত কী নয় প্রায়শই আমরা তা ভুলে যাই, নির্বিঘ্ন ভবিষ্যতের আশায় এক মূর্খ অন্ধত্বের অনুগামী হই এবং ধ্বংস করতে থাকি আমাদেরই আবশ্যিক সনাক্ত চিহ্ন সমূহ। উন্নতির শিখরে উঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূলত আমাদের আত্মবিস্মৃত করে।
অপুর ধর্মটিচার গল্পটি এই হিপোক্রেট সমাজ মানসের প্রতীকী গল্প। স্কুলে ধর্মশিক্ষা দেয়া হয়না বলে অপুকে ধর্মশিক্ষা দেয়ার জন্য গৃহে যে ধর্মশিক্ষক রাখা হয়, তার মাধ্যমে অপুর পরিচয় ঘটে জীবনের বিশ্বাসগত দ্বৈততাজাত ভণ্ডামীর সাথে। অবোধ শিশুর মস্তিস্কে যা প্রবিষ্ট করানো হয়,শিশু অচেতনে যে সংকটে পতিত হয় অভিভাবক শিশুটিকে তাতে ঠেলে দেয় সচেতন ভাবে। যেন পুরো একটি জাতির পরিণামের মেটাফর অপু। বিজ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর অন্ধ বিশ্বাসের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে সে দিশেহারা, প্রতারিত এবং আত্মবিশ্বাসহীন। অপুর পিতামাতা আমাদের দেশ চালনাকারী সেই ভণ্ড রাজনীতিবিদ দের প্রতীকী চরিত্র যারা নিষ্পাপ জনগণকে অপুর মতো বিভ্রান্তির চোরা গলিতে ঠেলে দেয়। অপুর ধর্মটিচার গল্পের নাম, কিন্তু ধর্মটিচারের ইউনিফর্মের আড়ালে লেখক যে বার্তা দেন, তা সচেতন ও সৎ নাগরিককে বিষাদে নিমজ্জিত করে। এটি লেখকের অত্যন্ত সুলিখিত গল্প। আগের গল্পগুলোর মতো এ গল্পে লেখক উপসংহার নিয়ে বিভ্রান্ত নন। তিনি জানেন অপুকে এই বিভ্রান্তির মধ্যেই পতিত করবেন তিনি, যে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে নিমজ্জিত পুরা জাতি।
'স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ' গল্পটি একটি বানর কিংবা একটি হনুমান কিংবা একজন মানুষ যার নাম হতে পারে সুলেমান,কিংবা হনুমান কিংবা এলেমান, যার পশ্চাদেশের গোড়ায় থাকতে পারে একটি লেজ, কিংবা সেটি হতে পারে টিউমার গল্পের উদ্দীষ্ট মোটেই তা নয়। লেখক এলেমানের সাথে পরিচিত হতে হতে কখন পৌছে যায় জাতির মহত্তম অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ন্যারোটিভে,পাঠক ঠিক সচেতনে টের পায়না। যখন টের পায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত এক জনগোষ্ঠীকে দেখতে পায় এলেমানের স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে। ফলে এলেমান নয় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক পরস্পর বিরোধী লজ্জাষ্কর ভূমিকা। এ গল্প স্বাধীন দেশের তথাকথিত স্বাধীন নাগরিককে দাঁড় করিয়ে দেয় বিবেকের মুখোমুখি।
'আকাশমুখী' গল্পে অদৃশ্য, স্পর্শ গ্রাহ্যহীন ঘ্রাণ গল্পের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। সেই ঘ্রাণ কোন সুঘ্রাণ নয়। দুর্গন্ধ তাড়িত মানুষ দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে চলে যাচ্ছে যাপনের অন্তিমে,কেননা এই দুর্গন্ধ তাদের জীবনকে সহজ যাপনযোগ্য রাখছে না। মিলি এবং হারুণ সম্মিলিত দুর্গন্ধ তাড়িত জীবনের প্রতিনিধি মাত্র। আমাদের চারপাশে প্রতিপদে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্য, অনিয়ম, বিচারহীনতা সবই আসলে এক বিকট দুর্গন্ধের মেটাফরেই ধরা দেয় এই গল্পে
বইটির নাম গল্প 'তেপান্তরের সাঁকো'। পিতা ও পুত্রের যুক্তিহীন এক অন্ধ আবেগী সম্পর্ক,যে সম্পর্কের সূত্রে পরিবার সংশ্লিষ্ট সবার অলৌকিক প্রত্যাশা জাগে বুঝি পুত্র মাহতাবের কারণে মৃত্যুঞ্জয়ী হবে কাশেম আলী খন্দকার, কিন্তু প্রকৃতি কখনোই তার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় না। এই গল্পে আমরা প্রথমবারের মতো একটি আখ্যানের সন্ধান পাই, যে আখ্যানের চরিত্রগুলি আমাদের চারপাশের চেনা জগতের এবং তাদের সমস্যা সংকটগুলিও অতি চেনা যা অনুসরণ করে গল্প এগিয়ে যায়।
এছাড়া আলোচনার শুরুতে আমরা যে ওয়াসি আহমেদ এর গল্পের মৌল প্রবণতা অনুসন্ধান করেছিলাম,তাকে উক্ত গল্পগ্রন্থের আলোকে বেশ কয়টি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়।
তাঁকে খুঁজে পাওয়া অতপর তাঁর ভাণ্ডারে আবিষ্কৃত হওয়া তাঁর সাহিত্য, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য একজন ওয়াসি আহমেদের নিজস্বতা, যাকে আমরা বলতে পারি তাঁর স্বাতন্ত্র্য। একেবারেই আলাদা এবং অন্য কণ্ঠে অনায়াস বলে যাচ্ছেন কিছু গল্প, যা মূলত গল্পের অধিক। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পর্যবেক্ষণে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মূহুর্ত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একটি নেপথালিনের গন্ধের পথ বেয়ে আসা লুকিয়ে রাখা অতীত কিংবা বাসস্ট্যান্ড এ ব্যাগের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়া হয়ে উঠে আগাম ভবিষদ্বাণী। মূলত বিষয়ে, বয়ানে, ক্রাফটে তিনি তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পে বিষয়ের অধিক অন্য বিষয় বলেন, এবং যে আঙ্গিকে বলেন আমরা পাঠক ততোটা বুদ্ধিমান হতে পারিনা যে তার গল্প বলার উদ্দেশ্যেটি শুরুতেই সনাক্ত করে ফেলতে পারবো। এতোটা সহজ পাঠ্য তিনি নন, এবং হয়তো তাই বাজার কাটতিও নন।
আমার হাতের কাছে, বইয়ের শেল্ফে টান দিতেই যে বইটি হাতে আসে "তেপান্তরের সাঁকো"। আটটি গল্পের সংকলন। প্রকাশনা ঐতিহ্য,প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০১। আজ সেটি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত।
১.খাঁচা ও অচিন পাখি,২.মেঘসাঁতার,৩.শেরশাহ ও তার অমোঘ পরিণতি, ৪.ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী,৫.অপুর ধর্মটিচার,৬.স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ,৭.আকাশমুখী,৮.তেপান্তরের সাঁকো।বইয়ে উল্লেখিত গল্পগুলোর রচনাকাল ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ কিনা আমার জানা নেই। লেখকের সাথে ব্যক্তিগত জানাশোনা নেই বলে তথ্যটি দিতে পারলাম না। কিন্তু তথ্যটি আমার জানা প্রয়োজন ছিলো তাঁর গল্পের মৌল প্রবণতা চিহ্নিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে।
অমীমাংসিত এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তাঁর স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা যায়। এই আটটি গল্প আমাদের সচকিত করে, আমরা অনেকটা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আবিষ্কার করি কাদের নিয়ে গল্প লিখছেন তিনি? কারা জুড়ে আছে তাঁর বিষয় ও নির্মাণের মনোযোগ? যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা থেকে ষাড় শেরশাহ, ডলফিন গলির একদল কুকুর, একটা মুনিয়া পাখি, অদৃশ্য-অপ্রাণ গন্ধও তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠছে অবলীলায়। নির্মাণ কিংবা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মোটেই আখ্যানমুখী নন ওয়াসি আহমেদ। শুরুতে বলেছিলাম তিনি গল্পগুলোতে যা প্রকাশ্যে বলেন, মূলত তার অধিক কিছু বলতে চান অপ্রকাশ্যে। এবং সেই অপ্রকাশ্যকে আবিষ্কার করতে পারার জন্য পাঠকের কিছু প্রস্তুতি কিংবা মানস গঠন দরকার, যা হয়তো সাধারণ পাঠকের জন্য কখনো কখনো সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু এর দায় মোটেই লেখকের উপর বর্তায় না, কারণ তাঁর গল্প বলে, তিনি খুব সচেতনে বিষয় নির্বাচন করেন এবং তিনি সুস্পষ্টভাবেই তাঁর গল্পের গন্তব্য জানেন,হতে পারে তা আমার মতো কাঙ্ক্ষা ধারণ করে না,কিন্তু তা একান্তই আমার ব্যক্তি অভিপ্রায়। তিনি ভরসা করেন পাঠকের অন্তর্গত তৃষ্ণা আর অন্তর্গত আবিষ্কারের বুদ্ধিমত্তায়।
'তেপান্তরের সাঁকো' গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পের প্রতিটি গল্পই মূলত আলাদা করে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ প্রতিটি গল্পের ট্রিটমেন্ট প্রতিটি থেকে আলাদা।
প্রথম গল্প 'খাঁচা ও অচিন পাখি'র যুদ্ধাহত যে মুক্তিযোদ্ধা, পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাস আমরা তাঁর সত্যিকার নামটি তিনি প্রথমেই বলে দেননা এবং এই না বলা তাঁর কৌশল,নাম না বলার কাজটি তিনি করেন সচেতনে, এর সুযোগে তিনি অন্য অনেক কথা বলবেন বলে।
পূনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁকে পাই দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে কৌতুককর আচরণে। নাম বলায় কিংবা আচরণে সে দর্শনার্থী নয় পুরো যুদ্ধোত্তর বাস্তবতাকেই যেন আমাদের সামনে সপাট উন্মোচন করে দেয়। নেপথালিনের গন্ধের মতো মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় সমূহ যেনো মস্তিস্কের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করে আছে আর লোক সম্মুখে তা প্রদশর্নীর জন্য যখন অবমুক্ত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তখন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার আচরণের মতোই তা এক অর্থহীন উপহাসে পর্যবসিত হয়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার একেকজনকে একেক নাম বলার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা মেরুকরণকে ইঙ্গিত করে যান কৌশলে। কৌশলও এমন যে এই জার্মান ভেবে জনৈক নারীকে হিটলারের নাম বলা, কিন্তু যে নারী মূলত পোলিশ তার কাছে হিটলার নামের বীভৎস মানে বিপ্রতীপ দুই ইতিহাসকেই আমাদের স্মরণের ডোবায় ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গায়িত করে। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সুলেমান তাঁর যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হওয়া পা এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া যে হাতটির জন্য তীব্র বেদনাক্রান্ত হয়, এই হাত, এই পা যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক প্রত্যাশা আর অপ্রাপ্তির মেটাফর। আমাদের প্রত্যাশার বৃন্ত চ্যূত এক দেশ, অস্ত্র হাতে যুদ্ধের বিনিময়ে প্রত্যাশিত সকল প্রাপ্তি যেখানে অধরা, সেখানে যুদ্ধাহত সুলেমানের অভিধা হয় "বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা"।
সুলেমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্পটির যে উপসংহার টানা হয়, তা লেখকের এক ধরনের অসহায়ত্ব। যুদ্ধকে ঘিরে এই যে অপ্রাপ্তি আর হতাশার বহুমাত্রিক বিস্তার লেখক হয়তো জানেন না এর শেষ কী,তাই একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি গল্পের ইতি টানেন। মূলত এই গল্পগুলো রচনার যে সময়কাল তাতে লেখক কেন মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ও সপক্ষের সবার মধ্যেই এই অজানা ভবিষ্যতের আশংকা ক্রিয়াশীল ছিলো। কিন্তু লেখকের কাছে প্রত্যাশা থাকে তিনি কালকে অতিক্রম করে নতুন কোন সত্যের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করবেন।অত্যন্ত আমার মতো ব্যক্তি পাঠকের। কিন্তু এর উত্তরও আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এ শেষ পর্যন্ত আমারই ব্যক্তি অভিপ্রায়,লেখকের দায়িত্ব হয়তো নয়।
দ্বিতীয় গল্প 'মেঘসাঁতার' এক জটিল মনস্তত্বের গল্প। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, লড়াই-সংগ্রাম, অপ্রাপ্তি, হতাশা তাকে এক অদ্ভুত কাজে প্রবৃত্ত করে, সে আবিষ্কার করে এই অদ্ভুত কাজে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এই অদ্ভুত কাজটি তাঁকে এক অসহায় অবদমন থেকে মুক্তি দেয়। নিজেকে তার জীবনের অসহায়ত্বের পাথরভার মুক্ত তুলার মতো হালকা মনে হয়। এই ভারমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটির সে সন্ধান পায় একদিন মেয়ের জন্য ইলিশ মাছ না কিনতে পারার ঘটনা থেকে। তারপর একের পর এক ঘটনা সে ঘটাতে থাকে এবং তার কপাল বরাবর সিরসির কমে যায়। "অথচ এতো সত্যি, ভেতর থেকে কেউ তাকে দিয়ে খুব সংগোপনে, সাবধানী কায়দায় ঘটনাগুলো ঘটিয়ে চলেছে।আর ঘটনাগুলো ঘটার পরমূহুর্তেই সে অন্য মানুষ হয়ে উঠছে।" এর ধারাবাহিকতায় অতীতের সব অপমান, অপ্রাপ্তি তাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে ক্লান্ত করে এবং শেষ মূহুর্তে তাকে ছাদে নিয়ে যায় এবং আমরা নিশ্চিত হই আত্মহননের মধ্য দিয়েই হয়তো বা সে জীবনের চূড়ান্ত ভার মুক্তির দিকে যাচ্ছে। এই গল্পটিতেও লেখক মৃত্যুর মতো সমাধানহীন সমাধানে পাঠককে ছেড়ে দিয়ে লেখক মুক্তি নেন।
শেরশাহ। এর আগে বাংলা সাহিত্যে ষাড় নিয়ে এক হৃদয় বিদারক গল্প পড়ি আমরা শরৎচন্দ্রের রচনায়। গরীব গফুরের ষাড় মহেশ। ওয়াসি আহমেদের শেরশাহ পড়তে গিয়ে বারবার আমাদের মহেশের কথা মনে পড়ে। তবে এ গল্প ভিন্ন সময়ের গল্প। মহেশ কে কেন্দ্র করে তৈজস বন্ধক দেয়ার যে বাস্তবতা এই সময়ে এসে তা এন জি ও কিংবা সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বাস্তবতায় বদলে গেছে। মহেশকে ঘিরে কালের যে প্রয়োজন তার চামড়া, মাংসে সীমাবদ্ধ ছিলো, কালান্তরে শেরশাহের প্রয়োজন 'কৃত্রিম প্রজননে' উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এই নির্বাক ও নির্বোধ প্রাণীর পরিণতি কালের হিসাবে বদলায়নি, বরং একই করুণ মৃত্যুতেই শেষ হয়েছে।
এর পরের গল্প 'ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী'। যে কুকুরের ঘেউঘেউ উৎপাতে গলির মানুষ ঘুমাতে পারতো না, তখন সিটি কর্পোরেশন এক বীভৎস ভয়ংকর পদ্ধতিতে কুকুরগুলোকে তুলে নিয়ে রেহাই দিলো এলাকাবাসীকে। বহুদিন পর নির্বিঘ্ন ঘুমের নিশ্চয়তায় এলাকাবাসী যতোটা খুশি হয়, তারচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয় এই নিথর নীরবতায়ও তাদের ঘুমহীনতার কারণ আবিষ্কার করতে না পেরে। এবং তারা হতবিহবল হয়ে পড়লো এক অভ্যাসহীন জগতে নিজেদের অসহায়ত্বে। মূলত এই ঘেউঘেউ, ঘেউঘেউ করা কুকুরের দল এদের নৈমিত্তিক জীবনের অঙ্গ বৈ নয়, যাদের বিহনে তারা উপলব্ধি করলো তাদেরই অঙ্গহীনতার অপার বেদনা। এ গল্পে কুকুরের রূপকে লেখক আসলে অন্য এক গল্প আমাদের মস্তিস্কে প্রোথিত করেন। পাঠক হিসাবে আমি উপলব্ধি করি, মুক্তির অজুহাতে আমাদের জীবনাভ্যাস থেকে কী বিচ্ছিন্ন করা উচিত কী নয় প্রায়শই আমরা তা ভুলে যাই, নির্বিঘ্ন ভবিষ্যতের আশায় এক মূর্খ অন্ধত্বের অনুগামী হই এবং ধ্বংস করতে থাকি আমাদেরই আবশ্যিক সনাক্ত চিহ্ন সমূহ। উন্নতির শিখরে উঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূলত আমাদের আত্মবিস্মৃত করে।
অপুর ধর্মটিচার গল্পটি এই হিপোক্রেট সমাজ মানসের প্রতীকী গল্প। স্কুলে ধর্মশিক্ষা দেয়া হয়না বলে অপুকে ধর্মশিক্ষা দেয়ার জন্য গৃহে যে ধর্মশিক্ষক রাখা হয়, তার মাধ্যমে অপুর পরিচয় ঘটে জীবনের বিশ্বাসগত দ্বৈততাজাত ভণ্ডামীর সাথে। অবোধ শিশুর মস্তিস্কে যা প্রবিষ্ট করানো হয়,শিশু অচেতনে যে সংকটে পতিত হয় অভিভাবক শিশুটিকে তাতে ঠেলে দেয় সচেতন ভাবে। যেন পুরো একটি জাতির পরিণামের মেটাফর অপু। বিজ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর অন্ধ বিশ্বাসের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে সে দিশেহারা, প্রতারিত এবং আত্মবিশ্বাসহীন। অপুর পিতামাতা আমাদের দেশ চালনাকারী সেই ভণ্ড রাজনীতিবিদ দের প্রতীকী চরিত্র যারা নিষ্পাপ জনগণকে অপুর মতো বিভ্রান্তির চোরা গলিতে ঠেলে দেয়। অপুর ধর্মটিচার গল্পের নাম, কিন্তু ধর্মটিচারের ইউনিফর্মের আড়ালে লেখক যে বার্তা দেন, তা সচেতন ও সৎ নাগরিককে বিষাদে নিমজ্জিত করে। এটি লেখকের অত্যন্ত সুলিখিত গল্প। আগের গল্পগুলোর মতো এ গল্পে লেখক উপসংহার নিয়ে বিভ্রান্ত নন। তিনি জানেন অপুকে এই বিভ্রান্তির মধ্যেই পতিত করবেন তিনি, যে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে নিমজ্জিত পুরা জাতি।
'স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ' গল্পটি একটি বানর কিংবা একটি হনুমান কিংবা একজন মানুষ যার নাম হতে পারে সুলেমান,কিংবা হনুমান কিংবা এলেমান, যার পশ্চাদেশের গোড়ায় থাকতে পারে একটি লেজ, কিংবা সেটি হতে পারে টিউমার গল্পের উদ্দীষ্ট মোটেই তা নয়। লেখক এলেমানের সাথে পরিচিত হতে হতে কখন পৌছে যায় জাতির মহত্তম অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ন্যারোটিভে,পাঠক ঠিক সচেতনে টের পায়না। যখন টের পায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত এক জনগোষ্ঠীকে দেখতে পায় এলেমানের স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে। ফলে এলেমান নয় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক পরস্পর বিরোধী লজ্জাষ্কর ভূমিকা। এ গল্প স্বাধীন দেশের তথাকথিত স্বাধীন নাগরিককে দাঁড় করিয়ে দেয় বিবেকের মুখোমুখি।
'আকাশমুখী' গল্পে অদৃশ্য, স্পর্শ গ্রাহ্যহীন ঘ্রাণ গল্পের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। সেই ঘ্রাণ কোন সুঘ্রাণ নয়। দুর্গন্ধ তাড়িত মানুষ দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে চলে যাচ্ছে যাপনের অন্তিমে,কেননা এই দুর্গন্ধ তাদের জীবনকে সহজ যাপনযোগ্য রাখছে না। মিলি এবং হারুণ সম্মিলিত দুর্গন্ধ তাড়িত জীবনের প্রতিনিধি মাত্র। আমাদের চারপাশে প্রতিপদে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্য, অনিয়ম, বিচারহীনতা সবই আসলে এক বিকট দুর্গন্ধের মেটাফরেই ধরা দেয় এই গল্পে
বইটির নাম গল্প 'তেপান্তরের সাঁকো'। পিতা ও পুত্রের যুক্তিহীন এক অন্ধ আবেগী সম্পর্ক,যে সম্পর্কের সূত্রে পরিবার সংশ্লিষ্ট সবার অলৌকিক প্রত্যাশা জাগে বুঝি পুত্র মাহতাবের কারণে মৃত্যুঞ্জয়ী হবে কাশেম আলী খন্দকার, কিন্তু প্রকৃতি কখনোই তার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় না। এই গল্পে আমরা প্রথমবারের মতো একটি আখ্যানের সন্ধান পাই, যে আখ্যানের চরিত্রগুলি আমাদের চারপাশের চেনা জগতের এবং তাদের সমস্যা সংকটগুলিও অতি চেনা যা অনুসরণ করে গল্প এগিয়ে যায়।
এছাড়া আলোচনার শুরুতে আমরা যে ওয়াসি আহমেদ এর গল্পের মৌল প্রবণতা অনুসন্ধান করেছিলাম,তাকে উক্ত গল্পগ্রন্থের আলোকে বেশ কয়টি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়।
আলোচ্য কোন গল্পেই তিনি আখ্যানানুসারী নয়। সচেতন ভাবেই তিনি গল্পে কোন আখ্যান নির্মাণের পথে হাঁটেন না। বরং তিনি একটি বক্তব্য, যা গল্পের মধ্য দিয়ে বলতে চান, তা বলার জন্য কিছু চরিত্রকে আশ্রয় করেন। যে চরিত্রগুলো গল্পকারের অভিপ্রায় অনুসরণ করে এবং তাদের মাধ্যমে যে তিনি বয়ান করেন সমাজ সংসারের নানা অসংগতির বহুমাত্রিক সংকট। এর জন্য তিনি সোজাসাপ্টা কোন বয়ানভংগিও নির্মাণ করেন না। দুর্গন্ধের মতো, অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার মতো, কুকুরের ঘেউঘেউ এর মতো এমন কিছু অনুষঙ্গ তিনি নির্বাচন করেন, আমরা পাঠকেরা গভীর অভিনেবেশ না দিলে অন্তর্গত সত্য আবিষ্কার করতে পারিনা। আমরা বুঝতে পারি তিনি সমাজ সংসারের অসঙ্গতিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন কিন্তু ঠিক কোন দিকটিকে তিনি ইঙ্গিত করছেন তা বুঝার জন্য আমাদের প্রবেশ করতে হয় চেতনার আরেকটু গভীরে। যে গভীরে হয়তো যে কোন পাঠক প্রবেশের সামর্থ্য রাখেন না।
তাঁর ভাষা তাঁর, ঠিক কোন শব্দের সাথে কোন শব্দ জুড়ে দিয়ে তিনি বর্ণনার ডিটেইলিং এ যাবেন এর জন্য পাঠক একেবারেই প্রস্তুত থাকেন না। তিনি প্রচলিত শব্দবন্ধ নির্বাচন না করে বরং এমন কিছু শব্দ বর্ণনায় যুক্ত করেন তা তাঁর বর্ণনাকে একান্তই ওয়াসি আহমেদের ভাষা করে রাখে এবং সেই ভাষার তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। যেমন তাঁর লেখায় "আধবুড়ো একটা লোক দুটো বানর নিয়ে রোদ গরমকে উসকে দিতে দিতে ডুগডুগিতে বলক তুলছে", "বেলকনির উপর নারকেল গাছের ঢালু পাতায় পিণ্ড পিণ্ড রোদ ঝলমলে বেলুন হয়ে ফুলছে "," ঝুপঝুপ বড় বড় ফোঁটায় লেকের কালো জল খলবল নেচে উঠবে।ছিটকানো তারারা হুমড়ি খেয়ে পাড় বেয়ে উঠতে হুটোপুটি জুড়ে দেবে।", "বিয়ে বাড়িতে মোরগপোলাও ঝাল রেজালার মো মো সৌরভে বিমোহিত অবস্থায় টেবিলে বসামাত্র মাথার ভেতরে যেন একটা ঘোড়েল পোকা পাখা ঝাপটাতে লেগে গেলো।",রিকশায় বেকায়দায় বসে বসে কিছু সময় আগে সন্ধ্যা নামা এ শহরের প্রায়ান্ধকার ভেজা বাতাসে নাহার তার বদ্ধমূল বিশ্বাসটাকে উড়ে মিলিয়ে যেতে দেখে।" এমন অসং্খ্য উপমা একান্ত ওয়াসি আহমেদের ভাষাই হয়ে ওঠে। যে বাক্যগুলো পাঠের আগে আমাদের কল্পনা জানেনা দুটো বানর কীভাবে গরম উসকে দিতে পারে কিংবা তারারা পাড় বেয়ে উঠার জন্য হুটোপুটি জুড়ে দিতে পারে। ওয়াসি আহমেদের মুন্সীয়ানা এই যে তিনি যখন বলেন, তখন তা এতোটাই বিশ্বস্ত হয়ে উঠে তাঁর বর্ণনার কৌশলে যে শব্দগুলো একেকটা ছবি হয়েই যেন সেই তপ্ত দুপুর কিংবা বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যাকে আমাদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট করে তোলে।
তাঁর গল্পের দীর্ঘ প্যারা পাঠককে ক্লান্ত করে। এই দীর্ঘ প্যারা নির্মাণ তাঁর ইচ্ছাকৃত হয়তোবা, হয়তোবা তিনি দাবি করেন পাঠকের অধিকতর মনোযোগ। কিন্তু এই দীর্ঘ প্যারায় পাঠকের মনোযোগ চ্যুতি খুব স্বাভাবিক, যা গল্পের পাঠাস্বাদন খানিক ব্যহত করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি ধারণ করেন মনেপ্রাণে। তাঁর গল্পে ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু তিনি যে সময়ে গল্পগুলো রচনা করেছেন, সেই সময়ের হতাশা তাঁর গল্পকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যা হয়তো এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় অবিশ্বাস্য ঠেকবে। কিন্তু যাঁরা সেই সময় অতিক্রম করেছেন তাঁরা জানেন, স্বাধীনতাত্তোর স্বদেশে আদর্শচ্যুত এক অন্ধকার সময়কে তিনি বিশ্বস্ততার সাথে দলিল করে রেখেছেন মাত্র। এবং সবশেষে "তেপান্তরের সাঁকো" তে ওয়াসি আহমেদ স্বতন্ত্র হয়ে থাকেন তাঁর ভিন্নতর ভাবনা বৈচিত্রের জন্য, সচেতন লেখক সত্তা এবং পাঠকের নিবিষ্টতাকে আকর্ষণ করার অসাধারণ ক্ষমতায়।
তাঁর ভাষা তাঁর, ঠিক কোন শব্দের সাথে কোন শব্দ জুড়ে দিয়ে তিনি বর্ণনার ডিটেইলিং এ যাবেন এর জন্য পাঠক একেবারেই প্রস্তুত থাকেন না। তিনি প্রচলিত শব্দবন্ধ নির্বাচন না করে বরং এমন কিছু শব্দ বর্ণনায় যুক্ত করেন তা তাঁর বর্ণনাকে একান্তই ওয়াসি আহমেদের ভাষা করে রাখে এবং সেই ভাষার তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। যেমন তাঁর লেখায় "আধবুড়ো একটা লোক দুটো বানর নিয়ে রোদ গরমকে উসকে দিতে দিতে ডুগডুগিতে বলক তুলছে", "বেলকনির উপর নারকেল গাছের ঢালু পাতায় পিণ্ড পিণ্ড রোদ ঝলমলে বেলুন হয়ে ফুলছে "," ঝুপঝুপ বড় বড় ফোঁটায় লেকের কালো জল খলবল নেচে উঠবে।ছিটকানো তারারা হুমড়ি খেয়ে পাড় বেয়ে উঠতে হুটোপুটি জুড়ে দেবে।", "বিয়ে বাড়িতে মোরগপোলাও ঝাল রেজালার মো মো সৌরভে বিমোহিত অবস্থায় টেবিলে বসামাত্র মাথার ভেতরে যেন একটা ঘোড়েল পোকা পাখা ঝাপটাতে লেগে গেলো।",রিকশায় বেকায়দায় বসে বসে কিছু সময় আগে সন্ধ্যা নামা এ শহরের প্রায়ান্ধকার ভেজা বাতাসে নাহার তার বদ্ধমূল বিশ্বাসটাকে উড়ে মিলিয়ে যেতে দেখে।" এমন অসং্খ্য উপমা একান্ত ওয়াসি আহমেদের ভাষাই হয়ে ওঠে। যে বাক্যগুলো পাঠের আগে আমাদের কল্পনা জানেনা দুটো বানর কীভাবে গরম উসকে দিতে পারে কিংবা তারারা পাড় বেয়ে উঠার জন্য হুটোপুটি জুড়ে দিতে পারে। ওয়াসি আহমেদের মুন্সীয়ানা এই যে তিনি যখন বলেন, তখন তা এতোটাই বিশ্বস্ত হয়ে উঠে তাঁর বর্ণনার কৌশলে যে শব্দগুলো একেকটা ছবি হয়েই যেন সেই তপ্ত দুপুর কিংবা বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যাকে আমাদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট করে তোলে।
তাঁর গল্পের দীর্ঘ প্যারা পাঠককে ক্লান্ত করে। এই দীর্ঘ প্যারা নির্মাণ তাঁর ইচ্ছাকৃত হয়তোবা, হয়তোবা তিনি দাবি করেন পাঠকের অধিকতর মনোযোগ। কিন্তু এই দীর্ঘ প্যারায় পাঠকের মনোযোগ চ্যুতি খুব স্বাভাবিক, যা গল্পের পাঠাস্বাদন খানিক ব্যহত করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি ধারণ করেন মনেপ্রাণে। তাঁর গল্পে ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু তিনি যে সময়ে গল্পগুলো রচনা করেছেন, সেই সময়ের হতাশা তাঁর গল্পকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যা হয়তো এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় অবিশ্বাস্য ঠেকবে। কিন্তু যাঁরা সেই সময় অতিক্রম করেছেন তাঁরা জানেন, স্বাধীনতাত্তোর স্বদেশে আদর্শচ্যুত এক অন্ধকার সময়কে তিনি বিশ্বস্ততার সাথে দলিল করে রেখেছেন মাত্র। এবং সবশেষে "তেপান্তরের সাঁকো" তে ওয়াসি আহমেদ স্বতন্ত্র হয়ে থাকেন তাঁর ভিন্নতর ভাবনা বৈচিত্রের জন্য, সচেতন লেখক সত্তা এবং পাঠকের নিবিষ্টতাকে আকর্ষণ করার অসাধারণ ক্ষমতায়।
---------------
আলোচক পরিচিতি:
রুমা মোদক
কথাসাহিত্যিক। নাট্যকার
হবিগঞ্জে থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ