ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন পড়ল বলে। রোদের হাসিতে শরীরে অস্বস্তি বাড়ে। ঘামে ভেজা বাতাস। পাড়া ঝিমোয়। সাথে এই বাড়ি। এ বাড়ির একপাশে জঙ্গল। আর এক পাশে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে কালো কড়ই। এ পারে সাদা কড়ই। শুনেছি কড়ই এর আরেক নাম শিরীষ।। গরম এলে কুচকুচে কালো কড়ই এর মাথা ছেয়ে যায় গোলাপী ফুলে। সাদা কড়ই এর ফুল গোলাপী নয়। শরীর আর ফুলের রং মিশে একাকার। গরমের বিকেলে সাদা কড়ই সব ফুল বিছিয়ে দেয় তাঁর পায়ের নীচে। মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, রাতের সমস্ত তারা এই দিনের আলোয় কড়ই তলে জমা হয়েছে।
সাদা কড়ই গাছটির মালিকানার বিষয়টি সুরাহা হতে গাছটির বয়সের সমান সময় লেগেছে। জরিনা বিবির শুরু থেকেই দাবী ছিল এই সাদা কড়ই গাছের উপর। এই বাড়ি ঘিরে অনেক গাছ। জরিনা বিবির দাবি সমস্ত গাছের উপরে। জরিনা বিবির মতে এই সব গাছ তার হাতেই লাগানো। কেউ কোনদিন তার দাবির বিরোধিতা করার খুব একটা সাহস করেনা। এর ফলাফল ভালো হয় না। জরিনা বিবির ছোট দেওর, রুস্তম আলী একবার করেছিল। উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল রুস্তম আলীর ছোট মেয়ে। সে এই কড়ই গাছটিকে বড্ড ভালোবাসে। এর সাদা ফুল তার খুব প্রিয়। প্রায়ই তাকে কড়ই গাছের তলায় বসে হাঁড়ি পাতিল খেলতে দেখা যায়। সে রুস্তম আলীর কাছে জানতে চেয়েছিল, গাছটি এখানে কে লাগিয়েছে। রুস্তম আলী গল্প শুরু করে কোথায়-কীভাবে সে গাছের চাড়াটি পায়। মেয়ে বাবার গাছ লাগানোর বীরত্বের কথা শোনে। জরিনা বিবি ধারে কাছেই ছিল। যে কেউ কোন কথা শুরু করলে সবসময় জরিনা বিবিকে ধারে কাছেই পাওয়া যায়। তাই এই বাড়ির লোকজন খুব একটা পরস্পরের সাথে কথা বলেনা। কেউ চায়না তাদের কথা জরিনা বিবি শুনতে পাক। কারণ এর ফল খুব একটা ভালো হয়না। জরিনা বিবি সব কথারই ভীষণ অন্য মানে করেন। আশফাক আলী, রুস্তম আলীর বড় ভাই দুপুরে বাড়ি এলে, জরিনা বিবি শুরু করেন তার অভিযোগ। আশফাক আলী কোন কথা বলেন না। তিনি জরিনা বিবির অভিযোগ শোনেন কী -না তাও স্পষ্ট না। তিনি ভাত খাবার সময় জরিনা বিবি পাখা নাড়েন আর বাড়ির কে কীভাবে তার প্রতি অবিচার করল তার বর্ননা করে যান। আশফাক আলী কোন শব্দ করেন না। এই ঔদাসীণতা জরিনা বিবিকে প্রথমে অধৈর্য করে তোলে। তারপর তার ক্রমাগত রাগ বাড়ে । এরপর তার গলা চড়ে। এই সবকিছুর মধ্যে আশফাক আলী তার খাওয়া শেষ করেন। জরিনা বিবি গামছা এগিয়ে দেয়। তিনি হাত মোছেন। মুখ মোছেন। নিজের ঘরে যান। পেছনে জরিনা বিবি এবং তার কথার তুবড়ি। জরিনা বিবি পানের বাটি বের করেন। আশফাক আলী সুপারি কাটেন। তার পর একটি পান খেয়ে ভাত ঘুম দেন। জরিনা বিবি রান্না ঘরে ফিরে আসেন। যেদিন রাগ বেশি হয় তার , রান্না ঘরের সমস্ত জিনিস উঠানে ছুঁড়ে ফেলেন। এই ছুঁড়ে ফেলার মধ্যেও ছন্দ আছে। তিনি একটি একটি করে ছুঁড়েন সাথে একটি একটি করে অভাব এবং অভিযোগ । কাঁসার থালি,বাটি, গ্লাস উঠানের মাটিত পড়ে ভোঁতা আওয়াজ তোলে। এই ভোঁতা আওয়াজে জরিনা বিবির আরও রাগ হয়। এরপর তিনি ভাতের হাড়ি এবং রান্না করা তরকারির হাড়ি ছুঁড়তে থাকেন। এই লঙ্কাকাণ্ডের সময়, বাড়ির সবাই চুপ থাকেন। কেউ এগিয়ে এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করেন না। বরং তার ছেলেমেয়েদের কাছে মায়ের এই আচরণ বিনোদনের খোরাক।
জরিনা বিবির ছেলে মেয়ে সাত জন। সবার বড় জন তার নিজের নয়। সে আশফাক আলীর ক্ষণস্থায়ী বিবাহ কালের একমাত্র চিহ্ন। আশফাক আলীর আগে যে একবার বিয়ে হয়েছিল, এই প্রসঙ্গ এই বাড়িতে কখনই উত্থাপিত হয়না। বাড়িতে এই ছেলের উপস্থিতি শুধু সবার প্রতিদিনকার অস্বস্তির কারণ। জরিনা বিবির নিজের ঘরের বড় ছেলে ইউনিভার্সিটি পাশ দিয়ে বাপের সাম্রাজ্যের সেনাপতি। তার সুর্যের চেয়ে বালি গরম অবস্থা। জরিনা বিবিও তাকে ঘাঁটাতে খুব একটা সাহস করেন না। এর পরের ছেলে খড়ির ঘরের এক কোণায় জায়গা করে নিয়ে সারাদিন সেখানেই পড়াশোনা করেন। সেখানে তার মায়ের চীৎকার থেকে কিছুটা রেহাই মেলে। সে জরিনা বিবির অত্যন্ত প্রিয়। শোনা যায় জরিনা বিবির পরের ছেলের মদের নেশা আছে। সে তার বাপের দোকানের পার্ট টাইম ম্যানেজার। সে দোকানে যায় দুপুর বেলা। দোকান বন্ধ করার দায়িত্ব তার। ঠিক দশটায় দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে সে সোজা চলে যায় শহরের একমাত্র শুঁড়িখানায়। সেখানকার বাঁধা খদ্দের তিনি। মাঝ রাত পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। শহর এবং বাড়ী দুটোই যখন ঘভীর ঘুম, তখন তিনি বাড়ি আসেন। জরিনা বিবি জেগেই থাকেন। তিনি ঠিক কী অবস্থায় বাড়ি পৌঁছান , তা শুধু জরিনা বিবিই জানেন। এবং জরিনা বিবি তা কারও সাথেই আলোচনা করেন না। খেয়াল করলে দেখা যায়, জরিনা বিবির আলোচনা বা গল্পের বিষয় বস্তুর ব্যপারে কিছু বাছ-বিচার মেনে চলেন। যেমন এই যে, এই বাড়িতে উঠতি বয়সী কাজের মেয়ে রাখা হয় না বা রাখলেও তারা মাস খানিক পরেই বিদায় নেন এবং জরিনা বিবিকে তার ছোট ছেলের সাথে রাগে গরগর করতে দেখা যায়, এ বিষয়ে কেউ কোনদিন কোন টুঁ শব্দ করেন না। যেন এ বাড়িতে মীনা বা রুনু কেউ কোনদিন থাকেনি। শেষ মেয়েটার বয়স ছিল বার কী তের।
এতগুলো ছেলে ছাড়াও জরিনা বিবির দুইটা মেয়েও আছে। বড় মেয়ে ছোট ঘরের দরজা এঁটে ইতিহাস মুখস্থ করেন সারদিন । মায়ের আচরণ তার কাছে লজ্জাজনক। বড় মেয়ে মনে করেন জরিনা বিবির এইসব অমার্জিত ব্যবহারের পেছনে তার মায়ের পারিবারিক ইতিহাস এবং প্রথাই দায়ী। রুস্তম আলী জরিনা বিবির পরিবারের অতীত এবং বর্তমান নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল। হাশেম মিয়ার সাথে জরিনা বিবির ছোট বোনের বিয়ের ঘটকালীটা রুস্তম আলীই করেন। রুস্তম আলী যখন ইস্ত্রী করা ছাড়া কাপড় গায়ে চড়াতেন না, সেই আমলে হাশেম মিয়া তার বন্ধু ছিলেন। জরিনা বিবি এবং তার ছানাপোনা তার নানাকে একজন প্রাক্তন দর্জি বলেই জানেন। কিন্তু রুস্তম আলীর দাবি দর্জি একসময় ভিক্ষা করতেন সেটশন পাড়ায়। ছোট মেয়ে মায়ের ভক্ত না হলেও মায়ের সব অভিযোগে তার সায় আছে। তাই তিনি মনোযোগ দিয়ে মায়ের চীৎকার শোনেন। জরিনা বেগম কোন অভিযোগ ভুলে গেলে মেয়ে তা পাশ থেকে মনে করিয়ে দেন। বাকী ছেলেরা কেউ এইসময় বাইরে থাকেন। বাড়িতে থাকলেও মায়ের চিৎকারে তাদের তেমন কিছু আসে যায়না। সবার বড় জন আশফাক আলির আগের ঘরের ছেলে। সে একবার জরিনা বিবির চীৎকার রেকর্ড করেন। এই রেকর্ড পারিবারকি আড্ডায় প্রায়ই চালানো হয়। সবাই হেসে লুটোপুটি খান। এতে জরিনা বিবিকে খুব একটা রাগ বা লজ্জা পেতে দেখা যায় না। তিনি নিজের কণ্ঠ রেকর্ডে শুনতে কিছুটা গর্বিতই বোধ করেন।
এত কাণ্ডের পরও তিনি যখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হোন , তখন জরিনা বিবির ফিটের উপক্রম হয়। ঠিক সে সময় রাবেয়া বেগম, জরিনা বিবির ছোট জা, রুস্তম আলীর স্ত্রী এগিয়ে যান। তিনি জরিনা বিবির হাত থেকে পানির জগ কিংবা মসলার কৌটা কেড়ে নিতে নিতে বলনে, "আপা এবার শান্ত হোন"। জরিনা বিবি রাবেয়াকে খুব বেশি পছন্দ করেন না। গণ্ডগোলের দুইমাস পর জরিনা বিবি রাবেয়াকে এ বাড়িতে নিয়ে আসেন রুস্তম আলীর জন্য। রাবেয়ার কোন এক দূরসম্পর্কের চাচা ছিলেন আশফাক আলীর পুরানো খদ্দের। সেই সুবাদে এ বাড়িতে তার কয়েকবার যাওয়া আসা হয়েছে। জরিনা বেগমের হাতে বানানো পান বেশ কয়েকবার তিনি মুখে পুড়েছেন। জরিনা বেগম পানের ডালায় জর্দা এবং চুন আলাদা করতে করতে জানান রুস্তম আলীর এবার স্থিতু হওয়া দরকার। চুনসহ পানের ডাঁটায় কামড় দিয়ে রাবেয়ার চাচা জরিনা বেগমের কথার সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি রাবেয়ার বাড়িতে জরিনা বেগমের প্রস্তাব নিয়ে যান। রাবেয়ার পরিবার রুস্তম আলীর বাড়ি বিষয়ে জানতে চাইলে রাবেয়ার চাচা বলেন, "খানদানী পরিবার। শুধু কথা খুব জোরে বলেন।" রাবেয়ার পরিবারে কেউ কখনো উচ্চস্বরে কথা বলে না।রাবেয়ার পরিবার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত।রাবেয়ার বড় চাচা এলাকার মাতব্বর। রাবেয়া তার বড় চাচার অতি আদরের। রাবেয়ার শ্বশুর বাড়িতে তার বড় চাচা ছাড়া কেউ তেমন আসেন না। কারণ তারা মনে করেন রাবয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনের মাথার ব্যামো আছে। ঝগড়া-ঝাটি এবং মারামারি এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
রাবেয়া রান্নার কাজে ভীষণ অপটু। ভাত-ডাল, শাক আর মাছের ঝোল করতে তার সারাবেলা যায়। তিনি স্নান সারেন বেলা পড়ে এলে। ততক্ষণে স্নানের ঘরের সামনে কোন হুড়োহুড়ি থাকেনা। অবেলায় স্নানে তার কোনদিন সর্দি-কাশি হয়নি। তারপর তিনি খেতে বসেন। রুস্তম আলী কিংবা তার ছেলেমেয়ে কেউ তখন ধারে কাছে থাকে না "এটা দাও", "সেটা কই" বলার । মেয়েটা মাঝে মাঝে সামনে বসে তার খাওয়া দেখে। মেয়েটার খাওয়া-দাওয়ায় কোন রুচি নেই। বাড়ির লোকে বলে, "ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে"। মেয়ে মনোযোগ দিয়ে মায়ের বাসি লাউয়ের ঝোল আর টকে যাওয়া ডাল দিয়ে ভাত মাখা দেখেন। এই সময় রাবেয়া তার ছোট বেলার গল্প করেন। তার সব গল্প গিয়ে শেষ হয় বাপের বাড়িতে এক সময় খাওয়া নানা বাহারি খাবারের বর্ণনায় দিয়ে। মেয়ে বুদ্ধি দেয়, রাবেয়া একটা কলসিতে সব খাবার জমা করে মাটিতে পুঁতে রাখতে পারত। তাহলে এখন মেয়ে মায়ের শৈশবের বাহারি খাবারগুলো চেখে দেখতে পারত। রাবেয়া মেয়ের কোথায় মুচকি হাসেন। কোনদিন মেয়ের জন্য মোটা দুধের সরের চা বানান কিংবা নারিকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি রাঁধেন শুধুই মেয়ের জন্য। দুধ কিংবা নারিকেলের যোগান রুস্তম আলী কিংবা ছেলেদের পাত পর্যন্ত যেতে পারেনা। রাবেয়ার খাওয়া হয়ে গেলে কোন বই নিয়ে বসেন কিংবা কোন সেলাই। সাদা কাপড়ে বাহারি রঙে লিখেন , "ভুলো না আমায়"। পাড়ায় তার হাতের কাজের সুনাম আছে। তাই প্রায়ই কেউ আবদার করে উলের পুতুল কিংবা কাপড় কেটে বাহারি ফুলের তোড়ার জন্য। রাবেয়া আনন্দের সাথেই সবার আবদার রাখেন।
রুস্তম আলী জরিনা বিবিকে পছন্দ করেন না। এর অবশ্য কারণ আছে। রুস্তম আলীর আশা ছিল সারা জীবন বড় ভাইয়ের কাঁধে চড়েই জীবনটা পার করে দিবেন । তার এই পরিকল্পনা জরিনা বিবির পছন্দ হয়নি। রাবেয়া এই বাড়িতে আসার পরদিন থেকেই জরিনা বিবির অভিযোগ বাড়ে। সেটা চীৎকারে পরিণত হলে রাবেয়া রুস্তম আলীকে বলেন, "চলেন আলাদা হয়ে যাই"। পরদিন বাড়ির পেছন দরজা পাড়ি দিয়ে আঙ্গিনার বাইরে ছোট এক চালাঘর উঠে। সেখানে একটা ভাতের পাতিল, একটা কড়াই আর চ্যাপটা তরকারির পাতিল নিয়ে রাবেয়া আলাদা রান্নাঘর শুরু হয়। হাড়ি-পাতিল আলাদা হলেও রুস্তম আলী তার বউ-বাচ্চা সহ বাড়ির পশ্চিমের ঘরটি দখল করে থাকেন। রুস্তম আলী জরিনা বিবির সংসারে আগাছার মত। তিনি ভেবেছিলন একটা বউ জুটিয়ে দিলে হয়ত আপদ বিদায় হবে। কিন্তু তার পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি। জরিনা বিবি এবং রুস্তম আলীর মধ্যে সেই থেকে কথাবার্তা বন্ধ। সুযোগ পেলেই রুস্তম আলী জরিনা বিবির অন্যায় দখল দারিত্যের কথা মনে করিয়ে দেন। এই মনে করানো যেন ফুটন্ত কড়াইয়ে পানির ছিটার মত। জরিনা বিবি প্রথমে এই সংসারে তার অবদানের তালিকা পড়েন। তালিকা পড়তে পড়তে তার গলা চড়ে। তারপর কান্নার সাথে বিলাপ শুরু হয়। সেদিন তিনি রাতের খাবের স্পর্শ করেন না। নিজের বিছানায় শুয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। সবার খাওয়া হয়ে গেলে, বাড়ি ঝিমোলে, রাবেয়া জরিনা বিবির পাশে গিয়ে বসেন, "আপা হইছে এইবার উঠেন"। জরিনা বিবি অবশেষে উঠেন এবং পরেরদিন লোক জোগাড় করে সাদা কড়ই গাছটি কেটে ফেলেন। দুই জন কাঠমিস্ত্রী এই বাড়িতে এক মাস কাজ করেন। তারা সাদা কড়ই কাঠ দিয়ে কালো বাদামী রঙের আলমিরা তৈরি করেন জরিনা বিবির শোবার ঘরের জন্য। আর এক টুকরো কাঠ দিয়ে তারা চমৎকার শক্ত রুলার তৈরি করে দেন রুস্তম আলীর মেয়ের স্কুলের জন্য। সেই রুলার দিয়ে রুস্তম আলীর মেঝ ছেলে তার ছোট বোনকে সকালবেলা বেধরড়ক পেটায়।
এই বাড়ির পেছন দিকটা জংগল। সারি সারি নারকেল গাছ জঙ্গলের এক পাশের সীমানার কাজ করছে। বছরে এক বার কী দুইবার গাছি আসে। সে আসে এই ভাদ্র-আশ্বিনের দিকেই। লুঙ্গি কাছা দেয়া। কাঁধে ঝোলানো মোটা হাত পাকানো দড়ি। হাতে শান দেয়া নতুন চাঁদের মত বাঁকানো কাঁচি। তাঁর উর্ধাঙ্গে কোন কাপড় নেই, আছে পেটানো পেট এবং বুকের পেশী। গাছি এসে জরিনা বিবির খোঁজ করে। কারণ, এই নারিকেল গাছের মালিকও জরিনা বিবি। বেশ কিছুক্ষণ দরদামের বাহানা হয়। নির্দিষ্ট একটা দামে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না। এই সময় রুস্তম আলীর মেয়ের প্রিয় সময়। গাছি নারকেল গাছ কেটে পরিষ্কার করলে একপাশে পাতার পাহাড় জমে। রুস্তম আলীর মেয়ে এই পাহাড়ে চড়ে বসে থাকেন। বাড়ির বউ-ঝি রা পাতা কেটে বেত তোলেন। সেই বেত দিয়ে বছরের উঠান ঝাড়ু, বিছানার ঝাড়ু বানানো হয়। কেউ কেউ রুস্তম আলীর মেয়েকে নারিকেলের পাতা দিয়ে ঘড়ি বানিয়ে দেন। মেয়ে সারাদিন সেই পাতার ঘড়ি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। গাছি কিছু ডাব আর নারিকেল জরিনা বিবিকে দিয়ে যান। জরিনা বিবি সেখানে থেকে সবচেয়ে কম বলিষ্ঠ সবুজ ডাবটি রুস্তম আলীর মেয়ের জন্য বাছাই করেন। এই মেয়ে সারাসময় গাছির এবং জরিনাবিবির চারপাশে ঘোরার ফোলে একটি কচি ডাব তার কপালে জোটে। সে ডাবের পানি, নরম শ্বাঁস, কুড়ানো নারকেল- সবই তার প্রিয়। তার ভাগের ডাবে সমসময় শ্বাঁস থাকেনা। সে অপেক্ষা করে নারকেলে জন্য। রাবেয়া সারাদিন বেত তোলে জরিনা বিবির কাছ থেকে একটি ছোট নারিকেল পায়। সন্ধ্যার পর সেই নারিকেল কুড়াতে বসেন রাবেয়া। মেয়ে সামনে বসে থাকে। বরফ কুচির মত সাদা নারিকেল জমা হয় এলুমিনুয়ামের বাটিতে। মেয়ের সংযম অসীম। ঐ বরফ কুচির মত সাদা নারিকেল তার মুখে পোড়ার ইচ্ছা থাকলেও সে তা সংবরণ করে। কারণ সে জানে কুড়ানো শেষ হয়ে গেলে আর্চিতে কিছু কুড়ানো নারিকেল তাকে দেয়া হবে। এরপর রাবেয়া চাল ভাজতে বসেন। মেয়ে শিল-পাটা প্রস্তুত করেন। চাল পিষে গুঁড়া করার দায়িত্ব সে মনের আনন্দেই পালন করে। ভাজা চালের গুঁড়া প্রস্তুত হলে, রাবেয়া মেয়েকে পাঠান গুড় আনতে। সেই গুড়, ভাজা চালের গুঁড়া আর কুড়ানো নারকেল একসাথে মাখানো হয়। মাঝে মাঝে রাবেয়া মেয়েকেও মাখাতে দেন। হয়ত তিন-চারদিন পর এই একটি খাবারই রাবেয়ার মেয়ে মুখে তোলে। মেয়ের তৃপ্ত মুখ দেখতে রাবেয়ার ভালো লাগে।
এই বাড়িতে সবার আগে ঘুম থেকে জাগেন জরিনা বেগম। তিনি তিনটায় উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। তারপর তসবি নিয়ে বসেন ফজর পর্যন্ত। ফজরের পরের কিছুক্ষণ কোরাআন শরীফের পাতা উলটান। তারপর তসবি নিয়ে উঠানে নামেন। ডানদিকে রুস্তম আলীর ঘরের দরজায় একবার তাকান। এ ঘরের লোকজন তারমত কাকভোরে উঠে আল্লাহ-খোদার নাম নেয়না। আজকে এদের দরজাটা একটু ফাঁক করা। রুস্তম আলী এত সকালে আজ দোকানে? তিনি তসবি জপেন হাঁটতে হাঁটতে। পশ্চিমমুখি হাঁটেন পরিষ্কার নারিকেল গাছগুলি আরেকবার দেখবেন বলে। কিছু একটা পড়ে আছে স্তূপ করা নারিকেলের পাতার পাশে। আরেকটু সামনে এগুলে দেখা যায় তা রাবেয়ার মেয়ের জামা। জামার নীচে দলা দলা রক্তের স্তূপ। মেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই ফেল ফেল করে। জরিনা বিবি শক্ত করে তসবি চেপে ধরেন। পারলে যেন তসবির গোঁটা দুই আঙ্গুল দিয়ে থ্যাঁতলে ফেলবেন। মেয়ে কিছু বিড়বিড় করে তার বড় আম্মার দিকে তাকিয়ে। জরিনা বিবি তার বড় আম্মা। জরিনা বিবি যেন নড়তে ভুলে যান। তসবি আরও জোরে জঁপেন। ওখানে এইভাবে কতক্ষণ ছিলেন কে জানে। তার হুঁশ হয় যখন বুঝতে পারেন মেয়ের শুকনো, রক্তাক্ত , ফুলে যাওয়া ঠোঁট আর নড়া চড়া করছে না। জরিনা বিবি ওখানে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকেন তবুও। যখন একটা পিঁপড়া মেয়েটির আলতোভাবে ফাঁক করা ঠোঁটের কোণা দিয়ে ভিতরে যাওয়ার দুঃসাহস করছে, তখন জরিনা বিবি নড়েন। কখন তিনি রাবেয়ার পাক ঘরের সামনে এসে দাঁড়ান, তা নিজেও জানেননা। রাবেয়াকে নাম ধরে ডাকতে চান, কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ উঠেনা। রাবেয়া কল থেকে পানি নিয়ে এদিকেই আসছিলেন। রাবেয়া জরিনা বিবির মুখ দেখেই টের পান কিছু একটা হয়েছে যা নিয়ে কথা বলা বারণ। জরিনা বিবি হাঁটা শুরু করেন। রাবেয়া তাকে অনুসরণ করেন। রাবেয়ার এইসব কিছুই মুখস্থ। এইভাবেই এ বাড়ি চলে। এটাই জরিনা বিবির নিয়ম।
1 মন্তব্যসমূহ
বরাবরের মতোই অসাধারণ আপু। আরো লিখবেন।
উত্তরমুছুন