দেবর্ষি সারগী'র গল্প : আত্মহত্যা



হত্যা করবে বলে মুখ বেঁধে শ্যামকে নদীর ধারে নিয়ে এল দীনু ও নারান। চারপাশে গাঢ় ভোর। জলের কাছে নেমে গিয়ে আছড়ে কাদায় শুইয়ে দিল। তারপর পিঠের ওপর হাতদুটো তুলে মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। মুখে তো গামছা বাঁধা ছিল প্রথম থেকেই। নারান ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে দেখে নিল গিঁটটা শক্ত আছে কিনা। গিঁট খুব শক্তই ছিল, তবু সে আরও দুটো গিঁট কষল। তারপর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কোমর ও পাছা ওপরের দিকে তুলে শ্যামকে বসিয়ে দিল। অনেকটা নামাজের ভঙ্গিতে।

শ্যাম কোনও ব্যাপারে বাধা দেয়নি। বাধা দেবার শক্তি তার রোগা ও দুর্বল শরীরে ছিল না। ওভাবে বসার সময় শুধু দুবার ডানদিকে গড়িয়ে পড়ে। দুবারই নারান তার পিঠ ও কোমরে কাদা মাখা পা দিয়ে জোরে লাথি কষায়।

শ্যাম চুপচাপ বসে। মাথা কাদায়। হাতদুটো পিঠের ওপর উঁচু করে বাঁধা। মুখ বাঁধা। কাদা থেকে উড়ে এসে কয়েকটা বড় বড় মাছি তার ঘাড় ও মুখের কাছে ভনভন করতে লাগল। পায়ের গোছ খুব চুলকোচ্ছিল। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই।

দীনু ও নারান ওপরে উঠে এসে একটা গাছের গোড়ায় বসল। বিড়ি ধরাল। তারিণী না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। তারিণী কোদাল আনবে। মেরে নদীর ধারেই গর্ত করে শ্যামকে পুঁতে ফেলা হবে। তাই কোদাল দরকার। তারিণীর নিজের কোদাল নেই। অন্য কারও কাছ থেকে চেয়ে আনার কথা। কুড়োলটা নারান সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। ওটা তার নিজের।

তারিণীটা দেরি করছে! নারান অস্থির হয়ে বলল। তাই তো দেখছি। দীনু বলল। আস্তে, ধীরেসুস্থে। তাড়াহুড়ো, অস্থিরতা তার স্বভাবে কম। তাকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখে বিষাদ। বিষাদ বাড়লে কাজ তো দূরের কথা, শরীরটাকে একটু নড়াতেও তার ইচ্ছে করে না। এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে। মাথার মধ্যে ঝিম। মানুষ যে কেন বেঁচে থাকে তখন বসে বসে সমাধান করার চেষ্টা করে।

ওটা ছাড়া দীনু খুব শক্তিশালী পুরুষ। বুকে দুর্জয় সাহস। খুন করার ভাবনা এলে একটুও ঘাবড়ায় না।
আসুক, ধীরেসুস্থে। দীনু আবার বলল। সকাল হতে অনেক বাকি।

শ্যাম একবার মাথাটা কাদা থেকে একটু উঁচু করে (কারণ বেশি উঁচু করার উপায় নেই) জোরে জোরে ঝাঁকাল। মাছিগুলো খুব বিরক্ত করছিল।
নারান সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে আবার কাদায় রাখল শ্যাম। আগের মতো।

বর্ষার ভোর। গত তিনদিন অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে। আজ ভোরের দিকে থেমে যায়। তারা ভাবে আজ আর বৃষ্টি হয়ত হবে না। কিন্তু হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল।

খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে, সাদা স্বচ্ছ পর্দার ভেতর দিয়ে দেখা যায় শ্যাম কাদায় মাথা ঠেকিয়ে অনড় বসে। দীনু ও নারান গাছের গোড়ায়। নারান উঠে গাছের বাঁদিকে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে লাগল। বৃষ্টির ছাটে পাখিরা নড়েচড়ে বসল। এই গাছের ওপরে একটা কাকের বাসা। দুটো ছানা মায়ের কোল ঘেঁষে সরে এল। মা কাক বিরক্ত হয়ে চোখ খোলে, এবং আবছা দেখতে পায় দূরে নদীর জলের কাছে একটা মানুষ অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে। এক মুহূর্তের জন্য একটু অবাক হল কাকটা। ভাল করে তাকিয়ে বুঝল লোকটা জ্যান্ত, শব নয়। আর একটু পরে উড়বে, আর একটু ঘুমিয়ে। চোখ বুজে কাকটা ভাবছিল। বর্ষার ভোর। সহজে ঘুম ভাঙতে চায় না।

যা বৃষ্টি নামল, তারিণী যদি না আসে? নারান বলল। অস্থিরতায় তার মাথার ভেতর দপদপ করছে।

দীনু উত্তর দিল না। কথা বলতে তার ইচ্ছে করছে না। সে ঈষৎ ঢুলুঢুলু, অসুস্থ চোখ মেলে দূরে তাকিয়ে। বৃষ্টির আবরণের ভেতর দিয়ে শ্যামের আবছা শরীর দেখে তার মনে হচ্ছে ওটা যেন একটা গর্ত, কিংবা কোনও অতিকায় জন্তুর ধুসর চোখ। নাকি কোনও দুঃস্বপ্নে দেখা রাস্তার অস্পষ্ট বাঁক। ওটা কি এমন কোনও ছায়া, যার মানুষটাকে দেখা যায় না।

কী হল? নারান কোনও জবাব না পেয়ে ক্ষুব্ধ। তারিণী না এলে কী করবা?

দীনু চুপ করে থাকে। কথা আসছেই না মুখে। আস্তে আস্তে বলে, তাহলে জলে ভাসিয়ে দাও। মুণ্ডুটা কেটে। তাহলে কেউ চিনতে পারবে না।

তোমার কি মাথা খারাপ? নারান উত্তেজিত হয়ে বলল। ওর বউ চিনতে পারবে না? মেয়ে চিনতে পারবে না?

শ্যাম হঠাৎ মাথাটা কাদা থেকে ওপরে তোলে, হয়ত একটু খাড়া হয়ে বসতে চায়। কিন্তু তা না করে বাঁ-গালটা কাদায় রেখে আগের মতো থাকল। এতে শ্বাসপ্রশ্বাসে আগের চেয়ে সুবিধে হল। বাঁদিকে নদী, নদীতে ভরাট জল, বৃষ্টির ফোঁটা যার শৃঙ্খলাপূর্ণ তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে দিচ্ছে। বউ ও মেয়ের জন্য তার খুব কষ্ট হতে লাগল। বউয়ের তো বয়স বেশি নয়, শ্যাম ভাবছিল, সে কি আবার বিয়ে করে নেবে। নাকি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবে। ভাল রাঁধত, চিবুকের ঠিক মাঝখানে একটা তিল, লাল শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায়। বিয়ের প্রথম প্রথম সকালে উঠে একদিন আপনমনে গান গাইছিল, সে শুনে ফেলে, আর তারপর থেকে বউয়ের কী লজ্জা! শত অনুনয়েও আর গান গায়নি। সে বাড়ি না থাকলে হয়ত গায়। মাঝেমাঝে বউয়ের বুকের নিচে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকলে এমন নিশ্চিন্ত লাগত যে মনে হত জগতে কোথাও এখন ভূমিকম্প হচ্ছে না। কোথাও আগুন লাগেনি। এখন কাজ ও অভাবের দুশ্চিন্তা নেই। পরম শান্তি। মাটির নিচের অন্ধ নিশ্চল তৃপ্ত পোকা যেন। হয়ত আবার বিয়ে করবে, বা বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবে। আবার বিয়ে করে নেওয়াই ভাল, বয়স তো বেশি নয়, চিবুকের ঠিক মাঝখানে অত সুন্দর তিল, লাল শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায়। বউকে অনেকেই পছন্দ করবে। কিন্তু পুতুলের কী হবে, পুতুলের কী হবে, পুতুলের কী হবে! মেয়ের কথা মনে পড়তেই শ্যাম দরদর করে কেঁদে ফেলল। কান্নার চাপে মাথাটা একটু ঝাঁকানি খেল। দূর থেকে তা দেখে নারানের মনে হল হারামজাদাটা বড় বেশি নড়ানড়ি করছে, পাছায় গিয়ে একটা লাথি কষানো উচিত। কাদা থেকে কপাল তুলে শ্যাম যখন বাঁ-গাল মাটিতে রেখেছিল, তখনই নারান খেপে যায়। কিন্তু এত বৃষ্টির জন্য তার নেমে যেতে ইচ্ছে করেনি।

কুড়োলটা নিয়ে গর্ত করে নেব? তারিণী মনে হয় আসবে না। নারান দীনুকে জিজ্ঞেস করে। এখনও ভোর, হাতে অনেক সময়, কিন্তু তার আর তর সইছিল ।
দীনু উত্তর না দিয়ে স্থির চোখে জলের দিকে তাকিয়ে।

শ্যামের কান্না বেগ মানছিল না। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। এবং বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গালে চোখের জলের তাপটা অনুভব করতে পারছিল। পুতুলের কী হবে। পুতুলের ঠোঁটের নিচে সাত বছরের মিষ্টি চিবুক। ওর মাথায় সাত বছরের চুল। চোখে সাত বছরের চাউনি। ওর সাত বছরের শ্যামলা নরম পায়ের পাতায় পরশু আলতা মাখিয়ে দিয়েছিল। আলতা একটু বেশিই লাগিয়ে ফেলে, ফলে পুতুল উঠে দাঁড়িয়ে মাটির দাওয়ার ওপর পা ফেলতেই পায়ের ছাপ। দাওয়ায় সাত বছরের ছোট ছোট পায়ের ছাপ। আস্তে আস্তে মাটি শুষে নিল পায়ের ছাপগুলো, কিন্তু থেকে গেল তার মনে। জগৎ থেকে জিনিস একে একে হারায় কিন্তু কারও মনে থেকে যায়। একদিন জগতটাই হয়ত হারিয়ে যাবে কিন্তু টিকে থাকবে কারও মনে। বউ যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয় তবে পুতুলের কী হবে। ওর নতুন বর কি পুতুলের দায়িত্বও স্বীকার করে নেবে। আস্তে আস্তে বড় হবে পুতুল, একদিন বিয়েও হবে। মা হবে, বুড়ি হবে, নাতিনাতনিরা জন্মাবে, তারাও বড় হবে। তখন কি কেউ জানবে তাদের দাদুকে এক বর্ষার ভোরে, এভাবে বসিয়ে, পাঠাবলি দেবার মতো করে হত্যা করা হয়। যদি কারও মনেও পড়ে, তবে সে কি তার জন্য কষ্ট পাবে। তা হয় নাকি, শ্যাম ভাবছিল। পঞ্চাশ বা একশো বছর আগে তার কোনও পূর্বপুরুষ কীভাবে মারা যায় সেও জানে না। জানলেও ওটা ভেবে সে এখন কষ্ট পেত না। এখন, মরার সময়, সে নিজেও বা কতক্ষণ আর কষ্ট পাবে। ওরা বৃষ্টির জন্যই বোধহয় দেরি করছে। খুব বৃষ্টি। পিঠের ওপর, ঘাড়ের ওপর, মাথার চুলে শব্দ করে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু পায়ের গোছ খুব চুলকোচ্ছে, হাঁটুতে ব্যথা। বৃষ্টি শুরু হতে মাছিগুলো পালিয়েছিল, ভিজতে ভিজতে আবার একটা এল। পেটের তলায় নাভির কাছে হাঁটছে। ওখানে বৃষ্টির ছাট নেই।

হারামিকে বলেছিলাম রাতেই কোদালটা জোগাড় করে রাখতে। তা গা করল না । নারান বলল। বলে আবার উঠে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে লাগল।

হাতদুটো বাঁধা না থাকলে পায়ের গোছটা একটু চুলকে নেওয়া যেত, শ্যাম ভাবছিল। ওরা বৃষ্টির জন্যই বোধহয় দেরি করছে। নদীর জলটা খুব বেড়েছে, ছোটবেলায় এখানে মাছ ধরত। চান করত। বউ ও পুতুল এখনও ঘুমিয়ে। বাঁপায়ের গোছটা ডান পা দিয়ে চুলকে নেবে নাকি। সেটা সম্ভব। কিন্তু নড়লেই হয়ত ওরা ছুটে আসবে, পিঠে লাথি কষাবে। ওরা কী ভাবছে কে জানে। বৃষ্টির জন্যই হয়ত দেরি করছে।

শ্যাম আর পারছিল না। ঘাড় ও শিরদাঁড়ায় তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। সে হঠাৎ পাদুটো সোজা করে মাটিতে শুয়ে পড়ল, তারপর ডান পাটা বাঁ-পায়ের ওপর জোরে জোরে ঘষতে লাগল।

এই হারামি, এই শুয়োরের বাচ্চা! নারান গাছতলা থেকে চেঁচিয়ে ওঠে। নামাজ করে থাক, নামাজ করে থাক। কুড়োলটা দিয়ে একেবারেতিন টুকরো করে দেব তোকে। ভাল চাস তো নড়িস না। যেমন রেখে এসেছিলাম তেমনি চুপ করে থাক। নড়লেই কোপ বসাব।

শ্যামের হঠাৎ মনে হল নড়লে নারান সত্যি এক্ষুনি ছুটে এসে কুড়োলর কোপ বসিয়ে দিতে পারে। তাই সে আবার আগের মতো উঠে বসল। তারপর ভাবল ওরা দেরি করছে কেন।

বৃষ্টি পড়ছে। কাকটা কয়েকবার ডাক ছাড়ে, তারপর উড়ে যায়। ছানাদুটোর মন খারাপ হয়ে গেল। তাদের হয়ত ইচ্ছে করছিল আজ এমন বৃষ্টির ভোরে মা বাসাতেই থাক। ঠোঁক ফাঁক করে তারা হাঁ করল, ঠোঁটের গহবরে গোলাপি রঙ, ওই রঙে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে থাকল।

শ্যাম ততক্ষণে এক মুহূর্তের জন্য পায়ের গোছ চুলকে নিয়েছিল। হাঁটুর ব্যথা এক মুহূর্তের জন্য একটু কমল। পেটের নিচে নাভির কাছে হাঁটতে থাকা মাছিটাও উড়ে গেল। শ্যামের আগের চেয়ে একটু স্বস্তি লাগছে। আসলে মরার কথা ভেবে খুব বেশি আতঙ্কিত হয়ে তো লাভ নেই, সে ভাবছিল। ওরা আজ মারবেই। কিন্তু দেরি করছে কেন। আবার মরতে যখন হবেই তখন নারানের কথায় ভয় পাচ্ছে কেন। নারান চেঁচাতেই সে কেন আবার আগের মতো উঠে বসল। বেপরোয়া হয়ে যেমন খুশি শুয়ে থাকতে পারত। কিন্তু নারান তাতে ছুটে এসে খুব জোরে লাথি কষাত। ওই লাথিকেই ওর ভয়। মরতে আর ভয় পায় না, কিন্তু নারানের প্রচণ্ড লাথিকে ভয়, ওরা দেরি করছে কেন। রক্তে জায়গাটা খুব লাল হয়ে যাবে। বৃষ্টির জলে ধুতে ধুতে গোলাপি হবে, তারপর ক্রমশ ফিকে গোলাপি, তারপর সাদা জলের মতো হয়ে জলে মিশে যাবে। পুতুলের পাদুটো আলতায় একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিল। মাটির দাওয়ার ওপর ছোট ছোট লাল পা, মাটিতে বেশিক্ষণ ছিল , কিন্তু তার মনের ভেতর আছে। পুতুল!

শ্যামের আবার ইচ্ছে করল মাটিতে শুয়ে পড়তে। বৃষ্টি পড়ছে।

ওকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? যা বৃষ্টি! বিষাদগ্রস্ত দীনু হঠাৎ বলে। বিষাদ এবং বৃষ্টি তাকে যেন একটা ভারি পাথর করে দিয়েছে। আজ তার একটুও নড়তে ইচ্ছে করছে না।

কী পাগলের মতো বকছ? নারান আশ্চর্য হয়ে বলল। তার হঠাৎ ইচ্ছে করল কুড়োলটা দিয়ে আগে দীনুকেই শেষ করে দেয়। ছেড়ে দিলে আর কখনও সুযোগ পাবা?

দীনু চুপ করে থাকে। তার মাথার ভেতর মাইলের পর মাইল ফাঁকা মরুভূমি। একটা বুড়ো অনড় সাপ বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে। যেন শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেও ওটার ইচ্ছে করছে না।

দীনু হঠাৎ অদ্ভুত হাসে, যেমন ঘুমন্ত মানুষ এক মুহূর্তের জন্য আপনমনে হাসে। বলল, ছেড়ে দিয়েও মারা যায়। ছাড়া পেয়ে ও যখন বাড়ির দিকে হাঁটবে তখন পেছন থেকে হঠাৎ কুড়োলের কোপ।

কুপ কুপ কুপ কুপ। কোনও গাছে বসে একটা পাখি ডাকছে। তারও ওড়ার সময় হয়ে এল। বৃষ্টি বোধহয় একটু কমেছে কিন্তু ভোর ভাবটা এখনও আগের মতো। এখনও ভোর। এখন পৃথিবীর কোথাও একজন ক্লান্ত সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, নলখাগড়ার বনের ভেতর দিয়ে, কাদা ও জলাশয় মাড়িয়ে, লোহার চেয়েও ভারি বুট ঠেলে ঠেলে তাঁবুর দিকে ফিরছে। বিশ্রাম নেবে। সারারাত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছে, এবং সে একাই বেশ কিছু শত্রুকে গুলি করে মেরেছে। একবার রাইফেলটা তার ঘাড় থেকে পিছলে কাদায় পড়ে গেল। ক্লান্ত সৈনিক ওটা তুলে নিতে নিতে ভাবছে যাদের সে মারল, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তারা একদিন আপনিই মারা যেত। তাহলে তার কৃতিত্বটা কোথায়। গুহা থেকে বেরিয়ে একটা সিংহ আড়মোড়া ভাঙার পর, হাই তোলার পর হঠাৎ দেখে সামনে একটা হরিণশিশু। সিংহটার বুক ধক করে উঠল। হরিণটা এত কাছে যে তার ঠোঁটের গন্ধও নাকে এসে লাগছে। হয়ত গত সন্ধেয় দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, সিংহটা ভাবল। হরিণটার একটা পা ভেঙে গিয়েছে, সে দেখল। তারপর মুগ্ধ হয়ে দেখল খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা বড় প্রজাপতির মতো করে ওটা ভোরের কুয়াশা মাখা সবুজ গাছপালার ভেতর হেঁটে গেল এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরে হরিণটাকে একপাল হায়েনা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে। এই মুহূর্তে প্রাচীন শহরের গভীর অলিগলির ভেতর একজন দার্শনিক প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। জগতকে পালটানোর চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জগতের কিছু মৌল বৈশিষ্ট্য ঠিকমতো বুঝে নেওয়া। পেছনে পেছনে হটছে তার কিছু প্রিয় শিষ্য। একজন শিষ্য এক রাজার প্রসঙ্গ তুলে বলল ওই রাজা যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। তারপর অহিংস ধর্ম প্রচার করে জগদ্বিখ্যাত হয়। দার্শনিক তন্ময় হল। ওখানে এখন বৃষ্টি হচ্ছে না, চারপাশে ভোরের আলো। শিষ্যরা পাশাপাশি হাঁটছে। সবাই চুপ। দার্শনিক বলল তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ হত্যাকে রোধ করার জন্য হত্যা দরকার। কিছু মানুষ হত্যাকারী হয়ে ওঠে বলেই অধিকাংশ মানুষ মানবিক থাকে। জগতের প্রতিটি হত্যা অন্যদের একটু মানবিক করে দিয়ে যায়। এই নিষ্ঠুর নিয়ম ছাড়া যে মানুষ মানবিক হত না। কাকটা বাসায় ফিরে এল। ঠোঁটে খাবার। শ্যাম আর পারছিল না, তার আবার ইচ্ছে করল পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তে। বৃষ্টি আরও বাড়ল। দীনু আধবোজা চোখে ঝিমোচ্ছ।

নাঃ, আর দেরি করা ঠিক না! বলে নারান পেচ্ছাব করতে উঠল।
আর একটু দাঁড়াও, দীনু বলে। তারিণী আসবেই। ও কথার খেলাপ করে না ।

তবে এত দেরি করছে কেন হারামিটা? নারান অধৈর্য হয়ে দূরে তাকায়। দুপাশে ঘন গাছপালা জঙ্গল। কোথাও রাস্তা নেই। কারণ নদীর এ অঞ্চলে কেউ আসে না।

ভয় পেয়ে লাভ নেই, শ্যাম ভাবছিল, ওরা আজ মারবেই। তবে এত দেরি করছে কেন। মৃত্যু যখন একেবারে অবধারিত, কোনওভাবে ওটা যখন এড়াবার আর রাস্তা নেই, তখন মন আপনিই শান্ত হয়ে যায়। তখন মনে হয় যত তাড়াতাড়ি মৃত্যুটা আসে তত ভাল। ডান কানটার মধ্যে কি কোনও পোকা ঢুকে গেল, কানের ভেতর ফরফর করছে কেন, ভেতরে কি কোনও পোকা ঢুকে গেল। এক্ষুনি উঠে বসে মাথা ঝাঁকানো দরকার। থেমেছে। আর ফরফর করছে না। হয়ত জল ঢুকেছে। উঠে দৌড় লাগিয়ে লাভ নেই। অত শক্তি শরীরে নেই। কয়েক লাফেই নারান ধরে ফেলবে। তারপর হয়ত খেপে গিয়ে কুড়োলটা দিয়ে পাদুটোই প্রথমে কেটে দিল, এবং প্রাণে মারল হয়ত অনেক পরে। যার মৃত্যু অবধারিত সে যদি শেষ মুহূর্তে ওরকম বোকামি না করে তবে অনেক শান্তিতে মরতে পারে। মৃত্যুর মুহুর্তে বোকামি করতে নেই। কতক্ষণ আর ব্যথা পাবে। ধড় থেকে মুণ্ডুটা বিচ্ছিন্ন হতে কতক্ষণ লাগে। একটা কোপই যথেষ্ট। একটা বিদ্যুতের চমকানি। একটা বাজের পতন। এক মুহূর্তের জন্য সাপের লিকলিকে জিভ দেখা। তারপর তো শুধু ধড়টা ছটফট করবে, গড়াগড়ি খাবে, পাদুটো থিরথির করে কাঁপতে থাকবে। কিন্তু যন্ত্রণা নেই। মুণ্ডুকাটা ধড় যন্ত্রণা পায় না। ছটফট করতে থাকা ধড়টাকে যদি গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দেয় তবু কিছু যায় আসে না। ধড় যন্ত্রণা পাবে না। জল পড়ে পড়ে নদীর জল ক্রমে বাড়ছে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে লাভ নেই। হাতদুটো বাঁধা, সাঁতার কাটতে পারবে না। যদি কোনও হৃদয়বান ইঁদুর চুপিচুপি বাঁধনগুলো কেটে দিত!

কেউ আসছেনা? নারান কান খাড়া করে শুনতে শুনতে বলল। কারও পায়ের শব্দ পাচ্ছ?
দীনু উত্তর দিল না।

তাহলেও সে কী করতে পারত, শ্যাম ভাবছিল। যদি কোনও হৃদয়বান ইঁদুর চুপিচুপি হাতের বাঁধনগুলো কেটে দিত, তাহলেও সে কী করত। জলে ঝাঁপ দিয়ে ডুবসাঁতার দিতে দিতে পালিয়ে যেত? কিন্তু বেশিক্ষণ সাঁতার দিতে পারত না, শরীর দুর্বল, মনের জোরও নেই। নারান ধরে ফেলত। সাঁতার দীনুও খুব ভাল জানে। যদি এরকম হত যে জলে ঝাঁপ দিয়ে আর উঠলই না, জলের মধ্যেই তলিয়ে গেল? ওদের হাতে কুড়োলের কোপ খেয়ে মরার চেয়ে সেটা ভাল হত। কিন্তু সে যে সাঁতার জানে! সাঁতার জানে! যে সাঁতার জানে সে ইচ্ছে করে জলে ডুবে মরতে পারে না। আর একটা উপায় অবশ্য ছিল। কোনও হৃদয়বান ইঁদুর যদি চুপিচুপি হাতের বাঁধন কেটে দিত, তবে সে এখান থেকে উঠে চুপিচুপি গাছটার তলায় চলে যেত। দীনু ঝিমোচ্ছ। নারান পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তে কুড়োলটা নিঃশব্দে হাতে তুলে নিয়ে একটা কোপ দীনুর মাথায়, আর একটা নারানের ঘাড়ে। দুজনের রক্তে খুব লাল হয়ে যেত জায়গাটা। ঢালু জমি দিয়ে রক্ত গড়াত, তারপর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গোলাপি হত, ক্রমে খুব ফিকে গোলাপি, তারপর জলের মতো সাদা হয়ে জলে মিশে যেত। মাটির দালানে ছোট ছোট লাল পা। দালানে আর নেই কিন্তু মনের ভেতর আছে। তারপর? দীনু ও নারানকে হত্যা করে সে না হয় বাঁচল। কিন্তু তারপর? বউকে আর কখনও নিশ্চিন্ত মনে ভালবাসতে পারত? ওর বুকের অন্ধকারে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকলে আর কখনও মনে হত যে কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে না? পুতুলকে কখনও নিশ্চিন্ত মনে ভালবাসতে পারত? পুতুল কি ঘুম থেকে উঠেছে? কী করছে? তখন বাতাসের শব্দ শুনে ভয় পেত। আয়নায় নিজের মুখ দেখলে ভয় পেত। নির্জন দুপুরে মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় নিজের ছায়া দেখে ভয় পেত। সামনের দিকে তাকিয়ে আর হাঁটতে পারত না, কারণ শুধু মনে হত পেছনে কেউ অনুসরণ করছে। হত্যা করার পর থেকে হত্যাকারীকে আজীবন পেছনদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়। কিন্তু আর যে এভাবে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না, ওরা দেরি করছে কেন। বৃষ্টি আর সহ্য হচ্ছে না। গায়ে বোধহয় খুব জ্বর। শিরদাঁড়া ছিঁড়ে যাচ্ছে। পিঠের ওপর বাঁধা হাতদুটোয় কোনও সাড়া নেই। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। বউ আর পুতুল কি ঘুম থেকে উঠল। ওরা এখন কী করছে। তাকে খুঁজছে?

শ্যাম হঠাৎ পা প্রসারিত করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নারান দৌড়ে নেমে গেল।
নামাজ করে বোস, নামাজ করে বোস। ওঠ শুয়োরের বাচ্চা।

শ্যামের মুখ গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধা। কোথাও একটা ছাগল তারস্বরে চেঁচায়। শ্যাম মনে মনে বলল, এক্ষুনি বসছি। মাত্র দু-মিনিট গো। পা আর শিরদাঁড়া একেবারে ছিঁড়ে যাচ্ছে।

কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না? তোর এত বড় আস্পর্ধা? বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে বলে নারান আরও রেগে গেল। শ্যামের পাঁজরে খুব জোরে লাথি মেরে বলল, কেমন লাগছে এখন?

শ্যাম মনে মনে জানাল, খুব কষ্ট লাগছে। পাঁজর মনে হয় ভেঙে গেল নারান। এরকম লাথি মারা কি সত্যি তোমার দরকার? কুড়োলটা দিয়ে ঘাড়ে কোপ বসালেই তো পারো। তোমরা দেরি করছ কেন।

লাথি খেয়ে শ্যামের নাকমুখ কাদার মধ্যে থুবড়ে গেল। পাদুটো নাড়িয়ে, আঙুল বাঁকিয়ে সে পাঁজরের ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছিল। উঠে আগের মতো বসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাঁটু ভেঙে, শিরদাড়া বাঁকিয়ে একটু সোজা হতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আবার চেষ্টা করতে লাগল।

বৃষ্টি পড়ছে। নারান বুঝল শ্যাম আর আগের মতো বসতে পারবে না। এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করল সে। ক্রোধে দিশেহারা হয়ে গেল। হঠাৎ উপলব্ধি করল বেয়াদব প্রজা সামনে দাঁড়ালে সম্রাটরা কেন টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার হুকুম দেয়। যতক্ষণ না ঘাড়ে কোপ পড়ছে ততক্ষণ শ্যাম ওরকম নামাজের ভঙ্গিতে বসে থাকবে—এই হুকুম দিয়ে নারান আশ্চর্য তৃপ্তি পেয়েছিল। এখন খুব অপমানিত লাগছে তার।

দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি! বলে সে ছুটে গেল গাছটার দিকে, যেখানে দীনু ঝিমগ্রস্ত আধবোজা চোখ মেলে কল্পনায় জীবন নামক উদ্ভট রসিকতার মদ খেয়ে চলেছে। এবং যেখানে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা আছে কুড়োলটা।

কুড়োল ধরতেই নারান দেখতে পেল তারিণী আসছে। হাতে কোদাল। কুপ কুপ কুপ কুপ। কোনও গাছে বসে পাখিটা ডেকে যায়।

বললাম না, তারিণী আসবেই? দীনু খুশি হয়ে বলল। ও কথার খেলাপ কর না।

তারিণী হাসল। বসন্তের দাগ ভরা মুখ। দাঁত একটু বড় বলে দেখায় যেন সব সময় হাসছে। দূর থেকে শ্যামকে দেখে সে খুশি হল। আয়োজনের সবটাই সারা, শুধু তার জন্যই অপেক্ষা করা হচ্ছিল, এটা ভেবে তারিণীর ভাল লাগল।

যা বৃষ্টি না! তারিণী একটু ঢঙ করে বলল।

খুব, দীনু বলল। একবার ভাবলাম ছেড়ে দি। এমন বৃষ্টির দিনে নড়তে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ছাড়া কি যায়। আমি অত বোকা নাকি! আর দেরি কেন? কোদালটা নিয়ে মাটি কোপাও, মাটি কোপাও! অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে।

অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে, আর ভোর নেই। পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়ে গিয়েছে। শুধু বাচ্চারা আছে। মুখের লাল গহবর ওপরে তুলে কাকের বাচ্চাগুলো মাঝেমাঝে বৃষ্টির জল খাচ্ছে।

ধুব! কোদালের প্রথম কোপটা মাটিতে পড়ল এবং কেঁপে উঠল যেন পৃথিবীর বুকের শাঁসটা। শুয়ে থাকা শ্যাম ঘাড় উঁচু করে দেখল তারিণীই গর্ত খুঁড়ছে। তারা দেরি কেন করছিল সে এতক্ষণে বুঝল। নারান গর্ত থেকে মাটি বাইরে ফেলছে। দীনু পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে। সে একবার বলল পাঁচ হাত লম্বা গর্ত খুঁড়তে। তারপর বলল লম্বায় তিন হাত হলেও চলবে, কারণ মাটির ভেতর মড়াকে শোয়বার দরকার নেই, বসিয়ে রাখা হবে। গর্তটা শুধু গভীরতায় যেন পাঁচ হাত হয়।

এখনও বলছি নামাজ করে বোস। মাটি তুলতে তুলতে নারান হঠাৎ শ্যামকে বলে।

শ্যাম পা জড়ো করে পিঠ বাঁকিয়ে ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। আরও কয়েকবার চেষ্টা করে সে আগের মতো উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল। ধুব ধুব ধুব, কোদালের কোপ পড়ছে। শুয়ে থাকা অবস্থায় শ্যাম শুধু কোদালের ওঠানামা এবং তারিণীর ফাঁক করা দুটো স্থির পা দেখতে পাচ্ছে। কারও মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। তবে কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিল। মুখ তুলে সে নদীর জলের দিকে ফেরাল, বৃষ্টির ফোঁটায় শৃঙ্খলাবদ্ধ তরঙ্গগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। এরা সবাই বেঁচে থাকবে, সে ভাবছিল। শুধু সে-ই বেঁচে থাকবে না। এরা হয়ত অনেকদিন বাঁচবে, বুড়ো বয়স পর্যন্ত, তার আগে মরবে না। শীতে রোদ পোয়াবে। বর্ষার রাতে বউদের বুকের তলায় মুখ গুঁজে পরম তৃপ্তিতে শুয়ে থাকবে। মেয়ের জন্য মেলা থেকে নাকছাবি কিনে আনবে। মাঝেমাঝে একটা বড় ইলিশ হাতে বাড়ি ফিরবে। নাতিনাতনিকে ঘাড়ে বসিয়ে তাকিয়ে থাকবে রথের চুড়োর দিকে, যার পতাকা আজকাল কাগজের বা টিনের পাতের না হয়ে দামি রেশমের হয়। কাশফুল দেখবে। বিজয়ার রাতে একে অপরের মুখে একটা নারকোলের নাড় জোর করে পুরে দেবে। গাঁয়ের সবচেয়ে বড়লোক ঘনশ্যাম শিকদারের নতুন তোলা পাকা বাড়িটার হলুদ রঙ যতবার দেখবে ততবারই আশ্চর্য হবে। ভাববে সত্যিকারের মাখন না মেশালে ওরকম রঙ তৈরি হতেই পারে না। খোলের বাজনা শুনে আনমনা হবে। দুপুরে দাওয়ায় বসে পাকা চুল ভোলাবে, ওই সময় ঘুঘুও ডাকে। বাঁশের খুঁটি একটু চিরে মাসে অন্তত একটা আধুলি ফেলবে। রেলগাড়ির জানলায় বসে বিকেলের সিঁদুরে মেঘের ভেসে যাওয়া দেখবে। মেঘগুলো পালটাতে পালটাতে একবার না একবার প্রত্যেকের বুড়ি মায়ের মুখের মতো হবেই। গরমের দিনে মাঝেমাঝে চিনিপাতা দই খাবে। নির্জন সন্ধেয় হাঁটতে হাঁটতে কখনও একপলক বড় দিঘিটার দিকে তাকাবে, ওর জল তখন কালো ও রহস্যময়। আর মেয়ের পাজোড়ায় কখনও কখনও মাখিয়ে দেবে আলতা। দাওয়ার মাটিতে ছোট ছোট পা। লাল লাল পা।

গর্ত খোঁড়া শেষ হয়ে এসেছিল। তারিণী কোদাল মারা বন্ধ করল।

বেঁচে থেকে ওরা এসবই করবে, শ্যাম ভাবছিল। এবং বেঁচে থাকলে সেও তো তাই করত। কিংবা উলটোভাবে বলা যায়, বেঁচে থাকলে সে যা যা করত, ওরাও তো তাই করবে। ভাবনাটা শ্যামের মনকে হঠাৎ একটা দুর্বোধ্য, বেদনার্ত, অথচ প্রগাঢ় ভালবাসার উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন করে দিল। সে স্পষ্ট করে কিছু বুঝতে পারল না। ঠিক হল ঘাড়ে নয়, গলায় কোপ মারা হবে। শ্যামকে চিৎ করে ওলটানো হল। দীনু ও তারিণী একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। নারান যখন শ্যামের মাথার কাছে এসে কুড়োলটা উঁচু করে ধরে, শ্যাম গামছা বাঁধা মুখের ভেতর দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে চাইল, নারান থামো থামো! নিজেকে হত্যা কেন করছ গো?


লেখক পরিচিতি
দেবর্ষি সারগী
কথাসাহিত্যিক। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
কলকাতায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসামান্য
    -অলোকপর্ণা

    উত্তরমুছুন
  2. বেঁচে থাকাটা কেন জরুরি এই গল্পের মধ্যে দিয়ে সেটা যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

    -নিলয় নন্দী

    উত্তরমুছুন