ওয়াসি আহমেদ এর গল্পবিশ্ব : সময় ও বৈচিত্র্যের অন্বেষণ- শামসুল কিবরিয়া


বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছোটগল্প নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিষয় নির্ধারণে বৈচিত্র্যের সাথে উপস্থাপন ভঙ্গিতেও এই পরিবর্তন লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি গল্প বলার যে প্রথাগত কায়দা রয়েছে তা-ও অনেক লেখক অনুসরণ করছেন। এ সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার ওয়াসি আহমেদ। তিনি যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে যাননি তেমনি প্রথাগত কায়দায়ও গল্প বলেন নি।

ওয়াসি আহমেদ গল্প বলার একটি নিজস্ব কৌশল তৈরি করে নিয়েছেন। গল্প বলতে গিয়ে বেশি রাখঢাক তিনি করেন না। চট করে বলে ফেলেন। চরিত্রগুলোও অনায়াসে নির্মিত হয়ে যায় তাঁর হাতে। বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি গল্প রচনা করেছেন। এসব গল্পের বিষয় এবং চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশে তাকালেই পাওয়া যাবে। ওয়াসি আহমেদ তার সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী শক্তির মাধ্যমে সেগুলো শৈল্পিকভাবে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় হয়তো আমরা সেগুলো দেখি না বা দেখলেও না দেখার ভান করি বা ততোটা গুরুত্ব দেই না।

‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের নির্বিকার প্রকৃতির লোকমান হাকিম, ‘নখদর্পন’ গল্পের কবিরাজ, ‘যোদ্ধা’ গল্পের পুলিশের হাতে ধৃত সন্তানের অসহায় মা-বাবা, ‘তীরভূমি’ গল্পের আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখা এক পরিবার- আমাদের আশেপাশেই এরা বসবাস করে। ওয়াসি আহমেদ এদেরকে আমাদের ভাবনার অন্দরমহলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে আমাদের চেনা মানুষদেরই দেখি আরো নিবিষ্টভাবে।

ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে ‘ডলফিন গলি’র গল্প শোনান। ধানমণ্ডির আশেপাশে কোন এক জায়গায় তিনি এ গলি তৈরি করে নিয়েছেন। এ পরিবেশে গড়ে তুলেছেন বিচিত্র বৈশিষ্ট্যধারী চরিত্রদের। তাদের দিনযাপনের বিবিধ পীড়া, সুখ ও দুঃখ পাঠকের সামনে হাজির হয় বিবিধ ব্যঞ্জনায়।‘ডলফিন গলির কুকুর বাহিনী’র গল্প যখন তিনি আমাদেরকে বলেন তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি যে নির্মমভাবে একটি কুকুর মেরে ফেলার মাধ্যমে কি নিপুণভাবে মানবচরিত্রের একটি নেতিবাচক দিককে পাঠকের ভাবনার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এ গল্পের শেষদিকে এসে যখন পাঠ করি “আসলে ট্রাকে চড়ে বিদায় হওয়ার সময় কুকুর বাহিনীর সাথে ডলফিন গলিবাসীদের কিছু কিছু অসাবধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও যে চালান হয়ে গিয়েছিল, তারা তখন খেয়াল করেনি। তারা মুক্তির কথা ভেবেই হাঁফ ছেড়েছেল” তখন পাঠক হিসেবে আমাদের চিন্তা-জগতে গল্পের টেক্সট এর ভেতরের কথাটি এসে যায়। রূপকের আড়ালে স্পষ্টভাবে বলে দিলেন মানুষের ক্রম-নির্মম হয়ে ওঠার কথা।

এরপর ডলফিন গলির ভেতর রচিত হয় ‘গর্তসন্ধান’ গল্পটি যেখানে এক দুধওয়ালাকে স্থানীয় জনতা দুধে পানি মেশানোর অপরাধে নির্মমভাবে পেটায়। এত পিটুনি খেয়েও সে নির্বিকার থাকে। এটাও একটি উল্লেখযোগ্য দিক এ গল্পে। এ গলিতে আরো দেখা যায় ‘শিঙা বাজাবে ইস্রাফিল’ গল্পের ঘটনা ঘটতে। এ গল্পে এক অচেনা শব্দে একটি সাততলা বাড়ি আচমকা ধ্বসে পড়ে। এলাকার লোকজন এর কোন কূলকিনারা করতে পারে না। যদিও পরে এসে কিছু জট খুলে যায়।

ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন, স্বৈরশাসনের আমলে নির্বিচারে মানুষ হত্যার কথা বলেন, বলেন দেশভাগের যন্ত্রণার কথা। এছাড়া পুলিশের নির্মমতা, মানুষের বিবিধ মানসিক যাতনা, মানুষের অবমূল্যায়ন, স্বপ্ন পূরণ না হওয়া জনিত কষ্টের কথা বলেন। তাঁর গল্প পড়তে পড়তে আরও দেখি উদ্ভট স্বপ্নসমূহ মানুষকে কীভাবে তাড়া করে, দেখি অর্থনীতির আপাত উন্নয়নের তলায় কীভাবে সীমাহীন আঁধার লুকিয়ে আছে, দেখি দরিদ্র জনগণের বিপদ উত্তরণের উপায় হিসেবে তাবিজ-কবচের আশ্রয় নেয়, দেখি ধর্ষণের নির্মমতা। হিজরাদের জীবন যাপন এবং মনস্তত্ত্বও তার গল্পের বিষয় হয়ে এসেছে। এছাড়া নারী সহকর্মীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, মানুষের সুবিধাবাদী আচরণ ইত্যাদিও তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন। আখতারুজ্জমান ইলিয়াস এর পা অপারেশন এর ঘটনা নিয়েও একটি গল্প লিখেছেন তিনি। এ গল্পে ইলিয়াস এর জীবনের একটি বেদনাবহ সময়কে মর্মস্পর্শী করে তোলে ধরা হয়েছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ওয়াসি আহমেদ এর গল্পে বিষয়-বৈচিত্র্য রয়েছে। এ কথা বলা যায় যে জীবনের নানাদিকে দৃষ্টি দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছেন তিনি। এখানে এসে আবার তার তীক্ষ পর্যবেক্ষণী এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা উল্লেখ করতে হয়। আপাতসরল বিষয়ে তিনি গভীরভাবে ডুব দিয়েছেন। সূত্রধর হয়ে আমাদের কাছে ধরিয়ে দিয়েছেন এমনসব বিষয়কে যা আমরা স্বাভাবিকভাবে এত গুরুত্ব দিয়ে কখনও খেয়াল করতাম না। যেমন ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের লোকমান হাকিম অফিসে ভালো-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন তাতে তার কোন বিকার নাই। সে সবকিছু পাশে সরিয়ে রেখে নির্বিবাদে লাঞ্চ টাইমে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়, অফিস ছুটির সময়েই সে কোনদিকে কোন খেয়াল না করে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ এখানকার ভালো-মন্দ কিছুতেই তার সংস্রব নাই। আবার ‘মেঘসাঁতার’ গল্পের মূল চরিত্র ‘অফিসে, সংসারে দুই জায়গায়ই সে নির্বিবাদী’, ‘মিস নমিতা’ গল্পের নমিতা নামধারী তরুণীর গৃহকর্মী থেকে পোশাককর্মী হয়ে ওঠা, ‘পরিবেশবাদী’ গল্পের অবস্থা অনুযায়ী রূপ পরিবর্তনকারী ব্যক্তির নোংরামি; ‘খর দুপুর’ গল্পের পুলিশের মনোযাতনা যেখানে একপর্যায়ে সে তার সাথে থাকা আসামির দুঃখবোধের কাছাকাছি চলে আসে।

ওয়াসি আহমেদ তাঁর গল্পগুলোতে যেসব মানুষদের ফোকাস করেছেন তাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন-যাপনকারী। শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই তারা কখনো মানসিক যাতনা ভোগকারী, কখনো পিতৃভক্তি এবং পুত্রবাৎসল্যের মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটানো, কখনো আমেরিকার মতো দেশে বসবাস করার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যাওয়ার কারণে কল্পসুখে থাকা, কখনো স্বপ্নভঙ্গ, কখনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলা, কখনো স্বামী সন্তান হারিয়ে বয়স্ক শ্বশুরকে আঁকড়ে ধরে জীবনে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনসংশ্লিষ্ট এ বিষয়গুলো তাঁর গল্পে এসেছে।

মধ্যবিত্ত মানুষ যেন একটি ঘোরের ভেতর বসবাস করে। টিকে থাকার বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করে। ইচ্ছে থাকলেও তার উপরে ওঠার সুযোগ কম আবার তার অবস্থান থেকে নিচেও নেমে আসতে পারে না। এ টানাপোড়েনের কারণে মানসিক যাতনা তার জীবনেরই অংশ হয়ে যায়। এসবের প্রভাবে তার যৌক্তিক আচরণ কখনো কখনো লোপ পেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে মানসিক বিকারের কবলে পড়ে। এ বিকার প্রবণতাকে ওয়াসি আহমেদ এর গল্পে প্রায়শই দেখা যায়।

অবশ্য এ কথা বলার সুয়োগ নাই যে নিম্নবিত্তের মানুষেরা তার গল্পে আসেনি। যোদ্ধা, খরদুপুর, শেরশাহ ও অমোঘ পরিণতি, মিস নমিতা, লাইলি সুন্দরী ও জীবন যাপনের রূপকথা, আরজু যা বুঝতে চেয়েছিল,বক ও বাঁশফুল প্রভৃতি গল্পে এ শ্রেণিভুক্ত মানুষদের দেখা যায়। তারা কখনো ভয়াবহ প্রতারণার শিকার, কখনো নির্মমতার শিকার হয়ে গল্পে হাজির হয়েছে।

তবে ওয়াসি আহমেদ এর মনোযোগ মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রতি। এজন্যই হয়তো তার বেশিরভাগ গল্পই গড়ে উঠেছে শহরের প্রেক্ষাপটে। কেননা এদের বসবাস মূলত শহরেই। নির্বিকার চাকরিজীবী, তার উপর বিরক্ত হয়ে তাকে ধাওয়া করে মারতে আসা তারই অপর সহকর্মী, কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করা যুবতী, উদ্ভট স্বপ্ন দেখা যুবতী, বনসাইয়ের মতো ছোট হয়ে যাওয়া যুবক, স্বপ্নে আত্মহত্যা করতে দেখা সাংবাদিক, নিজেকে গুমের শিকার বলে মনে করা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সাবেক অ্যাকাউন্টস অফিসার, এরা সকলেই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তজীবন যাপন করে।

অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজন এদেরকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত করলেও এদের সংকটের মূল কারণ অর্থনৈতিক নয়। যে বিবিধ জঞ্জালের কারণে বিকৃত হওয়া পরিবেশের ভেতর তাদের বসবাস করতে হয় এগুলোর ছাপ পড়ে তাদের জীবনাচারে। কখনো বা নিজেরাই দায়ী হয় নিজেদের কোন দুর্ভোগের জন্য। মধ্যবিত্ত মানসগঠনও এর জন্য উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। ওয়াসি আহমেদ এর দক্ষতা এখানে যে তিনি এগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং শৈল্পিকভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।

এ নিবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ওয়াসি আহমেদ এর গল্প আমাদের চেনাজানা পরিবেশেই গড়ে উঠেছে। তাঁর গল্পের আপাত সরল প্লট এবং কুশলী বণর্নাভঙ্গী গল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশে এবং এর কাহিনী ও চরিত্রের সাথে সংযোগ রাখতে সহযোগিতা করে। তিনি যেসব বিষয় অবলম্বনে গল্পের কাহিনী গড়ে তুলেন তা জটিল কোন প্লটের দাবিও করে না। এ পদ্ধতিতে গল্প বলতেই তিনি অভ্যস্ত হয়েছেন। গল্প বলার এ কৌশলের মাধ্যমেই তিনি তুলে ধরেন গভীর জীবনবোধ। আর এটাই তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য। মানুষের জীবন-যাপনের নানাবিধ সংকট, টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়কে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা তাঁর গল্পের শরীর যতই সরলতার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হোক না কেন এর বক্তব্য গভীরতর ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়।

গল্প কথনের কৌশল হিসেবে তিনি কখনো রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। কখনো সরাসরি বক্তব্য উপস্থাপন না করে করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। ‘বীজমন্ত্র’ গল্পটির কথা ধরা যাক। এক তরুণ একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। এ চাকরি পাওয়ার প্রসেসটি গতানুগতিক নয়। প্রতিষ্ঠান চাকরিপ্রার্থীর এক্সপেক্টেড বেতনের চেয়ে অনেক বেশি বেতন দিয়ে নিয়োগ দেয়। চাকরিতে প্রবেশ করার পর হঠাৎ একদিন নিজেকে দেখতে পায় একটি বিশেষ রূমে। এ রূমে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তার অণ্ডকোষ কেটে নেয়া হয়। এখানে যারা চাকরি করতে আসে তাদের প্রত্যেককে একই প্রক্রিয়ায় ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এ কাজের মাধ্যমে আসলে কর্মীদের নিজস্বতা কেড়ে নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের চলতে হয়। এটাই একসময় স্বাভাবিক হয়ে যায়। অর্থাৎ চাকরিতে প্রবেশের পর ব্যক্তি লীন হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানের ভেতর। তখন প্রতিষ্ঠানই নিয়ন্ত্রণ করে তার সুখ-দুঃখ-সবকিছু।

এ প্রসঙ্গে ‘শেরশাহ ও তার অমোঘ পরিণতি’ গল্পটির কথাও বলা যায়। বদরু তার সর্বস্ব বিক্রি করে বিশাল আকারের এক ষাঁড় কিনে আনে। এটির শুক্রাণু ব্যবহার করে ভালোমানের গরু উৎপাদন করা তার উদ্দেশ্য। এলাকার লোকজন উন্নতমানের ভালো গরু পাওয়ার আশায় তাদের গাভীগুলো তার কাছে নিয়ে আসে। ‘শেরশাহ’র শুক্রাণু প্রদানের বিনিময়ে বদরু টাকা নেয়। কিছুদিন এই প্রথাগত পদ্ধতি চলার পর খোঁজ পেয়ে সরকারি বিভাগ যন্ত্র ব্যবহার করে শুক্রাণু নির্গমন করার প্রস্তাব নিয়ে আসে। বদরু বেশি টাকা পাওয়ার আশায় তাদের প্রস্তাবে রাজি হয় কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে তার নিজস্ব সাইনবোর্ডটি সরিয়ে সরকারি সাইনবোর্ড বসাতে হয়। অর্থাৎ কর্তৃত্ব তার হাত থেকে চলে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর চেয়েও খারাপ পরিণতি নেমে আসে বদরুর জন্য। গল্পের ডাইমেনশনও তখন বদলে যায়। ‘শেরশাহ’ নামক ষাঁড়ের শুক্রাণু ব্যবহার করে যে বাছুরগুলোর জন্ম দেয়া হয়েছিল সেগুলো মারা যেতে থাকে। এক পর্যায়ে লোকজনের রোষের মুখোমুখি হয়ে তাকে পালিয়ে যেতে হয়। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে ষাঁড় কিনে সে গ্রামে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গল্পের শেষদিকে লেখক যখন বলেন “ স্বপ্নে পাওয়া বলেই? শুধু স্বপ্নে ভর করে এত বড় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা যায় না। না-কি স্বপ্ন ও বাস্তবের গোঁজামিলের কারণেই বিপ্লবটা ফেঁসে গেল?” তখন গল্পের মর্মার্থ পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে উন্মেচিত হয়।

আবার ‘বনসাইয়ের স্বপ্ন’ গল্পে দেখা যায় এক যুবক অনেক বড় কিছু হতে গিয়ে আসলে কিছুই হতে পারেনি। বাস্তবতার সাথে কল্পনার বিপরীতাত্মক অবস্থার কারণে গল্পের নায়ক আতিক প্রকৃতপক্ষে বনসাইয়ের মতো হয়ে যায়। ছাদে মুরগি পালনে ব্যর্থ হয়ে বনসাইয়ের চাষ করা যেন তার জীবনেরই বাহ্যিক প্রতিফলন। অথচ তার যে অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে করে সে আরো ভালো কিছু করতে পারতো। কিন্তু সে এমনই ব্যর্থ যে তার পরম মমতায় সাজানো বনসাইগুলোও একসময় তার তার নিয়ন্ত্রণে না থেকে “ডালপালা-পাতায়” বেড়ে উঠে। এতে করে তার অকর্মণ্যতা আরও প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে।

"দেখেশুনে আদিত্যবাবু পর্যন্ত চোখ কপালে তোলেন, এমন তো দেখিনি, সারা জীবন গাছ নিয়ে কাটালাম, গাছের নাড়িনক্ষত্র মুখস্থ, তোমার এগুলো কী! কী করেছ তুমি! কেটেকুটে সাফ করে দিচ্ছ, তারপরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! কী করেছ বলো তো! ছেড়ে দাও, এগুলো তোমার অধীন থাকবে না। তোমার কাজ না।"

‘স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ’ গল্পে একসময়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে অবহেলা করা হয়েছিল তার করুণ কাহিনী উঠে এসেছে। ‘এলেমান’ যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা যেন লোকে ভুলতেই বসেছিল। যদি না নির্বাচনের প্রার্থী এ প্রসঙ্গটি সামনে না নিয়ে আসতেন তাহলে হয়তো তিনি বিস্মৃতির আড়ালেই চলে যেতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি একসময় এলমানের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে স্মৃতিস্মম্ভ নির্মাণ করলেও তা দিনের বেলায় পরিষ্কার করা হয় আর রাতের বেলা লোকজন ময়লা করে ফেলে। যোগ্যদের যথাযথ মর্যাদা দান ও তাদের স্মৃতি ধরে রাখার ব্যাপারে সমাজের মানসিক দীনতার দিকটিও প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে।

‘পরিবেশবাদী’ গল্পের মাধ্যমে লেখক একটি কমন সামাজিক মনেবৃত্তিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। আমরা প্রায়শই দেখি যে সুবিধাবাদী লোকেরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অবস্থাভেদে তাদের রূপ পালটে ফেলে। ‘লাইলি সুন্দরী ও জীবনযাপনের রূপকথা’ গল্পে মোহগ্রস্ত মানুষ কীভাবে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে তার চিত্র পাওয়া যায়।

ওয়াসি আহমেদ এর গল্পে সমাজ সচেতনতার বিষয়টি লক্ষণীয়। বিশেষ করে ধর্ষণের মতো একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বর্তমান সময়ে তো এর প্রকটরূপ বিরাজমান আছেই। আরো দুই-তিন দশক আগে- যে সময়ে এই গল্পগলো রচিত হয়েছে তখনও এই ব্যাধির ব্যাপকতা কতো ভয়াবহ ছিল। একজন সাহিত্যিকের রচনায় তার সময়ের নির্মমতা, পাশবিকতা উঠে আসবে এটা খুবই স্বাভাবিক। ওয়াসি আহমেদ এখানেও তার সাহিত্যিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।

‘কলাপাতা শাড়ি ও হাবুল শেখের বাড়ি ফেরা’ গল্পে গণধর্ষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। যদিও গল্পপাঠ শেষে দুটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা পাঠকের মনে ধরা পড়তে পারে তবু গণধর্ষণের ফলে একটি মেয়ে কিভাবে ‘....অসহায়, প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন..’ হয়ে পড়তে পারে এ বিষয়টিই মূখ্য হয়ে উঠেছে। আবার ‘উদ্ধার-পুনরুদ্ধার’ গল্পে ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর গল্প শুনি, যে তার নিজের ভাষ্যমতে, কয়েকজন তাকে ধর্ষণ করলেও তা গ্যাং রেপের মধ্যে পড়ে না। কারণ প্রথম ব্যক্তি ধর্ষণ করার পর যে ব্যক্তি তাকে ধর্ষকের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য আসে সে-ই আবার ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এভাবেই কয়েকজন ব্যক্তি উদ্ধারকারী হয়ে আসার পর তাদের খারাপ প্রবৃত্তিকে দমন করতে না পেরে ধর্ষক সেজে যায়-

"রাতভর। উদ্ধারকারী বলাৎকারকারী হতে থাকে। একর পরে এক, প্রাকৃতিক নিয়মে। তার (হতে পারে যাত্রী, স্টেশনের কুলি, রেলের কর্মচারী...) প্রত্যেকেই যুগপৎ উদ্ধারকারী ও বলাৎকারকারী, যদিও প্রথমত ও মূলত উদ্ধারকারী, পরে বলাৎকারকারী"

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘পঁচিশ বছর’ গল্পে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চালিত অমানবিক অত্যাচারের বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে ধর্ষণের বিষয়টিও এসেছে। গঙ্গাদাস এর বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় আর তার মাকে কি করেছিল তা রহস্য হয়েই থেকে যায়। তবে পাকিস্তানী মিলিটারির দ্বারা মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার সময় তার উপুর হয়ে পড়ে থাকা একটি ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় যখন গল্পে আমরা দেখি ঘটনার পঁচিশ বছর পরেও সে পান খেলে তার মুখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে ধারণা করা যায় শুধু-

"বহুদিন আগে গোবর-চোনায় উপুড় বেণুবালাকে অক্ষত, রক্তচিহ্নহীন দেখে পাকিস্তানী মিলিটারির বিচিত্র আচরণের ব্যাখ্যা খোঁজা দুরূহ ছিল। এতদিনে, পঁচিশ বছরে ধারণা হয়, বেণুবালার শরীরের সমস্ত রক্তবাহী শিরা-অনুশিরা বিন্দু-বিন্দু রক্তকণা অন্তরীণ রেখেছিল শরীরেরই কোনো গোপন কুঠুরিতে মিলিটারির সাধ্য ছিল না খুঁজে পায়! এতদিনে পঁচিশ বছরে, পুঞ্জিভূত রক্তকণিকা আলতা কিংবা সিঁদুর কিংবা ছেঁচা পানের বর্ণিল রস হয়ে মাটিতে, পারে তো, পুকুরপাড়ের রত্তি-রত্তি ভাঁটফুলে একাকার মেশে।"

‘মুগ্ধতার কারসাজি’ গল্পে এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মুগ্ধ হয়ে বাড়ি নির্মাণ কাজ বিল্ডিং এর উপর থেকে দড়ির গিঁট বেয়ে নেমে এসে এক শ্রমিকের লুঙ্গি চিপে পানি ফেলার দৃশ্যের অবতারণা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপরীতে দিকটাও পাঠকের নজরে আনেন। অধ্যাপকের মুগ্ধ হয়ে নির্মাণ কাজ দেখার মধ্যেও একটি ফাঁকি থেকে যায়

"যেমন... যেমন... তুমি আনবিলিএবল লাইটনেস অব ব্রিকস নামে একটা কেতাব নামিয়ে ফেলতে পারো। কিংবা ধরো কিছুই করলে না, তোমার মুগ্ধতাটুকুই মানুষকে বলে বেড়ালে, বা তাও না,মনের মধ্যে পুষে রাখলে, সেটাও একই। মানে, করাপশনটা যেভাবে শুরু হয় আর কি"

‘আবার করাপশনও!’

‘দেখতে থাকো। মুগ্ধতার মার্জিনে কিছু ধরা পড়ে কি না’

এ প্রসঙ্গে ‘ওয়ে আউট’ গল্পের কথাও উল্লেখ করা যায়। সামগ্রকি উন্নয়নের কথা বললে আর্থ-সামাজিক সব বিষয়ই চলে আসার কথা। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের জীবনমানও উন্নত হবে এটাই কাম্য। কিন্তু গল্পে দেখা যায় অর্থমন্ত্রী বাজেট অধিবেশন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ফ্লাইওভার, ইনফ্লেশন, শেয়ারবাজার ইত্যাদি বিষয়ে কথা বললেও বুড়ি ভিক্ষুকের অবস্থা উন্নয়নে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে এ বিষয়ে কিছু বলেন না। তাহলে শুধু উপরতলার উন্নয়ন কি কিছুটা ম্লান হয়ে যায় না?-

"এক বুড়ি ভিক্ষা চাইতে এসে নতুন চাল চালল, দ্যান বাবা, আর তো নিচে ঘুরাফিরা করবেন না, উরপে উরপেই থাকবেন। নতুন কথায় কি না, তারেক পাঁচটা টাকা দিল। বুড়ি বলল, ফেলাইউবারে ভিক্ষা করতে দিব?"

দেশভাগের দরুণ মানুষের মনে তৈরি হওয়া ক্ষত,সামরিক শাসনের বিভীষিকা প্রভৃতি বিষয়ও লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এ জন্যই তিনি লিখতে পেরেছেন ‘মধ্যদিনের গান’ ‘চক্রবৃদ্ধি’ নামের গল্প।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে দেশভাগের বিষয়টি রাজনৈতিক ঘটনা হলেও এর ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদেরকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। এমনকি একই পরিবারের সদস্যরা রয়ে গেছে দুটি ভিন্নদেশে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠলেও সাধারণ জনগণ লেগে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কঠোর সংগ্রামে। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে তাদের অনেককে চলে যেতে হয় সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে। ‘মধ্যদিনের গান’ গল্পে একটি পরিবারের দ্বি-খণ্ডিত হয়ে যাওয়ার চিত্র দেখা যায়। পরিবারের এক অংশ চলে আসে বাংলাদেশে অপর ভগ্নাংশ থেকে যায় ভারতে। ভারতে থাকা মাসুক আলী কয়েকবার বাংলাদেশে ঘুরে গেলেও পরে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে এখানে চলে আসে সোজা পথে নয়,দালালের মাধ্যমে। গুজরাটের দাঙ্গাও তাকে দেশান্তরী হতে প্রভাবিত করে। কিন্তু এ দেশে এসেও সে স্থির থাকতে পারে না। কি এক টান যেন তার থেকে যায়। এখানে কিছুদিন পরিবারের সদস্যদের সাথে থেকে সে পালিয়ে যায়। এ গল্পে দেখা যায় যে দেশভাগের পেছনে অন্যতম দায়ী সাম্প্রদায়িক বিভেদ এখনো কাটেনি গুজরাটের দাঙ্গা এর নিকটতম একটি উদাহরণ।

‘চক্রবৃদ্ধি’ গল্পে এরশাদ এর সামরিক শাসনামলের ভয়াবহতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এ ভূ-খণ্ডের মানুষের জন্য এ-ও এক অভিশাপ। বেশ কয়েকবার তারা এ অপশাসনের শিকার হয়েছে। কোনবারের অভিজ্ঞতাই ভালো নয়। এসব শাসনামলে মানুষের ব্যক্তি অধিকার যেমন হরণ হয়েছে তেমনি সামারিক কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা নানাধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নির্বিচারে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে আশির দশক পুরোটা কেটেছে সামরিক শাসনে। এ সময়ে রাজনৈতিক কারণে মানুষের মৃত্যু অতি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ গল্পে দেখা যায় সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তির জন্য বিচারের দাবি জানাতে সমাবেশ করতে এসে আরেক ব্যক্তি নিহত হয়। আগের নিহত ব্যক্তির নাম ছিলো স্বপন। কোন স্বপনের জন্য সমাবেশ হচ্ছে এ নিয়েও মানুষ বিভ্রান্তিতে পরে যায় কেননা স্বপন নামধারী অনেকেই তো মারা যাচ্ছে। আবার এ সমাবেশ স্থলেই দেখা যায় আদমজী পাটকলে নিরীহ শ্রমিক হত্যার বিচারের দাবিতে সমাবেশ বসে। অর্থাৎ এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলে।

স্বপ্ন সংক্রান্ত বিষয়-আশয় ওয়াসি আহমেদ এর বিভিন্ন গল্পে এসেছে। ‘লোকমান হাকিমের স্বপ্নদর্শন’ গল্পে লোকমান হাকিম এর স্বপ্নে কুৎসিত শিশু জন্ম দেয়া দেখা, ‘শেরশাহ ও তার অমোঘ পরিণতি’ গল্পে স্বপ্ন দেখে বড় আকারের ষাঁড় কিনে আনা, ‘ছোঁয়া’ গল্পে এক তরুণীর স্বপ্নে কেবল বেড়াল দেখা, ‘ভারহীন দৃষ্টিহীন’ গল্পে এক যুবকের হত্যা-দৃশ্য দেখা, ‘ত্রিসীমানা’ গল্পে এক মধ্যবয়সী নারীর স্বপ্নে মৃত স্বামী ও সন্তানের দেখা দেওয়া, ‘ছয়মিটার দূরত্ব’ গল্পে এক যুবকের আত্মহত্যার দৃশ্য দেখা এগুলো নানা প্রেক্ষাপটে এসেছে।

মানুষের স্নায়বিক অনুভূতির প্রভাব পড়ে স্বপ্নে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় নানা ধরণের বিকার ও উদ্ভটত্বের প্রকাশ ঘটে এবং তা মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। এর কিছু নমুনা উল্লেখিত গল্পগুলোতে দেখা যায়।

ইসলাম ধর্মে একটি মিথ আছে ইসরাফিল ফেরেশতার শিঙায় ফুঁ দেয়ার মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস হবে। এই মিথকে ব্যবহার করে ওয়াসি আহমেদ লিখেছেন ‘শিঙা বাজাবে ইসরাফিল’ গল্পটি। এ গল্পে দেখা যায় একটি অচেনা এবং অদ্ভুত শব্দ আসে হঠাৎ করে আর এতে সাততলা একটি ভবন ধ্বসে পড়ে। এ রহস্যজনক ঘটনায় ‘ডলফিন গলি’র লোকেরা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং এ ঘটনার কারণ খোঁজতে থাকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এরা কোন কারণ বের করতে পারে না। এরই মাঝে একটি বালকও নিখোঁজ হযে যায়। এটাও অনেক রহস্যজনক ঘটনা। ঘটনার কিছুদিন পর এলাকাবাসী দেখে ইসরাফিল নামের যে হিজরা এলাকায় থাকে তার হাতে শিঙার মতো একটা কিছু। এরপর তাকে দেখা যায় এ শিঙাটি নিয়ে সে নারকেল গাছে উঠে এবং ‘শিঙার সরু মুখটা নিজের মুখে বসিয়ে সুদূর আকাশ বরাবর মাথাটা হেলিয়ে দেয়।’

ইসরাফিল তখনও শিঙায় ফুঁ দেয়নি। লোকজন বুঝতে পারে না কি করবে। তাকে রুখবারও কোন উপায় থাকে না-

"এ অবস্থায় কে রুখবে ইসরাফিলকে! শিঙা তো তারই বাজাবার কথা। কারো বুকের পাটায় কুলাবে খুব লম্বা বাঁশের খোঁচায় তাকে ছিটকে ফেলে! মানুষজন কী করে! রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা।"

ওয়াসি আহমেদ এর গল্প বিশ্বে পরিভ্রমণ শেষে বিচিত্র স্বাদের অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। একজন স্বার্থক কথাশিল্পী হিসেবে তিনি যেসব বিষয়কে অবলম্বন করে গল্প রচনা করেছেন সেগুলো আমাদের চিন্তার জগতে নাড়া দিতে সক্ষম। তবে তার সবগুলো গল্পই যে শিল্পসার্থক হয়েছে তা নয়। ভালো ভালো গল্পগুলোর ফাঁকে তিনি কিছু দুর্বল গল্পও লিখেছেন। সেগুলো যদি তার সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তেমন ক্ষতি হবে না। তিনি গল্পে যেসব গভীরতর বিষয়কে তুলে ধরেছেন তা তার লেখক হিসেবে শক্তিমত্তার পরিচয়বাহী। তিনি গল্প বর্ণনায় বেশ কুশলীও বটে। বিষয়ের সাথে সুসামঞ্জস্য একটি বর্ণনাভঙ্গী ঠিক করে নিয়েছেন। তাই দেখা যায় তিনি কখনো ইন্টারভিউয়ের আকারে, কখনো রূপকের আড়ালে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। আবার কখনো দেখা যায় সংবাদ সম্মেলনকে তিনি গল্প উপস্থাপনার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

ওয়াসি আহমেদ সময়কে ধরেছেন। তাই তার গল্পে সময়ের যাতনা, নানাবিধ সংকট উঠে এসেছে। তিনি ব্যক্তিকে যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে। একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে তাঁর এ পর্যবেক্ষণগুলো যথার্থ বলেই মনে হয়। সব মিলিয়ে তাঁকে এ সময়ের একজন অপরিহার্য কথাশিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি হবে না বলেই মনে করি।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. বেশ! আমার ব্যতিক্রমধর্মী কাজ পরিণামে লোকজনের চোখে পড়ে এটা ভেবে ভালো লাগছে। আপনি তখন রাঢ়বঙ্গ পত্রিকার জন্য কষ্ট করে লিখেছিলেন। আজ সেটা নেট দুনিয়ার জগতে স্থান করে নিল। অনেক ভালোবাসা নেবেন।।

    উত্তরমুছুন