জাপান অন্য দশটা দেশ থেকে ভিন্ন, অন্য দশটা দেশ আবার নিজেদের মধ্যে ভিন্ন। তবু জাপানের কিছু বৈশিষ্ট্য খুবই স্বতন্ত্র – মানুষেরা এখানে মানিয়ে চলতে চায়, কিন্তু যে সমাজ উজ্জ্বল পোষাক পরা বা উচ্চস্বরে কথা বলাকে এড়িয়ে চলতে চায় তাদের পক্ষে কি নজর কাড়া আর্ট বা সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব? সেটা যে সম্ভব তা আমরা জানি। প্রায় এক হাজার বছর আগে মুরাসাকি শিকিবু, যাকে বলা হয়ে থাকে প্রথম উপন্যাস, The Tale of Genji, লিখে গেছেন। হকুসায়ের কানাগোয়ার বিশাল তরঙ্গের ছবি দেখে কে না মোহিত হয়েছে! জাপানি জেন বাগানের সংযত, কিন্তু সূক্ষ্ণ প্রকাশ আমাদেরকে জীবনে সরলতার সন্ধান দেয়। অন্যদিকে হিরোশি তেশিগাহারার মত পরিচালক বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশেলে ‘বালিয়ারির নারী’র (Woman in the Dunes) মত চলচ্চিত্রে আমাদের এমন এক পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেন তা যেন জাপান সম্পর্কে আমাদের ধারনা ভেঙে দেয়। এক পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞ সমুদ্রের ধারে দূর গ্রামে যেয়ে আটকা পড়েন, গ্রামবাসীরা তাকে বাধ্য করে দুর্ভেদ্য বালিয়ারির মধ্যে এক নারীর সাথে বাস করতে এবং তাদেরকে বালি সরাবরাহ করতে। তখনই আমরা আবিষ্কার করি জাপানের শিল্পীরা মুক্তির পথ খুঁজছেন, কিন্তু সেই পথটি একদিকে সংযত সরলতা ও অন্যদিকে কাফকার আতিশয্যবিহীন অ্যাবসার্ড ভয়াবহতায় যেন আবদ্ধ।
রিয়োনোসুকে আকুতাগাওয়ার জন্ম হয়েছিল ১৮৯২ সনে। ১৫০টি ছোট গল্প লিখে ৩৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করলেন। তাঁকে আধুনিক জাপানি গল্পের জনক বলা হয়। অনেক তাঁকে এডগার অ্যালান পো’র সঙ্গে তুলনা করেন, পো’র মতই তিনি ছোটবেলায় পিতা মাতাকে হারিয়েছিলেন যদিও এই ক্ষেত্রে তাঁর মা’কে একটি মানসিক চিকিৎসার প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়েছিল, আকুতাগাওয়ার মনে ভয় ছিল যে তাঁর অবস্থা মা’য়ের মতই হবে। তিনি এডগার পো’র গল্প অনুবাদ করেছেন, তাঁর গল্প পো’র মতই ছোট ছিল, কিন্তু পো দিয়ে হয়তো পুরোপুরি প্রভাবিত ছিলেন না – এই সংখ্যায় তাঁর যে তিনটি গল্প যাচ্ছে ‘রাশোমন ও জীবিকা বৃত্তান্ত’ (অনুবাদ - বিপ্লব বিশ্বাস) ‘ঝোপের ভেতর’ (অনুবাদ - মাজহার জীবন) এবং ‘একটি অদ্ভুত গল্প’ (অনুবাদ - সুমু হক)। সেগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন যে, জাপানের ইতিহাস ও লৌকিক গাথা তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। ‘ঝোপের ভেতর’ গল্পটি অবলম্বনে আকিরা কুরাসাওয়া বিখ্যাত ‘রাশোমন’ ছবিটি নির্মাণ করেন। কিন্তু একই সাথে আকুতাগাওয়া খুব আধুনিক (‘একটি অদ্ভুত গল্প’ সেটির প্রমাণ), কারণ তাঁর সময়টি যাকে ‘তাইশো পিরিয়ড’ (সম্রাট তাইশোর নামে, ১৯১২ – ১৯২৬) বলা হয় তখন জাপানে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চলছিল ও বিদেশী সংস্কৃতি গ্রহণের প্রতি জাপান উন্মুক্ত ছিল। [এর আগে ‘মেইজি পিরিয়ডে’ (১৮৬৮–১৯১২) জাপান তার একাকিত্ব বর্জন করে, পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যর সূচনা করে, রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যায়।] বর্তমানে আকুতাগোয়া পুরস্কার জাপানের সবচেয়ে সম্মানের সাহিত্য পুরস্কার।
এডগার পো কবি ছিলেন। আকুতাগাওয়া হাইকু লিখতেন -
ঝড়েরও মধ্যে
সমুদ্রের রঙ রয়ে যায়
শুকানো মাছে
অথবা আত্মহননের আগে লিখলেন নিজের মৃত্যুগাথা - ‘নিজেকে উপহাস’ নামে -
আমার সর্দির নাক
এক বিন্দু ছাড়া সবখানে
সন্ধ্যার অন্ধকার
এর মানে কী আমি বলতে পারব না, তবে মনে পড়ল রুশ কবি সেরগেই ইয়েসেনিন ১৯২৫ সনে, ৩০ বছর বয়সে, আত্মহত্যা করার আগে লিখলেন ‘বিদায়, আমার বন্ধু, বিদায়’
এ’ জীবনে মৃত্যু নয় কিছু নতুন
কিন্তু জীবনও নিশ্চয় নয় নতুনতর
১৮৪৯-এর অক্টোবরের এক দিনে এডগার পোকে বাল্টিমোরের এক রাস্তায় মরণাপন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়, চারদিন পর মারা যান, তাঁর বয়স হয়েছিল চল্লিশ। এর ৭৪ বছর পরে, আমেরিকা ভ্রমণের সময়, ইয়েসেনিন নাকি একবার মত্ত অবস্থায় তাঁর নিমন্ত্রণকর্তাকে অপমান করে পরের দিন বলেছিলেন তাঁর অসুখ এডগার পো’র মতই। তবে সেরগেই ইয়েসেনিন ও ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি যদি নতুন সোভিয়েত শাসনের সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পেয়ে আত্মবিনাশের পথ বেছে নিলেন, জাপানের সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশের সেই একই পথে হাঁটার রহস্য কী?
গল্পপাঠের এই সংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছে তামিকি হারার লেখা ‘আমার ইচ্ছাপুর’ (অনুবাদ – রঞ্জনা ব্যানার্জি)। এটি বলা যায় তাঁর মৃত্যুপত্র। তামিকি হারা হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে ছিলেন, বেঁচে গিয়েছিলেন, এর এক বছর আগে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল, স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন – ১৯৫১ সনে, ৪৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করলেন। তাঁর সমাধিতে লেখা হল তাঁর শেষ কবিতা -
পাথরে খোদাই হয়েছিল বহু আগে
হারিয়ে গিয়েছিল বালির পাহাড়ে
ভেঙে পড়া এক পৃথিবীর মাঝে
একটি ফুলের কল্পনা
‘আমার ইচ্ছাপুর’ কোনো গল্প নয়, অনুবাদকের ভাষায়, “বিক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে এই লেখা যেন তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা।” সেখানে তাঁর বিগতা স্ত্রীর জন্য আকুতি রয়েছে – “প্রিয়তমা, সেইসময় রোগশয্যায় তুমিও নিশ্চয় বসন্তের আগাম আহবানে এমনই শিহরিত হয়েছিলে। তোমার বেলায়ও যতই মৃত্যু ঘনাচ্ছিল, বিছানার ধারে স্বর্গের সুবাতাসে সবকিছু এমনই স্ফটিকের মতো স্বচ্ছই দেখাচ্ছিল, নয় কি? সেই সময়, অসুস্থ তুমি বিছানায় শুয়ে কী ধরনের স্বপ্ন দেখতে?”
১৯৪৫-এর ৬ই আগস্ট, সকাল সাড়ে আটটায়, মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বোমারু বিমান থেকে একটি পারমাণবিক বোমা হিরোশিমায় ফেলা হয়, সরাসরি আঘাতে ৭০,০০০-এর ওপর লোক মারা যায়, আরো ৭০,০০০ আহত হয়। তামিকি হারা বেঁচে যান, বিদ্ধস্ত শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন – “যতদূর চোখ যায় দেখলাম সব মৃতদেহগুলো একই রকম , তাদের মাথাগুলো ফোলা, মুখমণ্ডল পোড়া, দেহ ও বাহু উভয়েই ফুলেছে তাদের মৃত্যু হবার প্রক্রিয়ায়। পুড়ে যাওয়া বাহুগুলোতে কীটে গিজগিজ করছে। শুনতে পেলাম ১৩ তারিখে হাজার হাজার অচিহ্নিত মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে, আর মৃতের আত্মা কম্পিত অগ্নিশিখায় হারিয়ে যাচ্ছে।”
জাপান তামিকি হারাকে মনে রেখেছে তাঁর এই পারমাণবিক নোটসের জন্য। ৬-ই আগস্টের তিন দিন পরে নাগাসাকিতে আর একটি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয় যাতে অন্তত ৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। হিরোশিমা ও নাগাসাকির বহু অধিবাসী তেজস্ক্রিয়তার ক্ষত নিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল যুদ্ধ বেশিদিন টানলে জাপান ও মার্কিন উভয় দিকের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হত, ১৯৪৫-এরই মে ও জুন মাসে প্রল্ম্বিত ওকিনাওয়া দ্বীপ দখলের যুদ্ধ এক লক্ষেরও বেশি জাপানি সৈন্য নিহত হয় যার মধ্যে অনেকেই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। তবু পারমাণবিক বোমা সাধারণ নাগরিকের ওপর ফেলে বিশাল ধ্বংস ও মৃত্যুসংখ্যা দিয়ে শত্রুকে বশে আনা মানবিক নয় সেটি অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করবেন।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির মৃতদের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ কোরিয়ো ছিল। ১৯১০ সনে জাপান কোরিয়া অন্তরীপ দখল করে নেয় এবং ১৯৪৫-এ অন্তত ছয় লক্ষ কোরিয়োকে জাপানে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করে। জাপান সারকার কোরিয়ো অন্তরীপে ধীরে ধীরে কোরিয়ো ভাষাকে অপসারণ করতে থাকে। ১৯৩৭ সনে জাপান চিনদেশ আক্রমণ করে। ১৯৩৭-১৯৩৮ সনে কুখ্যাত নানজিং গণহত্যা সংঘঠিত হয় যখন জাপানি বাহিনি প্রায় এক লক্ষ চিনা বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। যুদ্ধ পরবর্তী জাপানি মানসে এই সময়কার জাপানি অপরাধের খতিয়ান পুরোপুরি হয়নি তাই কোরিয়া ও চিনদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের এটি একটি খুব সংবেদনশীল দিক। এই অবস্থানটির সম্বন্ধে নোবেলবিজয়ী কেনজাবুরো ওয়ে কখনই স্বস্তি বোধ করেন নি এবং একদিকে যেমন পৃথিবীতে পারমাণবিক মারণাস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে সামিল হয়েছেন অন্যদিকে জাপানি উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। গল্পপাঠের এই সংখ্যায় প্যারিস রিভিউয়ের কেনজাবুরো ওয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে (অনুবাদ – শামীম মনোয়ার), প্যারিস রিভিউয়ের যত আর্ট অফ ফিকশন পড়েছি তার মধ্যে এই সাক্ষাৎকারটিকে মনে হয়েছে বেশ গভীর ও শিক্ষামূলক। ওয়ে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মানজনক শৈল্পিক পুরস্কার Order of Culture প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ওয়ের মতে এই পুরস্কারটি জাপানের গণতান্ত্রিক ধারার বিরুদ্ধে। গল্পপাঠের এই সংখ্যায় যাচ্ছে ওয়ের গল্প ‘স্বপ্নের ছবিগুলি’ (অনুবাদ – উৎপল দাশগুপ্ত)। ওয়ের অনেক গল্পই তাঁর মানসিক প্রতিবন্ধী বড় ছেলে হিকারিকে নিয়ে যে শত বাধা সত্ত্বেও একজন সঙ্গীত সুরকার হয়েছে। পিতা–পুত্রের এই মিথস্ক্রিয়া যে কতখানি সৃজনশীল ও আনন্দের সেটি ওয়ের সৃষ্টি থেকে বোঝা যায়। ওয়ে বলেন হিকারি মনে করে সেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।
কেনজাবুরো ওয়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টোকিয়ো-প্রবাসী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মনজুরুল হক (‘জাপানের সংস্কৃতি সঙ্গট’)। ওয়ে মনজুরুল হককে বলছেন, “রাতে মায়ের পাশে বসে তিনি টেলিভিশন দেখছিলেন। টিভির খবরে একসময় নোবেল পুরস্কারের প্রসঙ্গ আসে। সংবাদপাঠক উল্লেখ করেন যে কেনজাবুরো ওয়ে হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার পর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এশিয়া মহাদেশের তৃতীয় প্রতিনিধি। সেই সংবাদ শুনে মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘কেনজাবুরো, কাওয়াবাতার প্রসঙ্গ তুমি ভুলে যাও। এখন থেকে তুমি হচ্ছো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমপর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্ব।’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওয়ের পরিচয় জাপানি অনুবাদে কবির রচনাবলি পাঠের মধ্য দিয়ে।”
রবীন্দ্রনাথের মতই ওয়ে শত বিপর্যয়ের মধ্যেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীতে জাপানি সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইউকিও মিশিমার (১৯২৫ – ১৯৭০) কথা বলা দরকার। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে মিশিমা ৩৪টি উপন্যাস, ৫০টি নাটক ও ২৫টি ছোট গল্পের সংকলন লেখেন। পশ্চিম জগতে এখনো তাঁর Confessions of a Mask, The Sailor Who Fell from Grace with the Sea, কিংবা The Temple of the Golden Pavilion ভীষণ জনপ্রিয়। মিশিমার ভাষাকে বলা হয় ধ্বনিময়, একদিকে প্রাচীন জাপানে প্রোথিত, অন্যদিকে সেই প্রাচীনতাকে আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশিত। তাঁর নোবেল পাবারও সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু যুদ্ধোত্তর জাপান তার অতীতের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নি, সেটারই একটা ফলশ্রুতি হল মিশিমার ডানপন্থী সরণ, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি ও আধা-সামরিক অভ্যুথ্বানের চেষ্টা (১৯৭০ সনে) এবং সেটি ব্যর্থ হলে ‘সেপুক্কু’ প্রথায় (পেট কেটে) আত্মহত্যা। কেনজাবুরো ওয়ের, রাজনৈতিক মতভেদ সত্ত্বেও, মিশিমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল, কিন্তু ওয়ের মতে মিশিমার আত্মহত্যা জাপানের আত্মিক বোধকে প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং জাপানের বাইরের মানুষেরা জাপনকে কীভাবে দেখতে চায় সেটার প্রতিনিধিত্ব করে, বিশ্বের কাছে জাপানিরা তাই এখনও দুর্বোধ্য (inscrutable)।
ওয়ে প্রসঙ্গে হারুকি মুরাকামির কথা আসে, এই মুহূর্তে জাপানের বাইরে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত, কিন্তু ওয়ে মুরাকামির লেখার একজন বড় সমালোচক ছিলেন। মুরাকামির অনুবাদ খুব সহজপাঠ্য, আমার কাছে তাকে পশ্চিমা লেখকই মনে হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল মুরাকামি তাঁর প্রথম উপন্যাস জাপানিতে লিখে তৃপ্ত হননি, এরপরে লিখলেন ইংরেজীতে। ইংরেজীতে লেখা তাঁকে যেন এক ধরণের মুক্তি দিল, তিনি আবার সেটা জাপানিতে অনুবাদ করলেন। জাপানিরা হারুকি মুরাকামির এই অ-জাপানিয় চরিত্রটিকে চিহ্নিত করতে পারে। মুরাকামির সাথে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর The Wind-Up Bird Chronicle উপন্যাস দিয়ে। এই গল্পের ভাষা ও প্লটটি আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল এবং এটি পড়াকালীন রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। কোনো লেখক যদি পাঠকের ওপর এরকম প্রভাব রাখতে পারেন সেটি হয় লেখকের প্রতিভাকে নির্দেশ করে, নয় পাঠকের অনভিজ্ঞতার নিদর্শন হয়। ২০০০ সন থেকে আমি মুরাকামি পড়া শুরু করি এবং ২০১৫ পর্যন্ত ইংরেজীতে প্রকাশিত তাঁর প্রায় সব উপন্যাসই পড়া হয়ে যায়, কিন্তু এরপরে আটকে যাই তাঁর 1Q84 – যেটি শেষ করতে পারি না। হঠাৎ মনে হল একটি পরাবাস্তব ধারণাকে কত বার ব্যবহার (শোষণ করা) সম্ভব? বইটির অহেতুক কলেবর বৃদ্ধি আমাকে পীড়িত করেছিলে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমি যেন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম মুরাকামির সব উপন্যাসই যেন একটি অভিযানেরই রকমফের, এক ধরণের ছোটা যার শেষ নেই। আরো দেখলাম তাঁর অধিকাংশ সাংস্কৃতিক রেফারেন্সই হয় মার্কিন ও ইউরোপীয়, জাপানি নয়। ‘দম-দেয়া পাখির উপাখ্যান’ তার মোহ হারালো, মনে হল আমি তখন অনভিজ্ঞ পাঠক ছিলাম। অনেক জাপানি সাহিত্য সমালোচকই মুরাকামির রচনাকে অগভীর, আত্মমুখী ও মনোবিকলনের বিলাসিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পরবর্তী সময়ে মুরাকামির ছোট গল্প আবিষ্কার করি, সেখানে তিনি কিন্তু শক্তিশালী। এই সংখ্যায় তাঁর দুটি গল্প যাচ্ছে – ‘নীরবতা’ (অনুবাদ - মোস্তাক শরীফ) এবং ‘আয়না’ (অনুবাদ – শুভ চক্রবর্তী)। মুরাকামির গল্পে চরিত্র বেশি থাকে না, এই দুটি গল্পেই উত্তম পুরুষে আখ্যান এবং মনস্তাত্ত্বিক।
একদিকে রাজতন্ত্র ও জাপানি সামরিক সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যদিকে উদার গণতান্ত্রিক সমাজের ইচ্ছা এই দুটি ধারা বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে জাপানি সমাজকে বিভক্ত করে রাখে। আগেই বলেছি ১৯১২ থেকে ১৯২৬-এর বছরগুলিতে, যাকে তাইশো পিরিয়ড বলা হয়, জাপান উদার চিন্তার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই সময়েই রিয়োনোসুকে আকুতাগাওয়া তাঁর গল্পগুলো লেখেন এবং এই সময়েই খুব অল্প সময়ের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে সহানুভূতিশীল ‘প্রলেতারিয়’ লেখক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। সেই আন্দোলনের একজন প্রতিভূ ছিলেন ইয়োশিকি হায়ামা (১৮৯৪ – ১৯৪৫), তাঁর ‘সিমেন্ট ব্যাগের ভেতর পাওয়া সেই চিঠি’ (অনুবাদ – নাহার তৃণা) এই সংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছে। হায়ামা সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানতে পারিনি, তবে বলা হয়ে থাকে পরবর্তীকালে তিনি জাপানি জাতীয়তাবাদের সমর্থক হয়ে ওঠেন। আমার স্বল্প পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে জাপানি শ্রমজীবী মানুষের সাহিত্য ওই সময়ের তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৮ – ১৯৭১) বা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের (১৯০৮ – ১৯৫৬) মত শক্তিশালী হয়নি, হতে পারে জাপানকে ভারতবর্ষ তথা বাংলার চরম সামাজিক দুর্দশার সম্মুখীণ হতে হয় নি।
[গল্পপাঠের এই সংখ্যায় সুনেও তোমিতার ‘গড়াগড়ি খেলা’ (অনুবাদ – সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত) নামে একটি গল্প যাচ্ছে। তোমিতা সম্পর্কে আমি একেবারেই অজ্ঞ, কিন্তু তাঁর গল্পটি পড়ে কেন জানি মনে হয়েছে তোমিতা জাতীয়তাবাদী ধারার লেখক, তবে আমার ভুল হতে পারে।]
প্রলেতারিয় আন্দোলনের আর একজন লেখক ইনেকো সাতার (১৯০৪ – ১৯৯৮) গল্পটি হল ‘রঙহীন ছবিগুলো’ (অনুবাদ – বেগম জাহান আরা)। সাতা জাপান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭৩ সনে ‘Imperial Art Academy Prize’ প্রত্যাখান করেন সেটির অতি-জাতীয়তাবাদী ভূমিকার জন্য (খেয়াল আছে কেনজাবুরো ওয়ে Order of Culture প্রায় একই কারণে প্রত্যাখান করেছিলেন ১৯৯৪-এ)। ‘রঙহীন ছবি’ গল্পে সাতা তাঁর বন্ধু K. এবং Y.-এর কথা বলছেন যারা দুজনেই নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছিল। লেখক Y.-এর সাথে K.-এর আঁকা ছবি দেখছেন মিউজিয়ামে, বলছেন – “…K.-র ছবিগুলো বেশ শক্তিশালী মনে হতো, কারণ সে গুলো রঙহীন। রঙহীন হওয়ার কারণে তাঁর ভেতরের হিংস্র নাটকের সত্যিকার ভাব বোঝা যায়, যেটা তাঁর ভেতরে বাস করে। যেটা তাঁর পবিত্রতাকেই প্রকাশ করে। এটাই K.-র বৈশিষ্ট্য। ঠগবাজি বা চাতুরি সে করতেই পারতো না। একটাই পথ তার সামনে খোলা থাকতো, সেটা হলো ছবি থেকে রঙ বর্জন করা।” গল্পটি কিছুটা বিমূর্ত, কিন্তু নিবিড় পঠনে বাস্তবতা (নাগাসাকির বিভীষিকা) ও আর্টের মেলবন্ধনটি পাঠকের কাছে মূর্ত হবে।
হারুকি মুরাকামির মত রিও মুরাকামির লেখাতেও পশ্চিমের অনেক সাংস্কৃতিক প্রভাব বিদ্যমান। তিনি খুব জনপ্রিয়। তাঁর ‘দ্যা লাস্ট পিকচার শো’ (অনুবাদ – দিলশাদ চৌধুরী) সেটির প্রমাণ। অন্যদিকে আধুনিক সময়ের লেখক মিয়েকো কাওয়াকামি ‘লজ্জা’ (অনুবাদ – ফারহানা আনন্দময়ী) আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় শত উন্নতির জাপানের মত সমাজেও নারীর নিরাপত্তা ও সম্মান সুরক্ষিত নয়। গল্পপাঠের এই সংখ্যায় মাত্র দুজন নারী লেখক স্থান পেয়েছেন (ইনেকো সাতা ও মিয়েকো কাওয়াকামি), কিন্তু বর্তমানে বেশ কয়েকজন তরুন নারী লেখক নারী-অধিকার নিয়ে লিখছেন, যেমন সায়াকা মুরাতা, বানানা ইয়োশিমোতো, ইয়োকো ওগায়া – যাঁদের লেখায় জাপানের অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধকর সামাজিক (অলিখিত) নিয়ম ও গঠন এবং পিতৃতন্ত্র ফুটে ওঠে, সাথে থাকে হারানোর বেদনা ও একাকিত্ব। অন্যান্য অনেক জাপানি লেখকের মত তাঁরাও ব্যবহার করেন পরাবাস্তবতা ও কল্পনা।
কাজিও ইশিগুরোর একটি গল্প ‘যুদ্ধের পরের গ্রীষ্ম’ (অনুবাদ – অমিতাভ চক্রবর্তী) এই সংখ্যাতে আছে, কিন্তু ইশিগুরো ইংরেজীতে লেখেন এবং নিজেকে বিলেতের সাহিত্যিক বলেই পরিচয় দেন (তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সনে নাগাসাকিতে), কাজেই বর্তমান প্রবন্ধে তাঁর কথা আর না তুলি।
পরিশেষে বলি, হায়াও মিয়াজাকির অ্যানিমেশন ছবি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। তাঁর Princess Mononoke কিংবা Castle in the Sky পরিবেশ-চিন্তা, মানবিক বোধ ও শিশু কিশোর অমলিনতার এক বিস্ময়কর সম্ভার। [নিইমি নানকিচির ‘দাদুর লন্ঠন’ (অনুবাদ – হারুন রশীদ) আমার সেই ধারার মনে হয়েছে।] কিন্তু এগুলোর মধ্যেও, আমি ওপরের প্যারায় যে একাকিত্ব বা হারানোর বেদনার কথা উল্লেখ করেছি, তা যেন বর্তমান। এমন যেন জাপানিরা অস্তিত্বের সঙ্গটকে গভীরভাবে উপলব্ধি করছে, কিন্তু সেটিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করে। ফরাসীরা যেমন অস্তিত্ববাদের মধ্যেও আশার আলো দেখে, জাপানিরা সেই এক অস্তিত্ববাদের মধ্যে দেখে নৈরাশ্য। কেনজাবুরো ওয়ে প্রথম দর্শনটির প্রতিনিধি, হারুকি মুরাকামি পরেরটি – আর আমরা জানি মুরাকামির লেখা ওয়ের থেকে জনপ্রিয়।
----------------
জ্যোতির্বিদ। কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক ও কবি
ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
সাহিত্যে আমার জ্ঞান অতি সীমিত, এই বয়সেও পড়তে বসলেই ঘুম পায়! জাপানি সাহিত্য তো দূরস্থান। এক নিঃশ্বেসে পড়লাম তোমার লেখা। সত্যি, এতো বড় পৃথিবীর কতটুকু যে জানি, সেটা আবার বুঝলাম! খুব ভালো লাগল এই জ্ঞানসমৃদ্ধ তথ্যভাণ্ডার…
উত্তরমুছুন