কাল রাতে শূন্য ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের তলায় চলে গেছে। পারা নেমে কোথায় থামে সে হিসেব করতে গিয়ে কেবল দু বছরের পুরনো এক হিসেব দেখেছি। উনপঞ্চাশ বছরের মধ্য সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়েছিল তখন। তারপর থেকেই শীতকালে ঠাণ্ডারা নামে? উনপঞ্চাশ বছর ধরে কেন ঠাণ্ডারা নামে নি শূন্যের তলায়?
সারা ঝাড়খণ্ড জুড়ে রাস্তা আর সেখানে অভ্রের কুচি পড়ে চকচক করছে। গাড়ি চললে রাস্তা স্বচ্ছ সেখানে মুখ দেখা যাচ্ছে আর ছায়া ছায়া - গাছের বা অনেক কিছুর। রাস্তার অভ্রের ওপর দিয়ে , তার ভেতর দিয়ে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করলাম। রানার বাগান দেখা গেল। বাপিন বলল,“ এরপর আমরা ডেগাডেগি যাব।”
—— কোথায় ?
------ ডেগাডেগি। নদীর তীর।
—— কোন নদী?
—— মনে নেই।
—— আগে মনে ছিল?
—— ছিল।
—— তখন ঠাণ্ডা ছিল?
—— ছিল।
—— তখন তো ঠাণ্ডা শূন্যের তলায় নামত?
—— না। উনপঞ্চাশ বছর নামেনি। তারপর থেকে নামে।
—— ডেগাডেগিতে কী আছে?
—— আছে।
—— কী আছে? কী কী আছে?
—— নদী আছে।
—— জল আছে - নদীতে?
—— এখন থাকার কথা নয়।
—— কেন?
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জে এ সময় নদীতে জল থাকার কথা নয়।
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জ?
—— হ্যাঁ, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।
—— তবে যে বললে ডেগাডেগি?
—— ম্যাকল্যাস্কিগঞ্জের শেষ যেখানে, সেখানেই ডেগাডেগি।
রাস্তার অভ্র খোঁজার চেষ্টা করলাম। তার ভেতর দিয়ে কী কী দেখা যাবে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। রাস্তায় অভ্র ছিল না। বুঝতে পারিনি কখন ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ঢুকে পড়েছি। অভ্রের ভেতর দিয়ে রানার বাগানের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম আর এখন কি গোটা বাগানটাই দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপর? সত্যিই আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ঢুকে পড়েছি যেখানে বাগানেরা আছে, বাগানের পর বাগান আর তার সীমা দিয়ে নিচু নিচু পাঁচিল। কখনও উঁচু উঁচু পাঁচিল সব রয়েছে। বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম,“ বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
—— সব বাড়ি বাগান দিয়ে ঢাকা বলে। দিনেরবেলা বলে সব বুঝতে পারছ না।
—— রাতের বেলা আলো জ্বললে বোঝা যাবে।
—— কী?
—— বাড়ি।
বাড়ি বুঝতে বুঝতে রাস্তা দিয়ে চলছিলাম আর রাস্তায় অভ্রেরা না থাকায় ধূলোরা ছিল। তার পাশে শাল গাছ বা সেগুন গাছেরা সারিবদ্ধ ভাবে ছিল, সাজানো গোছানো পাম গাছেরা পাতা ছেঁড়া না ছেঁড়া হয়ে বাহার দিচ্ছিল আর ছিল ফুলেরা ঝাড় দিয়ে অথবা ঝোপের ভেতর থেকে তাদের দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে রঙ আসছে কিনা দেখতে দেখতে রাস্তা আরো খারাপের দিকে চলে গেল আর দৃশ্যেরা গাছ হয়ে , ছোট ছোট টিলা ও নদীর খাত হয়ে দেখা গেল। দেওয়ালে এক সাবধানবাণী দেখা গেল,“ ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বন-পাহাড়-নদী সব অটুট রাখুন কারণ ওরাই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সম্পদ।” সেই দেখে বাপিন বলেছে,“ বোঝাই যাচ্ছে ডেগাডেগি এসে পড়ল।”
—— এসে পড়ল?
—— এসে পড়ল বলে।
—— কী করে বুঝলে?
—— দেখছ না সাবধান করেছে।
—— কী?
—— সব অটুট রাখতে।
—— কী? ঠাণ্ডা?
—— না বন-পাহাড় - নদী এই সব।
—— আর ঠাণ্ডা?
ডেগাডেগি এলে বাপিনকে নেমে যেতে দেখা গেল। সে নদীর খাত ধরে অনেক নীচে নেমে যাচ্ছে দেখে আমি বললাম,“ এতো নীচে নামছে, নামছে তো নামছেই উঠতে পারবে তো?”
—— পারবে।
—— কিন্তু নামল কেন? নদী তো ওপর থেকেও বেশ দেখা যাচ্ছে।
—— ও ফিরে যাচ্ছে।
—— কোথায়?
—— পঁয়ত্রিশ বছর আগে এসেছিল।
—— কী করে বুঝলে?
—— তনুজকে বলেছিল।
—— সে কী করবে?
—— সে বড়সড় একটা বই তৈরি করছে।
—— তো কী?
—— সে বইতে থাকবে।
—— কী থাকবে?
—— পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সব কথা।
—— আর উনপঞ্চাশ বছর আগেকার সব কথা?
—— থাকবে।
—— এই উনপঞ্চাশ বছর ধরে যে ঠাণ্ডা পড়েনি তখনকার কথা ?
—— সব থাকবে।
—— নিশ্চিত?
—— হ্যাঁ।
—— কী জানি।
—— আমি জানি।
—— আমি জানি কি? বলতে পারব না।
বাপিন বলেছে এক ঝর্ণার ধারে পাথরের ওপর থেকে এক বন্ধু এসে বুকের ওপর পড়ায় ওর চোয়াল আটকে গিয়েছিল। তখন বন্ধুদের মধ্যে ভীষণ আতঙ্কের সঞ্চার হল আর ওর হাঁ মুখ থেকে কষ বেয়ে লালা ঝরতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ তোমরা যে বাড়িটা ছিলে সেই বাড়িটার ছবি দেখলাম।” বাপিন চুপ করে থাকে । তার আর কথা বলার মতো সামর্থ্য নেই খালি লালা ঝরা কষ নিয়ে সে আমার দিকে তাকায়।
—— এখানের বাড়িগুলো সব বাগান দিয়ে ঢাকা অথচ তোমরা যেখানে ছিলে সে বাড়িটার সামনে কোন বাগানের ছবি দেখা যাচ্ছে না। না, বাগান একদম নেই তা নয় তবে সে এতোই কম যে তাকে আর বাগান বলা যাবে কি?
বাপিন বাজে রকমের হাঁ করে আমার কথা শুনতে থাকে আর কোন কথা বলতে পারে না। আমি বুঝলাম ওর চোয়াল লক হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি চোয়াল লক হয়ে গেছে?” এবার বাপিন অতি কষ্টে মাথা নাড়ল আর আমি বুঝতে পেরেছি এই ঘটনাটা ঘটে ছিল এক ঝর্ণার ধারে যার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে সেটা ওই বইটাতে পাওয়া যাবে যা তনুজ তৈরি করছে। এরপর ঘটনাগুলো এরকম করে ঘটেছিল- ওরা বাপিনকে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এক বিলেত ফেরত বাঙালি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তিনি অদ্ভূত দক্ষতায় বাপিনকে সারিয়ে দেবার আগে বলেছিলেন,“ আমি তোমায় সারিয়ে দিতে পারি কিন্তু এক হাঁড়ি বা এক বাক্স ভীম নাগের কড়া পাকের সন্দেশ খাওয়াতে হবে - প্রমিস।” সে সব একটা কাগজে লিখে দিতে হয়েছিল। বাপিনকে জিজ্ঞেস করলাম,“ তুমি বইতে কী লিখেছ এক হাঁড়ি না এক বাক্স।” বাপিন এবারো তার আটকে পড়া চোয়াল নিয়ে নিরুত্তর থেকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকায় আমার চোখ চলে গেল সেই দিকে দেখি গভীর নদীখাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও ডেগাডেগি ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে- অনেকটা ছোট আকারে তাকে দেখা যাচ্ছে। ও কি পঁয়ত্রিশ বছর আগে চলে গেছে ? তা হলে তো আরো অপেক্ষা করতে হবে। কত ক্ষণ অপেক্ষা করা যায় ? অবশ্য এর মধ্যে বারবার আলোকে বদলাতে দেখা যাবে যেমন সূর্য ডোবার অদ্ভূত আলো, সূর্য ওঠার কম আলো, সূর্য পুরোপুরি ওঠার বেশ ভালো আলো আবার সূর্য কমে আসার কম কম আলো। এই ভাবে নানান আলোর রকমফেরে ডেগাডেগিকে দেখা যেতে থাকে। নানান আলোর মধ্যে হোটেলের ঘরের বর্ণনাও নানান ভাবে দেওয়া হয় তবে সব জিনিসপত্র অটুট থাকে। তাদেরকে অটুট রাখার জন্য দেওয়ালে আহ্বান লেখা হয়,“ ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বন-পাহাড় -নদী সব অটুট রাখুন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ তুমি কি পঁয়ত্রিশ বছর আগে চলে গেলে?” কিন্তু অনেক দূর থেকে বলে বাপিন শুনতে পায় নি।সবে যখন এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে রাস্তার আলো পরখ করছিলাম দেখি ঠাণ্ডা বাড়ছে। আর আমাকে গাড়িতে উঠতে হয়। উঠলে বাপিন বলেছিল,“ একটা জায়গায় বারবার আসা দরকার।”
—— একই দিনে?
—— হ্যাঁ, একই দিনে।
—— বিরক্তিকর।
—— নানান আলোতে দেখতে আসতে হয়।
—— কেন?
—— সময় বদলাতে।
—— তাতে?
—— রঙ বদলায়।
সত্যিই রাস্তা ও গাছেদের ও বামনাকৃতি জঙ্গলের ও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িদের সবার রঙ বদলাতে বদলাতে আমরা যাতায়াত করি। আর দেখলাম জঙ্গলের মধ্যিখানে কোথাও অথবা রাস্তার ধূলোর ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা আছে ‘রানার কটেজ’ ওই তীর ধরে ধরে পৌঁছতে আমার একদম ভালো লাগে নি। কিন্তু অন্য রাস্তা দিয়ে চলতে চাওয়া আটকাতে পছন্দ না হওয়ায় অবশেষে জঙ্গলের মধ্যিখানে পৌঁছে বুঝলাম আসলে উনপঞ্চাশ বছর আগেকার সময়ের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডার কাছাকাছি থাকাই সবচেয়ে পছন্দের হতে পারে। আর তা হতে হলে বাড়ির সামনে বালির ঢিপি থাকতে হয়, সকালবেলা প্রাচীনতম ঠাণ্ডায় আবিষ্কার করতে হবে বড়সড় পাগ মার্কের। ওটা কোন জন্তুর পায়ের ছাপ চিতা নাকি নেকড়ের? এটা নিয়ে আলোচনা চলবে। সে সময় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আবার তার এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান বাদামী সাহেবকার পুরুষদের নিয়ে আর হাঁটু ছাপিয়ে ছাপিয়ে লুটিয়ে লুটিয়ে পরা পোষাক তুলে নিয়ে গোল টুপি পরে হাঁটা বাদামী মেমকার নারীদের নিয়ে গমগমিয়ে উঠবে। মরা মরা দোকানগুলোয় কলকাতার হগ মার্কেটের মতো পণ্যসারি ঝমকঝল্লো করবে। হগ মার্কেটের নকলে তৈরি করা মাংসের বাজারে পাওয়া যাবে বিফ পর্ক বা হরিণের মাংসের উল্লুস। ফ্যাট ফ্যাট করে গুলির আওয়াজ হল- উনপঞ্চাশ বছর আগে, পরিষ্কার বোঝা গেল সামনের জন্তুটি আসলে ছিল চিতা বাঘের পায়ের ছাপ আর সেই জন্তুটি গুলি খেতে খেতে অসাধারণ বডি ফেন্ট করে পাঁচিল টপকে পালালো। রানার কটেজের নিচু নিচু পাঁচিল টপকে। পেছন পেছন ছুটে এলো হাউ হাউ দুটো জার্মান শেপার্ড— তাদের রঙ রাত্তিরের থেকেও কালো হতে হতে বহু বছর টিঁকে রয়েছে রানার কটেজের রঙ লাগানো এ্যান্টিক নামের ফলক আর আধুনিক কাঠের দরজায়। যার সামনে এসে দাঁড়ালো পুলিশের ডিআইজির গাড়ি কারণ সেটা একটা ভাড়া খাটানো রিসর্ট- ঠিক উনপঞ্চাশ বছর পর।
বাপিনের পা দেখতে পেলাম, হাত দেখতে পেলাম সে ডেগাডেগির গভীর খাত থেকে উঠে আসছে। রানার কটেজের পলকা, পাতলা জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আমাকে বলল, “ তুমি যা বলেছ তাই হল।”
—— তাই হল? আমি কী বলেছি?
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সব বাড়ি বড় বড় । সব বাড়ি বাগান দিয়ে ঢাকা।
—— বলেছিলাম?
—— হ্যাঁ। রানার কটেজও তাই।
—— তাই?
—— হ্যাঁ আর বন্দুকও আছে, এ্যালশেসিয়ানও- দু দুটো।
—— বল জার্মান শেপার্ড।
উনপঞ্চাশ বছর আগেকার ঠাণ্ডা আবার পড়তে শুরু করল। বাপিনকে বললাম,“ ঘুরে এলে?”
—— কোথায় ?
—— পঁয়ত্রিশ বছর........
বাপিন বলল,“ তবে সেই ঝর্ণাটা আর পেলাম না।”
—— কোথায় ?
------ ডেগাডেগি। নদীর তীর।
—— কোন নদী?
—— মনে নেই।
—— আগে মনে ছিল?
—— ছিল।
—— তখন ঠাণ্ডা ছিল?
—— ছিল।
—— তখন তো ঠাণ্ডা শূন্যের তলায় নামত?
—— না। উনপঞ্চাশ বছর নামেনি। তারপর থেকে নামে।
—— ডেগাডেগিতে কী আছে?
—— আছে।
—— কী আছে? কী কী আছে?
—— নদী আছে।
—— জল আছে - নদীতে?
—— এখন থাকার কথা নয়।
—— কেন?
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জে এ সময় নদীতে জল থাকার কথা নয়।
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জ?
—— হ্যাঁ, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।
—— তবে যে বললে ডেগাডেগি?
—— ম্যাকল্যাস্কিগঞ্জের শেষ যেখানে, সেখানেই ডেগাডেগি।
রাস্তার অভ্র খোঁজার চেষ্টা করলাম। তার ভেতর দিয়ে কী কী দেখা যাবে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। রাস্তায় অভ্র ছিল না। বুঝতে পারিনি কখন ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ঢুকে পড়েছি। অভ্রের ভেতর দিয়ে রানার বাগানের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম আর এখন কি গোটা বাগানটাই দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপর? সত্যিই আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ঢুকে পড়েছি যেখানে বাগানেরা আছে, বাগানের পর বাগান আর তার সীমা দিয়ে নিচু নিচু পাঁচিল। কখনও উঁচু উঁচু পাঁচিল সব রয়েছে। বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম,“ বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
—— সব বাড়ি বাগান দিয়ে ঢাকা বলে। দিনেরবেলা বলে সব বুঝতে পারছ না।
—— রাতের বেলা আলো জ্বললে বোঝা যাবে।
—— কী?
—— বাড়ি।
বাড়ি বুঝতে বুঝতে রাস্তা দিয়ে চলছিলাম আর রাস্তায় অভ্রেরা না থাকায় ধূলোরা ছিল। তার পাশে শাল গাছ বা সেগুন গাছেরা সারিবদ্ধ ভাবে ছিল, সাজানো গোছানো পাম গাছেরা পাতা ছেঁড়া না ছেঁড়া হয়ে বাহার দিচ্ছিল আর ছিল ফুলেরা ঝাড় দিয়ে অথবা ঝোপের ভেতর থেকে তাদের দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে রঙ আসছে কিনা দেখতে দেখতে রাস্তা আরো খারাপের দিকে চলে গেল আর দৃশ্যেরা গাছ হয়ে , ছোট ছোট টিলা ও নদীর খাত হয়ে দেখা গেল। দেওয়ালে এক সাবধানবাণী দেখা গেল,“ ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বন-পাহাড়-নদী সব অটুট রাখুন কারণ ওরাই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সম্পদ।” সেই দেখে বাপিন বলেছে,“ বোঝাই যাচ্ছে ডেগাডেগি এসে পড়ল।”
—— এসে পড়ল?
—— এসে পড়ল বলে।
—— কী করে বুঝলে?
—— দেখছ না সাবধান করেছে।
—— কী?
—— সব অটুট রাখতে।
—— কী? ঠাণ্ডা?
—— না বন-পাহাড় - নদী এই সব।
—— আর ঠাণ্ডা?
ডেগাডেগি এলে বাপিনকে নেমে যেতে দেখা গেল। সে নদীর খাত ধরে অনেক নীচে নেমে যাচ্ছে দেখে আমি বললাম,“ এতো নীচে নামছে, নামছে তো নামছেই উঠতে পারবে তো?”
—— পারবে।
—— কিন্তু নামল কেন? নদী তো ওপর থেকেও বেশ দেখা যাচ্ছে।
—— ও ফিরে যাচ্ছে।
—— কোথায়?
—— পঁয়ত্রিশ বছর আগে এসেছিল।
—— কী করে বুঝলে?
—— তনুজকে বলেছিল।
—— সে কী করবে?
—— সে বড়সড় একটা বই তৈরি করছে।
—— তো কী?
—— সে বইতে থাকবে।
—— কী থাকবে?
—— পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সব কথা।
—— আর উনপঞ্চাশ বছর আগেকার সব কথা?
—— থাকবে।
—— এই উনপঞ্চাশ বছর ধরে যে ঠাণ্ডা পড়েনি তখনকার কথা ?
—— সব থাকবে।
—— নিশ্চিত?
—— হ্যাঁ।
—— কী জানি।
—— আমি জানি।
—— আমি জানি কি? বলতে পারব না।
বাপিন বলেছে এক ঝর্ণার ধারে পাথরের ওপর থেকে এক বন্ধু এসে বুকের ওপর পড়ায় ওর চোয়াল আটকে গিয়েছিল। তখন বন্ধুদের মধ্যে ভীষণ আতঙ্কের সঞ্চার হল আর ওর হাঁ মুখ থেকে কষ বেয়ে লালা ঝরতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ তোমরা যে বাড়িটা ছিলে সেই বাড়িটার ছবি দেখলাম।” বাপিন চুপ করে থাকে । তার আর কথা বলার মতো সামর্থ্য নেই খালি লালা ঝরা কষ নিয়ে সে আমার দিকে তাকায়।
—— এখানের বাড়িগুলো সব বাগান দিয়ে ঢাকা অথচ তোমরা যেখানে ছিলে সে বাড়িটার সামনে কোন বাগানের ছবি দেখা যাচ্ছে না। না, বাগান একদম নেই তা নয় তবে সে এতোই কম যে তাকে আর বাগান বলা যাবে কি?
বাপিন বাজে রকমের হাঁ করে আমার কথা শুনতে থাকে আর কোন কথা বলতে পারে না। আমি বুঝলাম ওর চোয়াল লক হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি চোয়াল লক হয়ে গেছে?” এবার বাপিন অতি কষ্টে মাথা নাড়ল আর আমি বুঝতে পেরেছি এই ঘটনাটা ঘটে ছিল এক ঝর্ণার ধারে যার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে সেটা ওই বইটাতে পাওয়া যাবে যা তনুজ তৈরি করছে। এরপর ঘটনাগুলো এরকম করে ঘটেছিল- ওরা বাপিনকে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এক বিলেত ফেরত বাঙালি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তিনি অদ্ভূত দক্ষতায় বাপিনকে সারিয়ে দেবার আগে বলেছিলেন,“ আমি তোমায় সারিয়ে দিতে পারি কিন্তু এক হাঁড়ি বা এক বাক্স ভীম নাগের কড়া পাকের সন্দেশ খাওয়াতে হবে - প্রমিস।” সে সব একটা কাগজে লিখে দিতে হয়েছিল। বাপিনকে জিজ্ঞেস করলাম,“ তুমি বইতে কী লিখেছ এক হাঁড়ি না এক বাক্স।” বাপিন এবারো তার আটকে পড়া চোয়াল নিয়ে নিরুত্তর থেকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকায় আমার চোখ চলে গেল সেই দিকে দেখি গভীর নদীখাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও ডেগাডেগি ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে- অনেকটা ছোট আকারে তাকে দেখা যাচ্ছে। ও কি পঁয়ত্রিশ বছর আগে চলে গেছে ? তা হলে তো আরো অপেক্ষা করতে হবে। কত ক্ষণ অপেক্ষা করা যায় ? অবশ্য এর মধ্যে বারবার আলোকে বদলাতে দেখা যাবে যেমন সূর্য ডোবার অদ্ভূত আলো, সূর্য ওঠার কম আলো, সূর্য পুরোপুরি ওঠার বেশ ভালো আলো আবার সূর্য কমে আসার কম কম আলো। এই ভাবে নানান আলোর রকমফেরে ডেগাডেগিকে দেখা যেতে থাকে। নানান আলোর মধ্যে হোটেলের ঘরের বর্ণনাও নানান ভাবে দেওয়া হয় তবে সব জিনিসপত্র অটুট থাকে। তাদেরকে অটুট রাখার জন্য দেওয়ালে আহ্বান লেখা হয়,“ ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বন-পাহাড় -নদী সব অটুট রাখুন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ তুমি কি পঁয়ত্রিশ বছর আগে চলে গেলে?” কিন্তু অনেক দূর থেকে বলে বাপিন শুনতে পায় নি।সবে যখন এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে রাস্তার আলো পরখ করছিলাম দেখি ঠাণ্ডা বাড়ছে। আর আমাকে গাড়িতে উঠতে হয়। উঠলে বাপিন বলেছিল,“ একটা জায়গায় বারবার আসা দরকার।”
—— একই দিনে?
—— হ্যাঁ, একই দিনে।
—— বিরক্তিকর।
—— নানান আলোতে দেখতে আসতে হয়।
—— কেন?
—— সময় বদলাতে।
—— তাতে?
—— রঙ বদলায়।
সত্যিই রাস্তা ও গাছেদের ও বামনাকৃতি জঙ্গলের ও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িদের সবার রঙ বদলাতে বদলাতে আমরা যাতায়াত করি। আর দেখলাম জঙ্গলের মধ্যিখানে কোথাও অথবা রাস্তার ধূলোর ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা আছে ‘রানার কটেজ’ ওই তীর ধরে ধরে পৌঁছতে আমার একদম ভালো লাগে নি। কিন্তু অন্য রাস্তা দিয়ে চলতে চাওয়া আটকাতে পছন্দ না হওয়ায় অবশেষে জঙ্গলের মধ্যিখানে পৌঁছে বুঝলাম আসলে উনপঞ্চাশ বছর আগেকার সময়ের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডার কাছাকাছি থাকাই সবচেয়ে পছন্দের হতে পারে। আর তা হতে হলে বাড়ির সামনে বালির ঢিপি থাকতে হয়, সকালবেলা প্রাচীনতম ঠাণ্ডায় আবিষ্কার করতে হবে বড়সড় পাগ মার্কের। ওটা কোন জন্তুর পায়ের ছাপ চিতা নাকি নেকড়ের? এটা নিয়ে আলোচনা চলবে। সে সময় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আবার তার এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান বাদামী সাহেবকার পুরুষদের নিয়ে আর হাঁটু ছাপিয়ে ছাপিয়ে লুটিয়ে লুটিয়ে পরা পোষাক তুলে নিয়ে গোল টুপি পরে হাঁটা বাদামী মেমকার নারীদের নিয়ে গমগমিয়ে উঠবে। মরা মরা দোকানগুলোয় কলকাতার হগ মার্কেটের মতো পণ্যসারি ঝমকঝল্লো করবে। হগ মার্কেটের নকলে তৈরি করা মাংসের বাজারে পাওয়া যাবে বিফ পর্ক বা হরিণের মাংসের উল্লুস। ফ্যাট ফ্যাট করে গুলির আওয়াজ হল- উনপঞ্চাশ বছর আগে, পরিষ্কার বোঝা গেল সামনের জন্তুটি আসলে ছিল চিতা বাঘের পায়ের ছাপ আর সেই জন্তুটি গুলি খেতে খেতে অসাধারণ বডি ফেন্ট করে পাঁচিল টপকে পালালো। রানার কটেজের নিচু নিচু পাঁচিল টপকে। পেছন পেছন ছুটে এলো হাউ হাউ দুটো জার্মান শেপার্ড— তাদের রঙ রাত্তিরের থেকেও কালো হতে হতে বহু বছর টিঁকে রয়েছে রানার কটেজের রঙ লাগানো এ্যান্টিক নামের ফলক আর আধুনিক কাঠের দরজায়। যার সামনে এসে দাঁড়ালো পুলিশের ডিআইজির গাড়ি কারণ সেটা একটা ভাড়া খাটানো রিসর্ট- ঠিক উনপঞ্চাশ বছর পর।
বাপিনের পা দেখতে পেলাম, হাত দেখতে পেলাম সে ডেগাডেগির গভীর খাত থেকে উঠে আসছে। রানার কটেজের পলকা, পাতলা জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আমাকে বলল, “ তুমি যা বলেছ তাই হল।”
—— তাই হল? আমি কী বলেছি?
—— ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সব বাড়ি বড় বড় । সব বাড়ি বাগান দিয়ে ঢাকা।
—— বলেছিলাম?
—— হ্যাঁ। রানার কটেজও তাই।
—— তাই?
—— হ্যাঁ আর বন্দুকও আছে, এ্যালশেসিয়ানও- দু দুটো।
—— বল জার্মান শেপার্ড।
উনপঞ্চাশ বছর আগেকার ঠাণ্ডা আবার পড়তে শুরু করল। বাপিনকে বললাম,“ ঘুরে এলে?”
—— কোথায় ?
—— পঁয়ত্রিশ বছর........
বাপিন বলল,“ তবে সেই ঝর্ণাটা আর পেলাম না।”
লেখক পরিচিতি:
উপল মুখোপাধ্যায়
কথাসাহিত্যিক।
বর্তমান আবাস- মুখার্জিগেট, মহেশতলা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ ভারত।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- চারটি।
3 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগলো
উত্তরমুছুনএকটা ছবি আঁকা হলো ব্যাকরণ মেনে। রেখা রঙ সব যেখানে চাপানোর চাপলো। তারপর তাদের ধেবড়ে দেওয়া হলো যাতে অতীত ভবিষ্যত বর্তমান সব একাকার হয়ে গিয়ে অখন্ড কালপ্রবাহের মাঝখানে গিয়ে পড়ে পাঠক, হাবুডুবু খেতে খেতে স্পর্শ পায় এক অনির্বচনীয়ের। এই গল্পে আঁকা ছবিটা ঠিক তেমন।
উত্তরমুছুনচমৎকার লাগলো l আরো লিখুন
উত্তরমুছুন