অমিত ভট্টাচার্যের গল্প: প্রেয়


 সেদিন ঝড় হচ্ছিল খুব। ই এম বাইপাসের দুধারে গাছগুলো হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে করে হাঁপাচ্ছে। বেগতিক দেখে আমাদের অটোচালকটি একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে আমরা তিনজন। চালককে নিয়ে চার। দরজার দিকে আমার ঠিক বাঁ পাশে যে মেয়েটি বসে, তার ডান হাতে একটা প্যাকেট। ওই প্যাকেটের ভেতর কোন আশঙ্কা জমা ছিল নিশ্চই। মেয়েটির শরীরী ভাষায় তা স্পষ্ট। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ দেখে প্রায় কেঁদে ফেলল সে। আমি আশ্বস্ত করতে চাইলাম। ও বলল, কী যে করব বুঝতে পারছি না। ঝড় কি এক্ষুনি থামবে?

কোথায় যাবেন আপনি? জিগ্যেস করলাম ওকে।

পার্কস্ট্রিট। তারপর হাতের প্যাকেটটা উঁচু করে দেখিয়ে বলল, এটা খুব তাড়াতাড়ি জমা দিতে হবে।
 
কী আছে ওতে?
 
বায়োপ্‌সি হবে। বাবার আজ অপারেশন হলো।

ওর মুখের দিকে তাকাবার আগে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। কী আশ্চর্য ! আমারও মায়ের বায়োপ্‌সি রিপোর্ট আনতে যাচ্ছি আমি। পার্ক স্ট্রিটেই। সকাল থেকেই মনে মনে একটা আশঙ্কা । কী রিপোর্ট পাবো, কে জানে।
 
সামনে বিশাল একটা গাছের ডাল ভাঙ্গার মড়মড় আওয়াজে সবাই তাকিয়ে রইলাম। কোনো আশনি সংকেত নয় তো? সাধারণত এরকম দুর্বলতা আমার আসে না। কিন্ত আজ মনে হলো। মা বলছিল, তোদের অনেক কষ্ট দিলাম। এখন মানে মানে গেলেই হয়।
 
কী যা তা বলছ।

আমার কথায় ঠোঁটের কোণায় কষ্ট করে হাসি এনে মা বলল, তোর সংসারটা দেখে যেতে পারলে ভালো হতো বাবু। আমি চলে গেলে কে তোকে দেখবে? মা ছেলের কথোপকথনের মধ্যেই একটা বাজ পড়ার বিকট আওয়াজ। যেন মনে হলো, কোনো তৃতীয় পক্ষ যোগ দিতে চাইছে আমাদের কথায়। সারা শরীর কেঁপে উঠল মায়ের। একটা চাদর টেনে দিলাম গায়ে। কাজের মাসিকে বললাম, একটু গরম দুধ খাইয়ে দাও তো। তা শুনে ওই শরীরেও মা ঠাট্টা জুড়ল। বলল, ঘরে একটা বউ আন আগে। সে আমাকে খাইয়ে দেবে’খন।
 
বাড়ি থেকে অটো স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতে আসতে নানান স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায় । ছেলেবেলায় একবার দোলনার জন্য পিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছিল মা। কিন্ত সেটা গাছে বাঁধবে কে? মা-ই শেষমেশ একে তাকে বলে ব্যবস্থা করল। তারপর তাতে চড়িয়ে যেই আমায় ঠেলে দিল, পেটটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নামতে গিয়ে উল্টে গেলাম। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছিল। আঁচল দিয়ে মুছে , মা আমায় বুকের ভেতর চেপে ধরল। সেই ওমের স্মৃতি আজও আমায় প্রচন্ড শীতে কিছুটা আরাম দেয়।
 
ওদিকে গাছের ডালটা ভেঙ্গে গেলেও,এতক্ষণ অন্য ডালের সাহারায় ঝুলছিল। এইমাত্র সেটা হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল আমাদের থেকে একটু দূরে। দাঁড়ানো অবস্থায় অটোর ছেলেটি বলল, ব্যস শালা এক্ষুনি জ্যাম লেগে যাবে। এই বলে সে বাঁ হাতে টিউব ওয়েল পাম্প করার মতো স্টার্টারের রডটা ওঠানামা করাতে লাগলো। মেয়েটির মুখে একটা অস্বস্তি । অটো চলছে সাপের মতো। একপাশ থেকে হাওয়া ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। যেন প্রকৃতি তার উন্মাদনায় আমাদের বিপাকে ফেলতে চায়। মেয়েটির গোটানো চুলগুলো হাওয়ায় খুলে গিয়ে ধেয়ে আসছে আমার দিকে। কিন্তু প্যাকেটে ওর একটা হাত আটকে থাকায় কিছু করার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে হাওয়ার গতি কিছুটা কমে এলো। দুচার ফোঁটা বৃষ্টি টরেটক্কা আওয়াজ তুলেছে অটোর বডিতে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ভেতরে যে তিনজন ছিলাম , তারমধ্যে একজন উধাও। অটোওয়ালাকে জিগ্যেস করতে সে বলল, চলে গেছে। বলল শুনলেন না , অপয়াদের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। একথা শুনে মেয়েটি কেমন নার্ভাস হয়ে গেল। বললাম, ওসব লোকের কথায় কান দেবেন না। মনে মনে ভাবলাম , ব্যাটা আসলে চটেছে অন্য কারণে। ওঠার সময় মেয়েটির পাশে বসার ইচ্ছে ছিল ওর। কায়দা করে সরিয়ে দিতেই বিড়বিড় করে কী যেন বলল।
 
বৃষ্টির ছাঁট বাঁচাতে এবার মেয়েটি সরে আসছে আমার দিকে। মিথ্যে বলব না, ভালোই লাগছে। আশপাশে কেউ না থাকলেও অটোর লুকিং গ্লাসে চালকের সঙ্গে একবার চোখাচুখি হলো। ভদ্রতার স্বার্থে একটু সরে বসতে গিয়ে আরও যেন কিছুটা ঘন হলাম। কিন্তু মেয়েটি হঠাৎ ডুকরে উঠল। তারপর তার ভেজা চোখে সদ্য ভেজা রাস্তার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল, যে তা দেখে আমার ভালোলাগা মনটা ভীষণ সহানুভূতিশীল হতে চাইল। এইমুহূর্তে আমার বাঁ হাতটা একটু মেলে অনায়াসে ওর বাঁ কাঁধে আশ্রয় নিতে পারে। কিংবা ওর উরুর ওপর রাখা ডান হাতে। কিন্তু কেন যেন মনে হলো, এ তো আমারই আশ্রয়স্থল। বরং সবুর করাই ভালো।
 
মাঝখানে চালক ছেলেটি একবার রাস্তার ধার ঘেঁষে অটোটা দাঁড় করালো। তারপর পেছনদিকে চলে গেল প্যান্টের চেন টানতে টানতে। সেই ফাঁকে মেয়েটিকে বললাম, আমিও পার্কস্ট্রিট যাচ্ছি। আমার মায়ের বায়োপ্‌সি রিপোর্ট আনতে। কিছুটা অবাক হয়ে দুচোখ ভরে সে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন ওর গা থেকে ভেসে আসা মেয়েলি গন্ধ উপভোগ করছি। যেন নাম না জানা কোনো ফুলের গন্ধ।

আলাপ জমানোর উদ্দ্যেশে নিজের নাম বললাম ওকে। ও কিছু বলল না। অভিমান হলো খুব। একটু পরেই সে তার নাম বলল একপাশে মুখটা ঘুরিয়ে। দুটো নামের উচ্চারণে একটা ছন্দ তৈরি হলো যেন। বাবুয়া আর তুয়া।
 
ওজন না থাকলেও সাবধানে একটানা প্যাকেটটা বয়ে তুয়ার হাত ব্যথা করছিল বোধহয়। তাই এক হাত থেকে অন্য হাতে নিলো। আমি একটু সরে গিয়ে আমাদের মাঝখানটা দেখিয়ে বললাম, এখানে রাখো না। কথামতো তুয়া প্যাকেটটা মাঝখানে রাখল। সেটার দিকে তাকিয়ে আমি তখন তুয়ার বাবাকে কল্পনা করে চলেছি। ধুতি পাঞ্জাবি, নাকি প্যান্ট সার্ট । গোঁফ কী আছে না কামানো? মাথায় চুল কিংবা টাক। পঁয়তাল্লিশ না পঞ্চাশ ? লম্বা না মাঝারি? এই তো কেমন একটা গোটা শরীর ফুটে উঠছে চোখের সামনে ! পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই আমায় আর্শীবাদ করলেন । ওদিকে হাসিহাসি মুখ করে মা তাকিয়ে আছে তুয়ার দিকে। সে দৃষ্টিতে স্পষ্ট আমার ভবিষ্যত। 
 
পার্ক স্ট্রিট পৌছে আমি চললাম বিখ্যাত সেই প্যাথোলজিকাল ল্যাবরেটরির দিকে। তুয়াও আমার পেছন পেছন সেইদিকেই। দুজনেই কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই মায়ের রিপোর্ট আসবে। আশঙ্কায় বুকের ভেতর হাতুড়ির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সারা শরীর ঘামে ভিজে একশা। পেছন থেকে পিঠে হাত রাখল তুয়া। শরীরের ঘাম নিমেষে কে যেন শুষে নিলো ব্লটিং পেপারে। এরপর যখন রিপোর্ট হাতে এলো, আমি তখনও শুধু তুয়ার কথাই ভাবছি। শুধুই তুয়া। বাবুয়া আর তুয়া। তুয়া আর বাবুয়া। 
 --------------
 
 
লেখক পরিচিতি:
অমিত ভট্টাচার্য
গল্পকার। অবসরপ্রান্ত ব্যাঙ্কার
কলকাতায় থাকেন। 
প্রকাশিত গ্রন্থ দুটি: "রক্তমাংসের ক্যানভাস" এবং "আলোছায়া"
 
 

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ