বাস্তব-পরাবাস্তবের অন্তরালে এক ইচ্ছে-পূরণের-গল্প: পাপড়ি রহমান


মৃত্যু নিশ্চিত আছে জেনেও, মৃত্যুর এক অলৌকিক-ভ্রমণের কথা বয়ান করেন যে লেখক, তাঁর প্রতি সিরিয়াস-পাঠকের ঝুঁকে পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলত আমিও আমার টগবগে তারুণ্যে তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলাম। এই ঝুঁকে-পড়া কিন্তু যেনতেন প্রকারে ছিল না, ছিল একেবারে আভূমি-নত হয়ে ঝুঁকে-পড়া! বরাবরই আমি সিরিয়াস-পাঠক! [এখানে চাপা-স্বরে পড়তে হবে ‘উন্নাসিক পাঠক’, হ্যাহ! ভাবধরা পাঠক!] এবং এই সিরিয়াস-পাঠক হিসেবে গুরুতর বদনাম আমার আছে। এবং এই বহু-চর্চিত-বদনাম শিরোধার্য করে আমি পড়তে শুরু করেছিলাম কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের বইপত্র। যেমন করে আমি পড়তে শুরু করেছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বইপত্র। বা শহীদুল জহির কিংবা নবারুণ ভট্টাচার্যের বা সুধীর চক্রবর্তীর লেখাপত্র! আমার ‘পাঠরুচির’ নানা ফ্যাকরার কারণে আমাকে নানান সময়ে নানান স্থানে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। অনেক পত্রিকার ফরমাইশ থাকা স্বত্বেও আমি বহুগ্রন্থ অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছি। এবং আগেভাগেই বলে নিয়েছি, যদি আমার মনপছন্দ না-হয়, তাহলে আমি কোনোকিছুই কিন্তু লিখব না এই বই নিয়ে। গ্রন্থ ফিরিয়ে নিতে নিতে কত সম্পাদকের ব্যাদান-মুখ যে আমাকে দেখতে হয়েছে! কিন্তু আমি নির্বিকার থেকেছি। আর মনে মনে সদা জপে গেছি---

সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়?

ওয়াসি আহমেদের লেখাপত্রে প্রবেশের পূর্বে এসবই আদতে গৌরচন্দ্রিকা। কিন্তু গৌরচন্দ্রিকা করতে করতে ভাবছি, বার হাত কাঁকড়ের তের হাত বিচি না হয়ে যায়? অর্থাৎ আলোচনার চাইতে ভূমিকাই যদি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে-সাকুল্যে বড় হয়ে যায় তার তখন কী উপায় হবে, প্রভু?

‘গল্পপাঠের’ নানান ইস্যুই আমি মিস করি নিজের ঘাড়ে চেপে থাকা জোয়ালের মতো রাজ্যির ফরমাইশি-লেখার কারণে। অথবা নিজের একান্ত লেখাটিতে অতি-মনোযোগী থাকার ফলে। অথবা রোগশোক আমাকে জর্জর করে ফেলার সুবাদে। এত অসুখবিসুখের কথা মুখ ফুটে বলতেও দ্বিধা-বোধ-করি ইদানীং। এসব দেখেশুনেজেনে সকলেরই নির্ঘাত মনে হবে, এইরকম ‘হাড়মড়মড়ি-ব্যারামের’ নিদান কভু নাহি হয়! কভু নাহি হবে!

এবারেও ‘গল্পপাঠের’ এই সবিশেষ আয়োজনে যথারীতি কথাসাহিত্যিক ও প্রিয় ভগ্নি নাহার তৃণার আমন্ত্রণ-পত্রটি এসেছে। কিন্তু জবাবে কী বলব এই দ্বিধায় আমি সংকুচিত হয়ে থেকেছি। ওদিকে মনে গোপন-আশা--- ওয়াসি আহমেদ মিস করা যাবে না কিছুতেই। এসেছে কুলদা রায়ের আন্তরিক আমন্ত্রণ। আমি দীর্ঘ একমাস জ্বরে ভুগে ভুগে [এটাকেই বোধকরি হাড়মড়মড়ি ব্যারাম বলা হয়], জ্বর-অন্তে নিয়ত করেছি--- ওয়াসি আহমেদকে মিস করা যাবে না কিছুতেই। না, মিস করা যাবে না, কিছুতেই!

এদিকে বয়সোজনিত কারণে চোখের আলো নিভুনিভু হয়ে আসছে, ক্লান্তি আমায় কভু ক্ষমা না-করার কারণে অবসাদে নিমগ্ন-দেহখানি। কিন্তু তো বলতে পারছিনে---

"আমার এই দেহখানি তুলে ধর / তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো /

নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে…"

মার্ক টোয়েইনের বই রাখার কায়দাটি রপ্ত করে আমার ঘরে-বাইরে, ব্যালকনি-ড্রেসিংয়ে বইয়ের আবাসস্থল গড়ে ওঠার কারণে প্রয়োজনীয় কোনো বই খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব! তবুও গ্রন্থের এই ক্ষুদ্র-জলনিধি মন্থন করে, সুঁই খুঁজে পাওয়ার মতো করে তল্লাশি চালিয়ে হাতে পেয়েছি ‘মেঘপাহাড়’! নীলকণ্ঠের নীল-বিষাদের মতো নীল-মলাটের বইখানি বড় আদুরে-আদলে ভরপুর! এই নীল-বিষাদ আমাকে সেই দুইযুগ আগের মতোই যারপরনাই মুগ্ধতায় কাছে টেনে নিয়েছে।

মৃত্যুর সমান্তরাল সৌন্দর্য বিকশিত করে এক জোছনারাতের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে ওয়াসি আহমেদের উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়’!

আহা! মেঘের এত রঙ! আর জোছনার এমন আলো! মরি যদি সেও ভালো, সে মরণ স্বর্গ সমান! ওই অপরূপ-রূপের মাঝে আদতে সত্যিই সত্যিই এক মানুষ লোকান্তরিত হচ্ছেন। এবং কী অদ্ভুত কায়দায় ওয়াসি আহমেদ আমাদের ঘোরগ্রস্ত করে তুলছেন! তা ভায়া এক্ষণে ওয়াসির কায়দাটা কী?

"Surrealism aimed to revolutionize human experience, rejecting a rational vision of life in favor of one that asserted the value of the unconscious and dreams. The movement’s poets and artists found magic and strange beauty in the unexpected and the uncanny, the disregarded and the unconventional."

ফ্রয়েড ব্রাদার হয়তো আরেকটু অন্যভাবে ধরা দিয়েছেন।

কিন্তু আমি ‘মেঘপাহাড়ের’ তলায় বয়ে যাওয়া এক ছোট্ট-ঝিরি দেখে মনে মনে ভাবছি--- যাহা দেখেছি বা দেখি নাই, ঘটেছে বা ঘটে নাই--- এসব বিভাজনের দরকারটা কী? বরং আমার দেখা, না-দেখার চোখ, হৃদয়ের আর্তি বা অনার্তি সবই একাকার করে দিয়ে বলি--- আমার এই দেহখানি তুলে ধর / তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো / নিশিদিন আলোক শিখা জ্বলুক গানে…

আমি আদতে ঘুচিয়ে দিতে চাইছি এই দেখা, না-দেখার সংরাগ! মুছে দিতে চাইছি দেহে ও মনের সেই একাত্ম হতে না-পারার সংঘর্ষ!

‘চারপাশ খুব অচেনা লাগল। হঠাত সামনে তির তির কাঁপা আলো লক্ষ করে চলতে শুরু করলে, সে আবার চমকালো। আলো নয়, হাত পনের দূরে ডোবার পানিতে ভোরের ফিকে পানসে আলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে তার গা শির শির করে উঠল--- এ যে তার বাপ-দাদার ভিটা! বাড়িছাড়া হওয়ার পর সে এ-পথে কোনোদিন আসেনি। এ কেমন করে হল? সে এখানে কেন? মাঝরাতের পর থেকে এত আলো পথে-ঘাটে, তারপরেও সে পথ ভুলে এ কোথায়? এদিকে বুকে দম নেই যে আবার ছুটবে। তড়িঘড়ি দু’পা বাড়াতেই সে বিপাকে পড়লো। পেছন থেকে কে আপনে, কে বলে মেয়েমানুষের গলা তাকে পাকড়াও করে ফেলল। কাপড় টেনে মাথায় ঘোমটা পরাতে পরাতে মেয়েমানুষটা কয়েক পা সামনে এসে এবার সসংকোচে কে বলে আঁতকে উঠল--- হায় আল্লা! রমযান গলাটাই শুনল, মুখ দেখবে কি, তার মনে হলো, আজ, এখনি দুনিয়া ধ্বংস হবে।

[মেঘপাহাড়, পৃষ্ঠা নাম্বার---২০]

এরকম আবছায়ার মাঝে ভুলভুলাইয়ার সিঁড়িগুলি ততোধিক অন্ধকারাছন্ন মনে হয়। এবং পাঠক পা-হড়কে ভুল-পথেই পথ খুঁজে ফেরে!

কিন্তু ওয়াসি আহমেদ আদতে আমাদের কোনো চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি অবস্থানে রাখতে চান নাই। তিনি এগিয়েছেন বড়ই কৌশলে। ওয়াসির স্থির-লক্ষ্য কিন্তু অন্য-জালে। এবং তার ইঙ্গিত তিনি রেখে গিয়েছেন বহুভাবে। বহুরকম করে!

এরকম পরাবাস্তবতার বা অতি বাস্তবতার অসংখ্য নজির রেখেও কৌশলি-লেখক ওয়াসি আহমেদের টার্গেট কিন্তু ভিন্নখাতেই ধাবিত হয়েছে! তাঁর টার্গেট বার্ট্র্যান্ড রাসেলের ‘উইল টু ডাউট’ এর দিকেই ক্রমে ক্রমে বিস্তৃত হয়েছে।

নাতিদীর্ঘ এই উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়ে’ কী আছে?

এক মানুষের চিরপ্রস্থানের চমকপ্রদ-বর্ণনা দিয়ে শুরু হওয়া এক উপন্যাস। সেই প্রাচীন-আখ্যান--- শহুরে মানুষের গ্রাম অভিমুখে-যাত্রা। অতঃপর স্বপ্নপূরণের সেই ক্লিশে-ম্যাড়ম্যাড়ে যবনিকা। কিন্তু না, ওয়াসি আহমেদ এত সহজেই ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তাছাড়া ওয়াসি আহমেদের লেখাপত্র ‘সহজপাঠ’ও নয়। পাঠককে ১০০% মনোযোগী না-হয়ে ওয়াসি আহমেদ পড়া একেবারেই অসম্ভব!

এবং তাঁর গদ্য-ভঙিমা ‘জলো’ নয় একেবারেই। বরং প্রতিটি বাক্য থেকে আভিজাত্যের আভাখানি বিচ্ছুরিত হয়। হতেই থাকে। এ বড় বিষম-ক্যাচাল!

কত কথাই না বলে গেলেন লেখক! এত স্বল্প পরিসরে কত কী? লেখক নিজের পলিটিক্যাল-আইডিওলজিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কত ব্যক্তি-চিন্তা, ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনাকেই না পর্দার ওপাশে রেখে দিলেন! সদ্য বিধবা রাবেয়া বানুর ব্যক্তিগত শোক-সন্তাপের কোনো চিহ্নই তাই পাঠক দেখতে পেল না! এমনকী সন্তানদের মাঝেও তেমন আহাজারি দেখা গেল না। জেআরভির নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যই সকলে যেন মরীয়া! তাঁদের শোক করার সময় কই? আহাজারি করার মানসিকতা কই? ব্যক্তির চাইতে কর্মই বড়। কর্মই প্রধান! ফলত সকলে মিলেই ছুটতে শুরু করলেন সেই কর্ম-অভিমুখেই।

‘মেঘপাহাড়’ লিখবার সময়ে ওয়াসি আহমেদের কীসের এত ভীষণ তাড়া ছিল? কুসুমকে নিয়ে পারিবারিক-সংঘাতের চিত্রগুলি বোধকরি আরেকটু বড়-পর্দায় এবস্ট্রাক্ট করে আঁকা যেত। বা কুসুমের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন! কুসুম কেন-ই বা, কিংবা কীভাবে সকলের বিশ্বাসের-পাহাড় ভেঙ্গেচুরে দিয়ে নিজেকে এত সহজে সমর্পণ করেছিল জালালুদ্দিন রিজভীর কাছে? অথবা জালালুদ্দিন রিজভীই বা কেন বা কীসের তাড়নায় কুসুমকেই আকড়ে ধরেছিল? বা কনিষ্ঠপুত্র কামরানের ম্যাচিউর্ড বয়সের আইডিওলজিকেও আরো খানিকটা উন্মোচন করলে পাঠকের কৌতূহলী-গবাক্ষে কিছুটা খোলাআলো-খোলাহাওয়া খেলা করতে পারত।

নারীশিক্ষা, সমাজরূপান্তর, গ্রামের প্রতি ভালোবাসা, পিছুটান, মানব-কল্যাণে যত কিছুই ব্যয়িত হোক, যত রব উঠুক চারপাশে, তোলপাড় হয়ে যাক এতদিনের গড়ে-ওঠা-ইমেজ---আদতে তো লেখক আমাদের নিয়ে যাবেন তাঁর কাঙ্খিত গল্পের শেষ সীমান্তে। নিয়ে যাবেন তাঁর নিজস্ব মনোভূমের যে সমাজ, সেই সমাজেরই টানাপোড়েনে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে শ্রেণীবিভেদ তা ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের তিনি বসিয়ে দেবেন এক-কাতারে।

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চড়ে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
[শক্তি চট্টোপাধ্যায়]

কার্ল মার্কসের পাঠ তো তিনি খামাখাই কামরুলকে দেন নাই। কামরুল মানে কিন্তু এপাশে বসে থাকা পাঠক! কিংবা দর্শক। পর্দার অন্তরালে বসে থেকে যারা দেখছেন---

এই ভবের নাট্যশালায়, মানুষ চেনা দায় রে। মানুষ চেনা দায়।

লেখক মাত্রই ভগবান। তিনিই বাঁচান ও মারেন। তিনিই সারান এবং সারেন। তিনিই শত চরিত্রের জন্মদাতা, তাদের রক্ষাকর্তা! সহস্র-চরিত্রের এই একজনই মাত্র জিম্মাদার। তো এক্ষণে সেই লেখক-ভগবান আমাদের নিয়ে যাবেন তাঁর নিজের ইচ্ছেপূরনের গল্প শোনাতে--- মানুষের একই সমতলের গল্প! মানুষের মাঝে ভেদাভেদ-রেখা মুছে দিয়ে এক দূর-স্বপ্ন সফলতার-গল্প!

যেহেতু এই সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা লেখকের অনুকূলে নয়, এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জাও লেখকের আওতার ভিতরে নয়, সুতরাং ওয়াসি আহমেদ আমাদের আঁকাবাঁকা পথের খানা-খন্দে হোঁচট খাইয়ে, ভুলভুলাইয়ার অন্ধকারে ইচ্ছেমত নাকানিচুবানি খাইয়ে নিয়ে যাবেন তাঁর ইচ্ছেপূরণের গল্প শোনাতে--- এ-কথা কান-খাড়া-করে-রাখা যে কোনো পাঠকেরই আগাম বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।

এক্ষণে কার্ল মার্কসের ব্যাপারস্যাপারকে প্রতিষ্ঠা দিতে হলে লেখককে তো তাঁর শ্রেণীচ্যুত হতেই হয়। না হলে সে কী করেই বা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দেবেন? ফলত ধরাছোঁয়ার বাইরে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন-পূরণের জন্য যে সংগ্রাম, তাকে সফলতা দিতে হলে শেষমেশ বাড়ির গৃহপরিচারিকাই ভরসা। অবলা-গৃহপরিচারিকার বিশুদ্ধ-গর্ভখানিতে আপাতত শ্রেণীসংগ্রাম সফল করে তোলার প্রথম বীজটি বপন করা যাক। এবং লেখক ওয়াসি আহমেদ কিনা তাই করলেন। নিজের ইচ্ছেপূরণের গল্পখানি খানিকটা কৌশল করে সুসমাপ্তি টানলেন। ওপরতলার বাসিন্দা জজ জালালুদ্দিন রিজভী ওরফে জেআরভির উষ্ণ-শোণিত নিয়ে গেলেন একেবারেই নিচুতলার বাসিন্দা, হাভাতে ঘরের মুখ্যসুখ্য কুসুমের গর্ভে। এতে কি পুত্র কামরানের মনে-মনে-দেখা স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটল? হতেও পারে। কারণ সমাজ-সংসার-আইনের শৃঙ্খলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জন্ম নেয়া রিজভী-কুসুম যুগলের পুত্র আরমানকে দেখে কামরানের অতীত-কৈশোর যেভাবে হামলে পড়লো, তাতে করে মৃত-পিতার কুকীর্তির চাইতেও বড় হয়ে দেখা দিলো কিনা মানবতা! ইচ্ছেটাতো অমনই ছিল নাকি? জেআরভির ইচ্ছে তো তাই ছিল! তিনি তো বরাবরই চেয়েছিলেন পুত্র কামরানকে লিবারাল হিউম্যানিস্ট বানাতে।

সমতল-সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং শ্রেণীবৈষম্যকে উৎপাটিত করতে লেখক ওয়াসি আহমেদ তাঁর উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়ে’ ভীষণরকম সচেতন থেকেছেন। এবং তা থাকতে গিয়ে জালালুদ্দিন রিজভীর পুত্র কামরানের মনঃস্তত্বেরর ওপর জোর-আলো ফেলেছেন---

“কথাটা সুভাষ সরকার শুনল সবটুকু মনোযোগ দিয়ে। দেখে মনে হলো খুব বিস্মিত হলো। চোখজোড়া কামরানের দিকে স্থির তাক করে রেখে সে যেন কথাটার মানে ধরতে সময় নিল। তারপর বলল--- যা সত্য তাতো একদিন প্রকাশ পাবেই। দেবতার মতো মানুষকে নিয়ে স্ক্যাণ্ডাল।

কামরান বলল---মুশকিলটা তো আপনারা এখানেই বাঁধিয়ে বসে আছেন। দেবতা-ফেবতা বানিয়ে এখন আর মানুষ বলে মানতে নারাজ।

মানে?

তিনি তো মানুষই ছিলেন।

আপনি কি কোনো খোঁজটোজ নিয়েছেন?

কথার পিঠে কামরান জবাব দিলো না। একটু পর বলল--- খোঁজ যদি নিয়েই থাকি, আর তাতে যে গুজবটা উড়ছে তা সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে?

কামরান দেখল, সুভাষ সরকারের মুখ বেকেচুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণা, হতাশা অবিশ্বাস--- সবকটা দানব একসঙ্গে তার মুখে ঘুষি চালাচ্ছে।

কামরান বলল--- বলুন তাহলে কি? জালালুদ্দিন রিজভীর বারো বছরের কাজকর্ম পণ্ড হয়ে যাবে, মিথ্যা হয়ে যাবে? এ তো ফানুষ নয় যে, একটা ফুটো করে দিলেন আর, অমনি সব শেষ হয়ে গেল।

কামরান একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপল। সুভাষ সরকারের মাথাটা যেন বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। কামরান উঠল। সুভাষ সরকার কিছুই বলল না। কামরানের সাথে দরোজা পর্যন্ত এসে বলল--- কবে যাচ্ছেন?

কোথায়?”

[ মেঘপাহাড়--- পৃষ্ঠা নাম্বার ১১৫/১১৬]

এই একটি মাত্র শব্দ ‘কোথায়’, মাত্র এই একটি শব্দকে নিক্ষেপ করে লেখক আমাদের চোখের সামনেই নির্ধারণ করে দিলেন নিচুতলার কুসুম-পুত্রের ভূত-ভবিষ্যত। এবং রিজভীর কনিষ্ঠ-পুত্র কামরানের হাতে তুলে দিলেন সমাজ-বদলের চাবিটি।

তাই তো! কামরানের এখন বহু কাজ বাকী! পিতার রেখে যাওয়া আধখাওয়া-স্বপ্নগুলির বাস্তবায়ন কামরান ছাড়া আর কেই-বা করবে বা করতে পারবে? জেআরভি তো হরহামেশাই আভাষে-ইংগিতে, স্বপ্নে-বিভ্রমে কামরানকে এসব কথাই বলতে চাইছেন। যদিও কামরানও সামান্য বিভ্রান্ত! একটু-আধটু টলোমলো!

কিন্তু কামরানের শক্তির উৎস--- তার কাছে রাখা আছে নিজবংশের প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করা ঝকঝকে বল্লমখানি। এই বল্লম কি আদতে কাস্তের মতোই কোনো হাতিয়ার? পাঠকের মনে সহস্র প্রশ্নের উন্মেষ! কামরান কি একা একা লড়াই করতে পারবে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে? পিতার রেখে যাওয়া অজস্র- অমীমাংসিত-কাজ, গোপন-প্রণয় আর দৃশ্যমান-পুত্র আরমানকে সাথে নিয়ে বা আড়ালে রেখেই সে কি গড়ে তুলতে পারবে বৈষম্যহীন কোনো সমাজ? সে সমাজের প্রতিটা বাসিন্দা একই-রকম আদলের। একই বিত্তের অন্ন-বস্ত্র তাদের দৈনন্দিন চাহিদাকে পরিপূর্ণ রাখে।

লেখক ওয়াসি আহমেদ যা-ই বলেন না কেন, সেসব কিন্তু কিছুতেই উচ্চকিত নয়। বরং কিছুটা যেন মৃদু অথচ ক্ল্যাসিক। ফলত অতি সাধারণ-বিষয়ও অসাধারণ হয়ে ওঠে ওয়াসির লেখনীর-গুণে। তবে এ-কথাও স্বীকার্য--- ফাঁকিবাজ পাঠকের জন্য ওয়াসি আহমেদ কিছুতেই পাঠ্য হবার নন। এমনকী ‘তরল-পাঠকের’ জন্যও নন তিনি। ‘তরল-পাঠক’ তাঁহারাই , যাঁহারা অতি দ্রুততায় গ্রন্থের পাতা-উল্টে যেতে চান এবং গ্রন্থের সারমর্ম আত্মস্হ করতে অপারগ হোন। অবশ্য তাঁরা চানও না কোনোকিছু আত্মস্হ করতে। তাঁরা চান সেইসব গ্রন্থ, যাতে ‘সারমর্ম’ বলে কিছুই থাকে না। থাকেনা কোনো খটমটে-দর্শন বা মনগড়া-মনস্তত্ত্ব। যা থাকে, তা হলো সস্তা-বিনোদনের নামে অতি কাঁচা-আবেগ! আর পুতুপুতু-প্রেমের রম্যরসে-ভরপুর চটুল আমন্ত্রণ!

অতি সাধারণ বিষয়ও ওয়াসি আহমেদের কলমের টানে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ তাঁর রয়েছে জাদুকরি বাক্যবিন্যাস ও সূক্ষ্ণ- অন্তর্দৃষ্টি। রয়েছে নিজস্ব জীবনদর্শন। ওয়াসি আহমেদের গদ্যের-ভঙ্গিমাও তাঁর একান্তই-নিজস্ব।

‘মেঘপাহাড়ের’ ঝকঝকে বল্লমটিও আদতে ওয়াসি আহমেদের মেধার মতোই শাণিত ও অভিজাত। আমরা অপেক্ষায় থাকি--- ওয়াসি আহমেদের কলম-বল্লমটি বারংবার ঝলসে ওঠবার জন্য। অন্তত কিছু আলো বিচ্ছুরিত হোক। কিছুটা তেজ। সবকিছুই তো ক্রমে নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। চারপাশের থইথই অন্ধকারের মাঝে পথ চলার জন্য নির্মল-আলোর আজ বড় অভাব! ওয়াসি আহমেদের লেখা মানেই কিন্তু সেই আলোর-আভাষ! সেই অধরা-আলোর-বিন্দুটি!

আমাদের চারপাশে স্তূপ-আবর্জনার মতো উঁচু-হয়ে-ওঠা ‘জলো-সাহিত্যের’ মাঝ থেকে পাঠক ওয়াসি আহমেদের লেখাকে খুঁজে নিক, তাঁর গ্রন্থাবলী বোদ্ধাপাঠকের হাতে পৌঁছাক--- কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের তরে আমার এই শুভকামনা চিরকাল রইবে..।
-------------
 

আলোচক পরিচিতি:
পাপড়ি রহমান
কথাসাহিত্যিক। সম্পাদক
ঢাকায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ