বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যে আলাদা একটা অবস্থানে পৌছে গেছে সেটা আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শহীদুল জহীর, জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ূন আহমেদ সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান, শাহাদুজ্জামান, শাহীন আখতার, এবং আরও অনেকের লেখা থেকেই জেনেছি। আমরা এও জানি যে বাংলাদেশের সাহিত্য বা সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ, নিচুতলার মানুষ, মধ্যবিত্তের সংকট ও সংশয়, এসব খুব সহজভাবেই বিষয় হিসেবে এসেছে। ওয়াসি আহমেদ একজন মেধাবী কথাসাহিত্যিক হওয়া স্বত্তেও তাঁর নিভৃতচারীতার কারণে খুব লক্ষ করে পড়েননি তাঁকে অনেকেই। কিন্তু যারা পড়েছেন তাদের কেউ কেউ তাঁকে চেখভীয় বলেছেন। কেউবা বলেছেন, নাহ, তাঁর লেখায় ও হেনরীও আছে। আবার কেউ বলেছেন খোদ আখতারুজ্জান ইলিয়াসের উত্তরসূরী তিনি। আমি বলছি, ওয়াসি আহমেদ কারও পূর্ব বা উত্তরসূরী নন। তিনি তার নিজস্ব স্বত্তায় অনন্য ও এক। এট্টুন একটা দ্যাশ, বাংলাদেশের মানুষের কথাই অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ সব গল্প আছে।
কীভাবে তাকে আলাদা বলা যায়? কেনই বা তাঁর সাহিত্য পাঠকের কাছে কৌতুহল উদ্দিপক বলে হয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে তাঁকে আরও বেশী বেশী পড়তে হবে। এই লেখাটি শুধুমাত্র তাঁর কয়েকটি গল্পের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ মাত্র।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ‘বরফকল’ এর সেই শেফালী বেগমের কথা, যে চরিত্রটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত কতশত নারীকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। ‘এট্টুন দ্যাশ, কই যাই’ এই বাক্যটি পড়লেই যে কেউ বুঝে যাবে পলায়নপর জীবনের মর্মার্থ কি। ‘যুদ্ধের পলায়নপরতা’ বোধটা কতটা ভয়ংকর এবং জীবিতকালে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা আদৌ সম্ভব কিনা সেই প্রশ্নটি ওয়াসি আহমেদকেও তাড়িত করেছে।
‘খাঁচা ও অচিন পাখি’ গল্পটি সম্ভবত ওয়াসি আহমেদের অন্যতম একটি সেরা গল্প। মুক্তিযোদ্ধা সুলেমান যুদ্ধে দুটি হাত আর পা হারিয়ে একটি পুনর্বাসনকেন্দ্রের হুইল চেয়ারে বসে আছে। তাঁকে বিদেশী দাতাসংস্থার লোকজন এবং অন্যান্য দর্শনার্থীরা দেখতে আসছে। তাদের সাথে সুলেমানের মশকরা টাইপের ডায়ালগগুলো আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও সেসবই তাঁর মনস্তত্ত্বের জটিল পীড়ন, ক্ষোভ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণার প্রকাশ। একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা্র বোধ যখন ‘যাদুঘরের শো পিস’ হয়ে দাঁড়ায় তখন নিজেকে একটা বানর ছাড়া আর কীইবা মনে হতে পারে? আর সুলেমান জানে, বানরের খেলা মজাদার হলেও তাতে খুব একটা আয় উন্নতি নেই। সুলেমানের কাছে তাই এসব শুধুই ডুগডুগির আওয়াজ, কে এলো, কে গেল, কী যায় আসে? সেকারণেই দর্শনার্থীদের সামনে আগবেড়ে ফাজলামোগুলো সেই করে। বিলেতী এমপি, সাংবাদিক, দেশি টিভি, সরকারী বাহিনী বলে কথা। ক্যামেরার সামনে জ্বলে ওঠা আলো আর জামা থেকে উড়ে আসা ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ, সবকিছু মিলিয়ে হৃৎপিণ্ড মুচড়ে যায় সুলেমানের। দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যেতে থাকলে সেই সরকারী বরাদ্দের পোকায় খাওয়া চাল, আটা-নুন-তেল। যে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিল একদিন, আজ কিনা ভন্ড রাষ্ট্রের কাঠপুতুল সে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মূল্যবোধহীনতা, সুলেমানের মগজের কলকব্জায় কামান দাগার মতন জ্বলে ওঠে। বিপথগামী এই মুক্তিযোদ্ধার ইতরামীর শাস্তি হয় যখন তদন্ত কমিটির এক সদস্যের বাঘের থাবা তাঁর উরুর হাড় মাংস আলাদা করে ফেলতে চায়। ডান হাতের চামড়া মুচড়ে দিয়ে বলে, ‘‘বেশি ব্যথা লাগে? ব্যাথাতো লাগবেই সোনা, কত বিখ্যাত এই হাত, এই ঠ্যাং! মনে পড়ে এই দুটোর কথা, কেমন ছিল দেখতে? নাকি মনেই নেই? এ দুটোর জন্যই তো জাতটা আজ স্বাধীন, ফ্রি। এমন ফ্রি জাত জগতে আছে!’’ ঝিমিয়ে পড়া কেন্দ্রের ঘুপচি ঘরে সুলেমানের দীর্ঘ, তালগোল-পাকানো ঝিমুনী জীবন ওয়াসী আহমেদের লেখায় যেভাবে উঠে এসেছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলা সাহিত্যে এটি একটি শ্রেষ্ঠ গল্প।
আবার দেখুন, ‘সাঁতার শেখার সূত্র’ গল্পের আজিজ মাস্টার বয়স লুকিয়ে চোট্টামী করে যুদ্ধ করে অল্পবয়সে মাথা এলোমেলো করে এলো। এই গল্প লিখতে গিয়ে গল্পকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন গ্রেনেড ফাটালেন না। কিন্তু এমন একটি চরিত্র সৃষ্টি করলেন যিনি স্বাধীন দেশে ফিরে এসে পানিতে মাথা চুবিয়ে রাখতেন যেন তার মাথা ঠান্ডা থাকে। একটি ঘোরলাগা অস্বাভাবিক চরিত্রের ভেতর পাঠককে ডুবিয়ে রাখলেন ওয়াসি আহমেদ। তিনি বাখ্তিনের দ্বিরালাপ সৃষ্টি করলেন গল্পের চরিত্রগুলোর ভেতর নানা বৈচিত্র, হতাশা বা উৎসাহ তৈরীর মধ্যে দিয়ে এবং পাশাপাশি পাঠকের ভেতরও সেইসব পরিস্থিতির সুক্ষ যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন অনায়াসে।
‘ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী’ গল্পে আমরা দেখি রাত ঘন হওয়া মাত্র যে গলিটি কুকুরের দখলে চলে যেত, যাদের হাঁকডাঁক আর জোটবাঁধা সন্ত্রাসে হারাম হয়ে যেত গলির প্রায় প্রতিটি চোখের ঘুম, সেই গলিটি থেকেই যখন সিটি করপোরেশনের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী কুকুরগুলোকে মেরে ফেলে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেল, তখন গলির মানুষের বুকে হাহাকার শূন্যতা নেমে এলো। রাতের পর রাত কুকুরবিহীন অবস্থায় পার হয়ে গেলেও ঘুম কিংবা মুক্তি মিলল না কারও। ‘কী যেন ছিল, কী নেই!’ এই হাহাকার বইতে বইতে একদিন তারা টের পেল যে গলিবাসিদের কিছু কিছু অসাবধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সাথে চালান হয়ে গেছে। কোন চরিত্র বা সংলাপ ছাড়াই কতগুলো ‘সমন্বিত মানুষের হাহাকার’ গল্পটিকে অসামান্য করে তুলল। ওয়াসি আহমেদ প্রমাণ করে ছাড়লেন গল্পের জন্য চরিত্রের প্রাধান্যের প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি ডায়ালগেরও প্রয়োজন নেই। ওসব ছাড়াও অসাধারণ গল্প লেখা যায়।
‘শেরশাহ্ ও তার অমেঘ পরিণতি’ গল্পের শুরুতে যেমন নামচরিত্রটির নাম বলা হয় আকবর। পাঠক দেখতে পায় বদরুর বউ তাকে ভেজা খড় দিয়ে ডলে ডলে গা ধুয়ে দিচ্ছে। পাঠক ভাবতে শুরু করে হয়ত কোন পুরুষ সন্তানকে কেন্দ্র করে গল্প ঘনীভূত হচ্ছে। বদরু যখন বউকে আনকোরা সাবানটি বের করে দেয় ঠিক তখুনি বোঝা যায়, গল্পের নায়ক একজন ‘গরু’ যার লেজটা যৌবনবতী মেয়েমানুষের বেণীআঁটা লম্বা চুলের মতন। ওয়াসী আহমেদের গল্পবলার এইযে চমৎকার মুন্সিয়ানা, তাকে অসামান্য ছাড়া আর কী বলব?
‘বীজমন্ত্র’ গল্পটিকে হয়ত একটি কল্পকাহিনী বলবেন অনেকেই। আসলে এর অন্তর্মূলে রয়েছে এমন এক অমানবিকতা যা পড়লে একধরনের ভীতিজনক প্রতিক্রিয়া হয়। পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরের স্থুলতাগুলো ধরা পড়ে। মানবিক সত্ত্বার পতন হতে হতে সমাজকে নির্বীজ করে তোলার যে প্রক্রিয়া তৈরী হচ্ছে তার একটা ব্যঙ্গাত্মক চিত্র দেখে পাঠক হিসেবে আমরা শিউরে উঠি। এই গল্পটির ‘বিষয়’ ওয়াসি আহমেদের মাথায় এলো কি করে তার পেছনের কাহিনীটি জানতে ইচ্ছে করে।
সত্যি কথা বলতে কি, ওয়াসি আহমেদকে পড়তে গেলে কোন ঘরানায় তাকে ফেলতে পারি না। অধিকাংশ গল্পই মনস্তত্ত্বকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। জীবনের সুক্ষ জটিলতাগুলো মধুর করে লিখতে পারার দক্ষতাটিই সামগ্রিকভাবে তাঁর লেখকস্বত্তাটিকে ফুটিয়ে তোলে। তবে অবশ্যই বলা উচিত, 'মুক্তিযুদ্ধ' বিষয় হিসেবে তাঁর গল্পে বারবার এসেছে, ছায়ায়, মায়ায়, কায়ায়। ওয়াসি আহমেদের লেখার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাষা। তাঁর গল্পভাষার প্রলেপে খুঁজে পেয়েছি রুক্ষতা, আর্দ্রতা, নির্লিপ্ততা, বিষাদ, ক্ষেদ,শ্লেষ... এমন সব মনস্তাত্তিক বোধ। কিন্তু একই সঙ্গে অবাক করেছে তাঁর ভাষার নম্রতা, শব্দের অন্তর্গত দ্বন্দ ও বিষন্নতা।
ওয়াসি আহমেদ বলেছেন, ‘জিজ্ঞাসাই লেখাকে ধাপে ধাপে জাগায়, আর শেষমেশ সেটাই হয়ে ওঠে পরিণামহীন পরিনতি।’ তার লেখায় সেই জিজ্ঞাসার বেশী ভাগই নিক্ষিপ্ত ছিল নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রতি। তবে সেখানেও কোন পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে মনে হয়নি বরং মধ্যবিত্তের অন্তঃসারশূন্যতার বিষয়টি এসেছে। ‘জগত ও জীবনের চালচিত্র’ নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল; ‘চারপাশের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা ইন্দ্রিয়াতীত জগতের প্রতীক মাত্র- প্রতিচ্ছবি নয়, সিমবল্।
এই সূত্রটি মেনে নিলে তাঁর অসংখ্য লেখাতেই ইন্দ্রিয়াতীত জগতটি চেনা যায়। যে জগতে দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ মগজকে নাড়া দেয়। আর এখানেই ওয়াসী আহমেদ হয়ে ওঠেন অনন্য।
0 মন্তব্যসমূহ