ঢোকার মুখে কাচের দরজায় গোটা গোটা অক্ষরে : পেছনের দরজা ব্যবহার করুন। নিচে ইংরেজিতে : প্লিজ ইউজ রিয়ার ডোর। দরজার হাতল ডান দিকে অর্ধেকটা ঘুরিয়েছে, এমন সময় লেখাটা চোখে পড়তে হাত সরিয়ে নিল তপু। কী ব্যাপার, ঢুকতে মানা করছে কেন? হাতলে চাপ পড়ামাত্র দরজাটা খুলি-খুলি করছিল, একটু হলে খুলে যেত। দরজার ওপারে আলো কম, কাচটাও টিন্টেড, ভেতরে কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় এখানে দাঁড়ানোও অশোভন। পেছনের পথটা কোন দিকে?
তপু সরে দাঁড়াল। বড় রাস্তায় ফিরে বাড়িটাকে ভালো করে খেয়াল করল। বাড়ি নয়, ভবন। মাঝারি উচ্চতায়, চোখে পড়ে এমন জায়গায় দুধসাদা মার্বেলে নামফলক : কর্মীসংঘ। ভবনের অন্য কোথাও সাদার চিহ্ন নেই; মসৃণ কালো মার্বেল টাওয়ার খাড়া উঠে গেছে মহাশূন্যে। এক দুই তিন পাঁচ করে আঠারো পর্যন্ত গুনল তপু। আর পারল না, গুলিয়ে ফেলল।
শহুরে কোলাহল থেকে দূরে ছিমছাম গাছপালায় নিরিবিলি, প্রায় অবাস্তব ভবনটা তাকে চুম্বকের মতো টানতে লাগল। কিন্তু পথ কোন দিকে? আশপাশে মানুষজন নেই যে জিজ্ঞেস করবে। বেলা সোয়া দশটায় জায়গাটা নিঃসাড়, জনশূন্য। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ির হুস্হাস্, এই পর্যন্ত। আর কোনো শব্দ নেই, কলরোল নেই। এত বড় দৈত্যপুরী, প্রতি তলায় কাচবসানো ওগুলো কি জানালা? জানালা হলে আটকানো কেন? লোকজন কোথায়? জানালায় একটাও মুখ নেই কেন?
বুকপকেট থেকে খামসমেত টাইপ করা চিঠিটা বের করে তপু। গত সন্ধ্যায় পেয়েছে এটা। এরই মধ্যে শ-খানেকবার পড়া হয়ে গেছে। নতুনত্ব কিছু নেই, তারপরও ভাঁজ খুলে চোখ বোলাতে রোমাঞ্চ হলো। প্রিয় পদপ্রার্থী, জাতীয় কর্মীসংঘ এই মর্মে সন্তুষ্ট যে, একজন মেধাবী, সৃষ্টিশীল, প্রাণচঞ্চল তরুণ হিসেবে আপনাকে সংঘের সুবিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য উপযুুক্ত বিবেচনা করা হয়েছে। আগামী অমুক তারিখ তমুক জায়গায় আপনাকে স্বাগত জানানো হবে। নিচে স্বাক্ষর অস্পষ্ট, সিল স্পষ্ট, তাং....। দামি অফসেট কাগজ, পেশিবহুল দুটো হাত আড়াআড়ি করে আঁকা মনোগ্রাম, ভেতরে একটুখানি ফাঁকা, তাতে ‘কর্মই উৎস’।
চিঠিটা যখন বাসায় পৌঁছে, তপু বাইরে ছিল। ছোট বোন মিনির হাতে পড়ে ওটা। মিনির হবি, কেবল হবি বললে পুরোটা বলা হয় না, ফেবারিট হবি হলো অন্যের চিঠি পড়া চেনা-অচেনা যে কারো চিঠি। প্রেম-ভালোবাসার চিঠি হতে হবে এমন কথা নেই। বিয়ের ঘটকালি, জায়গাজমির মামলা, পাওনাদারের গালাগালি, মৃত্যুসংবাদ যেকোনো বিষয়ের চিঠিই তার কাছে সমান কৌতূহলের। এমনকি চিঠির গন্ধ শুঁকে বাজারের ঠোঙা খুলে মর্ম উদ্ধারেও সে মহা আগ্রহী।
তপু ফিরল সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে। এদিকে মিনি অবিশ্বাস্য চিঠির কথাটা ঘরে সবার কাছে ফাঁস করে হুলস্থূল বাঁধিয়ে বসে আছে। প্রিয় হবির জন্য এই প্রথম সে বকাঝকা খেল না। অনেক রাত পর্যন্ত বাসায় উৎসব-উৎসব ভাব বজায় থাকল। বাবা-মা, ছোট বোন মিনি, বড় বোন রিনি (বিয়ের মাত্র এক বছর পর স্বামীর ঘর ছেড়ে এ সংসারে এঁটো কাঁটা হয়ে এর ওর পায়ে বিঁধেই চলেছে), বড় ভাই রাজীব (বি-কম পাশ করে আট বছর চাকরির ধান্দা করতে করতে ইদানীং প্রায়-- দার্শনিক একটা কথা বলে, চুরি-ডাকাতিতেও যোগ্যতা লাগে; কথা শুনে একদিন তপু-রাজীবের বাবা আহমদ হোসেন তেড়ে এসেছিলেন কী মনে করো, লাগে না? ন্যাকা!) সবাই যার যার মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। আহমদ হোসেন বাড়াবাড়ি করলেন, রাত আটটায় বৃষ্টি ভেঙে কোথা থেকে খাসির মাংস নিয়ে ফিরলেন। বৃষ্টি-জবজব ছাতা ভেঙে ঘরে ঢুকেই যেন লজ্জা পেলেন, মাংসের পুঁটলিটা বড় মেয়ের হাতে দিয়ে খুব আক্ষেপ করলেন। কী কাণ্ড দেখ তো, আগে জানলে সকাল-সকাল ফ্রেশ মাংস নিয়ে আসতাম; বলেছে তো টাটকা, এদের কথা! শোন, বেশি করে পেঁয়াজ, রসুন দিবি।
রাতের খাওয়া হয়ে গেছে এমন সময় রাজীব এসে বসল তপুর বিছানায়। এমনিতে দুজনের বড় একটা কথাবার্তা হয় না। মনে মনে রাজীবকে তপু ঘৃণাই করে। আট বছর বেকার থাকার ব্যর্থতা অন্য কারো ওপর চাপানো যায় না। রাজীব বলল-- চিঠিটা একবার দেখতে দিবি? কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল, দাদা এভাবে কথা বলছে কেন? অন্য সবার হাত ঘুরে ঘুরে চিঠিটা টেবিলের ওপরই ছিল। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিতে রাজীব খুব আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা পড়ল, খামের ঠিকানা পড়ল, আবার চিঠিটা উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে বলল, সাজগোজের চিঠি রে, ম্যালা মালকড়ি, না? তপু বলল না কিছু, নিজেকে একটু অপরাধী ভাবল। চিঠিটা এরপর নাকের কাছে ধরে রাজীব বলল-- গন্ধটা কী ডেলিশাস!
রিনির প্রতিক্রিয়া আলাদা। বিয়ের সময় কে যেন তাকে একটা শেফার্স বলপেন উপহার দিয়েছিল। কলমটা সে কাছ-ছাড়া করত না। বিয়ের স্মৃতি হিসাবে কলমটাই হয়তো ছিল মূল্যবান। সকালবেলা তপু জামাকাপড় পরছে, রিনি কলমটা তার শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল; তোকে দেবার মতো আমার কিছু নেই, এটা নে।
বিচিত্র অনুভূতির মধ্যে তপু নাশতা খেয়েছে, জামাকাপড় পরে বাইরে বেরিয়েছে। গত রাতটা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে গেছে। বিছানায় একরকম ছটফট করে কাটিয়েছে। এমন অভাবনীয় সংবাদ, অথচ রত্নার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না, যন্ত্রণাটা তাকে বিঁধছিল। গতদিন সকালে যখন রত্নার সঙ্গে দেখা হলো, তখন কে জানত রত্নাকে দেওয়ার মতো এমন একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে আছে। রাতে তার খুব ইচ্ছে করছিল, যে করেই হোক রত্নাকে খবরটা দিয়ে আসে। কিন্তু কাঁঠালবাগান আর মিরপুরের দূরত্ব কম না, তারওপর বৃষ্টি।
আজ সকালে রত্নাকে যখন তপু খবরটা দিল, কয়েক মুহূর্ত রত্না শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তপু অপেক্ষা করে ছিল, রত্না কী করে। রত্নার প্রতিক্রিয়া একেবারে অন্য রকম। তার চোখমুখ খুশিতে নেচে উঠল না, বরং দুচোখ বড় বড় টলমল ফোঁটায় ভরে উঠল। এক সময় দুহাতে মুখ আড়াল করল।
ঘড়ি দেখে তপু চমকাল, এগারোটা বাজে প্রায়। চিঠিতে ঠিক এগারোটার কথা বলা আছে। চিঠিটা পকেটে ভরে বড় রাস্তা থেকে আবার ভবনের সামনে চলে এল। এবার আর দরজার মুখে না দাঁড়িয়ে সামনা বরাবর হাঁটতে লাগল। কেন জানি ধারণা হলো, ভবনের শেষ মাথায় ঘুরপথে ঢোকার রাস্তাটা হয়তো পেয়ে যেতে পারে। ধারণাটা যে এভাবে ফলে যাবে তপু ভাবতে পারেনি। ঠিক যেখানে ভবনের সীমানা শেষ, তার ওপারে একটু দূরে খাড়া দেয়াল, মাঝখানে কংক্রিটের ঢালু সুড়ঙ্গ, অনেকটা বেসমেন্টে গাড়ি ওঠানামার পথের মতো। কী করবে, যাবে কি না ভাবছে, এমন সময় দেয়ালের গায়ে চোখ পড়ল, রিয়ার ডোর, পাশে তির চিহ্ন।
তপু ছুটতে শুরু করল, একে ঢালু পথ, তারওপর দ্রুত পা ফেলায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুড়ঙ্গের ভেতর। আধো অন্ধকারে মিটিমিটি হলুদ বাতি জ্বলছে দেয়ালের গায়ে। পরপর দুটো বাঁক ঘুরল তপু, তারপর হঠাৎ করেই সুড়ঙ্গ পার হয়ে বিশাল হলঘরের মতো জায়গায় এসে পড়ল। চারপাশে ঝলমলে আলো, এত আলো, তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তকতকে মেঝে, মসৃণ দেয়াল, ঘরময় মিহি শীতল সুবাস। তপু ঘড়ি দেখল, এগারোটা বাজতে মিনিটখানেক বাকি। সুড়ঙ্গ ধরে দৌড়ে নামায় তার বুক দ্রুত ওঠানামা করছে, এদিকে ঘড়ির কাঁটা তাকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। এত দূর এসে এবার কী করবে তপু ভেবে পেল না। এমন সময় সে খেয়াল করল ঘরের ভেতর ছোট ছোট টেবিল জুড়ে অনেক মেয়ে-পুরুষ। তাকে কেউ লক্ষ করছে না। সবচেয়ে কাছের টেবিলটা হাত-পনেরো দূরে। বুক-- উঁচু টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে একটা মেয়ে। কাছে-- দূরে আরো ক’টা টেবিল দেখতে পেল, প্রতি টেবিলে হয় কোনো ছেলের মুখ, নয় মেয়ের। তপু ছুটল। কাছের টেবিলের মেয়েটাকে লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে গত সন্ধ্যার চিঠিটা বাড়িয়ে ধরামাত্র অপরূপ সুরের মূর্ছনা তুলে গোটা হলঘর জুড়ে বেলা এগারোটার সময় সঙ্কেত বেজে উঠল। চিঠিতে একনজর চোখ বুলিয়ে মেয়েটা পাশের র্যাক থেকে চারকোনা কার্ড তুলে কী সব লিখতে শুরু করল। তপু কথা বলতে চাইল, কিন্তু এই পরিবেশে কথা বলায় কোথায় যেন অলিখিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপার আছে। কার্ডে মেয়েটা চটপট কীসব নম্বর বসাচ্ছে। কলম চালানোর তালে খোলামেলা মসৃণ কাঁধে রেশম-মিহি চুল দোল খাচ্ছে, উঁচু টেবিলে চাপ খেয়ে ফরশা স্তন বেলুনের মতো ফুলে উঠছে।
মিনিট দুয়েকের ব্যাপার, কার্ডে লেখাজোখা শেষ করে সেটা তপুর হাতে দিয়ে মেয়েটা অন্য একটা টেবিলে যেতে ইঙ্গিত করল। এ টেবিলে যার মুখ, সে মেয়ে নয়, বছর তিরিশের গোমড়ামুখো যুবক। কার্ডে কী একটা চিহ্ন বসিয়ে ঝটপট তাকে আরেক টেবিলে পাঠাল। এও একজন মেয়ে, অনেকটা প্রথমজনের মতো, বেলুনস্তনী। মুখ তুলে সে একটুখানিক শুষ্ক অভ্যর্থনার ভঙ্গি করল। তপু মুখ খুলতে যাবে, তার আগেই কার্ডে একটা টিক মেরে তাকে পাঠিয়ে দিল উল্টো পাশের টেবিলে। আবার গোমড়া মুখ, গোমড়া মুখ থেকে বেলুন, বেলুন থেকে গোমড়া। গোমড়া, বেলুন, বেলুন, গোমড়া।
কতক্ষণ এই করে কেটে গেছে তপু বলতে পারবে না। এক সময় খেয়াল করল সে এসে পৌঁছেছে হলঘরের শেষ মাথায়। এখানে একজন গোমড়ামুখো তার সাথে ব্যতিক্রমী আচরণ করল। কার্ডে দাগ মেরে তপুর দিকে হাত বাড়িয়ে গমগমে গলায় বলল, স্বাগতম। গলায় আন্তরিকতার আভাস নেই, চেহারাটা এমনভাবে সেলাই করা যাতে অন্য কোনো অভিব্যক্তি না ফোটে। ঠান্ডা হাতটা ছেড়ে তপু দেখল ঠিক পাশেই কাচের দরজা, মাঝখানে লাল হরফে প্রবেশ। নিচে ইংরেজিতে : এন্ট্রি। লোকটা কি তাকে ভেতরে যেতে বলছে? ভাবাভাবি বাদ দিয়ে তপু কেবল দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, লোকটার গলা শোনা গেল আজ না, কাল এগারোটায়।
ফিরতিপথ অত দীর্ঘ মনে হলো না। ঢোকার সময়ের মতো অনেক কিছুই সে খেয়াল করল না। বোধশক্তি কেমন ভোঁতা। বাইরে এসে দাঁড়াতে খেয়াল হলো কপালে, গলার খাঁজে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। ঘড়িতে বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট। মাত্র এইটুকু সময়, অথচ মনে হচ্ছিল কয়েক ঘণ্টা।
হাঁটতে হাঁটতে কর্মীসংঘের ভবন ফেলে অনেকটা দূরে চলে আসতে কার্ডটার কথা মনে পড়ল। চিঠিটা ওরা রেখে দিয়েছে, তবে কার্ডটা যত দূর মনে পড়ে, যে-লোকটা স্বাগতম বলেছিল, দাগ মেরে ফেরত দিয়েছে। বুকপকেটে হাত ছোঁয়াতেই কার্ড পাওয়া গেল। বের করে আনতে চিত্রবিচিত্র আঁকিবুকি। ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম, পাশে পরপর কয়েকটা নম্বর। এরপর কার্ডের এপিঠ ওপিঠ জুড়ে নানা রঙের বিদঘুটে চিহ্ন, আঁকিবুকি। কোনোটা পরিষ্কার টিক মার্ক, কোনোটা হিসাব মেলানোর পর ক্যাশের লোকেরা যেমন চিহ্ন দেয় সেরকম, কোনোটা গোল্লা, হাফ-গোল্লা, চন্দ্রবিন্দু, আবার শুধু বিন্দুও আছে। লাল, সবুজ, কালোর পাশাপাশি হলুদ, বেগুনি রঙ দগদগ করছে।
বাসায় গেল না তপু, রত্নার কাছেও না। তার ঘোরের মতো লাগছে। চিঠি পাওয়ার সাথে চাকরির যোগসূত্র নিয়ে সন্দেহ হতে লাগল। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে কাটাল। রত্নার মুখোমুখি বসে আলাপ করলে হয়তো হাল্কা লাগত, কিন্তু এ অবস্থায় রত্নার সামনে পড়তে ইচ্ছে হলো না। রত্না শক্ত মেয়ে না, হয়তো ভেঙেই পড়বে। পাশ করে ভাইয়ের সংসারে রত্না বোঝার মতো পড়ে আছে। বাচ্চাদের স্কুলে-টুলেও একটা কাজ জোটাতে পারছে না। আজ সকালে তপুর চিঠি পাওয়ার খবর শুনে রত্নার কেঁদে ফেলাই প্রমাণ সে কতটা অসহায়।
রাতে ঘরে ঢুকে শরীর খারাপের কথা বলে সবাইকে পাশ কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল তপু। ফল হলো উল্টো, মা চেপে ধরলেন। হঠাৎ করে শরীর খারাপ কেন? মাথা ধরা, জ্বর, না-কি আর কিছু? তপু রাগারাগি করল, শরীর খারাপ হলে এমনিতেই সে একটু বেশি হইচই করে। এত করেও বাবাকে এড়ানো গেল না। পোড়াখাওয়া মানুষ, সৌজন্যের খাতিরে একবার ছেলের কপালে হাত রেখে আসল কথাটা পাড়লেন, এপোয়েন্টমেন্ট লেটারে তো সেলারি, এলাউন্স কিছু লিখল না, কত পাবি বল তো? তপু এক কথায় পার পেতে চাইল, সবে তো আজই গেলাম, কাল জানব। আহমদ হোসেন আকাশ থেকে পড়লেন; বলিস কী! জয়েন করলি, বেতন জানিস না? কোলিগদের কাছ থেকে জানতে পারলি না! একাউন্টসে কথা বললেই তো...
রাতটা কাটল। ঘুমের ভেতর খাপছাড়াভাবে কয়েক বার হলঘরটা দেখল তপু, আর দেখল বেলু্ অসংখ্য, রং-বেরঙের বেলুন ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে।
পরদিন সুড়ঙ্গপথে পা দিয়ে তপু তাড়াহুড়ো করল না, হাতে যথেষ্ট সময়। ঢালু বেয়ে নামতে চারপাশে তাকাল। গতকালের মতোই লাগছে, টিমটিম আলোয় আবছা পথ। ধীরেসুস্থে বাঁক দুটো পেরোলো। তারপর হঠাৎ করেই সুড়ঙ্গের শেষ, হলঘরের শুরু। আজ প্রস্তুতি থাকায় আলোর ঝাপটা চোখে চাবুক মারল না। সার-সার ছোট-ছোট টেবিল, টেবিলের ওপর টবে বসানো মুখ; ছেলেমুখ, মেয়েমুখ। মাঝখানে বিস্তর ফাঁকা জায়গা, একটা টেবিল থেকে অন্য টেবিলের দূরত্ব কম হলেও দশ থেকে পনেরো হাত। তপু এগোতে এগোতে গতদিন যে টেবিল থেকে ফেরত এসেছিল, সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। পাশেই সেই কাচের দরজা, দরজায় গায়ে প্রবেশ ও এন্ট্রি। পকেট থেকে কার্ডটা বের করে টেবিলে রাখতে লোকটা চোখ তুলে তাকাল, তবে গতদিনের মতো স্বাগতম-টাগতম বলল না। কার্ডে চোখ বুলিয়ে টেবিলের ওপাশে উঁচু টুল থেকে নেমে কাচের দরজার নব ঘুরিয়ে পিছুপিছু আসতে ইঙ্গিত করল।
লম্বা করিডোর, দুপাশে ভেতর থেকে বন্ধ দরজা। করিডোরে পা দিয়ে এই প্রথম তপু কয়েকজন মেয়ে-পুরুষকে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে দেখল। চলার ভঙ্গিতে ব্যস্ততা থাকলেও তাদের স্বাভাবিক হাঁটাচলা তাকে আশ্বস্ত করল। তপু যাকে অনুসরণ করছে, সে একটা লিফটের দরজায় থামতে, তপুও থামল। পরপর কয়েকটা লিফট, দরজা খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, লোকজন উঠছে নামছে, হলঘরের একঘেয়েমির চেয়ে ভিন্ন চিত্র। আজকের দিনটা গতকালের মতো নয়, তপু ভাবল।
দশ-বাই-বারো’র ঘরটা কী ভীষণ ঠান্ডা! লিফটে করে লোকটা তপুকে নিয়ে এসেছে বাইশ তলার ওপর এই মাঝারি আয়তনের ঘরে। তপুকে বসিয়ে সে চলে গেল। তিনটা চেয়ারের মাঝেরটায় তপু বসে, দুপাশে চেয়ার দুটো খালি, সামনে সাধারণ মাপের সেক্রেটারিয়েট টেবিল, টেবিলে কাগজপত্র নেই, একটা মাত্র ইন্টারকম, টেবিলের ওপাশে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের হাতে ধরা তপুর কার্ড। প্রৌঢ় ড্রয়ার খুলে একটা ফোল্ডার বের করলেন, তারপর তপুকে চমকে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলেন, তপন হায়দার, এজ টুয়েন্টি সেভেন, ফাইভ ফিট নাইন এন্ড হাফ, ব্ল্যাক মোল অন রাইট আর্ম, চেস্ট থার্টিসেভেন, ননস্মোকিং, মাস্টার্স ইন সোসাল ওয়েলফেয়ার, আনম্যারেড, রেডি টু আনডারটেক চ্যালেঞ্জিং এসাইনমেন্ট, এক্সপেকটেড সেলারি ফাইভ থাউজেন্ড। ফাইভ থাউজেন্ড?
ভদ্রলোক যা-- যা বললেন, চাকরির দরখাস্তে তপু নিজ হাতে লিখে দিয়েছিল। চাকরির বিজ্ঞাপনে দরখাস্ত হাতে লিখতে হবে এমন শর্ত ছিল। ড্রয়ার থেকে ভদ্রলোক যে ফোল্ডারটা বের করলেন তাতে নিশ্চয় দরখাস্তটা রয়েছে।
ফাইভ থাউজেন্ড?
তপু আমতা আমতা করল। প্রথম চাকরি হিসেবে কি টাকার অংকটা বেশি হয়ে গেছে! কিন্তু এরকম অংকই যে তার দরকার। মুহূর্তে বাবা মা রিনি মিনি রাজীবের মুখগুলো ভেসে উঠল। রত্নার মুখটা ভেসে ওঠার কিছু নেই, সারাক্ষণ বুকের মধ্যে আছে।
টাকার কথায় তপু গেল না, বলল, আমার চাকরি খুব দরকার, আই নিড দ্য জব বেডলি।
চাকরি বলছেন কেন? আমরা এখানে কেউ চাকরি করি না। উই আর কমিটেড টু আওয়ারসেলভস, চাকরিতে কারো কমিটমেন্ট থাকে না। আমাদের মনোগ্রাম দেখেননি, কর্মই উৎস, এখানে সবাই কর্মী, আমরা কাজ করি, একটিভিটি জেনারেট করি। কেন, আমাদের নামটা খেয়াল করেননি-- কর্মীসংঘ। উই আর অল পার্টনার্স ইন হিউজ একটিভিটি। তবে হ্যাঁ, কাজের বিনিময়ে আমরা রেম্যুনারেশন পাই, হ্যান্ডসাম রেম্যুনারেশন। ফাইভ থাউজেন্ড...দ্যাটস পিনাট!
তপু কথা বলতে পারল না; সে যা ভেবেছিল ঘটনা তাহলে তার উল্টো। দরখাস্তে টাকার অংকটা বসাতে গিয়ে সে অনেক ভেবেছে। শেষমেশ পাঁচ হাজারের অংকটা যখন সাহস করে লেখা হয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল বেশি চাইতে ক্ষতি কী! এখন?
প্রৌঢ় তার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে ভারী চশমা, টকটকে ফরসা গায়ের রং, কপালটা বড় হতে হতে মাথার আধাআধি গিয়ে ঠেকেছে। এই মানুষটার পরিচয় তপু জানে না। ঢোকার সময় দরজায় কোনো নেমপ্লেটও লক্ষ করেনি। তবে যে ঢঙে আলাপ করছেন তাতে সন্দেহ থাকে না ইনি একজন কর্তাব্যক্তি।
বাড়িতে কে কে আছেন?
বাবা-মা আর ভাই-বোন।
আর?
রত্নার কথাটা বলা যায় না, রত্না তো এখনো হিসেবে আসেনি। তপু মাথা নাড়ল।
এই তাহলে, আর কেউ নেই?
নাহ্।
ঠিক আছে, উই উইল টেক গুড কেয়ার অব ইউ! পাঁচ হাজার চেয়েছেন, সেটা আপনার হিসাব। আমাদের হিসাব আলাদা, সে-হিসাব এর বেশি, অনেক বেশি। বেশিতে তো আপত্তি থাকার কথা না, কম হলে আপত্তি...
প্রৌঢ় হাসলেন, কিন্তু এ ধরনের কথায় হাসিটা যেমন খোলামেলা হওয়ার কথা, তেমন হলো না বরং রংহীন, বিবর্ণ হাসি। এত ফ্যাকাশে, রক্তহীন হাসি আর কাউকে হাসতে দেখছে বলে তপুর মনে পড়ল না। হাসিটা বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো নয়, বজ্জাতির চিহ্নমাত্র নেই, ‘আবার শত দুঃখেও নলিনী চন্দ্রের হাসি পাইল’ এমনও নয়। খোঁচা খাওয়া হাসি, মুখটা বেঁকেচুরে গেল।
ইন্টারকম তুলে কফি চাইলেন প্রৌঢ়। ঠান্ডা ঘরে উত্তেজনায় ভেতরটা লাফাচ্ছে তপুর। গতদিনের দ্বিধা-সংশয় কেটে গেছে। প্রৌঢ়কে অমায়িক বলতে হবে, বাড়ির কথা পর্যন্ত জানতে চাইলেন। একে কি নিচের হলঘরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে? ওরা মুখে খিল এঁটে বসে কেন? কিংবা সামনের দরজার বদলে পেছনের দরজা?
কফি শেষ হতে ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন। তপু চট করে দাঁড়িয়ে হাতটা নিল। চমকে গেল সে, বরফশীতল হাতটা তাকে কামড়ে দিল।
# #
পাঁচ হাজার টাকার অংক শুনে আহমদ হোসেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, বলিস কী! যা চেয়েছিলি তাতেই রাজি, এমনও হয়!
তপু বলতে পারত, পাঁচ নয়, পাঁচের বেশি, হতে পারে পাঁচের দ্বিগুণ; কিন্তু এইটুকু শুনে বাবা যেভাবে লাফিয়ে উঠলেন, বাড়িয়ে বললে নির্ঘাৎ অবিশ্বাস করবেন।
রিনি এসে বলল, বলেছিলাম না, তোর ভাগ্যে বেকারত্ব নেই, ওটা দাদার কপালে। দেখলি তো, কত বড় চাকরি জুটে গেল!
তপু মনে করতে পারল না এমন ভবিষ্যদ্বাণী রিনি কবে করেছিল। তবু রিনির মুখে কথাটা শুনে ভালো লাগল। তপু জানে, রিনির একটা খুব গোপন প্রেম আছে। ছেলেটা ব্যাংকে ছোটখাটো চাকরি করে। আগের বিয়েটা রিনির বড় দায়সারাভাবে সেরেছিলেন আহমদ হোসেন। বিয়েটা মোটেও বিয়ের মতো হয়নি। হয়তো সে-কারণেই ওটা টিকল না। রিনির যদি আবার বিয়ে দেওয়া যায়, তার প্রেমিক ছেলেটার সাথে!
সারাটা সন্ধ্যা তপু কাটাল রত্নাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরে ঘুরে। রত্নার চোখমুখ তৃপ্ত। হুড-তোলা রিকশায় রত্নার কোমর জড়িয়ে এরাস্তা ওরাস্তা অনেক ঘুরল। ফেরার কথা বলে রত্না অন্যদিনের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল না। রাত আটটা নাগাদ রত্নাকে নামিয়ে দেওয়ার সময় তপু অনেকক্ষণ ধরে তার ঘাড়ে-গলায় মুখ ঘষল। সুড়সুড়ি লাগলেও রত্না বাধা দিল না।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে একটা হিমঠান্ডা হাতের স্পর্শ তপু কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারল না।
পরদিন ঝুটঝামেলা ছাড়াই তপু কর্মীসংঘের একজন হয়ে গেল। কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর ব্যাপার মনে উঁকি দিলেও সে গায়ে মাখল না। নতুন চাকরির উত্তেজনার চেয়ে তাড়নাটাই অনুভব করল বেশি। ঘরে আহমদ হোসেনের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ তো আছেই, অন্যদের বেলাও সেটা কম কিছু নয় (কেবল রাজীবের প্রতিক্রিয়াটা সঙ্গত কারণেই কিছুটা প্যাঁচালো)। অন্যদিকে রত্না তো একাই একশো। রত্না আর চাকরি, দুটো জিনিস যে জট পাকিয়ে একাকার হয়ে আছে, তপু আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারেনি।
একদিন দুইদিন গেল। তপু বসে বসে হাই তুলে সময় পার করে দিল। তাকে কিছু করতে দেওয়া হয়নি। কেবল দ্বিতীয় দিনে একটা কাগজে দস্তখত দিতে হলো। আগে কখনো কাজ করেনি বলে অফিস-আদালতের কাগজপত্র তার অচেনা। তবে এটা যে বেতনের বিল জাতীয় কাগজ, পরিষ্কার বোঝা গেল। টাকার অংকটা তিন-চারবার পড়ল। দশ হাজার ছাড়িয়ে শতক, দশক, এককের ঘরেও খুচরা অংক। ভয়াবহ ব্যাপার, কাগজটায় সে দস্তখত করল। এ দুই দিন আর কারো দেখা পেল না তপু। তৃতীয় দিন বুদ্ধি করে বাসা থেকে কিছু পত্রপত্রিকা এনে রেখে দিল ড্রয়ারে। একঘেয়েমি কিছুটা এতে কাটল, কিন্তু ঘন ঘন এত বেশি হাই উঠতে লাগল, তার ভয় হলো ঘুমিয়ে না পড়ে। আকাশছোঁয়া ভবনের বাইশ তলায় একটা মাঝারি আয়তনের ঘরে সময় কাটানোটা বিড়ম্বনার মতো মনে হলো।
দুপুরের দিকে পা টিপে টিপে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কেন জানি মনে হলো তার এই বেরিয়ে আসার সাথে গোপনীয়তার একটা যোগাযোগ রয়েছে। দুপাশে ভেজানো দরজা, সামনে অন্তহীন করিডোর। কোথায় এর শেষ, তপু আন্দাজ করতে পারল না। একেকটা করিডোর কিছু দূর গিয়ে ডানে-বাঁয়ে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছে। কয়েকটা ভেজানো দরজা পার হলো তপু। দুপাশে দেয়ালের গায়ে নানা ধরনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন, সঙ্কেতগুলো বুঝতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। একটা দরজার সামনে সে থামল। ভীষণ ঔৎসুক্য জাগল, যদি দেখা যেত ওপাশে কী? ভাবতে না ভাবতে সে কাজটা করে ফেলল। হাতলে মৃদু চাপ দিতে দরজাটা খুলে গেল। মস্ত ঘর, নিচের হলঘরের মতো, সার-সার টেবিল, মাথা ঝুঁকিয়ে কাজে ব্যস্ত অগুনতি নারী-পুরুষ। আগন্তুকের উপস্থিতি ওরা লক্ষ করল না কিংবা গ্রাহ্য করল না। বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন নয়, দরজাটা ছেড়ে তপু এগোল। এবার উল্টোদিকের একটা দরজার হাতল ঘোরাল। মাথা বাড়িয়ে সে অবাক হলো, এটা কি অফিস, না শাকসবজি, ফলমূলের নার্সারি। চারপাশে কাচমোড়া বিশাল খামার, সবুজের সমারোহে দৃষ্টি অবশ হয়ে এল। গ্রিন হাউজ? দরজা ছেড়ে তপু পা বাড়াল। কিছুু দূর গিয়ে আবার দরজার হাতলে হাত; যন্ত্রপাতিঠাসা ঘর, নানা বর্ণের আলো ঠিকরে যন্ত্রগুলোর চেহারা কীরকম মোহময়।
একের পর এক দরজা তপু মেলে ধরছে, ফের বন্ধ করছে। কাজটা উচিত না অনুচিত এ নিয়ে ভাবাভাবিতে যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে এটাও একটা কাজ, সূক্ষ্ম নেশার অনুভূতিও যেন রয়েছে। এত বিশাল কর্মযজ্ঞ, তপু খেই হারিয়ে ফেলল, মনে হলো গোটা পৃথিবীটাই এখানে ঠাঁই পেয়েছে। হঠাৎ সে চমকে লক্ষ করল কোথা থেকে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে, কর্মীসংঘের এই ভবনে যা কল্পনাতীত। কাছাকাছি একটা ভেজানো দরজা, শব্দটা কি দরজার ওপাশ থেকে আসছে? এক মুহূর্ত তপু অপেক্ষা করল, তারপর হাতলে চাপ দিয়ে দরজাটা খুলে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল। অন্য ঘরগুলোর মতো এটাও বিশাল, টেবিল-চেয়ার নেই, তার বদলে সার-সার খাট, হাসপাতালে যেমন ছোট-ছোট লোহার খাট দেখেছে, সে-রকম। খাটে সাদা চাদরে গা ঢেকে শোয়া অনেকগুলো যন্ত্রণাকাতর মানুষ। দরজা খোলার সাথে সাথে সম্মিলিত গোঙানির আওয়াজ প্রকট হয়ে কানে ঝাপটা মারল। মাত্র ক’টা মুহূর্ত, তপু দরজা ঠেলে সরে দাঁড়াল।
পরদিন প্রৌঢ়ের ঘরে ডাক পড়তে তপু ছুটল। মুখোমুখি বসামাত্র মনে হলো অনেক ব্যাপারেই তার কথা বলা দরকার। কোনটা রেখে কোনটা বলে, ভাবতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলল। প্রৌঢ় চোখ তুলে তাকাতে সে বেফাঁস বলে উঠল, এখানে হাসপাতাল কেন?
প্রৌঢ় কথাটা বুঝতে পারলেন না। ফ্যাকাশে চেহারায় শূন্য দৃষ্টি ফুটে উঠতে তপু প্রশ্নটা আবার ছুড়ল। পরমুহূর্তে তার মনে পড়ল, সে ওখানে পা টিপে চোরের মতো গিয়েছিল। এ জন্যই কি তিনি তাকে আমল দিচ্ছেন না?
কিন্তু প্রৌঢ়ের হাবভাবে তেমন মনে হলো না। শূন্য দৃষ্টিটুকু তিনি তেমনি ধরে রাখলেন, তারপর স্বগতোক্তির গলায় বললেন, হাসপাতাল কেন হবে? ওরা ফ্রেশ রিক্রুটস।
ফ্রেশ...
প্রৌঢ় ঘাড় নাড়লেন।
আমার মতো?
প্রৌঢ় আবার ঘাড় নাড়লেন।
আমাকেও ওখানে যেতে হবে?
সবাই যায়, আমাকেও যেতে হয়েছে।
কয়েক মুহূর্ত তপু কথা বলতে পারল না। চোখ তুলে সে মুখোমুখি তাকাল। ফ্যাকাশে চোখেমুখে বিষণ্নতা। এত বিষণ্ন, এত বিষণ্ন, তার মনে হলো চিমটি কেটে বিষণ্নতা তুলে আনা যাবে।
কিন্তু হাসপাতাল কেন? তপু আবার আগের প্রশ্নে ফিরে গেল।
হাসপাতাল কে বলল?
ওরা কি অসুস্থ?
তা কেন হবে?
আমাকে ওখানে যেতে হবে? আমি অসুস্থ?
প্রৌঢ় চুপ করে থাকলেন। চেহারা কাঠকাঠ, ভাবলেশহীন। তপু দেখল এ চেহারায় কোনো ভঙ্গি নেই। ভঙ্গিহীন, অভিব্যক্তিহীন ঠোঁট চোয়াল চিবুক। ভারী কাচের আড়ালে পাথুরের চোখ। তাকিয়ে তার অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হলো সত্যিই সে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
পঞ্চম দিন তপুকে ডেকে নেওয়া হলো সাদামাটা একটা ঘরে। হাসপাতালের ব্যাপারটা মাথায় থাকায় সে অপেক্ষায় ছিল, যখন তখন ডাক আসবে। তবে এ ঘরে যখন তাকে এনে বসানো হলো, সে ঠিক আন্দাজ করতে পারল না কী ঘটবে? পরনে ঢিলেঢালা ডাক্তারি এপ্রোন নেই, তবু ডাক্তার ভদ্রলোককে তপু ঠিক শনাক্ত করল। বুকে স্টেথো চেপে তিনি জোরে কাশতে বললেন। উলঙ্গ হতে বলায় তপু বিব্রত হলো।
উঁচু, লম্বা টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে তপু নিজেকে ছেড়ে দিল। উন্মুক্ত নিম্নাঙ্গে হাতের চাপ দিয়ে ডাক্তার বললেন, যৌন অভিজ্ঞতা আছে? প্রশ্নটা তপু খেয়াল করতে পারল না। তিনি তখন ভেঙে বললেন, এ্যানি এ্যক্সপেরিয়েন্স অব সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স? তপু মাথা নেড়ে ‘না’ জানাতে ডাক্তারের হাত থমকে গেল।
কাটাছেঁড়ার কাজটা ডাক্তার খুব যত্নের সাথে করলেন। অপ্রাসঙ্গিক দুটো মাংস গোলক দক্ষতার সাথে বিচ্ছিন্ন করে নিপুণ হাতে সেলাই করলেন। তপু টের পেল না। কাস্ট্রেশন চেম্বারের ছিমছাম বিছানায় সাদা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষরাতের দিকে ঘুম ভাঙতে গোঙানির আওয়াজ এল কানে। এপাশে-ওপাশে সার-সার খাট। এটা সেই হাসপাতাল, তপু নিশ্চিত। নিম্নাঙ্গ জুড়ে তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতিটা প্রথমেই মনে এল। হাতে ছুঁয়ে অনুভব করল চাদরের নিচে জামাকাপড়হীন উলঙ্গ শরীরে যন্ত্রণার ধারালো বোধটুকু ছাড়া আর কিছু নেই। চিৎকার করতে চাইল তপু, আওয়াজটা নিজের মনে হলো না, ঘড়ঘড় বিকৃত গোঙানিতে রূপ নিল। অবিকল সেই আওয়াজ, যা কয়েকদিন আগে তাকে দরজা খুলতে কৌতূহলী করেছিল। যতই সে গলা চড়াতে চাইল, ক্ষোভে-দুঃখে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাইল, গলা বেয়ে একই গোঙানির আওয়াজ বেরোলো। আওয়াজটা তার একক কণ্ঠের থাকল না, আশপাশের সবকটা খাট থেকে একই আওয়াজ উঠে এল। সম্মিলিত কোলাহলে তপু নিজের কণ্ঠ হারিয়ে ফেলল।
হাসপাতালের মতো ঘরটায় চার দিন কাটাল তপু। অধিকাংশ সময় ঘুমের ঘোর চোখে। জেগে উঠামাত্র অঙ্গছেদের যন্ত্রণা শরীর জুড়ে পাক খেয়ে খেয়ে গলা দিয়ে সেই গোঙানির আওয়াজই সঞ্চার করল। এই চার দিন কয়েকটা বিষয় তপু লক্ষ করল। অতীতের ঘটনা, স্মৃতি, ব্যর্থতা তাকে নাড়া দিচ্ছে না। বাবা-মা’র কথা তেমন মনে পড়ছে না, রত্নার কথাও না। আর আশ্চর্য, এজন্য অনুতাপও হচ্ছে না।
বাসায় ফিরে তপু দেখল কারো মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সবই আগের মতো চলছে। আহমদ হোসেনের বাড়াবাড়ি (যা এ কয়দিনে আদিখ্যেতা ছাড়া কিছু মনে হলো না), মা-রিনি-মিনির উচ্ছ্বাস, রাজীবের নিভৃতাচরণ। কোথাও পরিবর্তনের আঁচড় পড়েনি।
নিজের শরীরের সংগোপন পরিবর্তনটুকু নিরিবিলিতে দেখতে গিয়ে তপু বারবার হোঁচট খেল। ক্ষোভ কষ্ট যন্ত্রণার সমবেত অনুভূতি শরীর-মনে আন্দোলিত হলো, কিন্তু প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেই বিচিত্র গোঙানির উপস্থিতিই কণ্ঠে স্থায়ী হয়ে থাকল।
প্রৌঢ় এই প্রথম নিজেকে অবারিত করলেন। গলায় কৈফিয়ৎ-এর ঢঙ নেই; স্বাভাবিক কণ্ঠে, ফ্যাকাশে চোখমুখে অভিব্যক্তির ছায়া না ফেলে বললেন, কাস্ট্রেশনের ব্যাপারটা প্রিমিটিভ, সব প্রিমিটিভ আচারের মতো এটাও ক্রুড। ষাঁড়কে বলদ, কিংবা পাঁঠাকে খাসি করা হতো মানুষের প্রয়োজনে। আজও করা হয়, স্বার্থের প্রয়োজনে। কিন্তু আজকাল মানুষ নিজেকে কাস্ট্রেট করছে প্রতিনিয়ত;অফিস, সংসার, ব্যবসা, রাজনীতি, ধর্মবিশ্বাস,সবখানে। উপায় নেই, মানুষ নিজের স্বার্থেই বন্দী হচ্ছে, বিশেষ করে এস্টাবলিশমেন্টের। মেন্টাল কাস্ট্রেশন। আমরা এখানে ক্লিনিক্যালি কাজটা করে ফেলি, এতে কমিটমেন্টে কোনো ফাঁক থাকে না।
প্রৌঢ়ের বলার ভঙ্গিতে আন্তরিকতা ছিল। তপু শুনল, শোনামাত্র হু হু হাওয়া ঝটপট করে উঠল ভেতরে। গলা দিয়ে গোঙানির ধ্বনিটা অজান্তেই বেরিয়ে এল।
# #
ধীরে ধীরে তপু অভ্যস্ত হয়ে উঠল। আয়নায় নিজের কাঠকাঠ চেহরা (আগের চেহারাটা মনে পড়ে না), সকালবেলা দাঁত মাজার সময় ঠোঁট চোয়াল চিবুকের যা কিছু ভাঙচুর, ঘুম বলতে নিখাদ ঘুম, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের জটাজালহীন মাথাটা খুব নির্ভার।
রত্নার মুখটা অভিযোগঠাসা। তপুকে টানে না সে-মুখ। রত্নাকে সে কী বলবে! তার ভয় হয়, কথার বদলে গলা দিয়ে সেই গোঙানিটা বেরিয়ে পড়বে। নিজের অনিচ্ছুক, নিরাসক্ত হাত রত্নার কাঁধে রাখতে রত্না চমকে হাতটা সরিয়ে দেয়। বরফঠান্ডা স্পর্শে তার চোখেমুখে ভয়, ভয়।
পেছনের দরজার বিষয়ে তপুর কৌতূহল নেই। তার মনে হয় ঢোকার পথ সামনে পেছনে যেকোনো দিকেই হতে পারে। বেলুন-রমণীরা মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিতে ফেলে। একদিন সে জটও খোলে। আদতে ওগুলো বেলুনই, ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে পরতে হয়, বাতাস কমে গেলে যেই সেই, রবারের বেলুন।
# #
বহু বছর কেটে গেছে। কর্মীসংঘের ভবন তেমনি আছে। তপু নামটা এতদিনে বেমানান। তরুণ বয়স পেরিয়ে সে এখন রীতিমতো প্রৌঢ়। রত্না তার স্ত্রী হয়েই আছে। নিরানন্দ কাটে বলে রত্নাকে বেলুন জোগাড় করে দিতে হয়েছে। ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে যখন পরে, একটুখানি উদ্দীপনা জাগে। প্রৌঢ় বিদায় নিয়েছেন অনেক দিন। তার জায়গায় দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ অনেক প্রৌঢ় এসেছেন। তারপর তপু নিজেও যখন প্রৌঢ়, তার জায়গা হয়েছে প্রথম-প্রৌঢ়ের ঘরে। প্রথম-- প্রৌঢ়ের কথা বেশ মনে পড়ে। আয়নায় তাকালে প্রথম-প্রৌঢ়ের মুখটাই ভাসে। ভারী কাচের আড়ালে পাথুরে চোখ, হাঁটার সময় ডান পা অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় বলে অসমান কাঁধ জুড়ে মৃদু ওঠানামা।
একদিন বছর ছাব্বিশ-সাতাশের এক তরুণকে নিয়ে আসা হলো। চোখেমুখে কৌতূহল। চেহারার এই ভঙ্গিটা তপুর চেনা। তরুণ বসল। বসেই একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরল। এটি আরো বেশি চেনা। র্যাক থেকে একটা ফোল্ডার খুলে তপু পড়তে শুরু করল : তপন হায়দার, এজ টুয়েন্টি সেভেন...। তপন হায়দার? ফাইভ ফিট নাইন এন্ড হাফ, ব্ল্যাক মোল অন রাইট আর্ম। তপু নিজের ডান হাতের কনুইয়ের ওপর চোখ রাখল, জড়ুলটা এতদিনে রং মরে ফ্যাকাশে বাদামি। চেস্ট থার্টিসেভেন, ননস্মোকিং, এক্সপেকটেড সেলারি... কিছু নেই। তপন হায়দার?
মুখোমুখি বসা তরুণ সলজ্জ হাসল। তপু চমকাল, বিশ-বাইশ বছর আগে আয়নায় দেখা মুখ। সেই চোখ, নাক, ঠোঁট। কেবল দৃষ্টিটা বড় স্বচ্ছ, সংশয় নেই।
কথা বলতে গিয়ে তপু হোঁচট খেল। দীর্ঘদিন এমন অভিজ্ঞতা হয়নি, কীরকম বিচলিত মনে হচ্ছে নিজেকে, যা তার বর্তমান শারীরিক-মানসিক অবস্থায় ঘোরতর বেমানান।
বিচলিত অবস্থা থেকে তরুণ রক্ষা করল। বলল, আমার কোনো দোটানা নেই, পিছুটান নেই, আমি প্রস্তুত।
এমন তো কেউ বলে না। প্রথম-তপুর খটকা লাগল, দ্বিতীয়-তপু নতুন কথা বলছে। যেন এখনই তৈরি, ছুরি-কাঁচির নিচে ভারমুক্ত হতে চায়। যেন ব্যাপারটা কৌতুককর, আগ্রহেরও। কিন্তু বিশ-বাইশ বছর, হতে পারে তারও আগে, আয়নায় দেখা মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রথম-তপুর অন্য কথা মনে হলো; এমনও তো হতে পারে, বিশ-বাইশ বছর আগে খোয়া-যাওয়া সম্ভাবনাকে ফিরিয়ে নিতে চায় দ্বিতীয়-তপু, বানচাল করতে চায় সব। হতে পারে বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, দুষ্কৃতি। বিশ-বাইশ বছর আগেকার নিজের পরিস্থিতির সাথে এর কত তফাৎ!
রত্না কোথায়? প্রথম-তপু জিজ্ঞেস করে।
রত্না? বোঝা যায়, এ নামে কাউকে চেনে না দ্বিতীয়-তপু।
রাজীব?
ওহ্ দাদা-- আত্মহত্যা করেছে।
আর?
রিনি-মিনি আপাতত বেলুন পেয়ে খুশি।
আর?
আর?
আহমদ হোসেন, তসলিমা খাতুন?
আজকাল ঘ্যানঘ্যান কম করে। আমার সাফল্যে দুজন খুশি।
আত্মবিশ্বাসী তরুণকে নিয়ে তপু ঘর থেকে বেরোয়। বিশ-বাইশ বছর কিংবা আরো আগের সেই পুরোনো ছবি। সার-সার ভেজানো দরজা, ডানে-বামে বাঁক খাওয়া করিডোরের গোলকধাঁধা। প্রথম-তপুর ভয় হয় পেছন থেকে তরুণ তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে। অল্প সময়েই চারপাশে গোলকধাঁধার ব্যাপারটা যেন তরুণকে পেয়ে বসে। তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখায়। ডানে-বামে অসংখ্য বাঁক পেরিয়ে একটা দরজার মুখে প্রথম-তপু থামে। পেছন-পেছন দ্বিতীয়। সাদামাটা লিফটের দরজার মতো দরজা, কাচ বসানো হলেও ভেতরে আলো নেই বলে অন্ধকার। তরুণকে তপু এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে। তরুণ এগোয়, দুই পা বাড়িয়ে দরজা খুলে ভেতরে ডান পা-টা বাড়ায়, তল পায় না, পা ডুবে যেতে থাকে, যেন পাঁকে গেঁথে যাচ্ছে গোড়ালি-হাঁটু-উরু, বেঁকে যাওয়া কোমরের ডান পাশ। বাঁ পায়ে ভর রেখে সে শরীরটা খাড়া করতে, টেনে তুলতে চেষ্টা করে। যন্ত্রণা, কষ্ট ও সেই সাথে দোর্দণ্ড সাহসের, শক্তির এক গতিচঞ্চল ঘূর্ণি ঝকমকিয়ে ওঠে; আর আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় শরীরকে সাপের মতো বাঁকিয়ে বাঁ পায়ের ওপর প্রায় খাড়া করার উপক্রম করে। আধখোলা দরজায় প্রথম-তপু হাত রাখে, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, পরপরই এক ধাক্কায় দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ দরজার ওপারে, তলকুঠুরির ভেতর পতনের আওয়াজটা ভোঁতা ও সুদূর।
কত কাল হয়ে গেল! দোটানা-টা যাই-যাই করে যাচ্ছে না।
2 মন্তব্যসমূহ
এটা কী পড়লাম!
উত্তরমুছুনএকটা অসামান্য ডিসটোপিয়ান গল্প-- যা আমাদের শেকড় ধরে টান দেয়। অনেক দিন আগে অনুস্টুপে-এ গল্পটি পড়েছিলাম।
উত্তরমুছুন