দুরন্ত দিদার দেশে কিছুদিন সর্বহারা পার্টির স্থানীয় এক নেতার দৃষ্টিতে ছিল। তার মাধ্যমে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও ইত্যাদি নেতাদের বেশ কিছু বই সে পড়েছে এবং দেশের ও পার্টির স্বার্থে প্রয়োজনে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেও সে নীতিগতভাবে প্রস্তুত ছিলো। জোতদার ও শোষকদের শ্রেণি হিসাবে খতম করার সাথেও ছিলো একমত কিন্তু নিজ হাতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করার বিষয়টায় তার মন সায় দেয় নাই। এ তো ঠাণ্ডা মাথায়, খুন করা।
যারা মানুষ খুন করতে দ্বিধা করেনা, তারা মানুষের কল্যান করবে? তার বিশ্বাস হয়না। কিন্তু এ ছিলো নৃশংস ফাঁদ, সর্বহারা পার্টিতে ঢোকা যায়, কিন্তু জীবিত বের হওয়া যায়না। কেউ বের হয়ে আসতে চাইলে নিজের কমরেডরাই ফুটো করে দেয়। ওর নেতার সাথে একটা রিভলভার থাকতো সব সময়, সেটা কিভাবে ব্যবহার করে তা-ও সে নেড়ে চেড়ে দেখিয়েছে। শিগগিরই তোমার অস্ত্রচালনার ট্রেনিং শুরু হবে- বলা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হন এবং ওর এলাকার সর্বহারা, গণবাহিনী, সশস্ত্র বিপ্লবী কমিউনিস্ট শক্তিগুলো সব উধাও হয়ে যায়। যেন এই পার্টিগুলোর গরম শ্লোগানের নীচে একটাই ছিল লক্ষ্যঃ শেখ মুজিবকে উৎখাত করা। যাই হোক, দিদার একটা বদ আছর থেকে মুক্তি পায়।
কয়েক বছর যেতেই সে সিরিয়াসলি মার্কসবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষা নেয় এটা আমরা আগেই জেনেছি। জর্জিয়ার তিবিলিসি থেকে মস্কোতে আসার পর ওর সৌভাগ্যের দুয়ার খোলে। ওরই হোস্টেলে ওরই সমমনা আরও চারজন ছাত্র ছিল। দুজন ওর সিনিয়র, তাদের একজন অভ্র, ওর
দুই বছরের সিনিয়র, দুজন ওর বছরের। তারা খুব সক্রিয় তাভারিশ। নিয়মিত গ্রুপ মিটিং ও মার্কসবাদের চর্চা করে। কমরেড মতিউর রহমানের “একতা” পড়ে এবং বিভিন্ন খবর ও আর্টিকেল নিয়ে আলোচনা করে।
তারা মেস করে একসাথে রান্না করে খায়। দিদারের ছিল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ঝাল খেলেই পেটে ব্যথায় ভুগতো ভীষণ। সিনিয়র ভাইদের মধ্যে যিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয়, পার্টির তাত্ত্বিক এবং বাংলাদেশের বিশুদ্ধতম কমিউনিস্ট পরিবারের ছেলে, তিনি দিদারকে স্নেহ করতেন খুবই বেশি। তিনি দিদারের মেধা এবং গণসংযোগের ক্ষমতায় তার মধ্যে ভবিষ্যতের এক শক্তিশালি নেতাকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি খুব যত্ন সহকারে ওর খাদ্যের ওপরে চোখ রাখতেন এবং ওর জন্য যাতে আলাদা করে কম ঝাল দিয়ে রান্না হয় তার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের লোকজন এমনিতে সোজা সাপ্টা হলেও, দ্বৈত নীতি, গোঁজামিলগুলো ধরে ফেলতে পারে সহজেই। বাংলাদেশের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছেলে-মেয়েরা প্রতিবছর দেশে যেতে পারে কারণ তাদের বাপ মা টিকেট পাঠাতে পারে, কিন্তু গরীব ঘরের কমরেডদের বছরের পর বছর দেশে যাওয়া হয়না। এমন কিছু ছেলে গ্রীষ্মে লন্ডন গিয়ে কাজ করে দেশে যাওয়া বা দেশে টাকা পাঠিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে চাইলে তা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে, তাত্ত্বিকভাবে দেখা হয় এবং পার্টির নীতিবিরুদ্ধ বলে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অনেক কমরেডের মত দিদারের মধ্যেও অস্বস্থির সৃষ্টি হয়।
সে পরিস্কার দেখতে পায় যে তাদের নেতৃত্বে রয়েছে এমন একটা শ্রেণির প্রতিনিধিরা যারা নিজেদের সুযোগ সুবিধা স্বার্থগুলো সব সংরক্ষণ করে, নি:স্ব একটি শ্রেণির কাছ থেকে দাবী করছে ১০০% ত্যাগ, নিবেদন ও আনুগত্য। সে ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছে যে বাংলাদেশের পার্টির ভেতরে ২ টি শক্তিশালি গ্রুপ আছে: একটি ফরহাদ ভাইয়ের গ্রুপ-যারা নিজেদের শ্রেণিচ্যুত কমিউনিস্ট বলে দাবি করে এবং শ্রমিক শ্রেণির মাধ্যমে বিপ্লব হবে এটা বিশ্বাস করে। অন্য গ্রুপটি মতি ভাইয়ের, যারা মনে করে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তেরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবে।
পার্টির বড় তাত্ত্বিক কমরেড অনীল মুখার্জি নিজে শ্রেণিচ্যুত পুরানো জমানার অসম্ভব ত্যাগি নেতা হয়েও শেষ জীবনে মতি ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। কমিউনিষ্ট অকৃতজ্ঞ নয়, তিনি মতি ভাইয়ের গ্রুপকে সমর্থন করেন। সে কারণে পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ব্যক্তিগতভাবে অতি সৎ এবং একচ্ছত্র নেতা হয়েও ফরহাদ ভাই যথেষ্ট বেকায়দায় ছিলেন, যতদিন অনীল মুখার্জি জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পরে পার্টির দুই গ্রুপের মধ্যে মোটামুটি ব্যালান্সের সৃষ্টি হয় এবং পার্টির প্রতিটি অঙ্গসংগঠনে প্রেসিডেন্ট এক গ্রুপ থেকে হলে, সাধারণ সম্পাদক হতো অন্য গ্রুপ থেকে। মস্কোর তাভারিশ গ্রুপে এই বিভাজনের পক্ষে বিপক্ষে কারা ছিলো, তা পরিস্কার না হলেও, ‘বাইরে গিয়ে কাজ করা বা না করা’, ‘ব্যবসা করা বা না করা’ এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকে।
২ বছরের মাথায় দিদার ঘোষণা দেয় যে, সে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির সাথে একমত নয় এবং
গ্রুপ মিটিংগুলোতে আর যাবেনা। তাকে অনেক বোঝানো হয়, এমনকি দেশে পাঠিয়ে দেবার হুমকিও দেয়া হয় কিন্তু সে অনড় থাকে। এরপরে প্রথম যে পরিবর্তনটা হয়, তা হয় কিচেনে। তার জন্য ঝালহীন রান্না করার বিধান রদ হয়ে যায়। এখন থেকে তাকে মেসে থাকলে সবাই যা খায় , তাই খেতে হবে। দিদার এটা গ্রহণ করে। এটা একটা মানবিক বিষয়। মানুষ তার কাছের মানুষের জন্য যে ত্যাগটুকু করতে রাজি, দূরের মানুষের জন্য তা করবেনা, এটা আশা করাও ঠিক নয়।
২য় একটা জিনিস সে উপলব্দ্ধি করে। নিজের স্বার্থ ও অন্য কমরেডের স্বার্থ এক হতে পারেনা , আদর্শগত যত মিলই থাকুকনা কেন। যেমন একজন কমরেড কোনদিনই মেনে নেবেনা যদি অন্য কমরেড তার প্রেমিকা বা স্ত্রীকে নিয়ে টানাটানি করে। তখন এই অতি সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থটুকু আদর্শে ফাটল ধরায়। এই একই ঘটনা ঘটে মতের বা নেতৃত্বের প্রশ্নে। এবং আশ্চর্য যে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তা সত্য। জীবন চলে জীবনের নিয়মে, ব্যতিক্রমে নয়। অর্থাৎ সমাজে একজন মণি সিংহ, একজন জিতেন ঘোষ, একজন যীশু খৃষ্ট সব কিছু দিয়ে দিতে পারেন মানুষের জন্য, কিন্তু তা হল ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমের ওপরে ভিত্তি করে তৈরী তত্ত্ব বা আদর্শ মানবসমাজের জন্য নয়।
পুষ্পিতাকে নিয়ে দিদার তার নিজস্ব বনাম তার একজন প্রিয় কমরেডের স্বার্থের সংঘাতে বিপর্যস্ত ছিল। সে পুষ্পিতাকে তা জানতে দেয়নি, পুষ্পিতাও ওর সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ওকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি তার মনোজগতের কথা। দিদার ওকে প্রস্তাব করেছে সিঙ্গাপুরে যেতে, মনের গহীনে কোথায় যেন একটা ছোট্ট আশা ছিল যে, হয়তো সে পুষ্পিতার মন জয় করতে পারবে। পুষ্পিতা খুশি মনে গ্রহণ করেছে সেই প্রস্তাব। ভুত যাকে ছোঁয়না প্রেম তাকে দুলিয়ে যায়, এটা মানুষের জন্য সত্যিই বড় ট্র্যাজিডি।
কিন্ত আলিওনা সেই যে গেছে আর ফেরেনি।
সেলুন বন্ধ হয়ে গেছে ৮ টায়। ভেতরে কোনো আলো দেখা যায়না। তখনও মুঠোফোনের যুগ আসেনি। সুদীপের মাথার চুল ছেড়ার দশা। সে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে, কিন্তু ভেতরটা মৃতপুরী। দিদার সেলুনের পেছনে চক্কর মেরে আসে, একটা জানালা আছে মাটি থেকে বেশ ওপরে, ভেতরে কেউ আছে কি নেই, সরাসরি দেখার উপায় নেই। সে এসে সুদীপকে নিয়ে পেছনে যায়। সুদীপ দিদারের চেয়ে লিকলিকে, সে দিদারের কাঁধে চড়ে বসে, জানালার শিক ধরে ঝুলে ভেতরে চেয়ে দেখে আলিওনা চেয়ারে বসে আছে। ওর পিঠ জানালার দিকে। সারা শরীর এপ্রোনে ঢাকা, পিঠ ঢাকা চুলে, আর সেই চুলে রং করছে ওরই বয়সি এক মেয়ে অসম্ভব মনোযোগিতায়।
সুদীপ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।
মেয়েটি দেখতে পায়।
“কে যেন জানালায় উঁকি মারছে” সে বলে।
“বোধ হয় আমার স্বামী”, বলে ফিরে দেখে সুদীপ তীর্থের কাকের দৃষ্টি নিয়ে জানালায় ঝুলে আছে।
অপরাধীর হাসি হাসে আলিওনা।
সুখী মানুষ ঘড়ি দেখেনা। আলিওনা খুব বেশি সুখী। সে তার ঘড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। বুঝতে পেরেছে যে একটু বেশিই সময় লাগছে কিন্তু মাঝপথে চলে যাওয়াও সম্ভব নয়।
ভাবতেই পারেনি এত সময় কেটে গেছে। মেয়েটি গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওরা চেয়ারে বসে।
একটু ভীড় থাকায় ওর চুলে রঙ করা শুরু করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি নতুন। সে যথেষ্ট যত্ন সহকারে কাজটি করছে। সব নাপিতের মতই কথা বলতে ওস্তাদ। সামনে থেকে দরজা ভাঙলেও পেছনে শোনা যায়না। আলিওনা সিঙ্গাপুর যাচ্ছে শুনে সে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওর এক ক্লায়েন্টের গল্প শুরু করে। সেই বলেছিল অদ্ভুত সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ওই দেশটি। ফুলে ফুলে ভরা, ছবির মত দেখতে। তার স্বপ্ন সেও একদিন সিঙ্গাপুর যাবে।
তখন ওভার টাইমের ব্যপার ছিলনা, মেয়েটি প্রায় অতিরিক্ত দেড় ঘন্টা সময় কাজ করেছে বেশ মনযোগ দিয়ে। সুদীপ আলিওনাকে সাদা চুলে নতুন ভাবে দেখে মুগ্ধ হয়। পারলে রীতিমত কোলে করে হোস্টেলে নিয়ে যায়। এমনই বয়েস, যে কোন রূপেই আলিওনাকে উর্বশী মনে হয়। সে মেয়েটিকে ভালো বকশিশ দেয়।
ওরা হোস্টেলে রাত কাটায়। আলিওনা পুষ্পিতার সাথে। ওদের মধ্যে সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পুষ্পিতা আসলেই চমৎকার একটা মেয়ে। সিঙ্গাপুরে ওদের থাকার বন্দোবস্ত ছিল একই রকম। মেয়েরা একরুমে ছেলেরা অন্য। অবশ্য সুদীপ আলিওনাকে নিয়ে একরুমে থাকতে পারলে আরও সুখী হতো। তবে দিদার পুষ্পিতা সাথে থাকায় সব মিলিয়ে ভালোই একটা ভ্রমণ হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় ম্যারিনা বে’ র অপূ্র্ব নির্জনতায় দিদার একান্তে কথা বলেছিল পুষ্পিতার সাথে।
ওর বুক ভেঙে গিয়েছিল। এবং এত সুন্দর একটা দেশ, ওর মনে হয়েছিল ভীষণ ধূসর।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল পদ্মার চরের বালুতে শুয়ে চিৎকার করে কাঁদতে, অথবা রাতগাঁ’র বিলে অশ্বিনী মালোর মত চুপ করে মরে যেতে।
সুদীপ জানতো যে দিদারের বুক ভাঙবে।পুষ্পিতা আলিওনাকে বলেছিল, দিদার তার প্রেমিক নয়। বরং খুব কাছের একজন বন্ধু। সে ভালোবাসে অন্য একজনকে। দিদারকে সে তা জানায়নি।
সুদীপ ভেবেছে বিষয়টি ওদের নিজেদের মধ্যেই ফয়সালা হওয়া ভালো এবং তার এতে নাক গলানো উচিত নয়।
প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা সহজও নয়, জটিলও নয়। এ হল এক ধরনের তরঙ্গ, দুইজন মানুষের মধ্যে যার জন্ম হয় এবং দুজনের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। একজনের মধ্যে উদগত যে অনুভূতি তার সঠিক কোনো নাম নেই।
সিংহও নাকি ভালোবেসে নির্জীব হয়। কোমল অনুভূতির কাছে ভূলুন্ঠিত ও বিধ্বস্থ এই ছেলেটিকে দেখে মনেই হয়না এই সেই দিদার যার ছিল দুরন্ত কৈশোর ও বেপরোয়া সাহসীকতার পথ! এবং সর্বহারা দলে যোগদান করে সে ও মানুষ মারতে পারতো পাখির মতো অথবা মরে যেতে পারতো নিজেও।
২২ তম পর্ব
আলিওনার সান্নিধ্যের স্বপ্নিলতা ছাড়াও দ্বিতীয়বারের এই ট্রিপটিতে সুদীপের আরও ১৫শ ডলার লাভ হয়। সে খিলজি ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায় অফিসে।
উনি রাগ করেন।
“ডাক্তারি পাশ করছস কিন্তু মানুষ হস নাই।”
“বখতিয়ার ভাই কি হয়েছে?”
“তর লজ্জা করেনা, নিজের বৌরে আরেকজনের পাইলট বানাইয়া সিঙ্গাপুরে লইয়া যাইতে? আমারে কইলেই পারতি, দিতাম পাঠাইয়া, দুইজনে দুইটা কম্পিউটার লইয়া আইতি, লাভও বেশি হইতো, আমি কি তর জন্য কিছুই করি নাই? ”
পাইলট শব্দটা সুদীপের কাছে নতুন কিন্তু সে ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে, কিন্তু বুঝতে পারেনা এখানে মান ইজ্জতের প্রশ্ন কেন আসে? যে বড় ভাই আলিওনার টিকিট কেটেছেন উনিও চিরকাল ছিলেন বখতিয়ার ভাইয়েরই শিষ্য এবং ওদেরই কমরেড। আগের মূল্যবোধ কি আর নেই? বখতিয়ার ভাইয়ের সাহায্য নিলে দোষ হয়না কিন্তু অন্য ভাইয়ের সাহায্য নেয়ায় মান ইজ্জতে টান পড়লো?
আমাদের কমরেডরা কি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেছে এবং নতুন শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হয়েছে?
সুদীপ বুঝতে পারে যে কুশীলবগন বাহ্যিকভাবে সেই আগের এবং এক হলেও, তাদের অন্তর্জগত এখন ভিন্ন। মঞ্চ বদলে গেছে, নতুন নিয়ম-কানুন এসেছে। পুরোনো নিয়মে খেলা আর চলবেনা।
তাকে বদলাতে হবে। সুদীপের সমস্যা সে বড়দের শ্রদ্ধা করে খুব বেশি। ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজমের প্র্যাকটিস করতে করতে, যেখানে তর্ক করার প্রয়োজন সেখানেও সঠিক সময়ে সঠিক শব্দটি সে খুঁজে পায়না।
এখানেও সেই একই অবস্থা হয়। সে উপলব্ধি করে যে বখতিয়ার ভাই -ই ঠিক। ওরই কাজটা ঠিক হয়নি। বখতিয়ার ভাই তার এত বড় একটা উপকার করেছে। আলিওনার জন্য অন্য কমরেডের টিকেট নিতে রাজি হবার আগে তার অন্তত উচিত ছিল একবার ফোন করে বখতিয়ার ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে নেয়া।
সুদীপ ৬ মাস সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করে, আরও সঠিকভাবে বললে ‘খেপ’ মারে ।
লেনিনগ্রাদ-মস্কো টই টই করে। ততদিনে কম্পিউটার, ফ্যাক্সের প্রফিট মার্জিন কমে এসেছে, কিন্তু ফটোকপি মেশিন, প্লটার, স্ক্যানার, ক্যালকুলেটর ইত্যাদির বাজার রমরমা। আনলেই বিক্রি হয়ে যায়। তার হাতে লাভে আসলে প্রায় ১১ হাজার ডলার জমে যায়। এটা অনেক টাকা, ঠিক সেই সময়ে টাকার নিজস্ব মান ও ‘অপরটুনিটি কস্ট্’ হিসাব করলে, যারা সেই মুহূর্তে সেই দেশে ছিল তারা বলতে পারবে কত বড় ছিল সেই সংখ্যাটা। তখন পানির দরে বিক্রি হয়েছে এমন সব এপার্টমেন্ট, জমি, বিল্ডিং যা কয়েক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লাখ লাখ এমনকি মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে।
কেঁচো দিয়ে মাছ ধরা প্রজাতির সুদীপ, যে জ্ঞান হবার পুরো সময়টা কাটিয়েছে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মিশনে, তার নিজেকে মনে হয় সে বাদশা সোলায়মান হয়ে গেছে।
এত টাকা! তখনও তার ৪ জনের পরিবারের সারা মাস চলতে ৩-৪ শ রুবলের বেশি লাগেনা, আর ১০০ ডলার ভাঙালে ৭০০-৮০০ রুবল হয়।
এত টাকা দিয়ে সে করবে কি?
একটা সমাধান বের হয়ে আসে ।
সুদূর ইউক্রেন থেকে বিশ্বজিতের ফোন আসে। সুদীপ দেশে যখন ছাত্র ইউনিয়ন করতো এবং স্বপ্ন দেখতো যে সে শিগগিরই পার্টির গ্রুপে ঢুকতে পারবে, বিশ্বজিত ততদিনে ছিল পি. এম ( পার্টি মেম্বার )। একটি অকল্পনীয় সন্মানের ব্যাপার। কমিউনিস্ট পার্টির পি. এম হতে বছরের পর বছর লাগে। এটা সবারই জানা যে, প্রথমে গ্রুপ মেম্বার, তারপরে ক্যান্ডিডেট মেম্বার, কেবলমাত্র তারপরেই ফুল মেম্বার বা পি এম হওয়া যায়। সততা ও ত্যাগের কত ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেকে সবগুলো ধাপ পার হয়ে মেম্বারশীপ পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনা। কিন্তু বিশ্বজিত নাকি পার্টির মেম্বার হয় ১৪ বছর বয়সে। ১৪ বছর! তার মানে সে কি মাপের কমিউনিস্ট!
বৃটিশ পিরিয়ডে কমিউনিস্ট পার্টির মূল সদস্যরা আসেন বিভিন্ন আত্মত্যাগী সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ থেকে। যারা দেশমাতাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন বৃটিশ তাড়ানোর সংগ্রামে। তাদের অনেকেই পরে সন্ত্রাসবাদের পথ ত্যাগ করে মার্কসবাদ- লেনিনবাদে দীক্ষা নিয়ে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে ঢোকেন। বেশির ভাগ সময়ই তাদের আত্মগোপনে কাটে। পাকিস্তান আমলের সবটা সময়ই। সুতরাং তখন পার্টি মেম্বার নেয়া হতো বহু যাচাই বাছাইয়ের পর। বেশির ভাগ কমিউনিস্ট কাজ করতেন আওয়ামী লীগ ও (পরে) ন্যাপের প্লাটফর্মে। তারা ছিলেন ছায়ার মত, কেউ তাদের দেখতে পেতনা। একটু আধটু শুনতে পেত, তাও মূলত ক্ষমতাসীনদের কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা থেকে। দেশ স্বাধীন হবার পরে পার্টি বৈধ হয়। সদস্য গ্রহণের জটিলতা কমিয়ে এনে পার্টিকে গণমানুষের পার্টিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সদস্য হওয়া সহজ হয়ে পরে।
৬০ এর দশকের ছাত্র আন্দোলনের ‘শিড়দাঁড়া’ হিসেবে পরিচিত কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ পার্টির সেক্রেটারি হন। বৃদ্ধ নেতারা পেছনে চলে যান। ছাত্র আন্দোলন থেকে এক গুচ্ছ মেধাবি নেতা পার্টির সামনে চলে আসেন। তখন কতগুলো যুক্তির প্রশ্ন সামনে এসে যায়:
পার্টি যেহেতু নিজেই এখন কাজ করতে পারে অফিস ও সাইনবোর্ড বসিয়ে, তাহলে ন্যাপের আর দরকার কি? মস্কোর মধু কেন ন্যাপের সাথে শেয়ার করতে হবে? কেন মোজাফফর আহমদকে নেতা মানতে হবে যদি নিজেরাই বড় বড় ভালো নেতা?
মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু চরিত্র ও ইন্সটিঙ্কট আছে। সবাই এটা জানে। সভ্য মানুষ এই ইন্সটিঙ্কটগুলোকে লুকিয়ে রাখতে চায়। যে যত শিক্ষিত ও সফিস্টিকেটেড সে তত ভালোভাবে এ কাজটা করতে পারে। সাফল্যের চাবি-কাঠি হল মানবিক ইন্সটিঙ্কট লুকিয়ে রাখার নান্দনিকতায়।
সুদীপের খুব মনে আছে ছাত্র ইউনিয়ন ও পার্টির ট্রেইনিং সেমিনারগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলে- মেয়েদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বড় ভাইয়েরা একটি দৃষ্টান্ত প্রায় ব্যবহার করতেন: “আমাদের ছেলে-মেয়েরা এত চরিত্রবান যে তাদের একরুমে এক বিছানায় ঘুমাতে দিলেও একজন আর একজনকে স্পর্শ করবেনা।”
তুখোর দৃষ্টান্ত। একটুও অতিরঞ্জন নয়।যেন তারা সবাই এই পরীক্ষায় পাশ করে এসেছেন।
মানে এরা অসুস্থ নয়, কিন্তু আদর্শের কারণে প্রাকৃতিক ইন্সটিঙ্কটকে অবদমন করতে পারে। আর যারা এটা পারে তারা অন্য ক্ষেত্রেও নিজেদের অবদমন করতে পারবে। নেতারা এই উদাহরণ ব্যবহার করে আসলে কোন ইন্সটিঙ্কট অবদমনের কথা বলতে চেয়েছেন কিন্তু বলেন নি, তা তখনও সুদীপরা বুঝতে পারেনি।
ক্ষমতা নারীর মতই মোহনীয়া। নারীর চারুময়তার হাত থেকে আত্মরক্ষা করার বীরত্ব আগের দিনের কমিউনিস্টরা অনেক দেখিয়েছেন, এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এই পরীক্ষায় পাশ করলেও সুদীপ নিশ্চিত যে, এই পরীক্ষায় সে এবং তার সঙ্গীরা বিরাট গোল্লা পেয়ে ফেল করতো। কমরেড হলেও ক্ষমতা যে নারীর মতই ‘শেয়ার করার অযোগ্য’ তা মার্কসবাদী সকল পার্টিই মার্কসকে কানা করে দিয়ে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিদ্বন্দ্বী পছন্দ করেনা।
সুতরাং খুব লজিকালভাবেই কিছু সিদ্ধান্ত এসে যায়ঃ
ন্যাপ থেকে সব সদস্যদের পার্টিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হোক। ছাত্র ইউনিয়নকে ন্যাপের বলয় থেকে বের করে আনা হোক। সুক্ষ্ণভাবে সারাদেশে পরিচিত সম-আদর্শের ও মস্কোপন্থী নেতা মোজাফফর আহমদের চরিত্র হরণ করা হোক। প্রয়োজনে ন্যাপকে ভেঙে তছনছ করে দেয়া হোক। কমরেড স্ট্যালিনকি বিপ্লব মানে ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে লেনিন- ট্রটস্কির বিপ্লব ও তার সহযোগীদের নির্মূল করেন নাই? বোকা সুদীপের বোধ বলে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাগণ বুঝে বা না বুঝে সেই কাজটিই করেছেন। মস্কোপন্থী বাম রাজনীতিকে ধ্বংস করেছেন। চীনপন্থী মেধা-মুনীরা তো ইতিমধ্যেই পরস্পরকে ভস্ম করে নাই হয়ে গেছেন।
সুদীপের কাছে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই এবং ঠিক এমনটাই যে ঘটেছে তা সে নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। হয়তো সে দ্বন্দ্ববাদ ভুলভাবে শিখে, ভুলভাবে প্রয়োগ করছে। হয়তো সে বোঝেই নি এই জটিল সমাজ দর্শন।
সুদীপ কি বলতে চাচ্ছে যে পার্টির নেতারা খারাপ ছিলেন এবং দেশপ্রেমিক ছিলেন না?
না।
তারা নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে সব মানবিক দোষগুন ছিল: হিংসা , প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতার লড়াই, কে কত বেশি ভালো তার সংঘাত, এমনকি ( অচ্ছুত ) যৌন কামনাও তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু তাদের দেখানো হয়েছে পাক-পবিত্র, ‘চারু-বাক’ ও জীতেন্দ্রীয় হিসাবে ( অবশ্যই কেউ কেউ ছিলেন ) এবং ইন্সটিঙ্কট লুকিয়ে রাখার প্রপাগান্ডায় তারা ছিলেন অসম্ভব মেধাবি।
তার মানে কি অন্যেরা ভালো ছিল?
অন্যেরা আরো খারাপ ছিল। তারা মানুষের গলা কেটেছে, হালুয়া রুটি কম্বল চুরি করেছে, ক্ষমতার পা চেটে স্বাধীনতার অর্জনকে বিপথে নিয়ে গেছে। কথায় বলে, পবিত্র স্থান কখনও খালি থাকেনা। রাজনীতির মাঠ হলো পবিত্র স্থান, বামপন্থীরা তা ছেড়ে গেলে ডানপন্থী ও মৌলবাদীরা এসে দখল করবে এটাই স্বাভাবিক। তারপর তারা যখন জীবন শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলবে অথবা নরবলির নৃত্য শুরু করবে, তখন বামপন্থীরা তা নিয়ে আবার রাজনীতি করবে।
রাজনীতির মাঠ হলো চরিত্রহীনদের ঈদগাহ্।
২৩ তম পর্ব
বিশ্বজিত প্রত্যন্ত পাড়া গাঁয়ে থেকে স্কুলে পড়াশুনো করার সময়ে খেলাঘর, কৃষক সমিতি করতো। ছিল খুব ভালো সংগঠক। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে। পিতৃহীন। বড় ভাই শহরে ছোট চাকরি করতো। বিশ্বজিত রাজনীতি করা ছাড়াও টিউশনি করতো। তারপরেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে, ম্যাট্রিকে ৫ টি লেটার সহ স্টার মার্কস পেয়ে। তাই সে তখনকার বাংলাদেশের ১ নম্বর কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ পায়। কলেজে আসার আগে স্থানীয় পার্টি নেতাদের জিজ্ঞেস করে ঢাকায় সে কাদের সাথে যোগাযোগ করবে বা কাজ করবে?
“ছাত্র ইউনিয়ন, তবে তার কিছু করা লাগবেনা তাকে খুঁজে বের করে নেয়া হবে।”
কিছুদিনের মধ্যেই সে ছাত্রসংগঠন এবং পার্টি সংগঠনে জড়িয়ে পড়ে। তাকে বিভিন্ন সময়ে পার্টির গোপন মিটিংয়ে যোগ দিতে হতো। তার গোপন নাম দেয়া হয় মাকসুদ। সে কয়েকটি টিউশনি করতো এবং তার টিউশনির আয়ের উপর ভিত্তি করে পার্টির মাসিক চাঁদা বা লেভি নির্ধারণ করা হত।টিউশনির টাকায় নিজে চলতো, মাকেও কিছু পাঠাতো। কোনো কোনো মাসে টাকায় কুলাতো না, সুদীপ বা বন্ধুদের থেকে ধার নিতো।
বয়সে সে সুদীপ ও অন্যান্যদের তুলনায় কমপক্ষে ৫ বছরের বড়।
রাজনীতির মাধ্যমে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্টতা হয়ে ওঠে পঞ্চপাণ্ডবের এক অচ্ছেদ্য আত্মার বন্ধনেঃ সুদীপ, ইমরান, বিশ্বজিত, সবুজ ও চেঙ্গিজ। একমাত্র বিশ্বজিতই পার্টির সদস্য যা অন্যেরা জানতে পায় কলেজের ২য় বর্ষে। কলেজে আন্দোলনের কারণে তাকে বিএনপির এক উঠতি গুণ্ডা ও তার দলবলের হাতে বহু নির্যাতিত হতে হয় এবং সে পড়াশুনায় এক বছর পিছিয়ে যায়। সুদীপ, ইমরান চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে, সবুজ, চেঙ্গিজ পূর্ব জার্মানিতে।
বিশাল ঢাকা শহরে বিশ্বজিতের একটা বছর খুব মনমরা কষ্টে কাটে। মিছিল মিটিং রাজনীতি সব করা সত্ত্বেও দূরে চলে যাওয়া বন্ধুদের ভাগ্যের সাথে নিজের ভাগ্য মিলিয়ে ব্যথিত হয়। পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের জন্য এত ত্যাগ যার এবং একজন প্রকৃত প্রলেতারিয়েত তাকে স্কলারশিপ জন্য নির্বাচিত করা হয়না। পুশ করার কেউ নেই। একদিন টি এস সির সামনে দেখা ওর পার্টি গ্রুপের বৃদ্ধ এক নেতার সাথে: “তোমার স্কলারশিপ হইছে?”
“না, আমার তো কোন আত্মীয় স্বজন পার্টির নেতৃত্বে নাই, আমাকে বৃত্তি কে দেবে?”
“চলো আমার সাথে” বলে হাঁটা ধরে হোসাইনি দালান রোডে ছাত্র ইউনিয়নের অফিসের দিকে।
“কি মিয়ারা, এত মানুষ রে বৃত্তি দেও, আর এই গরীব পোলাডা পার্টির জন্য এত কাম করছে,তা রে বৃত্তি দেও না, এই ডা কেমুন কতা?”
তাকে পরের দিন পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বলা হয়। বিশ্বজিত অবাক হয়। লাইন ঘাট আর ম্যানেজারদের খোঁজ-খবর জানা থাকলে অধরা বৃত্তি কত সহজে ধরা দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সে আসে এক বছর পরে। এসেই নিজ শহরে তাভারিশ গ্রুপের নেতাদের সাথে তুমুল কলহে জড়িয়ে পড়ে। সে দেশে পোড় খাওয়া সাচ্চা কমিউনিস্ট, এখানে যে চেংড়া ছেলেগুলো নেতৃত্ব দেয় ওরা আসলে সুবিধাবাদী। সে মস্কোতে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। মস্কোর নেতারা একবার আসেও অভিযোগের তদন্ত করতে, কিন্তু যারা নেতৃত্বে ছিল তারা থেকেই যায়। সে তখন প্রকাশ্যে মস্কোর নেতাদেরও সুবিধাবাদী বলে গালি দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে কলহ এমন তুঙ্গে ওঠে যে, সে প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্ররোচনায় তার কিছু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তাভারিশ গ্রুপের নেতাকে আচ্ছা করে উত্তম মাধ্যম দিয়ে হাত ধোয়। কাজটি সে খুবই খারাপ করে কারণ যার গায়ে হাত তোলা হয়, সে সুদীপদের ভাতৃপ্রতীম কমরেড।
বিশ্বজিত সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে পৌঁছানোর পর পরই সুদীপ মস্কোর নেতৃত্বকে অনুরোধ করেছিল ওকে লেনিনগ্রাদে পাঠাতে। ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সেই হাত ছিল, মস্কোর আন্তর্জাতিক শিক্ষা দপ্তর তাদের বেশির ভাগ অনুরোধ রক্ষা করতো। যাই হোক মস্কোর নেতারা সুদীপকে বলেছিল, ইউক্রেনের ঐ শহরে আমাদের শক্তিশালী কোন নেতা নেই এবং পার্টির স্বার্থে ওর ইউক্রেন যাওয়াটাই বেশি জরুরি। এই সেই বিশ্বজিত! চামড়ায় যার মান্দার গাছের কাঁটা। মারামারি, গণ্ডগোল করা এবং নেতৃত্বকে অশ্রদ্ধা করার কারণে মস্কোর নেতারা স্থান মত অনুরোধ করে তাকে বহিস্কার করে দেশে পাঠিয়ে দিতে।
ততদিনে বিশ্বজিত স্থানীয় গুপ্ত পুলিশের নেতৃস্থানীয় এক কমরেডের সাথে বন্ধুত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। গুপ্ত পুলিশ বিদেশি ছাত্রদের কর্মকাণ্ড মনিটর করার জন্য বিদেশিদের মধ্য থেকে সহযোগী রিক্রুট করতো। অবশ্যই গোপনে। এরা তাদের চোখ ও কানের কাজটি করতো। কখনও কখনও ছাত্রদের সাথে ব্যবসায় জড়িত হয়ে তাদের কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট দিতো এবং এই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ খুব বিপদজনক মাত্রায় পৌছে গেলে তাকে ধরে ফেলা হত। আর যেহেতু এই গুপ্তচরেরা ব্যবসায়ীদের সাথে কাজ করতো তারাও ব্যবসা করতো এবং সেইভাবে তারা বস্তু জীবনেও বঞ্চিত হতোনা।
তারা হোস্টেলে ভালো রুমে থাকতো, সেখানে গান বাজনা হতো এবং “অবলিপিখা” নামে রাশিয়ায় যে অপূ্র্ব ও ঔষধি একটি বেরি রয়েছে সেই বেরির মত সুন্দর মেয়েরা তাদের দেহ ও মনের যত্ন নিত। গুপ্তপুলিশের হস্তক্ষেপে বিশ্বজিত মস্কোর তাবৎ নেতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তার বহিস্কার আদেশ রদ করে প্রমাণ করে দেয় যে, সে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসা অন্যসব ম্যাড়াদের মত নয়, যাদের মাথার ওপরে লাঠি ঘুরানো যায় ।
যা হোক, স্ট্র্যাটিজিক আপদ বিশ্বজিতের সাথে সুদীপের প্রায় বছর চারেকের কোন যোগাযোগ ছিলনা। তখনকার দিনগুলোতে কনফারেন্সে না গেলে একে অন্যের সাথে দেখা হবার কোন পথ ছিলনা, ফোন ছিলনা। এক মাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি লেখা। বান্ধবিকে চিঠি লেখা যায়, বন্ধুকে চিঠি লেখে কোন অকর্মণ্য?
তাছাড়া সুদীপও যার পরনাই বিরক্ত ছিল ওর হঠকারিতায়।
'যাই হোক না কেন’ পার্টি এবং পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটা বিপ্লবের পেছনে ছুরি মারা, আর ছুরি যারা মারে তারা যত কাছেরই হোকনা কেন তাদের সাথে সংশ্রব রাখাটা বিপ্লবীদের মানায়না।
ওর শহরে সম্মেলন হয় ১৯৮৭ সালে। সুদীপ সেই সম্মেলনে যায়। ওর সাথে দেখা করতে আসে বিশ্বজিত। আগের মতই প্রাণবন্ত হাসি, বুকে জড়িয়ে ধরা অন্তরঙ্গতা। বি.এন.পির গুণ্ডাদের অস্ত্র হাতে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো, রাতে রাতে হোস্টেলের বাইরে ঘুমানো, ভোরের শিশিরে সদ্যস্নাত বেলিফুলের মত পবিত্র একজন "রানুদি"র স্মৃতিচারণ, লঞ্চে করে ওর বড় ভাইয়ের বিয়ে খেতে যাওয়া এইসব কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলে। সত্যিকারের বিপ্লবী আবেগের কাছে ধরা দেয়না, সত্যিকারের বিপ্লবী শয়তানের প্ররোচনার মত লোভ, মোহ, শ্রেণিস্বার্থকে জয় করতে পারে। কিন্তু সুদীপ তার বন্ধুকে ফিরে পেয়ে আবার আবেগাপ্লুত হয়।
"চল্ আমার হোস্টেলে, রান্না করে রেখে এসেছি।"
সুদীপ চলে যায় বন্ধুর সাথে।
নতুন বিল্ডিং, সচরাচর নতুন হোস্টেলগুলোতে ছোট ছোট কক্ষ এবং দুজন ছাত্র থাকে এবং কয়েকটি রুমের একটি ব্লকে বাথরুম ও শাওয়ার থাকে ।
সুন্দর ছিম ছাম, গুছগাছ একটি রুম। একাই থাকে সে। সেই সময়ে একা একটি রুমে থাকার পথ ছিল দুটিঃ ডিনকে পয়সা দিয়ে হাতে রাখা, তাহলে সে কাগজে কলমে দেখাবে দুজন বা তিনজন অথবা যে কয়জন হওয়া উচিত ততজনই থাকে। অথবা কোন রাশিয়ান রুমমেট ধরা যে হোস্টেলে না থেকে শহরে কোন বান্ধবির সাথে থাকে। তাকে কিছু রুবল দিয়ে দিলে সে আর রুমে আসেনা।
এ ব্যাপারেও অবশ্য ডীনকে হাতে রাখা প্রয়োজন।
এক কোনায় টেবিলের ওপরে চক চক করছে একটি বড় ক্যাসেট প্লেয়ার, যা পার্টির ছেলেমেয়েদের জন্য বাসন্তি স্বপ্নের মতই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
সুদীপ বলে,"বাহ্ বা তুমি আমাদের মধ্যে একমাত্র কমিউনিস্ট বুর্জোয়া।"
ও হাসে ।
"তোরা তো আমাকে বের করে দিয়েছিস, আমি তো আর তোদের মত কমিউনিস্ট নই।"
সারা রাত আড্ডা, গল্প , জেগে থাকা।
পার্টির গল্প। সে বলে পার্টির ভেতরে যেমন বহু ত্যাগি নেতা আছে, তেমনি আছে অনেক সুবিধাবাদী। এই সুবিধাবাদীরা যতদিন পার্টির নেতৃত্বে থাকবে ততদিন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা কোনো বাম আন্দোলনই দাঁড়াবেনা।
সুদীপের বিশ্বাস হয়না, যে পার্টির নেতারা নিজেদের জমিদারি বিলিয়ে দিয়ে সারা জীবন জেলে, আত্মগোপনে, মাঠে ঘাটে কাটিয়েছে খেয়ে না খেয়ে, সেই পার্টিতে সুবিধাবাদী থাকতে পারে।
বিশ্বজিত প্রশ্ন করে, "তুই জানিস যে মৈত্রী সমিতির অমুক ভাই, ছাত্র পাঠাতে টাকা নেয়?"
সুদীপ অবিশ্বাস করে, যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে তাকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে, সে যখন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলো সুদীপ ছিলো ঢাকা শহর-কমিটিতে। তার সম্পর্কে ওর ছিল অগাধ বিশ্বাস।
সে বেশ কিছু উদাহরণ দেয়, বলে তুই চাইলে যারা তাকে টাকা দিয়েছে তাদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে আসি, এই হোস্টেলেই আছে। সুদীপের এমন কোনো ইচ্ছে হয়না। ওর মনে হয় দুর্মুখ বিশ্বজিত, যেহেতু তাকে বের করা দেয়া হয়েছে, সে একান্তই মনের ঝাল তুলছে। তাদের পার্টিতে খারাপ মানুষে নেই, থাকতে পারেনা।
ব্যাচেলর যুবকদের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায় প্রেম, ভালোবাসা ও নারীর গল্প ছাড়া। নারীর গল্প পৃথিবীর সেরা গল্প, মাঠ ঘাট পাখী নদী ফুল কোন কিছুই নারীর গল্পের কাছে ভিড়তে পারেনা। রানুদির কথা ওঠে। এক পৃথিবীর অভিকর্ষের সমান ছিল ওর আকর্ষণ রানুদির প্রতি। দিদি বললেও আসলে সম বয়সী। সে তন্ময় হয়ে যেতো তার কথা বলতে গিয়ে, সে কখনও সখনও ছল ছুতা করে দিদিকে ছুঁয়ে ফেলতো, “এই কি হচ্ছে” বলে দিদিও এমনভাবে ওর গাল টিপে দিত যেন ছোট বাচ্চা। কিন্তু ওরা দুজনেই জানতো সে ছিল স্পর্শ তড়িতের আলো আঁধারি। দিদি ওকে একজন পুরুষের মতই দেখতো, একজন পুরুষ যে ভালোবাসার প্লাবনে ভাসিয়ে নিতে সক্ষম।
তাদের মধ্যে চকিত চুম্বন এমনকি বুকে বুক ঘষে দেবার ঘটনাও বহু ঘটেছে। শুধু নিবিড় মিলনের নির্জনতাটুকু মেলেনি। সেই অপ্রাপ্তি এক আকাশ সমান হাহাকার হয়ে আছে।
সেই রানুদির বিয়ে হয়ে গেছে কত আগে।
“তোর মনে আছে রানুদির মুখ?”
হ্যাঁ, সুদীপ স্পষ্ট মনে করতে পারে, শ্যমল কমনীয় ওই মুখটি ও মাত্র একবারই দেখেছিল। সেটা ছিল বর্ষাকাল, চারিদিকে জল থৈ থৈ করছিল এবং তাদের বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটি কদমগাছে ছিল সাদায় হলুদে মেশানো অগুনিত কদম ফুল। বর্ষাস্নাত সেই ফুলগুলো সেই রানুদির শান্ত মুখের প্রতিবিম্ব হয়ে আছে ওর চোখে।
বিশ্বজিত স্পষ্টই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপরে রাশিয়ান মেয়েদের গল্প ওঠে।
"তোর কি কোন রাশিয়ান বান্ধবি আছে?
"না"
"কোন মেয়ের সাথে শুয়েছিস?"
“না”
“শালা ধ্বজভঙ্গ!"
চিরাচরিত নিজস্ব ব্রান্ডের খিলখিল হাসি হেসে ওঠে সে।
“তা হলে তো সমাজতন্ত্রের জন্য খালি লড়াই -ই করলি, এর কিছুই ভোগ করলি না। "
এখানে সে তার মার্কসীয় জ্ঞানের টিপ্পনী কাটেঃ
"কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে মার্কস - এঙ্গেলস তো বলেইছেন যে বুর্জোয়া বিবাহ প্রথা হচ্ছে কমন ওয়াইফ রাখার একটা সিস্টেম, যেখানে একজন আর একজনের বৌকে নিয়ে টানাটানি করে, সেই অর্থে কমিউনিস্টদের বড়জোর গালি দেয়া যায় এই বলে যে, তারা অন্তত ভণ্ডামি না করে সরাসরি মুক্ত ও বৈধ ভালোবাসার কথা বলছে। "
“এই মুক্ত ভালোবাসার নদীতে একটু সাঁতরালে ক্ষতি কি? মস্কোর থেকে যারা নিষেধ করে তারা তো এ ব্যাপারে এত কট্টর নয়, কেউ কেউ বিয়েও করেছে।"
সুদীপ বলে,"তাদের কথা বাদ দাও"।
ওর মনে পরে, দেশ থেকে আসার পর পর খিলজি ভাই অকপটে এক সমমনা মিটিং এ বলেছিলেন, "আমি বিয়ে করেছি না বুঝে, পার্টির নিষেধ আসার আগে, আমি বুঝি তাতে আসলেই কত অসুবিধা হয় দেশের কাজ করতে।"
"আমার মুখে হয়তো এ কথায় আপনারা স্ববিরোধিতা পাবেন কিন্তু এটা সত্য, দেশের কাজ করতে হলে, আপনাদের বিদেশি বিয়ে করা থেকে বিরত থাকতে হবে।"
এ কথার মধ্যে সুদীপ অকপটতার কোন অভাব দেখেনি। বিপ্লবীরা অযৌক্তিক হলে চলবে কেন? একজন কমরেড যদি ভুল করে এবং সেই একই ভুল থেকে অন্য কমরেডকে সরিয়ে রাখতে চায়, সে তো ভালো কথা, সত্যিকারের কমরেডের কাজ।
বিশ্বজিত বলে, "নারী হচ্ছে এমনি একটি ভুল, যা প্রতিটি পুরুষই আগে পরে করে থাকে এবং এখানে অন্যের অভিজ্ঞতার দাম জিরো।"
২৪ তম পর্ব
সুদীপ ভাবে বিশ্বজিতের বয়েস বেশি এবং ইওরোপীয় নারী স্বাধীনতার ডামাডোলে সম্ভবত একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে গেছে পার্টির কন্ট্রোল-বিচ্যুত হয়ে।
"তুমি এ ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো মনে হচ্ছে "
ও এখানে হো হো করে হেসে একটা গালি দেয়, " কেন শালা? তোর খাড়ায়না?"
সুদীপ কিছুটা বিরক্ত বোধ করে। যতই সময় যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে কেমন যেন সেই আত্মার বন্ধনটি আগের মত নেই ।
"তোমার কি মনে হয়?"
"তা হলে এমন সন্নাসীগিরি দেখাস কেন? জানস এই দেশের মেয়েরা কত ভালো? আমাদের দেশের মেয়েদের মত নয়-ছয় আর কুটিলতায় ভরা নয়। তোকে নিয়ে যেই বৌদিকে আমরা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, তুই জানিস সে আমাদের ঘরে এসে কি আগুন লাগিয়েছে?"
সুদীপ বলে, "ভালো মন্দ সব দেশেই আছে, ওভাবে জেনেরালাইজ করা ঠিক নয়।"
বিশ্বজিত বলতেই থাকে, "আর সৌন্দর্য, আমাদের দেশে দশটা মেয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় বড়জোর ২ টা সুন্দর, আর এখানে ৯টাই সুন্দর।"
সুদীপ বলে, "দেখার ব্যাপার, দেশে তোমার চোখে হয়তো সুন্দর মেয়ে কম পড়েছে, আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম।"
"শালা বাঞ্চোত, তোর দেশ কি আমার দেশের থেকে আলাদা যে ভালোমানুষি দেখাস?"
"দেশ একই, তোমার জীবন-অভিজ্ঞতা হয়তো একটু বেশি, কিন্তু আমার কখনও মনে হয়না যে মেয়েরা অসুন্দর হয়।"
"ও হো আমি তো ভুলেই গেছি তুই শালা বিশ্বপ্রেমিক ছিলি চিরকাল, অথচ মেয়েদের কাছে যেতে বুক কাঁপতো। মেয়েরা ম্যাড়া পছন্দ করে না, তোকে বলেছি না? আগেও বলেছি, আজও বলি, ওরা ধরি মারি খাই বেশি পছন্দ করে।"
"এই দেখ্" বলে সে একটা ঔষধের কৌটা দেখায়। "এর একটা, যে কোন মেয়ে তোর।"
"মানে?"
ও আবার হাসে,"আমার এখানে অনেক মেয়েই আসে, গানের ক্যাসেট ছেড়ে নাচ গান করি। ওদের শ্যাম্পেনে এক ফাঁকে এটা ছেড়ে দিলে ওরা ড্রিংক করার সাথে সাথে অন্য মানুষে পরিণত হয়ে যায়। ওদের তখন সমস্ত বাঁধা বন্ধন ও ইতস্ততি ভাব চলে যায়। অসম্ভব হাসি খুশী ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তীব্র সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং দৈহিক স্পর্শের আকাংখায় পাগল হয়ে যায়। কোনো জোর করতে হয় না।”
ওর বর্ণনার মধ্যেই একটা বুলডগের লালা ঝরানো অভিব্যক্তি ছিল।সুদীপ অচৈতন্য চেতনহীন নয়, নারীর প্রতি টান সেও তীব্রভাবে অনুভব করে। কিন্তু এই স্পষ্ট অপরাধ ও পাশব প্রবৃত্তির কথা শোনার পরে ওর হাত-পা অবশ হয়ে আসে, কেমন একটা ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করতে থাকে। মনে হয় এক্ষুনি ওর সমস্ত নাড়ি ভুড়ি উল্টে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে। ও ডাক্তারি পড়ে, কিনতু কোনোদিন তার ধারণাই ছিলনা এমন কোনো জিনিস মানব জাতি তৈরি করেছে যা এত নীচ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। এবং শুধু তাই নয়, ওরই এককালের প্রিয় বন্ধু, আদর্শগত কমরেড শুধুমাত্র আদর্শ থেকেই বিচ্যুত হয়নি, পরিণত হয়েছে এক অভিজ্ঞ ও অনাচারি নারী শিকারীতে।
ওর আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকতে ইচ্ছে হয়না।
ততক্ষণে ভোর হতে শুরু করেছে, সে বিছানা ছেড়ে জামা কাপড় পরে রওনা দেয়। বিশ্বজিত "কই যাস, কই যাস" করে বিছানার থেকে ওঠে কিন্তু সুদীপ ওকে বলে, "তুমি ঘুমাও, আমার যাওয়া দরকার"।
অনেক সাধাসাধি করা সত্ত্বেও সে বের হয়ে আসে।
বাইরে সাদা তুষারে ঢাকা শহর, এক পশলা শীতের বাতাস নাকে মুখে এসে লাগে। ওভারকোটের নীচে সোয়েটার, তার নীচে শার্ট, তার নীচে গেঞ্জি, তারপরেও শরীর বেয়ে শির শির করে শীত ঢোকে । বাইরে ফর্সা হতে শুরু করেছে কিন্তু হয়ে সারেনি। ঘুমহীন রাত্রির ক্লান্তি, অতি প্রিয় বন্ধুর অদ্ভুত মেটামরফোসিসের তিক্ত বিবমিষা নিয়ে ট্রাম স্টেশনের দিকে যেতে যেতে সুদীপ দেখতে পায় ধীর গতিতে, আধো অন্ধকারে আর্জিনার চোখের মত চোখ খুলে সরীসৃপের মত এগিয়ে আসছে ট্রাম। সে দৌড়ায়। সেই কনকনে ঠাণ্ডা ট্রামের সিটে গিয়ে বসতেই ঝিমুনি আসে, কিন্তু মগজের কোথায় যেন বিঁধে থাকা গজালের মত একটি বাক্য:
"এই দেখ, এর একটা, যে কোনো মেয়ে তোর"
কয়েক বছর চলে গেছে। সেই বিশ্বজিতের ফোন। সে বিয়ে করেছে, একটা ছেলে হয়েছে, মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। ব্যবসা শুরু করেছিল এবং ভালোই করছিল। ৫ম বর্ষে উঠে আর লেখা পড়া করেনি, ইনস্টিটিউট ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায় সব টাকা পয়সা খুইয়ে খারাপ অবস্থা এখন।
একজন বাংগালির সাথে পার্টনারশীপ, একটা অফিস আছে। সুদীপ যদি কিছু মাল সরবরাহ দেয় সে তা বিক্রি করে কিছু লাভ করে সংসার নিয়ে চলতে পারে। সে জানায় তার হাতে একজন ক্যালকুলেটরের ক্রেতা আছে। মাল পাবার সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যাবে এবং টাকা পাঠাতে পারবে অবিলম্বে। কনসাইনমেন্টে বিক্রি ছিলো তখন বহুল প্রচলিত ।
আবেগী, ভাববাদী, স্বপ্নচারী মানুষকে বাম রাজনীতি চুম্বকের মত টানে। কারণ ডান অর্থবিত্ত, মুনাফা, ক্ষমতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা বলে।৩য় বিশ্বে গণতন্ত্র নেই, শুধু অর্থবিত্ত, মুনাফা ও ক্ষমতা আছে শোষণের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ হিসাবে। তাই যে-ই মানবতা-কাতর ও মানুষের কল্যানের কথা ভাবে, বাম শ্লোগানগুলো তাদের গিলে ফেলে আপাদ মস্তক, যেমন সত্যভাষী ও কল্যানকামী লাকুনকে ট্রয়ের উপকূলে গিলে ফেলেছিল সমুদ্র সর্প সেই ট্রয় যুদ্ধের সময়! বলা হয় ট্রয়ের যুদ্ধ থেমেছে কিন্তু আসলেই থেমেছে কি? সুদীপ হল সেই বিরল লাকুন প্রজাতির।
সুদীপ ওর কথা শুনে বিচলিত হয়। ওর মেয়েটা সুস্থ অথচ বিশ্বজিতের ছেলে প্রতিবন্ধী। ওর মনেই আসেনা যে, সে একদিন ওর ওখান থেকে চলে এসেছিল এক অসম্ভব অস্বস্থি নিয়ে তীব্র ঘৃণার বমন ও বাইল গিলতে গিলতে। শুধু মনে পড়ে বিশ্বজিত ছিল ওর প্রিয় বন্ধুদের একজন এবং সে কষ্টে আছে। অথচ সুদীপ ভালো আছে, ওর হাতে অনেক টাকা।
বন্ধু কষ্ট থাকলে এই টাকা দিয়ে কী হয়?
সুদীপের এক দুর্সম্পর্কীয় শ্যালক ছিল, ইগর। ২০ বছর বয়েস। ২ বছরের বাধ্যতামূলক আর্মি সার্ভিস শেষ করে এসেছে। পেশীবহুল পোক্ত গড়ন। অস্ত্র পরিচালনায় সক্ষম। তখনকার লাখ লাখ মানুষের মত আগামীকাল সম্পর্কে অনিশ্চিত, ভীত ও কর্মহীন। এই ধরনের ছেলেরাই তখন কর্মাভাবে দলে দলে বিভিন্ন ক্রিমিনাল গ্রুপ ও মাফিয়ায় যোগ দিচ্ছিল। যারা ক্রাইমে যেতে চাইছিল না তারা গড়ে তুলছিল বিভিন্ন সিকিউরিটি গার্ড ও বডিগার্ড গ্রুপ।
দু দলেরই জীবন-বাজী অস্তিত্বের লড়াই। প্রতিদিন প্রতিঘণ্টায় বাড়ছিল ক্রাইম।
একদিকে নিঃস্ব, বিশাল বেকার বাহিনী, অন্যদিকে অপিরিমিত ক্যাশের চলাচল।
সুদীপ ইগরকে নিয়ে আসে ওর ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে। সে হয় তার বডিগার্ড ও ফাই ফরমাস খাটার মানুষ। একটা গ্যাস পিস্তল কিনে দেয়া হয়, যা দেখতে অবিকল আসল পিস্তলের মতই। আইনত নিষিদ্ধ কিন্তু আইন তখন ছুটিতে। আর আইন প্রয়োগকারী মিলিশিয়া ভক্ষক এবং রক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ স্যাঙাত। সুদীপ ইগরকে ট্রেনে তুলে দেয়, ৬ জনের সাধারণ রাশিয়ান প্লাৎসকার্ট কুপে, তার ব্যাগে প্রায় ৪ হাজার ডলারের ক্যালকুলেটের। সে একজন সাধারণ
রাশিয়ান, তার জামা কাপড় বা ব্যাগ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সাথে তার যক্ষের ধন।
সাথে গ্যাস পিস্তল। সারারাত ট্রেন চড়ে সকালে সে নিরাপদে কিয়েভে পৌঁছায়।
বিশ্বজিত ইগরের যথেষ্ট সমাদর করে। মাল বিক্রি করে ফলস-নোট-ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে গুনে গুনে ৪ হাজার ডলার হাতে তুলে দেয়। তারপরে চড়িয়ে দেয় ফিরতি ট্রেনে। বিশ্বজিতের লাভ হয় ৯ শ ডলার। খুব খুশী হয়। সুদীপকে কল করে ধন্যবাদ দেয়, বলে “ইগরকে ট্রেনে তুলে দিয়েছি।”
“৬ জনের প্লাৎসকার্টে?”
“না, দুজনের ফার্স্ট ক্লাসে।”
“বল কী? কোন্ সাধারণ রাশিয়ান ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে?”
সুদীপের মনে হয় কে যেন তার বুকে বিশাল এক সাইথিয়ান ড্যাগার ফুঁড়ে দেয়।
চলবে
0 মন্তব্যসমূহ