ওয়াসি আহমেদ'এর গল্প: ছয় মিটার দূরত্ব



অনেকটা উঁচু, ৩০/৩৫ তলা থেকে লাফালে পতনের আগে শূন্যে ভাসমান অবস্থায়ই দেড় থেকে দুই সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু ঘটে যাওয়ার কথা। ল্যান্ডিং এর জায়গাটা পাথুরে বা কংক্রিটমোড়া না হলেও চলে। নিচে শক্তসমর্থ জাল বা স্তূপাকার ফোমের বিছানা পেতে হাড়-মাংসসহ গোটা শরীরকে আঁচড়হীন রাখা গেলেও মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব নয়।

রাজন এমনই জানত। বইপত্র, ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁটিনাটি নানা তথ্যের মধ্যে কৌতূহলকর আর যা পেয়েছিল তা এ রকম : মৃত্যুটা ঘটে মাটি বা কংক্রিট যা-ই হোক তা থেকে অন্তত ছয় মিটার ওপরে থাকা অবস্থায়। লাইফ এন্ডস পিসফুলি সিক্স মিটারস বিফোর ইমপ্যাক্ট উইথ দ্য গ্রাউন্ড।

রাজনের বেলা যা ঘটেছে তা ব্যতিক্রমী। বিস্ময়করও বটে। যতদূর মনে পড়ে, সে লাফ দিয়েছিল একটা কুড়ি-একুশতলা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে। ঢাকা শহরেরই কোনো বিল্ডিং হয়তো। ঢাকারই হবে। অতো উঁচু ঢাকার বাইরে কোথায়! এছাড়া যেটুকু মনে আছে, নিচে গাড়ি-টাড়ির ভিড়ভাট্টায় জায়গাটা ঢাকার মতিঝিল হওয়াই স্বাভাবিক, তবে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ বা গুলশানও হতে পারে। যাই হোক, বিল্ডিং বা ভবনটা কুড়ি-একুশতলা হলে মাটি থেকে উচ্চতা কমপক্ষে ষাট-বাষাট্টি মিটার, লাফানোর জন্য খুবই সিকিওর উচ্চতা। রাজনের ওজন ৭৫ কেজির এদিক ওদিক, লাফানোর পর প্রতি সেকেন্ডে ৩৪ মিটার বা ঘণ্টায় ১২২.৪ কিলোমিটার ভেলোসিটিতে তার ধেয়ে নামার কথা, আর ইমপ্যাক্টের অন্তত ছয় মিটার দূরত্বে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় সে রাজন আর রাজন থাকার কথা নয়। মাটিতে বা কংক্রিটে হাড়-মাংস পিণ্ড পাকানোর আগেই সে তার শরীর থেকে বেরিয়ে পড়বে। তারপর সেই ছয় মিটার উচ্চতায়ই ভেসে থাকবে কি না এ নিয়ে অবশ্য কোনো তথ্য কোথাও পায়নি। মোদ্দা কথা, ঘাড়-কোমর বা খুঁলি চুরমার হওয়ার বীভৎসতা তাকে ছুঁবে না, ব্যথা-যন্ত্রণা তো না-ই।

লাফানোর মুহূর্তে এসব মাথায় এলেও সে মনযোগী ছিল একটা ক্লিন লাফ দেওয়ায়। দিয়েও ছিল। সময়টা তখন সকাল না বিকাল এ নিয়ে অবশ্য খটকা রয়ে গেছে। কিন্তু লাফানোর পরপরই, সেকেন্ডে ৩৪ মিটার বা সামান্য কম-বেশি ভেলোসিটিতে তার পতনের বিষয়টা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও রাজন খেয়াল করল সে শূন্যে ভাসছে। সম্ভবত দশ-এগারো বা বারোতলা সবে পার হয়েছে তখনি ঘটনাটা ঘটল। রাজন পরিষ্কার লক্ষ করল সে আর নিচে নামছে না, হাওয়ায় ভাসছে। হাত দুটো ছড়ানো, পাগুলোও টানটান। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে নিয়ম হলো লাফানোর সময় সুইমিংপুলে বা উঁচু পাড় থেকে খালে বা পুকুরে ঝাঁপানোর মতো ঘাড়-মাথা অন্তত ৩০-৩৫ ডিগ্রি সামনে ঝুঁকিয়ে রাখা। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টা মনে রাখেনি বলেই কি প্রয়োজনীয় ভেলোসিটির অভাবে আটকে আছে; হাওয়ায়?

প্রশ্নটা মাথায় টোকা দিতে সে ভাবল কোথাও কিছু গোলমেলে ঘটে গেছে, আর তখনি তাকে চমকে দিয়ে কানে এল মোবাইলের টানা রিংটোন। আশেপাশে কোথাও বাজছে। বেশ সুরেলা। তার নিজের মোবাইলের রিংটোন বেশ কয়েকবার বদলানোর পরও ঝাঁঝালো। ভলিউম কমিয়েও ঝাঁঝটুকু দমাতে পারেনি। কিন্তু শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় সুরেলা বা বেসুরো কোনো রিংটোনই যে কানে পৌঁছার কথা নয়, এ যুক্তিটুকু তার মাথায় এল না। সে বরং ভাবল তার নিজের মোবাইলটা কোথায় রেখে এসেছে? ভাবতে না ভাবতেই শুনল সুরেলা-টুরেলা না, বাজছে তার নিজের বদমেজাজি মোবাইল। আর সেটা তার হাতেই। মোবাইল হাতে নিয়ে কোন আক্কেলে লাফ দিয়েছিল এ প্রশ্নটাও অবান্তর মনে হলো। কিন্তু বোতাম টিপতে গিয়ে মুশকিলে পড়ল, বুড়ো আঙুলের চ্যাপ্টা ডগা কিছুতেই সঠিক বোতামে রাখতে পারছে না। পিছলে যাচ্ছে, নয়তো একটার বদলে দু-তিনটা বোতামে চেপে বসছে। এদিকে শরীরটা পেছন দিকে বেঁকে যাচ্ছে, হাত দুটো ভারী, হাত তো না যেন লোহার দুটো চওড়া নল কাঁধ ফুঁড়ে মাথার ওপরে উঠে যাচ্ছে। এদিকে মোবইলটা তো হাতে নেই। এই না ছিল। গেল কোথায়? ঝাঁঝালো গলায় বেজেই চলেছে।

পুরো বৃত্তান্ত ঠিক এভাবে না হলেও ছাড়াছাড়াভাবে রাজনের মনে পড়ল সকালে বাথরুমে সবে ডান গালে শেভিং ফোম লাগিয়েছে তখন। তাড়াহুড়োর সময়। অন্য গালে, থুতনিতে, গলায় দ্রুত দেদার ফোম ছড়িয়ে সে একটুখানি হাসল। ফোমের ফেনাবন্দী বিমূর্ত হাসিটা ঝটিতে ফকফকে তরঙ্গ তুলল চৌকোনো ঘোলা আয়নায়। রাজন দেখল হাসি না, এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল পারদ-ওঠা পুরোনো আয়নায়।

রাতের ঘটনা বা আয়নার চকিত বিদ্যুৎ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে যখন তার পলাশীর দেড় কামরা ভাড়া বাসা ছেড়ে রাস্তায়, নভেম্বরের আকাশে এলোমেলো ইতস্তত মেঘ, সূর্যটা আছি-আছি করেও পুরোপুরি জেগে ওঠবে কি না দোটানায়। বার কয়েক আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো সূর্য দোটানায় নেই মোটেও, মেঘই চেপে ধরে আছে সূর্যকে, এলোমেলো ভঙ্গিটা আঁটসাঁট হচ্ছে; পারে তো লাজুক তরুণীর গালের এই আছে এই নেই লালচে আভার মতো সূর্যের নিভুনিভু আঁচটাকে এক ফুঁ-তে নিভিয়ে দেয়। রাজন ভাবছে আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা অটোরিকশা খুঁজছে, তখনি দেখল মেঘ যা করার করে ফেলেছে, সূর্যটাকে গিলে ফেলে কালচে পোঁচে আকাশ ছেয়ে ফেলছে। এবার ঝমঝমিয়ে নামবে।

জামাকাপড়ে বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে সে যখন পল্টনে তার অফিসে পৌঁছল, লিফ্টের দরজায় দেখা ইভনিং শিফ্টের আবদুল্লার সাথে। বয়সে বড়, মূল নামটা লম্বা; এ জেড এম আবদুল্লা। এ সময় অফিসে কেন জানতে চাইলে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, নামের সঙ্গে বেমানান বেঁটেখাটো আবদুল্লা বলল, ‘খবর শোনোনি, আরেফিনভাই নাই।’

‘নাই?’

‘সুইসাইড। গতরাতে ছাদ থেকে লাফিয়ে।’

রাজনকে থতমতো খাওয়ার সুযোগ দিয়ে আবদুল্লা বলল, ‘রাত তখন বেশি না, এগারোটা হয় কি না, গলিতে লোক চলাচল ছিল, পড়ন্ত অবস্থায় তাকে উল্টো দিকের বিল্ডিং এর দারোয়ানরা দেখেছে। একটু হলে একটা চলন্ত রিকশার ওপরে পড়তেন। বলতে গেলে লোকজনের চোখের সামনে। দশতলা থেকে কংক্রিট-ঢালাই ম্যানহোলের ঢাকনির ওপর পড়ার পরও জান ছিল, মগজ-টগজ বেরিয়ে যা তা, তারপরও। হাসপাতালে নিতে নিতে সারা।’

‘পড়ার পরও ছিল?’

‘কী?’

‘বললেন না জান। ছিল?’

রাজন এমনভাবে প্রশ্নটা করল, আবদুল্লা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে জানাল, বাদজোহর জানাজার জন্য লাশ আসবে প্রেসক্লাবে।

লিফ্টের দরজা ফাঁক হতে আবদুল্লাকে ঢুকতে ইশারা করে রাজন দাঁড়িয়ে থাকল। শিফ্ট-ইন-চার্জ আরেফিন হাসানের রাত এগারোটা বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত অফিসেই থাকার কথা। তার মানে রীতিমতো প্ল্যান করে আগেভাগে, শরীর খারাপ বা অন্য কোনো ছুতায় বাসায় চলে গিয়েছিলেন। হতে পারে বেশ আগেই চলে গিয়েছিলেন। বাসায় পৌঁছে কি জামাকাপড় বদলেছিলেন? মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়েছিলেন? রাতের খাবার? না-কি বাসায়ই ঢোকেননি, লিফ্টে সোজা দশতলায় উঠে ছাদের কার্নিশে গিয়ে নিচে গলির রাস্তায় তাকিয়েছিলেন। লাফ দেওয়ার আগে নিশ্চয় তাকিয়েছিলেন, কোথায় পড়বেন এ নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা না থাকলেও একবার অন্তত ল্যান্ডিংটা তাকিয়ে দেখা স্বাভাবিক।

এতদূর এসে রাজনের মনে হলো গত রাতে সে নিজেকে দশতলা না, কম পক্ষে কুড়ি বা একুশতলা একটা ভবনের ছাদ থেকে লাফাতে দেখেছে। সকালে গালে ফোম লাগানোর সময় এক ঝলক দৃশ্যটা মাথায় উঁকি দিয়েছিল, এবার খুঁঁটিনাটিসহ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, সঙ্গে হাওয়া। অফিসে হাজিরা দিয়ে তার যাওয়ার কথা এক বিরোধী দলীয় নেতা-কাম-ব্যবসায়ীর বাসায়। ভদ্রলোক সরকারি দল করতেন, মন্ত্রীও ছিলেন এক দফা, গত বছর সিটি কর্পোরেশন ইলেকশনে নাকি খোদ ঢাকার মেয়র নমিনেশন পাওয়া প্রায় ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রকারীদের কারসাজিতে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ইলেকশন করে গো-হারা হারলেও বিদ্রোহী ইমেজকে পাকাপোক্ত করতে পাঁচ-সাতজন সাগরেদসহ গাঁদা ফুলের মস্ত তোড়া নিয়ে বিরোধী দলে যোগ দিয়েছেন। বিরোধী দল প্রথমে নাচানাচি করলেও এখন আর তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। মানববন্ধন-টন্ধন জাতীয় কর্মসূচীতে প্রেসক্লবের সামনে মাইক্রোফোনে গলা ঝাড়ার সুযোগ দিলেও দলীয় প্রধানের ধারেকাছে ঘেঁষার মওকা দিচ্ছে না। ফলে দলবদলের আগে সরকারি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে তার অবস্থা ঘোরতর অনিশ্চিত। এ নিয়ে তার মধ্যে আবার বিদ্রোহের দানা বাঁধব-বাঁধব করছে। এক টেলিভিশন চ্যানেলের টকশো-তে এরকমই কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছেন দিন কয়েক আগে। দ্বিতীয় দফা বিদ্রোহে তিনি কতটা লাভবান হবেন বা আদৌ তার বর্তমান মনোভাবকে বিদ্রোহ বলা যাবে, না-কি তা দীর্ঘ দিনের পুরানো দলের প্রতি অভিমান এসব নিয়ে নিউজ এডিটারের কাছ থেকে ব্রিফিং নিয়ে রাজন যাবে সেই বারিধারায়। এতদূর, তারওপর বৃষ্টি, তারওপর আরেফিন হাসান গতরাতে দশতলা থেকে ...

দুই-তিনবার লিফ্ট ছেড়ে দেওয়ার পর ওপরে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার না পেয়ে রাজন ছয়তলায় তার টেবিলে পৌঁছে দেখল এদিকে ওদিকে ডেস্কটপ মনিটারগুলো জ্বলজ্বল করছে, চোখ গেঁথে যে যার কাজে মশগুল।

ব্রিফিং বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু না। নিউজ এডিটার শুধু মনে করিয়ে দিলেন লোকটা ইডিয়ট টাইপের, কায়দা করে জেরা করলে উল্টাপাল্টা বকবে। সরকারি দলের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ, ত্যাগী নেতা এসব বলে-টলে গেঁথে ফেলতে পারলে রসালো স্টোরি হবে, ঠিকমতো তেল-মশলায় বাগাড় দিলে সেকেন্ড লিড করা যেতে পারে। পাঠকেরা পলিটিশিয়ানদের বদমায়েশির খবরাখবর নিয়ে আর মাথা ঘামায় না, বরং এই লোকের মতো একটা সিনিয়ার ক্লাউনকে নিয়ে কিছুটা মজা পেতে পারে। ‘তোমার রোলটা হবে সিমপেথাইজারের’ বলে ফাজিল হাসি হেসে সঙ্গে সঙ্গে চাপা দিতে, রাজন মাথা দুলিয়ে চেয়ার ছেড়ে ‘আরেফিনভাই এটা কী করলেন’ বলে উঠে দাঁড়াল।

‘তুমি কি অফিসে এসে শুনলে?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘রাতে, অফিসেই খবর পেলাম। ভদ্রলেকের নানা ঝামেলা ছিল, দেখতে না সারাদিন অফিসে পড়ে থাকতেন, ফ্যামিলি লাইফ বলতে কিছু ছিল না। এ অবস্থায় ধুঁকেধুঁকে মরার চেয়ে এক লাফে সব শেষ, ভালো না? স্যরি, ইনডালজ করলাম, সবে মারা গেছেন। কন্ডোলেন্স মিটিং কাল, পারলে থেকো।’

‘কিন্তু লাফ দেওয়ার পরও নাকি বেঁচেছিলেন, মাথা থ্যাঁতলে মগজ-টগজ ছিটকে বেরুনোর পরও।’

‘দশতলা থেকে জাম্প করলে তোমার কি ধারণা মাথা ইনটেক্ট থাকার কথা?’

‘তা না। বললেন না এক লাফে সব শেষ, তা কিন্তু না। পড়ার পরও টিকেছিলেন, জান যায়নি, আবদুল্লাভাই বললেন।’

‘কোন আবদুল্লা?’

‘এ জেড এম। ইভনিং শিফ্টের।’

‘ও কি তখন ছিল নাকি কাছে যে জানবে! সেটা কথা না, আমি ভাবছি অন্য কথা। আরেফিনভাইয়ের পায়ে গাউট ছিল, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুব কষ্টে হাঁটাচলা করতেন, এক অর্থে পঙ্গুই ছিলেন, সেই মানুষ এমন একটা এডভেনচারের সিদ্ধান্ত নিলেন! এক লাফে পগার পার।’

‘কিন্তু পড়ার পরও যদি বেঁচে থাকেন তাহলে এক লাফে ঘটনা শেষ হয়নি, পিসফুলি মারা যাননি, কষ্ট পেয়ে ...’

‘এ গবেষণা তোমার পরে করলেও চলবে, এখন যাও, যেমন বললাম সেভাবে কেয়ারফুলি এগোবে।’

# #

নিজের স্বপ্নের সাথে না মিললেও একই রাতে তার দেখা স্বপ্নের এমন মর্মান্তিক কিন্তু সফল পরিণতিকে রাজন কী বলবে! অবশ্য একথা ঠিক যে সে এমনি এমনি স্বপ্নটা দেখেনি। বছর দুয়েক আগে মাত্র অল্প দিনের ব্যবধানে দিনাজপুরের এক দুর্গম গ্রামে বেশ কয়েকটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যেতে পত্র-পত্রিকায় যা-ই লেখা হোক, তার মনে হয়েছিল আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে সেসময় একটা ঘোর কাজ করছিল। সবসুদ্ধ সাতটা ঘটনা, যার মধ্যে তিনটা একই পাড়ার গা-ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িঘরে। আর সবকটাই ছিল সেই সনাতন গোবর-চোনা মাখা গরুর দড়ি বা শাড়ি-গামছা গলায় পেঁচিয়ে আম-কাঁঠালের শক্তপোক্ত ডাল নয়তো ঘরের কড়িবর্গায় ঝোলে। ঘোর ভেবেছিল এজন্য যে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি, মামলা-মোকদ্দমায় হার, প্রেমে ব্যর্থতার মতো ঘটনাগুলোকে তখন পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতারা যত গুরুত্ব দিয়েই বয়ান করুক, রাজনের বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল আত্মহত্যাকারীরা একে অন্যের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই শাড়ি, গামছা বা দড়ির শরণাপন্ন হয়েছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংগোপনে, হতে পারে, নিজেদের অজান্তেই তারা প্ররোচিত হয়েছে আর সময়-সুযোগমতো যার যার কাজ হাসিল করেছে।

এ নিয়ে যত ভেবেছে, এক ধরনের বলা যেতে পারে সউদ্ভাবিত উপসংহারের দিকে সে এগিয়েছে। কখনো কখনো মনে হয়েছে প্ররোচনাটা তার মধ্যেও কাজ করছে। আত্মহত্যা নিয়ে সাইকায়াট্রিস্টদের কেসহিষ্ট্রি পড়ায় মন দিয়েছে, আর আশ্চর্য হয়ে দেখেছে সে যাকে ঘোর বলে ধরে নিয়েছিল তাকে তারা কেউ কেউ সোজাসাপটাভাবে বলেছেন মোটিভেশন। জীবন শেষ করে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক মনে হলেও দুর্ভোগহীন মৃত্যু-আকাঙ্ক্ষা কারণে মোটিভেশনটা ভিকটিমদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাঁচক। দুর্ভোগহীন, নিরাপদ মৃত্যু। তবে সব আত্মহত্যাকারীদের জানার কথা নয় কোন পন্থাটা সবচেয়ে নিরুপদ্রব। মফস্বলের দিকে লাফিয়ে পড়তে নানা অসুবিধা, যথেষ্ট উঁচু বাড়িঘর কোথায়! নিরাপদ উচ্চতার অভাবে কড়িবর্গা নয়তো আম-কাঁঠালের ডালকে ভরসা করা তাদের দিকে থেকে যৌক্তিকই বলা যায়।

তবে লাফিয়ে পড়ার ব্যাপারটা একদম আলাদা। অবশ্যই নিরাপদ উচ্চতা থেকে। কারণ অন্য কিছু না; লাইফ এন্ডস পিসফুলি সিক্স মিটারস বিফোর ইমপ্যাক্ট উইথ দ্য গ্রাউন্ড। রাজন এমনই জেনে এসেছে। আর মোহেও পড়েছে। ফলে গতরাতে সে যখন নিজেকে কুড়ি-একুশতলা একটা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখল, সেই মোহটাই তাকে তখন আচ্ছন্ন করেছিল। যদিও লাফানোর পরপরই একটা ভজকটে আটকে শেষটুকু আর দেখা হয়ে ওঠেনি। নিজেকে নিয়ে মাত্র গতরাতেই সে স্বপ্নটা দেখল, তবে প্রায় রাতেই কাউকে না কাউকে সে লাফাতে দেখে। দিনের বেলা ছিন্নভিন্ন স্মৃতি মাথায় আসে। সবদিন যে আসে তা না।

মোট কথা, ব্যাপারটা যত অন্য রকমই মনে হোক, রাজন এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে যায় না। এ এমন বাস্তবতা যাকে নিয়ে তাকে চলতে হবে, ব্যথিত হওয়ার কারণ নেই, মজা পাওয়ার তো না-ই। মানুষ লাফাচ্ছে, উঁচু উঁচু দালানের ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাচ্ছে, লাফটা দেওয়ার আগে এদিক ওদিক তাকিয়ে কেউ চোখ থেকে চশমা খুলছে, কেউ ঘড়ি খুলে কার্নিশের ওপর বেশ যত্নে পড়ে না যায় এমনভাবে, আবার কেউ ওয়ালেট, মোবাইল ফোন বের করে একই কায়দায়; যেন একটা চিরাচরিত মুখস্থ রিচ্যুয়েল,সাবধানে গচ্ছিত রেখে তৈরি হচ্ছে। যেন কারো জানতে বাকি নেই বাতাস কেটে প্রবল বেগে ধেয়ে নামতে নামতে মাটি ছোঁয়ার নিরাপদ দূরত্বে, ছয় মিটার আগেই শরীর থেকে নিজেদের তারা মুক্ত করে ফেলবে।

# #

পাক্কা দেড় ঘণ্টা ধরে একের পর এক ট্রাফিকজ্যাম ঠেলে সরকারি দলের সাবেক ও সদ্য-বিরোধী নেতার ঠান্ডা বসার ঘরে বসে রাজন নিজেকে গোছগাছ করতে গিয়ে খানিকটা বিপাকে পড়ল। তেমন কিছু না ভেবেই এসে পড়েছে, প্রশ্ন-টশ্নগুলো মাথায় থাকলেও কি করে এগোবে, সিমপেথাইজারের ভূমিকায়ই-বা কীভাবে অভিনয় চালাবে এ নিয়ে নিজের সাথে ধস্তাধস্তির ফাঁকে লক্ষ করল, নেতা লোকটা সজ্জন। গরমে ঘেমেটেমে তার দুরবস্থা খেয়াল করে, ‘আরে আপনার তো মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হওয়া দরকার’ বলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে দিলেন। ফিরে এসে দেখল বরফকুঁচি ভাসা লেবুর শরবতের গ্লাস তার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজনকে গ্লাসে চুমুক দেওয়ার সুযোগ দিয়ে কথাবার্তা নেতাই আরম্ভ করলেন, আর তা সবকিছু ছেড়ে মার্চের শুরুতেই গরমটা কী সাংঘাতিক, শীত তো এ বছর পড়লই না, ক্লাইমেট চেঞ্জের সবে তো শুরু, আসল বিপদ সামনে; এসব নিয়ে আগড়মবাগড়ম।

নানা প্রসঙ্গ ধরে কথাবার্তা এগোতে নিউজ এডিটারের মুখে লোকটা ইডিয়ট টাইপের শুনে যেমন মনে হয়েছিল, বাস্তবে তার মিল না পেয়ে সে তার ধারণায় অটল থাকল; লোকটা সজ্জন, আর হয়তো সে-কারণে বেশ সরলও। সরল বলেই কি ইডিয়ট, সোজা বাংলায় বেয়াকুফ? সরল লোকদের জন্য বাংলায় আরেকটা লাগসই শব্দ-- নিরীহ। শোনামাত্র ভালোমন্দের হিসাবে না গিয়ে ডাগর চোখের জাবরকাটা আনমনা গরুর মুখ ভেসে ওঠে। তবে রাজনের সমস্যা হলো, সারা জীবন রাজনীতি করা এ লোককে সজ্জন বলে যদি মেনে নেওয়াও যায়, সরল বলা কীভাবে সম্ভব! না-কি নিউজ এডিটারের কথাই ঠিক, সরল বলেই ইডিয়ট! একজন সজ্জন ইডিয়টকে নিয়ে খেলতে তার মোটেও ইচ্ছা করল না।

ভদ্রলোক বললেন একটা বড় ভুল করে ফেলেছেন। গেঁথে ফেলার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও রাজন কাজে লাগাল না। আরো বললেন রাগের মাথায় নিজের এত বছরের দল ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। আফটার অল, রাজনীতির হাতেখড়ি তো এ দলেই সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে। তবে ফিরে আর যাচ্ছেন না, দল আর দল নেই। বিরোধী দলেও থাকছেন না, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন অবসর নেবেন, অনেক তো হলো। ব্যস, কথাবার্তার এখানেই মাথা মুড়িয়ে রাজন কবে থেকে পত্রিকায় কাজ করছে, জব সেটিসফ্যাকশন কি আছে, নতুন ওয়েজ বোর্ডের কী খবর, বাড়ি কোন জেলায়, বিয়ে কি করেছে এসব ভ্যাজরভ্যাজরে চলে যেতে সে হঠাৎ চমকে উঠল, এই সজ্জন বেয়াকুফের সামনে বসে কী করছে! লোকটা জীবনভর রাজনীতিই করেছে, অন্য কিছু না, একবার মন্ত্রীও হয়েছে পশুপালন না কি এক মন্ত্রণালয়ের, এবার বলছে অবসরে যাবে, আর এদিকে সে আরো বড় বেয়াকুফের মতো এসব শুনছে। কেন শুনছে? লোকটা যদি বলত রাজনীতি ছেড়ে ইন্টার ডিস্ট্রিক ট্রাক চালাবে বা রোজ বিকালে সংসদ ভবনের সামনের চওড়া ফুটপাথে বাদাম কি ফুচকা বেচবে তাতেও কি তার কিছু যেত আসত? এমন খবর যদি কাগজে ছাপা হয়, তাহলেই-বা কার কী! পাঠককে এমন ফালতু মজা দিয়ে তার লাভ!

মজা! মজা পেতেই মানুষ বাঁচে, আর যখন নিশ্চিত হয়ে যায় মজার আশা-টাশা বরবাদ, তখন অবসরে যায়, অসুখে পড়ে, মৃত্যুর অপেক্ষা করে বা নিজে নিজেই ডেকে আনে মৃত্যুকে। নতুন করে মজা পাওয়ার আশা নেই, তাই মুক্তির ব্যাপারটা তখন কারো কারো মধ্যে লাগামছুট হওয়া বিচিত্র নয়। তারা তখন উদ্যোগী হয়েই মৃত্যু আহ্বান করে। এ লোকটার জীবন থেকে বোঝা যাচ্ছে মজা-টজা উবে গেছে। কিন্তু অবসরে কেন যাবে, খামোখা সময় নষ্ট। প্রশ্নটা না চাইতেই করে ফেলতে রাজন নিজেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কিন্তু জবাব যা শুনল তা একজন প্রথম শ্রেনির বেয়াকুফকের মুখেই মানায়। লোকটা এবার ধর্মে মন দেবে, এতদিন তো এসব করা হয়নি, দান-খয়রাত করবে, নিজের গ্রামে মরহুম মায়ের নামে এতিমখানা-কাম-মাদ্রাসা করবে, স্ত্রীকে নিয়ে মক্কা-মদিনা ঘুরে আসবে।

রাজন অনুভব করল তার হঠাৎ অস্থির-অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে তার অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল। ঠান্ডা ঘরে বরফকুঁচি মেশানো লেবুর শরবতের পর শরীর-মনে যে প্রশান্তি নেমে আসার কথা তেমন হচ্ছে না। সে নোটপ্যাড, ডটপেন ব্যাগে ঢুকিয়ে লোকটাকে খানিকটা চমকে দিয়ে আরেক দিন এসে অবসরের পরিকল্পনা শুনে যাবে বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়ল।

রাস্তায় নেমে কোথায় যে যাওয়ার কিছুতেই মাথায় এল না। চাকরিটা যাব-যাব করছিল, এবার হয়তো ঠেকানো যাবে না। একটা অটোরিকশা ধরে দোনোমনা করে বলল প্রেসক্লাব। কিন্তু প্রেসক্লাব কেন? ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল অফিসে লিফ্টের সামনে এ জেড এম আবদুল্লার মুখে শুনেছিল বাদজোহর ওখানে আরেফিন হাসানের লাশ আসবে। সে কি শেষবারের মতো আরেফিন হাসানের মরা, ঠান্ডা, থেঁতলানো মুখ দেখতে যাচ্ছে? লাশ দাফনের আগে আপনজনেরা কাজটা করে, আরেফিন হাসান তার আপনজন ছিলেন না। এক জায়গায় কাজ করত বলে মুখচেনা, বারকয়েক কথা হয়েছে, এ পর্যন্তই। একটা চালু দৈনিক থেকে রিটায়ার করেছিলেন বেশ ক’বছর আগে, বয়স হয়েছিল, তবে প্রায় অচল পায়ের জন্য বলতে গেলে পঙ্গুই ছিলেন। অনেক বয়স্ক সাংবাদিকের মতো তিনিও চুক্তিভিত্তিতে কাজ করতেন। তবে যতক্ষণ অফিসে থাকার কথা, তিনি থাকতেন তারচেয়ে অনেক বেশি। কারণ নাকি ফ্যামিলি লইফ, সেখানে থেকে দূরে থাকতেই। কী হতে পারে, অশান্তি না হয় বোঝা গেল, কেমন অশান্তি? আরেফিন হাসান তাহলে শান্তি পেতে খোঁড়া পা সত্ত্বেও লাফটা দিয়েছিলেন। দশতলা উচ্চতাকে তার নিরাপদ মনে হয়েছিল, না-কি এসব নিয়ে রাজন যেমন ভাবে, ভেবে ভেবে একটা পাকাপোক্ত ধারণায় এমনকি বিশ্বাসেও পৌঁছে গেছে, তিনি তেমন ভাবাভাবিতে যাননি?

# #

প্রেসক্লাবে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়িতে তিনটা পার। লাশ দাফনের জন্য আজিমপুর গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা লম্বা মানববন্ধন চলছে প্রেসক্লাবের দেয়ালের ওপারে টানা ফুটপাথ জুড়ে। মাইকে বক্তৃতা চলছে, তবে আশপাশের বেদম ক্যাঁচমেচে কথাগুলো ঠিকঠাক বেরুনোর পথ করতে পারছে না। ভাসা-ভাসা যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, কার যেন মুক্তির দাবী জানাচ্ছে। মানববন্ধন সাধারণত সকালের দিকে হয়। এরা নিশ্চয় সকালে ফুটপাথের দখল পায়নি, কিন্তু অসময়ে এই গরমের মধ্যে গায়ে গা ঘেঁষে ঘাম-জবজব হাত ধরাধরি করে অন্যের মুক্তির দাবীতে কিসের জ্বালা মেটাচ্ছে!

গেটের ভেতরে খোলা চত্বরে টুপি মাথায় জনাচারেক লোক। এদেরই একজন, ময়লা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা কাঁচাপাকা দাড়ি-গোফের কর্মচারি গোছের লোক আরেফিন হাসানের লাশ গোরস্তানে নিয়ে যাওয়ার খবর দিল। বলল, লাশের লরিতে জায়গা হয়নি বলে সে যেতে পারেনি, তাকে একা ফেলে বাকিরা চলে গেছে। পথঘাট চেনে না, ফিরে যাবে কী করে বুঝতে পারছে না, দূর তো কম না, সেই কল্যাণপুর। তবে ফেরা সংক্রান্ত সমস্যার মধ্যেও জানাল সে সাম্বাদিগ ছারের বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার। আল্লা ছারের বেহেশ্ত নসিব করুক বলে বিড়বিড় করে কী যেন বলল, খুব সম্ভবত যারা তাকে ফেলে চলে গেছে তাদের উদ্দেশে।

লোকটা মাথা থেকে টুপি খুলে দলামোচা করে পাঞ্জাবির পকেটে ভরে কল্যাণপুরের বাস এখানে কোথায় পাবে জানতে চাইলে রাজন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, দশতলার ওপর থেকে যখন নিচে পড়লেন, আপনি কাছাকাছি ছিলেন?’

‘চিল্লাপাল্লায় বাইরে আসলাম, রাইত তো কম না, শুইয়া পড়ছিলাম।’

‘কাদের চিল্লাপাল্লা? যারা রাস্তায় ছিল তারা চিল্লাচ্ছিল?’

‘রাস্তায় মানুষজন ছিল না। আশপাশের বিল্ডিং এর সিকিউরিটিরাই চিল্লাচিল্লি করছে আর সাম্বাদিক ছারও ...।’

‘বলেন কী! উনি চিল্লাচ্ছিলেন আপনি নিজের কানে শুনেছেন?’

‘নিজের কানে না শুনলে কই ক্যামনে! নিজের কানে শুনছি, কথা বুজবার পারি নাই।’

‘তারপর?’

‘সে বড় খারাপ অবস্থা ছার, আমরা কয়জন মিল্যা উনারে ধরতে কী কবো, রক্ত তো না, মনে হইছে ফুটানো পানি, আর কল্লাডা তো ছারখার। এর বাদেও গলার আওয়াজ থামে নাই, কী যে কইতেছিলেন কিছু বুজি নাই, আর হাত-পাও-এ কী খিচাখিচিা! কইল্যাণপুরের বাস কি ছার এইখানে পামু?’

লোকটাকে বাসে তুলে দিয়ে ভাড়া আছে কি না জানতে চাইলে সে জোরে মাথা নেড়ে জানাল আছে। বাস ছেড়ে যেতে রাজন কয়েকটা দীর্ঘ মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে নিজেকে বলল, এবার?

লাইফ এন্ডস পিসফুলি সিক্স মিটারস বিফোর ... এমন একটা বানোয়াট কথা সে বিশ্বাস করে আসছে ভাবতে গিয়ে মনে হলো এতদিনের খাঁচাবন্দী চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় হাজারটা পোকা হয়ে হুটোপুটি জুড়ে দিয়েছে। একটা মিথ্যাকে লাই দিয়ে সে তার ভাবনাচিন্তার জগতকে পাল্টে ফেলতে চেয়েছিল। খুব যে মুক্তি-মুক্তি করত মনে মনে, স্বপ্নে দেখত উঁচু-উঁচু দালানের কার্নিশে বুক-পেট চেপে লাফাবে বলে মুক্তিকামনায় বাঁধা-বন্ধনহীন মানুষ তৈরি হচ্ছে, সে তো ভুয়া। লাফিয়ে পড়ে মানুষ মারা গেছে শুনে শুধরে বলত, মরে নাকি আবার, হাড়গোড় চুরমার হওয়ার আগেই শান্তিতে, পিসফুলি ...

কিন্তু এত সহজে রাজন দমে কী করে! শান্তিতে, পিসফুলি যদি না হয়, মৃত্যু যখন অনিবার্য; সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে হলেও, মুক্তি কি অধরা থেকে যায়!

খটকাটা মাথায় পুরে সে গুটিয়ে যাওয়া শেষবিকালের আলো দেখল। বৃষ্টির পর আকাশে চনমনে বাদামি রোদ, ছিন্ন মেঘ।

গত রাতের স্বপ্নটা যদি আজ রাতে আবার ফেরে? নিজেকে নিয়ে না দেখলেও চেনা-অচেনা অন্য কাউকে নিয়ে দেখা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এতদিনের অভ্যাস। চারপাশে এত এত মুক্তিপাগল!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ