এমন উত্তেজনাকর ঘটনা কদাচিৎ ঘটেনি নিস্তরঙ্গ মুকুন্দপুরে। পাঁচ বছর অন্তর অন্তর বড় ভোটের সময় মুকুন্দপুরে সাজ সাজ রব ওঠে, একথা ঠিক। মাইক, পোস্টার, উটকো লোকজনের আনাগোনায় কদিনের জন্য উৎসব উৎসব আমেজ জেঁকে বসে গ্রামটা জুড়ে। আজকের ঘটনা ভিন্ন।
ভোট ভিক্ষার হট্টগোল ছাড়াই গ্রামটা উত্তেজনায় কেমন থরথর করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুকুর পাড়ে লোকের মাথাও ক্রমশ বাড়ছে। এসব খবরের যেন পাখা থাকে। খবর উড়ে গিয়ে দূর-দূরান্তের গ্রামবাসীর কান পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যায়। দূরেরগাঁ থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। পুকুর থেকে একটু দূরে একটি পুরনো পাকুড় গাছ। গাছটার গুঁড়ি ঘেঁষে সিমেন্ট বাঁধানো চাতালের উপর ছায়া পড়েছে। সেখানে রহিম শেখ বসবে কি বসবে না ভেবে বেশ কিছুক্ষণ দোনামোনা করছিল। সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে শূন্য চোখে মানুষের ঢলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই চাতালটা খুব পুরোনো নয়। মাস নয়েক আগে বলা কওয়া নেই, হুট করে একদিন ইট সুরকি ফেলে চাতালটা তৈরি করায় চেয়ারম্যান। তারও কয়েক মাস পর পুরো জায়গাটা ঘটা করে পাকা করা হয়। সব মিলিয়ে সাড়ে ষোল মাস বয়স চাতালটার। কী এক রহস্যময় কারণে গ্রামের কাউকেই চাতালের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না চেয়ারম্যানের সাঙ্গোপাঙ্গরা। পাহাড়ি মণ্ডলের নেতৃত্বে গুটিকয়েক গ্রামবাসী সে রহস্য নিয়ে যে মাথা ঘামায়নি তা নয়; কিন্তু হালে পানি পায়নি। গ্রামের বাকি হতদরিদ্র মানুষগুলোর এই রহস্যের থই খোঁজার খুব একটা আগ্রহ কিংবা সময় নেই। দিনের অধিকাংশ সময় পেটের চিন্তায় তারা ব্যতিব্যস্ত থাকে। উদয়-অস্ত তাদের খাটুনিতেই যায়। ঘটনার ডামাডোলে চেয়ারম্যানের সাঙ্গোপাঙ্গরা আজ এদিকটায় কেউ পাহারায় নেই। সেই সুযোগে কিংবা মনের ভুলে, নিষেধাজ্ঞা মাড়িয়ে রহিম শেখ চাতালটায় থেবড়ে বসে পড়ে। বহুদিন পর হঠাৎ করে একটা অন্য রকম হাওয়া ওঠে। পাকুড় গাছটা সরসড় করে পাতা দোলায়। রহিম শেখ সড়সড় নয়—শুনতে পায় গাছটা বিড়বিড় করে কিছু বলছে। গাছের ভাষা তার জানা নেই। শূন্য চোখে সে কেবল মানুষ দেখে। অদূরে হরিচরণের বউ ইন্দুবালা এর মধ্যে বার কয়েক মূর্ছা গেছে। জ্ঞান ফিরতেই তার আহাজারিতে গাছটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
চেয়ারম্যানের শালা জাহাঙ্গীর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থানায় খবর দিতে গেছে সেই কখন। এখনও ফেরেনি। রহিম শেখ একটা বিহিতের অপেক্ষায় বসে আছে বহুক্ষণ। সকালে সবেমাত্র যখন সে ক্ষেতের কাজে হাত লাগিয়েছে, খবরটা তখনই পায় রহিম শেখ। সেই প্রথম ব্যক্তি যে পাহাড়ি মণ্ডলের মুখে পুকুর পাড়ের খবরটা শোনা মাত্র কালক্ষেপণ না করে ছুটে এসেছিল। উত্তেজনায় নিজের বয়স ভুলে প্রায় দৌড়েই এসেছিল রহিম শেখ। হাপরের মতো বুকের ওঠানামা সামাল দিতে দিতে কাদার ভেতর গেঁথে থাকা কাঠামোটা শকুন দৃষ্টিতে বহুক্ষণ দেখেছে। এমাথা- ওমাথা গিয়ে নানাভাবে দেখেও কোনো সিদ্ধান্তে সে পৌঁছাতে পারেনি। তার পক্ষে নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব হয়নি রতনদের আবিষ্কৃত কঙ্কালটার সাথে তার সাতমাস নিখোঁজ ছেলে শেরালির কোথাও কোনো মিল আছে কি নেই। হাড়গোড় দেখে কীভাবে চেনা সম্ভব! অথচ রহিম শেখের মন বলছে এ কঙ্কাল তার নিখোঁজ সন্তান শেরালিরই। চেয়ারম্যানের মতে পুলিশই নাকি এর বিহিত দিতে পারে। ব্যর্থ পিতার দায়ভার নিয়ে ভিড় থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে রহিম শেখ চাতালে বসে আছে। পুলিশ আসবে। তার জন্য অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে পুকুর পাড়ে প্রচুর লোকের ভিড় জমে গেছে।
চেয়ারম্যানের শালা জাহাঙ্গীর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থানায় খবর দিতে গেছে সেই কখন। এখনও ফেরেনি। রহিম শেখ একটা বিহিতের অপেক্ষায় বসে আছে বহুক্ষণ। সকালে সবেমাত্র যখন সে ক্ষেতের কাজে হাত লাগিয়েছে, খবরটা তখনই পায় রহিম শেখ। সেই প্রথম ব্যক্তি যে পাহাড়ি মণ্ডলের মুখে পুকুর পাড়ের খবরটা শোনা মাত্র কালক্ষেপণ না করে ছুটে এসেছিল। উত্তেজনায় নিজের বয়স ভুলে প্রায় দৌড়েই এসেছিল রহিম শেখ। হাপরের মতো বুকের ওঠানামা সামাল দিতে দিতে কাদার ভেতর গেঁথে থাকা কাঠামোটা শকুন দৃষ্টিতে বহুক্ষণ দেখেছে। এমাথা- ওমাথা গিয়ে নানাভাবে দেখেও কোনো সিদ্ধান্তে সে পৌঁছাতে পারেনি। তার পক্ষে নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব হয়নি রতনদের আবিষ্কৃত কঙ্কালটার সাথে তার সাতমাস নিখোঁজ ছেলে শেরালির কোথাও কোনো মিল আছে কি নেই। হাড়গোড় দেখে কীভাবে চেনা সম্ভব! অথচ রহিম শেখের মন বলছে এ কঙ্কাল তার নিখোঁজ সন্তান শেরালিরই। চেয়ারম্যানের মতে পুলিশই নাকি এর বিহিত দিতে পারে। ব্যর্থ পিতার দায়ভার নিয়ে ভিড় থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে রহিম শেখ চাতালে বসে আছে। পুলিশ আসবে। তার জন্য অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে পুকুর পাড়ে প্রচুর লোকের ভিড় জমে গেছে।
হরিচরণের বউ ইন্দুবালাও খবর পেয়ে বসে থাকেনি। আলুথালু শাড়ির আঁচল লুটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুকুর পাড়ে এসে উপস্হিত হয়েছে। কেউ একজন আঙুল তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়া মাত্র, ঘোরগ্রস্তের মতো কী দেখছে না দেখছে, তার তোয়াক্কা না করে ‘ওরে আমার সতী রে’ বলে আছাড়ি-পিছাড়ি করে কান্না জুড়েছে।
রতন, মতি, নাড়ু কেমন বেকুব বনে গিয়ে পুকুর পাড়ে জালের কাছাকাছি থম ধরে বসে আছে। জালে আটকে থাকা অতিরিক্ত মাছগুলো খাবি খেতে খেতে কখন জানি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওদের তিনজনের মুখে কেমন একটা বিব্রত-বিরক্তির ছাপ। পুকুরে মাছ বেছে নেওয়ার কাজটা আধ খামচা পড়ে রইল। ভাবচক্করে মনে হচ্ছে হাটে ওদের দোকান গুলো আজ গোটাদিন তালাবদ্ধই থাকবে। কারবারে সম্ভাব্য ক্ষতির চিন্তা চিড়বিড়ে রাগ ছড়ায় তিনজনের শরীরে। নাড়ুর কথা মতো পুকুর পাড় ছেড়ে না পালানোটা যে বোকামির হয়েছে, সে বিষয়টা এমুহূর্তে তিনজনকে তিনভাবে সন্তর্পণে বিদ্ধ করতে থাকে। এই ঝামেলা কখন মেটে কে জানে! পুলিশ না আসা পর্যন্ত ওদের কোথাও যাওয়া চলবে না। চেয়ারম্যানের এই হুকুম মাথায় নিয়ে কাদামাখা শরীরে পুলিশের অপেক্ষায় ওরা বসে আছে।
ওদের সবার মাথার উপর সূর্যটা ডগডগিয়ে রীতিমত তেজ দেখাতে শুরু করেছে।
বড় পুকুরের বছরান্তের সংস্কার কাজ শেষে নতুন করে পোনা ছাড়া হবে। এ বছর পুকুরের তেমন বড়সড় সংস্কারের প্রয়োজন নেই। পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের রাক্ষুসে শোল গজার, বোয়াল ইত্যাদির সাথে পুঁটি, মলা ঢেলার মতো ছ্যাচড়া মাছ গুলো সরিয়ে নেওয়া লাগে। তিন বন্ধু গতসন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজ সাত সকালে পুকুরে জাল ফেলবে। তারপর একটু বেলা করে খেয়েদেয়ে যে যার কাজে রওনা দেবে। কথা মতো দিনের গায়ে রোদ চড়ে বসবার আগেভাগে তিনজনে পুকুরপাড়ে চলে এসেছিল। রতনের জাল আছে। আগেই ঠিক হয়েছিল, মাছ যা ধরা হবে চারভাগ হবে। রতনের দুইভাগ- যেহেতু জালটা রতনের। অন্য দুজনে একভাগ করে। পুকুরে জাল ফেলার আগে স্বভাব মতো কীসব মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে জালটা ছুঁড়ে দেয় রতন। পুকুরের পানিতে এখন টান ধরেছে। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। এ পুকুরে বছরের পাঁচ থেকে ছয় মাস পানি থাকে, তাতে মাছ চাষ হয়। পুকুরটা বারোয়ারি। মুকুন্দপুর সমবায় সংঘ, চাঁদা তুলে পুকুরের দেখভাল করা হয়। রতন, মতি নাড়ু নিয়মিত চাঁদা দেয়, শ্রম দেয় সমিতির উন্নয়নে। পুকুরের মাছ নিয়মিত হাটে বিক্রির পাশাপাশি সদস্যেরা চাইলে নিজেদের জন্যও বছরে এক-দুবার মাছ ধরতে পারে। রতনের মন্ত্রে কাজ হয়েছে। জালটা ওজনে বেশ ভারি। টেনে তোলার আগে পাড়ে বসে বিড়ি ফুঁকতে থাকা মতি আর নাড়ুকে গলা তুলে ডাকে রতন।
- তোরা কী বিড়ি ফুঁকতে আসছিস? মাছ বাছি যেগলান নেবার নিয়ে বাকিগুলান পুকুরে থুবার লাগবি না! নে হাত লাগা।
রতনের কথায় বিড়ি ফেলে দুজনেই তড়াক করে উঠে পড়ে। ঠাণ্ডা পানিতে মুখ হাত ধুয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও এখন পুকুরের পানি কাদাময় হওয়ায় ইচ্ছেটা বাতিল করে মতি। কী খেয়ালে সেই পানিতে নেমে পড়ে সে। নাড়ু রতনের পাশে দাঁড়িয়ে জালে আটকে থাকা মাছ বাছায় হাত লাগায়। ভালো মাছ উঠেছে। সাথে জঞ্জালও কম নেই। বেছে বেছে জঞ্জাল-মাছ আলাদা করতে থাকে দ্রুত। মতি খানিকটা উজিয়ে ডানপাড়ের পানা আর কাদাময় জায়গাটায় কী একটা দেখে এগিয়ে যায়। বাছাবাছিতে ব্যস্ত দুজন খানিক পর মতির আর্তচিৎকার শুনে চমকে তাকায়।
দেখে মতি দুদ্দাড় পানি ভেঙে ওদের দিকে ছুটে আসছে। ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। একে অন্যের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। গোটানো জালে তখনও গুটি কয়েক মাছ রয়ে গেছে, যেগুলো এখন রীতিমত খাবি খাচ্ছে। নাড়ু নীরবতা ভাঙে প্রথম।
-ওইটে মানুষের কঙ্কাল, ঠিক কিনা ক তোরা?
- হ, হ, মানুষেরই তো বটে।
সমবায় সমিতির পুকুরে মাছের চাষ হয় বহু বছর ধরে। এখানে মানুষের মৃতদেহ কী করে আসতে পারে তার কোনো থই খুঁজে পায় না ওরা। তবে ঘটনা খুব সুবিধার না এটা স্পষ্ট। প্রথম সনাক্তকারী হিসেবে কোনো ঝামেলায় তাদের জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটা নিয়ে তিনজনে তিন রকম ভাবনা ভাবে। মতিটা ওদের মধ্যে ভীতু প্রকৃতির। সে প্রস্তাব দেয়,
- যেটুকুনি মাছ পাওয়া গেছে তাই নিয়ে সরে পড়ি চল। ও জিনিস আমরা দেখি না…
মতির মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই পুকুর পাড়ে পাহাড়ি মণ্ডল কাকাকে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়। ছোট্টখাট্ট গড়নের আগন্তুক মানুষটার নামটাই শুধু অদ্ভুত তা নয়, ওর আচার-ব্যবহারও বেশ অদ্ভুত। একজনের কথা পাঁচকানে পৌঁছাতে ওস্তাদ লোক।
-কী রে মাছ কিরম ধরিছিস?
বলতে বলতে পাড়ের কাছে ফেলে রাখা জালটার কাছে চলে আসে পাহাড়ি কাকা।
-অম্মা! জালে মাছ খাবি খায় আর তোরা ভ্যাবলার মতো খাড়ায়ে রয়েছিস! এ কেমন ধারার ব্যবহার তোগের? খপর কি খুলে ক’ দেনি?
এরপর কয়েক মুহূর্তের ভেতর মতির দেখা ঘটনার সবটা পেটপাতলা রতনের কাছ থেকে খুঁটিয়ে জেনে নিতে পাহাড়ি মণ্ডলের বেশিক্ষণ লাগে না। গলা উঁচিয়ে নিজেও অকুস্হল দেখে নেয় একবার। তারপর, তার অনেক কাজ, একথা বলে দ্রুত পুকুর পাড় ত্যাগ করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, পাহাড়ি মণ্ডলের অনেক কাজের নমুনা হিসেবে পুকুরের পাঁকে মানুষের হাড়গোড় দেখার খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগেনা।
বৈচিত্রহীন গ্রামীণ জীবনে এরকম ঘটনাগুলো বেশ একটা হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপারের জন্ম দেয়। দশদিক থেকে ছুটে আসা কৌতূহলি মানুষের ভিড় জমে যায়। ঘটনা যাই ঘটুক, প্রায় প্রত্যেকেরই সে বিষয়ে কিছু একটা বলার থাকে। এই সরবতা ঘটনাস্হলে পুলিশ আসবার আগ পর্যন্ত চলমান থাকে। পুলিশ হাজির হওয়া মাত্র অধিকাংশের মধ্যেই ঘটনা সম্পর্কে কেমন বৈরাগ্য জন্মায়। মোচড়া-মোচড়ি করে যে যেভাবে পারে ঘটনাস্হল থেকে পালিয়ে বাঁচে। গ্রামের মানুষ এখনও পুলিশ ভয় পায়। এই ভয়ের সাথে সমীহের কোনো সম্পর্ক নেই। যা আছে সেটা অযথা হেনস্হা আর ক্ষয়ক্ষতির ভীতি।
উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘটনাস্হল দেখে আসা কেউ একজন গামছায় মুখ মুছতে মুছতে মতামত দেয়--
-ওইটে মাইয়ে ছেইলের হতি পারে।
-কী কচ্ছো! ওইটে কি তালি সতীবালা?
-হতি পারে, আবার নাও হতি পারে।
সটান পরিণতিতে না পৌঁছে দোদুল্যমান মতামতের অভিঘাতে অনেকের কণ্ঠে আফসোসের ঢেউ খেলে যায়। ঢেউটুকু মিলাতে না মিলাতে অন্য কেউ গলা তোলে-
-ও মিয়া তুমি এইডে কি কও! হাড্ডিগুড্ডি দেখি কওয়া সম্ভব ওইটে মাইয়ে ছেইলের না ব্যাটা ছেইলের?
সেই প্রশ্নে মুখগুলোয় কৌতূহল ঝলকে ওঠে। মুহূর্তকাল পরেই ফস্ করে আরেকজন ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বলে ওঠে
- যাই বলো, ওইটে আমাগের গ্রামের ছেইলে-মাইয়ের দুইজনার মধ্যে কারো একজনার হবার পারে এইটে নিচ্চিত- নাকি?
নিজের মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার আশায় বাকিদের দিকে তাকায় মন্তব্যকারী।
এই গ্রামের দুটি হতভাগ্য ছেলে-মেয়ে শেরালি এবং সতীর নিখোঁজ হওয়ার শোক স্মৃতি জীবন্ত হয়ে গ্রামবাসীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদের নিখোঁজ হওয়ার সর্বমোট সাড়ে ষোল মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ আজও কোনো হদিশ দিতে পারেনি। গ্রামের লোকজন এখনও বিষয়টা নিয়ে প্রায় আলোচনা করে। ওদের ধারণা গরীবগুর্বাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সরকার কিংবা পুলিশের মাথা ব্যথা থাকে না। চেয়ারম্যানের গরু খোয়া গেলে যতটা দৌড় ঝাঁপ হয়, তাদের মতো মানুষের ক্ষেত্রে তার এককণাও ঘটে না। চোখের সামনে ওদের বেড়ে উঠতে দেখেছিল গ্রামবাসী। আলাপরত মানুষগুলোর বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। হঠাৎই তখন ঝনঝনে জৈষ্ঠ্যের রোদ ঠেলে বাতাসের একটা ঘূর্ণি ওঠে। মানুষগুলোর সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস গিয়ে মিশে তাতে। ঘূর্ণিটা পাক খেয়ে পাকুর গাছটায় ধাক্কা দেয়। আচমকা বাতাসের ঘূর্ণি বিশাল গাছের ডালপালায় আলোড়ন তোলে। আন্দোলিত ডালপালার শক্তপোক্ত শাখায় রূপোর একটা তাবিজও তার সাথে তাল মিলিয়ে হেলেদুলে নেচে যায়। নাচনের তালে তালে তাবিজের রূপোর চেনটা ডালে পাক খায়। ইতোমধ্যে চেনটা গাছের ডালে বেশ কয়েকবার পাক খেয়ে নিজের অবস্হান শক্ত করে ফেলেছে। যে কারণে গিঁট খুলে না গিয়ে ডালের সঙ্গে বেশ শক্ত বাঁধনে সেটা জড়িয়ে আছে।ডালপালার আড়ালে ‘আল্লাহ’ লেখা তাবিজটা কেমন এক বোবা কান্নার মতো গাছের ডালে ঝুলে থাকে। হঠাৎ ওঠা সে আলোড়নে গাছের তলায় নিশ্চল বসে থাকা রহিম শেখের শরীরে জৈষ্ঠ্যের পাকা গরমেও শীতের কাঁপন ধরিয়ে ক্ষণকাল আগে মূর্ছা যাওয়া ইন্দুবালার চোখে মুখে ঝাপটা দেয়। ইন্দুবালার চোখের পাতা ঈষৎ কাঁপে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে। সজ্ঞানে থাকলে সে তার নিখোঁজ সপ্তদশী কন্যা সতীবালার শোকে নতুন করে কেঁদে উঠতো।
মাঠে আউশের চারায় প্রথম কিস্তির সার দেবার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে রহিম শেখ কতক্ষণ বসে থাকবে ঠাহর হয়না। চেয়ারম্যান তাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে ঠিকই বাড়ি চলে গেছে। মাঠে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে ছোটো ছেলে সুরুজালি কী কাণ্ড বাঁধায় কে জানে। লোকমুখে পুকুরের খবরটা পেলে বিপদ। বউটা জেগে উঠলে অসুস্হ শরীরেই ছুটে আসবে হয়ত। ছেলেটার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ওরচে বয়সে দুই বছরের ছোটো মেয়েটা ঢের বুদ্ধি রাখে। বউ শরিফা পেটের পুরনো যন্ত্রণায় সারারাত কাটা মুরগির মতো ছটফট করে ভোরের মুখে ঘুমিয়েছে। গোটা দিনটাই সে আজ ঘুমের ঘোরে থাকবে। সকালে মাঠে যাওয়ার সময় নিজেই যা পারে খেয়ে নেবে ভেবেছিল। মেয়েটা ঠিক উঠে গেছে। শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে পেঁয়াজ কুচিয়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে পান্তার সাথে বাপকে খেতে দিয়েছে। ভরপেট খেয়ে এসে মাঠের কাজে সবে হাত লাগিয়েছিল...। এতটা বেলা বয়ে গেল এখনও জাহাঙ্গীর বা পুলিশ কারো দেখা নেই। নড়েচড়ে বসে রহিম শেখ। ঘাড় তুলে ভিড়ের ভেতর সুরুজালি বা তার মেয়েটা উপস্হিত কিনা সেটা দেখবার চেষ্টা করে। অত মাথার ভিড়ে থই হারিয়ে তার চোখ স্হির হয় হরিচরণের উপর। বেচারার মতো বউটার পাশে বসে আছে। বউটা থেকে থেকে মূর্ছা যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন করে রহিম শেখের। আচ্ছা ওইটে যদি শেরালির না হয়! তারা কি শেরালির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাবি না? গোরের মাটি পাওয়ার ভাগ্যি হবি না তার সন্তানের!
এখানে উপস্হিত হওয়া অবধি সে বড় ছেলের কথা ভেবে চলেছে। তার ওরকম সহজ সরল ছেলেটা নাকি রাজনীতিতে জড়িত ছিল, তাও আবার সর্বহারার মতো ভয়ানক একটা দলে। তারা কেউ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। এই দল যে এখনো দেশে আছে, রহিম শেখের জানা ছিল না। একসময় সর্বহারার ভয়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। রাতবিরেতে তো বটেই, দিনে দুপুরে গলায় ছুরি চালিয়ে পালিয়ে যেতো ওরা। তার ছেলে ওরকম একটা খুনে দলে যোগ দিতে পারে কল্পনারও বাইরে। তাছাড়া সেরকম শিক্ষাদীক্ষাও তো তার ছিল না। কার পাল্লায় পড়ে ওই সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিল ছেলেটা! এখন মাবুদে এলাহি ছাড়া আর কারো পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না। ছেলের পাগলামির মাশুল এই বুড়া বয়সে তাদের গুণতে হচ্ছে। ছেলের কোনো সন্ধান তারা পায়নি। কেউ কেউ বলেছে- সে আর নেই। লাশ হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের লাশটাও দেখার সুযোগ পায়নি রহিম শেখ। এতোদিন রহিম শেখ বিশ্বাস করতে চায়নি। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে এই কঙ্কালটা তার সন্তানের। গভীর মমতায় কঙ্কালটা বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। শেরালি এই পুকুরে শুয়ে ছিল এতদিন। দমচাপা কষ্ট আঁচড় কাটে বুড়ো বাপের বুকে। পাকুড় গাছটা আবার সড়সড় করে ওঠে। খানকতক পাতা ঝরিয়ে দেয় চাতালের উপর।
উত্তর পাড়ার মজিদ মাস্টার না বললে ছেলের বিষয়ে হয়ত তারা কোনোদিন জানতেও পারতো না। মজিদ মাস্টারের সাথে রাজনীতি করা লোকদের যোগাযোগ আছে। তাদের কাছ থেকে একদিন খবর পাওয়া গেল ছেলে সর্বহারার কোন্দলে পড়েছে। তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে। বাড়ি থেকে তাকে সরিয়ে দিতে বলেছিল মজিদ মাস্টার। কিন্তু তার আগেই একদিন ছেলেটাকে রাতের বেলা কেউ এসে চেয়ারম্যানের শালা জাহাঙ্গীর কথা বলতে চায় বলে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর থেকে ছেলে নিখোঁজ। পরদিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছেলের খোঁজে গিয়ে রহিম শেখ জানতে পারে জাহাঙ্গীর বাড়িতে নেই। রাতে শেরালিকে তার ডেকে আনার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ফেরার পথে রহিম শেখ বৈঠকখানায় চা পানরত জাহাঙ্গীরকে দিব্যি দেখতে পেয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে মুখখোলার আগেই চেয়ারম্যনের খাস লোক এসে, নগদে চোটপাট দেখিয়ে তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল। উচ্চবাচ্যের জোর পায়নি আর। সতী নিখোঁজ হওয়ার পর হরিচরণ আর ইন্দুবালা হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতো চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। ভিটেমাটি লোপাটের হুমকি দিয়ে ওদের হটানো হয়। সেরকম হুমকি পেলে কোথায় যেতো তারা!
পুলিশের কাছে গিয়ে কাজ হয়নি। উল্টে তাদের নানা ধমকিধামকি সহ্য করতে হয়েছে। গাঁটের পয়সাও খসেছে কিছু। নিখোঁজের সাড়ে সাত মাস পেরিয়ে গেল, ছেলের খবর পেলো না। নিদেনপক্ষে তার লাশের হদিশটাও না। এতদিন তবু শোকটা চাপা দেওয়া ছিল, কোনো একদিন ছেলেটা ফিরে আসবে। কিন্তু এই কঙ্কাল আবিষ্কার হওয়ার পর চাপা দেওয়া শোকটা জেগে উঠেছে। রহিম শেখের মন বলছে এটা তার শেরালি। ছেলের ফিরে আসার যে ক্ষীণ আশাটা জেগে ছিল, সেটা আজ বুঝি শেষ হয়ে গেল।
পাকুর গাছটার ছায়া মাড়িয়ে দিনটা যখন পুকুরের দক্ষিণে হেলে পড়েছে ঠিক তখন জটলা পাকানো মানুষগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্যের একটা ঢেউ ওঠে। জাহাঙ্গীর ফিরেছে। সাথে একজন এসআই এবং দুজন কনস্টেবল। চারপাশে শোরগোল পড়ে গেল হঠাৎ করে। চেয়ারম্যানও হন্তদন্ত এসে উপস্হিত হয়। জাহাঙ্গীর এখানে পৌঁছানোর আগে নিশ্চয়ই দুলাভাইকে জানিয়েছে।
পুলিশের হুকুম মতো ল্যাকপেকে দুজন কাদাময় পুকুরে নামে। কঙ্কালটা সাবধানে তুলে আনার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকে পুকুর পাড়ে দাঁড়ানো কনস্টেবল দুজন।
-সাবধান, হাড্ডিগুড্ডি আস্ত থাকে যেন।
ভয় মিশ্রিত প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে লোক দুজন কঙ্কালটা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বাধা পায়।
যত হালকা হবে ভাবা হয়েছিল ততটা হালকা নয় কাঠামোটা। চেন দিয়ে বিশাল বড় আর ভারি একখানা পাথরের সঙ্গে বাঁধা ওটা। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে লোকগুলো। কঙ্কাল আস্ত রেখে এই জগদ্দল টেনে হিঁচড়ে নেওয়া অসম্ভব। আরো দুজন আসুক।
পায়ে পায়ে রহিম শেখ এসে দাঁড়ায়। স্ত্রীর কাঁধ আঁকড়ে হরিচরণও আসে। পুকুর পাড়ে টেনে তোলা কঙ্কালটার দিকে সমবেত চোখগুলো বিস্ময়-কৌতূহল আর বেদনা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
রহিম শেখের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। লোকজন ঠেলে কঙ্কালটার কাছে আসার চেষ্টা করে। তীক্ষ্ণচোখে কঙ্কালের গলার কাছটা দেখে নিতে চায়। তার ছেলের গলায় রূপোর চেনে ‘আল্লাহ’ লেখা একটা তাবিজ ছিল। সাত্তার পীরের কাছ থেকে রহিম শেখের মা ফরিদা বেগম এনে দিয়েছিল। নাতীকে বিপদ-আপদ থেকে তাবিজটা রক্ষা করবে। আদরের নাতী মৃত দাদীর শেষচিহ্ন হিসেবে সযত্নে সেটা ধারণ করতো। যেরাতে চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে যায়, সে রাতেও তাবিজটা গলায় ঝুলতে দেখেছে। আদুল গায়ে ছিল ছেলেটা। চেয়ারম্যানের বাড়ি রওনা দেবার মুখে সাদার উপর সবুজ হলুদ ফুলতোলা শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই শেষ দেখা। রহিম শেখের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বার বার। বারকয়েক চোখ ডলেও রূপোর চেন বাঁধা তাবিজটা দেখতে পেলো না। একটু হোঁচট খেয়ে রহিম শেখ আবার চাতালের কাছে যায়, বসতে গিয়েও বসে না। ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ঘাড় থেকে হরিচরণের হাত সরিয়ে ইন্দুবালাও ভীড় ঠেলে কঙ্কালের খুব কাছে যায়। জলভরা চোখে আতিপাতি কঙ্কালের নাকনকশা খোঁজে। নাকের বদলের একটা প্রায় ত্রিভুজাকৃতির হাঁমুখ ফুটো দেখে তরাসে চোখ বুজে ফেলে। মেয়ে সতীবালার নাকে একটা নকল নীরে বসানো নাকছাবি ছিল। ইন্ডিয়া থেকে ইন্দুবালার পিসতুতো নিঃসন্তান বড়দা আর বড়দার বউ বছর দুয়েক আগে একবার বেড়াতে এসেছিল। তখন ভাগ্নীকে পূজোতে পরার জন্য জরিপাড় শাড়ি-চুড়ির সঙ্গে নাকছাবিটাও কিনে দিয়ে গেছিল। যত্নে থাকবে বলে নাকছাবিটা মায়ের কাছে রেখেছিল সতীবালা। নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন পরেশ দাসের ছেলের মুখেভাতে নাকছাবিটা মায়ের ট্রাঙ্ক থেকে বের করে পরেছিল। খুলে আর ট্রাঙ্কে রাখার সময় পায়নি। ওটা নাকে পরে মেয়েটা যখন হাসতো নকল হীরেটা ঝকমকিয়ে উঠতো। নাকছাবিটা দেখতে না পেয়ে গভীর করে শ্বাস নেয় ইন্দুবালা। তারপর সরে গিয়ে পাকুড় গাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে। পাকুড় গাছের দুটো ডালে হাওয়ার দাপট লাগে। কট কট শব্দ হয়। আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতে পারে।
পুলিশের সাথে কঙ্কাল নেবার একটা বস্তা আছে। পুকুরের পানা আর কাদামাটি ঝরিয়ে হাড়গোড়গুলো সব সেই বস্তার ভেতর ঢোকানো হলো। পুলিশের এসআই পুকুরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে জরিপ করলেন। কঙ্কালটা প্রথম যে তিনজন দেখেছিল তাদের একটু তফাতে নিয়ে কীসব জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনি। তারপর সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন এই কঙ্কালের ব্যাপারে কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে এখানে বলে যেতে পারে। সাক্ষ্য রেকর্ড করা হবে। প্রকাশ্যে বলতে না চাইলে থানায় গিয়েও সাক্ষী দিয়ে আসতে পারে।
জনতা এতক্ষণ খুব উৎসাহী ছিল কঙ্কালের নানান অনুমান নিয়ে। কিন্তু সাক্ষী দেবার কথা আসতেই একজন একজন পেছনে হটতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে দেখা যায় রহিম শেখ, ইন্দুবালা, হরিচরণ, রতন-নাড়ু-মতি, চেয়ারম্যান-জাহাঙ্গীর বাদে বাকীরা বেশ তফাতে চলে গেছে। কেউ কেউ বাড়ির পথ ধরেছে।
এসআই সাহেবকে হতাশ মনে হলো। এরকম কেসগুলো জটিল হয়। ছ্যাঁচা দিয়ে তথ্য আদায়ের নামে নগদ কামানো যায় না। অথচ বারবার ছুটতে ছুটতে আর রিপোর্ট করতে করতে বেহুদা হয়রান হতে হয়। অতি দরিদ্র এলাকা। ধরার মতো উপযুক্ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একদম খালি হাতে ফেরত যাওয়াও কেমন লাগে।
রহিম শেখের দিকে নজর পড়লো। আধবুড়ো লোকটা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। সে কী এই খুনের সাথে জড়িত ছিল? কিংবা কিছু জানে? এরকম ভাবলেশহীন থাকার কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে। এসআই নজরুল হাঁক দিলেন - এই বুড়া মিয়া, তুমি তো কিছু জানো নিশ্চয়ই। এটা কার লাশ?
রহিম শেখ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখে কোনো কথা যোগায় না। সে আসলে বলতে চাইছিল - এইডে আমার ছাওয়াল, এরে আমার কাছে দিয়ে যান। আমি তারে নিজের হাতে গোর দিবো। ভয়ে কিংবা পাথরচাপা শোকের উৎস মুখ খুলে যাওয়ায় সে কথা তার মুখেই এলো না।
বিরক্তি নিয়ে এসআই কনস্টেবলদের বললেন- চল যাই। ব্যাপক হাঙ্গামার কেস। থানায় গিয়ে পোস্ট মর্টমের জন্য শহরে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্হা করা লাগবে।
কঙ্কালের বস্তা নিয়ে রওনা দিতেই ছুটে গিয়ে ইন্দুবালা পুলিশের পথরোধ করে দাঁড়ালো।
- এইডে আমার মাইয়ে। আমার একমাত্তর সন্তান। সেই যে নয় মাস আগের এক পরন্ত দুপরে চেয়ারম্যানের মাইয়ে ডাকি নেয়ে গেল, আর তারে দেখতি পালাম না। ওইটে আপনারা আমার কাছে দিয়ে যান। আমি তারে চিতায় তুলবো।
ইন্দুবালাকে পথরোধ করতে দেখে রহিম শেখেরও সাহস জাগলো। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে শ্লেষ্মা জড়ানো ঘড়ঘড়ে গলায় বললো-
-ওইটে আমার হারায়ে যাওয়া ছেইলে। আমারে দিয়ে যান। আমি তারে গোর দিবো।
মুহূর্তে গুঞ্জন শুরু হলো। দূরে সরে যাওয়া লোকগুলো এবার নতুন রসের সন্ধান পেয়ে কাছাকাছি এসে গেল। ইন্দুবালা চিৎকার করে কাঁদছে আর দাবি করছে ওটা তার মেয়ে। মনের জোর ফিরে পাওয়া রহিম শেখ দৃঢ় গলায় বলছে ওটা তার ছেলে। রহিম শেখ কিংবা ইন্দুবালা কেউই কঙ্কালের শরীরে সনাক্তকারী আলামত খুঁজে পায়নি। তারপরও কি এক অযৌক্তিক আবেগে পরস্পর দাবী জানাতে থাকে কঙ্কালটা তাদেরই সন্তানের।
সন্তানহারা মা-বাবার হাহাকার জড়ো হওয়া লোকগুলোর মনে তেমন দাগ কাটে না। তাদের হিসেবে একটা গড়বড় হওয়ায় সেটা নিয়ে তারা বেশি ভাবিত হয়। তারা ভেবেছিল, একটি নয়- দুটি কঙ্কাল তারা দেখতে পাবে। পুকুরে জাল ফেলে সে সম্ভাবনাকে এখনও সত্যি করা যায়। সে জন্য তারা আশা নিয়ে পুলিশের হুকুমের অপেক্ষা করে। কিন্তু পুলিশের ভেতর সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখতে না পেয়ে তারা কেমন হতাশায় ডুবে যায়। ভিড়ের মধ্যে গাঢ় এক নিস্তদ্ধতা নেমে আসে।
অন্যদিকে পুলিশের দলটা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এসআই নজরুল ইসলাম এই থানায় নতুন এসেছেন রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে। মুকুন্দপুর গ্রামে কয়েক মাসের ব্যবধানে দুজনের নিখোঁজ সংক্রান্ত বিষয়ে তার জানা নেই। প্রশ্নবোধক চোখে তিনি চেয়ারম্যানের দিকে তাকান। চেয়ারম্যান বিগলিত হাসির সাথে মাখনের প্রলেপ দেওয়া কণ্ঠে বলে- স্যার, থানায় যাওয়ার আগে আমার বৈঠকখানায় বসি একটু জিরোয়ে নিবেন চলেন। চা খাতি খাতি বিস্তারে আপনারে কাহিনির সবডা বলবো স্যার।
পাশে মেঘে ঢাকা মুখ নিয়ে দাঁড়ানো শ্যালকের কনুইয়ে মৃদু চাপ দিয়ে কিছু ইশারা করতেই সে ত্বরিত - ‘আসেন স্যার, চলেন স্যার’, বলে এসআই নজরুলকে পুকুর পাড় থেকে একরকম সরিয়ে নিয়ে যায়।
পাকুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা রহিম শেখ, হরিচরণ, ইন্দুবালা ও সমবেত মানুষগুলোর চোখের সামনে পুলিশের জিপ ধুলো উড়িয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
মূক গাছটায় আবারও আলোড়ন ওঠে। কড় কড় করে কিছু বলতে চায়। মানুষ বৃক্ষের ভাষা বোঝে না।
বৃষ্টি আসছে বলে ভিড় ভেঙে লোকগুলো দৌড়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। নিজেদের গাঢ় অসহায়ত্ব মুঠোয় নিয়ে চাতালের উপর দাঁড়িয়ে থাকে তিনজন দুঃখী মানুষ। পুলিশের জীপটা ধুলো উড়িয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেও ওরা তিনজন ঘোরগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ ঝর ঝর করে বৃষ্টি শুরু হয়। শুনশান চাতালটা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। পাকুড় গাছটার ধুলোমাখা পাতায় পাতায় বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ে রহিম শেখের চুলহীন মাথায়। ইন্দুবালার এলানো চুলে। হরিচরণের মলিন চোখে মুখে।
পাকুড় গাছটার গোড়া থেকে একটা মোটা শিকড় বাঁকা হয়ে ঢুকেছে চাতালের ভেতর। সেখানে একটা ফোঁকড়। তাতে ধুলোবালি জমেছে। বৃষ্টির সাথে সাথে তীব্র একটা হাওয়া আসে। সে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাকুড় গাছটা ঝরাতে থাকে অজস্র জলধারা। সে জলধারা চাতাল আর শেকড়ের ফোকড় থেকে ধুলোবালি ধুয়েমুছে সরিয়ে দেয়।
যেমন হুট করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, হুট করে সেভাবে থেমেও যায়। মেঘ সরে গিয়ে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা বাড়তি আলো নিয়ে হেসে ওঠে। রোদের ছটা তেরছা হয়ে নেমে আসে চাতালটায়। তেরছা সে রোদের আলো গাছের ফোকরেও এসে পড়ে। সেই আলোর টানে ঝকমকিয়ে ওঠে হীরে বসানো একটা নাকছাবি।
-------------
রতন, মতি, নাড়ু কেমন বেকুব বনে গিয়ে পুকুর পাড়ে জালের কাছাকাছি থম ধরে বসে আছে। জালে আটকে থাকা অতিরিক্ত মাছগুলো খাবি খেতে খেতে কখন জানি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওদের তিনজনের মুখে কেমন একটা বিব্রত-বিরক্তির ছাপ। পুকুরে মাছ বেছে নেওয়ার কাজটা আধ খামচা পড়ে রইল। ভাবচক্করে মনে হচ্ছে হাটে ওদের দোকান গুলো আজ গোটাদিন তালাবদ্ধই থাকবে। কারবারে সম্ভাব্য ক্ষতির চিন্তা চিড়বিড়ে রাগ ছড়ায় তিনজনের শরীরে। নাড়ুর কথা মতো পুকুর পাড় ছেড়ে না পালানোটা যে বোকামির হয়েছে, সে বিষয়টা এমুহূর্তে তিনজনকে তিনভাবে সন্তর্পণে বিদ্ধ করতে থাকে। এই ঝামেলা কখন মেটে কে জানে! পুলিশ না আসা পর্যন্ত ওদের কোথাও যাওয়া চলবে না। চেয়ারম্যানের এই হুকুম মাথায় নিয়ে কাদামাখা শরীরে পুলিশের অপেক্ষায় ওরা বসে আছে।
ওদের সবার মাথার উপর সূর্যটা ডগডগিয়ে রীতিমত তেজ দেখাতে শুরু করেছে।
বড় পুকুরের বছরান্তের সংস্কার কাজ শেষে নতুন করে পোনা ছাড়া হবে। এ বছর পুকুরের তেমন বড়সড় সংস্কারের প্রয়োজন নেই। পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের রাক্ষুসে শোল গজার, বোয়াল ইত্যাদির সাথে পুঁটি, মলা ঢেলার মতো ছ্যাচড়া মাছ গুলো সরিয়ে নেওয়া লাগে। তিন বন্ধু গতসন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজ সাত সকালে পুকুরে জাল ফেলবে। তারপর একটু বেলা করে খেয়েদেয়ে যে যার কাজে রওনা দেবে। কথা মতো দিনের গায়ে রোদ চড়ে বসবার আগেভাগে তিনজনে পুকুরপাড়ে চলে এসেছিল। রতনের জাল আছে। আগেই ঠিক হয়েছিল, মাছ যা ধরা হবে চারভাগ হবে। রতনের দুইভাগ- যেহেতু জালটা রতনের। অন্য দুজনে একভাগ করে। পুকুরে জাল ফেলার আগে স্বভাব মতো কীসব মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে জালটা ছুঁড়ে দেয় রতন। পুকুরের পানিতে এখন টান ধরেছে। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। এ পুকুরে বছরের পাঁচ থেকে ছয় মাস পানি থাকে, তাতে মাছ চাষ হয়। পুকুরটা বারোয়ারি। মুকুন্দপুর সমবায় সংঘ, চাঁদা তুলে পুকুরের দেখভাল করা হয়। রতন, মতি নাড়ু নিয়মিত চাঁদা দেয়, শ্রম দেয় সমিতির উন্নয়নে। পুকুরের মাছ নিয়মিত হাটে বিক্রির পাশাপাশি সদস্যেরা চাইলে নিজেদের জন্যও বছরে এক-দুবার মাছ ধরতে পারে। রতনের মন্ত্রে কাজ হয়েছে। জালটা ওজনে বেশ ভারি। টেনে তোলার আগে পাড়ে বসে বিড়ি ফুঁকতে থাকা মতি আর নাড়ুকে গলা তুলে ডাকে রতন।
- তোরা কী বিড়ি ফুঁকতে আসছিস? মাছ বাছি যেগলান নেবার নিয়ে বাকিগুলান পুকুরে থুবার লাগবি না! নে হাত লাগা।
রতনের কথায় বিড়ি ফেলে দুজনেই তড়াক করে উঠে পড়ে। ঠাণ্ডা পানিতে মুখ হাত ধুয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও এখন পুকুরের পানি কাদাময় হওয়ায় ইচ্ছেটা বাতিল করে মতি। কী খেয়ালে সেই পানিতে নেমে পড়ে সে। নাড়ু রতনের পাশে দাঁড়িয়ে জালে আটকে থাকা মাছ বাছায় হাত লাগায়। ভালো মাছ উঠেছে। সাথে জঞ্জালও কম নেই। বেছে বেছে জঞ্জাল-মাছ আলাদা করতে থাকে দ্রুত। মতি খানিকটা উজিয়ে ডানপাড়ের পানা আর কাদাময় জায়গাটায় কী একটা দেখে এগিয়ে যায়। বাছাবাছিতে ব্যস্ত দুজন খানিক পর মতির আর্তচিৎকার শুনে চমকে তাকায়।
দেখে মতি দুদ্দাড় পানি ভেঙে ওদের দিকে ছুটে আসছে। ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। একে অন্যের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। গোটানো জালে তখনও গুটি কয়েক মাছ রয়ে গেছে, যেগুলো এখন রীতিমত খাবি খাচ্ছে। নাড়ু নীরবতা ভাঙে প্রথম।
-ওইটে মানুষের কঙ্কাল, ঠিক কিনা ক তোরা?
- হ, হ, মানুষেরই তো বটে।
সমবায় সমিতির পুকুরে মাছের চাষ হয় বহু বছর ধরে। এখানে মানুষের মৃতদেহ কী করে আসতে পারে তার কোনো থই খুঁজে পায় না ওরা। তবে ঘটনা খুব সুবিধার না এটা স্পষ্ট। প্রথম সনাক্তকারী হিসেবে কোনো ঝামেলায় তাদের জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটা নিয়ে তিনজনে তিন রকম ভাবনা ভাবে। মতিটা ওদের মধ্যে ভীতু প্রকৃতির। সে প্রস্তাব দেয়,
- যেটুকুনি মাছ পাওয়া গেছে তাই নিয়ে সরে পড়ি চল। ও জিনিস আমরা দেখি না…
মতির মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই পুকুর পাড়ে পাহাড়ি মণ্ডল কাকাকে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়। ছোট্টখাট্ট গড়নের আগন্তুক মানুষটার নামটাই শুধু অদ্ভুত তা নয়, ওর আচার-ব্যবহারও বেশ অদ্ভুত। একজনের কথা পাঁচকানে পৌঁছাতে ওস্তাদ লোক।
-কী রে মাছ কিরম ধরিছিস?
বলতে বলতে পাড়ের কাছে ফেলে রাখা জালটার কাছে চলে আসে পাহাড়ি কাকা।
-অম্মা! জালে মাছ খাবি খায় আর তোরা ভ্যাবলার মতো খাড়ায়ে রয়েছিস! এ কেমন ধারার ব্যবহার তোগের? খপর কি খুলে ক’ দেনি?
এরপর কয়েক মুহূর্তের ভেতর মতির দেখা ঘটনার সবটা পেটপাতলা রতনের কাছ থেকে খুঁটিয়ে জেনে নিতে পাহাড়ি মণ্ডলের বেশিক্ষণ লাগে না। গলা উঁচিয়ে নিজেও অকুস্হল দেখে নেয় একবার। তারপর, তার অনেক কাজ, একথা বলে দ্রুত পুকুর পাড় ত্যাগ করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, পাহাড়ি মণ্ডলের অনেক কাজের নমুনা হিসেবে পুকুরের পাঁকে মানুষের হাড়গোড় দেখার খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগেনা।
বৈচিত্রহীন গ্রামীণ জীবনে এরকম ঘটনাগুলো বেশ একটা হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপারের জন্ম দেয়। দশদিক থেকে ছুটে আসা কৌতূহলি মানুষের ভিড় জমে যায়। ঘটনা যাই ঘটুক, প্রায় প্রত্যেকেরই সে বিষয়ে কিছু একটা বলার থাকে। এই সরবতা ঘটনাস্হলে পুলিশ আসবার আগ পর্যন্ত চলমান থাকে। পুলিশ হাজির হওয়া মাত্র অধিকাংশের মধ্যেই ঘটনা সম্পর্কে কেমন বৈরাগ্য জন্মায়। মোচড়া-মোচড়ি করে যে যেভাবে পারে ঘটনাস্হল থেকে পালিয়ে বাঁচে। গ্রামের মানুষ এখনও পুলিশ ভয় পায়। এই ভয়ের সাথে সমীহের কোনো সম্পর্ক নেই। যা আছে সেটা অযথা হেনস্হা আর ক্ষয়ক্ষতির ভীতি।
উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘটনাস্হল দেখে আসা কেউ একজন গামছায় মুখ মুছতে মুছতে মতামত দেয়--
-ওইটে মাইয়ে ছেইলের হতি পারে।
-কী কচ্ছো! ওইটে কি তালি সতীবালা?
-হতি পারে, আবার নাও হতি পারে।
সটান পরিণতিতে না পৌঁছে দোদুল্যমান মতামতের অভিঘাতে অনেকের কণ্ঠে আফসোসের ঢেউ খেলে যায়। ঢেউটুকু মিলাতে না মিলাতে অন্য কেউ গলা তোলে-
-ও মিয়া তুমি এইডে কি কও! হাড্ডিগুড্ডি দেখি কওয়া সম্ভব ওইটে মাইয়ে ছেইলের না ব্যাটা ছেইলের?
সেই প্রশ্নে মুখগুলোয় কৌতূহল ঝলকে ওঠে। মুহূর্তকাল পরেই ফস্ করে আরেকজন ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বলে ওঠে
- যাই বলো, ওইটে আমাগের গ্রামের ছেইলে-মাইয়ের দুইজনার মধ্যে কারো একজনার হবার পারে এইটে নিচ্চিত- নাকি?
নিজের মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার আশায় বাকিদের দিকে তাকায় মন্তব্যকারী।
এই গ্রামের দুটি হতভাগ্য ছেলে-মেয়ে শেরালি এবং সতীর নিখোঁজ হওয়ার শোক স্মৃতি জীবন্ত হয়ে গ্রামবাসীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদের নিখোঁজ হওয়ার সর্বমোট সাড়ে ষোল মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ আজও কোনো হদিশ দিতে পারেনি। গ্রামের লোকজন এখনও বিষয়টা নিয়ে প্রায় আলোচনা করে। ওদের ধারণা গরীবগুর্বাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সরকার কিংবা পুলিশের মাথা ব্যথা থাকে না। চেয়ারম্যানের গরু খোয়া গেলে যতটা দৌড় ঝাঁপ হয়, তাদের মতো মানুষের ক্ষেত্রে তার এককণাও ঘটে না। চোখের সামনে ওদের বেড়ে উঠতে দেখেছিল গ্রামবাসী। আলাপরত মানুষগুলোর বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। হঠাৎই তখন ঝনঝনে জৈষ্ঠ্যের রোদ ঠেলে বাতাসের একটা ঘূর্ণি ওঠে। মানুষগুলোর সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস গিয়ে মিশে তাতে। ঘূর্ণিটা পাক খেয়ে পাকুর গাছটায় ধাক্কা দেয়। আচমকা বাতাসের ঘূর্ণি বিশাল গাছের ডালপালায় আলোড়ন তোলে। আন্দোলিত ডালপালার শক্তপোক্ত শাখায় রূপোর একটা তাবিজও তার সাথে তাল মিলিয়ে হেলেদুলে নেচে যায়। নাচনের তালে তালে তাবিজের রূপোর চেনটা ডালে পাক খায়। ইতোমধ্যে চেনটা গাছের ডালে বেশ কয়েকবার পাক খেয়ে নিজের অবস্হান শক্ত করে ফেলেছে। যে কারণে গিঁট খুলে না গিয়ে ডালের সঙ্গে বেশ শক্ত বাঁধনে সেটা জড়িয়ে আছে।ডালপালার আড়ালে ‘আল্লাহ’ লেখা তাবিজটা কেমন এক বোবা কান্নার মতো গাছের ডালে ঝুলে থাকে। হঠাৎ ওঠা সে আলোড়নে গাছের তলায় নিশ্চল বসে থাকা রহিম শেখের শরীরে জৈষ্ঠ্যের পাকা গরমেও শীতের কাঁপন ধরিয়ে ক্ষণকাল আগে মূর্ছা যাওয়া ইন্দুবালার চোখে মুখে ঝাপটা দেয়। ইন্দুবালার চোখের পাতা ঈষৎ কাঁপে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে। সজ্ঞানে থাকলে সে তার নিখোঁজ সপ্তদশী কন্যা সতীবালার শোকে নতুন করে কেঁদে উঠতো।
মাঠে আউশের চারায় প্রথম কিস্তির সার দেবার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে রহিম শেখ কতক্ষণ বসে থাকবে ঠাহর হয়না। চেয়ারম্যান তাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে ঠিকই বাড়ি চলে গেছে। মাঠে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে ছোটো ছেলে সুরুজালি কী কাণ্ড বাঁধায় কে জানে। লোকমুখে পুকুরের খবরটা পেলে বিপদ। বউটা জেগে উঠলে অসুস্হ শরীরেই ছুটে আসবে হয়ত। ছেলেটার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ওরচে বয়সে দুই বছরের ছোটো মেয়েটা ঢের বুদ্ধি রাখে। বউ শরিফা পেটের পুরনো যন্ত্রণায় সারারাত কাটা মুরগির মতো ছটফট করে ভোরের মুখে ঘুমিয়েছে। গোটা দিনটাই সে আজ ঘুমের ঘোরে থাকবে। সকালে মাঠে যাওয়ার সময় নিজেই যা পারে খেয়ে নেবে ভেবেছিল। মেয়েটা ঠিক উঠে গেছে। শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে পেঁয়াজ কুচিয়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে পান্তার সাথে বাপকে খেতে দিয়েছে। ভরপেট খেয়ে এসে মাঠের কাজে সবে হাত লাগিয়েছিল...। এতটা বেলা বয়ে গেল এখনও জাহাঙ্গীর বা পুলিশ কারো দেখা নেই। নড়েচড়ে বসে রহিম শেখ। ঘাড় তুলে ভিড়ের ভেতর সুরুজালি বা তার মেয়েটা উপস্হিত কিনা সেটা দেখবার চেষ্টা করে। অত মাথার ভিড়ে থই হারিয়ে তার চোখ স্হির হয় হরিচরণের উপর। বেচারার মতো বউটার পাশে বসে আছে। বউটা থেকে থেকে মূর্ছা যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন করে রহিম শেখের। আচ্ছা ওইটে যদি শেরালির না হয়! তারা কি শেরালির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাবি না? গোরের মাটি পাওয়ার ভাগ্যি হবি না তার সন্তানের!
এখানে উপস্হিত হওয়া অবধি সে বড় ছেলের কথা ভেবে চলেছে। তার ওরকম সহজ সরল ছেলেটা নাকি রাজনীতিতে জড়িত ছিল, তাও আবার সর্বহারার মতো ভয়ানক একটা দলে। তারা কেউ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। এই দল যে এখনো দেশে আছে, রহিম শেখের জানা ছিল না। একসময় সর্বহারার ভয়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। রাতবিরেতে তো বটেই, দিনে দুপুরে গলায় ছুরি চালিয়ে পালিয়ে যেতো ওরা। তার ছেলে ওরকম একটা খুনে দলে যোগ দিতে পারে কল্পনারও বাইরে। তাছাড়া সেরকম শিক্ষাদীক্ষাও তো তার ছিল না। কার পাল্লায় পড়ে ওই সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিল ছেলেটা! এখন মাবুদে এলাহি ছাড়া আর কারো পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না। ছেলের পাগলামির মাশুল এই বুড়া বয়সে তাদের গুণতে হচ্ছে। ছেলের কোনো সন্ধান তারা পায়নি। কেউ কেউ বলেছে- সে আর নেই। লাশ হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের লাশটাও দেখার সুযোগ পায়নি রহিম শেখ। এতোদিন রহিম শেখ বিশ্বাস করতে চায়নি। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে এই কঙ্কালটা তার সন্তানের। গভীর মমতায় কঙ্কালটা বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। শেরালি এই পুকুরে শুয়ে ছিল এতদিন। দমচাপা কষ্ট আঁচড় কাটে বুড়ো বাপের বুকে। পাকুড় গাছটা আবার সড়সড় করে ওঠে। খানকতক পাতা ঝরিয়ে দেয় চাতালের উপর।
উত্তর পাড়ার মজিদ মাস্টার না বললে ছেলের বিষয়ে হয়ত তারা কোনোদিন জানতেও পারতো না। মজিদ মাস্টারের সাথে রাজনীতি করা লোকদের যোগাযোগ আছে। তাদের কাছ থেকে একদিন খবর পাওয়া গেল ছেলে সর্বহারার কোন্দলে পড়েছে। তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে। বাড়ি থেকে তাকে সরিয়ে দিতে বলেছিল মজিদ মাস্টার। কিন্তু তার আগেই একদিন ছেলেটাকে রাতের বেলা কেউ এসে চেয়ারম্যানের শালা জাহাঙ্গীর কথা বলতে চায় বলে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর থেকে ছেলে নিখোঁজ। পরদিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছেলের খোঁজে গিয়ে রহিম শেখ জানতে পারে জাহাঙ্গীর বাড়িতে নেই। রাতে শেরালিকে তার ডেকে আনার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ফেরার পথে রহিম শেখ বৈঠকখানায় চা পানরত জাহাঙ্গীরকে দিব্যি দেখতে পেয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে মুখখোলার আগেই চেয়ারম্যনের খাস লোক এসে, নগদে চোটপাট দেখিয়ে তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল। উচ্চবাচ্যের জোর পায়নি আর। সতী নিখোঁজ হওয়ার পর হরিচরণ আর ইন্দুবালা হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতো চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। ভিটেমাটি লোপাটের হুমকি দিয়ে ওদের হটানো হয়। সেরকম হুমকি পেলে কোথায় যেতো তারা!
পুলিশের কাছে গিয়ে কাজ হয়নি। উল্টে তাদের নানা ধমকিধামকি সহ্য করতে হয়েছে। গাঁটের পয়সাও খসেছে কিছু। নিখোঁজের সাড়ে সাত মাস পেরিয়ে গেল, ছেলের খবর পেলো না। নিদেনপক্ষে তার লাশের হদিশটাও না। এতদিন তবু শোকটা চাপা দেওয়া ছিল, কোনো একদিন ছেলেটা ফিরে আসবে। কিন্তু এই কঙ্কাল আবিষ্কার হওয়ার পর চাপা দেওয়া শোকটা জেগে উঠেছে। রহিম শেখের মন বলছে এটা তার শেরালি। ছেলের ফিরে আসার যে ক্ষীণ আশাটা জেগে ছিল, সেটা আজ বুঝি শেষ হয়ে গেল।
পাকুর গাছটার ছায়া মাড়িয়ে দিনটা যখন পুকুরের দক্ষিণে হেলে পড়েছে ঠিক তখন জটলা পাকানো মানুষগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্যের একটা ঢেউ ওঠে। জাহাঙ্গীর ফিরেছে। সাথে একজন এসআই এবং দুজন কনস্টেবল। চারপাশে শোরগোল পড়ে গেল হঠাৎ করে। চেয়ারম্যানও হন্তদন্ত এসে উপস্হিত হয়। জাহাঙ্গীর এখানে পৌঁছানোর আগে নিশ্চয়ই দুলাভাইকে জানিয়েছে।
পুলিশের হুকুম মতো ল্যাকপেকে দুজন কাদাময় পুকুরে নামে। কঙ্কালটা সাবধানে তুলে আনার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকে পুকুর পাড়ে দাঁড়ানো কনস্টেবল দুজন।
-সাবধান, হাড্ডিগুড্ডি আস্ত থাকে যেন।
ভয় মিশ্রিত প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে লোক দুজন কঙ্কালটা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বাধা পায়।
যত হালকা হবে ভাবা হয়েছিল ততটা হালকা নয় কাঠামোটা। চেন দিয়ে বিশাল বড় আর ভারি একখানা পাথরের সঙ্গে বাঁধা ওটা। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে লোকগুলো। কঙ্কাল আস্ত রেখে এই জগদ্দল টেনে হিঁচড়ে নেওয়া অসম্ভব। আরো দুজন আসুক।
পায়ে পায়ে রহিম শেখ এসে দাঁড়ায়। স্ত্রীর কাঁধ আঁকড়ে হরিচরণও আসে। পুকুর পাড়ে টেনে তোলা কঙ্কালটার দিকে সমবেত চোখগুলো বিস্ময়-কৌতূহল আর বেদনা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
রহিম শেখের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। লোকজন ঠেলে কঙ্কালটার কাছে আসার চেষ্টা করে। তীক্ষ্ণচোখে কঙ্কালের গলার কাছটা দেখে নিতে চায়। তার ছেলের গলায় রূপোর চেনে ‘আল্লাহ’ লেখা একটা তাবিজ ছিল। সাত্তার পীরের কাছ থেকে রহিম শেখের মা ফরিদা বেগম এনে দিয়েছিল। নাতীকে বিপদ-আপদ থেকে তাবিজটা রক্ষা করবে। আদরের নাতী মৃত দাদীর শেষচিহ্ন হিসেবে সযত্নে সেটা ধারণ করতো। যেরাতে চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে যায়, সে রাতেও তাবিজটা গলায় ঝুলতে দেখেছে। আদুল গায়ে ছিল ছেলেটা। চেয়ারম্যানের বাড়ি রওনা দেবার মুখে সাদার উপর সবুজ হলুদ ফুলতোলা শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই শেষ দেখা। রহিম শেখের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বার বার। বারকয়েক চোখ ডলেও রূপোর চেন বাঁধা তাবিজটা দেখতে পেলো না। একটু হোঁচট খেয়ে রহিম শেখ আবার চাতালের কাছে যায়, বসতে গিয়েও বসে না। ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ঘাড় থেকে হরিচরণের হাত সরিয়ে ইন্দুবালাও ভীড় ঠেলে কঙ্কালের খুব কাছে যায়। জলভরা চোখে আতিপাতি কঙ্কালের নাকনকশা খোঁজে। নাকের বদলের একটা প্রায় ত্রিভুজাকৃতির হাঁমুখ ফুটো দেখে তরাসে চোখ বুজে ফেলে। মেয়ে সতীবালার নাকে একটা নকল নীরে বসানো নাকছাবি ছিল। ইন্ডিয়া থেকে ইন্দুবালার পিসতুতো নিঃসন্তান বড়দা আর বড়দার বউ বছর দুয়েক আগে একবার বেড়াতে এসেছিল। তখন ভাগ্নীকে পূজোতে পরার জন্য জরিপাড় শাড়ি-চুড়ির সঙ্গে নাকছাবিটাও কিনে দিয়ে গেছিল। যত্নে থাকবে বলে নাকছাবিটা মায়ের কাছে রেখেছিল সতীবালা। নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন পরেশ দাসের ছেলের মুখেভাতে নাকছাবিটা মায়ের ট্রাঙ্ক থেকে বের করে পরেছিল। খুলে আর ট্রাঙ্কে রাখার সময় পায়নি। ওটা নাকে পরে মেয়েটা যখন হাসতো নকল হীরেটা ঝকমকিয়ে উঠতো। নাকছাবিটা দেখতে না পেয়ে গভীর করে শ্বাস নেয় ইন্দুবালা। তারপর সরে গিয়ে পাকুড় গাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে। পাকুড় গাছের দুটো ডালে হাওয়ার দাপট লাগে। কট কট শব্দ হয়। আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতে পারে।
পুলিশের সাথে কঙ্কাল নেবার একটা বস্তা আছে। পুকুরের পানা আর কাদামাটি ঝরিয়ে হাড়গোড়গুলো সব সেই বস্তার ভেতর ঢোকানো হলো। পুলিশের এসআই পুকুরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে জরিপ করলেন। কঙ্কালটা প্রথম যে তিনজন দেখেছিল তাদের একটু তফাতে নিয়ে কীসব জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনি। তারপর সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন এই কঙ্কালের ব্যাপারে কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে এখানে বলে যেতে পারে। সাক্ষ্য রেকর্ড করা হবে। প্রকাশ্যে বলতে না চাইলে থানায় গিয়েও সাক্ষী দিয়ে আসতে পারে।
জনতা এতক্ষণ খুব উৎসাহী ছিল কঙ্কালের নানান অনুমান নিয়ে। কিন্তু সাক্ষী দেবার কথা আসতেই একজন একজন পেছনে হটতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে দেখা যায় রহিম শেখ, ইন্দুবালা, হরিচরণ, রতন-নাড়ু-মতি, চেয়ারম্যান-জাহাঙ্গীর বাদে বাকীরা বেশ তফাতে চলে গেছে। কেউ কেউ বাড়ির পথ ধরেছে।
এসআই সাহেবকে হতাশ মনে হলো। এরকম কেসগুলো জটিল হয়। ছ্যাঁচা দিয়ে তথ্য আদায়ের নামে নগদ কামানো যায় না। অথচ বারবার ছুটতে ছুটতে আর রিপোর্ট করতে করতে বেহুদা হয়রান হতে হয়। অতি দরিদ্র এলাকা। ধরার মতো উপযুক্ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একদম খালি হাতে ফেরত যাওয়াও কেমন লাগে।
রহিম শেখের দিকে নজর পড়লো। আধবুড়ো লোকটা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। সে কী এই খুনের সাথে জড়িত ছিল? কিংবা কিছু জানে? এরকম ভাবলেশহীন থাকার কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে। এসআই নজরুল হাঁক দিলেন - এই বুড়া মিয়া, তুমি তো কিছু জানো নিশ্চয়ই। এটা কার লাশ?
রহিম শেখ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখে কোনো কথা যোগায় না। সে আসলে বলতে চাইছিল - এইডে আমার ছাওয়াল, এরে আমার কাছে দিয়ে যান। আমি তারে নিজের হাতে গোর দিবো। ভয়ে কিংবা পাথরচাপা শোকের উৎস মুখ খুলে যাওয়ায় সে কথা তার মুখেই এলো না।
বিরক্তি নিয়ে এসআই কনস্টেবলদের বললেন- চল যাই। ব্যাপক হাঙ্গামার কেস। থানায় গিয়ে পোস্ট মর্টমের জন্য শহরে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্হা করা লাগবে।
কঙ্কালের বস্তা নিয়ে রওনা দিতেই ছুটে গিয়ে ইন্দুবালা পুলিশের পথরোধ করে দাঁড়ালো।
- এইডে আমার মাইয়ে। আমার একমাত্তর সন্তান। সেই যে নয় মাস আগের এক পরন্ত দুপরে চেয়ারম্যানের মাইয়ে ডাকি নেয়ে গেল, আর তারে দেখতি পালাম না। ওইটে আপনারা আমার কাছে দিয়ে যান। আমি তারে চিতায় তুলবো।
ইন্দুবালাকে পথরোধ করতে দেখে রহিম শেখেরও সাহস জাগলো। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে শ্লেষ্মা জড়ানো ঘড়ঘড়ে গলায় বললো-
-ওইটে আমার হারায়ে যাওয়া ছেইলে। আমারে দিয়ে যান। আমি তারে গোর দিবো।
মুহূর্তে গুঞ্জন শুরু হলো। দূরে সরে যাওয়া লোকগুলো এবার নতুন রসের সন্ধান পেয়ে কাছাকাছি এসে গেল। ইন্দুবালা চিৎকার করে কাঁদছে আর দাবি করছে ওটা তার মেয়ে। মনের জোর ফিরে পাওয়া রহিম শেখ দৃঢ় গলায় বলছে ওটা তার ছেলে। রহিম শেখ কিংবা ইন্দুবালা কেউই কঙ্কালের শরীরে সনাক্তকারী আলামত খুঁজে পায়নি। তারপরও কি এক অযৌক্তিক আবেগে পরস্পর দাবী জানাতে থাকে কঙ্কালটা তাদেরই সন্তানের।
সন্তানহারা মা-বাবার হাহাকার জড়ো হওয়া লোকগুলোর মনে তেমন দাগ কাটে না। তাদের হিসেবে একটা গড়বড় হওয়ায় সেটা নিয়ে তারা বেশি ভাবিত হয়। তারা ভেবেছিল, একটি নয়- দুটি কঙ্কাল তারা দেখতে পাবে। পুকুরে জাল ফেলে সে সম্ভাবনাকে এখনও সত্যি করা যায়। সে জন্য তারা আশা নিয়ে পুলিশের হুকুমের অপেক্ষা করে। কিন্তু পুলিশের ভেতর সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখতে না পেয়ে তারা কেমন হতাশায় ডুবে যায়। ভিড়ের মধ্যে গাঢ় এক নিস্তদ্ধতা নেমে আসে।
অন্যদিকে পুলিশের দলটা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এসআই নজরুল ইসলাম এই থানায় নতুন এসেছেন রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে। মুকুন্দপুর গ্রামে কয়েক মাসের ব্যবধানে দুজনের নিখোঁজ সংক্রান্ত বিষয়ে তার জানা নেই। প্রশ্নবোধক চোখে তিনি চেয়ারম্যানের দিকে তাকান। চেয়ারম্যান বিগলিত হাসির সাথে মাখনের প্রলেপ দেওয়া কণ্ঠে বলে- স্যার, থানায় যাওয়ার আগে আমার বৈঠকখানায় বসি একটু জিরোয়ে নিবেন চলেন। চা খাতি খাতি বিস্তারে আপনারে কাহিনির সবডা বলবো স্যার।
পাশে মেঘে ঢাকা মুখ নিয়ে দাঁড়ানো শ্যালকের কনুইয়ে মৃদু চাপ দিয়ে কিছু ইশারা করতেই সে ত্বরিত - ‘আসেন স্যার, চলেন স্যার’, বলে এসআই নজরুলকে পুকুর পাড় থেকে একরকম সরিয়ে নিয়ে যায়।
পাকুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা রহিম শেখ, হরিচরণ, ইন্দুবালা ও সমবেত মানুষগুলোর চোখের সামনে পুলিশের জিপ ধুলো উড়িয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
মূক গাছটায় আবারও আলোড়ন ওঠে। কড় কড় করে কিছু বলতে চায়। মানুষ বৃক্ষের ভাষা বোঝে না।
বৃষ্টি আসছে বলে ভিড় ভেঙে লোকগুলো দৌড়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। নিজেদের গাঢ় অসহায়ত্ব মুঠোয় নিয়ে চাতালের উপর দাঁড়িয়ে থাকে তিনজন দুঃখী মানুষ। পুলিশের জীপটা ধুলো উড়িয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেও ওরা তিনজন ঘোরগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ ঝর ঝর করে বৃষ্টি শুরু হয়। শুনশান চাতালটা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। পাকুড় গাছটার ধুলোমাখা পাতায় পাতায় বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ে রহিম শেখের চুলহীন মাথায়। ইন্দুবালার এলানো চুলে। হরিচরণের মলিন চোখে মুখে।
পাকুড় গাছটার গোড়া থেকে একটা মোটা শিকড় বাঁকা হয়ে ঢুকেছে চাতালের ভেতর। সেখানে একটা ফোঁকড়। তাতে ধুলোবালি জমেছে। বৃষ্টির সাথে সাথে তীব্র একটা হাওয়া আসে। সে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাকুড় গাছটা ঝরাতে থাকে অজস্র জলধারা। সে জলধারা চাতাল আর শেকড়ের ফোকড় থেকে ধুলোবালি ধুয়েমুছে সরিয়ে দেয়।
যেমন হুট করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, হুট করে সেভাবে থেমেও যায়। মেঘ সরে গিয়ে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা বাড়তি আলো নিয়ে হেসে ওঠে। রোদের ছটা তেরছা হয়ে নেমে আসে চাতালটায়। তেরছা সে রোদের আলো গাছের ফোকরেও এসে পড়ে। সেই আলোর টানে ঝকমকিয়ে ওঠে হীরে বসানো একটা নাকছাবি।
-------------
শিরোনাম ভাবনা- জীবনানন্দ দাশ
লেখক পরিচিতি:
নাহার তৃণা
গল্পকার। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র, শিকাগোতে থাকেন।
4 মন্তব্যসমূহ
পরিপাটি গল্প। শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে।
উত্তরমুছুনপড়ে মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ-ভালোবাসা প্রিয় কথাসাহিত্যিক :)
উত্তরমুছুনঅনবদ্য গল্প। শুভকামনা নিরন্তর।
উত্তরমুছুনপড়বার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।
মুছুন