ঘন ঘন ম্যানহোলের ঢাকনি-চুরি ঠেকাতে, কয়েক রাতের পাহারায় একজন ঢাকনিচোর ধরা পড়তে লেকসার্কাস ডলফিন গলির দি নিউ আল-মদিনা সুপার ড্রাই ক্লিনার্সের সামনের ল্যাম্পপোস্টে একটা ঘোষণা ঝোলানো হয়েছিল : এখানে ম্যানহোলচোরকে উত্তমরূপে ধোলাই করা হয়। নিচে চক দিয়ে বা পান খাওয়া হাতের চুন দিয়ে ফুটনোট : ফ্রি ডেলিভারি। (আস্ত ম্যানহোলের ওপর চোরদের লোভ-লালসা থাকার কথা নয়, তারপরও ম্যানহোলচোর কথাটা বসানোর সময় এমন সন্দেহ কাজ করতে পারে, চোরদের বিশ্বাস কী, শুধু লোহার ঢাকনি কেন, গোটা ম্যানহোলও হাওয়া করে দিতে পারে!)
কয়েকদিন পর ছুটির দিন ভোরবেলা, ডলফিন গলি থেকে সংসদ ভবন, আবার সংসদ-টু-ডলফিন মর্নিংওয়াক শেষে মদিনা সুপার ড্রাই ক্লিনার্সের সামনে ছোটখাটো ভিড় দেখে মাহমুদ ফিক করে হেসে ফেলে। তার পঁয়তাল্লিশ বছরের গোলগাল শরীরে, ভারী চশমায়, ফাঁপানো গালে হাসিটা মানানসই হয় না। তারপরও ঠোঁট-চিবুক-দাঁতের সম্মিলিত তৎপরতায় মুখভঙ্গিটা শরীর-মনে উষ্ণ-ঠান্ডা, ঝিরিঝিরি আমেজ ছড়ায়। আর পরমুহূর্তেই দিনটা ছুটির, অকাজের, বিবিসি, স্টার স্পোর্টস, ঝালমুরগি, ভরদুপুরের বিছানা, ঘুম না নাসরীন, নাসরীন না ঘুম, এসব মাথার আনাচেকানাচে হুটোপুটি জুড়ে দিলে হাসিটা ফ্যালনা হয়ে যায় না।
ঘাড় ঘুরিয়ে মাহমুদ যাকে দেখে, তিনিও হাসছেন, জটলার দিকে মুখ, তবে ফিকফিক হাসি না, হো হো। অবাক হতে হয়, ইনি পথেঘাটে হেসে ফেলার মানুষ নন। একটু দূরে গলির মাথাটা যেখানে দু-দিকে নব্বুই ডিগ্রিতে ভাগাভাগি হয়ে ঠিকানা-খোঁজা লোকজনকে হঠাৎ করে ধাঁধায় ফেলে মজা পায়, সেখানে দক্ষিনমুখি ব্যালকনি ছড়ানো বাড়িটা তার ‘শান্তির নীড়’। গেটের পিলারে শান্তির নীড়ের তালব্য শ অস্পষ্ট হয়ে গেলেও শান্তি বিঘ্নিত হয়নি, কারণ অপর পিলারে কুকুর হইতে সাবধান-এর বদলে এ্যালসেশিয়ানের কান-ঝোলা সুবোধ মুখ, নিচে মার্বেল প্লেটে জি এম হান্নান, জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অবঃ। কুকুরের মুখের নিচে মানুষের নাম নিয়ে ডলফিন গলিতে কানাঘুষা কম হয়নি। তবে এ মুহূর্তে জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অবঃকে হাসতে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি মাহমুদ আশ্বস্তও হয়। এই ভোরবেলা হাসির প্রেরণাটা তার একার ওপরই ভর করেনি।
কিন্তু যে-কারণে হাসি, তার সাথে বাস্তব ঘটনার যোগাযোগ নেই। কারণ গত রাতে ডলফিন গলিতে ম্যানহোলের ঢাকনি খোয়া যায়নি। অন্যদিকে ঢাকনিচোরের পরিবর্তে পাড়ার ভলান্টিয়ার যুবসমাজ যাকে ঘিরে জটলা পাকাচ্ছে, সে একজন দুধওয়ালা। পাটীগণিতের অসাধু গোয়ালা। খুব ভোরবেলা ডলফিন গলির ওপারে, ধানমণ্ডি লেকের হাঁটুপানিতে উবু হয়ে লোকটা মন দিয়ে দুধের লালরঙা প্লাস্টিকের বালতিতে আবর্জনাময় দুর্গন্ধ পানি ভেজাল দিচ্ছিল। কাজটা করার সময় তার মধ্যে কোনো বিকার লক্ষ করা যায়নি; দিনের প্রথম আলো, রাস্তার পথচারি কিংবা দুর্গন্ধময় বিষাক্ত পানি কিছুই তার ওপর ক্রিয়া করছিল না।
এমন অবস্থায় দিনের আলো ও দূষিত পানির পটভূমিতে তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে আনা ছাড়া উপায় কী ছিল! কিন্তু দড়িবাঁধা অবস্থায় ভয়ংকর পরিণাম সামনে নিয়েও তার তেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। এ পর্যায়ে ঘিরে ধরা জটলা ধাপে ধাপে তার ওপর চড়াও হয়। তোর নাম কী? প্রশ্ন শুনে সে উদাস হয়। নামের প্রসঙ্গ অবান্তর প্রমাণ করতে কোমরে নারকেল ছোবড়ার দড়িতে আঙুল চালায়। প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার উচ্চারিত হতে তার চেহারায় পরিষ্কার বিরক্তির চিহ্ন ফোটে, সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ঘাড় বরাবর মাঝারি খোঁচা পড়ে। খোঁচা খাওয়ামাত্র সে ঘাড় বাঁকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, গুতান ক্যান? নামে কাম কী! একটা থাপ্পড় পড়ে গালে, পাতানো গালে পাঁচ আঙুলের জুতসই সংযোগে মনোমুগ্ধকর চড়াৎ আওয়াজ ওঠে। পরপরই দুটো ঘুষি, একটা আনাড়ি লাথি। নাকের বাম পাশে দেখতে না দেখতে লালচে বিন্দু টকটকে রূপ নিয়ে দুই ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত গুটিগুটি গড়ায়।
# #
নাম?
আবদুল করিম।
বাপের নাম?
আবদুর রহিম।
বাড়ি?
কামরাঙিরচর।
আবদুল করিম সংক্ষেপে যা বলে, তা এ রকম : কামরাঙিরচরে তার টিনের দোচালা বাড়িতে সে তার পরিবার মিলে দুটো সিন্ধী গাই পালে। ভরণপোষণের বিনিময়ে গাই দুটো দৈনিক পনেরো লিটার খাঁটি দুধ দেয়। এই দুধ আবদুল করিম ও তার দুই ভাই মিলে শহরের কয়েকটা এলাকায় খাঁটি দুধ-পিপাসু গাহককের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়, তবে কোনোদিন যদি পাকিস্তানি গাইগুলো মাপ মতো দুধ দিতে গড়িমসি করে, তো ওয়াসার টেপে, বৃষ্টির পানিতে, ধানমণ্ডি লেকের মতো অভিজাত লেকে দুধের পরিমাণটা ঠিকঠাক করে নেয়। কাজটা তার আগে তার বাবা আবদুর রহিম করেছে, বাবার বাবা দাদা করেছে, দাদার বাবা করেছে।
এমন প্রাঞ্জল বিবরণের পর আবদুল করিমকে নতুন কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে না। কিন্তু গোল হয়ে ছেঁকে ধরা মাথাগুলো এই সংক্ষিপ্ত, অতিসরল বিবরণে আস্থা রাখতে পারে না। তাদের চোখমুখে জিজ্ঞাসু ভঙ্গি ফোঁসফোঁস ফণা তোলে। লোকটা নির্ঘাৎ গাঁজাখোর, গাঁজা খেয়ে রূপকথা শোনাচ্ছে। দুধ ও পানি (খাল-বিল-বাঁওড়-ধানমণ্ডি লেক, যে-জায়গারই হোক) দ্রব্য দুটি তাদের দৃষ্টিতে কিছুতেই সহাবস্থান করতে পারে না। দুধ ও পানি একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারে, একাত্ম হয়ে মিশে যেতে পারে এমন কথা বাপের জন্মেও তারা শোনেনি। বৃষ্টির পানির ধাক্কাটা না হয় সামলানো গেল। কিন্তু ওয়াসার পানি? খাওয়ামাত্র রক্তে বেলরুবিন বেড়ে জগৎ-সংসারের রং-রূপ হলুদ, সর্ষে খেত। চিৎ হয়ে শুয়ে কড়িবর্গা গোনো, জাউ খাও, আখ খাও। আর ধানমণ্ডি লেকের পানি? পেটে গেলে কী হতে পারে, এ নিয়ে কারো ঝাপসা ধারণাও নেই। ভিডি, এইডস হওয়াও কি বিচিত্র? মোটা কথা, সময় গড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে অল্পবয়সিদের সাথে বড়রাও যোগ দিয়ে সাত-পাঁচ নানাকিছু ভাবতে গিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। কোনো সিদ্ধান্তে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
কিন্তু আবদুল করিমের জবানি সত্য, দিনের প্রথম আলো ফোটার মুহূর্তে তাকে লেকের হাঁটুপানিতে উবু হয়ে একমনে দুধ-পানি এক করতে দেখা গেছে। এ পর্যায়ে অবিশ্বাস্য ঘটনার সত্যতায় জটলায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে, রাগে কারো কারো গা জ্বলে। লোকটাকে কী করা উচিত এ নিয়ে উচ্চস্বরে মতামত বিনিময় চলে। অতিউৎসাহী তরুণেরা তার গা থেকে আলগোছে চামড়া খুলে ফেলতে আগ্রহী। তবে কাজটা বলা সহজ, করে দেখানো সহজ নয়; কারণ ডলফিন গলির অভিজ্ঞ কসাই হামদু যে দিনে অন্তত বারোটা গরু-খাসির চামড়া ছিলে স্তূপাকারে করে ফেলে, তার পক্ষেও বলা শক্ত মানুষের চামড়া ছুরি আর হাতের ছোঁয়ায় তরতরিয়ে খুলে আসবে, না চ্যাটাস করে ছিঁড়ে ঝুলে থাকবে। কারো কারো মতে, লোকটাকে ডলফিন গলির কোনো খোলা ম্যানহোলে হাত-পা বেঁধে ছেড়ে দেওয়াই সঙ্গত।
মতামতগুলো আবদুল করিমের মনে কী প্রতিক্রিয়া করে বলা কঠিন। কোমরে দড়িটার কারণে তার অস্বস্তি হচ্ছে বোঝা যায়, একটু পরপর দড়ির গিঁটে হাত ছোঁয়াচ্ছে। নাকের বাম পাশে রক্তের চিকন ধারাটা স্থির হয়ে বসে গেছে, ওপরের ঠোঁটটা অল্প ফুলে চেহারাটা অভিমানী, বিষণ্ন, উদাস।
জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অবঃ বাড়ি ফেরার পথে ভাবেন লোকগুলো গরু, আবদুল করিমের পাকিস্তানি গরুগুলোরও অধম। কী করে মারবে, এ পরিকল্পনাটাও করতে পারছে না। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তিনি পরিষ্কার দেখতে পান গরুগুলো আগড়মবাগড়ম বকবক করছে। দেখে হাত দুটো শিরশির করে। শোবার ঘরের স্টিলক্যাবিনেট থেকে ডবল ব্যারেল ওয়েব্লি এন্ড স্কট হাতে আবার ব্যালকনিতে দাঁড়ান, ধীরেসুস্থে দুই ব্যারেলে দুটো ইলি কার্ট্রিজ ভরে ভিড়ের মাঝখানে আবদুল করিমের বুকের বাম পাশে হার্ট বরাবর তাক করেন। এ্যাঙ্গলটা চমৎকার, লোভ হয়। গু... ড়ু...ম শব্দে জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অবঃ পুব আকাশ ফুটো করে ফেলেন। দ্বিতীয়বার গুলি ছোড়েন ঘুরে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশে।
ম্যানহোলচোর ধরা পড়ার পর দ্বিতীয় দফায় ডলফিন গলি মেতে ওঠে। গুলির ঘটনায় প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও লোকজন যখন দেখে লক্ষ্যবস্তু পুব ও পশ্চিম আকাশ, তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। গলিতে ভিড় বাড়ে। রিকশা, বেবিট্যক্সি জ্যামে আটকা পড়ে। বালুবোঝাই দুটো আন্তঃজেলা-সমগ্র-বাংলাদেশ বেদম হর্ন টিপে পরিস্থিতি আরো সরগরম করে তোলে। লোকজন যারা পথ ধরে যায় আসে, তারা না থেমে পারে না। নতুন ম্যানহোলচোর ভেবে উঁকি মেরে তাজ্জব হয়ে যায়, লেকের পানি! কারো কারো পক্ষে কৌতূহল সত্ত্বেও ভিড় ঠেঙিয়ে ভেতরে সেঁধুনো সম্ভব হয় না, তারা নিরীহ প্রশ্ন করে, কী ভাই এখানে? জবাব আসে, লেকের পানি। লেকের পানি?
গুলির শব্দ যে একটা প্রতিক্রিয়া ফেলতে পেরেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকটাকে একটু দূরে রাস্তা লাগোয়া প্রাক্তন বামপন্থি বিরোধীদলীয় নেতার চারতলা কড়া লাল ইটের বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টে টাইট করে বাঁধা হয়। এ জায়গাটা তুলনামূলক ভাবে চওড়া, জনসমাগমের জন্য সুবিধার, তবে নিউট্রাল নয়। সরকারদলীয় কিছু তরুণ আপত্তি তোলে, কিন্তু এর চেয়ে সুবিধেজনক ভেন্যু না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা ব্যবস্থাটা মেনে নেয়। বিরোধীদলীয়রা এই উপরি পাওনাকে উপভোগ করে। ঘটনাটা তাদের কাছে রাজনৈতিক দিক দিয়ে বেশ সম্ভাবনাময় মনে হয়।
স্থান পরিবর্তনের পর আবদুল করিম গোয়ালকে চিন্তিত মনে হয়। ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে, তবে অনুশোচনার ছাপ তার মধ্যে নেই। বরং ফোলা ঠোঁটের অভিমানী ভঙ্গিটা এখন খুঁটিয়ে দেখলে মনে হবে অভিমান নয়, রাগ। এ পর্যায়ে তার ওপর সৃশৃঙ্খল অভিযান শুরু হয়। আনাড়ি, বোকাসোকা লোকজনেরই ঝোঁক বেশি। জীবনে কোনো দিন মারপিট করেনি বলে নিজেদের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার সুযোগ তারা আগেভাগে নেয়। কেউ এসে চুল ধরে এমনভাবে টানে যেন ঢাকনি খুলে খুলির ভেতরটা দেখবে, কারো শখ কান মোচড়ানোয়। এ অবস্থায় কয়েকজন এক সাথে যোগ দিলে আবদুল করিম মুখভরতি থুতুতে দুতিনজনকে আচমকা ঘায়েল করে ফেলে। আকস্মিক ঘটনায় জনতা খেপে ওঠে, আবার যারা থুতু খেয়ে শার্টে পাঞ্জাবিতে গামছায় রুমালে মুখ লুকাতে ব্যস্ত, তাদের নিয়ে ঠাট্টা-টিটকারিতেও মেতে ওঠে।
জনসমাগমের গন্ধ শুঁকে সদর রাস্তা ছেড়ে দুইজন পুলিশ এসে হাজির হয়, আর স্রেফ বাঁশি বাজিয়ে ভিড় ফাঁকা করে সামনে এগোয়। ঘটনা শুনে পুলিশ দুজন একে অন্যকে দেখে, ভ্রু কোঁচকায়। দুজনের মধ্যে রোগাজন হাতের চিকন বেত তুলে আবদুল করিমের ডান কানে সাঁই করে বসিয়ে দিতে সে কানে হাত চেপে উরি আল্লারে বলে চিল্লিয়ে ওঠে। দুজন এবার জেরা করে-- খানকির পুত, দুধে পানি দিছস? বেতের বাড়ি খাওয়া কান মোচড়াতে মোচড়াতে আবদুল করিম মাথা নেড়ে জানায়, দিয়েছে। পুলিশেরা আবার একে অন্যকে দেখে। রোগাজন জোরালো গলায় জনতার কাছে জানতে চায় আলামত কই? আলামতের খোঁজ করে হতাশ হতে হয়, প্লাস্টিকের লাল বালতিটা ধারেকাছে কোথাও নেই। পুলিশেরা নাছোড়, আলামত তাদের চাই। কিসের পানি--টেপের, না ধানমণ্ডি লেকের, না অন্য কিছুর--পরীক্ষা করতে দুধটা চাই। এ পর্যায়ে আবদুল করিম খোয়া যাওয়া দুধ সমেত বালতির শোকে গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে।
মর্নিংওয়াক সেরে অন্যদিনের তুলনায় মাহমুদ দেরি করে ফেরে। নাশতার টেবিলে বসতে বসতে স্ত্রী নাসরীনকে বলে, ঢাকা শহরে গোয়ালা আছে জানো? ছুটির দিনের হেঁয়ালি ধরতে নাসরীন ভ্র কোঁচকায়, থাকবে না কেন? এ পাড়ায়ই তো একটা আস্ত ডেয়ারি। মাহমুদ রহস্য করে, আরে ডেয়ারি না, গোয়ালা। বহু দিন পর একজন খাঁটি গোয়ালা দেখলাম। দশ বছরের মেয়ে সোমা বলে, গোয়ালা কী করে? প্লেটে লুচি, বেগুন ভাজি নিতে নিতে টেবিলের মাঝবরাবর মিহি স্তর পড়া ধ্যানমগ্ন পায়েশের বাটিটা মাহমুদ লক্ষ না করে পারে না, এবং মুহূর্তেই ঘন দুধের ধ্যানী আড়ষ্টতা থেকে একটা চঞ্চল হাতছানি তাকে অস্থির করে তোলে। বাটিটা কাছে টানতে গিয়ে টের পায় তার হাতের আঙুলে, ঝুঁকে-পড়া মুখের উৎসুক জিভে লজ্জা, লজ্জা। অবস্থা সামাল দিতে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়, গোয়ালা দুধে পানি মেশায়।
সত্যি দুধে পানি দেয়?
অবশ্যই।
কী বুদ্ধি! আমি দেখব।
# #
গোড়াতে আবদুল করিমের কাছে ব্যাপারটা ইয়ার্কির মতো লাগছিল। এমনকি কোমরে দড়ি পরিয়ে যখন চার-পাঁচটা সবে গোঁফ-গজানো ছেলেপেলে তাকে লেকের ঢালু থেকে টেনে উপরে ওঠাচ্ছিল, ইয়ার্কি-আচ্ছন্ন ভাবটা পুরোপুরি তাকে ছেড়ে যায়নি। ছেলেগুলো তার সাথে রসিকতা করছিল, তাঁর নিজেরও ইচ্ছে করছিল পাল্টা রসিকতা করে। কিন্তু অবস্থা এত দ্রুত পাল্টাছিল, সে ভেবে পাচ্ছিল না এরা কী চায়? অল্প সময়েই সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল এরা তামাশা করছে না, কিন্তু কী চায়? তার রাগ বাড়ছিল। শরীরে মার পাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্ষোভে, বিদ্রোহে ইচ্ছে করছিল সবকটাকে শেষ করে দেয়। কিন্তু কোমরে শক্তপোক্ত দড়িটা এমনভাবে তলপেটের নরম মাংসে চাকুর মতো বসে যাচ্ছিল, শেষ করার কোনো কায়দাকানুনই মাথায় খেলছিল না। তারপর যখন হাত দুটোও পিছমোড়া করে চারতলা লাল বাড়িটার সামনের খুঁটিতে টাইট করে বাঁধা হলো, থুতু ছোড়া ছাড়া আর কী করার ছিল! গা-ভরতি রাগ নিয়ে সে লোকগুলোর পাগলামি সহ্য করে। এ অবস্থায় আশপাশে কী হচ্ছে, সে পরিষ্কার খেয়াল করতে পারে না। এমনকি গায়ে এসে পড়া চিকন চ্যাপ্টা মোটা ভারী নানা ওজনের মারগুলোকেও আলাদা করতে পারে না। কিল ঘুষি লাথির প্রতিক্রিয়াগুলো মোটামুটি এক রকম-- ভোঁতা ভোঁতা। অন্যদিকে পাতলা, মোলায়েম হাতের চড়গুলো এত ধারালো ভাবা যায় না। গালে পড়তে কলাপাতা ছেঁড়ার চ্যাড়াৎ আওয়াজ ওঠে। গুঁতোগুলো আবার আলাদা, বুলেট বেঁধার মতো, এধার ওধার ছ্যাদা করে ছাড়ে।
এত ঝামেলার মধ্যেও আবদুল করিমের বোধশক্তির যেটুকু নিভুনিভু কাজ করে, তাতে লোকগুলোর পাগলামিটাই মস্ত ধাঁধার মতো লাগে। এদের মতলবটা কি? শুধু দুধের লোভেই এমন করেছে! এক বালতি দুধ থেকে এতগুলো লোক এক ফোঁটা দুই ফোটা করেও ভাগে পাবে না। শুধু দুধটা মেরে দেওয়াই যদি এদের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে অনেক আগেই তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা। এখনো এরা খেপে আছে কেন? তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে, যেন মাছবাজারের পকেটমার। পকেটমারের কায়দায়ই তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তবে আবদুল করিম তাদের কিছু মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। লোকগুলো যখন তাকে ছেঁকে ধরেছিল--নাম, বাপের নাম নিয়ে জেরা করছিল--রাগের মাথায় সে কয়েকটা কথা মিথ্যা বলেছে। প্রথম মিথ্যাটা-- সিন্ধী গাই জাতীয় কিছু তার নেই। দুটো চিমসে, হাড্ডিসার খাস দেশি গাই থেকে সে আর তার বউ মিলে জবরদস্তিতে লিটার তিনেক দুধ আদায় করে নেয়। বউটা খণ্ডারনি, দুধ নামাতে বসলে ওলানে রক্ত বের করার দশা করে ছাড়ে। দুই নম্বর মিথ্যা কামরাঙিরচর। কামরাঙিরচর কী খেলার কথা! এত পথ ঠেলে দুধে পানি মেশাতে কেউ ধানমণ্ডি লেকে আসে! আহম্মকগুলো এসব বিশ্বাস করেছে।
মিথ্যাগুলো কেন বলেছিল সে বলতে পারবে না। হতে পারে, এমনভাবে আহম্মকগুলো তার ওপর চড়াও হয়েছিল, তেজ দেখাচ্ছিল, আবদুল করিম নিজের অজান্তেই ধরে নিয়েছিল, সে একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
সময় গড়াতে, রোদ চড়চড় করে চোখে লাগতে লোকগুলোর পাগলামি ধাপে ধাপে বাড়ে। হাত-পা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে নাপিত ডেকে তারা তার লম্বা, তেল-চপচপে কোঁকড়া চুল চেঁছে দেয়। পয়সা খরচ করে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বাসি ঘোল এনে মোড়ানো মাথায় ঢালে। টক স্বাদের কয়েক ফোঁটা ঘোল কপাল গড়িয়ে ফোলা ঠোঁটে পড়তে শুকনো জিভ সেটুকু নিমেষে শুঁষে নেয়। কাণ্ড দেখে কেউ কেউ হাততালি দেয়। একজন ঘোলের ভাণ্ড উপুড় করে ঢেলে দিতে ঠোঁট-জিভের তৎপরতা বাড়ে, আর গড়ানো ধারা যতটা সম্ভব মুখবন্দী করতে দুই ঠোঁটের মাঝবরাবর আবদুল করিমের আগুয়ান জিভ হিস্হিস্ আওয়াজ তোলে। শব্দটা ঠিক ঠিক শনাক্ত করতে একজন মাথা বাড়িয়ে এগিয়ে এলে, আবদুল করিম হিস্হিসে গলায় বলে, তোগো মায়রে...। শোনামাত্র জটলা আবার উত্তেজিত হতে বাধ্য হয়।
গোবেচারা গোছের যে লোকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, তার কালো মুখটা লজ্জায় গাঢ় বেগুনি পোঁচে ছেয়ে যায়। সে কী করবে ভেবে উঠতে না পেরে ঘাড়-গর্দানের ওপর বেগুনি রঙের বেঢপ মুখ নিয়ে কাঠকাঠ দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভয় হয়, নড়াচড়া করলেই বদমাইশটা আবার বলবে। এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে। মাথায় ঘোল ঢালার সময় জনতা খেয়াল করেনি ভেজা কাপড়ের বাড়তি ওজনের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ যোগে আবদুল করিমের চেককাটা কলাপাতা-রং লুঙ্গি একটু একটু করে নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এ মুহূর্তে অদৃশ্য কারসাজির মতো প্যাঁচ খুলে কলাপাতা লুঙ্গি ধীরে ধীরে কোমর ছাড়িয়ে গোপনাঙ্গ অর্গলমুক্ত করে উরু-হাঁটু-টাটু ছাড়িয়ে দুই পায়ের গোড়ালিতে বেড়ির মতো জড়িয়ে থাকে। জনতার আক্রোশে বাধা পড়ে। বাধাটা কোথা থেকে আসে, কেনই-বা বাধা, তারা বলতে পারবে না। তবে বাধাটা সত্য। বিমূঢ় ভঙ্গিতে তারা দাঁড়িয়ে থাকে। হিস্হিসে গলায় আবদুল করিম দ্বিতীয়বার তোগো মায়রে বলে।
ভরদুপুরে ডলফিন গলি স্তিমিত, কোলাহলশূন্য রূপ নেয়। গলির যারা আদি বাসিন্দা তারা তো বটেই, যারা অন্তত কয়েকটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা গলিতে কাটিয়েছে, তারাও জানে এ সময়টা একেবারে আলাদা। গলির উঁচ-উঁচু নিমগাছগুলো ঝিরিঝিরি হাওয়া দেয়। রোদের ঝাঁঝ থাকলেও নিমপাতার স্বাস্থ্যকর ঠান্ডা সুগন্ধি হাওয়া গলিময় মৃদুমন্দ বয়। গলি ছাড়িয়ে এই হাওয়া দক্ষিণে বশিরউদ্দিন রোড, জিঞ্জিরা হোটেল, গ্রিন রোড, পশ্চিমে মিরপুর রোডের কোলাহলে, ধানমণ্ডি লেকের দুর্গন্ধ পানিতে মেশে।
দিনটা সাপ্তাহিক ছুটির বলে দুপুর নাগাদ ডলফিন গলি ঝিমিয়ে পড়ে। নিমগাছের হাওয়ার সাথে বোল-ধরা আমগাছগুলোও হেলেদুলে পাতা নাড়ায়। এসবের মধ্যে মসজিদফেরত লোকজনের চলাফেরা তেমন চাঞ্চল্য জাগায় না। তবে টুপি পাজামা লুঙ্গি আচকান পাঞ্জাবি ইত্যাকার পোশাকে আমণ্ডু আবৃত শরীরে তারা যখন প্রাক্তন-- বাম-- বর্তমান-- ডানপন্থী বিরোধী নেতার বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টে হাতবাঁধা, কোমরবাঁধা ন্যাংটো আবদুল করিমকে দেখে, তাদের সুরক্ষিত দেহের আনাচেকানাচে অনিশ্চিত অস্বস্তির সুড়সুড়ি জাগে।
ছুটির দিন দুপুরের অবধারিত ঝালমুরগির পর বিছানা ও নাসরীনের যুগপৎ আকর্ষণ সত্ত্বেও মাহমুদ শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় পায়চারি করে। বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে ডান দিকে ঘাড় কাত করলে গলির যেটুকু চোখে পড়ে, তাতে বাড়িঘরের কার্নিশে খোঁচা-খোঁচা রোদ, দু-একটা রিকশা-স্কুটার, ভিডিও দোকানের কাচে হিন্দি নায়িকার বিস্ফোরক বুক, পথচারী-- এসবের পটভূমিতে ন্যাংটো আবদুল করিমকে মিস করা যায় না। ভোরবেলা মর্নিংওয়াক সেরে দি নিউ আল মদিনা ড্রাই ক্লিনার্সের সামনে জটলা দেখে অজান্তে ফিক করে হেসে ফেলার পর, এই এত বেলা পর্যন্ত তার মাথায় একটা দুর্দান্ত ঠাট্টা কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। এ রকম জটিল ঠাট্টায় বহুকাল পড়েনি। কোন দিকে মোড় নেবে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না। এতক্ষণ ধরে ব্যাপারটা থেকে মুক্তি না পাওয়ায় তার এক রকম দুর্ভোগই হচ্ছে। ন্যাংটো আবদুল করিমকে দেখামাত্র ঠাট্টার মারপ্যাঁচ থেকে কিছুটা হলেও সে বেরিয়ে আসে, এবং হালকা বোধ করে যখন দেখে জনতা একটা সংকটে পড়ে গেছে। শোবার ঘরে ফিরে দেখে সোমা মেঝেতে পা ছড়িয়ে দৈনিক কাগজের অংকধাঁধা ভাঙছে। মেয়েকে ডেকে মাহমুদ ধাঁধা দেয় : একজন অসাধু গোয়ালা প্রতি লিটার দুধে আড়াইশো মিলিলিটার পানি মেশায়...
মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে, অসাধু কী?
যে দুধে পানি মেশায়।
তাহলে সাধু?
যারা দুধ খায়।
পড়ন্ত দুপুরে জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অবঃ-র শান্তির নীড়ের কোণ ঘেঁষে একটা ছোট জমায়েত একটু একটু করে বড় হয়, সরব হয়। দুধে পানি, তাতে কী! বিষ তো না! পানি দেবে না, মধু দেবে! শালাদের খাঁটি দুদু খাওয়ার শখ, খা না শালারা, একটা খা, একটা হাতা, মানা করে কে? খুচরা, অসংলগ্ন প্রতিক্রিয়াগুলো এর মুখ ওর কান হয়ে ঘুরে ঘুরে একটা অনিশ্চিত লক্ষ্যবিন্দু খোঁজে। ব্যাপারটা নির্ঘাৎ বিরোধী পার্টির চাল। ডলফিন গলির আবালবৃদ্ধবনিতার দুধের প্রতি লোভকে পুঁজি করে চালটা চেলেছে। এদিকে সরকার পার্টি না বুঝেই ইডিয়টের মতো তাল ঠুকছে। বুদ্ধু কাহাকা! আরে, দুধ-পানি আলাদা করার উপায় আছে!
বিকেলের ছায়ামোড়া ডলফিন গলিতে পরিস্থিতি বেশ পাল্টায়। আবদুল করিমকে নিয়ে অহেতুক দীর্ঘসূত্রিতায় লোকজন ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়ে। ঘোরতর একঘেয়ে দৃশ্য থেকে মুক্তির আশায় কারা যেন তার কোমরের নারকেল ছোবড়ার দড়ির গিটটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলগা করে দেয়, পিছমোড়া হাত দুটোও খুলে দেয়। আর তখনি সে হুমড়ি খেয়ে দাদ-এগজিমা আকীর্ণ দুই ভাঁজ উন্মুক্ত পাছা উপুড় করে লুটিয়ে পড়ে। যারা কাজটা করে, তারা আফসোস করে। এর চেয়ে দড়িবাঁধা অবস্থায় নিম্নাঙ্গের উদোম সামনের অংশটাই বরং ভালো ছিল।
এ পর্যায়ে একটা আশঙ্কা লোকজনের মনে একটু একটু করে ঠাঁই পেতে থাকে। এদিকে দিনের আলো বেশি সময় বহাল থাকে না, আর থাকে না বলেই আসন্ন অন্ধকারে নানা গুজব উড়ে বেড়ায়। সেসব অধিকাংশই আবদুল করিমের মৃত্যু সংক্রান্ত। একটা সাধারণ, গোবেচারা মানুষের আসন্ন মৃত্যু গলি-নিবাসী মানুষজনের কাতরতা মমতা সহানুভূতির চোরাগোপ্তা জায়গাগুলো অধিকার করে বসে। তারা নানাকথা বলে। দুধ ও পানির ব্যাপারটা তাদের কাছে স্ক্রু-আটা ধাঁধার মতো ঠেকে।
কিন্তু ঘটনা হলো আবদুল করিম জীবিত, জ্যান্ত। তবে তাকে এভাবে ফেলে রাখা কিছুতেই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয় না। কারণ পরিস্থিতি এখন এমন, মৃত্যু তাকে যেকোনো মুহূর্তে আলিঙ্গন করতে পারে। এ অবস্থায় চিন্তাভাবনার পর বিরোধী নেতার বাড়ির সামনে থেকে তাকে সরিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত নিভৃত উপগলির খোলা ম্যানহোলে চেষ্টা চালানো হয়। গর্তটা ছোট। আবদুল করিমের দাদ-এগজিমা আকীর্ণ উলঙ্গ শরীর সে-তুলনায় অনেক বড়।
এক উপগলির পর অন্য উপগলি, ম্যানহোলের পর ম্যানহোল। কিছুতেই সম্ভব হয় না। ম্যানহোলের পরিবর্তে সে ঘাড়ে ঘাড়ে ঘোরে। যারা তাকে বয়ে বেড়ায়, তারা অনুভব করে একটু একটু করে চাপ বাড়ছে। উপায় কী! ঘাড়ে ঘাড়েই তাকে রাখতে হচ্ছে, একটা যোগ্য গর্ত যতক্ষণ না ...
0 মন্তব্যসমূহ