ওয়াসি আহমেদ এর গল্প : বনসাইয়ের স্বপ্ন



ন্ধ্যার পর হালকা বৃষ্টি-হাওয়ায় বনসাইয়ের মাথাগুলো হি হি কাঁপে। বৃষ্টি-অন্ধকার গাঢ় হতে খুদে ডালপালা-পাতায় ঝড়টা ওঠে। বামন-বামন শরীরের অন্ধিসন্ধি থেকে আড়মোড় ভাঙার কটকট আওয়াজ সুরে-বেসুরে বাজে।

আতিক দেখে বামনগুলো গা-গতরে চওড়া হচ্ছে, লম্বা, ঢ্যাঙা হচ্ছে, আর ধেইধেই জুড়ে চার-পাঁচতলা বাড়িঘরের মাথা টপকে আকাশ ধরে ফেলছে। এ সময় তাদের গাট্টাগোট্টা কাণ্ড থেকে, ডালপালা-পাতার ঝাঁপি থেকে সবুজ-কালচে অন্ধকার গড়ায়। গড়াতে গড়াতে আতিককেও ছুঁয়ে ফেললে, সে বালিশের নিচে টর্চ হাতড়ায়। আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে, দুঃস্বপ্ন মনে হয় না। ঘুম কেটে না যাওয়া পর্যন্ত খানিকটা হাঁসফাঁস। বনসাইয়ের দৌড় তো জানা।

আদিত্যবাবু বলেন, স্বপ্নে তুমি তোমাকেই দেখো। আকাশ ছোঁয়ার বাতিক কমবেশি সবার মধ্যেই থাকে। স্বপ্নে এসব শেকড়বাকড় বেশি গজায়। রেগুলার কাটো তো? কাটা বন্ধ করলে তোমার বনসাই তোমার অধীন থাকবে না।

কৃষ্ণচূড়ার একটা গাছ আদিত্যবাবুর দেওয়া। আতিক খুব চেষ্টায় আছে পোষ মানানোর। গত সপ্তায় শেকড় কেটেছে, গাছটা মুখ কালো করে আছে। গোড়াতে সব গাছেরই এমন দশা হয়, কোনো কোনোটা প্রথম চোটেই পাতাটাতা খসিয়ে ধুম ন্যাংটো হয়ে যায়, মারাও পড়ে। ধাক্কা সামলে যেগুলো টিকে থাকে, সেগুলোর অবস্থাও হয় মরোমরো। এ সময়টায় সাবধানে থাকতে হয়, মরোমরো অবস্থাকে জিইয়ে রাখা, আর সুযোগ বুঝে আরো শেকড় কাটা, ডাল ছাঁটা। তবে মুশকিল যা, এ অঞ্চলে বনসাই করার মতো গাছ কম। একমাত্র বট, অশ্বত্থই ভরসা। ঝাঁকড়া মাথা, ঠাসাঠাসি ডাল-পাতায় মানায়ও মন্দ না। কৃষ্ণচূড়ার গাছটা করতে পারলে আতিকের নিজের একটা এক্সপেরিমেন্ট হয়, এচিভমেন্টও। লম্বায় কতটুকু পর্যন্ত আটকে রাখবে, এ নিয়ে তার কিছুটা দোনোমনা আছে। দেড়-দু ফুট পর্যন্ত বাড়তে দিলে মাথাটা কি যথেষ্ট ঝাঁকড়া হবে? নতুন গাছ বলে আন্দাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। অন্য ব্যাপারও আছে। ফুল কি ফোটানো যাবে না? কৃষ্ণচূড়া যখন, ফুল তো জরুরি। বাঙালি কৃষ্ণচূড়া বলতে রক্তলাল রঙই বোঝে।

বনসাই করার উপযুক্ত কিছু দেশি গাছ নিয়ে আতিক ভেবেছে। যেমন নাগকেশর, চলতি কথায় অনেকে নাগালিঙ্গম বলে চালিয়ে দেয়, বোটানিক্যাল নাম করুপিটা গায়নেনসাস। কিংবা জারুল-- ল্যাগারস্ট্রেমিয়া, তেঁতুল-- ট্যামারিন্ডাস ইন্ডিকা। এ ছাড়া ছাতিম, শিরীষ পাওয়া যাবে, কিন্তু মানুষ চায় চেনাজানা গাছ। চিরচেনা একটা বট বা অশ্বত্থ এইটুকু টবে এক-দেড় ফুট উচ্চতায় ঝুরিটুরি নামিয়ে বুড়ো বনে গেছে, এ অনুভূতিটুকু মজাদার। বৈচিত্র্যের কারণেই এটা হয়, চেনা জিনিসের উদ্ভট, পাগলাটে অবয়ব।

প্রথম যে-রাতে স্বপ্নে বনসাইরা হইচই জুড়ে দিয়েছিল, আতিক ভেবেছিল, বলা যায় না, হতেও পারে। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নেমে চিলেকোঠার দরজার ওপারে অন্ধকার ছাদে চোখ ফেলতে হুঁশ হয়েছিল। গর্ধভ কাঁহাকা! আলোহীন ছাদে সারি সারি টবে গোটা পঞ্চাশেক বেঁটে বেঁটে গাছ ঝাঁকড়া মাথায় অন্ধকারের ঝাঁপি সাজিয়ে যেন তারই অপেক্ষায়। আলাদা করে তাদের চেনা যাচ্ছিল না। কৃষ্ণচূড়াটা যে কোথায়, খুঁজেই পাচ্ছিল না আতিক। সেই থেকে টর্চ রাখে বালিশের তলায়। মাঝরাতে একটা চক্কর মন্দ না। আবার হাসিও পেয়েছিল বলা তো যায় না!

চারতলায় আট-বাই-দশ চিলেকোঠা আর ছাদের আধাআধি ভাগ পাওয়ার পর আতিক ভেবেছিল এবার মুরগি পালা বাকি। ছাদেই খাঁচা তুলবে। চিন্তাটা সিরিয়াস কিছু ছিল না। শোনামাত্র ভাইবোনরা তেড়ে এল - ইতরামি! জবাবে আতিক দাঁত বের করে বলেছিল, আণ্ডা পাবে মাগনা। তারপরও ব্যাপারটা কতটা ঠাট্টার, ভাইবোনদের ধরতে সময় লেগেছিল। ওরা তো দেখতে পাচ্ছিল, আতিকের সব জায়গায় ঢুঁ মারা সারা। চাকরি, ব্যবসা, বিদেশ যাওয়া। এখন বাড়ির ভাগ পেয়ে (হোক চিলেকোঠা, ছাদটা ফ্যালনা না) সবার ওপর শোধ তুলবে।

তো মুরগি থেকে বসনাইয়ে চলে যাবে, কারো মাথায় আসেনি। ছাদের খালি জায়গায় টব থাকতেই পারে, টব থাকলে গাছও দশটা যা পঞ্চাশটাও তা। প্রথম প্রথম কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। আতিকও শুরুটা করেছিল চোরের মতো। তবে কারো ওপর শোধ-টোধ তোলা নয়। কিছুটা খেয়াল, কিছুটা দেখা যাক, যদি হয়। সম্বল বলতে কিছু বই-পড়া বিদ্যা (কানজামিতা একোর একটা বই বগলদাবা করে রাখত সারাক্ষণ) আর বাদবাকি নার্সারি ঘুরে ঘুরে স্রেফ চুরিবিদ্যা।

বিদ্যা যে মাঠে মারা যাচ্ছে, তা না। পোষ মানানোর কাজটা এক রকম দখলে চলে এসেছে। দুটো কাজ এক সঙ্গে একই তালে করতে হচ্ছে। খাইয়েদাইয়ে গাছগুলোকে তরতাজা, চাঙ্গা রাখা, আবার ফাঁকতালে শেকড় কাটা, ডাল ছাঁটা। একজিবিশন জাতীয় অনুষ্ঠানে এখনো যায়নি বটে, তবে এর ওর মুখে রটে যাওয়ায় লোকজন আসে। মহিলারাই বেশি। কেনে-টেনে না, চোখমুখ নাচিয়ে, ওমা, কী সাংঘাতিক, এসব বলে-টলে। আতিকও দাম হাঁকে যখন যেমন খুশি। সুন্দরী যুবতী হলে হাঁকানোর মাত্রাটা বাড়ায়। ভয় পেয়ে পিছিয়েও ওরা টবগুলো ঘিরে চক্কর কাটে, শাড়ির আঁচল লুটিয়ে, কুঁচি ফুলিয়ে পাগলাটে গাছগুলো দেখে। কেউ আবার টলটলে চোখে বলে, কী নিষ্ঠুর!

জাপানি কনসুলেট থেকে এক মহিলা ফোন করে যাচ্ছিল। কী গাছ, ট্রিটমেন্ট প্যাটার্ন কী, হাইট, বয়স এসব শুনে বলল, আসবে। আগ্রহ দেখে আতিক বলল, চারতলা সিঁড়ি ভাঙতে পারলে এসো। মহিলা খেপাটে, ডোন্ট ওয়ারি বলে চলেই এল একদিন। কলাবাগানের অলিগলি চষে, গরমে ঘামে নাকানিচুবানি খেয়ে যখন পৌঁছল, আতিক বেকায়দায় পড়ল। বসায় কোথায়? চিলেকোঠায় তো প্রশ্নই ওঠে না। দোতলায় বড় আপার ঘরে নেবে কি না ভাবছে, মহিলা তাড়া দিল, কই চলো দেখি। ভাঙাচোরা সিঁড়িতে মহিলার উঁচু হিল বারকয়েক ঠোকর খেল। পেছন পেছন সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আতিক ভাবল জাপানিদেরও তাহলে গোলগাল ব্যাপারস্যাপার থাকে, সে তো জানত সবই চ্যাপ্টা, ফ্ল্যাট।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গাছ দেখল মহিলা। গাছ দেখা শেষ, এবার সে আতিককে দেখল। গাছ দেখার মতো করেই, তবে মাথা না ঝুঁকিয়ে, ঘাড়ের পেছনে মাথাটা অল্প হেলিয়ে। আতিক জানতে চাইল, কেমন দেখলে? মহিলা তাকে অবাক করে কৃষ্ণচূড়াটাকে নিশানা করল। আতিক যতই বলে, এটা তো তৈরি না, সময় লাগবে, তারওপর আদৌ হয় কি না, মহিলার চাপাচাপি ততই বাড়ে। না হোক রেডি, এটাই চাই। আতিক অন্য গাছ দেখায়, এই দেখো, এটা কী সুন্দর, হানড্রেড পারসেন্ট রেডি, কিছু করতে হবে না, শুধু মাঝে মাঝে ঘর-বার করবে, আর ...। মহিলার এক কথা, দেবে কি না? শেষমেশ রফা হলো, আরো দিনসাতেক আতিক গাছটার যত্নআত্তি করবে, দানাপানি খাওয়াবে, তারপর পৌঁছে দেবে।

আদিত্যবাবু শুনে বলেন, রুজি-রোজগার তাহলে শুরু হলো তোমার? কিন্তু তিন মাসে, চার মাসে একটা, দুটো বেচে কী করে চলবে! মাসে চার-পাঁচটা দরকার, পারলে আরো বেশি। খুব খাটনি আর বুদ্ধির কাজ কিন্তু। মনে করো না চাষাভূষার কাজ, এ তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার চেয়ে কম যায় না। ঢিলেমি দিলে তোমার বনসাই তোমার অধীন থাকবে না।

আতিক বলে, ঢিলেমি কোথায়? তারপরও রোজ রাতে থ্রেট করে। চোখ বুজলেই সবকটা তেড়েফুঁড়ে ওঠে। কোনো কোনোটা তো বাড়তে বাড়তে...

মেঘ ছুঁয়ে ফেলে। আদিত্যবাবু ঠা ঠা হাসেন। বলেন, খাঁটি মালি যদি হতে, এটা হতো না। তোমার সমস্যা হলো... যাক। শেকড় কাটবে আরো।

কাটি তো।

গাছের?

আর কিসের?

আরে গাছের তো কাটবেই। নিজেরও কাটবে।

সে তো কাটা সারা। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে মালি।

অত সোজা মনে করো না। কত অ্যামবিশন ছিল, বড় চাকরি হবে, নয়তো ব্যবসা, তাও বড়, নয়তো অ্যামেরিকা, ওখানে অবশ্য সবাই বড়, ডেগ-বাসন মাজুক আর না-ই মাজুক। ওপরে ওঠার স্বপ্নটা তো ছিল, এখন পোষা গাছকে বারণ করছ ওপরে উঠতে।

কিসের সঙ্গে কী!

# #

জাপানি মহিলা কিন্তু একবার এসেই থেমে থাকল না। কৃষ্ণচূড়াটা সে বাঁচাতে পারেনি। সে বলে, গাছটা আত্মহত্যা করেছে। সে আসে ঘন ঘন। আরো কৃষ্ণচূড়ার ফরমাশ দেয়। আতিক হাসে, অত সোজা নাকি? অগত্যা, সে বট-অশ্বত্থই নিয়ে যায়। কোনোদিন অকারণেই ছোট্ট ছাদে বামনগুলোকে পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ঘুরঘুর করে। আতিককে তেমন কিছু করতে হয় না। চারতলা পর্যন্ত সিঁড়ি টপকানোর সময় পেছন থেকে গাঢ়-গম্ভীর দুলুনিটুকু চোখভরে দেখে। প্রায়ই ভাবে, এত গোলাগাল, মাপমতো টবে বসিয়ে দিলে এর মতো আচানক কী হতে পারে!

এক জাপানির সুবাদে আরো জাপানি আসে, কোরিয়ান আসে। মহিলাই বেশি, কারো সঙ্গে পুরুষ। সবাই যুবতী নয়, কেউ কেউ। পিছুপিছু সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে ফারাকটুকু আতিকের চোখে ধরা পড়ে। টবে বসানোর চিন্তা সবার বেলায় খাটে না। তবে হঠাৎ হঠাৎ যখন মাথায় খেলে, সে দিশেহারা বোধ করে।

বিদেশিদের কারণেই কি না কে জানে, চারতলার ছাদে দেশিদেরও আনাগোনা বাড়ে। এপাড়া-ওপাড়া, দূর-দূরান্ত থেকে তারা আসে। বেশির ভাগই মহিলা। একা আসে, পুরুষ সঙ্গী নিয়ে আসে, তিন-চারজনের দলবলসহ আসে। গাছ-টাছ বোঝে না। কাঁধের ব্যাগ নাচিয়ে চেক না ক্যাশ বলে মাঝবয়সি রমণী যখন কষ্টেসৃষ্টে ঢালু বুক দোলায়, আতিক ভাবে উপুড় করে টবে বসালে কাকতাড়ুয়া হিসেবে মানাবে ফাস্ক্লাস।

সিঁড়ি ভাঙার কাজ আতিক ছেড়ে দেয়। চিলেকোঠায়ই থাকে। তো চিলেকোঠায়ই একদিন দেখা হয়ে যায়, আতিক ভেবে পায় না কী বলবে একে, পদ্মমুখী? পদ্মপাতার মতো মুখ, তিরতির চোখের পাতায় পদ্মপাতারই টলোমলো আবেগ। আতিক চমকে যায়। অভিভূত হয়ে দেখে আর দেখে, দিশেহারা বোধ করে, আর তখনি মাথায় খেলে তীব্র বিদ্যুচ্চমক। টবে বসানোর মতো এমন মুখ আর কোথায়!

দিনে দিনে আতিক বোঝে বনসাইদের থেকে সে একটু একটু করে সরে আসছে। গাছগুলোও সুযোগ বুঝে বেপরোয়া। রাতে ঘুমঘোরে ভয় দেখানো তো আছেই, দিনের বেলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে টের পায় ডালপালার বাড় বাড়ছে। সত্যিই তবে অধীন থাকছে না! কেটেছেঁটেও বাড় থামানো যাচ্ছে না। বেশি বেশি কাটতে গিয়ে গোটা চারেক প্রায়-তৈরি গাছ বলতে গেলে নিজ হাতেই সে গলাটিপে মেরে ফেলে। মরা গাছের কঙ্কাল সাফ করতে গিয়ে মনে মনে বলে, বশ না হওয়ার শাস্তি। আদিত্যবাবু দেখতে এসে বলেন, জঙ্গল হয়ে গেছে তো, সার-টার দিচ্ছ নাকি! আতিক বলতে পারে না, গাছ তার বশে নেই।

বাড়িতে একমাত্র বড় বোনের সঙ্গে আতিকের লেনদেন। মহিলার কথা একদিন কানে বাড়ি মারে, তোর জেদটা কার ওপর? কার ওপর শোধ তুলছিস?

আতিক জানতে চায়, এ কথা কেন?

যা করছিস তা জেদ মেটানো ছাড়া কী! লেখাপড়া শিখে মালি। নিজে কিছু করতে পারলি না, তাই অন্যের ওপর ঝাল ঝেড়ে কী লাভ!

বলো তো কার ওপর?

তুই জানিস। গাছগুলোর কী দোষ!

আতিক হাসে। বলে, গাছ না।

তা তো জানি। মানুষ। কে, কারা?

আতিক চুপ করে শোনে। অন্যের ওপর ঝাল মেটাতে সে কেন গাছ পুষবে! এক হতে পারে, গাছগুলোকে বাড়তে না দিয়ে, নিজের অধীনে রেখে একটা কিছু সে পাচ্ছে। বশ্যতা নিশ্চয়। রোজ রাতে গাছগুলো যে তেড়েফুঁড়ে ওঠে, তার প্রতিশোধ নিতেই দিনের বেলা শেকড়বাকড় কাটা, কাটতে কাটতে মেরেও ফেলা। আবার এও হতে পারে, নিজের শেকড়বাকড় নিজেই যখন কেটেকুটে সে বামন হয়ে আছে, তখন বামন গাছগুলোকে আয়না বানিয়ে নিজেকে দেখতেই তার ভালো লাগছে।

তবে গাছদের বেড়ে ওঠার বাতিক দেখে তাজ্জব হতে হয়। দিন নেই রাত নেই, মাথায় তাদের একই খেয়াল। সারাক্ষণ নজর আকাশ বরাবর। আকাশ বলে কিছু নেই, তবু মরি-বাঁচি, আকাশ ধরা চাই। লাগামছাড়া আকাক্সক্ষা, মানুষের মতোই।

আতিক অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে, প্রেরণাটা আসছে কোথা থেকে? এত বাড় বাড়তে নেই সোনা, বলে সে বেদম কাঁচি চালায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মূল শেকড়-টেকড় পর্যন্ত থেঁতলে দেয়। প্রেরণাটা যদি এতে মার খায়!

কাজ হয় বলে মনে হয় না। আতিক হতভম্ব হয়ে দেখে বাড় থামানো যাচ্ছে না। তার কাটছাঁটকে টেক্কা দিয়ে ডালপালা-পাতায় জেল্লা বাড়ছে, আর সবুজ-কালচে চোখেমুখে লকলকে লোভ, না-কি লাগামছাড়া পাগলা আকাক্সক্ষা! মনে মনে আতিক বলে, চড়াচ্ছি আকাশে! মনের জোরে কত দূর যাবে, মন ভাঙার চাবি তো আমার হাতে, প্রাণ ভাঙারও। শেষ কথাটা ভাবতে গিয়ে মনে হলো বুকের ডানদিকে না বাঁদিকে যেখানে তার নিজের প্রাণ বা হার্টটা থাকার কথা, সেটা হঠাৎ ডিগবাজি খেল।

দেখেশুনে আদিত্যবাবু পর্যন্ত চোখ কপালে তোলেন, এমন তো দেখিনি, সারা জীবন গাছ নিয়ে কাটালাম, গাছের নাড়িনক্ষত্র মুখস্থ, তোমার এগুলো কী! কী করেছ তুমি! কেটেকুটে সাফ করে দিচ্ছ, তারপরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! কী করেছ বলো তো? ছেড়ে দাও, এগুলো তোমার অধীন থাকবে না। তোমার কাজ না।

আতিক মনমরা গলায় বলে, আমি তো এদের নিয়েই থাকতে চেয়েছিলাম। চেষ্টাও তো কম করলাম না। এতদিন ঠিকঠাক চলল, এখন আর হচ্ছে না কেন?

আদিত্যবাবু, যাকে গাছবাবু বলেও কেউ কেউ ডাকে, চিন্তিত মুখে ছাদের চারধারে চক্কর কাটেন, গাছগুলোর গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে, পাতার সবুজ হাতে কচলে সহানুভূতির গলায় বলেন, এগুলো নিয়ে থাকতে চেয়েছিলে, তা তো জানি। দিনরাত খাটাখাটনি কম করোনি। নিজের উচ্চাশা, স্বপ্ন ঝেড়েঝুড়ে গাছে মন দিয়েছিল। ভেবেছিল, গাছগুলোকে বাড়তে না দিয়ে নিজের উচ্চাশা দমন করবে। পারলে না। মনে হচ্ছে, তোমার স্বপ্ন, অ্যাম্বিশন তোমার গাছগুলোকে পেয়ে বসেছে। কোনো বাধাই আর...

আতিক বিরক্ত হয়। কথার পিঠে ঝাল ঝাড়তে সে আচমকা হাতের নাগালে যে গাছটা পায়, সেটার ঝাঁকড়া মাথা ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। যতটা বিক্রম বা তেজ নিয়ে সে কাজটা করে, সে-তুলনায় প্রায় বিনা প্রতিরোধে টবের মাটি ছেড়ে গাছটা তার হাতে উঠে আসে। আর তখনি তাদের দুজনের বিস্মিত চোখ গিয়ে পড়ে গাছটার নিম্নাঙ্গে, ধূলিধূসর কালচে কাণ্ডের নিচে, যেখানে শেকড়বাকড় বলতে কিছু নেই।

পদ্মের মতো মুখ সেই রমণী এক স্তব্ধ দুপুরে চিলেকোঠায় নিজেকে আতিকের কাছে সঁপে দেয়। আতিক অভিভূত চোখে বেছে বেছে তার খোলা, মসৃণ ঘাড়টাকে নিয়ে খেলে। টবে জুতমতো বসাতে পারলে এ মুখ আকাশ ধরতে চাইবে না। দেখে দেখে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে আতিকের তৃষ্ণা বাড়ে। আঙুলের দ্রুত, অশান্ত সঞ্চালনে সে পাকা গম-রং চামড়ার অতলে শিরা-উপশিরাবহুল শক্তপোক্ত শেকড় খোঁজে। আঙুলের ছোঁয়ার সঙ্গে দু-চোখের সব জ্যোতি এক করে খোঁজে। তার মনে হতে থাকে, চোখ দিয়েই ছুঁয়ে যাচ্ছে একের পর এক আচ্ছন্ন, শাখা-প্রশাখাময় শিরা-উপশিরা। দুই কাঁধে কনুই চেপে সযত্নে মুচড়ে মুচড়ে মাথাটাকে শেকড়সমেত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে আতিক বাধা পায়। চেরা চিৎকার চিলেকোঠার আধোঅন্ধকারে ঘূর্ণি তুলে ঘোরে।

ঘুমঘোরে সে-রাতে আতিক স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখে না। অন্য সব রাতের মতো বনসাইদের লাফঝাঁপও তাকে তাড়া করে না। বরং খুব সন্তর্পণে একটা বিরতিহীন খচমচ শব্দ তার কানের ফুটোয় ঢুকে পড়ে। দুই কানের দুই ফুটো দিয়ে ঢুকে তেলতেলে পর্দায় ঠোকর খেয়েও শব্দটা পিছু হটে না। মৃদু কোলাহল তুলে গায়ে গা ঠেকিয়ে জায়গা নিতে থাকে। পরতের পর পরত জমে দুই কানের দুটো ফুটোই যখন ঠাসাঠাসি, দুর্ভেদ্য, শব্দগুলো তখন তার চোখের সামনে ঘুরে ঘুরে ওড়ে। বিরতিহীন, টানা শব্দ। এদিকে আবার বনবাদাড়ের টাটকা, তেজি ঘ্রাণ। আতিক বিছানা ছেড়ে নামে। বালিশের তলায় টর্চ হাতড়ানোর কথা মাথায় আসে না।

চিলেকোঠার দরজা ঠেলে ছাদে পা ফেলতে কাঁপুনি লাগে গায়ে। অক্টোবরের মাঝামাঝি এ শহরে কাঁপুনি এল কোত্থেকে! ভাবতে ভাবতে সে টের পায় কাঁপুনিটা আসছে শরীরের ভেতর থেকে; সম্ভবত খুব ভেতর থেকে, যে-কারণে সে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কুঁকড়েমুকড়ে বসে পড়ে। চোখজোড়া একবার খুলেই ঝপ করে বন্ধ করে ফেলে। খুলবে কী খুলবে না করে যখন খোলে, কাঁপুনিটা তাকে বেদম ঝাঁকায়। আতিক দেখে, ভয় পেয়েও দেখে, কারণ তাকে দেখতেই হয় বনসাইরা আকাশে উঠে যাচ্ছে। ছোট-বড় টবের দেয়াল ফাটিয়ে, ভেঙে লণ্ডভণ্ড করে তারা হু হু বাড়ছে; ডালপালা-পাতা ছড়িয়ে, একে অন্যের সঙ্গে বাজি ধরে বাড়ছে। ছোটখাটো একটা চাঁদ ঝুলছে বহু দূরে। চাঁদের আলো-টালো ছত্রখান করে বামনগুলো চাঁদটাকে নিশানা করেই ছুটছে।

কয়েক মুহূর্ত হাঁ হয়ে থেকে আতিক উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। বাঁকানো ঘাড়-পিঠ নিয়ে প্রথমে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে দুই পায়ে ভর সামলে উঠে দাঁড়ায়। শরীরজুড়ে শিউরানি। হৃৎপিণ্ডটাই বেশি লাফাচ্ছে। এত বছরের পরিশ্রম ...। বুকে হাত চেপে হৃৎপিণ্ডটাকে বেশি করে চেপে আতিক আকাশ বরাবর, দূরের চাঁদ বরাবর তাকায়। কত কাল পর সে আকাশমুখো হলো মনে করতে পারল না। সে তো মাথা গুঁজেই থাকতে চেয়েছিল। তাই তো বামন পোষা।

শিউরানিটা বেড়েই চলে। দুই পায়ে সব শক্তি জড়ো করেও আতিক টিকে থাকতে পারে না। বাধ্য হয়ে বসে পড়ে, কিন্তু মাথাটাকে সোজা না রেখে উপায় নেই, দেখতে তাকে হচ্ছেই। নিজের এত বছরের ব্যর্থ শ্রম, পরাজয় না দেখে উপায় কী! বনসাইরা তো তার পরাজয়কে নিয়েই খেলছে। কিন্তু এই যে বামনগুলো রাতের আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, চাঁদ-টাদ মানছে না, ঝড়বাদলা, বিপদআপদ কোনো কিছুই পরোয়া করছে না এ দৃশ্য কি তার একারই দেখার কথা! দেখে দেখে কাঁপুনিতে হাত-পা-ঘাড়-মাথা জট পাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই!

হৃৎপিণ্ডটা জোরে জোরে মোচড় তুলছে, হাতের চাপ খেয়েও থামছে না। এ অবস্থায় চিৎকার করলে মন্দ হয় না, অস্থিরতা হয়তো কিছুটা কমবে; আর চিৎকার শুনে যারাই ঘুম-টুম ফেলে বাইরে বেরুবে, তারা তো প্রথম ধাক্কায় তারই মতো হতভম্ব হবে, তারপর তাদেরও কাঁপুনি আসবে, শিউরে শিউরে উঠবে সারা শরীর, শরীরের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা বেশি বেশি লাফাবে, আর আকাশমুখো তাদের জোড়া-জোড়া ঘুমজর্জর চোখ অস্থির, অবিশ্বাস্য আবেগে, মুক্তিতে জুড়িয়ে যাবে তারই মতো!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ