ওয়াসি আহমেদের উপন্যাস "মেঘপাহাড়" নিয়ে কুমার চক্রবর্তীর আলোচনা: বয়স্কের যৌনবেদনার সুড়ঙ্গবীক্ষণ


ভালাে উপন্যাসে দর্শন ইমেজে পরিণত হয়ে ওঠে—এমনই একটি কথা বলেছিলেন আলবের কামু সার্ত্র-র বিবমিষা-র আলােচনায়। তিনি আরও বলেছিলেন, এই রূপান্তরণে যদি দর্শন চরিত্রকে ছাপিয়ে যায় তাহলে প্লটের যথার্থতা থাকে না, আর আখ্যানও জীবনপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। কথাগুলাে মূল্যবানই শুধু নয় বরং বিবেচিত সূত্রও বটে এবং কথাগুলাে সব সাহিত্য-মাধ্যমের জন্যেও সমভাবে প্রযােজ্য।

জীবন ও তার অভীপ্সার প্রতিফলন যে-বােধের জন্ম দেয়, তাকে উদ্দিষ্ট করে যে আখ্যান রচিত হয়ে উঠতে চায়,—এই পথে যথাযথ সংশ্লেষণ শুধু জরুরিই নয়, অনিবার্যও বটে। না হলে আখ্যানের নিয়তি ব্যর্থ-কথনে পর্যবসিত হয়। আখ্যানকে যদি ‘অব্যর্থগভীর হতে হয় তাহলে এই শিল্পসৌকর্যের অন্বেষণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। এখানেই আপতিক অর্থে হলেও, উপন্যাস নামক এই নতুন সাহিত্যমাধ্যমটির সম্ভাবনা ও সমাধির অস্তি-নাস্তি ও দোলাচলের ভার। কেননা যে কারণে এই সাহিত্য-আঙ্গিকটির সৃষ্টি তা যদি তার নিজস্বতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে প্রয়ােজনহীনতার বিষয়টিও উচ্চকিত হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎ উপন্যাসের সার্থকতা তাই এই নবায়নের সম্ভাবনা ও সার্থকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়।

বিংশ শতাব্দীতে উপন্যাস আকার-ঐকতানে, বৈচিত্র্য-ভাবনায়, নন্দনে-প্রতিবেদনে, অনুসন্ধান-উপসিদ্ধান্তে একেবারে ফাটাফাটি একটি বিষয় ঘটিয়ে দিয়েছে যাকে বলা যায় epoch making, কেননা এর ওপর ভিত্তি করেই, এর সংগঠিত ও জায়মানিত ভাষারীতি, উপস্থাপনা, আঙ্গিক, দর্শন ও অন্বেষণের রীতিকে অনুসরণ করেই পরবর্তীকালের (এখন অব্দি) উপন্যাসের বিস্তার ঘটতে থাকে। সাহিত্যের স্মরণীয় ও আশ্চর্যের একটি দিক হল, নিরঙ্কুশভাবেই তা নতুনের দিকে যায় ও অবশেষে নতুন হয়ে ওঠে। এই মেটামরফসিস আছে বলেই সাহিত্য অন্তহীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। বিংশ শতাব্দীর উপন্যাসই প্রথম তার উদ্দেশ্য ও পরিচয়ের এতদিনের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডকে অস্বীকার করে অধিকতর মানবমুখী হওয়ার চেষ্টা করে, ও সার্থকও হয়। বুর্জোয়া পাঠকের অবসর বিনােদনের পরিসর থেকে উপন্যাসকে মুক্ত করে আত্মস্বরূপের সন্ধান ও মুক্তির বাতায়নে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দী এক অর্থে বিস্ফোরকের কাজ করে। সৃষ্টি হয় উপন্যাসের নতুন পাঠক যারা নবসৃষ্ট উপন্যাসে সেঁধিয়ে যেতে চাইছে। এতদিন উপন্যাস যেত পাঠকের কাছে কিন্তু এখন পাঠক যেতে চাইছে উপন্যাসে, কেননা সে জীবন ও শৈলীর মুক্ত প্রয়াসটিকে গ্রহণ করতে চাইছে উপন্যাস থেকে, যা তাকে বিচলিত করবে, বিশিষ্টও করবে। জীবনবাস্তবতাগুলাে সরলরৈখিক নয়, আবর্তসঙ্কুল, আর তা গােপন ও বিস্তৃত। আত্মস্বরূপের অনুসন্ধান তাই অপরিসীম ও অনিঃশেষ। উপন্যাস মানুষকে এই অনুসন্ধানের বিশ্বসিত এলাকায় পৌঁছে দিতে চায়। কবিতার তুলনায় উপন্যাস একেবারেই সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত সাহিত্যমাধ্যম কিন্তু উপন্যাস এর মধ্যেই এক সঞ্চারিত সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে যে এর পরিসরে সব কিছুকে ধরা সম্ভব, এমনকী কবিতাকেও। এটা এমন একটি সাহিত্যরীতি যা ব্যক্তিমানুষের টলস্টোরি-কে সামষ্টিক অভিভাবনায় উপস্থাপন করে যার থেকে প্রকারান্তরে দাঁড়ায় মানবের জন্যে উপযুক্ত পিকচার-ফ্রেম। আবার উপন্যাসের রয়েছে এক প্রসারিত পরিসর যা তাকে প্রবহমান স্থায়িত্ব দেয়। উপন্যাসের পরিসর তাই যৌগিক অভিগমনের সঞ্চারক্ষেত্র যেখানে কাঠামােবাদী সাহিত্যমাধ্যমগুলাের অন্যধরনের পুনর্বাসন ঘটে। উপন্যাস তাই ধারাবাহিক আত্মস্থতার আধার। ফলে উপন্যাসের সম্ভাবনা বা স্থিতিস্থাপকতা একটু বেশি বলেই বােধ হয়। আর এ জন্যেই উপন্যাসের ধারণক্ষমতাও অধিক। এইসব ক্ষমতা উপন্যাসকে সম্পৰ্কায়িত ও সম্প্রসারিত হওয়ার সুযােগ দেয়। যে-অস্তিত্বের চিত্র ও ফনােগ্রাফ সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায় সেখানে উপন্যাস নিবিড় ডালপালা নিয়ে হাজির হয়। অস্তিত্বের ধ্বনিগুলাে সেখানে ভাববিনিময় করে, প্রতিধ্বনি তােলে। সময়ের ও পরিসরের মাঝ দিয়ে উপন্যাস খোঁজে তার তাৎপর্যের দিশা।

২.


ফরাসি লেখিকা জেরমেইন নেকতা দ্য স্তেল(১৭৬৬-১৮১৭)১৭৯৫ সালে লিখিত তার এক বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘এসেইস অন ফিকশান্স'-এ আখ্যানের এক সূত্রের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কিছু কিছু আখ্যান আছে যেখানে সবকিছু একইসঙ্গে আবিস্কৃত এবং অনুকৃত হয়, যেখানে বস্তুত কোনােকিছুই সত্য নয় বরং সবকিছুই সত্যের মতো। এটা তাে ঠিক যে গল্প বাস্তব নয় কারণ তা সত্যিকার কোনাে ঘটমান প্রপঞ্চকে উপস্থাপন করে না। কিন্তু গল্প বাস্তবকে অনুসরণ করে নিজ পদ্ধতিতে যেখানে স্তেল কথিত আবিস্কারের ইশারা ও অভিব্যক্তি আত্মপ্রকাশিত হয়। আর ভালাে করে দেখলে বস্তিৰ মানেই ঘটমান বাস্তব নয়, ঘটিতব্য বিষয়ও বাস্তব, মনােশারীরিক অভিজ্ঞতাও বাস্তব, স্বপ্নও বাস্তব। বােধ হয় শিল্প সম্পর্কে এটি একটি প্রগাঢ় উক্তি যা একটি ভিন্নতর তাৎপর্যকে উপস্থাপন করে। ব্যক্তিক ও সামাজিক বাস্তবতার নানা চোরাগলি থাকে যার একটি ধরে আর-একটিতে এসে হাজির হওয়া যায়। এই আখ্যানের ক্ষেত্রেও আমরা এমন ধরনের বাস্তবতাকেই খুঁজে পাব যেখানে একজন মানুষের কামজ বাস্তবতা সামাজিক বাস্তবতায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে বসে।

ওয়াসি আহমেদ-এর মেঘপাহাড় উপন্যাসটির মধ্যে আমরা একটি বিষয়কে উপলব্ধি করতে থাকি যা ঘটনা ও চরিত্রের রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে দেয়। মূলত খুব নিবিড় বাতাবরণে ব্যক্তির পতনকে আমরা দেখি উপন্যাসের শুরুতেই তার মৃত্যুর পরপর, আর এখান থেকেই আবির্ভূত হতে থাকে উপন্যাসের চরিত্র যা পুরাে আখ্যানকেই নিয়ন্ত্রণ করে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের বাস্তব উপস্থিতি ছাড়া। ব্যক্তি মৃত কিন্তু চরিত্র ঘটনাকে পরিচালিত করে, ব্যক্তি নেই। কিন্তু এই নেই থেকেই চরিত্র গড়ে উঠতে থাকে উন্মোচনের অন্তস্তলীয় কানাগলিকে সম্বল করে। আবির্ভূত হতে থাকে অন্যান্য চরিত্ররা। মৃতকে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হয়, মৃতের গােপনীয় অথচ স্বাভাবিক এক অভিজ্ঞতা অস্বাভাবিক এবং নিন্দনীয় হওয়ার আশঙ্কায় দু-জন ছাড়া অবশিষ্ট চরিত্ররা ঘােরতর চাপাচাপিতে উথাল-পাথাল হতে থাকে। বস্তুত মৃতই যেন কেন্দ্রীয় চরিত্র এ উপন্যাসের।

উপন্যাসটির কাহিনিতে তেমন কোনাে চমক নেই, বরং যৌথঅবচেতন জায়গা থেকে মনে হতে পারে এর সঙ্গে আমরা অতি পরিচিত। সমাজের ভেতরের ব্লু-প্রিন্টে আকছার এসব ঘটনার ছাপ আছে যা কোনাে নতুন বাস্তবতার কথা এখন আর আমাদের বলে না, তা আজ-অব্দি আমাদের সমাজের এক ওপেন-সিক্রেট বিষয়। বাংলা-ভারতীয় সিনেমার কাহিনিতেও এর সবল উপস্থিতি চোখে পড়ে। যৌনতার সামাজিকীকরণ আমরা পছন্দ করি না যদিও ব্যক্তি-পর্যায়ে আরােপিত নিষেধকে আমরা বার বার অতিক্রম করে যাই ব্যক্তিগত যৌন-ফ্যান্টাসির দ্বারা। উপন্যাসটি হাতে নিয়েই আমরা জেনে যাই, এর পূর্ব-প্রকাশিত নাম ছিল অবতার এবং এই নামটি মূল চরিত্রটির সাইকোম্যাপিং-এ এক দুর্মর শ্লেষকে উপস্থাপন করে। যা-ই হােক, বই হিসেবে আত্মপ্রকাশে তার নাম বদলে যায়, নামটি মেঘপাহাড় অধিকতর প্রতীকী হয় বলেই মনে হয় কারণ প্রথম পাঠ চলাকালে পাঠককে মৃতের রহস্য ধাক্কা দিয়ে অনেকটা এগিয়ে দেয়,মেঘ তার ইয়ারদোস্ত জোছনাকে নিয়ে উপন্যাসের আগা ও গােড়ায় পরাবাস্তবিক বাতাবরণ সৃষ্টি করে।

অবতার-সুলভ এক অবসরপ্রাপ্ত জজের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় তার অজানা অদেখা যৌনসুড়ঙ্গ, যা পুরাে পরিবারকে সমাজ সহযােগে এক নতুন বিস্ময়ের দিকে ঠেলে দেয়, আর এই সুড়ঙ্গবীক্ষণের কাজটি করে তারই এক ছেলে কামরান যে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বরাবরই ছিল আপােষহীন। কামরান মানুষের দেবত্বারাপিত ধারণায় বিশ্বাসী না, আর এই অ্যান্টিথিসিসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় তার বাবার অতিমানবিক ইমেজের বিমােক্ষণ করার বিষয়ে। উপন্যাসে কামরান ভাবে এই বিষয়ে,

[...] কিন্তু জেআরভি মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ, আর তাই তাকে দেবতা নয়, মানুষ প্রতিপন্ন করার এতটুকু দায় কি কারাে নেই প্রয়ােজনে দেবতার আসন থেকে টেনে-হিচড়ে নামিয়ে হলেও।

[পৃ. ৭০]

ব্যাপারটি শুরু হয় তার দেবতাপ্রতিম পিতার মৃত্যুর পর এক রহস্য থেকে যে তার পিতা জালালউদ্দিন রিজভীর সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ যৌন সম্পর্ক ছিল তাদেরই বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকা কাজের মেয়ে কুসুমের সঙ্গে যে রিজভী-পরিবারের সঙ্গে গ্রামে আসার এক বৎসরের মধ্যে তার নিজ বাড়িতে চলে যায়, এবং এখানেই শেষ নয়, দেবতাপ্রতিম পিতার ঔরসে কুসুমের গর্ভে সন্তানের জন্ম হয় যাকে নিয়ে কুসুম তার নিজ বাড়িতে বসবাস করতে থাকে, এবং এক সময় সে তার সন্তান যে রিজভীর ঔরসে জন্ম, তা-ও উচ্চকণ্ঠে সবাইকে জানিয়ে দিতে চায় এবং এর পরিণামে বাজে মেয়ের খেতাবও তার জোটে। উপন্যাসের প্রােটাগনিস্ট চরিত্র হলাে কামরান যে ছােটবেলা থেকেই বাবার বিরুদ্ধে নিজ নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করেছে এবং বাবার মৃত্যুর পরও আদর্শ পিতার মুখােশ উন্মােচনের দায়কে বহন করেছে। কামরান এটা করেছে জেদের বশে নাকি দায়িত্বের বশে, তা স্পষ্ট নয়। দু-দিকেই এর যুক্তি খুঁজে পাওয়া ভার। শুরুতেই পিতার আদর্শকেন্দ্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট, আবার পিতাকে সে এই কারণে পছন্দও করত। চিন্তার জায়গা থেকে দুজনের ফাক ছিল, পিতা যেখানে বিশ্বাসী সেখানে কামরান সংশয়বাদী। এটা সম্ভবত মার্কসবাদে এবং পরে সংশয়বাদে কামরানের দীক্ষার কারণে বুর্জোয়া নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক সাবলীল মিসপ্রাইজ্ড। আবার কামরানের বাইরে যাবার ব্যাপারে তার পিতা অর্থ না দেওয়ায়ও কামরান তার ওপর তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু কেন কামরান এতটা আধুনিক হয়ে উঠল যে মৃত পিতার গােপন যৌনতাকে তার মৃত্যুর পর উদঘাটন করতে চাইল, তা পরিপূর্ণভাবে বােধগম্য নয়। যা ছিল পিতা-পুত্রের অহংকেন্দ্রিক তুচ্ছতার টানাপড়েন, তা-ই হয়তাে পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিত্বের এক স্থায়ী অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কামরান চরিত্রটি আমাদের পরিচিত মনে হয়। একটু নিবেশ দিলে আমরা ধরতে পারি,আলব্যের কামুর আগন্তুক (১৯৪২)-এর নায়ক মারসোল-এর একটি প্রতিরূপ হয়তােবা আমরা পেয়ে যাই কামরানের মাঝে। মারসেল ভাবে, মা আজ না কাল মারা গেছে সে জানে না। আর মেঘপাহাড়-এর কামরান তার বাবার মৃত্যুর পাকা দুইদিন পর বাড়িতে আসে কোনাে কারণ ছাড়াই। আখ্যানকার আমাদের জানান দেন,

[...] কারণ, মৃত্যুটা এই সন্ধ্যারাতে পাকা দুই দিনের বাসি। খবর পাঠানাের পরও এই বিলম্বের কোনাে অজুহাত খাটে না, কেউ অজুহাত আশাও করে না।

[পৃ. ৩২]

তারপর আমরা দেখি বড় বােনের স্বামীর সঙ্গে কথােপকথনে আবারও কামরানের উনুল চিন্তার প্রতিধ্বনি:

[...] সুতরাং অসুস্থতার খবর, মৃত্যুর খবর,—দু'দুটো খবর পাওয়ার পর তুমি আসবে না,সবাইকে অপেক্ষায় রেখে বুড়াে আঙুল দেখাবে, এর তাে একটা জবাব দরকার।

আমি আপনাকে জবাব দেব না।

অন্য কাউকে দেবে? না।

আমার ইচ্ছা হয়নি, আসি নি।

[পৃ. ৩৩]

এসব সংলাপ প্রাথমিকভাবে আউটসাইডার-কে মনে করিয়ে দিলেও দিতে পারে কিন্তু উপন্যাস দুটির মধ্যে চেতনাগত কোনাে মিল নেই। আগন্তুক বিচ্ছিন্ন জীবনের অস্তিত্বসংকটকে নিয়ে ভাস্বরিত, আর মেঘপাহাড় প্রকারান্তরে এক অন্তৰ্বত যৌনতার পােস্টস্ক্রিপ্ট।

৩.

উপন্যাসটির প্লট খুব উদোম নয়, বরং বলা দস্তুর তা পরিমাপিত । চরিত্রগুলাে বিন্যস্ত ও ঠিক ঠিক স্থাপিত। যেটা অতি উল্লেখযােগ্য তা হলাে, আমরা জানি উপন্যাসে ভাষার অন্যতম প্রধান দিক হলাে আবশ্যকতা। ভাষা কাহিনিকেই শুধু উপস্থাপন করে না, তা মনের স্তরগুলােকেও আবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে উপস্থাপন করে। আলােচ্য উপন্যাসে যা যথাযথভাবে আত্মপ্রকাশিত তা হলাে ভাষার অব্যর্থসন্ধানীর ভূমিকা। উপন্যাসে ঘটনার বাস্তবতা লেখকের কথনকৌশল ও আবিষ্কারের ভিন্ন উপায়ের কারণে অবশেষে ভিন্নতর হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটির শুরুতেই ভাষা তার স্থান করে নেয়, তার যাথার্থ্য ও সহজতা নিয়ে কাহিনি অগ্রসর হতে থাকে এবং এই ধারাবাহিকতা শেষাবধি বজায় থাকে। শুরুতেই কিছুটা আধিঘােরের সৃষ্টি করা হয় কেন্দ্রীয় চরিত্রের উন্নমিত অবস্থাকে বােঝানাের জন্যে, মেঘ-জোছনা মিলেমিশে কিংবদন্তির উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় আর জালালুদ্দিন রিজভী ঠোঁটের ডান কোণে আলাে এনে দেহত্যাগ করেন। ঠোঁটের কোণের আলাে বা অস্ফুট হাসি, এটা একটি বিশ্ববিখ্যাত গল্পের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আর তাহলাে তস্তোয়ের ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু যেখানে মৃত্যুর পর ইভান ইলিচের শব দেখে পিওত্র ইভানবিচের মনে হয়, আরও একটা জিনিস রয়েছে মুখের ভাবে? জীবিতদের প্রতি ভসনা বা হুসিয়ারি।' এটা আসলে নিজের প্রতি নিজেরই বিদ্রুপ যেন যা ইঙ্গিতধর্মী। প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুতে যেখানে দেহসমেত সবকিছুরও কবর হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে রিজভী বেঁচে ওঠেন এবং মুখােমুখি হতে থাকেন তার জীবিতকালীনসময়ে মাটিচাপাপড়া একটি ঘটনা, একান্তভাবে সংঘটিত একটি বিষয়ের কারণে। এই অতীত-বাস্তবতার ছিদ্রান্বেষণের মাধ্যমেই উপন্যাসটির 'flowering the art' উপস্থাপিত হয়। আবার যে বাতাবরণের মাঝ দিয়ে কাহিনির শুরু হয়, একই বাতাবরণেই তা শেষ হয়। পিতার দেবত্বারােপিত ইমেজের ওপর কামান দাগানাের যে অবদমিত বাসনা পুত্রকে তাড়িত করেছে আগাগোড়া পুরাে উপন্যাসে, শেষ পর্বে যেন তারই দার্শনিক কারণকে উন্মোচন করা হয়:

[...] মানুষকে ধোঁয়ার ভেতরই হাঁটতে হয়। পথ করে। সে যদি চায়, সেও পারে, ধোয়ার

কুণ্ডলীর ভেতর দিয়েই পারে।

[পৃ. ]

এখানে জীবন-দর্শন একধরনের ইমেজের মাত্রা পেয়ে যায়।

ভাষা ও বিন্যাসে উপন্যাসটি সরল গােছের, অনেকটা মনােফ্রনিক। হয়তাে এটা তার অবলম্বনও। কিন্তু অনুসঙ্গ হিসেবে এসেছে সামাজিক নানা নিবন্ধন। একটি চরিত্র ছাড়া। আর-সবও সরল, তবে দুটি চরিত্রের রয়েছে ইদারাসম গভীরতা। আখ্যানটির বিষয়ও স্বাভাবিক গােছের। আধুনিক উপন্যাসে বিষয় অপেক্ষা বিন্যাস গুরুত্ব পেয়ে থাকে। শুধুমাত্র বিন্যাসের ওপর ভর করেও অসাধারণ লেখা হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে, ও বাংলা সাহিত্যে। এক্ষেত্রে উপন্যাসটির বিন্যাস সরল হলেও সুগঠিত, আঁটসাট। কাহিনিতে কিছুটা আকস্মিকতা রয়েছে, ঘুরপথে অন্বেষণের উপস্থিতি রয়েছে। ভাষার উদ্ভাসন তেমন নেই, অ্যালিগরিও তেমন নেই, কিন্তু এপিগ্রামসুলভ অংশ আছে কিছু।

8.

ডিভেলাপমেন্টাল সাইকালজির একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলাে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে যৌনতা পরিবর্তিত হয় এবং কী কী বিষয় তাতে অবদান রাখে। বলা হয়, পুরুষের যৌনসক্রিয়তা আশি-নব্বই পর্যন্ত অটুট থাকতে পারে। এই দীর্ঘমেয়াদি যৌনসক্রিয়কালে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নানাভাবে আবির্ভূত হয়, অথবা যৌনতাকে নবায়িত করার জন্যে। প্রয়ােজন হয়ে পড়ে তার, এবং এর সাধারণ দুটি রূপ হলাে প্যাডােফিলিয়া ও প্যারাফেলিয়া। কিন্তু এই পরিক্রমায় সেজুয়াল রিপ্রেশন ও সেক্সুয়াল লিবারেশন পাশাপাশি চলতে থাকে। কখনাে কখনাে প্রথমটির কারণ হিসেবে দ্বিতীয়টি দেখা দেয়। আলােচ্য উপন্যাসেও বয়স্কের এই অবদমন ও উৎসার কেন্দ্রীয় চরিত্রের মাঝ দিয়ে অপ্রত্যক্ষে ফুটকি তোলে।

মৃত রিজভীর মধ্যে যে মানবীয় সামান্যতার উপস্থিতি, তাকে নিয়েই এক ইনকারনেশন-এ রূপায়িত হয় তার জীবন, জীবনে ও মৃত্যুতে। তার ছেলে কামরান এই দেবত্বারােপিত সত্তার বিমােক্ষণ চেয়েছে স্বীয় মনস্তত্ত্ব থেকে এবং তা হয়েছেও রিজভীর ফুলের মতাে পবিত্র মানুষের সম্বন্ধে সন্দেহ ও প্রতীতি সৃষ্টির মাধ্যমে। একটা বিষয় পরিষ্কার, বয়স্ক মানুষের কম-বয়সি মেয়েমানুষের প্রতি যে-প্যারাফিলিক আকর্ষণ, তা সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি রিজভীর জীবনে, বরং অসমীচীন উপায়ে পূর্ণ হয়েছে কাজের মেয়েকে অতিগােপনীয় ভাবে ভােগ করার মাধ্যমে। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের, এই ভােগ যেন কুসুম নামের কাজের মেয়েটিকে এক আইডেন্টিফিকেশনও দেয় যা প্রকাশিত হয় তার মুখ দিয়েই;

... কুসুম জানিয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে বলে তার জীবনে কিছু ঘটেনি। তার ছেলে তার ভালবাসার সন্তান। মৃত জালালুদ্দিন রিজভীর ঔরসে তার জন্ম।

[পৃ. ৯৭]

কুসুম তার জীবনে ঘটে যাওয়া এই গােপন যৌনতাকে অভিঙ্গামণ্ডিত করে আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষায়, বা প্রয়ােজনীয়তায়। তাই সে ছেলের নাম রাখে আরমনি? কামরানের সঙ্গে মিল রেখে।

যেখানে যৌনতা অবদমিত সেখানে এই ধরনের অনুসন্ধিৎসা শুধুমাত্র যৌনতার একটি প্যাটার্নকে আবিস্কার করে মাত্র যা আবার মুক্তগােপন। কিন্তু আমাদের এন্তার সামাজিকতায় তা কি আদৌ কোনাে আণুবীক্ষণিক বা লুক্কায়িত বাস্তবতাকে উপস্থাপন করে এখন আর? সম্ভবত উপন্যাসটির উদ্দেশ্যও তা ছিল না। যদি তা-ই হতাে তাহলে উপন্যাসটি তার অন্তর্গত এন্ট্রোপিকেই উপস্থাপন করত মাত্র। তা যা-ই হােক, উপন্যাসটিকে বলা যায় বয়স্কের যৌনবেদনার এক ধরনের সুড়ঙ্গবীক্ষণ।



লেখক পরিচিতি:
কুমার চক্রবর্তী 


জন্ম ২রা চৈত্র ১৩৭১। কবি-সমালােচক-প্রাবন্ধিক। পেশা-সরকারি কর্মকর্তা।

প্রকাশিত বই : আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত : টোমাস ট্রান্সট্যোমারের কবিতা (১৯৯৬), লগপুস্তকের পাতা (১৯৯৮), আয়না ও প্রতিবিম্ব (২০০৩), নির্বাচিত কবিতা : ইহুদা আমিচাই (২০০৫), সমুদ্র বিষণ্ণতা ও অলীক বাতিঘর (২০০৭), পাখিদের নির্মিত সঁকো (২০১০), [কবিতা]; ভাবনাবিন্দু (২০০২), ভাবনা ও নির্মিতি (২০০৪), মাত্রামানব ও ইচ্ছামৃত্যুর কথকতা (২০০৫), হুমায়ুন আজাদ: মৃতদের সমান অভিজ্ঞ (২০০৯), শূন্যপ্রতীক্ষার ওতপ্রােতে আমি আছি ইউলিসিস (২০০৯)[প্রবন্ধ)।
 

বইয়ের জগৎ, ষষ্ঠ সংকলন, ফেব্রুয়ারি ২০১১|



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ