মানসী মন্ডল'এর তিনটি গল্প

১. 
ক্লীপ
------------------ 
একটা শ্যাম্পুর বোতলের সঙ্গে ছোট একটা প্যাকেট ফ্রি তে দিলেন দোকানদার ভদ্রলোক। । হ্যাঁ, শ্যাম্পুর সঙ্গে একদম বিনামূল্যে। হাতে নিয়ে দেখি ছোট্ট একটা চৌকো বাক্সে পাশাপাশি সাজানো দুটো গোল্ডপ্লেটেড ক্লীপ। সুন্দর কারুকাজ করা, সোনালি রঙ। ক্লীপের সঙ্গে তারার মত দুটো ফুলও ঝুলছে। খুব পছন্দ হলো। এই ক্লীপ এই বয়সে? তাই ভাবলাম কোনো বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে দেব। পরমুহূর্তে একটা ছবি ভেসে এলো। হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম ক্লীপ দুটো।

তখন কত আর ওই বছর আট কি নয়। একটা দূর সম্পর্কের পিসির বিয়েতে এক গ্রামে গেছি। আর এক পিসির মেয়েও এসেছে। বছর দুয়েকের বড়।ওরা শহরে থাকে আর আমি গ্রামে। মিঠুদি দেখতে খুব সুন্দর। শহুরে আদবকায়দা ।খুব ভাব হয়েছে ওর সঙ্গে।

বিয়ের দিন দুপুরে দেখি একটা ঘরে মাটির কুলুঙ্গি তে রাখা দুটো সোনালি রঙের ক্লীপ। কী সুন্দর কারুকাজ! আর তার থেকে ছোট্ট ছোট্ট ফুল ঝুলছে।এত সুন্দর ক্লীপ! আগে কখনো দেখিনি।
 
দেখছি আর ভাবছি যদি মিঠুদিকে বলি, এই ক্লীপদুটো আজ রাতে পরতে দেবে আমায়। তক্ষুণি কোথা থেকে এসে ক্লীপদুটো ছিনিয়ে নিল মিঠুদি। ব্যঙ্গ করে বলল, ক্লীপ পরার শখ হলে বাবাকে বলো কিনে দেবে। আমার ক্লীপে হাত দিও না।

বাবাকে বলব ক্লীপের কথা? অসম্ভব। কী ভাববেন বাবা! পড়াশোনায় মন নেই, সাজগোজে মন? ঠাকুমাকে তবুও বলা যায়। মাকেও না। চাই না আমার ক্লীপ। বাবা মানেই তো সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসা। অঙ্ক, ইংরেজি। কঠিন কঠিন অঙ্ক পারলে বাবার বাহ্ বাহ্ বলে প্রশংসা। এর মাঝে কোথাও কোনো ক্লীপ, চুড়ি কিচ্ছু নেই। মা মানে যৌথ সংসারে তিনবেলা রান্না। পরপর তিন মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে অপরাধী একটা মানুষ। তিন মেয়ের বিয়ে, খরচ অনেক টাকা। সেখানে ক্লীপের মত সামান্য বস্তুতে অপচয়ের কোনো অর্থ হয়?বাবাকে অনেক টাকা জমাতে হবে। সেই বয়সেই বুঝে গেছি এসব। কাউকে বলিনি ক্লীপের কথা। তখন শুধু একটাই লক্ষ্য পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে হবে। ছেলেদের মত অনেক টাকা রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আজ যা কিছু হারাচ্ছি সব ফিরে আসবে সুদে আসলে দ্বিগুণ হয়ে।

বাড়ি ফিরে দাঁড়ালাম ঝকঝকে মেহগিনি কাঠের তৈরি ড্রেসিংটেবিলের সামনে। ক্লীপ দুটো চুলে ।আয়নায় কাকে দেখছি? আর কাকেইবা খুঁজছি আমি? সে তো নেই কোথাও।তাহলে যা হারিয়েছি তা হারিয়েছিই । হারিয়েছি অনেকটা সময়।আমার জীবন আমাকে সুদে আসলে ভরিয়ে দিয়েছে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে। সুদ দেয় নি সময়। 


২. 
একটি অন্ধ মেয়ে, প্ল্যাটফর্ম আর কিছু প্রশ্নচিহ্ন 
---------------------------------------
"আমার হাতটা ধরে কেউ স্টেশনে নিয়ে যাবেন ? আমি চোখে দেখতে পাইনা।"

বাস থেকে নেমে হাঁটার জন্য সবেমাত্র পা বাড়িয়েছি। নির্দিষ্ট স্টপেজের বেশ খানিকটা আগেই বাসটা পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়েছে। তেল নেবে। কাছেই রেল স্টেশন। যারা স্টেশন স্টপেজে নামবে তারা সবাই নেমে যাচ্ছে। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। বাড়ি ফেরার তাড়া ।
 
আমিও দরজার দিকে পা বাড়াই।পিছু ফিরে তাকাই। বছর বাইশ - তেইশের একটি অন্ধ মেয়ে।

পেট্রোল পাম্পের বড় উঠোন। তারপর সামনে চওড়া পিচের রাস্তা। অনবরত বাস, লরি সাঁ সাঁ করে ছুটছে। ওকে রাস্তা পার করিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে নিরাপদ দূরত্বে এনে ওর হাত ধরে ওর পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছি। ও ওর গল্প বলছে আমাকে। আমি শুনছি আর দেখছি ওকে। পরনে পরিষ্কার সস্তা একটা নাইটি। পাতলা অল্প একটু চুল তেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চাপা গায়ের রং। খুব একটা লম্বা নয় ।

--তুমি পায়ে চটি পরো না কেন? তোমার চটি নেই?
 
--পায়ের তলায় চটি থাকলে কোথায় গর্ত, কোনখান উঁচু কোনখান নীচু বুঝতে পারব না, দিদি। তাই পরি না।
 
--কোথায় গর্ত আছে তুমি আগাম বুঝতে পারো?

--আমি কি পারি? আমার পা পারে। আনজাদ করে করে বোঝে।
 
তারাহীন আধখোলা দুটো সাদা চোখ, যা ওর জীবনের মানে বদলে দিয়েছে। ওদের ঘরে ওর বয়সী মেয়েরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘোর সংসারী।

ওর গল্প শুনছি আর এগিয়ে যাচ্ছি প্ল্যাটফর্মের দিকে। আলো ফুরিয়ে আসছে দিনের। সন্ধ্যার পূর্বাভাস। ঘরে ফেরার তাড়া সবার। মেয়েটিও ফিরছে তার প্ল্যাটফর্মের ঘরে। গত দুদিন সে ঘুরতে গেছিল কোন এক দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ি।তাঁরা ওকে মাছভাত খাইয়ে হাতে কিছু টাকা দিয়ে আবার স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এমনিতে রোজদিন ভিক্ষা করে আর রাতে জি আর পি অফিসের সামনে শুয়ে থাকে। হ্যাঁ, রাতে জি আর পি অফিসের সামনেই শুয়ে থাকে। খুব ছোটবেলায় বাবা, মা মারা যান।একে তো মেয়ে তার উপর অন্ধ। গায়ে গতরে খাটতেও পারবে না। আত্মীয়েরা কেউ সেভাবে ওর দায়িত্ব নেয় নি। তাই ও নিজেই বুদ্ধি করে স্টেশনে চলে এসেছে সেই শিশুকালে । চেয়ে চিন্তে খেয়ে আজ ও এত বড়। এক পরিপূর্ণ নারী। ওর বালিকাবেলা, বয়ঃসন্ধি সব নিশ্চয়ই এসেছে ট্রেনের টাইমটেবিলের মতো সময় মিলিয়ে। এসেছে প্রথম মেয়ে হওয়ার লক্ষণ। কে জানে কী করে সামলেছে সেসব। গল্প অনেক, সময় কম ।তার আগেই পথ ফুরোলো।প্ল্যাটফর্মে উঠে একটা চপ মুড়ির প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দিলাম।

এরকম হাত আগে কখনো স্পর্শ করিনি, চেপেও ধরিনি হাতের মুঠোয়। নিরাপদে রাস্তা পার করে এনে ওর ঘরের কাছে ছেড়ে দিলাম। তখন সন্ধ্যা নামছে শহরের বুকে। এমন সন্ধ্যা রোজ নামে কাঠুয়ায়, দিল্লিতে, কামদুনি তে। 

এখন আমার শূন্য হাতের মুঠোয় অনেক অনেক প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে আমি ফিরছি আমার ঘরে।



৩.
এক বাদুলে গল্পকথা / এক বাদলদিনের গল্পকথা
----------------------------------------------------

মৃতদেহ এখনও এসে পৌঁছয়নি। ভেবেছিলাম একবার চোখের দেখা দেখেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

শ্মশান থেকে কয়েক পা এগোলেই গঙ্গার স্নানঘাট। সিঁড়ি যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানে একটা সুন্দর সিমেন্টের তোরণ। তারপর ধাপে ধাপে অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে জলের গভীরে যেভাবে একটা একটা করে দিন পার করে মানুষ পৌঁছে যায় মৃত্যুর মুখোমুখি । সিঁড়ির দুপাশে সিমেন্টের বেঞ্চ। একটু দূরে একপাশে একটা ঝোপালো গাছ। সেই গাছের নীচে দুটো বেঞ্চ। সামনের বেঞ্চে একটি ছেলে গঙ্গার জলের উপর দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে বসে।বয়স একুশ কি বাইশ। গলায় গামছা। পিছনের বেঞ্চে আমি এসে বসি ।তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সিঁড়ির ওপাশে বেঞ্চে মা, বাবা, আরো কিছু আত্মীয়স্বজন। সবাই একবার শেষ দেখা দেখতে এসেছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। দাদুর কথা, নিজেদের সংসারের কথা। কান্নাকাটি তেমন নেই, খুব স্বাভাবিক একটা পরিবেশ।

আত্মীয়পরিজন, বাড়ির লোক সবাই জানতেন যেকোনো দিন দাদু মারা যাবেন। বছর দুয়েক আগেই ধরা পড়েছে রোগ। কিডনী আর প্রস্টেটের সমস্যা। আশির উপর বয়স। তাই ডাক্তারবাবুরা অপারেশনের ঝুঁকি নিতে চান নি। ওষুধ আর ক্যাথিটার। প্রথমদিকটায় বেশ ভালোই ছিলেন। শুধুমাত্র সবসময় ইউরিন ব্যাগটা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে হতো এই যা। দাদুর অসুস্থতার খবর পেয়ে দফায় দফায় আত্মীয়পরিজন এসে দেখে গেলেন। আমিও গেলাম দেখতে।তখন প্রথম ডিসেম্বর। অল্প ঠাণ্ডা দাদু বেশ ভালোই আছেন। দাদু বেশিরভাগ সময় চেয়ারে নিয়ে উঠোনে রোদে বসে থাকেন। চেয়ারের পাশে ঝোলে ইউরিন ব্যাগ। উঠোনে বসেই দুচারজন মামাতো ভাইবোনের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। সমীরদা বলল, আরে জানিস সবাই তোর দাদুর জন্য কী বলছে?
সমীরদা খুব ফচকেটাইপ ।হাসি মজায় আসর মাতিয়ে রাখে। খুব আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করি , কী বলছে?
বাদল মোড়ল খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়েছে।
হা হা করে ফেটে পড়ি হাসিতে। দাদুও যোগ দেন।
দাদু রোগটাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। দিদিমা বললেন, বুড়োর খুব মাংস মাংস বাই হয়েছে। মাংস ছাড়া কিছুই রুচছে না মুখে। সমীরদা চোখ টিপে আবার বলল, তোর দাদু পরের জন্মে কী হয়ে জন্মাবে জিজ্ঞেস কর।
কী হয়ে গো? খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি।
দাদু ফোঁকলা দাঁতে মিটিমিটি হেসে বললেন, খটাশ।
মামাবাড়ির ওদিকে বড় বড় বনবেড়ালকে খটাশ বলে। মাঠে, ঝোপঝাড়ে থাকে। মাঝে মাঝে লোকালয়ে এসে হাঁস মুরগি ধরে নিয়ে যায়।
মাংস খেতে চাইলে তোর দিদিমা শুধু মুখনাড়া দেয়। বলে বুড়ো মরতে বসেছে তাও নোলা দ্যাখো। খটাশ হলে নিজেই হাঁস, মুরগি ধরে ধরে খেতে পারব।

আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি হলেও হতে পারে।
ছোটমামাকে ফোন করলাম । ওদের শ্মশানে পৌঁছতে এখনও ঘন্টাদেড়েক ।কীর্ণাহারে বাজারে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। সবাই চপ মুড়ি খাচ্ছে। তাছাড়া রান্নার জন্য বাজারে কেনাকাটাও করা হচ্ছে। মদ, খাসির মাংস। শ্মশানের পাশেই রান্না করার জন্য ঘর বানানো আছে। সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যায়। বৃষ্টি নামবে যেকোন সময়।জরুরি কাজ ফেলে এসেছি। ভেতর ভেতর অস্থিরতা টের পাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু এই মুহূর্তে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায়ও নেই।

গঙ্গার ঘাটে হৈ হল্লা। দাহ করাতে নিয়ে আসা একদল লোক নেমেছে গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে। ওদের বোধহয় দাহকাজ শেষ হয়েছে। কারো পা মাটিতে ঠিক ভাবে পড়ছে না। টলমল। গ্রাম থেকে অনেকে শুধুমাত্র মদের লোভেই আসে শ্মশানযাত্রী হয়ে। সবাই জলে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়েছে। কেউ কেউ ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে। তাতে কারো কোনো হেলদোল নেই। দলের সবাই বোধহয় সাঁতার জানে। বর্ষার গঙ্গা। ঘোলাটে জল। তবে এখনও ততটা ভরাট হয়ে ওঠে নি। শ্মশানযাত্রীরা ছাড়াও আরও কিছু সাধারণ মানুষ নেমেছে স্নান করতে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে গঙ্গা স্নান করতে। গঙ্গাস্নান করে গামছায় চপ মুড়ি, ঘুগনি মাখিয়ে খায় ।ঘাটের লাগোয়া বাজার। মিষ্টির দোকান। পেতলকাঁসার পুজোর সামগ্রীর দোকান।শাঁখাপলার দোকান । মেয়েরা হাতে নতুন শাঁখা পড়ে, আলতা, সিঁদুর কেনে। দিদিমা কী করছে কে জানে। যদিও মানসিক প্রস্তুতি ছিল তবুও এতকালের সঙ্গী। একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি দুজনের।একসঙ্গে বড় হয়েছে দুজনে। অবিশ্বাস্য হলেও আমার মামাবাড়ি আর মায়ের মামাবাড়ি পাশাপাশি দুটো বাড়ি, একটাই পাঁচিল।

মা আর বাকি আত্মীয়রা বেশ গল্প করেই যাচ্ছে।মাকে চোখ মুছতেও দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। বাবা একজন চা ওয়ালাকে ধরে এনেছেন। ওদের চা দিচ্ছে। এক কাপ চা আমিও নিলাম। এখানে বসে শ্মশান দেখা যায় না। মাঝে শ্মশানযাত্রীদের জন্য বানানো খড়ের চালের মাটির রান্নাঘরের আড়াল। চালাঘরগুলোর এপাশে রোজকার স্বাভাবিক জীবন। উত্তর দিকের হাওয়ায় মাঝে মাঝে মানুষপোড়ার চিমসে গন্ধ নাকে আসছে। মনে পড়িয়ে দিচ্ছে শ্মশান খুব কাছেই।

উঠে আয়, রান্না হয়ে গেছে, খেয়ে নিবি ।
চমকে পিছনে তাকাই। না আমাদের কেউ নয়। একজন প্রবীণ মানুষ। পরনে কাছা।
সামনে বসে থাকা ছেলেটি যেভাবে বসেছিল সেভাবেই কোনদিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল,
তোমরা খেয়ে নাও, খিদে নেই আমার।
অল্প করে খেয়ে যা। আর বেশি দেরি নেই দাহ হতে।
বললাম তো, ভালো লাগছে না ।

বাদল মোড়ল নামটা ছাড়াও দাদুর একটা ভালো নাম ছিল। শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্র নাথ মণ্ডল নামটার সঙ্গে পরিচয় খাম আর পোস্টকার্ড থেকে।
শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্র নাথ মণ্ডল
গ্রাম মুইতিন
পোস্ট বালিগুনি
জেলা বীরভূম

মামাবাড়িতে যেসব চিঠি আসত গোঁজা থাকত করোগেটের চালের নীচে কাঠের সাঙার ফাঁকে। সেইসব চিঠির ঠিকানায় ওই নামটাই থাকত। তখন বোঝা গেল দাদুর একটা ভালো নাম আছে আর সেটা বেশ কঠিন। তিন বর্ণের যুক্তাক্ষর ন, দ আর র ফলা। প্রাইমারি স্কুলে বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ পড়ার সময় মাঝে মাঝে মনে পড়ত নামটা। মনে মনে একবার ঝালিয়ে নিতাম। মাসুকে চিঠি লিখতে হলে এই নামের বানান মনে রাখা খুব জরুরি।তখনও পালিতপুর থেকে বাসাপাড়া, খুজুটিপাড়া হয়ে নানুর যাওয়ার শর্টকাট বাসরাস্তা চালু হয় নি। কাজ শুরু হয়েছে। সেইসময় পালিতপুর থেকে নানুর যেতে হলে বোলপুর হয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে নানুর যেতে হত।দাদু বাসে না এসে সাইকেল নিয়ে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। ফেরার সময় সাইকেলের সামনের রডে গামছা বাঁধা হল। তারপর বসলাম আমি। চললাম মামাবাড়ি। তখন আমার বয়স বছর ছয়েক হবে। অতটা রাস্তা সাইকেলের রডে বসে বসে ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। দাদু গামছা খুলে ক্যারিয়ারে বাঁধছেন। ক্যারিয়ারে বসেও একই অবস্থা। মাটির উঁচু নীচু, এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। সাইকেল লাফাতেই থাকছে। আমি রেগে গিয়ে দোষ দিচ্ছি দাদুকে।
বুড়ো ড্রাইভার, ঠিক করে সাইকেল চালাতেও পারো না।

এই তো আর চলে এসেছি। ওই যে বন্দরের পাশ দিয়ে ভুরভুরের ডাঙা দেখা যাচ্ছে। ওই তো। ওই তো।

অনেক অনেক দূরে ধোঁয়া ধোঁয়া গাছ। বোঝা যায় কি যায় না। মাসুর মুখটা মনে পড়লেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে । আর সাইকেলে চাপার যণ্ত্রণার কথা মনে থাকছে না।

একটা ট্রাক্টর আর একটা লরি এসে দাঁড়াল। বাবা ডাকলেন উঠে আয় এসে গেছে। ট্রাক্টর থেকে মৃতদেহ নামছে। পিছনের লরি থেকে নামছে মানুষের ঢল। বড় বড় মাংসের ডেকচি, চালের বস্তা, দামি হুইস্কির পেটির পর পেটি। সুখের মড়া ।তার উপর বাদল মোড়ল পয়সাওয়ালা মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে গ্রামের মানুষের এটুকু দাবি থাকবে না? পেয়ারাওয়ালার সমস্ত পেয়ারা নুন লঙ্কা সমেত চলে গেল পেটির সঙ্গে।

বাঁশের খাটিয়া রাখা হয়েছে শ্মশানের উঠোনে।দাদুকে পরানো হয়েছে গিলে করা তসরের পাঞ্জাবি। কপালে চন্দনের ফোঁটা। গলায় রজনীগন্ধার মালা। শরীরের খাঁচাটা এখনও বেশ বড়সড়।একসময় যে সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়। দু বছর রোগে ভুগে শরীর শীর্ণ। ফোঁকলা দাঁতের গালদুটো আরো খানিকটা চুপসে গেছে। দাদু বলেছিলেন , পরের জন্মে খটাস হবে। মা বসে আছে পায়ের কাছে। বিড়বিড় করে বলছে কিছু। বড় মামা স্নান করে এসেছেন। মুখাগ্নি হবে। মামাদের ছেলেরা সব মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে রেডি। পুরোটাই লাইভ অথবা রেকর্ডিং হবে।

শ্মশান থেকে সরে এসে আবার গঙ্গা ঘাটের পাশে বেঞ্চটায় বসি। ছেলেটা এখনও থম মেরে বসেই আছে। এখানে বসে থাকতে বেশ লাগছে। গঙ্গা বয়ে চলেছে নিজের খেয়ালে। কে জানে কতকাল। আর একটু দক্ষিণে এগিয়ে অজয় এসে ভাগিরথীতে মিশেছে ।অজয়ের নীল জলস্থি ভেসে যাচ্ছে গঙ্গার বুকে। এক নদী বুকের গভীরে টেনে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর এক নদীকে, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না।
 
আকাশে মেঘ জমেছে আরো খানিকটা। একটা ঠান্ডা বাদুলে বাতাস ভেসে আসছে গঙ্গার জলের উপর দিয়ে। বাদল মানে তো বর্ষা। আচ্ছা দাদুর জন্মও কি বর্ষাকালে? তাই কি নাম বাদল? কে রেখেছিল নাম? দাদুর একজন ধর্ম মা ছিলেন। জাতিতে হাঁড়ি।দাদুর মামাবাড়ির পাশের গ্রামের বৌ। দাদু তখনও হাঁটতে শেখেনি দাদুর মা বাপেরবাড়ি যাচ্ছিলেন। দাদুর জন্মের পর থেকেই অসুখে ভুগছিলেন। অসুস্থ মানুষ। দাদুকে অনেকক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। বাপেরবাড়ির পথে নদী পড়ে। নৌকায় ওঠার সময় মাথা টলছিল। নৌকায় এক সধবা যাত্রীকে দেখে কোলের ছেলেকে বাড়িয়ে দিলেন সামনে।
"আমার ছেলেটা একটু ধরবে গো, আমার মাথা খুব ঘুরছে।"

হাঁড়িদের মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে দুহাত বাড়িয়ে দাদুকে বুকে তুলে নিলেন। দাদুর মা বললেন, "এই যে তুমি আমার ছেলেকে ধরলে, আজ থেকে তুমি ওর ধর্ম মা, আর আমার সই। বাকি রাস্তা সেই মেয়ে দাদুকে আর কোল থেকে নামান নি। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদুটি পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে চলল। তারপর অনেক গল্প স্বল্প হল দুই মায়ের। দাদু যত বড় হতে লাগল দাদুর মায়ের অসুখ তত বাড়তেই থাকল। একসময় দাদুর মা হয়তো বুঝতে পারছিলেন তিনি বোধহয় আর বাঁচবেন না। কোলের শিশুর চিন্তায় অস্থির। শাশুড়ি অনেক আগেই গত। বাড়িতে কোন জা ননদ নেই। কে দেখবে ছেলেকে। হঠাৎ মনে পড়ল সেই ধর্ম মায়ের কথা। লোক মারফত খবর পাঠানো হল। ধর্ম মা এলেন। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন বাদলকে। হাঁড়িদের ছেলেমেয়ের সঙ্গেই মানুষ হবে সদগোপের ছেলে বাদল। যতদিন না সে বড় হয় বা তার মা সুস্থ হয় সে ওদের সঙ্গেই বড় হবে। আনুষঙ্গিক সব খরচ যাবে এবাড়ি থেকে। ধম্মোমা নিয়ে যাচ্ছেন বাদলকে। ছেলের মায়ায় অসুস্থ শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে ধম্মোমায়ের পিছন পিছন যাচ্ছেন বাদলের জন্মদাত্রী। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা বটগাছ। তার তলায় এসে বসলেন দুজন। শেষবারের মত বুকের দুধ খাইয়ে ধম্মোমায়ের কোলে তুলে দিলেন। ঘুমিয়ে পড়েছে বাদল। ধম্মোমা বাদলকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন মাঠ ছাড়িয়ে তাঁর গ্রামের দিকে। দাদুর মা সারাদিন পড়ে রইলেন গাছতলায়। বাড়ি ফিরে একমাস পেরোয় নি।

বাবা ডাকছেন। বাড়ি ফিরতে হবে। ওদিকে দাহকাজ শুরু হয়েছে । শরীর পুড়ছে আর পুড়ছে তাকে ঘিরে যত গল্পকথা। গঙ্গার ঘাটে নেমে মাথায় জল ছেটালাম। সামনের মিষ্টির দোকানের সব মিষ্টি আজ আমাদের। সব মিষ্টি কিনে নেওয়া হয়েছে। শ্মশানে এলে মিষ্টিমুখ করতেই হয়। সবাই যে যার পছন্দ মত মিষ্টি খাচ্ছে। ওদিকে রান্না চালায় রান্না হচ্ছে খাসির মাংস আর ভাত। রীতিমত ভোজের আয়োজন। মামাবাড়ির গ্রামের মানুষজন মাংস ভাত খেয়ে ফিরবেন।আমাকেও বলছেন মাংস ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য। আমার ফেরার তাড়া। হঠাৎ খেয়াল হল জলের বোতল ফেলে এসেছি গাছতলায় বেঞ্চে। গিয়ে দেখি ছেলেটি তখনও বসে। জলের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । প্রিয়জনের মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে তাকে। যেন শ্মশানের সবার সব শোকের ভার একাই তুলে নিয়েছে তার বুকে ।আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর নিঃশব্দে জলের বোতল নিয়ে সরে আসি। বাড়ি ফেরার তাড়া। ঠিক তক্ষুণি আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। গঙ্গার জলের বুকে রাশি রাশি বৃষ্টি ফোঁটা।


লেখক পরিচিতি
মানসী মন্ডল
বাংলায় স্নাতকোত্তর।
পেশায় শিক্ষক। গল্পকার। 
বাড়ি - পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এই গল্পকারের সামান্যকে অসামান্য করার ক্ষমতা আছে।

    উত্তরমুছুন
  2. Prothom duti ageo pora ,bhalo legechhilo ,,sesher ti ke upekkha kore chole jabar shakti karor nei ,amaro na , sutorang sahaj satyo ke aro sahaje moner moddhe genthe nilam !

    উত্তরমুছুন
  3. এক বাদুলে গল্পকথা... অশেষ মুগ্ধতা... প্রিয় কথাকার!

    উত্তরমুছুন