ওয়াসি আহমদের ‘ তলকুঠুরির গান’ : হারানো ইতিহাসের উন্মোচন




রুখসানা কাজল

ব্যক্তিগতভাবে খুবই নীরব কিন্তু একশ্রেণীর পাঠকপ্রিয় গল্পকার এবং কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের, ‘তলকুঠুরির গান’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমি বর্তমান সময়কে হাতে রেখে পেছনে হেঁটে গেছি। সময়ের হিসেব গুনেছি বেশ কয়েকবার । আর চমৎকৃত হয়ে দেখেছি এ উপন্যাসের আখ্যান জুড়ে যে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে রয়েছে তা ঘটেছিল মাত্র সত্তর বাহাত্তর বছর আগে।
সময়টি নাতিদীর্ঘ বটে।

১৮ আগস্ট ১৯৪৯ সাল। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর আর উলুউরী গ্রামের মধ্যে সুনাই নদীর তীর। প্রতিপক্ষ দুটি দল। একটি দলে ভুখা নাঙ্গা অত্যাচারিত নানকারগণ। অস্ত্র বলতে দেশিয় বর্শা, বইঠা, সড়কি লাঠি রামদা । সম্বল বলতে শত শত বছরের পুঞ্জীভূত বঞ্চনা থেকে মুক্ত হওয়ার অর্জিত আত্মশক্তি । আর সাথে থেকে তাদের সংগঠিত করে দেওয়া কমিউনিস্ট পার্টির অকুন্ঠ সমর্থন, সাহস, অণুপ্রেরণা এবং সরাসরি সাহায্য ও অংশগ্রহন । অন্যপক্ষে পাকিস্তান সরকারের আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পুলিশ ইপিআর বাহিনীসহ জমিদার ও মারিশদলের ঠ্যাঙাড়ে লাঠিয়াল বাহিনী। সম্বল সামন্তান্ত্রিক শোষকের ক্রোধ, ঘৃণা, অধিকার হারানোর ভয়ে নিষ্ঠুর দমননীতির দানবতা।

দুর্বলের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সুনাইয়ের তীর। সেই রক্তে রচিত হয়েছিল নানকার দ্রোহের ইতিহাস, নানকার বিদ্রোহ । ‘সুনাই গাঙ তোমার কেনে উতলা পানি/ সানেশ্বরের কারবালায় কারা জান দিল-কুরবানি/ কও বন্ধু কও একবার শুনি...।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গণসঙ্গীত শিল্পী।

কিন্তু এ বিদ্রোহের ইতিহাস আমরা কজন জানি ! সময় এবং অই একই সময়ে সংঘটিত অন্যান্য আন্দোলনের চাপে চাপা পড়ে গেছিল নানকার বিদ্রোহ । কিন্তু তাই বা গেল কেনো ? আমরা তেভাগা আন্দোলনের কথা জানি। জানি মা ইলা মিত্রের কথা। হাজংদের টঙ্ক আন্দোলন অজানা নয় আমাদের কাছে। জানি আত্মাহুতি দেওয়া রাশিমনি আর কুমুদিনী হাজংএর নাম। কেন সেভাবে জানিনা বিনা মজুরিতে সবংশে শ্রম দেওয়া ভুখা নাঙা শোষিত নানকারদের সম্পর্কে ? কেন জানিনা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে গর্ভস্থ সন্তানহারা নানকার আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পালচৌধুরী সম্পর্কে?

লেখক, গল্পকার উপন্যাসিক ওয়াসি আহমেদ বিস্মৃতির ধূলোজট ছাড়িয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সামন্ত শোষণের ফলে হদবেগারি নানকারদের কীট সদৃশ জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঋণ শোধের রক্ত দিয়ে তিনি রচনা করেছেন লাঞ্ছিত বঞ্চিত, নির্যাতন, অত্যাচারে খুন হয়ে যাওয়া নানকারদের ফুঁসে ওঠা বিদ্রোহের করুণ অথচ সাহসী কাহিনী।

এ বিদ্রোহ কি সহসা ফুঁসে উঠেছিল !

তলকুঠুরীর গান এর সূত্র ধরে জানতে পারি নানকার বিদ্রোহ কোনো সাময়িক ফুঁৎকার নয়। এ বিদ্রোহের আগুনে আঁচ লেগেছিল ১৯২০ বা ২২ সাল থেকে। ঠিক অই সময়ে কংগ্রেসের আহবানে নিখিল ভারত জুড়ে শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল খেলাফত আন্দোলন । তো সময়টা যে নাতিদীর্ঘ দুরত্বের। অই ঢিল ছোঁড়া দুরত্ব সময়ে সংঘটিত অসহযোগ এবং খেলাফত আন্দোলন সম্পর্কে আমরা ব্যাপকভাবে জানি। জানতে হয়েছে। কেননা পাঠ্য বইতে পড়েছি। এখনও ছাত্রছাত্রীদের পড়তে হয়। প্রশ্নপত্রে থাকে। উত্তর না জানলে শূন্য দেওয়া হয়।

কিন্তু ‘নানকার বিদ্রোহ’ সম্পর্কে আমরা তো তেমন কিছু জানি না। সেভাবে জানানোর ব্যবস্থাও নেই। অনেক সময় কৃষক আন্দোলনের সাথে নানকার আন্দোলন সংযোজন হিসেবে আসে। কিন্তু নানকাররা ত কৃষক ছিলেন না। কৃষকদের ক্ষুদ্র হলেও একখন্ড জমি ছিল। তা না থাকলেও লাঙ্গল কিম্বা বলদ ছিল। বর্গা চাষের অধিকার ছিল। এমনকি খরা বা বন্যায় স্থানান্তরে চলে যাওয়ার স্বাধীনতা ছিল। নানকারদের এসব কিছুই ছিল না। এরা ছিল যাবতীয় অধিকারহীন অচ্ছুত হিন্দু মুসলিম জনসম্প্রদায় । যারা বংশ পরম্পরায় আসাম এবং সিলেট অঞ্চলের ছোটবড় মিরাশদার এবং জমিদারদের কেনা গোলাম ছিলেন।

গুণি সাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ, ‘তলকুঠুরীর গান’ লিখে আমাদের জানিয়ে দিলেন বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের একসময়ের প্রচলিত নানকার ব্যবস্থা সম্পর্কে । অনুদ্ঘাটিত এক বঞ্চনার ইতিহাস সিলেটের সুনাই নদীর তীর থেকে আমাদের সামনে এসে পড়ল। সে ইতিহাসের গায়ে রক্তচন্দনের তিলক প্রলেপে লেখা জমিদার আর মিরাশদারদের হাতে শত শত বছর ধরে খুন হয়ে যাওয়া নানকারদের রক্ত আর পাকিস্তানী সরকারের পুলিশের হাতে নিহত বিদ্রোহী নানকারদের রক্তকথা। একই সাথে দক্ষ মুন্সিয়ানায় লেখক যুক্ত করে দিয়েছেন বর্তমান আধুনিক সময়, কর্পোরেট স্লেভারি, মালিক কর্মচারিদের মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, নানকার প্রথা বিলুপ্তির পর নানকারদের দ্বিতীয় প্রজন্ম, যে কিনা এ উপন্যাসের মূল চরিত্র শরীফউদ্দীন নানকারের আত্মবিশ্লেষণ শেষে এটা আবিষ্কার করা যে বাহ্যত সে নানকারি থেকে মুক্ত হলেও আসলে সে একজন কর্পোরেট নানকার । মূলত সে স্বাধীন নয়। আর এ কারণেই তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে একজন প্রতিবাদী নানকারের প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন।

আমার কেন যেন মনে হয়েছে, শরীফউদ্দীন নানকার আসলে এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চেয়েছে যা কিনা চেয়েছিল ‘তলকুঠুরীর গান’ উপন্যাসের কম্যুনিস্ট অজয় ভট এবং তার সঙ্গীরা। যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা লিখে গেছেন মহামতি কার্ল মার্ক্স।

অন্যদিকে তিনি তুলে ধরেছেন বর্তমান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মোড়কে ঢাকা ভোগবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরম হতদরিদ্র অবস্থা থেকে কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে উঠে আসা মুনিরা চরিত্রটিকে । যে কিনা শরীফউদ্দীন নানকারের স্ত্রী এবং তার দু সন্তানের মা। শরীফের আত্মবিশ্লেষণের চরম উত্তেজনা ও বৈকল্যে সতত শঙ্কিত এবং সন্ত্রস্ত্র মুনিরা । অর্জিত স্বচ্ছলতা হারানোর ভয়ে যেমন শঙ্কা আশঙ্কা নিয়ে থাকে কর্পোরেট নির্ভর রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এক চিলতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাও এসেছে উপন্যাসে । সেই সূত্রে এসেছে বুড়ি বিহারী চাচিজীর কথা, যিনি সর্বদা মুনিরাকে বলতেন, ‘চলে যা বেটি, যেদিক চউখ যায় চলে যা, বাঙ্গালি-বিহারির নাফরমানির বহোত লহু এ জমিনে, হিয়াসে নিকাল যা, ভাগ যা।’ ( পৃঃ ৫৯)

ভাগ যা—বললেও সে ভেগে কোথায় যাবে ? মুনিরা জানে, পালিয়ে কোথাও যাওয়া যায় না ! এ বিষয়টি সম্পর্কে সহকর্মী অমিতা গোমেজ মুনিরাকে বলেছিল। মুনিরা তাই মধ্যবিত্তীয় ভয়ে আতঙ্কিত। তীক্ষ্ণ সতর্কতা আর উদ্বিগ্ন মনে সে স্বামি শরীফউদ্দীনকে দেখে যাচ্ছে।

উপন্যাসটি পড়া শেষে প্রশ্ন জাগে, এ ত আমাদের দেশেরই ঘটনা। এ যে জঘন্য মানব পীড়ন। আমাদের কি উচিত ছিল না নানকারদের সম্পর্কে ভাল করে জানার ?

সেই সাথে একটি রাজনৈতিক প্রশ্নও এসে পড়ে, ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ । অথচ এরা কেউই অখন্ড ভারতের আসাম এবং শ্রীহট্টে প্রচলিত এই জঘন্য প্রথার বিপক্ষে সরাসরি নানকারদের পক্ষে এসে দাঁড়াননি ! ইতিহাস বলছে একমাত্র ১৯২০ মতান্তরে ১৯২৫ সালে গঠিত ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি নানকারদের জন্যে কাজ করেছে। বিখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা অজয় ভট্টাচার্যের লেখা ‘নানকার বিদ্রোহ’ নামে একটি বই রয়েছে। তিনি নিজেও ছিলেন নানকার বিদ্রোহের সাথে জড়িত। ‘তলকুঠুরির গান’ উপন্যাসের অজয় ভট হয়ত উনারই ছায়ায় রচিত। কিন্তু অন্যান্য দলগুলো ? কেন তারা নানকারদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি ? কেন ?

নানকারদের কি ভোটাধিকার ছিল ? তবে কী তলস্য তলের নামানুষ ছিল বলেই নানকারদের সম্পর্কে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির কোন আগ্রহ ছিলনা !

বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে ওয়াসি আহমেদ পরিচিত একটি নাম। দুর্দান্ত ছোটগল্প লিখেন। এছাড়া উপন্যাসও রয়েছে অনেকগুলো। চাটুকর সাহিত্য গোষ্ঠীর বাইরে নিরিবিলি তার অবস্থান। পড়ুয়া পাঠক যারা তাদের কাছে তিনি একজন ভালো গল্পকার, লেখক কথা সাহিত্যিক উপন্যাসিক । তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচিতি অনেকদিনের। তাই কেবল পুরস্কার যথেষ্ট নয়। পাঠক হিসেবে কৃতজ্ঞ হই লেখকের কাছে । তিনি এমন একটি নারকীয় প্রথাকে পাঠকের খোলা দরবারে উপস্থাপন করেছেন বলে কমরেড বলে ডাকতে ইচ্ছে করে । আশ্চর্য হয়ে যাই তার সাহসি আর অনুসন্ধানী মনের বিস্তার দেখে। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর একজন দুধেভাতে মানুষ হয়েও তিনি নিরলস প্রচেষ্টায় খুঁজে বের করেছেন তার নিজের জেলা বৃহত্তম সিলেটের এই কদর্য ক্ষত । ক্লাশ সিস্টেমের নিকৃষ্ট অভিশাপকে। সামন্তযুগের দুষ্ট শোষণকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে যা ছিল অজানা অজ্ঞাত। তিনি ‘তলকুঠুরির গান’ লিখে তাদের জানিয়ে দিলেন । আমি, আমরা সুচিন্তিত পাঠক সমাজ শিউরে উঠেছি এ উপন্যাস পড়ে।

কি লিখেছেন তিনি ‘তলকুঠুরীর গান’ উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ?
বৃহত্তর সিলেটে প্রচলিত একটি জঘন্য ও নির্মম প্রথা ছিল নানকার প্রথা ।

‘নানকার’ ফার্সি শব্দ। নান অর্থ রুটি। আর কার হচ্ছে যোগাড়ে। যে মানুষগুলো নানকার ছিল তারা ছিল সিলেট অঞ্চলের ছোট বড় মাপের মিরাশদার এবং জমিদারের চির দাস। এদের নিজস্ব জায়গা জমি ছিলনা। জমিদারের দেওয়া জায়গায় ঘর তুলে থাকত। এদের কাজ ছিল, সারা দিন রাত বিনা মজুরীতে বিনা প্রতিবাদে জমিদারের কাজ করে দিয়ে নিজের জন্য খাবার সংগ্রহ করা । নানকারদের পুরো পরিবারই ছিল মিরাশদার এবং জমিদারদের খেদমতে নিয়োজিত। সামান্য উনিশ কুড়ি হলে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি পেত এরা। জমিদারের অত্যাচারে মৃত্যু হওয়া কোন বিচিত্র ব্যাপার ছিল না নানকারদের কাছে। এমনকি এদের বউ মেয়েদের উপরও মিরাশদার আর জমিদারদের ছিল ভোগের অবাধ অধিকার।

উপন্যাসটি পড়ে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা থেকে আমার মনে উৎসারিত হয়েছে একটি মানস উচ্চারণ, ভাত চাকর।
সাথে সাথেই চমকে মুচড়ে মুখ তুলে উঠেছে আমার কিছু শৈশব স্মৃতি।

হাওয়া খেলানো একটি ছোট বাড়ি। তিনটে নারকেল গাছ, তার সাথে হিলহিলে কয়েকটা সুপারিগাছ, একাত্তরের ক্ষত বুকে নিয়ে একটি আধপোড়া তাল গাছ আর আধকাঁচা একটি ড্রেন পরিস্কার করতে আসত একজন কাঙ্গালকাকু। শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি আর নেংটি পরা লিকলিকে হাত পা। কাজ শেষ হলে গোসল সেরে ইঁদারার বাঁধানো চাতালে বসে ভাত খেতে বসত । সে এক মহা খাওয়া। মাঝে মাঝে পেটে হাত দিয়ে আমাদের বলত, ও মনু দউড়ে দুডে শুগনো মরিচপুড়া আনি দেও দেহি সুনা ।

কখনও কি টাকা দিতে দেখেছি ? মনে ত পড়ে না। পাড়ার কেউই টাকা দিত না। পেটচুক্তি ভাত খেয়ে কিছু নারকেল সুপারি নিয়ে চলে যেত ।

কাঙ্গালকাকু কাজের বিনিময়ে ভাত খেতে পেত কিন্তু স্বাধীন ছিল। সময়টাও ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। কাজ পছন্দ না হলে কাজের বাড়ির মালিক বা মালিকগিন্নী কিছু বললে অনেক সময় মুখের উপর কাঙ্গালকাকু বলে দিত, ইস্যিরে দেও ত কয়ডা ভাত। কাম কি কম করাও তুমরা ? বিড়িডাও কিনি খাতি হয় তা জানো । দুই চার আনা পয়সা ত দিতি পার ! টাহাপয়সা না দিলি আর কিন্তুক কাজ করতি আসপো নানে বড়কা।

নানকারদের জীবন ছিল কাঙ্গালকাকুর জীবনের থেকেও করুণ। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল তারা । অনাগত নানকার শিশুটিও নিয়মের লেখায় মরিশদার আর জমিদারদের ভাতচাকর হয়ে জন্মাত।

আসাম শ্রীহট্ট অঞ্চলে এ প্রথাটি ছিল দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের প্রাচীন।

সে সময়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট, আসামের করিমগঞ্জ জেলা, কাছাড় এবং হাইলাকান্দি পর্যন্ত বিস্তৃত এক সময়ের শ্রীহট্ট। অঞ্চলটি ছিল বৌদ্ধ হিন্দু রাজাদের শাসনে। এরপর চলে আসে মুসলিম নিয়ন্ত্রণে। ঠিক কবে কখন নানকার প্রথার জন্ম হয়েছিল সঠিক তথ্য না থাকলেও জানা যায় সাধারণতঃ নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই ছিল নানকার। কিরান, নম-শূদ্র, মালি, ঢুলি, নাপিত, পাটনিসহ আরও অনেক শ্রেণীর লোকদের নানকার বলা হত। সনাতন হিন্দু ধর্মে যে জাতিগত বৈষম্যরেখা্র সৃষ্টি করেছিল তা ছিল অভেদ্য। ব্রাম্মণদের কাছে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্ম মৃত্যু বেঁচে থাকা না থাকার কোন মূল্য ছিল না। আবার উল্লেখ আছে যে পাঠান মুঘল আমলেও নানকার প্রথা বহাল ছিল। এরা ছিল মুসলিম নানকার। ক্ষমতার কাছে ইসলামের সাম্যতার বাণী অবরুদ্ধ ছিল। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ইসলাম যুগে দাসত্বপ্রথা ছিল বলেই লেখা আছে ।

সিলেট অঞ্চলে স্বল্প ভূ-সম্পত্তির মালিকদের মিরাশদার আর অনেক বেশি জমির মালিককে বড় মিরাশদা বা জমিদার বলা হত। দারিদ্র্যের কশাঘাতে ভূমিহীন অসহায় হয়ে এই ছোটবড় মিরাশদারদের দেওয়া ভূমিতে থাকার বিনিময়ে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিক্রি করে দিয়েছিল নানকাররা । এরা বংশ পরম্পরায় নানকার হয়ে যেত। বিনা প্রতিবাদে ঘাড় গুঁজে মিরাশদারদের কাজ করে যাওয়াই ছিল এদের কর্তব্য। মিরাশদাররা তাদের প্রয়োজন অনুসারে নানকারদের কাজ ভাগ করে দিত। এ কাজে সামান্য ব্যতায় হলেই নেমে আসত অসহ্য নির্যাতন। চাবুক মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া থেকে তক্তাচাপার মত অমানুষিক নিষ্ঠুর উপায়ে অত্যাচার করা হত। নানকার নারী পুরুষের জীবন ত তাঁর নিজের জীবন নয়। সে জীবনে প্রাণ থাকা আর রাখার নিয়ন্ত্রক ছিল মিরাশদার বা ভূমালিকরা। এ উপন্যাস থেকে আমরা আরও একটি প্রথার কথা জানতে পেরেছি। মিরাশদার এবং জমিদাররা তাদের বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নানকারদের অবিবাহিতা দেখতে সুশ্রী সুন্দরী কিশোরি মেয়েদের বাঁদি হিসেবে পাঠিয়ে দিত । সেই যাওয়াই ছিল নানকার মেয়েদের শেষ যাওয়া ।
এরপর ?

সেই সব মেয়েরা পাখি হয়ে হারিয়ে যেত ! তাদের ফিরে পাওয়ার জন্যে মাবাবা ঘর উঠান কাঁদলেও আর কখনও তারা ফিরে আসতে পারত না। এভাবে কাছাকাছি বসতির ডেফলবেওয়ার মেয়ে আজিনা হারিয়ে গেছে বছর কয়েক আগে, আলিমুদ্দির পরির মত মেয়ে রুশনি কোথায় কে জানে ! আর মতিজানের একই বসতির কালাইর মেয়ে তরক্কি চলে গেছে বহু বহুদূরের অজানায়। কাছে-দূরে এমন বসতি পাওয়া যাবে না, সেখান থেকে বাছা –বাছা মেয়েগুলো এভাবে হারিয়ে যায়নি। (পৃষ্ঠা ১২২, তলকুঠুরির গান )

উপন্যাসিক যে পথে পিছু হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলেন নানকার বা ভাত চাকরদের ইতিহাসের সরণিতে আমিও সে পথে হেঁটে আমার মনুষ্যত্বের চেতনায় সপাটে ঝাপট খেয়েছি। সে সময়ের সমগ্র সিলেট অঞ্চলের ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগই ছিল নানকার ! ভাবা যায়!

চমক জেগেছে মনে।

ওয়াসি আহমেদের ‘তলকুঠুরির গান’ পড়তে পড়তে আলেক্স হ্যালির ‘The Roots’ বইটির কাহিনী স্মৃতিতে ঝাঁপিয়ে এসেছে । টেলিভিশনে দী রুটস এর চলচ্চিত্র দেখে প্রতিনিয়ত শিউরে উঠেছি। বার বার ভেবেছি, এভাবে কি মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা উচিত ! ভুতিয়ে গালি দিয়েছি সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের। অথচ তখনও জানতাম না, বাংলাদেশের উত্তর পুর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট জেলায় শত শত বছর ধরে প্রচলিত ছিল আফ্রিকান দাস কুন্তাকিন্তের সহোদর সহোদরা তকবির চান, হারান ধুপি, শুকুর চান, মতিজান, আম্বিয়া, রুশনি কালাই তরক্কিরা।

এ উপন্যাস আমাকে আরও মনে পড়িয়ে দিয়েছে ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’ উপন্যাসের যক্ষা আক্রান্ত সেই তরুণ শ্রমিকের কথা। দমকে দমকে ওঠা রক্তকাশিকে চাপা দিয়ে যে নিলভনা ভ্লাসভকে জানিয়েছিল, আগুন গ্যাস আর ধোঁয়া্ময় এক দমবন্ধ হয়ে আসা অন্ধকার কুঠুরিতে বসে দিনরাত খেটে সে জমিদারের রক্ষিতার জন্যে পেশাবের পাত্র বানিয়ে দিয়েছিল। নিঃশ্বাসের সাথে গ্যাস ঢুকে গেছে ফুসফুসে। এখন মৃত্যুই তার শ্রমিক জীবনের নিয়তি । কতখানি পার্থক্য আছে সিলেটের তক্তাচাপায় নাকে মুখে রক্ত উঠে অসুস্থ হয়ে যাওয়া নানকার তকবির চানের সাথে রাশিয়ার কোন এক গ্রামের লম্পট জমিদারের খেয়ালখুশি মেটাতে এক তরুণ শ্রমিকের বিষাক্ত গ্যাসে ধুঁকে ধুঁকে মরার সাথে ?

যুগে যুগে দেশে দেশে শোষকের চরিত্রের বাহ্যিক রূপান্তর ঘটলেও ভেতরে ভেতরে তারা এক রয়ে গেছে। তাই ত আজকের যুগেও পত্রপত্রিকার পাতা জুড়ে থাকে গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর হাতে নির্যাতিত কর্মসহায়িকাদের আহত ধর্ষিত পুড়িয়ে মারার খবর। কালো বেঁটে লম্বা, শ্যামলা ফর্সা, ছোট বড়, ধার্মিক অধার্মিক, নারী পুরুষ, বাঙ্গালী অবাঙ্গালী সে যে জাত বা রঙেরই হোক না কেন শোষকের চরিত্র একই নিষ্ঠুরতায় গঠিত এবং কলঙ্কিত !

‘তলকুঠুরির গান’ গুমরে উঠেছে আরও একটি কারণে । আমরা আমাদের দেশটাকে কতটুকু জানি ? আশ্চর্যেরও আশ্চর্য ১৯২০- ২২ সাল থেকে চলমান নানকার আন্দোলন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্টের বিদ্রোহে যে ছয় জন নানকার প্রাণ দিয়েছিল কই আমরা ত কখনও তাদের কথা বলিনা ! ওয়াসি আহমেদ তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন তাদের কথা। সেই সাথে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, ১৯৪৬ সালে ঘটে যায় ভয়াবহ হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে অখন্ড ভারত ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা তুলে এনেছেন। দেশভাগের ফলে আসাম হয়ে যায় ভারতের অংশ আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় সিলেট। দেশভাগের ঠিক আগেপরে ১৯৪৬ – ৪৭ সালে জুড়ে সংঘটিত হয়েছিল টঙ্ক বিরোধী হাজং আন্দোলন, ভাগচাষীদের তিন ভাগের দুভাগ ফসলে দাবিতে সংঘটিত হয়েছিল তেভাগা আন্দোলন। পাকিস্তান সরকার নির্মমভাবে গুম, খুন, ধর্ষণ, ধরপাকড় ইত্যাদির মাধ্যমে সে আন্দোলন বন্ধ করেছিল। আর পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে সংঘটিত ‘নানকার বিদ্রোহ’ও সরকার জমিদারদের সাহায্যে নির্মূল করেছিল অকথ্য অত্যাচার, হত্যা, খুন, ধর্ষণ বিতাড়নের মাধ্যমে।

এই সমস্ত আন্দোলনের যুগপৎ ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে নানকার প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। রদ করা হয় জমিদারি প্রথা। আর সরকার বাধ্য হয় নানকার এবং কৃষকদের জমির মালিকানা দিতে।

ওয়াসি আহমেদ সুনিপুনভাবে এ উপন্যাস লিখেছেন। একই সাথে কংগ্রেস এবং মুস্লিম লীগের মধ্যে দেশ ভাগাভাগির সাথে শেরে বাংলার কৃষক- প্রজাপার্টির আন্দোলন সাফল্যের কথাও তুলে এনেছেন। তিনি তার উপন্যাসে সেই সব মায়াবী মানুষদের কথাও বলেছেন যারা ভঙ্গুর, নিপীড়িত, হতাশ মনোবলহীন নানকারদের পাশে থেকে ছায়ার মত সাহস দিয়ে গেছেন। ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’ তলকুঠুরির বড় মিরাশদার সোনামিয়া চৌধুরী, জমিদার পুত্র অমল ভট, আবজল মাস্টার, করিমউল্লারা সমাজের সুবিধাজনক অবস্থান ছেড়ে নেমে এসেছিলেন নানকারদের পাশে। এরাই ত গোকুলে বেড়ে ওঠা নানকার সখা !

ওয়াসি আহমেদ সিলেট আসাম অঞ্চলের যে নির্মম নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথা, নানকর মানুষদের কথা বিস্তারিতভাবে তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন তাতে একটি চলচ্চচিত্র নির্মাণ করা যায়। ভেবে দেখেছি, অসংখ্য চরিত্র, ঘটনা আর দীর্ঘ সময়ব্যাপি ‘দি রুটস’ এবং ‘মা’ উপন্যাস নিয়ে যদি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে পারে, তবে ‘তলকুঠুরির গান’ নিয়েও চলচ্চিত্র হতে পারে ! তাছাড়া বাংলাদেশের আরণ্যক নাট্যগোষ্ঠী ‘নানকারের পালা’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে কিছুটা পথ ত প্রশস্ত করেই রেখেছে। আহা যদি উপযুক্ত, নির্মেদ মানুষ পাওয়া যেত !

সত্য ঘটনার উপর কল্পনার রক্ত মেদ মাংস দিয়ে লেখা হয়েছে ‘তলকুঠুরির গান’। প্রতিটি চরিত্র সচল। পাঠককে ক্লান্ত করতে অহেতুক রং রস রঙ্গ নেই। উপন্যাসের স্থানিক প্রয়োজনে এসেছে আঞ্চলিক ভাষা যা বুঝতে আমপাঠকের অসুবিধা হয় না।

প্রথমা প্রকাশনীকে ধন্যবাদ। সতত বর্ণিত মাছে ভাতে বাঙ্গালীর সরল ভাবমূর্তির আড়ালে ক্ষমতা পেলে বাঙ্গালীও যে শোষক রাক্ষস হয়ে উঠতে পারে উপন্যাসটি তার অকাট্য প্রমাণ। আমি বিমুগ্ধ তাই একথা বলতেই পারি, ওয়াসি আহমেদ এর তলকুঠুরির গান ofcourse an eminent and especially distinguished novel for bengali readers.

-------------------------------------------
তলকুঠুরিরগান
ওয়াসি আহমদ
প্রথমা প্রকাশন , প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সব্যসাচী হাজরা
মূল্যঃ ৪৫০ টাকা
প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা ২০১৫





লেখক পরিচিতি
রুখসানা কাজল।
কথাসাহিত্যিক। প্রবন্ধকার।
ঢাকায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ