ডকের পাড়ে দাঁড়িয়ে গুলতি দিয়ে গাছের মাথায় বসে থাকা চড়ইগুলোকে বারে বারে ফসকে তবু ভীষণ একনিষ্ঠ যেহেতু চড়ুই-এর মাংস সুস্বাদু অতএব লক্ষ্যবস্তুকে বেঁধার চেষ্টায় তৎপর সে, শক্তিপদ, বাপকে ঝুপড়ির দিকে আসতে দেখে তেরছা চোখে তাকায়। অপুষ্টিজনিত চোখে রুখে দাঁড়ানোর তেজ। তার চোখে চোখ পড়তেই গঙ্গাপদর বয়স্ক চেহারাটা কেমন যেন কুঁকড়ে যায়।
চোখে মুখে সামান্য জ্বরের ঘোর। মাথায় ঝিমুনি। তাই অতি শ্লথ পায়ে লাঠিতে ভর দিয়ে এগোয় গঙ্গাপদ। পায়ের তাল তবু অসমান। করমচা রঙা চোখ দুটো রগড়ে নিচু ঝুপড়িটার মধ্যে ঢোকে। বয়েসের তুলনায় বার্ধক্য বয়স্ক। এই নিচু ঝুপড়িটাই তার বার্ধক্যে দ্রুত এগিয়ে যাবার সহায়ক। ঘরের কল্যাণে তার স্বাভাবিক উচ্চতা অস্বাভাবিক কুঁজো দৈর্ঘে পরিণত। অপরিসর নিচু ঝুপড়ির মধ্যে হাঁটু গেড়ে কিংবা উবু হয়ে থাকতে থাকতে তার আকৃতি এখন 'দ'-এর মতো। পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে ধনুক। হাঁটুর কাছ থেকে ভাঁজ, পা দুটো। সুতরাং বেশি চলাফেরায় হাঁফ ওঠে। থাই দুটো অথর্ব মানুষের মতো থরথরিয়ে কাঁপে। খোলা আকাশের নিচুতেও এখন সোজা টানটান হয়ে দাঁড়াতে অক্ষম।
কালীঘাট রেল স্টেশনের কাছে আদিগঙ্গার থেকে খিদিরপুর ডকে জল যাবার টানেল। তারই খাদে এই সমস্ত ঝুপড়ির মানুষগুলো গঙ্গাপদর আকৃতি। মেদমজ্জাহীন, হাড্ডিসার চেহারাগুলো গঙ্গাপদর ইয়ার, দোস্ত, প্রতিবেশী। যদিও ডকের ঢালু খাদে এই সমস্ত ঝুপড়ি তবু মানুষগুলো নিশ্চিন্ত যেহেতু ডকে জল থাকে না। ঝুপড়ির পেছনে চেতলা সাইডিংসংলগ্ন কাঠ আর কয়লার গুদাম। উঁচু পাহাড়।
জন্ম থেকেই গঙ্গাপদ এই ঝুপড়ির বাসিন্দা। অথচ ছেলেবেলায় আকৃতি এমন ‘দ’-এর মতো ছিল না। তার উচ্চতা যেহেতু তখন ছিল ঝুপড়ির থেকে অনেক নিচু। তারপর বয়েসের সঙ্গে তার আকৃতিরও পরিবর্তন হয় ক্রমশ।
ডিসেম্বরের দুপুর। বারোটা অথবা সাড়ে বারোটা। ভোরের কুয়াশা না থাকলেও মধ্যাহ্নশীতে সূর্যের উত্তাপে রক্তহীনতা। গঙ্গাপদ গেছিল চেতলা সাইডিংয়ে কাঠ বা কয়লা হাতানোর তাগিদে। জুর আসছে দেখে ফিরে আসে। কাশতে কাশতে আরও কুঁজো হয়ে যায়। ঝুপড়ির সামনে একদলা কফ ফেলে।
বাপের দিকে তাকিয়ে শক্তিপদর মনোসংযোগে চিড় ধরে। তার ওপর কেমন রাগ হয়। ঘেন্না হয়। যেহেতু কুঁজো লোকগুলোকে সে সহ্য করতে পারে না। মাঝে মাঝে আবার সে, শক্তিপদ, তার ক্ষুদে মাথায় যেন সব বুঝে ফেলে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকায়। গঙ্গাপদ সে মুহূর্তে একটু আশ্বস্ত হয়। কিন্তু, যেহেতু বছর দশেকের বাচ্চাকে তার কেমন ভয় করে, কাছে ডাকতে সেহেতু সাহস পায় না। অতএব অপরাধীর মতো নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে শুয়ে পড়ে।
শক্তিপদ পায়ে পায়ে ডকের পাড় ধরে। কিছুটা এগিয়ে ডকের পাড়েই পোর্টকমিশনার্সের উঁচু কোয়ার্টার্স। রোজই এখানে আসে সে। যেহেতু উঁচু বাড়িগুলোর প্রতি মজ্জাগত অতৃপ্তি এবং ভেঙে ফেলার ইচ্ছা দেহমনে কেন্দ্রীভূত সুতরাং আজ হাতে হাতিয়ার ভাবতে ভাবতে লক্ষ্যবস্তু বিষয়ে আর কোনও দ্বিমত থাকে না চারতলার কাচের জানালা ছাড়া। প্রথম ঢিলের লক্ষ্যভ্রষ্টতা তাকে আরও উৎসাহী এবং একাগ্র করে তোলে। অতএব দ্বিতীয় আর একটা কাচের জানালায় লাগতেই কাচটা ভেঙে পড়ে এবং নিঃশব্দে গা ঢাকা দেয় শক্তিপদ। এই মুহর্তে উঁচু বাডিগুলো ধ্বংস করার আনন্দে ওর চোখে মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি। যেমন
চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ঢিল ঢুকিয়ে, দু’বছর আগে ভাইকে গিলে ফেলার প্রতিশোধের চেষ্টায়, দুরন্ত দানবের গতিকে থামিয়ে দেবার সংকল্পে ও যে আনন্দ পায়। এইভাবে অস্বীকার করতে চায় নিজের পরিপার্শ্বকে। নিজের বেঁচে থাকাকে।
চারিদিক দেখে নিয়ে সন্তর্পণে ঝুপড়ির দিকে পা বাড়ায়। খিদেটা চনচন করে ওঠে। পেটের মধ্যে একটা জ্বালা অনুভব করে। ঝুপড়ির মধ্যে উঁকি মেরে দেখে মা এখনও ফেরেনি। বাপটা পড়ে আছে মড়ার মতো। ঝুপড়ির বাইরে এসে এদিক ওদিক উঁকি মারে মায়ের আসার পথের দিকে তাকিয়ে। মা বাবুদের বাড়ি বাসন মাজে। রোজই সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে এসে ডকের জমে থাকা পচা জলে স্নান করে। কাপড় কাচে। আঁচ দিয়ে রান্না চাপায়। বিকেলে আবার বাবুদের বাড়ি। আজ অবশ্য রান্না হবে না। মা বাবুদের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবে বলে গেছে। কোনওদিনই এমন চিন্তার মিল খুঁজে পায় না আজকের মতো, যেদিন কিনা তার মা ফেরে আর বাবুদের বাড়ি থেকে ভাল ভাল খাবার আসে।
কোনও কোনও রাতে মা বাড়ি ফেরে না। পাশের ঝুপড়ির সরলা বাবুদের বাড়ি থেকে ওদের জন্যে খাবার নিয়ে এসে বাপের কানে ফিস ফিস করে এবং বাপটা কোনওমতে ঘাড় নেড়ে, যদিও এক্ষেত্রে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়া অর্থহীনের পর্যায়ভুক্ত তবুও, অনাহারী চোখ খাবারগুলোর দিকে মনোযোগী হয়। এবং যেহেতু তখন খাবারের দিকে চেয়ে শক্তিপদর ক্ষুধার্ত চোখে লোভ ঝরে সুতরাং মায়ের কথা কিছু জিজ্ঞেস করে না। খেতে খেতে ওর মনে হয় মা ঘরে না ফিরলে বেশ ভাল খাবার জোটে। অথচ খাওয়া হয়ে গেলে মায়ের জন্যে মনটা কেমন বিষণ্ন হয়। মায়ের ওপর রাগ হয়। মনে হয় মা, বাপের সঙ্গে ঝুপড়িটায় থাকতে থাকতে বাপের মতো কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। ছোট হয়ে যাচ্ছে। বাপের অথচ কিছু মনে হয় না। নির্বিকারভাবে ঘুমোয়। শীতের সুর্যে উত্তেজনা কম। মাঝদুপুরে ডকসংলগ্ন ঝুপড়ি অঞ্চলটা প্রাণচঞ্চল। সকাল থেকে এর চোখের ঘুমের আমেজ এখন নেই। প্রত্যেক ঝুপড়ির মেয়ে মরদ ফিরে আসে এ সময়ে। আবার বিকেলের দিকে কর্মহীন হয়ে পড়ে অঞ্চলটা। এখন প্রত্যেকে নিজের ঝুপড়ির সামনে রান্নায় ব্যস্ত। বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভাতের সোদা গন্ধ। নাকে ঢুকতে শক্তিপদর মাথাটা ঝিম ধরে। পেটটা অসম্ভব মোচড় দেয়। মুখে অদ্ভুত একটা টক-লালানি ভেসে ওঠে। ‘মায়ের ফিরতে এত দেরি হচ্ছে!’ যেহেতু খিদেটা কিছুতেই বাগ মানছে না সেহেতু এরকম চিন্তা ক্রমশ দ্রুত এবং সময়ের গতি আনুপাতিক হারে মন্থর হচ্ছে। অথচ মা বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে। শ্যামাবাবুর ছেলের মুখে ভাত। বাড়িতে উৎসব। শক্তিপদ যাবার জন্যে বায়না ধরেছিল। মা নিয়ে যায়নি। দোষটা অবশ্য শক্তিপদরই।
মাস তিনেক আগে যতীনবাবুর ছেলের পৈতেয় ওকে নিয়ে গেছিল মা। উৎসবমুখর সমস্ত বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার মুখেই ওর চোখে জমাট বিস্ময়হেতু প্রাসাদের মতো বিরাট বাড়িটার দিকে অনেকক্ষণ ঘাড় কাত করে তাকায় এবং ঘোর কাটার আগেই মায়ের হাতের হ্যাচকা টানে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ভেতরে আরও বিস্ময়। এবং এই বিস্ময়ের কারণ হিসেবে বলা যায়
এক : এ বাড়ির মানুষগুলো তাদের মতো ঝুপড়ির মধ্যে বাস করে না।
দুই : মানুষগুলো ওই ঝুপড়ির মানুষের মতো কুঁজো নয়।
তিন: ঝুপড়ি সম্পর্কিত সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো, যা কিনা দশ বছরের মাথায় আলোড়ন তোলে। এবং
চার : ইত্যাদি আরও।
সুতরাং তার বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর দিকে সে জুলজুলে চোখে দেখে। চারিদিকে খাবারের গন্ধ ভাসে।
তারই লোভে মাঝে মাঝে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে এদিক ওদিক উঁকি দিতে দিতে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটা ছবির ওপর ওর লক্ষ পড়ে। অন্যদিকে কারোরই কৌতুহল না থাকায় এবং কাজে ব্যস্ততাহেতু ঘরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা সত্ত্বেও অনাগ্রহী থেকে যায় ওর ওপর প্রত্যেকের নজর। এ সুযোগে একটানা ছবিগুলো দেখতে থাকে এবং হঠাৎ-ই একটা ছবি ওর চোখে বিঁধে যায়। ছবির লোকটা খালি গা। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত প্রতি। ঠিক ওর বাবার মতো কুঁজো। লাঠির ওপর ভর দিয়ে হাঁটছে। বাপের মতো ছবিটার ওপর ভীষণ ঘেন্নায় একটা আক্রোশ ভেতরে জমা হয়। বাড়ে। হঠাৎ টেবিলের ওপর থেকে পেপারওয়েটটা তুলে ছুঁড়ে দেয় ছবিটার দিকে। অব্যর্থ লক্ষ্য। ছবির কাচ ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে। মুহুর্তের ঘটনা।
কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই যতীনবাবু এসে খপ করে হাতটা ধরে এঁচোড়ে পক্ক বালকের সুশীল গালে গোটা দুতিন চড় বসিয়ে দেয়। এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় বালক অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে জল গড়ায়। মাকেও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় যেহেতু বাবু ‘তোর মাইনে থেকে ছবির টাকা কেটে নোব। এই হাভাতে ছেলেকে কে আনতে বলেচে?' ইত্যাদির সঙ্গে কথা বিশেষণে শাসায়, যা কিনা ভদ্রমানুষের মুখোশ খুলে পড়ার হেতু এক্ষেত্রে উহ্য থাকা বিশেষ প্রয়োজন।
ঘরের মধ্যে ভিড় জমে। উৎসব বাড়ির লোক। মা অপরাধীর মতো নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে। যতীনবাবুর শক্ত মুঠোয় একটা আর্তনাদ তোলপাড় করে। 'কেন ভাঙলি ছবিটা?' বাবুর গলার আওয়াজে ভেতরের সমস্ত অবরোধ ভেঙে পড়ে তবু উত্তর দেয় না দেখে একটা বছর চব্বিশের ছেলে এগিয়ে এসে 'কাকাবাবু ওকে ছেড়ে দিন, আমি জিজ্ঞেস করছি' বলে অপর হাতটা ধরায় 'এ সব ত্যাঁদোড় ছেলে, চাবুক ছাড়া তুমি একটা কথাও বার করতে পারবে না, অরুণ' ইত্যাদি বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান এবং অরুণকে দেখে শক্তিপদর মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয় যেহেতু বড় চোখগুলোর চাহনি জুলজুলে, তীক্ষ্ণ। মুখে একমুখ গোঁফ আর রুক্ষ চুলে কেমন রাশভারী চেহারা। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। শক্তিপদ একবার অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের চোখে মুখেও অসহায়তার লক্ষণ। এবং যে মুহূর্তে মুখের সমস্ত রক্ত নেমে হিমঘরে মৃত মানুষের মুখের মতো আর শারীরিক রক্ত চলাচলের মাত্রা দ্বিগুণ ঠিক সেই মুহূর্তে অরুণ শক্তিপদকে কাছে টেনে নেয়। চড় খাওয়া গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ‘খুব লেগেছে, না?' বলায় শক্তিপদ সাহস পায়। তবু মুখে কোনও উত্তর না যোগানো হেতু ঘাড় নাড়ায়। ‘তুমি ছবিটা ভাঙলে কেন?’ প্রশ্নে অরুণকে আপন মনে হয়, কিন্তু, যেহেতু ভীত সেহেতু মনের কথাটা বলতে পারে না। ‘বল, আমি তোমাকে কিছু বলব না।‘ অতএব শক্তিপদ সাহস সঞ্চয় করে। কিন্তু বলার সময় কথাগুলো জিবে তালগোল পাকায় 'ওই, বু... বু... বুড়োটা আমার বাবার মতো কুঁজো হয়ে, লাঠি নিয়ে হাঁটে। আ...আ..আমার কুঁজো লোক দেখলে রাগ হয়।'
অরুণ হো হো করে হেসে ওর পিঠে আস্তে আস্তে চাপড়ায়। সুতরাং ও বুঝতে পারে অরুণ, ওকে আদর করছে। কিন্তু অপরিণত অথবা আধাপরিণত মস্তিস্ক কোষে হাসির কারণ উপলব্ধি না হওয়ার হেতু ভয়ে কেমন জড়োসড়ো হয়ে যায়। হাসির শব্দে যতীনবাবু ঘরে ঢুকে পড়েন। “কি হল হাসচো যে?'
অরুণ মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে ওঠে 'ও ঠিকই বলেছে কাকাবাবু। যার নিজেরই মেরুদণ্ড বেঁকা, সেই লোকটাই জাতির মেরুদণ্ড। তাই বোধয় আমরা এমন মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছি।”
যতীনবাবুর মুখে সমস্ত রক্ত জমাট বাঁধে। “আঃ, এই হাভাতে ছেলেটাকে এত মাথায় তোলার কি আছে ? তাছাড়া তুমি একটু ভেবেচিন্তে কথা বলার চেষ্টা কর। শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে তোমাদের...' বলতে বলতেই তিনি অন্য কাজে ব্যস্ততা হেত অতিরিক্ত তৎপরতায় বেরিয়ে যান। শক্তিপদর মাথায় সমস্ত ব্যাপারটা জট পাকায়। কিছু বুঝতে না পেরে সাদা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে মা ওকে নিয়ে ঝুপড়িতে ফিরে আসে এবং খামোকই মায়ের হাতে গুটিকত এলোপাতাড়ি কিলচড় খেয়ে, সারাক্ষণ গায়ের অসম্ভব ব্যথায়, সমস্ত রকম তদিড়ামি অন্তর্হিত হয়। গোটা পেটটা খিদে চনচন করে ওঠে। একটু দূরে কালো ব্রিজের ওপর লক্ষ যায়। মা খাবারের জায়গা হতে ব্রিজের রেলিং গলে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে সুতরাং হ্যাংলা চোখটা আরও ঝুলে পড়ে। ইতিমধ্যে তিনটে দশের ট্রেনটা কালীঘাট স্টেশন ছাড়ে। ঝুপড়ির মধ্যে এসে মা খাবার দিতেই সেগুলো খেতে থাকে গোগ্রাসে।
বেলা বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেছে। শীতের আমেজে দিনটা কেমন হাত-পা গুটোয়। সূর্যটা ক্রমশ নেমে পড়ছে পশ্চিমে। সন্ধের আগেই ঠাণ্ডা হাওয়া বন্য থাবা বসাচ্ছে ঝুপড়িগুলোতে। দুপুরের চঞ্চলতা এখন অনেক কম। আর কিছুটা পরে সমস্ত অঞ্চলটা একেবারে সুপ্ত অবস্থায় পৌঁছবে। তারই ব্যস্ততা। মা তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরিয়ে যায়। বাপটা ঘরের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে থাকে। শক্তিপদ পাড়ে দাঁড়িয়ে ডক কাটার কাজ দেখে। ডকে এখন জল শুকনো। যেহেতু আদিগঙ্গায় এখন জল থাকে না সেহেতু পোর্ট থেকে ডকটা বুজিয়ে অপেক্ষাকৃত সরু নালা কাটার ব্যবস্থা করেছে। তাই ডক এখন দু'ভাগ। একভাগ শক্তিপদদের ঝুপডির দিকে। যেখানে তার মা এবং ঝুপড়ির অন্যান্য লোকজন স্নান করে। এই ভাগের জল জমে বদ্ধ জলাশয়। অপর ভাগে একেবারেই জল নেই। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা হচ্ছে। অ
পর পাড়ে কালীঘাট সাইডিংয়ে লাইনের ওপর দিয়ে একটা বিরাট সরীসৃপ ধীরগতিতে এগিয়ে যায় ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসে। পাঁচটার ট্রেনটা এসে থামে স্টেশনে। কয়েকজন প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে ঝপাঝপ ঝাঁপ মারে। একজন চাকার ফাঁক দিয়ে ঢুকে, অদ্ভুত তৎপরতায়, কয়েকটা বস্তা টেনে বার করে। ট্রেন ছাড়বার আগেই বেরিয়ে আসে। বাকি ক’জন বস্তাগুলো নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা দেয়।
সূর্যটা কালীঘাট স্টেশনের পাশ দিয়ে নেমে পড়ল পশ্চিমে। সুতরাং পৃথিবীর ক্ষীণ আলোর বিন্দুটা মুছে গেল। ফিকে অন্ধকারের ডানায় ক্রমশ কালো রঙের প্রলেপ। ধোঁয়াশা ওৎ পাতছে ঘন শক্তি নিয়ে। ঝুপঝাপ নামছে ঝুপড়িগুলোর চারপাশে। বাতাস ক্রমশ কনকনে। ঘন সন্ধ্যায় মা ফেরে। বাবুদের বাড়ি থেকে এবেলাও খাবার এসেছে। আঁচ পড়েছে অন্যান্য উনুনে সুতরাং ধোঁয়াশা আরও গাঢ়। ঝুপড়িগুলোয় কেরোসিনের কুপি জ্বলে। ব্রিজের ঢাল বেয়ে এই সরীসৃপ শীতের আক্রমণে অর্ধোলঙ্গ মানুষগুলো ঝুপড়ির দিকে এগোয়। কুঁজো শরীরগুলোয় সারাদিনের ক্লান্তি।
রাত বাড়ার সাথে অন্ধকারের আলাদা অস্তিত্ব শূন্য। ধোঁয়াশায় ব্রিজের ওপর পোস্টের আলো দেখা যায়। সমস্ত এলাকার অন্ধকার নিস্তব্ধতা শীর্ষবিন্দুতে। শীতের কনকনে বাতাস, যেহেতু সামনে কালীঘাট স্টেশন এবং সাইডিং অঞ্চল ফাঁকা সেহেতু আরও তীব্র। অস্থিচর্মহীন মানুষগুলো কোনওমতে ঝুপড়ির মধ্যে থেকে শীতের আক্রমণ সামাল দেয়। অতএব সমস্ত অঞ্চলটা স্পন্দনহীন। শুধু মাঝে মাঝে ট্রেনের গর্জন শোনা যায়।
রাত আরও বাড়ে। মা শক্তিপদকে খেতে দেয় এবং খাওয়া হলে ডকের জমা জলে হাত ধোয়। বাপটাও খেয়ে দেয়ে ডকের জলে হাত ধুতে নামে দ'-এর মতো। শক্তিপদ বাপকে দেখে তার মস্তিষ্ককোষে যে ঘিলু জাতীয় পদার্থের অবস্থান তাতে সহসা অগ্নিসংযোগ ঘটার হেতু ডকের পাড়ে দাঁড়িয়ে ফোঁসে। ছোট হাতে মুঠি শক্ত হয়। বাপটা হাত ধুয়ে আসে। ঝুপড়িতে ঢোকে যতটা কুঁজো হয়ে হাঁটে তার চেয়ে আরও কুঁজো হয়ে তবে তার বাপকে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকতে হয়। দেখে, উত্তপ্ত মাথায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণে কেমন যেন পরিবর্তন হয় চিন্তার। শক্তিপদ বুঝতে পারে বাপ কুঁজো হওয়ার পেছনে এই ঝুপড়িটাই দায়ী এবং লক্ষ পড়ে ভিজে মাটিতে ঝুপড়ির বাঁশগুলো বসে যাচ্ছে। ফলত ঝুপড়ির চালা ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে দিন দিন। একদিন হয়তো মাটির সঙ্গে মিশে শ্বাসরোধ করে মারবে সকলের।
শক্তিপদ আস্তে আস্তে ডকের পাড় থেকে উঠে আসে। ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়ে ঝুপড়ির চালাটা মাথায় ধাক্কা লাগে। যন্ত্রণাটা খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায় সমস্ত শরীরে। ও পরিষ্কার বুঝতে পারে এবার ওকেও দিন দিন হাঁটু গেড়ে বসতে হবে। বাপের মতো দ’ হতে হবে।
সুতরাং শক্তিপদ ঝুপড়িতে ঢোকে না। ডকের পাড়ে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নাগালের বাইরে অনেক উঁচুতে আকাশ। ধোঁয়াশায় দেখা যায় না।
( কবিপত্র ১৯৮০ )
0 মন্তব্যসমূহ