অনুবাদ : ফজল হাসান
লেখক পরিচিতি : সমকালীন চীনা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী এবং মেধাবী ‘শেকড়-সন্ধানী’ লেখক লি রুই । তিনি ১৯৪৯ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন । লিয়াওনিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা সমাপ্ত করার পর ১৯৭৪ সালে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন । সেই সময় তিনি শানচি প্রদেশের লুলিয়াং পাহাড়ী এলাকায় বাধ্যতামূলক নির্বাসনে ছিলেন । তিনি পাঁচটি উপন্যাস, একাধিক অনু-উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটগল্প রচনা করেন । ইংরেজিতে অনুদিত উপন্যাসের মধ্যে ‘সিলভার সিটি’ (১৯৯৭) এবং ‘ট্রীজ উইথআউট উইন্ড’ বা ‘নো-উইন্ড ট্রী’ (২০১২) উল্লেখযোগ্য । তবে ‘থিক্ আর্থ’ ছোটগল্প সংকলনের জন্য তিনি পাঠকমহলে সুপরিচিত । এই গল্পসংকলনের জন্য তিনি ‘চায়না টাইমস্’ সাহিত্য পুরস্কার এবং অষ্টম ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন । এছাড়া তিনি তার সাহিত্য কর্মের জন্য ফ্রান্সের শিল্প-সাহিত্যের পুরস্কার অর্জণ করেন । তার লেখা গল্প এবং উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে ইংরেজি, সুইডিশ, ফরাসী, জাপানী, জার্মান এবং ডাচ, অনুবাদ করা হয়েছে । তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে শানচি প্রদেশের ‘শানচি লিটরেচার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন ।
নকল বিয়ে
লি রুই
শুরু থেকেই লোকটির মনে সন্দেহ হয়েছিল যে বিয়েটা আসলে নকল । যখন প্রোডাকশনের দলনেতা, যে কি না বিয়ের জামিনদারও ছিলেন, চোখেমুখে বিকৃত হাসির রেখা ফুটিয়ে মহিলা এবং তিন বা চার বছরের একটা মেয়ে নিয়ে উঠোনে প্রবেশ করে, তখনই লোকটি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে যে ইতিমধ্যে দলনেতা অবশ্যই মহিলার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করেছে । কিন্তু তারপরেও সে তার ভাঙ্গা মনকে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে মহিলা এবং মেয়েটিকে গ্রহণ করেছে । কুড়ি বছর আগে লোকটির স্ত্রী মারা গেছে এবং বিয়ের পরে দু’মেয়েও নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । এই দীর্ঘ সময় একলা জীবন কাটানোর পর তার অব্যবহৃত লাঠিটা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে । যাহোক, যখন মহিলা এবং সে বিয়ের নিবন্ধনের কাগজে বুড়ো আঙুলের ছাপ দিচ্ছিল, তখন দলনেতা খড়ের চাটাই থেকে একটুকরো খড় ছিঁড়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা পিঁয়াজ এবং ডিমের অংশ বের করে পুনরায় দুর্গন্ধ মুখের ভেতর ঠেলে দিয়ে পরম আয়েসে চিবুতে থাকে ।
‘ভালো ! তৈরি মেয়েসহ আরেকটা পরিবার । তোমার মতো নিঃসঙ্গ পুরুষ, এত গরীব যে বিয়ে করার মুরোদ নেই । আর তুমি ! তোমার স্বামী না-ফেরার দেশে চলে গেছে এবং তুমি ফসল তোলার সময় এখানে ভিক্ষে করতে এসেছ । যেইমাত্র মুখ হা করবে, সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে মুখের ভেতর খাবার ঢুকে যাবে । এক গরীবের সঙ্গে আরেক গরীবের মিলন – নিখুঁত যুগলবন্দি । দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় যাওয়া যাক না কেনো, সব জায়গাতে একই ছবি দেখতে পাওয়া যায় । পুরুষরা মহিলাদের সঙ্গে শোয়, মহিলারা আন্ডা-বাচ্চা জন্ম দেয় এবং পরবর্তীতে সবাই একসঙ্গে বসবাস করে । বিয়ের সময় সরকারী দলিলের জন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন নেই । যখন বিয়ের রেশ কেটে গিয়ে সবকিছু থিতিয়ে যাবে, তখন কাউকে ডেকে বললেই হবে যে প্রমাণের জন্য একখানা সরকারী কাগজ দরকার ।’
যাহোক, বিয়ের পর নতুন দম্পতি যখন গেইট পেরিয়ে বাইরে আসছিল, তখন দলনেতা এগিয়ে এসে লোকটির কানে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তোমার যা ইচ্ছে, তাই তুমি করতে পারবে না । তোমার নতুন বউ কিন্তু শানচি প্রদেশের ইউলিন এলাকার হিজিয়ালিং গ্রাম থেকে এসেছে । আমি স্কুলের শিক্ষক লিউকে মানচিত্র খুঁজে গ্রামটা দেখতে বলেছি এবং সে দেখেছে । তোমার নতুন বউ কোথাও পালিয়ে যাবে না । সুতরাং আজ রাতে জোর-জবরদস্তি এমন কিছু করো না, যাতে আজই তোমার তৃষ্ণা মেটাতে হবে । এখন থেকে অনেক রাত পাবে । তখন তুমি মনের সাধ মিটিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারবে। হে, হে ... তোমার বউয়ের মধ্যে এমন কিছু গোপনীয় জিনিস আছে, আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি কিছুতেই পস্তাবে না ।’
আচমকা লোকটির মস্তিস্কের ভেতর প্রচন্ড রাগের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠে, ‘লুচ্চা, কি এমন নিশ্চয়তা আছে যে তুমি তার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করোনি ?’ যদিও তার রাগ বিস্ফোরিত হয়েছিল, কিন্তু ক্রমশ তা স্তিমিত হয়ে আসে । দলনেতা তাকে নতুন বউ যুগিয়ে দিয়েছে । অথচ বিনিময়ে তাকে কিছুই দেয়নি । হয়তো দলনেতা মহিলার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করেনি, কিন্তু তার বউ যে আনকোরা – নিশ্চয়তা কি ? রাগ করার জন্য সে আপন মনে হাসলো । তার মনে হলো, সে যেন একটা বুড়া ব্যাঙ, রাজহংসীর নরম মাংসের লোভে ছুটে চলেছে ।
লোকটি ঘরে পৌঁছার পরপরই কোথায় চাল, আটা, তেল ও নুন আছে, তা মহিলাকে দেখিয়ে দিয়েছে । এছাড়া উনুনে কিভাবে আগুন জ্বলাতে হয়, তা-ও সে শিখিয়ে দিয়েছে । একসময় সে কাঁধের উপর একটা শক্ত লাঠির দু’মাথায় কয়েকটা বালতি ঝুলিয়ে পানি এনে বড় বড় পাত্র পূর্ণ করে রাখে । তারপর সে একটা কুঠার নিয়ে কাঠ কাটতে যায় । গত কুড়ি বছর সে প্রচুর পরিমানে পানি এনেছে এবং বন-জঙ্গলে কাঠ কেটেছে । কিন্তু মেয়েদের বিয়ের পর সে এসব কাজে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে । তবে আজকের কথা আলাদা । হঠাৎ পেশিতে শক্তির জোয়ার এসে তার সমস্ত শরীর চাঙ্গা করে তুলেছে । দলনেতার সঙ্গে সে গোগ্রাসে মদ্যপান করার জন্য তার কন্ঠনালী এবং বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে । যে কুঠার দিয়ে সে পাহাড়ের গায়ে সজোরে আঘাত করে মাটি পর্য্যন্ত কাপিয়ে তুলতে পারে, সেই ধারালো চকচকে কুঠারের প্রতিটি কোপে সে গাছের বাকল কেটে ভেতর থেকে সাদা কাঠের গুঁড়ো বের করে আনে । তার আশেপাশে সাদা কাঠের গুঁড়ো মনে হয় যেন কেউ শুভ্র তুষার ছড়িয়ে দিয়েছে । সে যখন কাঠ কাটছিল, তখন মহিলা এসে নিচু হয়ে কাটা কাঠ তুলছিল । সেই সময় মহিলার থলথলে বুকের দিকে চকিতে লোকটির দৃষ্টি চলে যায় । লোকটির কাছে মনে হলো মহিলা যেন তার বুকের মধ্যে জামার ভেতর এক জোড়া রাজহংসী লুকিয়ে রেখেছে । সে দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে হাসতে থাকে এবং মনে মনে ভাবে, কয়েকজন যাজক অই সুন্দর মাংসপিন্ডের উপর দাঁড়িয়ে অনায়াসে ভারসাম্য রাখতে পারবে ।
সত্যি বলতে কি, লোকটি গতকালই মহিলাকে প্রথম দেখেছে । যখন শুনেছে যে গ্রাম থেকে একজন মহিলা ভিক্ষা করতে এসেছে এবং দলনেতার বাড়িতে রাত্রি যাপন করবে, তখন সে মহিলাকে দেখতে গিয়েছিল । তবে দেখা করার সময় সে ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে মহিলা একজন স্বামীর খোঁজেও এসেছে । যাহোক, গতকাল মহিলাকে দেখার চেয়ে আজ দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে । তখন মহিলাকে সে অন্য একজনের স্ত্রী হিসেবে দেখেছে । কিন্তু আজ সেই মহিলা তার নিজের বউ । এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় তার দৃষ্টি মহিলার উপর গিয়ে স্থির হয়ে যায় । কিছুক্ষণ পরে তার অবাধ্য চোখের তারা মৃদু আলোর ঝলকানিতে জ্বলজ্বল করে উঠে । সেই সময় সে মহিলার শরীরের উপরে-নিচে, সামনে-পেছনে এবং মাথা থেকে পা অবধি কৌতূহলী দৃষ্টি বুলিয়ে আনে । তার তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে মহিলা অস্বস্তিবোধ করে এবং নিঃশব্দে একাগ্রমনে হাতের কাজ করতে থাকে । তবে মাঝে মাঝে সে চোখ তুলে লোকটিকে পরখ করার চেষ্টা করে এবং চোখাচোখির ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে । মহিলার মৌনতাকে বিদীর্ণ করে লোকটির অন্তর্দৃষ্টি সব কিছুই অবলোকন করতে পারে । লোকটি ভাবে, মহিলা এমনভাবে শান্ত এবং চুপচাপ না থাকলেই পারে । মহিলার এই অস্বাভাবিক মৌনতার জন্য সে বুকের ভেতর একধরনের উষ্ণতার অলৌকিক সংঘর্ষ উপলব্ধি করে । কিছুতেই সে ধারনা করতে পারে না যে মহিলা আদৌ তার ক্ষুধা নিবারণ করতে সক্ষম হবে কি না । তবে সে অপেরায় দেখেছে যে তিনজন মানুষ, যারা আগে কেউ কাউকে কখনো দেখেনি, দিব্যি ঘর-সংসার করে যাচ্ছে । কিন্তু এটা তো আর অপেরা নয় । তাকে কাছে পাওয়ার অনেক আগেই মহিলা জেনে গেছে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে কি সব ঘটনা ঘটে । মহিলার জীবনে শুধু আট বা দশ বারই ঘটনা ঘটেনি, তার তিন-চার বছরের একটা সন্তানও আছে । যাহোক, লোকটি নিজেকেই নিজে বললো, কপর্দহীন এবং শুকনো লাঠির মালিক, এসব নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেনো ? প্রচুর পরিমানে সুরা পান করার জন্য এখনো তার বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে । তবুও সে শক্ত হাতে কুঠার ধরেছে । আত্ম-গরিমায় সে কিছুতেই একজন ভিক্ষুক মহিলার সামনে নিজের অক্ষমতাকে প্রকাশ করতে পারে না । যেইমাত্র সে দেখতে পেল যে মহিলা দরজা পেরিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে, তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠে মহিলার উঁচু খোলা বুক, যেখানে দাঁড়িয়ে অনায়াসে যাজকরা ভারসাম্য রাখতে পারবে । তার ভীষণ হাসি পায় । হেঁয়ালি করে সে নিজেকে বললো, তুমি একটা আস্ত বোকা । এখনো ভাবছো, শিকার কি মোটা, না চিকণ । যে জিনিসে ক্ষুধা মিটে, সেটাই সুস্বাদু খাবার ।
দুপুরের খাবার খাওয়ার পরও বাতি জ্বলছে । বাতির সেই মৃদু আলোয় মেঝের উপর বিছানো চাটাই এবং দেওয়ালের গায়ে তিনজন মানুষের ছায়া উপরে-নিচে উঠানামা করছে । যাহোক, সন্ধ্যের অনেক আগেই মহিলা ঘরবাড়ি পরিস্কার করেছে । উনুনে তখনও কয়েকটা কয়লার টুকরা জ্বলছিল । মহিলা একপাশের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আগুনের শিখায় এবং বাতির আলোয় তার চোখমুখ রীতিমত চিকচিক করছে । কিন্তু লোকটির কোনো ভাবান্তর নেই ।
মহিলাকে যা জিজ্ঞেস করার, কিংবা কথা বলার ছিল, ইতিমধ্যে লোকটি তা জিজ্ঞেস করেছে, এমনকি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে আমতা আমতা করে যা বলতে চেয়েছিল, তাও বলেছে ।
মহিলা অপেক্ষার প্রহর গোণে । চুলার আগুনের তাপ এসে ঠিকরে পড়েছে তার চোখেমুখে । তবে সেই চোখমুখে অলৌকিক অদৃষ্টের একধরনের চাপা ভাব ফুটে আছে ।
মহিলা এবং লোকটির মধ্যে টানাপোড়েন নিয়ে বাচ্চা মেয়েটি মোটেও চিন্তিত নয় । লোকটির একটা বাঁশি নিয়ে মেয়েটি আপনমনে নাড়াচাড়া করে । মাঝে মাঝে তার দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে দু’ একটা শব্দ বা বাক্য বেরিয়ে আসে ।
ক্রমশ লোকটির মনের আকাশে অধৈর্য্য এবং বিরক্তির কালো মেঘ জমা হতে থাকে । মহিলার নির্লিপ্ত চাহনি তাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে । একসময় সে চট করে মাথা থেকে টুপি খোলে । তারপর টুপিটা মহিলার দিকে এগিয়ে ধরে আদেশের সুরে বললো, ‘এই নাও, এটা ধুয়ে দাও ।’
হাত বাড়িয়ে মহিলা হাসি মুখে টুপিটা ধরতে যায় । অমনি লোকটি মহিলার কাঁধে ধরে নিজের দিকে সজোরে হেঁচকা টান দেয় ।
‘মা, বন্দুক !’ দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা বন্দুকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বাচ্চা মেয়েটি আর্তচিৎকার করে উঠে ।
মহিলা কোনো প্রতিবাদ করেনি, এমনকি প্রতিরোধও গড়ে তোলেনি । সে শুধু দৃষ্টি আনত করে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘মেয়েটি ঘুমানো পর্য্যন্ত অপেক্ষা করুন ।’
‘না, পাশের ঘর ফাঁকা আছে,’ উত্তেজনায় লোকটি কাঁপতে থাকে । সে জানে না, কেনো তার সমস্ত শরীর এমন করে কাঁপছে । তবে সে জানে, গতরাতে দলনেতা মহিলার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করেছে । মনে মনে ভাবে, এখন তাকে নেতার উচ্ছ্বিষ্ট খাবার খেতে হবে । আর মহিলা কি না বলে, অপেক্ষা করুন ।
মহিলা কোনো কথা না বলে একটা বালিশের উপর আলতো করে মেয়েটির মাথা রাখে । তারপর পকেট থেকে সে একটা লজেন্স বের করে মেয়েটির মুখে পুরে দেয় ।
লোকটি বাতি না জ্বালিয়ে আহত শিকারী জন্তুর মতো মহিলাকে টেনে-হিঁচড়ে মাদুরের উপর এনে শোয়ায় । কুড়ি বছর ধরে লোকটির ভেতর সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো জমে থাকা কামনার জ্বলন্ত লাভা একসময় গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে অগ্ন্যুৎপাত হয়ে বিস্ফোরিত হয় । তারপর আদিম আঁধারে দু’টো শরীর এক হয়ে যায়, যে আঁধারে একজন আরেকজনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করতে পারে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পারে না, এমনকি কে পুরুষ বা কে রমনী, তা কিছুতেই বোঝা যায় না ।
একটা ইঁদুর খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে । হঠাৎ ইঁদুরটি পা ফসকে লোকটি ও মহিলার উত্তপ্ত শরীরের উপর পড়ে এবং ভয় পেয়ে নিমিষেই দৌঁড়ে পালিয়ে যায় । কিছুক্ষণ পরে চাটাইয়ের উপর ইঁদুরের নখের আচরের খসখস আওয়াজ শোনা যায় ।
প্রথম দিন এভাবে কেটে যায় ।
দ্বিতীয় দিন এভাবেই কেটে যায় ।
তৃতীয় দিনও এভাবেই কেটে যায় ।
লোকটি তার পাগলামির কথা বলতে পারে না । কিন্তু তার এমন কোনো শক্তি বা সামর্থ নেই, যা দিয়ে সে নিজের অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসা আদিম পাগলামিকে প্রতিহত করতে পারে । তবে সে ভাবে, কাছে পাওয়ার আগের রাতে কেমন করে দলনেতা মহিলার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করেছে । ভাবনাটা একটা তেজি লোমশ দৈত্যের মতো তার মস্তিস্কের মাঝখানে দশ বারের বেশি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে ।
যাহোক, ধীরে ধীরে লোকটির পাগলামির পারদ নিচে নেমে আসে । তখন সে মহিলার তুলতুলে নরম উষ্ণ বুকের মাঝে মুখ গুঁজে নিশ্চুপ শুয়ে থাকে । একসময় যখন পাগলামি পুরোপুরি উবে যায়, তখন আবার তার দেহের ভেতর আত্মসম্মান এবং বিশ্বাস ফিরে আসে । একদিন সকালের নাস্তা খাওয়ার পর সে অপেক্ষা করে কখন মহিলা হাতের অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে । একসময় লোকটি বুকপকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বললো, ‘এখানে ।’
টাকা না নিয়ে মহিলা ফাঁকা দৃষ্টিতে লোকটির দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে ।
‘কম হয়েছে ? এই নাও, আরো দশ টাকা ।’
তখনো মহিলা স্থির দৃ্ষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
‘আমাকে বোকা বানাতে চেষ্টা করো না । ইতিমধ্যে তুমি থাকার জন্য ঘর পেয়েছ এবং একজন জীবন্ত পুরুষ মানুষও পেয়েছ । এছাড়া তোমার বাল-বাচ্চা আছে, যারা গ্রামের বাড়িতে অধীর আগ্রহে তোমার ফেরার আশায় পথ চেয়ে আছে ।’
‘না, না ...’ মহিলা দু’পাশে মাথা দুলিয়ে বলেই সতর্ক হয়ে যায় ।
‘গোল্লায় যাও । অন্য কাউকে বোকা বানাও ।’ লোকটির সারা শরীরে রাগে টগবগ করতে থাকে । ‘এখানে তুমি তিন মাস থাকবে, পাঁচ মাস, খুব বেশি হলে এক বছর । তারপর একদিন যখন সুযোগ পাবে, সেদিন সবকিছু ফেলে চলে যাবে । তখন আমি আবার একা হয়ে যাবো । কি, ঠিক বলিনি ? তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, আমি কিসের পেছনে ছুটছি ? কোনোকিছু ছাড়াই কি আমি তোমাদের দু’জনের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব নিয়েছি ? তুমি যদি ভাবো আমার কোনো চাহিদা নেই, তাহলে এক্ষুণি কেটে পড়ো । আমি একজন রক্ত-মাংসের সুস্থ-সবল পুরুষ মানুষ । বাঁদর-নাচের মতো আমাকে কেউ নাচাতে পারবে না ।’
লোকটির কথা শুনে মহিলার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠে ।
যাহোক, কোনো কারণে মহিলার অশ্রুভেজা চোখ দেখার পর লোকটি তার মনের ভেতরে একধরনের আত্মতৃপ্তির অলৌকিক হালকা পরশ অনুভব করে । সে জানে, এই শান্ত-শিষ্ট মহিলার মৌনতাকে না ভঙার জন্য গত কয়েকদিন ধরে নিজেকে বোকা ভাবছে । সেই সময় চারদিক থেকে ক্রমশ হতাশা এসে তাকে ঘিরে ধরেছে । সে তখন আকাশের সিঁড়ি বেয়ে রাতের অন্ধকার নেমে আসার দীর্ঘ অপেক্ষায় থেকেছে । যখন সন্ধ্যার তরল অন্ধকার জমাট বেঁধে কৃষ্ণবর্ণ ধারন করেছে, তখনই উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য তার দুরন্ত মন আনচান করেছে । কিন্তু এখন সবকিছুই স্বাভাবিক । একসময় সে সাদা কাগজে ঢাকা জানালার ফাঁক গলিয়ে তাকিয়ে দেখে মহিলা তার জিম্মায় বহাল তবিয়তে আছে ।
আচমকা মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো, ‘বড়ভাই ...’
‘তাহলে এখন তুমি আমাকে বড়ভাই বলে সম্বোধন করছো ?’ লোকটি বুকের গভীর থেকে জোর করে ঠেলে একখন্ড শুকনো হাসি চোখেমুখে ফুটিয়ে ভ্রুকুটি করে বললো । তারপর সে সামান্য নড়েচড়ে বসলো । ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি ।
‘বড়ভাই, এ বছর আমাদের গ্রামে ভালো ফসল হয়নি । আমাদের কোনো বিকল্প পথ জানা নেই । আমি জানি, আপনার সঙ্গে আমি ঠিক কাজ করিনি । আপনি এখানে যদি আমাদের আশ্রয় দিতে না চান, তাহলে আমরা চলে যাবো । যাহোক, আপনার লেপের কভার খুলে আমি ধুয়ে দিয়েছি । কিন্তু ছেঁড়াটুকু সেলাই করার সময় পাইনি । ওটা সেলাই করেই চলে যাবো ।’
মহিলার আর্তি শুনে চকিতে লোকটির চোখের পাতা ভিজে উঠে এবং তা সংবরণ করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করে । তিন বছর আগে দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের সময় শেষবারের মতো তার লেপের কভার ধোওয়া হয়েছিল । গত কয়েকদিন ধরে মহিলা ঘরের ভেতর এবং বাইরের গেরস্থালির সমস্ত কাজ করেছে । সত্যি কথা বলতে কি, লোকটি ইতিমধ্যে মহিলা এবং শিশু মেয়েটিকে এ বাড়িতেই রাখার কথা ভেবেছে । সে আরো ভেবেছে, মহিলাকে নিয়ে হেজিয়ালিং যাবে এবং বিয়ের সনদপত্র নিয়ে আসবে । যদিও মহিলা খুবই সাদাসিধা এবং সরল মনের মানুষ, তবুও নকল বিয়ে সবসময়ই নকল । তবে তার রাগের মূল কারণ হলো, মহিলা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিপুনভাবে তার সামনে মিথ্যাকে সত্য বলে উপস্থাপন করেছে, যা তার নরম হৃদয়কে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে ।
যাহোক, শেষ মুহূর্তে মহিলার কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকানোর পর লোকটির পুরুষোচিত কঠিন হৃদয়ে বরফ গলতে শুরু করে ।
‘তুমি যদি এখানে থাকতে চাও, থাকতে পারো । আর যদি চলে যেতে চাও, তাও করতে পারো । তবে তুমি কি করবে, তা আমি বলতে পারবো না ।’
লোকটির সামনে মহিলা নতজানু হয়ে বসে আছে । কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে সে বললো, ‘বড়ভাই, মেয়েটির বাবা এবং আমি কোনোদিনও আপনার কথা ভুলবো না ।’
মহিলার কথা লোকটির কানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার মেজাজ পুনরায় গরম হয়ে যায় এবং সে রীতমত রাগে-ক্ষোভে জ্বলতে থাকে । ‘তুমি ফিরে যাও এবং তোমার অপদার্থ স্বামীকে বলো যে আমার বন্দুকের গুলি তার কাছে পৌঁছাবে না । তবে গুলি যদি ওখানে পৌঁছে, তাহলে আমি তাকেই প্রথম খুন করবো । বদমাশ কাঁহাকার !’
‘বড়ভাই, সে একজন নিরীহ গরীব মানুষ । আজই আমি আপনার লেপের কভার সেলাই করবো এবং আগামিকাল আমরা চলে যাবো ।’
বড়দের মধ্যে কি নিয়ে এত কিছু ঘটছে, তা বাচ্চা মেয়েটির বোধগম্য নয় । সে শুধু মাকে শক্ তকরে জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে অনবরত কাঁদতে থাকে ।
লোকটি ভেবেছিল, মহিলা এবং বাচ্চা মেয়েটি হয়তো কোনো অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের অবতারণা করবে । ঠিক তাই । সে এখন সেই দৃশ্যই ঘটছে । হঠাৎ তার মনে পড়ে, মহিলা এবং সে যখন বিয়ের কাগজের উপর টিপসই দিচ্ছিল, তখন তার মনে হয়েছিল মহিলা, যে কিনা শুরুতেই তার স্ত্রী হতে পারতো, এতদিন অন্যের ঘরণী হয়ে থেকেছে । ক্রমশ ভাবনাটা দাবানলের মতো তার হৃদপিন্ড থেকে মস্তিস্কের ভেতর এসে জমা হতে থাকে । যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবেই স্বামী-স্ত্রীর পুরো নাটকটা অত্যন্ত অল্প সময়ে শেষ হয়ে যায় ।
সেই রাতে খাওয়ার পর আরেকবার বাতি জ্বালানোর সময় হয় । কিন্তু লোকটি এবং মহিলা যে যার জায়গায় অনড় থাকে । ইতিমধ্যে বাচ্চা মেয়েটি চাটাইয়ের এক কোণে জুবুথুবু হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
মহিলা লোকটির জন্য অপেক্ষা করছে ।
লোকটি তখন ধূমপান করছে । চরম বিরক্তিতে তার মন বিষিয়ে আছে । জানা সত্ত্বেও সে এই রাত অযথা কিছুতেই ভেস্তে যেতে দিবে না । তার কোনো ধারণা নেই যে আজ রাতের এই সূবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে গেলে আগামীতে তাকে আরো কত বছর পুনরায় খরার রাত কাটাতে হবে । একটার পর একটা সিগারেট সে পুড়িয়ে ছাইদানি ভরে ফেলেছে । একসময় সে ভরা ছাইদানির ছাই চাটাইয়ের একপাশে জমা করে । তার মনের ভেতর নিরাশার কালো ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে । যা শুরু থেকেই নকল ছিল, সে এখন শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে জমে থাকা নিসঃঙ্গতা তাকে সীমাহীন যন্ত্রণা দিচ্ছে । এই যন্ত্রণার পরিধি যতই বড় হচ্ছে, ততই তার উত্তেজনা এবং বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে । লোকটি জানে না, এই উত্তেজনা এবং বিদ্বেষ থেকে কিভাবে সে পরিত্রাণ পাবে । মহিলা, যে আগামীকাল ভোরেই চলে যাবে, তার জন্য অপেক্ষা করছে । অকস্মাৎ লোকটি তার সুন্দর পাইপটা হেঁচকা টানে তুলে নিয়ে চুলোর গায়ে সজোরে আঘাত করে এবং চতুর্দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে আদেশের ভঙ্গিতে বললো, ‘ঘুমোতে যাও ।’
মহিলা জামার বোতাম খোলে এবং মলিন জামার ফাঁক গলিয়ে তার বুকের সমস্তটা বেরিয়ে আসে । দেখার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির মস্তিস্কের ভেতর বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায় । উত্তেজিত গলায় সে জিজ্ঞেস করে, ‘বদমাশ দলনেতা কি তোমার গরম হাঁড়িতে নুডুলস্ রান্না করেছে ?’
মহিলা অপ্রতিভ হয়ে মাথা নিচু করে এবং খোলা বুক ঢাকার চেষ্টা করে ।
‘সত্যি করে বলো ! সে কি তোমাকে স্পর্শ করেছে, নাকি করেনি ?’
এক মুহূর্তের জন্য মহিলা খানিকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলনায় দোলে । তারপর অনিচ্ছায় সে সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা দোলায় ।
‘অই বদমাশটা এখন আমাকে তার উচ্ছ্বিষ্ট খাবার খাওয়াতে চায় । ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী খাবে ।’
একসময় লোকটির মনের ভেতর প্রবল ঝড় থেমে আসে এবং আস্তে আসতে তার মস্তিস্কের সমস্ত বন্ধ দরজা খুলতে থাকে। আচমকা সে সামনের দিকে ঝুঁকে মহিলাকে ধরতে যায় । ঘটনার জন্য ক্রুদ্ধতায় তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করে এবং মুখের উপর পাশবিকতার হিংস্র ছবি ফুটে উঠে । এই মহিলার জন্যই এখন তার জীবন আরো বেশি কঠোর হয়ে যাচ্ছে । আকস্মিক বিক্ষুব্ধ আবেগ এবং মহিলাকে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা তাকে চতুর্দিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরে । অবশেষে সে মহিলার ভেতর একদলা উষ্ণ তরল পদার্থ উৎক্ষেপন করে ।
একসময় মহিলা নিঃশব্দে নেতিয়ে পড়া লোকটিকে ঠেলে সরিয়ে দেয় । তার উত্তপ্ত নরম বুক দ্রুত উঠানামা করতে থাকে । পিদিমের টিমটিমে অস্পষ্ট আলোয় ঘরের অন্ধকার কিছুতেই দূর হয় না ।
লোকটি খসখসে তালু দিয়ে মহিলার চোখের উষ্ণ পানি মুছে দেয় ।
গল্পসূত্রঃ
‘নকল বিয়ে’ লি রুইয়ের ইংরেজিতে ‘শ্যাম্ ম্যারেজ’ গল্পের অনুবাদ । চীনা ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম শ্যাফার এবং ফেংহুয়া ওয়াং । গল্পটি লেখকের ‘থিক্ আর্থ’ গল্পসংকলনে অন্তর্ভুক্ত । পরবর্তীতে এই বিখ্যাত গল্পটি হাওয়ার্ড গোল্ডব্লাট সম্পাদিত ‘চেয়ারম্যান মাও উড নট বী সারপ্রাইজড্’ গল্পসংকলনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ।
0 মন্তব্যসমূহ