স্বপন চলে গেছে আট মাস আগে। আমরা কেউ জানতাম না। নিঃশব্দে। তার স্ত্রী কাউকে জানায়নি। চেতলা থেকে কেওড়াতলা শ্মশান বেশি দূর নয়। আদি গঙ্গা পেরিয়ে এলেই হয়। সেতু আছে। স্বপনকে দাহ করে তাঁরা বসতিতে ফিরে গিয়েছিলেন।
স্বপনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। লিখত না কিংবা ওর লেখা ছাপা হতো না। এই রকম হয়। কতজন অনেক স্বপ্ন নিয়ে লিখতে আসেন। তারপর সেভাবে কিছু করে উঠতে পারেন না। লেখার জন্য ত্যাগ করেও শেষ অবধি প্রাপ্তি কিছুই না। হয়তো তার লেখা সেভাবে গ্রহণ করেনি পাঠক।
তবুও স্বপন লিখত। ছোট পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতো। বয়স হয়ে যেতে কর্মস্থল থেকে বিদায়। পেনশন ছিল না। বেশি বয়সে চাকরিতে ঢুকেছিল। সামান্য চাকরি। বেতন বেশি নয়। ফলে অবসরের পর হাতে তেমন কিছুই আসেনি যা দিয়ে বাকি জীবন ভাল ভাবে চলে যেতে পারে। আর এক জায়গায় ঢুকল হাজার দশেক টাকা বেতনে। খুব খাটনি স্বপনের। এই অবধি আমার জানা ছিল। না, আরো বেশি জানা ছিল। কী?
স্বপন আরম্ভ করেছিল সাড়া জাগিয়ে। সেই ৩৫-৩৭ বছর আগে নিজের পয়সায় একটি গল্পের বই, পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। ঝুপড়ির বাসিন্দা। তার ভিতরে অসামান্য দুটি গল্প ছিল, ঝুপড়ির বাসিন্দা, গলিত শবদেহ। এর পরে স্বপন লিখেছিল বুলগানিনের ব্যবসাঃ একটি পক্ষপাতমূলক অনুসন্ধান। আলাদা গল্প। সমাজকে তীব্র কষাঘাত।
স্বপন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন জানত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু জানত। বলত, লেখকের প্রকৃত জীবন অমন। মনে হতো ওর ভয় হয় না ? স্বপন আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। স্বপনের বন্ধুরা কেউ কবিতা লিখত, কেউ গল্প। এক বন্ধু খ্যাতিমান হয়েছে লিখে। এক বন্ধু কবি এবং অধ্যাপক। আর এক বন্ধু উকিল। এক বন্ধু বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করে সফল। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। স্বপন একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করত প্রথম জীবনে। সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হলো, কিন্তু কোম্পানি বলল, স্বপনের চাকরি আছে। সে সুপারভাইজার হয়ে অন্য ফ্যাক্টরিতে যাক। ভাল মাইনে। স্বপন এল বন্ধুদের কাছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে বসল। স্বপন বলল, তোরা যা বলবি, আমি তাই করব, আমাকে মালিক বেশি মাইনেতে অন্য কোম্পানিতে নিচ্ছে, আমার কি উচিত হবে এই অফার নেওয়া ? কতজনের কাজ গেল। আমি মালিকের দালাল হয়ে যাব ? বন্ধুরা স্বপনের চেয়ে ছোট বয়সে। তারা সকলে ভাবে বিপ্লব হবে। মানুষের সুদিন আসবে। স্বপন তুই রিফিউজ কর।
স্বপনের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না নিত্য। অভাব লেগে আছে। তা হোক, স্বপন লেখক। লেখক কেন মালিক পক্ষের লোক হবে? স্বপন বলল, তাহলে প্রত্যাখ্যান করছি। তাই-ই করল। বন্ধুরা এরপর চাকরি পেতে থাকে। তারা কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বপনের বয়স বেড়ে যেতে থাকে। শেষে বেশি বয়সে ছোট চাকরিতে ঢুকল। প্রুফ দ্যাখে। চাকরি পাকা নয়। যাই হোক, স্বপনের অদম্যতার শেষ নেই। এক জায়গা থেকে বই বের করল গল্পের। যে ছিল প্রকাশক তাকে অনেক গ্রাহক জোগাড় করে দিয়েছিল স্বপন। গ্রাহক বেশিরভাগ স্বপনের পরিচিত বন্ধুরা। প্রকাশক আগাম টাকা পেয়েও সেই বই বের করল দু-তিন বছর বাদে। আর গ্রাহকদের বই দিল না। স্বপন বলবে কী ? সে ছিল শান্ত প্রকৃতির, নম্র স্বভাবের মানুষ। বইটি মানের দিক থেকে ছিল ভাল। স্বপনের প্রথম বয়সের সব গল্প ছিল তার ভিতরে। আর একটি বই বেরিয়েছিল স্বপনের। ‘মুখোস যোদ্ধা’। উপন্যাস। যে পত্রিকা ছেপেছিল উপন্যাসটি সেই পত্রিকাই বই করে। বিদগ্ধ পাঠক ‘মুখোস যোদ্ধা’র সুনাম করেছিল। কিন্তু স্বপন সেই উপন্যাসের জন্য একটি পয়সাও পায়নি। এরপর নির্বাচিত ২৫ প্রকাশ করে এক প্রকাশক। এখানেই শেষ।
স্বপন কবে বিয়ে করেছিল আমি জানি না। আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না সেই সময়টায়। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হতো তার অফিসে। ঘাড় নিচু করে প্রুফ দেখে যাচ্ছে। ডাকলে উঠে এসে কথা বলত। ওর গল্পের বই নিয়ে আমার পত্রিকায় একটি রিভিউ লেখালাম ওর অধ্যাপক বন্ধুকে দিয়ে। স্বপন খুব খুশি। এমনি দিন যায়। এক সন্ধ্যায় আমার উত্তর কলকাতার বাড়ির সামনে আচমকা দেখি স্বপনকে। কোথায় এসেছিলে স্বপন? আমার বাড়ি আসবে না। না দাদা, এ পাড়ায় একজন কবিরাজ থাকেন। তাঁর কাছে ওষুধ নিতে আসতে হয়। ফিরব চেতলায়। রাত হয়ে গেছে। কার জন্য ওষুধ? স্বপন বলল, তার ছেলের জন্য। ছেলেটি অসুস্থ। তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একজন এই কবিরাজের সন্ধান দিয়েছে, দেখা যাক।
এর কিছুদিন বাদে আমার এক লেখক বন্ধু ফোনে বললেন, স্বপন খুব অসুস্থ। পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কিছু টাকা দিতে পারলে ভাল হতো। আমরা টাকা তুললাম স্বপনের জন্য। কেউ দিল, কেউ দিল না। হাসপাতালে গিয়ে ওর স্ত্রীর হাতে দিয়ে এলাম। স্বপন ফিরল হাসপাতাল থেকে। তারপর অবসর। আর এক জায়গায় ঢোকা। পুত্র আর স্ত্রী নিয়ে সংসার প্রতিপালন করতে হবে তো লেখককে। এই অবধি জানা ছিল। স্বপন আছে জানতাম।
পুজোর পর এক বন্ধু ফোন করল, তুমি কি জানো, স্বপন আর নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে মারা গেছে। নিঃশব্দে চলে গেছে। তার স্ত্রী কাউকে জানায়নি। এমন কি রবিকেও না। রবিকে আমি ফোন করলাম খবর নিতে, তুমি কি জানো রবি, স্বপন বেঁচে নেই। সে জানত না। একটু বাদে ফোন করে আমাকে বলল, সত্য। স্বপনের খবর তার জানা ছিল না। বাড়িতে ফোন করে জানল এখন। কোনো বন্ধুই জানে না। বিকাশ, সর্বজিত,ভাস্কর, অদীপ, কেউই না। কাউকে জানায়নি ওর স্ত্রী। অসুস্থ সন্তান নিয়ে সে বেঁচে আছে।
সেই জানার দু’মাসের মাথায় ডিসেম্বরে রবি চলে গেল। লেখক রবিশঙ্কর বল। স্বপন সেনের সঙ্গে নিশ্চয় তার দেখা হয়েছে। অনুজপ্রতিম দুই বন্ধু চলে গেছে। বাইরে কঠিন শীতের রাত। খুব গম্ভীর। আমি লিখছি এই শোক গাথা। হায়!
1 মন্তব্যসমূহ
real life and real writting
উত্তরমুছুন