বিশ্বদীপ চক্রবর্তী'র গল্প : দংশন


বাগানের ঘাসগুলো এখনো ভেজা। ভোরের শিশির নয়, বাগানের মাঝে মাঝে রাখা স্প্রিনক্লারগুলো সকালের আলো ফোটার আগেই জল ছড়িয়েছে খুব। হোস্টাস, ব্লু বেল আর অ্যানিমোনের সদ্য ফোটা পাপড়িগুলোয় জল টলমল করছে। পেরিয়ে যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে রুমির। বিশেষ করে অ্যানিমোনের ঝুঁকে পড়া গোলাপি পাপড়িতে। হয়তো সেই ইচ্ছেটা শরীরে সামান্য চাঞ্চল্য জাগায়, না থাকা পায়ের কড়ে আঙ্গুলটা একটু ঝুঁকে পড়ে বাঁদিকে। মৈনাকের দেখতে পাওয়ার কথা না, তবু কি করে বুঝল কে জানে! মাথা ঝোঁকাল রুমির কানের কাছে, ফুল তুলে দেবো তোমায় কটা?

মৈনাকের এই সময়ে বেরোনোর তাড়া থাকে। এরপর ইন্টারস্টেটে বড্ড ভীড়। অফিসের ব্যাজ বুকে, কাঁধে ল্যাপটপ ঝুলিয়ে এই সময় হন্তদন্ত হয়ে বেরোত মৈনাক। রুমির যাওয়া থাকতো আরও এক ঘণ্টা বাদে। রুমি মৈনাকের গলায় সেই ব্যস্ততা চাইছিল। নিস্তরঙ্গ অবয়বের অভ্যন্তরে কুয়ো খুঁড়ে খুঁড়ে খোঁজার প্রচেষ্টায় সেটাই মনে করিয়ে দেয়, তোমার দেরী হয়ে যাবে না?

মৈনাকের গলা ব্রিয়সে বানের মত নরম। হাসিটাও। সকালবেলা বাগানে বসে তোমার সঙ্গে কফি খাওয়াটা সারাদিনের জন্য টনিকের কাজ দেয়।

বাব্বা, কথায় কি মাখন! কই আগে তো বসতে না। রুমি জানে। রুমি বোঝে এত নরম কথা, এটা ভালবাসার উষ্ণতা নয় কিছুতেই। দয়া। পবিত্র, শীতল।

বাগানের অনেকটা জুড়ে হিকরির ডালপালা ছড়ানো। তার ঠিক নিচেই লোহার টেবিল, দুদিকে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। অনেক সাধ করে রুমি কিনেছিল, কিন্তু এতদিন ব্যবহার হত না সেরকম। রুমির কথার কোন উত্তর না দিয়ে মৈনাক হুইল চেয়ারটা টেবিলের অন্যদিকে লাগিয়ে দিল। টেবিলের উপর কফির পট, দুটো কাপ, দুধের পাত্র, একটা প্লেটে কফি কেক আর ব্লু বেরী স্কোন রেখে গেছিল আগেই। মৈনাক চেয়ার টেনে লম্বা দুই কাপে কফি ঢেলে রুমির কফিতে দুধ মেশায় মন দিয়ে। নিজের কফিতে দুধ খায়না কোনদিনও।

রুমির কোলে টপ করে একটা বাদাম পড়ল। গাছের তলায় এই সময় অনেক বাদাম পড়ে। যদিও এগুলো বিটারনাট, তেতো। ওদের জন্য অখাদ্য। কিন্তু কাঠবেড়ালিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কফিতে প্রথম চুমুক দেওয়ার আগেই এক জোড়া কাঠবেড়ালি ছুট্টে চলে গেল মৈনাকের পায়ের তলা দিয়ে।

দেখো, তোমার কুমড়োপটাশ গুড মর্নিং বলতে চলে এসেছে সকাল সকাল।

এই কথাটা রুমিকে আর গোমড়া থাকতে দিল না। পরিচিতির তৃপ্তি মুখে ছড়িয়ে বলল, না, না এরা কুমড়োপটাশ না। কুমড়োর চোখটা লালচে, একেবারে অন্য রকম। ওরা আমাকে দেখলে পালায় না কক্ষনো।

ওরে ব্বাস, তুমি তো ওদের উপরে তোমার বশীকরন মন্ত্র চালিয়েছ দেখছি। মৈনাকের গলা থেকে হাসি উঠে এলো। দিন দিন ওরা আমার কম্পিটিটার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মানে? ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুমি।

হাসিটাকে তবু ধরে রেখে রুমির চোখে চোখ রাখল মৈনাক, আমি সব সময়েই জানি তোমার চোখে জাদু আছে। মনে নেই, মা বিয়ের পরে পরে মেজোমাসিকে বলেছিল আমার ছেলেটাকে কি মন্ত্র যে পড়িয়েছে, শুধু বউয়ের কথায় ওঠে বসে। তুমিই তো শুনতে পেয়ে আমাকে বললে। তখন সে কি রাগ তোমার।

আগেও মৈনাক এরকম কথা বলেছে আর ওরা দুজনে সেই নিয়ে কত হাসাহাসি। এখন শুধুই রুমির বাঁ পায়ের হাটুর নিচে চুলকানি পায়। কিন্তু চুলকান কিংবা হাত বোলানোর কোন উপায় না থাকায় মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে। কফিতে হালকা চুমুক দিতে দিতে মৈনাক চেয়ে থাকে, রুমির মুখের আলো ছায়ার কারন জানতে পালটা প্রশ্ন করে না। বরং এই সময়ে ছুরি দিয়ে কফি কেক স্লাইস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেশী বেশী। রুমির মুখের রেখাগুলো একটা একটা করে মুছে গেলে এক খন্ড কেক ধরে রুমির মুখের সামনে। অপেক্ষা করে থাকে রুমির পাতলা ঠোঁটের আড়াল পেরিয়ে মুক্তোদানা দাঁতের ফাঁক হওয়ার জন্য। রুমি মুখ যতসম্ভব চেপে মৈনাকের চোখে চোখ বিঁধিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা আমার একটা পা না হয় নেই, কিন্তু হাত তো আছে। নিজে খেতে পারি না?

কোন কার্পণ্য না করেই হাসল মৈনাক। সেটা তো আমাকে খাওয়ানোর জন্যে।

আমাকে এত বেশী বেশী ভালবাসছ কেন মৈনি? আমার বাঁ পাটা কাটা গেছে বলে?

এই প্রশ্নটা তো প্রথম শুনল না। তাই কেক ধরা মৈনাকের হাত একটুও কাঁপল না। মৈনাক রুমির চোখ থেকে চোখ না সরিয়েও দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিল। রুমির চুলে জড়ানো দুলহীন কানের লতি, গলায় না বলা শব্দের ওঠানাবা, ঠেলে আসা কন্ঠার হাড়, পেস্তা সবুজ ছোট হাতা টি শার্ট যার বুক জোড়া অ্যান আরবার ম্যারাথন ২০১৮ লেখাটা কালো সাদা চেক ফ্লানেলের পাজামার নেতিয়ে পড়া বাঁ পায়ের সঙ্গে অহেতুক কৌতুক জুড়েছে- এই সমস্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৈনাকের চোখ রুমির অন্তঃকরনে ঢুকতে চাইছিল। থেমে থেমে যখন বলল, আমি তোমাকে আনতে যেতে পারতাম, যাই নি। তাই দোষটা আমার ছিল বলে ভাবতেই পারো। কিন্তু ভালবাসা ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কষে হয় না রুমি। কথাটায় গোপন কৃষ্ণ গহ্বরের আলগোছ টান। তাই তাড়াতাড়ি মুখের হাসিতে নতুন কথা মেশালো মৈনাক, তোমার বাঁ পাটা সত্যি তো যায় নি, তুমি তো ওর নড়া চড়া বেশ টের পাও এখনো।

ডক্টর হিল তো বলে ফ্যান্টম লেগ। না থেকেও রয়ে গেছে। নতুন পা লাগানোর পরেও থাকবে কি না কে জানে! কবে লাগাবে ওরা?

রুমির প্রস্হেটিক্স লেগ তৈরী হয়ে গেছে, কিন্তু হাঁটুর তলাটা পুরোপুরি সেরে না ওঠা অবধি দেবে না। তিন মাস তো হয়ে গেল, দেখো আর কদিন। ডক্টর হিল তো ছমাসের কথা বলেছিল। বলতে বলতে মৈনাক উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার ঝুঁকে পড়ে রুমির গালে হালকা চুমু এঁকে দিল। রোদ উঠে গেলে ঘরে চলে যেও কিন্তু। না হলে মুখ পুড়ে যাবে একদম।

হিকরির ছায়া অনেকদূর ছড়ায়। তাছাড়া রুমি হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়া খুঁজে নিতে পারে চাইলেই। কিন্তু মৈনাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অবধি টেবিলের পাশ থেকে একটুও নড়ে না রুমি। মৈনাকের গাড়ি এখন ছুটবে ইন্টারস্টেটের গতিময়তায়, মৈনাক দেখতে দেখতে সেঁধিয়ে যাবে একটা কর্মব্যস্ত দিনের পেটের ভিতর। রুমির দিন আস্তে আস্তে সরতে থাকবে রোদের সঙ্গে। রুমি হাতের স্কোনের বাকিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাগানের ঘাসে। একটু বাদে গিয়ে তুলে গার্বেজ বিনে ফেলতে হবে আবার। নোংরা একদম সয় না রুমির।

কদিন আগে রুমিরও একটা ছোটার জীবন ছিল। মৈনাকের থেকেও বেশী। সেরকমই এক ব্যাস্ত দিনের শেষে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছিল। নতুন কিছু নয়, সপ্তাহে দুই একবার তাকে তো যেতেই হত। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই ইকোরস রোডে এমনভাবে অ্যাকসিডেন্টটা হল। তিনমাস হয়ে গেছে,তবু ভাবলেই ভয়ে ভিতর থেকে চেপে ধরে। বাগানের চেয়ারে বসেও সিঁটিয়ে যায় রুমি।

সেদিন একটু বেশিই টায়ার্ড ছিল, খুব সকালের ফ্লাইটে ফ্লোরিডা গেছিল। ফোনে মৈনাক বলল, আমি আসবো তোমায় নিতে? মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, তার হয় ওরকম মাইগ্রেনের থেকে। কিন্তু গাড়ি পারকিং-এ, সেটাই বা কি করে হয় বলে রুমি না করে দিয়েছিল। মৈনাক যদি আর একটু জোর করত সেদিন! কেন করলে না মৈনাক?

এইসময় কাঠবেড়ালিটা আবার দৌড়ে এলো। এবার কুমড়োটা। থমকে দাঁড়িয়ে লালচে চোখে জুলজুল করে চেয়ে আছে রুমির দিকে। রুমি হাতের কাছে বিটারনাট খুঁজে খুঁজে রাখে ওর জন্য, কে জানে তাকেই গাছ বলে ভাবছে কিনা! গলার মধ্যে হাসল রুমি। হাত ঘষটে টেবিলের উপরে রাখা বিটারনাটগুলো থেকে দুটো তুলে নিল, চোখ সরাসরি কুমড়োর চোখে। কাঠবেড়ালির কি পলক পড়ে না? নাকি রুমিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকে মৈনাকের মত? এটা ভাবতেই নিস্তরঙ্গ সকালে দুষ্টুমি ছড়িয়ে পড়ল। আরও ঘন চোখে তাকাল কাঠবেড়ালিটার দিকে। কাঠবেড়ালির দুটো চোখ থাকে দুদিকে, নিজের দৃষ্টিতে বেঁধে ওদের চাহনি ঠিক কপালের মাঝখানে আনার চেষ্টা করল রুমি। তারপর দুই হাতের বিটারনাট কুমড়োর দুইদিকে ছুঁড়ে দিয়ে চোখের ইশারা করল ডানদিকে। কি আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো মাথা ঘুরিয়ে ছুটল ডানদিকে!

ও কি সত্যিই ওর ইশারা বুঝতে পারল? সেকি কাঠবেড়ালি ট্রেন করতে পারছে? পারুক না পারুক সকালবেলার স্নিগ্ধতা বেড়ে গেল নিঃসন্দেহে। এই কথাটা রসিয়ে রসিয়ে বলেছিল মৈনাককে সন্ধ্যাবেলায়। ও হাসতে হাসতে বলল, বলেছিলাম না তোমার চোখে জাদু আছে। তুমি বাঁ দিকে ছুঁড়ে ডানদিকে যেতে বললেও যেতো ঠিক।

ধ্যাত, তাই আবার হয় না কি?

মুখে বললেও পরেরদিন সকালে কথাটা বিনবিনিয়ে উঠল রুমির মাথায়। দেখি না কি হয় ভাব নিয়েই আজকে কুমড়োর জন্যে একটা বিটারনাট হাতে নিয়েছিল রুমি, চোখের ইশাড়ায় বাঁ দিক দেখিয়ে ডানদিকে গড়িয়ে দিয়েছিল এবার। রুমির শরীরে একটা আনন্দের স্রোত কুলকুল করে বয়ে গেল যখন বোকা কাঠবেড়ালিটা ছুট্টে চলে গেল বাঁদিকে। কিছুক্ষণ বাদে লেজ তুলে ফিরে এলো। ওর চাহনিতে তখন কেমন বোকা বোকা ভাব, যেন বলছে ঠকালে কেন? ওকে তখন কোলে তুলে গুচুম গুচুম করতে ইচ্ছে করছিল রুমির।

সত্যিই কি তার চোখ? না কি মনের থেকে কোন তরঙ্গ সিঁধিয়ে যাচ্ছে কাঠেবেড়ালির মাথায়। কুমড়ো কি তার মনের কথা বুঝতে পারে? এইসব ভাবতে ভাবতে ডেকেই ফেলল একবার। প্রথমে আস্তে, ফিসফিস করে, তারপর জোরে। কুমড়ো কুমড়ো! ও যখন সত্যি লেজ তুলে দৌড়ে এলো খুশির থেকেও অবাক হল বেশী। ওকে তো আগে কখনো ডাকেনি, ওর এই নাম নিয়ে মৈনাকের সঙ্গে আলোচনা করেছে শুধু। তাহলে ও রুমির কথা বুঝতে পারে? ওর লালচে চোখে চোখ রেখে বলল এবার, কোলে আয় কুমড়ো। রুমির ডান হাতের পাতা বাড়ানো ছিল ডান হাটুর উপরে। তার উপর ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে এক লাফে কোলে চলে এলো রুমির। কি নরম হয় ওদের শরীর, ঘন রোমের মধ্যে হাত চালাতে চালাতে বিস্ময়ে জেরবার হচ্ছিল রুমি। একটা কাঠবেড়ালি তার কথা বুঝতে পারছে? সেটা কি শুধু কুমড়ো বলে, ওর কোন বিশেষ ক্ষমতা আছে? নাকি সে ক্ষমতা আসলে রুমির? যে কোন কাঠবেড়ালিই কি বুঝতে পারবে তার কথা? মনে হতেই এবার গলা ছেড়ে ডাক দিল পটাশ, পটাশ! পটাশ এমনিতে লাজুক, এমন কিছু গা ঘেঁষাঘেঁষি করে না কুমড়োর মত। কিন্তু রুমিকে অবাক করে দিয়ে ছুটে এলো পটাশও। দুই কাঠবেড়ালি কোলে নিয়ে কি বকবক করছিল রুমি সে কি নিজেই জানে?

মৈনাক খুব আদর করে রুমির মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, ঘেঁটে দিচ্ছিল এদিক ওদিক। এই চুল নষ্ট হয়ে যাবে, এটা করছো কি?

আমি কদিন ছুটি নিই রুমি?

এই তো এতদিন ছুটি নিলে আমার অ্যাক্সিডেন্টের পরে? বেড়াতে যেতে চাও কোথাও?

না, না এমনিই, তুমি বড় একা থাকো সারাদিন।

একা কোথায়? এই যে বললাম কুমড়ো পটাশের সঙ্গে কিরকম ভাব হয়েছে আমার! বলতে বলতে থমকে গেল রুমি। মৈনাক, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করো নি? ভাবছ ডিপ্রেশানে পাগল হয়ে যাচ্ছি? নিজের অজান্তেই গলা উঁচুতে চলে গেল, চিঁড়ে গেল উপরে উঠে। হাতের কাছে কিছু থাকলে ছুঁড়েই দিত বুঝি।

তেমন কিছু করল না রুমি, আবার বললও না শিঞ্জিনির কথা। এরকম ভারী নামের প্রানীটি আসলে একটা ফড়িং। এত সুন্দর ফড়িং আগে কোনদিন দেখেনি রুমি। তুঁতে রঙ্গের শরীরে কালো রঙ্গের ডানা, হয় নাকি এমন? ঠিক মনে হয় তুঁতে পাড়ের কালো তাঁতের শাড়িতে কোন সুন্দরী মেয়ে। ওর ডানা চালানোর ঝিঞ্ঝিন আওয়াজেই হয়তো শিঞ্জিনি নামটা টপ করে মাথায় এসে গেছিল। ফড়িংটা প্রথমে বুঝতেও পারেনি যে এটা ওরই নাম। এর তো আবার গোল্লা দুটো চোখ ছাড়াও মাথার উপরে তিনটে। তবু যতদূর সম্ভব সব চোখকেই নিজের মায়ায় জড়ানোর চেষ্টায় রুমি ফিসফিস করে ডেকেছিল শিঞ্জিনি, শিঞ্জিনি! বারবার, অনেকবার। আঙ্গুলের ডগায় একদানা চিনি রেখে লোভাতেও চেষ্টা করছিল। এখন রোজ আসে। তার যেমন ইচ্ছে হুকুমও তামিল করছে শিঞ্জিনি। হাতের তালু বাড়িয়ে দিলে সেখানেই বসে পড়ে। রুমির গালের কাছে ঘুরে ঘুরে তার ডানার গান শোনানোর চেষ্টা করে। তারপর রুমি যেই বলে, ব্যাস অনেক হয়েছে তখুনি আবার শান্ত হয়ে হাতের পাতায়। রুমি কি ওকে সত্যিই জাদু করেছে? না হলে আসে কেন রোজ সকাল হলেই? ফুলে ফুলে বসা ভুলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় রুমির সঙ্গে!

এদের কথা মৈনাককে আর বলে না রুমি। এরা তার গোপন ঘর। না হলে মৈনাক সকালে কফি ঢালতে ঢালতে যখন জিজ্ঞেস করল আর কার কার সঙ্গে আলাপ হল তোমার রুমি? কোন পাখি বন্ধু হয় নি?

শিঞ্জিনির কথা বলেনি রুমি, বলেনি কানাইয়ের কথাও। কানাই একটা কেন্নো, কিন্তু ছোটবেলায় দেখা কেন্নোগুলোর থেকে একটু আলাদা। গায়ের রং গাঢ় বাদামী, পায়ের রং হলদে মতন। দুটো দাঁড়া আছে। একদিন টেবিলের গা বেয়ে উঠছিল। ছোটবেলায় কেন্নো দেখলে গা ঘিনঘিন করত রুমির। একবার মা গল্প শুনিয়েছিল কার নাকি কানের ফুটো দিয়ে কেন্নো ঢুকে গেছিল আর সেই কেন্নো মাথায় ঢুকে ঘর সংসার পেতেছিল। তারপর বহুদিন রুমি কানে আঙ্গুল চাপা দিয়ে শুয়েছে, সুযোগ পেলেই জুতোর তলায় পিষে মেরেছে পথ চলতি কেন্নোকে। আজ কিন্তু নিজের ক্ষমতা জাচাই করার লোভ সামলাতে পারল না। হুইল চেয়ার থেকে ঝুঁকে নিজের মাথাটা ওর কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করেছিল, এই তুই কে রে? কেন্নোটা চলা থামিয়ে শুঁড় ঘুরিয়েছিল রুমির দিকে। দেখেই রুমির শরীরে এক খুশির ঝিলিক। বুঝতে পারছে! রুমির চোখের দৃষ্টি ছুরির ধার পেলো যেন। একা থাকলে মাথার ভাবনারা সরাসরি চোখে পৌঁছে যায় অনায়াসে।

কেন্নো যে এমন করে পোষ মানবে ভাবলেই অবাক হয় রুমি। ওর প্রতিটা কথা বোঝে। আঙ্গুল বাড়িয়ে দিলে সুড়সুড় করে হাতে উঠে আসে। আঙ্গুলে করে চোখের সামনে তুলে আনে ওকে, আমাকে যেন আবার দাঁড়া বসিয়ে দিস না কানাই। নিজের মনেই হেসে খানখান হল রুমি।

বাইরে এসবের কোন প্রকাশ নেই রুমির।

তুমি আজকাল এত কম কথা বলো, কেন রুমি?

মৈনাকের অস্থির কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করল রুমি। তোমার আর আমার জগত যে আলাদা হয়ে গেছে মৈনাক। আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেছো তুমি। যেটা বলল না সেটা হল তুমি চলমান, আর আমি একটা হুইল চেয়ারে বন্দী। তোমার মহান হওয়া মানায়, লোক দেখানো বউ সোহাগ করে বাহবা পাবে। আমার জন্য শুধুই আহা উহু। এসব অবশ্য কিছুই বলল না রুমি, ভাবনাগুলো অনেক গভীরে টগবগ করে ফুটল শুধু।

আর কদিন রুমি, সেদিন ডাক্তার কি বললেন? তোমার পা সেরে এসেছে একদম। আর মাস খানেক হয়তো, তারপর তোমার প্রস্থেটিক পা লেগে গেলে তুমি আবার আগের মত –

আগের মত কিছুই হবে না আর, রাত্রে শোবার সময় খুলে রেখেই তো শোবো, তাই না?

নিজের অজান্তেই বাঁ পাটাকে চেয়ারের আড়ালে লুকোনর চেষ্টা করে মৈনাক। আচ্ছা আমি কি করতে পারতাম বলো তো?

আমি কি কিছু বলেছি? তোমার যেমন লিয়ার সঙ্গে কফি শপে বসে গল্প করার করো না বসে। বারন করেছি?

মানে?

ছন্দাদি আছে মৈনাকের অফিসে, সেদিন ফোন করে কথায় কথায় বলছিল, এই তো সেদিন মৈনাককে দেখলাম সাদা ছুঁড়িটার সঙ্গে কফি খাচ্ছে। ওইভাবেই কথা বলে ছন্দাদি সাদা ছুঁড়ি, কাল্লু ভাই, চিঙ্কি চামকি। আগে সবার সঙ্গে বসে এইরকম কথায় রুমির ঠোঁটে হাসি খেলত না, মনে মনে বিরক্ত হত। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল বোধহয় এই খবরটা দেওয়ার জন্যেই ছন্দাদি আরও ফোন করেছে। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, নামও জেনেছিল। লিয়া।

রুমির নৈঃশব্দে আরও রেগে গেল মৈনাক। তুমি কি বাড়িতে বসে বসে এইসবই ভাবছো রুমি? অফিসে কতজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, আগেও বলেছি তো। অফিসের কাফেটারিয়াতেও এমনি অনেক মিটিং থাকে।

চাপা কথার কয়েক ফোঁটা পাথর ঠেলে ছিটকে বেরল এবার। তোমার বুদ্ধদেবপনাগুলো লিয়া, ক্যাথি আর শর্মিলাদের জন্য তুলে রাখো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার হুইল চেয়ারে বসে থাকার কপাল, থাকব। তাই বলে কৃষ্ণলীলা বন্ধ করতে বলি নি তোমায়।

মৈনাক রুমির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওর বাঁ হাত রুমির ডান হাঁটুতে, ডান হাত রুমির গালের উপর আলতো করে রাখল মৈনাক। আজকে অফিসের ধড়াচুড়ো চাপায়নি, হাফপ্যান্ট আর টি শার্টে এখনো। তাই ঘাসে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে বসতে তুমি এমন করে? নিজের মনেই বলল রুমি। এরকম গা বাঁচানো আলগা আদর করা সহজ। যার হয়েছে শুধু সেই বোঝে। মৈনাকের আবেগ কিছুতেই উষ্ণ করতে পারছিল না রুমিকে। মৈনাকের সকাল বেলার উপচে পড়া ভালবাসায় গা রিরি করে রুমির। কই রাত্রে শোবার সময় তো তাকে খুঁজতে আসে না মৈনাকের হাত, বরং সে এগোতে চাইলেও সরে যায়। বলে আরও কদিন যাক। আমার পায়ে ব্যাথা লেগে যাওয়ার ভয় না হাতি! বোঝে না যেন রুমি। তার চেয়ে বলুক না কেন মুখে, এক পা না থাকা মেয়ের শরীর বিছানায় বিসদৃশ লাগে তার।

আমি কি করলে তুমি খুশি হও রুমি? যতদিন তুমি নিজের পা না পাচ্ছো, আমি বাড়ি থেকে কাজ করি?

হ্যাঁ, নিজের পা! এই উপহাসটা বুকের মধ্যে চেপে মুখে বলল, সেতো করবেই, না হলে আর আমার উপর নজর রাখা হবে কি করে?

মৈনাকের চোখ বিস্ময়ে স্তিমিত হয়ে গেল, একটু কি জলের ছোঁয়া? তাহলে তোমাকে আমি অফিসে পৌঁছে দিই, তুমি আবার অফিস শুরু করো।

আমি ঘণ্টা দুয়েকের বেশী বসে থাকতে পারি না মৈনাক, ক্লান্ত হয়ে পড়ি। না হলে বাড়ি থেকেই অফিস শুরু করতাম। মৈনাকের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রুমি, বেশী তাকালেই ওর মনটা নরম হয়ে যাচ্ছিল। মৈনাক ওর মাথা গুঁজে দিয়েছে রুমির কোলের মধ্যে, ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছিল। ওকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি হয়তো সত্যিই ভালো মৈনাক, আমিই আর পারছি না। এই পৃথিবীটা ঘুরে বেরাচ্ছে, আর আমি স্থবির হয়ে আছি। ভাল লাগছে না আমার। কিন্তু এসব কিছুই না বলে চোখ সরিয়ে নিল রুমি। তখনই দেখল গুটি গুটি পায়ে কানাই আসছে। ঘাস সরিয়ে সরিয়ে টেবিলের পায়া অতিক্রম করে। একটু ঝুঁকে পড়ল রুমি, হাতের পাতা রাখল এবার মৈনাকের মাথায়। আদর বুঝে মৈনাক নিজের মাথাটাকে আরও গুঁজে দিল রুমির কোলের মধ্যে। কেমন অদ্ভূত একটা ঝিলিক এবার রুমির চোখে। ফিসফিস করে বলল, দে কানাই দে।

এমন বাধ্য ছেলে! দিল ঠিক দাঁড়াটা বসিয়ে মৈনাকের পায়ে।


লেখক পরিচিতি
বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
মিশিগানে থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ