মৌরী তানিয়ার গল্প : উপহার


১.

শুক্রবার ছুটির এক সন্ধ্যায় মিশু বাড়ি থেকে নিয়ে আসা অ্যালবাম থেকে তার মার ছবিগুলো বের করে দেখছে। ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়তেই মিশুর শ্বশুর ইসমাইল হোসেন চমকে উঠলেন। মিশুকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে?

মিশু বলল, ছবিগুলো তার মা শিরিন বেগমের।

শ্বশুর দিকে তাকিয়ে মিশু বলল, মা তখন কি সুন্দর ছিলেন তাই না বাবা! আমার বিশ্বাসই হতে চায় না এগুলো মার ছবি!

অন্যদের তুলনায় সুন্দরী শিরিন বেগমকে মিশুর শ্বশুর ইসমাইল হোসেনের বেশি ভাল লাগত। কারণ অন্যদের মতো চাওয়ার আগেই শরীরটা উজার করে দিত না সে। সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে শিরিন বেগমের যে জিনিসটি ইসমাইল হোসেনকে বেশি আকর্ষণ করত তা হলো তার দেমাগী স্বভাব।

তার কাছ থেকে অনেক কসরত করে শরীরটাকে আদায় করতে হতো।সেকারণেই ইসমাইল হোসেন দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এই মুখটি ভুলতে পারেন নি। যদিও এখন এই মুখটি মনে পড়লে তিনি বার বার

আস্তাগফিরুল্লাহ্, নাউজুবিল্লাহ পড়েন। তিনি নামাজে বসে আগেকার গুণার জন্য মাফ চান বার বার। কিন্তু তবুও যুবতী শিরিন বেগমের সুন্দর মুখটি তার মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

সেদিন ইসমাইল হোসেন শিরিন বেগমের জন্য লাল আর নীল রংয়ের সুন্দর দেখে দু জোড়া ব্রা নিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাগুলো পড়লে শিরিন বেগমকে কি যে ভালো লাগবে! সে দৃশ্য কল্পনা করে শিরিন বেগমের কাছে যাওয়ার আগেই তার অস্হিরতা বাড়ছিলো। কিন্তু সেদিন যাওয়ার পর ইসমাইল হোসেন শোনেন, শিরিন বেগম পালিয়েছে!

মিশুর হাতের ছবিগুলো দেখার পর ইসমাইল হোসেন সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। ছি! ছি! একটা পতিতার মেয়ে তার ছেলের বউ মিশু! তিনি
শিরিন বেগমের পালিয়ে যাওয়ার সময়টার সঙ্গে মিশুর জন্মের সময়টা মিলিয়ে দেখলেন। তারমানে মিশুর বাপের কোন ঠিক নেই।

প্রথমদিন শিরিন বেগমের মুখ থেকে শোনা সেই গল্প ইসমাইল হোসেনের কানে বাজতে লাগল ‘গ্রামে মোহরা দিতে এলে আর্মির এক সেপাইয়ের সঙ্গে তার বাড়ি ঘরের কোন খোঁজ-খবর না জেনেই আমার সৎভাইরা আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ে হওয়ার পনেরদিন পর আমার স্বামী চলে যায়। চলে যাওয়ার কিছুদিন পর তার এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি চিঠি পাই, সেই চিঠি পড়ে জানতে পারি, আমার স্বামী রোড একসিডেন্টে মারা গিয়েছে। সেই চিঠিতে প্রেরকের কোন ঠিকানা ছিল না, তাই আমি আর তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। মাসদুয়েক পর আমি আমার গর্ভে মিশুর অস্তিত্ব টের পাই। সৎ ভাইদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মিশু যখন সাত মাসের পেটে তখন আমি তার বাবার কাছ থেকে শোনা তাদের বাড়ির ঠিকানা মিরপুর দশ নাম্বার সেক্টরে মিশুর দাদা-দাদিকে খুঁজতে আসি। আমি এবাড়ি সেবাড়ি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে নি:সন্তান রহমান চাচার এই বাড়ির সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। এরপর আমি তাদের মেয়ের মতো হয়ে ওনাদের সঙ্গেই থেকে যাই।’

তারমানে গল্পটি মিথ্যে, বানোয়াট! ইসমাইল হোসেন মাথা চাপড়াতে
চাপড়াতে বলেন, জারজ! জারজের পেটে আমার বংশধর জন্মাবে! তা হতে পারে না। তা হতে দেয়া যায় না।

২.

ভার্সিটির প্রথম বর্ষেই নিরব আর মিশুর প্রেমের শুরু। ঢাকা ভার্সিটি থেকে খুব ভাল রেজাল্ট করে বের হয়ে মিশু একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেয়। নিরবও ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাস করে একটি ব্যাংকে চাকুরী করে। এরপর তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে নিরবের মা-বাবা বিয়ের তারিখ পাকা করতে মিশুদের বাড়িতে আসে। মিশুর হবু শ্বশুর শাশুড়ির দেখে শিরিন বেগম সেদিন মিশুর বাবার সম্পর্কে গল্পটি বানিয়ে বলেছিলেন। মিশুও এই গল্প শুনেই বড় হয়েছে।

কিন্তু প্রকৃত সত্যটা হলো, ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো শিরিন বেগম সৎভাইদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গ্রামের এক বড় ভাইয়ের দেয়া চাকরির প্রলোভনে পড়ে তার সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকায় পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যান। তিনমাস পতিতালয়ে থাকার পর এক রাতে পতিতালয় থেকে পালিয়ে তিনি দৌড়াতে শুরু করেন। একসময় তিনি রহমান সাহেবের বাড়ির গেটের সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান।

নি:সন্তান রহমান সাহেব এবং তার স্ত্রী খুব দয়ালু মানুষ। সব কথা শোনার পর তারা শিরিন বেগমকে তাদের মেয়ে হিসেবে তাদের বাড়িতে
রেখে দেন।

মাসখানেক পর শিরিন বেগম তার গর্ভে অন্যরকম এক অনুভুতি টের পেলে তিনি তার চাচিকে মানে রহমান সাহেবের স্ত্রীকে বিষয়টি জানান।

চাচি তাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে শুরু করেন এবং যথাসময়ে মিশু জন্মগ্রহণ করে।

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নি:সন্তান চাচা-চাচিকে শিরিন বেগম মা-বাবার মতোই দেখেছেন, সেবা যত্ন করেছেন। মিশু ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় এক বছরের ব্যবধানে চাচা-চাচি মারা যান। নি:সন্তান হওয়ায় মারা যাওয়ার আগে তারা দু ইউনিটের তিন তলা বাড়িটি শিরিন বেগমের নামে লিখে দেন।

৩.

মিশুর মা পতিতালয় থেকে পালিয়ে যখন রহমান সাহেবের বাড়িতে আসেন, তার মাস দুয়েক পর রহমান সাহেব নিজের ক্যামেরা দিয়ে মিশুর হাতে থাকা শিরিন বেগমের রঙিন এই ছবিগুলো তোলেন। তখন মিশুর মা আঠার বছরের সুন্দরী যুবতী। এখন সেই সুন্দর চেহারা তার নেই।

শিরিন বেগমকে ভেতরে ভেতরে পতিতালয়ের সেই দুর্বিসহ তিন মাসের
জীবন কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দিয়েছে। এতবছর পর এখনও তিনি ঘুমের
মধ্যে প্রায় রাতে চিৎকার করে ওঠেন। এই বিভীষিকা তার পিছু ছাড়েনি
একমুহুর্তের জন্যও। যুবতী বয়সের সুন্দরী সেই শিরিন বেগমের সঙ্গে এখনকার শিরিন বেগমের চেহারার আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিশুর হতের ছবিগুলো দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না ছবিগুলো এখনকার শিরিন বেগমের। তাই এখনকার শিরিন বেগমকে মিশুর শ^শুর ইসমাইল হোসেন চিনতে পারেননি।

ইসমাইল হোসেনের গায়ের রং ফরসা। পুরো ঠোঁট আর চোখের উপরে
চওড়া আর পুরো জোড়া ভ্রুতে যুবক বয়সে ইসমাইল হোসেন দেখতে
খুব সুন্দর, হ্যান্ডসাম ছিলেন। শার্ট-প্যান্ট পড়তেন। কিন্তু অবসর গ্রহনের পর তিনি মুখ ভর্তি লম্বা চাপ দাড়ি রেখেছেন, পাজামা পাঞ্জাবি পড়েন। মুখভর্তি লম্বা দাঁড়ি রাখায় খুব ভালভাবে খেয়াল না করলে
তার ফর্সা গায়ের রংটা সহজে কেউ বুঝতে পারে না। তার যুবক বয়সের
ছবি দেখলে তাকেও কেউ এখনকার চেহারার সঙ্গে মেলাতে পারবে না। তাই শিরিন বেগমও এখনকার ইসমাইল হোসেনকে চিনতে পারেননি।

৪.

সারারাত ছটফট করার পর ইসমাইল হোসেন সকালে উঠে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বিষয়টি বলেন। নিরব কথাটি বিশ্বাস না  করে বাবার উপর ভয়ংকর ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলে ইসমাইল হোসেন ছেলেকে ঠান্ডা মাথায় পুরো বিষয়টি শোনার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি ছেলেকে বলেন, বিয়ের দিন মিশুর মাকে দেখে আমার পরিচিত একজনের সন্দেহ হয় এবং তিনি আমাকে সেদিনই কথাটা বলেছিলেন কিন্তু আমি তার কথাটি বিশ্বাস করে তাকে অপমান করেছিলাম। কাল রাতে তিনি আমাকে জানালেন, সেদিন তিনি যা বলেছিলেন তা সত্যি। লোকটি আরও বলেন, প্রমাণ হিসেবে শিরিন বেগমের গ্রামে যেয়ে খোঁজ নিলেই জানা যাবে আসল সত্যিটা।

নিরব বাবাকে নিয়ে শিরিন বেগমের গ্রামে যায়। তার ভাই ও গ্রামের অন্যান্য লোকদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিরব নিশ্চিত হয় তার
বাবার সেই পরিচিত লোকটির কথায় ঠিক, শিরিন বেগম পতিতা!

‘তুমি পতিতার মেয়ে! পতিতার মেয়ের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক
থাকতে পারে না। একটা পতিতার মেয়ে আমার স্ত্রী! একটা পতিতার
মেয়ের সঙ্গে আমি এক ছাদের নীচে, এক বিছানায় এতদিন শুয়েছি,
একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায়, ঘৃণায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে!’

নিরব এক নি:শ্বাসে কথাগুলো  বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিয়ের

চারমাসের মাথায় মিশু স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসে।

‘তুমি পতিতা! আমি পতিতার মেয়ে! এ লজ্জা! ভয়ংকর লজ্জা মা! এ লজ্জা নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না!’

শিরিন বেগম স্থির চোখে মেয়ের কথাগুলো শুনলেন। এরপর তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশুর শ্বশুর ইসমাইল হোসেনের কপালের বাম পাশের জন্মগত লম্বাটে কালো মোটা দাগটি। ফর্সা রং, পুরো ঠোঁট, চওড়া আর পুরো জোড়া ভ্রুর ইসমাইল হোসেনকে কপালের সেই কালো
দাগসমেত চিনতে এখন আর কষ্ট হলো না শিরিন বেগমের।

এরপর শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করেন, পতিতার মেয়ে হওয়াটা তোমার জন্য লজ্জা, ভয়ংকর লজ্জার বিষয় সেটা আমি মানি। পতিতার মেয়ে হওয়ার কারণে তোমার মারা যাওয়া উচিত এ বিষয়েও তোমার সঙ্গে আমি একমত। তুমি অবশ্যই মারা যাবে আমি তোমাকে একটুও বাধা দিব না। কিন্তু নিরবকে নিয়ে একসঙ্গে মরতে হবে তোমাকে।

মিশু চিৎকার করে ওঠে, কেন, নিরব কেন মারা যাবে? নিরব কি পতিতার
ছেলে? কিসের লজ্জা নিরবের?

না, নিরব পতিতার ছেলে নয় এটা ঠিক। কিন্তু এই পতিতারা যাদের কারণে পতিতা হয়। বউ, বাচ্চা রেখে যারা পতিতালয়ে সুখ খুঁজে বেড়ায়। যাদের মতো পুরুষ না থাকলে পতিতা নামের শব্দটি পৃথিবীতে থাকত না, ডিকশনারিতে থাকত না। তাদের ছেলে হয়ে নিরবেরও লজ্জা পাওয়া উচিত, ভয়ংকর লজ্জা পাওয়া উচিত। বরং তোমার চেয়ে নিরবের লজ্জাটা বেশিই হওয়া উচিত। কারণ নিরবের বাবারা আগে চাহিদা তৈরী করেছে বলেই পতিতা নামের ভোগ্য পণ্যটি এই সমাজে সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের কোন

পতিতা যৌন ক্ষুধা মেটাতে শখের বসে ঘরে স্বামী, বাচ্চা রেখে খদ্দেরদের কাছে পতিতালয়ে আসে না। সমাজে কোন পতিতা ইচ্ছে করে পতিতা হয় না। তারা বাধ্য হয়ে পতিতা হয়। নিরবের বাবারা বাধ্য হয়ে পতিতাদের খদ্দের হয় না। তারা স্ব ইচ্ছায়, বাড়তি ফুর্তি করতে বউ, বাচ্চা ফেলে পতিতালয়ে আসে। তোমার চেয়ে নিরবের লজ্জা হাজারগুণ, লক্ষগুণ হওয়া উচিত! নিরবেরও লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ। নিরব যদি লজ্জায়, ঘৃণায় মারা যায় তুমিও অবশ্যই মারা যাবে, আমি চেয়ে চেয়ে তোমার মৃত্যু দেখব, কোন বাধা দিব না।

৫.

নিরবের জন্মদিন আজ। একমাত্র ছেলের জন্মদিন ইসমাইল হোসেন খুব ধুমধামের সঙ্গে পালন করেন। এবার আরও বেশি বড় করে আয়োজন করেছেন। মিশু চলে গিয়েছে প্রায় দিন পনের হলো। ছেলের মনটা বেশ খারাপ দেখছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি ভাবেন, কিছুদিনের মধ্যে ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিলে আবার ঠিক হয়ে যাবে। বাড়ি আত্মীয়- স্বজনে ভরপুর। এমন সময় মিশুদের ড্রাইভার সুন্দর একটা গিফটের প্যাকেট এনে নিরবকে দেয়। এত অপমানের পরও মিশু তাকে জন্মদিনের গিফট পাঠাল, বিষয়টি নিরবের কাছে খুব অবাক লাগল। কারণ মিশু খুব দাম্ভিক মেয়ে। নিরব খুব আগ্রহ নিয়ে সুন্দর প্যাকেটটা খুলল।

একটা বিষের প্যাকেট আর একটা চিরকুট!

লেখা, আমার মায়ের মতো পতিতাদের খদ্দেরের ছেলে হওয়ার লজ্জা আর ঘৃণা নিবারণের জন্য আমার পাঠানো উপহারটা তোমাকে সহায়তা করবে নিরব!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ