এক/
বলরাম সাহা আজও খুব সকালে উঠেছেন,যেমনটা উঠেছেন সারা জীবন। কিন্তু তার দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে একটু পরেই। তিনি এখনো জানেন না।
দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই নেহায়েত সাদামাটা। স্ত্রী এখনো ঘুমে, দেরিতে উঠার অভ্যাস, দশটা এগারটার আগে উঠবেন না। কফির মগ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন বলরাম। রান্না ঘরের পেছনে একটা বড় কাঁচের দরজা। দরজা ঠেলে বারান্দায় বের হয়ে একধাপ নামলেই প্রশস্ত ব্যালকনি। টিলার উপরে বাড়ি, ব্যালকনিতে দাঁড়ালে শহরের অর্ধেকটা দেখা যায়। বহু বছর আগে বাড়িটি কেনার সময় এই দৃশ্যপটটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। সামনে টেনিস কোর্ট, খেলার মাঠ, মাঠ পেরিয়ে লেক, লেকের পাড়ে হাঁটা পথ, ওই পাড়ে সমান্তরাল রেল লাইন—এক দৃষ্টিতে সব নজরে আসে। ঝমঝমা বৃষ্টি বা তুখোড় তুষারপাত ছাড়া বলরামের আর সব দিন শুরু হয় এই অনাবিল পরিবেশের মুক্ত হাওয়ায়। কফি শেষ করার পর এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ততক্ষণে ফুটন্ত সূর্যের উজ্জ্বল হলুদ আলো এসে তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ে। জ্যামাইকান ব্ল্যাক কফির তেজ আর বুক ভরা শ্বাস তাকে সারা দিনের জন্য প্রস্তুত করে দেয়।
দুই/
বলরাম সাহা এখন হিয়ারিং এইড ছাড়া কানে শুনতে পান না। বছর পাঁচেক আগে, সমস্যাটা যখন শুরু হয়, তখনো নিজে ঠিকমতো বুঝেননি। তার অফিস সহকারী ভ্যালরি ধরিয়ে দেয় বিষয়টা, বেশ আমতা আমতা করেই বলেছিল আশঙ্কার কথা।
- যদি কিছু মনে না করো তো একটা কথা বলি?
- কী আশ্চর্য, ভ্যালরি! আমাকে কিছু বলতে অনুমতি চাও নি তো কখনো আগে।
- না, মানে, বিষয়টা কীভাবে নেবে সেই চিন্তা করেই জিজ্ঞেস করলাম।
- বলো, বলো, তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
- আমার মনে হয় তোমার কানটা একটু দেখানো দরকার ডাক্তারকে। আসলে আমার বাবারও এই সমস্যা ছিল, তাই আমি এ বিষয়ে জানি কিছুটা। আগে ভাগে ধরা পড়লে অনেক রেমেডি আছে।
মেয়েটি এত সুন্দর করে বলেছিল যে রাগ করার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু পরের কয়েকদিন বেশ মন খারাপ ছিল। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে বিষয়টা নিজে একদম বুঝতে পারেন নি আগে। বলরামের নিজের বাবারও কানের সমস্যা ছিল, তার পরেও বুঝতে পারেন নি l অথচ ভ্যালরি ধরিয়ে দেয়ার পর এখন স্পষ্ট টের পাচ্ছেন, মানুষজনের ভেতর সবার কথা আলাদা করে শোনতে বেশ অসুবিধা হয় তার। আওয়াজ না বাড়ালে টিভির কথাগুলোও ঠাহর করতে অসুবিধা হয়। বিষয়টা নিজে বেশ বুঝেছেন বলরাম, কিন্তু তার স্ত্রীকে সহজে বুঝাতে পারেনি।
- এও তোমার আরেক ভণিতা, আমার কথা শুনবে না তাই বলো, কানকে দোষ দাও কেন?
- এসব কী বলো তুমি, নন্দিনি। মানুষের কী সমস্যা হতে পারে না? আমার বাবারও তো কানের সমস্যা ছিল, দেখনি?
- তাই যদি হয় তো ডাক্তার দেখাও না কেন?
ডাক্তার দেখিয়েছেন বলরাম। রোগের কাঠখোট্টা নাম, প্রেসবাইকিউসিস। ডাক্তার বলেছেন, এর কোনো চিকিৎসা নেই, বরং ধীরে ধীরে বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে এই সমস্যা। অবস্থা খুব খারাপ হলে হিয়ারিং এইড লাগাতে হবে।
কথাটা শোনেই বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিলেন বলরাম। কানে যন্ত্র লাগিয়ে কথা শুনতে হবে চিন্তা করতেই ডিপ্রেশন এসে ভর করে মনে। ঠিক করলেন অপেক্ষা করবেন, একদম শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন। বছর কয়েক পরেই তার রিটায়ার করার কথা, ওই পর্যন্ত যদি টেনে টুনে চালানো যায় তাহলেই হল। বাড়ির ভেতরে যন্ত্র কানে লাগিয়ে শোনতে আপত্তি নেই, অস্বস্তিটা আসলে বাইরে বের হওয়ার সময়, জনসমক্ষে যন্ত্রনির্ভর প্রতিবন্ধীর জীবন ঊনসহা মনে হয় তার কাছে।
কিন্তু বলরামের এই মনোভাব বেশি দিন টিকেনি, স্ত্রীর ক্রমাগত চাপের কাছে হার মেনেছেন দ্রুত।
- শোন, তোমার এই না শোনার বাতিক কিন্তু আমাদের রিলেশনশিপে ফাটল ধরাচ্ছে। আমি কথা বলব আর তুমি শোনবে না, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
- আহা, তেমন বড় কোনো সমস্যা তো হয়নি এখনো, আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী?
- অনেক ক্ষতি, সেটা বুঝলে তো আজই দৌড়াতে ডাক্তারের কাছে।
বলরাম আর দেরি করেনি, বলতে গেলে দৌড়েই যেতে হয়েছে অডিওলজিস্টের কাছে। তবে সব কিছু শেষ হওয়ার পর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন কানের ভেতরের ছোট্ট যন্ত্রটা আসলে বাইরে থেকে দেখাও যায় না। দারুণ কার্যকরী একটা বস্তু, এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছেন এটা তার অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। বিষয়টা ধরিয়ে দেয়ার জন্য ভ্যালরির কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো নন্দিনিকে একবারও ধন্যবাদ জানানো হয়নি। কেন? হিয়ারিং এইড নেয়ার পরেও নন্দিনির কথা না শোনা সম্পর্কিত অভিযোগ বন্ধ হয়নি, এজন্য? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার চাপাচাপিতেই যন্ত্রটা নিয়েছে সে। অতএব একটা সুন্দর ধন্যবাদ তো নন্দিনির অবশ্য প্রাপ্য। বলরাম তার ভুলের হিসাব কষতে বসলেন, একটা পাথর-ভারী অনুতাপ এসে ভর করল মনে, আহ্হা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! আসলে মনস্তত্ত্ব একটা জটিল বিষয়, এতে ভালো-মন্দ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের চেয়ে তাৎক্ষণিক মানসিক অবস্থানটাই মানুষের কর্মপদ্ধতি ঠিক করে। ভুল করা সহজ কিন্তু ভুল শোধরানোর জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টার প্রয়োজন, সেখানেও মনেরই কর্তৃত্ব।চেতন-অচেতন সেই অদৃশ্য কর্তৃত্বের কাছে বলরামের মত মানুষদের ক্রমাগত হার l
বলরামের প্রতিটি জন্মদিনে একেকটি করে নতুন বছর যোগ হয় আর সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যগত দুঃসংবাদগুলোও মাথা নাড়া দিয়ে উঠে একে একে। গত একবছরে ধরা পড়ল ডায়াবেটিস আর অস্টিওয়ার্থাইটিস। গেল সপ্তাহে চোখের ডাক্তার ঘোষণা দিয়েছেন, তার মেক্যুলার ডিজেনারেসন এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। অর্থাৎ মেডিকেল পরিভাষায় বলরাম এখন 'লিগালি ব্লাইন্ড'। কথাটা শোনে বলরাম হেসে উঠেছিলেন উচ্চস্বরে। কিন্তু ডাক্তার বেশ সময় নিয়ে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝালেন তাকে। প্রথম কথাটাতেই প্রচন্ড ধাক্কা; অচিরেই তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করা হবে, অর্থাৎ আর গাড়ি চালাতে পারবেন না। এবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শুরু করলেন বলরাম। ডাক্তারের উপদেশটা কানে বাজতে লাগল, ডিসেবিলিটির বেনিফিট-সহ এক্ষুণি তার কাজ ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করা উচিত, আর এর পর পরিপূর্ণ অবসরের প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
বাড়ি ফিরে ডিনারের পর সংবাদটা জানালেন বলরাম। শোনেই নন্দিনি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল সামনের সোফায়, বলরামের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল সটান, কয়েক সেকেন্ড পরে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল দুই হাতে মুখ চাপা দিয়ে। নন্দিনি শক্ত মহিলা, কথায় কথায় কান্নার অভ্যাস নেই তার। হতভম্ব বলরাম পাশে গিয়ে বসলেন, পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন অপ্রস্তুত ভাবে।
- আহ্, দেখো দেখি, এতে কান্নার কী হলো? এটা হচ্ছে একটা লিগ্যাল ডায়াগনোসিস, আমি কি আসলে অন্ধ হয়েছি? এই যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট, মুখের সবগুলো ভাঁজ দেখতে পাচ্ছি, চুলের রঙ দেখতে পাচ্ছি, তোমার চোখের পাতা দেখতে পাচ্ছি, এমনকি তোমার গলার তিল...
খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বলরাম খেয়াল করলেন নন্দিনির ক্রন্দন ভারাক্রান্ত অক্ষিপুটের নিচে কুসুম আর্দ্র চোখ, শিশিরের মতো জল বেয়ে নেমে এসেছে ফর্সা গালের মাঝামাঝি, ঠোঁট দুটো ঈষৎ স্ফীত। বলরাম জানেন, কান্নাশেষে কোনো কোনো সুন্দরী রমণীর চেহারা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। নন্দিনি তাদেরই একজন, আটপৌরে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় নন্দিনিকে আজ তার ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হলো। নিকট অতীতের সকল অবহেলা-অনুযোগ ছাপিয়ে তার দুঃসংবাদ শোনে ক্রন্দনরতা নন্দিনির এই মুহূর্তের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলরামকে নিয়ে গেল পরিতুষ্টির আনন্দমার্গে। দীর্ঘদিন বলরাম এমনি একটি মুহূর্তের স্বপ্ন দেখেছেন, আজ তার মনে সন্দেহ নেই, এই নন্দিনিকেই ভালোবেসেছেন, আর এই নন্দিনিও তাকেই ভালোবাসে। সান্ত্বনা দিতে দিতে অজান্তেই নন্দিনির গালে গাল ঘষতে লাগলেন বলরাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখ চলে গেল নন্দিনির ঠোঁটে। দীর্ঘ আবাহনের শেষ পহরে বলরাম মনে করার চেষ্টা করলেন শেষ কবে নন্দিনির ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন l নাহ্, মনে করতে পারলেন না, চোখ আর কানের মতো তার স্মৃতিও বিকল হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
নন্দিনি কয়েকদিন উচাটন হয়ে থাকলেও বলরাম কিন্তু ভয় পাননি তেমন। হয়তো নন্দিনির সুপ্ত ভালোবাসার আবিষ্কার তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথবা কানের সমস্যার পুরোনো অভিজ্ঞতাটাই তাঁকে পোক্ত করে দিয়েছে। স্থির মনে ধীরে ধীরে আরাধ্য কর্মগুলো গুছাতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে অগ্রিম রিটায়ারমেন্টের জন্য আবেদন করেছেন। ডিসেবিলিটি বেনিফিটের জন্যও আবেদন করেছেন। বাড়ির দলিলপত্র আর লাইফ ইন্সুরেন্স সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক করছেন। উইল করার জন্য এটর্নির সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন। এসবই করেছেন ঠান্ডা মাথায়, একান্ত মনে, কোন উচ্চবাক্য না করে।
সেই সঙ্গে ঘরে অনুশীলন শুরু করছেন অন্ধের লাঠি নিয়ে হাঁটার, যদিও ডাক্তার বলেছেন এটা অনেক পরের ব্যাপার, এখন এর প্রয়োজন নেই। নন্দিনি কিছু বলে না, কণ্ঠে কোন তাচ্ছিল্য নেই, অভিযোগ অনুযোগ সব এখন তার অতীত স্মৃতি। বলরাম প্রায়ই কসরত করেন চোখ বন্ধ করে এবং হিয়ারিং এইড ব্যবহার না করে স্পর্শের মাধ্যমে বুঝতে। জিনিসপত্র হাতরে হাতরে ঠিকই এখন টের পেয়ে যান কোনটা কী। দেখা ও শোনা বন্ধ করার এই কসরতে অবাক হয়ে লক্ষ্য করছেন, তার স্মৃতি শক্তি বেড়ে যাচ্ছে, চিন্তার ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই এখন বুঝেন যা আগে বুঝতে পারতেন না। এটাকেই কি মেডিটেশন বলে? শ্রুতি ও দৃষ্টির বন্ধন থেকে বেরিয়ে নিজের ভিতরে অন্তর্লীন হওয়া, মনকে শৃঙ্খল মুক্ত করা?
তিন/
গেল রাতে বলরামের ঘুম ভালো হয়েছে, তবে ঘুম থেকে উঠেছেন প্রচণ্ড ঘাম নিয়ে। বুকে সামান্য চাপও অনুভব করেছেন, সাথে হালকা মাথা ব্যথা। ভাবলেন নিয়ম মাফিক কফির মগে কয়েক চুমুক দিলেই শরীরটা ঝরঝরে হয়ে উঠবে। হঠাৎ ঘরটাকে তার খুব গুমোট মনে হলো, চিন্তা করতেই মনে হলো আবদ্ধ ঘরে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দরজা খুললেন, কফির মগটা হাতে নিয়েই বারান্দায় বের হলেন আগের মতো। চোখের সমস্যার পর সাধারণত একা বাইরে বের হন না, ডাক্তারের বারণ, নন্দিনিও নিয়ম করে দিয়েছে। আজ এই নিয়ম ভাঙ্গলেন।
দীর্ঘদিন পরে ব্যালকনিতে আসা। এই ব্যালকনি ছিল তার এবং নন্দিনির খুব প্রিয় জায়গা। কাজ করা রেলিং, কাঠের পাটাতন, সবকিছুর চেহারা আগের মতোই আছে, শুধু একটু বুড়িয়ে গেছে। বাড়ি কেনার পর প্রথম রাতেই খোলা আকাশের নিচে এখানে কাটিয়েছিলেন মাঝরাত পর্যন্ত। তারা ভরা চাঁদনি রাত ছিল সেটা। নন্দিনির ভরা যৌবন ছিল l পৃথিবী আরও সবুজ ছিল। এইসব সুখস্মৃতি অকারণেই দুঃখ আনে মনে, তাই পর্দা সরিয়ে দেয়ার মতো আলতো করে সরিয়ে দিলেন চিন্তাটুকু। বলরাম বেশ রপ্ত করেছেন ধ্যানযোগের এই কৌশল, ডিটাচমেন্ট!
চেয়ারে না বসে রেলিং ধরেই দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। গাছে গাছে রঙ ছড়ানো হেমন্তের ভোর, এই সময়ের পৃথিবী খুব সুন্দর, কিন্তু বলরাম এখন ঝাপসা দেখেন, সুন্দর পৃথিবীটাকে সুন্দর করে দেখার অধিকার হারিয়েছেন কে জানে কোন অপরাধে? হঠাৎ খেয়াল করলেন, আজ হিয়ারিং এইড ছাড়াও পাখির ডাক শোনতে পাচ্ছেন। দূরের জিনিসগুলো স্পষ্ট না দেখলেও বেশ দেখতে পাচ্ছেন। জানেন এইটুকুও শেষ হয়ে যাবে এক সময়।
বলরামের মনে হলো ঘুম থেকে উঠে নন্দিনি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আগের মতো l ভাবলেন, নন্দিনিকে এবার বলবেন সামনের দৃশ্যগুলোর বর্ণনা দিতে। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যেমন সঞ্জয় বর্ণনা দিয়েছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের। বলরাম ধর্মে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ধর্ম নিয়ে আগ্রহী পড়াশোনা আছে তার। গীতার এই প্লটটা খুবই রহস্যময় মনে হয়েছে তার কাছে। বলরাম নিজেকে ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রে উপস্থাপন করলেন। তার রাজ্য ছিল না, কিন্তু সংসার ছিল। সেই সুখী সংসারের ছেলেরা এখন কলহে লিপ্ত। সঞ্জয়ের জায়গায় এখন নন্দিনির মুখে এই কলহের বর্ণনা শুনছে। তার মনে হলো, সংসার রাজ্যে সে ও আরেক অন্ধ বৃদ্ধ অসহায় রাজন, কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামাবার শক্তি নেই যার, দেখারও ক্ষমতা নেই, শুধু শোনে কী লাভ?
কিন্তু একটু চিন্তা করতেই বলরাম নিজেকে অর্জুনের জায়গায় দেখলেন। অন্যায়কে থামাবার ক্ষমতা আছে তার যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এত রক্তপাত কার বিরুদ্ধে? অর্জুনের মতোই পিছিয়ে থেকেছেন বলরাম। অর্জুনের ছিল কৃষ্ণ, বলরামের কেউ নেই। বস্তুত বলরাম বড়ই একা।
হঠাৎ বলরামের বোধোদয় হলো নন্দিনি কিন্তু সশরীরে নেই, তবে কি তার ছায়ামূর্তি? কানে কানে ঠিকই ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছে নন্দিনি—টেনিস খেলছে দুই তরুণী, সামনের মাঠে শরীর চর্চা করছে পৌঢ় নারী পুরুষ, লেক পাড়ের জগিং ট্রেইল ধরে দৌড়াচ্ছে যুগল দম্পতি, সকালের ট্রেন গেল ভেঁপু বাজিয়ে, গাছে গাছে ঝরা পাতার মর্মর, এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি উড়ে উড়ে আসে যায়...
আশ্চর্য হয়ে বলরাম খেয়াল করলেন তার দৃষ্টি আর ঝাপসা নয় এখন, পুরোটা দৃশ্যই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন সামনে। ছিটকে নেটের বাইরে আসা টেনিস বলটির পেছনে ছুটছে হলুদ জ্যাকেট পরা একটি বালক। বলরাম দেখতে পাচ্ছেন বলটি দ্রুতগতিতে যাচ্ছে রাস্তার দিকে, যেখানে একটি গাড়ি আসছে ধেয়ে। । আতঙ্কিত বলরাম চিৎকার করে বলছেন ছেলেটিকে রাস্তার দিকে না যেতে। নন্দিনি ফিস ফিস করে জানাল ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। স্পষ্ট দেখলেন, লাল রঙের মার্সেডিজ গাড়িটি ধেয়ে এলো উত্তর দিক থেকে। ছেলেটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়, চেহারাটা এক ঝলক দেখেই খুব চেনা মনে হলো, বহু বছর আগে যুদ্ধে নিহত তারই সন্তানের মুখ। ততক্ষণে হলুদ শাড়ি পড়া যে মেয়েটি গাড়ির দরজা খুলে উদভ্রান্তের মতো বের হয়ে এলো, সে দেখতে অবিকল নন্দিনির মতো। বুক চাপড়ে বারবার বলছে, এটা কেমন করে হলো, কেমন করে হলো?
বলরামের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো আবার আগের মতো। কল্পনা ছেড়ে এবার বাস্তবে ফিরে আসার কসরত করতে লাগলেন, কিন্তু পারছেন না। মাথা ঝিম ঝিম করতে শুরু করল, ঘুম ও স্বপ্নের মাঝামাঝি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নিরুপায় হয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন বলরাম। সহসাই স্মৃতির বায়োস্কোপ চালু হয়ে গেল তার, না চাইলেও চলতে লাগল ছবি l মাথা হেলিয়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের দৃশ্যগুলোতে আত্মসমর্পণ করলেন বলরাম, অনাবিল অনাগ্রহ সহকারে। শৈশব থেকে শুরু হওয়া সবগুলো দৃশ্য জ্যান্ত হয়ে ভেসে উঠছে। কিন্তু আবেগহীন বলরামের মনে হলো দীর্ঘজীবনের প্রচেষ্টার পর অবশেষে বিচ্ছিন্নতার সূত্র পেয়ে গেছেন, দৃশ্যগুলো আসছে একের পর এক, অথচ আনন্দ-অভিলাষ, রাগ-দুঃখ, ক্লেদ-ক্লেশ কিছুই অবশিষ্ট নেই তাতে, শুধুই ঘটনা। বলরাম এখন বোধহীন সুষুপ্তির জগতে ভাসমান। অতঃপর, তুরীয় দুয়ারে দাঁড়িয়ে বলরামের মনে একসময় বিশাল সমুদ্রে এক বিন্দু লবণ কণিকার দ্রবীভূত হওয়ার মতো একান্ত উপলব্ধির জন্ম নিল।
সেদিন হিমঝরা হেমন্তের ভোরে দেহত্যাগী বলরামের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল বলে ধরে নেয়া হয়। নন্দিনি তখনও গভীর ঘুমে। বস্তুত বলরামের একদা পরিচিত পৃথিবীর অর্ধেক অংশই তখন গভীর নিদ্রামগ্ন। বাকি অর্ধেক জুড়ে প্রভাতী সূর্যের আলো।
1 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার!দীপেন ভট্টাচার্য
উত্তরমুছুন