‘মনে রেখে দেবতাদের উত্তরায়ণে দিন আর দক্ষিণায়ণে রাত্রি'। চন্দ্রাবতী অবাক চোখে চেয়ে থাকলেন স্বামীর দিকে। সুরেন্দ্রনাথ আবার কথা বলছে, সেই একই রকম বণ্ঠস্বর, ভাঙা ভাঙা, অথচ কীরকম মন্ত্রোচ্চারণের মতো গম্ভীর, যেমন ভাবে সব কথাই একসময় বলতেন সুরেন্দ্রনাথ আর চন্দ্রাবতীর মনে পড়ল পাঁচ যুগ আগের এক রাত্রির কথা, প্রথম যে শীতরাতের বিছানায় সুরেন্দ্রনাথ তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন আর অসহায়ের মতো ডেকেছিলেন...'চন্দ্রাবতী'... !
‘আমি তোমার রোগ গ্রহণ করলাম। তুমি ভাল হয়ে যাবে চন্দ্রাবতী। ছেলে বউ নাতিদের নিয়ে আরও বহুদিন সুখে ঘর করবে। আরও অর্ধযুগ পরে দক্ষিণায়ণে তোমার মৃত্যু হবে।' মৃত্যুর আগে সুরেন্দ্রনাথের শেষ কথাগুলি এই বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে বহুদিন, চন্দ্রাবতীর আরোগ্যের পরও, তাঁর মৃত্যুরও বেশ কিছুদিন পর অবধি আর তারপর নতুন। যুগ এসে এইসব সংলাপকে বিস্মৃতির পথে নিয়ে গিয়েছে। মাঘ মাসের এক রাত্রিতে দিঘির অন্ধকার জলের মুখোমুখি বসে সুবর্ণ এইসব বিস্মৃতির কাছে ফিরে যায়। মনে হয়, দীপার পাশ থেকে উঠে সে কখন ধীর পায়ে জলস্রোত ভেঙে ভেঙে অন্তঃস্থলের গভীরতায় চলে গিয়েছে, যে ভাসানযাত্রা থেকে আর কোনওদিন সে ফিরে আসবে না। কিছুদিন আগে এমনটাই মনে হয়েছিল তার। সেদিন শীতকালের সকাল থেকে শুরু হয়েছিল বৃষ্টি, আর সে বাড়ির সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছিল, হিম হাওয়ায় আর বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল, তারপর বৃষ্টির ভিতর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গিয়েছিল আর সে তাকে ভেবেছিল, মা তাকে একবার ডাকবে, 'সুবর্ণ, এমন অকালের বৃষ্টিতে ভিজতে নেই রে', কই মা তো তাকে ডাকেনি, আর অকালের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেদিন অনেক দূরে চলে গেল সুবর্ণ। এভাবে সে কোথায় যায়?
'কী, কোথায় গিয়েছিলে আবার?' দীপার হাত সুবর্ণর কাধ চেপে ধরে।
অকস্মাৎ খেলা ভেঙে দিলে যেমন, ঠিক তেমন এক অপ্রস্তুত শিশুর মতো সে দীপার দিকে চোখ ফেরায়। কিন্তু এখন দীপাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। যেন কোনও গাঢ় বিস্মৃতির পর্দায় আড়াল হয়ে গিয়েছে দীপা, শুধু কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, যেমন ছেলেবেলায় সে বহুবার শুনেছে, ঘন বাঁশবনের ভিতরে ঘুরতে ঘুরতে, কীরকম মেরু অঞ্চলের মতো ভিজে ছিল সেখানকার মাটি, হাওয়ায় কোথাও সর সর করে বাঁশপাতা ঝরছে, সেই প্রথম সে অনুভব করেছিল শরীরহীন কণ্ঠস্বরদের, হয়তো বাঁশবনের পাশেই কুমোরবাড়ি থেকে সেইসব কণ্ঠস্বর ভেসে আসত... 'ও ফুলু, কমানি পিদিম হল..ও ফুলু, সলতে গুলো পাকাবি তো মা...। | '
‘কীকী হয় তোমার সুবর্ণ—আমাকে কি কোনওদিনও বলবে না?' দীপা সুবর্ণর দুই গাল চেপে ধরে। “উঃ শ্রী ঠাণ্ডা—কী ঠাণ্তোডামার শরীর—এত ঠাণ্ডা কেন তোমার শরীর?'
সুবর্ণ তার গালে চেপে ধরা দীপার দুই করতলকে আঁকড়ে ধরে। আবার সে দীপাকে দেখতে পাচ্ছে, 'আজকের মাঘরাত্রির দীপাকে, কিন্তু কী বলবো আমি দীপাকে, প্রতিনিয়তই কী সে খুঁজছে, কোনও শান্তিকে না আর কোনও সময়কে নাকি শৈশবকে? আজকের অস্তিত্ব নিয়ে সে আর পিছন দিকে ফিরে যেতে পারবে না, তার শৈশব-কৈশোর বা বাংলাদেশের কোনও গ্রাম—কোথাও তার আশ্রয় মিলবে না। তার জন্ম এই শহরে, বড় হয়েছে এখানেই, মাঝে-মধ্যে গ্রামে মামাবাড়িতে যেত সে, কিন্তু গ্রামের সেইসব দিন তো বড় বিচ্ছিন্ন তার জীবনে। শহরের মানুষ হিসাবেই সে অনুভব করছে গ্রামকে, যেন কয়েকদিন ভাল থাকার জন্যে, কয়েকদিন কল্পনাকথার ভিতরে বেঁচে থাকার জন্য গ্রামে যাওয়া—এ ছাড়া আর কোনওভাবে সে সময়ে গ্রামকে বুঝতে শেখেনি সে—এখনও সে জানে না রূপকথা দারিদ্র্য-ভিডিয়োর টানাপোড়েনে ছিন্নমূল গ্রামগুলিকে। কিন্তু শহরটাও কি তার কাছে কখনও আশ্রয় মনে হয়েছে? ছাব্বিশ বছর ধরে সে এখানে বেঁচে আছে, এই শহরকে ভালবেসে, ঘৃণা করে সে বেঁচে আছে, তবু কখনওই জায়গাটিকে আশ্রয় মনে হয়নি তার। যে রাত্রিতে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল, সেরকম রাত কোনদিন তার বা তাদের উত্তরপুরুষের জীবনে। ফিরে আসবে না আর, তারা কেউ নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে আপনজনের রাগ ধারণ করতে পারবে না। তাদের আর কোনও কথা ভবিষ্যবাণীর মতো উচ্চারিত হবে না, দীপার দিকে তাকিয়ে এইসব কথাগুলিই সে নীরবে বলতে চাইছিল। আমার দাদু বলেছিলেন, দেবতাদের উত্তরায়ণে দিন আর দক্ষিণায়ণে রাত্রি আর ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হবে দক্ষিণায়ণে, তবে কি তারা দেবতাদের রাত্রি দিনের ভিতরে বেঁচে ছিলেন ?
‘আবারও তুমি চুপ করে আছো--কিছুই কী বলবার নেই তোমার?'
সুবর্ণ চুপ করে থাকে। সে জানে, আরও দীর্ঘ সময় সে এভাবেই চুপ করে থাকবে, দীপা তাকে বারবার প্রশ্ন করবে, রেগে যাবে, দুহাতে মুখ ঢেকে হয়তো কাঁদবে, কিন্তু কিছুই সে বলতে পারবে না। ভাষা ফোটেনি এমন কোনও শিশুর ভিতরকার প্রকাশের আলোড়নে, অগ্নিমন্ত্রে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বসে থাকবে, অথচ কিছুই এভাবে বলা সম্ভব নয়, এই ভাষায়, দেবতাদের কণ্ঠস্বর ছাড়া কিছুই সে বলতে পারবে না।
চতুর্দিকে দেবযোনিরা অট্টহাস্য করে উঠবেন যদি আমি বলি, মনে রেখো, দেবতাদের উত্তরায়ণে দিন আর দক্ষিণায়ণে রাত্রি, তুমি হেসে উঠবে দীপা, কিন্তু আমি দেখেছি কুয়াশার ভিতরে তোমার শরীর কীরকম আলোকিত হয়ে ওঠে, লিপিহীন, শব্দহীন সেই ভাষার আলো, দেবতাদের কণ্ঠস্বর যাদের ছেড়ে গিয়েছে তারা এখন শুধু এমন নীরবতায় কথা বলে, তুমি আমাকে কোনওদিন বুঝতে পারবে দীপা, এই এখন আমি তোমাকে স্পর্শ করছি, তোমার চুলের ভিতরে এইসব আঙ্গুলের ভাষা তুমি জানো, যে মুখ তোমার অনাবৃত গলায়, অজস্র চুলে ছিন্নভিন্ন হয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, 'আর লালারস গড়িয়ে নামছে গলা থেকে বুকে, এর দুর্গন্ধ তুমি জানো, এই ঠোঁট কীভাবে তোমার ঠোঁটকে আঁকড়ে ধরে, তোমার মুখগহ্বরে এই জিহ্বার নীরব শিস, তোমার কপালে, চোখে, গালে সর্বত্র যে ঠোঁট ঘুরে বেড়ায়, দীপা, তোমার স্তন ভেঙে ফেলতে চায় যে দুটি হাত, আরও আরও বুকের ভিতরে আঁকড়ে ধরে সে তোমাকে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায় আর সে দাঁত বসিয়ে দেয় তোমার বুকের মাংসে, অস্ফুট আদিম চিৎকার করে উঠবে তুমি যন্ত্রণায়, কিন্তু এইসব ভাষার কথা তো তুমি জানো দীপা।
‘আমাদের এভাবে রোজ রোজ দেখা করার কী দরকার?' দীপার ভেজা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সুবর্ণ। দীপার ঘাড়ের কাছে ছড়ানো চুলে মুখ ডুবে আছে তার, আর দীপার গাল স্পর্শ করে আছে তার কপাল, যেখানে জলের স্পর্শ পেল সুবর্ণ। কোনও উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না তার। সুবর্ণ ফিরে যেতে থাকে, টিমটিমে বাতিকে ঘিরে আবছা অন্ধকার রাতের একটি ঘরে, যে রাতে আশ্চর্য মৃত্যু হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথের, পৃথিবীতে যখন শেষবার দেবতাদের কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল।
সুরেন্দ্রনাথের হাত ধরে সুবর্ণ প্রথম আকাশ দেখতে গিয়েছিল। তখন তার বয়স সাত। সত্তুর বছরের বৃদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ, গত শতাব্দীর শেষে যার জন্ম হয়েছিল, তখনও মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটতেন। প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখতেন তিনি বাড়ির সামনে এক চিলতে মাটির উঠোনে দাঁড়িয়ে। উঠোনে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে সুর্যকে দেখা যেত না, কেননা সেদিকে ছিল ঘন বাঁশবন, ক্রমে ক্রমে আলোর বিকাশ দেখতেন তিনি। তারপর প্রাতঃকৃত্য, স্নান সেরে আহ্নিক করতে বসতেন। দু ঘণ্টার কমে তাঁর আহ্নিক হত না। মনে আছে, সুবর্ণ যখন মামার বাড়িতে থাকত, তখন তার দাদু, সুরেন্দ্রনাথ শেষ রাতেই তাকে জাগিয়ে দিতেন। ছেলেমেয়েদের তিনি কিছু বলতে পারতেন না। “ওঠো, দাদুভাই, উঠে পড়, সূর্যদেবের ঘুম ভাঙার সময় ঘুমিয়ে থাকতে নেই। দেবতার অসম্মান হয় তাতে।' চোখ কচলাতে কচলাতে সে দাদুর হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়াত। চারিদিক তখন আবছা অন্ধকার, হিম করছে মৃদু। ছোট ছেলেটি দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে শেষ রাতের বাতাসে কাঁপত। সুরেন্দ্রনাথ যেন এক মনে বলে যেতেন ‘শেষ রাতের এই হিম কোথা থেকে আসে জানো তো দাদুভাই? এ দেশের যারা পুণ্যবতী নারী, তারা পরী হয়ে সারা রাত 'আকাশে ঘুরে বেড়ান। কোনওদিন আর তাঁরা আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না। আপনজনদের জন্য তাদের এমন কান্না—এই রকম হিম হয়ে ঝরে রোজ রোজ। জানো তো দাদুভাই, আত্মারা কোনওদিন আমাদের ছেড়ে যান না।' ছোট ছেলেটি তখন আম্মা বলতে জানত ভূতদের, যাদের নানারকম গল্প সে তার দিদিমা চন্দ্রাবতীর মুখে শুনেছিল। কবে কোন রাতে রান্নাঘরের ছোট জানলা দিয়ে কোন ভূত হাত বাড়িয়েছিল মাছ ভাজার জন্য, আর চন্দ্রাবতী তার হাতে গরম খুন্তির ছ্যঁকা দিয়েছিলেন – এইসব নানা গল্প। সে আরও অনেক গল্প শুনেছিল। বিয়ের কিছুদিন পর এক রাতে এসেছিলেন চন্দ্রাবতীর বাবা, তখন ছিল শীতকাল, মেয়ের প্রিয় পাটালি শুড় নিয়ে। চন্দ্রাবতী দেখেছিলেন বাবার মুখ কীরকম ফ্যাকাশে, খড়ির মতো সাদা। ‘আপনার কী শরীর খারাপ বাবা?' তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। বাবা কোনও উত্তর নেননি। অনেক সাধ্য সাধনা সত্ত্বেও বাবা সে রাতে থাকেননি। পরদিনই চন্দ্রাবতীর বাপের বাড়ির লোক তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর নিয়ে এসেছিল। শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন চন্দ্রাবতী। বাবা যখন তার কাছে এসেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই মৃত্যু হয়েছিল তার। জানিস তো খোকন, প্রিয়জনের আত্মা কখনও আপনজনকে দেখা না দিয়ে চলে যায় না। ভূত হয়ে ঠিক আগের মতো রূপ নিয়েই আসে তারা। কিন্তু কথা বলতে পারে না। আমি তো তখন বুঝিনি, বাবা কেন একটাও কথা বলেননি।' চন্দ্রাবতী তাকে খোকন বলে ডাকতেন। সুবর্ণ বুঝতে পারত, সুরেন্দ্রনাথের আত্মারা আর চন্দ্রাবতীর আত্মারা আলাদা আলাদা রকম। তার দাদুর আত্মারা কোনওদিন দেখা দেয় না, শুধু তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় হিমের স্পর্শে, বাতাসে আর দিদিমার আত্মারা ভূত হয়ে আসে, মানুষের দেহে কখনও কখনও দেখা দিয়ে যায়।
অন্ধকার থেকে ক্রমে ক্রমে আলোর বিকাশ অবধি সুরেন্দ্রনাথের কথা থামত না। ভরে পাওয়া কোনও মানুষের মতো কথাগুলি বলে যেতেন সুরেন্দ্রনাথ। সুবর্ণ এখন জানে, সব কথা তিনি তার নাতিকে উদ্দেশ্য করে বলতেন না, যেন কোনও আদিকথকের মতো নিজের ভিতরকার কোনও পাণ্ডুলিপি পড়ে যেতেন। অনেকটা পটচিত্রীদের একই কাহিনি বারবার বলার মতো, রোজ সকালবেলা একইভাবে, যেন এই ভূমিকা ছাড়া সুরেন্দ্রনাথের জীবনধারণ ছিল অসম্ভব। 'মনে রেখো দাদুভাই, আমাদের কেন্দ্রে আছেন সূর্যদেব, এই জগৎ-সংসার এক অনন্ত আলোর সমুদ্রে ভাসমান, আমরাও সেখানে এক একটি আলোর কণা। জীবসমুদায়ের জন্ম এই আলো হতে, তুমিও একদিন এই আলোতেই মিশে যাবে। প্রতিদিনকার ব্রাহ্মমুহূর্ত আর সূর্যোদয়কে কখনও হারিও না। আমাদের দেশ আলোকেই পুজো করেছে, আলোই আমাদের জ্ঞান। বহুদিন বাদে পিতৃ-তর্পণের জন্য গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে, চারিদিকে সমবেত মন্ত্রোচ্চারণের ভিতরে, সুবর্ণ নিজের শরীরে অনুভব করেছিল তার দাদু সুরেন্দ্রনাথের কথাগুলি, এই জগৎ-সংসার এক আলোর সমুদ্রে ভাসমান, আমরাও সেখানে এক একটি আলোর কণিকা।
আকাশ কি সে তার আগে দেখেনি? শহরের ঘিঞ্জি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে একফালি আকাশ সে দেখতে পেত, কখনও ধোঁয়ায়, কখনও উড়ন্ত শকুনের চক্রাকার ঘূর্ণনে ভরে থাকত শহরের আকাশ। সুরেন্দ্রনাথের কাছেই সে প্রথম আকাশ চিনেছিল, তখন গ্রামের মেঠো পথ পেরিয়ে বিস্তৃত ধানখেতের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সে দাদুর সঙ্গে। তখন মাঠের ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। এবড়ো খেবড়ো জমিতে ধানগাছের শুকনো গোড়াগুলি জেগে আছে আর সেখানে ধেড়ে ইঁদুরেরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। জমির মাঝে মাঝে জেগে আছে রুপোলি টেলিগ্রাফের পোস্ট। 'জানো তো দাদুভাই, এই আকাশের কোনও শেষ। নেই। ওই যে দূরে দেখতে পাচ্ছ কেমন মাটির সঙ্গে বুঝি মিশে গিয়েছে আকাশ, সেখানেও শেষ নয়, তুমি চলতেই থাকবে, কিন্তু কখনও আকাশ ফুরুবে না'...তারা ফাঁকা জমির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল... ‘ওই আকাশের পরে মহাশুন্য, সেও আরেকটি জগৎ দাদুভাই...।' নাতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুরেন্দ্রনাথ ফিরে গিয়েছিলেন চারযুগ আগে। তার পদ্মার ওপারের দেশে। তাদের গ্রামের রেবতী একদিন আকাশের শেষ খোঁজবার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল, গ্রামের লোকেরা বলত, নক্ষত্ররা তার উপর ভর করেছিল, যেমন কালপুরুষ দেখলে ভবঘুরে হয়ে যায় কেউ কেউ, আর তারপর রেবতী একদিন ফিরে এসেছিল উন্মাদ হয়ে। সুরেন্দ্রনাথের বয়েস তখন কুড়িও পেরোয়নি। রেবতীকে দেখে তার মনে হত, সে যেন এই পৃথিবীর মানুষ নয়, সেও বুঝি সেই সাতাশটি নক্ষত্রের একটি — রেবতী। দাদুর কাছ থেকেই সুবর্ণ ছেলেবেলায় জেনেছিল, আকাশকে কখনও বাইরে দেখা যায় না, তা শুধু কখনও কখনও বুকের ভিতরে অনুভব করা যায়, নইলে সেদিন, সেই প্রথম, দাদুর সঙ্গে থেকেও কেন মনে হয়েছিল, সে বুঝি এই চরাচরে হারিয়ে গিয়েছে, হাত-ধরে থাকা মানুষটিকে সে চেনে না। দাদুর মৃত্যুর পর সুবর্ণর মনে হয়েছিল, সে কি তবে কোনও নক্ষত্রের সঙ্গে সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল? সেই প্রথম আকাশ চেনবার শিহরন থেকেই, এই শহরেও সে বারেবারে আকাশ দেখেছে, আজও দেখতে পায়। যারা বলে, এই শহরে আকাশ দেখা যায় না, তাদের দিকে সে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে, কখনও আকাশ দেখবার জন্য গ্রামে যাবার কথা মনে হয়নি তার।
সুবর্ণ দেখল, দীপা অনেকক্ষণ তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। কিছু বলতে না পেরে হেসে ফেলল সে। দীপার হাত টেনে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। তারপর দীপার হাতের পাতার দিকে চেয়ে থাকল সে।
'মাঝে মাঝেই এমনভাবে হাতে তুমি কী দেখ?'
‘তোমার ভাগ্য।‘
‘আমি বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি। কী হয়েছে তোমার? এসব কী পাগলামো? এতে তো তুমি বিশ্বাস করতে না।'
‘আমি রেখা পড়তে জানি না দীপা। বিশ্বাস কর, জানি না—কোনও ইন্টারেস্ট নেই আমার।’
‘তাহলে কী কী দেখ?’
‘আচ্ছা, লোকে তো বলে, দু'জনের হাতের রেখা কখনও সমান হয় না।'
দীপা চুপ করে থাকে। এই সুবর্ণকে সে যেন কিছুতেই বুঝতে পারে না। সংস্কারে অবিশ্বাসী এই ছেলেটি মাঝে মাঝে কীরকম কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে, যেন সে কোন অতলে ডুবে যাচ্ছে, আর ওই কুসংস্কার শেষ কুটোটির মতো।
‘তবু তোমার হাতের সব কাটাকুটি—সব—সব কিছু আমার দিদিমার মতো। তুমি তো দেখনি তাকে—আমার দিদিমা চন্দ্রাবতীকে।'
‘তাতে কী?’
দীপার এই প্রশ্নে সুবর্ণ কিছু বলতে পারল না। দীপার হাত সে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল। সত্যিই, সে তো জানে না, এইসব কথার অর্থ কী? কী বলতে চায় সে? অনেকদিন আগে, গ্রামের মামাবাড়িতে চন্দ্রাবতীর আলিঙ্গনের ভিতরে শুয়ে থেকে তার মনে হয়েছিল এই গন্ধ তার খুব চেনা, এই গন্ধ কখনও তার জীবন থেকে ছেড়ে যাবে না।
তার জীবনে গন্ধের এক বিশেষ অস্তিত্ব গড়ে উঠেছিল ছোটবেলা থেকেই। প্রথমত, মা ইরাবতীর শরীরের গন্ধ। মায়ের শরীরের এই গন্ধ একেবারেই আলাদারকম, যা ছড়িয়ে থাকে মায়ের ব্যবহৃত সমস্ত কিছুতেই, শাড়ি, ব্লাউজ, সায়া, সবেতেই। ছোটবেলায় মাকে যখন সে কাছে পেত না, তখন মায়ের শাড়ির ভিতরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকত। ব্যাপারটা প্রায় এক নেশায় পরিণত হয়েছিল, সেই গন্ধের ভিতরে তার চোখ বুজে আসত, শরীর শিথিল হয়ে যেত, কিছুই তখন ভাল লাগত না, যেন এভাবেই মায়ের কাপড়ে মুখ গুঁজে সারাজীবন শুয়ে থাকবে সে। আর মামাবাড়িতে গেলে তার প্রিয় আকর্ষণ ছিল, দিদিমা চন্দ্রাবতীর শরীরের গন্ধ। এভাবেই প্রত্যেকটি আলাদা শরীরকে চিনে নিতে পারে সে গন্ধের মধ্য দিয়ে, যেমন এখন, যখন মাঝে মাঝেই সে দূরে চলে যাচ্ছে, তখনও দীপার চুল, দীপার শরীরের গন্ধ সেই অনির্দেশ্য যাত্রাপথে মিশে রয়েছে, দীপা, তুমি বুঝতে পারবে, আমি কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাইনি। সঙ্গমঋতুতে সাপিনীর শরীরের গন্ধের মতো, তোমার গন্ধও মিশে আছে আজকের মাঘরাত্রির বাতাসে।
কী সে খোঁজে দীপার হাতে? এইসব রেখার অর্থ তো সে জানে না। চন্দ্রাবতীর হাতের সঙ্গে কি দীপার হাতের কোনও মিল আছে? চন্দ্রাবতীর হাতের ছবি তো তার মনে নেই, তাহলে মিলের কথা সে বুঝবেই বা কীভাবে, নাকি তার সব কথাগুলিতে ভর করে আছে কোনও কল্পনা? অনেকদিন আগে চন্দ্রাবতী তাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, 'তুই আমাকে খুব ভালবাসিস না রে খোকন ? দেখিস মরে গিয়ে আমি আবার তোর মেয়ে হয়ে জন্মাব।' চন্দ্রাবতীর সেই আশাকেই কী সে খুঁজে দেখতে চাইছে দীপার হাতে? কোথাও কি এই হাতে চন্দ্রাবতীর আশার ছায়া পড়েনি? তার জীবনে কল্পনার এইসব মেদুর টানাপোড়েনের কথা কোনওদিন সে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না।
দুই
কিরণশশীর নাকি ফের জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীতে। চন্দ্রাবতীর মুখেই এই কাহিনি শুনেছিল সুবর্ণ। সে-কাহিনি শোনবার সময় সে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকত চন্দ্রাবতীর মুখের দিকে। এই মুহূর্তে কাকে দেখছে সে? চন্দ্রাবতীকে না কিরণশশীকে? কিরণশশী ছিল। চন্দ্রাবতীর মায়ের ছেলেবেলার সখী। বারো বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর আঠেরো পূরণ হতে না হতেই কিরণশশী বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে এসেছিল। একুশ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল কিরণশশীর। শোনা যায়, বিধবা হওয়ার পরেও কাউকে প্রেম নিবেদন করেছিল কিরণশশী। সেই পুরুষের নাম চন্দ্রাবতীর মুখে শোনেনি সুবর্ণ। এক অন্ধকার রাতে, অজানা পুরুষটির সঙ্গে মিলনের সময়েই সাপে কেটেছিল কিরণশশীকে। বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে কিরণশশী তার বাল্যকালের সখী প্রভাবতীকে বলেছিল, 'সই, আমাকে কখনও ভুলবি না তো? তোর পেটে আমি আবার মেয়ে হয়ে ফিরে আসব।' তাই প্রভাবতী যখন একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছিলেন, যার নাম চন্দ্রাবতী, তাকে সকলে কিরণশশীর পূর্নজন্ম হিসেবেই মনে করেছিল। নাকের বাঁদিকে গালের উপর যেরকম লালাভ একটি তিল ছিল কিরণশশীর, চন্দ্রাবতীও তার জন্মের সময় সেইরকম একটি তিল নিয়ে এসেছিলেন। সুবর্ণ আশ্চর্য হয়ে ভাবত, দিদিমা চন্দ্রাবতী কীভাবে ভিতরে ভিতরে আরও একটি মানুষকে বহন করছেন, তার মায়ের বাল্যসখী কিরণশশীকে। চন্দ্রাবতীও মনে প্রাণে জানতেন, কিরণশশীর আত্মাই তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল।
আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই দেশের জন্ম-পুনর্জন্মের রহস্যের ভিতরে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণ। একটু আগে দীপা ফিরে গিয়েছে। দীপাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েই সে হাঁটতে শুরু করেছিল। মল্লিকবাজার থেকে এপাশে চৌরঙ্গি অবধি দীর্ঘ পার্ক স্ট্রিট। আজ বছরের শেষ দিন। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলো নানা রঙের কাগজে মোড়ানো লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুটপাথেও, লাইটপোস্টগুলোর সঙ্গে টানা লম্বা দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির আলো, হরেকরকম কাগজের ফুল, পশুপক্ষী, ক্লাউন, সান্তা ক্লজ। রেস্তোরাঁগুলির দরজার দুপাশে টবে সাজানো কাগজের ঝাউ, দরজার উপরে রঙিন কাগজের ঝালর। পার্ক হোটেলের মাথায় দীর্ঘ সারি বিন্যাসে আলো জ্বলছে নিভছে। তার সবচেয়ে ভাল লাগে রঙিন টুপিবিক্রেতাদের। ফুটপাথে চোঙের মতো নানারঙা টুপি সাজিয়ে বসেছে তারা। কোনও টুপিতে জরি ঝিকমিক করছে। আশ্চর্য মনে হয় তার এইসব টুপিবিক্রেতাদের। যেন এই শহরে কোনওদিন সে দেখেনি তাদের, এর পরেও দেখতে পাবে না, শুধু ক্রিসমাস ইভের কয়েকটি দিন দেখা যায় এদের, আর প্রতি বছরেই নতুন নতুন টুপিবিক্রেতারা, আগে যাদের কখনও দেখা যায়নি, পরেও আর কোনওদিন দেখা যাবে না, এই আশ্চর্য টুপিবিক্রেতারা, রেস্তোরাঁগুলির পানভোজনের উৎসবের বাইরে যারা বসে থাকে, আর তাদের টুপির জরিগুলি উড়তে থাকে পানশালায়, উড়তে থাকে 'হাল্লেলুইয়া' চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে, উড়তে থাকে জ্যাজসঙ্গীতের তালে তালে আর জড়িয়ে যায় বিছানায়, পানপরবর্তী সঙ্গমের সময়ে, জড়িয়ে যায় এই অঞ্চলের কোনও ইহুদি বেশ্যার চুলে। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তাকিয়ে থাকে সেইসব টুপিবিক্রেতাদের দিকে। তার কীরকম মনে হয়, এই মানুষগুলো কোনও লুপ্তপ্রায় উপজাতিদের শেষ বংশধর বা হয়তো তারা জিপসি আর অমনি পার্ক স্ট্রিটের দুই ফুটপাথে এখানে ওখানে গজিয়ে ওঠা রঙিন সব তাঁবু, হ্যাঁ এসে গিয়েছে, সুবর্ণ দেখতে থাকে, বছরের শেষ কয়েকটি দিনে আবার ফিরে এসেছে জিপসির দল, বিভিন্ন পাখির পালকশোভিত টুপি নিয়ে এসেছে তারা, আর এই সন্ধেবেলা পেট বার করে, ফুলছাপা ঘাঘরা দুলিয়ে নাচছে। জিপসির মেয়েরা রাস্তার উপরে, চারিপাশের অ্যাংলো-বস্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে ন্যাংটো শিশুরা, উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের প্রখর হাততালি, কিন্তু ফুটপাথের পাশে সরু একটি রক্তের ধারা দেখে চমকে উঠল সুবর্ণ। নীচু হয়ে সে বুঝতে পারল, বস্তুত তা পানের পিক—গড়িয়ে যাচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। সে আবার হাঁটতে শুরু করল। বারবার কেন একই অসুস্থতার আক্রমণ? ওহ্? মাই কারস্ড, ফ্লাইট!
দীপার ব্যাখ্যা সে নীরবে বহুবার শুনেছে। তুমি আসলে বড় বাস্তববিচ্ছিন্ন সুবর্ণ। চারপাশটাকে ফেস করতে ভয় পাও তুমি। তাই ওসব জন্মান্তরবাদ...তাই ওসব জিপসি...তাই..হাঁটতে হাঁটতে সে পেরিয়ে যায়। দীর্ঘ নীরবতার টানেল এমনকি নিজের সঙ্গেও আর কোন কথা নয়, শুধু ভাসমান কোনও গ্রাহক থেকে সোডিয়াম আলো, ওই পাংশু হলুদ আলো শীতের কুয়াশা টুইয়ে তাকে ঘিরে ধরল। আর রাস্তা থেকে কোনও ভারী যানের তীব্র ব্রেক কষার শব্দ ঢুকে পড়ল তার চামড়া ফুঁড়ে, যার সঙ্গে সঙ্গেই এল ট্যাক্সির হর্ণ। মিনিবাস কণ্ডাক্টৱের চিৎকার, সেইসব কারখানার গোলাপ বিক্রেতাদের আবেদন, বেশ্যার দালালদের গোপন চুক্তি—সব সবকিছুই এখন ছড়িয়ে যেতে থাকে তার সমগ্র শারীরিক চেতনায় আর সে অনুভব করতে থাকে, কোথাও, এই শরীরেরই কোথাও, বা শরীরকে ছাপিয়ে শরীর-সম্পর্কীয় তার ধারণার ভিতরে হয়তো, কোথাও ঘটে যাচ্ছে এক জৈব-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, আর সে অনুভব করতে থাকে, তার ভিতরে কিছুই আর ধরে রাখতে পারছে না এই প্রক্রিয়ার অভিঘাত, এক্ষুনি তা ফেটে পড়বে, অন্য কিছু আলাদা রকম কিছু, যা এই চারপাশের সবকিছুকে গ্রহণ করেই জন্ম নিয়েছে। অথচ সেই আলাদা কিছু, কোনও বিস্ফোরণের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে চতুষ্পার্শ্বে, অদৃশ্য খুনির মতো তা ছড়িয়ে যাবে হাওয়ায় হাওয়ায়, যেন তা এক রাক্ষুসে জ্যামিতি আর সেই জ্যামিতিক কণ্ঠস্বর সে তখন শুনতে পাচ্ছে সারা শরীর জুড়ে...'মনে রেখো, সাইরাকিউজ পতনের পর যাকে হত্যা করেছিল রোমক সৈনিকরা, তার সুর্যবলয়, গোলক, নির্দেশক যন্ত্র এবার উৎক্ষিপ্ত হবে শত্রুদের উদ্দেশে'...আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস পিঠে নিয়ে হাঁটতে থাকে সুবর্ণ।
এই এখন সে শহরের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, রুজ-মাখা মহিলাদের মধ্য দিয়ে, হকার, ভিখিরি, পাগল, অভিব্যক্তিহীন পুরুষদের মধ্য দিয়ে, এলোমেলো কথাবার্তা, হঠাৎ হাসির ফোয়ারা, কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর, বিক্ষিপ্ত খিস্তি, প্রবহমান জুতোর শব্দের মধ্য দিয়ে সে এখন হেঁটে যাচ্ছে এই মুহূর্তে তার বাস্তবতার চেহারাটা কীরকম? ভিড়ের মধ্যে সেও একজন চলন্ত মানুষ। তার পাশে আর যারা যারা, অর্থাৎ ভিড়ের এইসব আলাদা আলাদা নারীপুরুষ-শিশুরা—এরা শুধুই প্রবহমান ভিড়? অথচ লক্ষ করলে তো বোঝা যায়, কেউ একজন খুব উদ্দীপনার সঙ্গে হেঁটে চলেছে, হয়তো তার প্রিয় কোনও জায়গায় পৌঁছেতে চায়, আবার ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে কোনও একজন, এই মুহূর্তে সত্যিই হাঁটবার একেবারে ইচ্ছে নেই তার, তবু মরিয়ার মতো তাকে পৌঁছোতে হবে কোথাও, আবার কারও হাঁটার মধ্যে ব্যস্ততা নেই একটুও, যেন কোনও সাময়িক গন্তব্য নেই তার সামনে—প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কত আলাদা রকমের পরিস্থিতি, সম্ভাবনা—এই সবকিছুকে বাদ দিয়ে সন্ধের কলকাতায় এমন নিরবচ্ছিন্ন গতিকে সে বুঝবে কীভাবে? এইভাবেই প্রত্যেকটা মানুষ ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যায়, এই ভিড়ের মধ্যেও তারা হাঁটছে আলাদা পরিস্থিতির ভিতরে, একা একা, বহন করে চলেছে সারাদিনের স্মৃতির নানা কাটাকুটি, তারা হাঁটছে, এগিয়ে যাচ্ছে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত নানারকম সম্ভাবনার দিকে যা তারা জানে না, আর ঘুমের ভিতরেও তাদের অপেক্ষা করে থাকতে হয় স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের জন্য। আশ্চর্য এক জ্যামিতিক গঠনের জন্ম হচ্ছে এখন সুবর্ণর চোখের সামনে, আশ্চর্য এক বৃত্তের পরিধি যা মিশে গিয়েছে। কেন্দ্রের সঙ্গে, আর সেই ত্রিকোণাকার কেন্দ্রের অন্তস্থল থেকে ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর...
বস্তুতপক্ষে বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের সব জ্ঞানই এখন এক ক্ষমতার উৎসে পরিণত। তোমার সম্পর্কে আমরা সবসময়েই এমন এক ধারণা পেতে চাই, আমাদের কাজে লাগে। তুমি এইভাবে পদক্ষেপ ফেলছ, তোমার হাত তোলার ধরন ওইরকম, কখন তুমি হেসে ওঠ, তোমার গোপন রোদনের মুহূর্ত—এইসব কিছু থেকেই তৈরি হয়ে ওঠে একটি ধারণা, যা ক্রমে ক্রমে তোমার সম্পর্কে একটি জ্ঞানে পরিণত হয়। আর তারপর এই জ্ঞানের তালিকাটি আমরা তোমার সামনে মেলে ধরি, দেখ, এই তোমার বাস্তবতা, এইরকমটাই তুমি, যাতে নিজের এই একখণ্ড বাস্তবতায় তুমি বন্দি হতে বাধ্য হও, সত্যিই আমরা তো আর কিছুই চাই না, শুধু তোমার এই বন্দিত্ব ছাড়া। যদি তুমি আমাদের বিরোধীও হও, তবু আমরা চাই, ওই বিরোধিতার বন্দিত্বেই তুমি যেন আটকে যেতে পার, অন্য কোনও সম্ভাবনার দরজা যেন আর ভোলা না থাকে, কেননা এবার থেকে তুমি যা করবে, সবই আমাদের জানা। |
সে অনুভব করেছে বাংলাদেশটা এভাবেই বদলে গিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ এদেশে নিয়ে এসেছিল ইউরোপীয় যুক্তির হাওয়া। এর বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল সে সময়েও, কিন্তু তা শুধু শাস্ত্রের বচন উদ্ধারে। অখণ্ড বাংলার লোকাচার, ব্রতপার্বণ, রূপকথা, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমিদের সঙ্গে এই বিরোধিতার কোনও যোগ ছিল না। একদিকে ইউরোপীয় যুক্তি, অন্যদিকে শাস্ত্রের নিয়ম—এই দুই পথে মানুষকে ব্যাখ্যা করার যুগ শুরু হল। সুবর্ণ জানে এর ভিতরে তার দেশের উপাদান কোথাও ছিল না, যে দেশের মানুষী চন্দ্রাবতী নিজের ভিতরে অন্য এক অস্তিত্বকে বহন করে রহস্যময়ী হয়ে ওঠেন, মানুষকে যে-দেশ আদিগন্ত বিস্তৃত, অপার সম্ভাবনাময় জমিন হিসাবেই জেনেছিল।
কয়েকদিন আগে, রাত্তিরবেলা, বিমলাপ্রসাদের মুখোমুখি বসে তার এই কথাগুলিই মনে হয়েছিল। বিমলাপ্রসাদ গল্প লেখে। সুবর্ণকে সে একরকম জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল গল্প শোনানোর জন্য। গ্রামের পটভূমিকায় লেখা গল্পটা, যেখানে হাঁটু অবধি কাপড় তোলা মানুষ, চাষি, বাগদি, গ্রাম্যবুড়ি, গ্রামের প্রকৃতি সবই ছিল; সে মন দিয়ে শুনেছিল; কিন্তু গল্প শেষ হবার পর সে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, ওই গল্পের ভিতরে কোথাও এই বাংলাদেশটা ছিল না।
‘বাংলাদেশটা কোথাও নেই রে, তুই আসলে ইলিউশানে ভুগছিস।' তার কথা শুনে বিজন এই কথাই বলেছিল। পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান—এসব তো আমরা বাবাদের মুখে শুনেছি।
‘কিন্তু বিজন, বাংলাদেশ মানে পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান নয়। আমি কোনও স্বর্ণযুগের কথা কল্পনা করছি না। সম্ভবত এরকম স্বর্ণযুগ ইতিহাসে কখনও ছিল না। আমি আমার বাবার মুখেই শুনেছি, ওপার বাংলার মুসলমানদের দারিদ্র্য ছিল অবর্ণনীয়, সেই যখন নাকি এক পয়সার চারটে মাছ পাওয়া যেত, তখনও তাদের মাছ কিনে খাবার ক্ষমতা ছিল না। বাংলাদেশ মানে একটা অন্যকিছু, একটা জীবনবধ...’
‘কিন্তু যুদ্ধ, দাঙা, মম্বন্তর, দেশ বিভাগ কি এই জীবনবোধকে বদলে দেয়নি? তাহলে সেই জীবনবোধকেই বা তুই কোথায় খুঁজে পাবি?'
এই প্রবহমান ভিড় থেকে সে আলাদা। আলাদা এবং একা তাকে হতেই হবে। চারপাশের সঙ্গে তার যোগসূত্রটা বোঝা যাবে না কোনওভাবেই। কেন সে এমন মানুষের মতো ভিড়ের মাঝেই থাকতে চাইছে, শহরের রাস্তায় রাস্তায়? তা কি ...চেতনাহীনতায় মিশে যাবার জন্য? সে তো চাইছে, এই ভিড় থেকে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র মানুষকে খুঁজে নিতে, এ তার এক অদম্য বিশ্বাস, হয়তো তার দিদিমা চন্দ্রাবতীর মতো অন্ধবিশ্বাস যে এইসব মানুষগুলোর মধ্যেই কিরণশশীর মতো আরও অনেক আত্মারা পুনর্জন্ম লাভ করেছে, তাদের নিশ্বাস যেন সে শুনতে পাচ্ছে।
এভাবেই তার অনেক রাত কেটে যায় অতন্দ্র জাগরণে, চারিদিকে সব শব্দ যখন থেমে যায়, তার ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দৌড়াদৌড়ি করে ধেড়ে ইঁদুর, গন্ধমুষিকরা; সে দেখে কীভাবে একটি গর্ভবতী মাকড়সা স্থির হয়ে বসে রয়েছে, আর শুয়ে থেকে কিছুতেই সে চোখ বুঝতে পারে না, মনে হয়, চারিদিকে এই রাতের ছিন্নবিচ্ছিন্ন শব্দগুলি যেন আজকের নয়...কবেকার ?...সেই যখন এদেশের মানুষেরা নদীর সঙ্গে কথা কইত? নদী, নদী, কোথায় যাও? বাপ-ভায়ের বার্তা দাও। নদী, নদী কোথায় যাও? সোয়ামি-শ্বশুরের বার্তা দাও। যেন কোন অদৃশ্য নদীর তীর থেকে ভেসে আসে রাত্রির সব শব্দ, কোনও গুহামন্ত্রের মতো যে শব্দরা জাগিয়ে তোলে আত্মাদের আর সে অনুভব করে, ঘরময় কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো সে বিছানায় উঠে বসে, সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে তাকায়, অনেক মৃতের কথা মনে পড়ে তার যাদের সে কখনও দেখেনি, যাদের কথা কখনও শোনেনি।
1 মন্তব্যসমূহ
আখ্যান নিরুদ্দিষ্ট মানুষের আত্মানুসন্ধান একমাত্র রবিশঙ্কর বল পারেন লিপিবদ্ধ করতে
উত্তরমুছুন