দু’দিকটা জুড়েই রয়েছে ছোট বড় বাঁশের ঝোপ। তার মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে পায়ে হাঁটার প্রশস্ত হালটটি। সুন্দর ঘন সবুজ বাঁশ পাতার সাথে সাথে সরু চিকন বাঁশের কঞ্চি গুলি মাথা গলিয়ে ঊর্ধ্বপানে চোখ মেলেছে। মনে হয় আকাশটাকে ভাল করে দেখে নিতে চায়। এখানকার মাটিতে কেমন যেন একটা সাদাটে ভাব আছে। হাত দিয়ে ধরলে নরম আর ঝুরঝুর করে ঝরে পরে। বৃষ্টি হলেও কাদা জমেনা হালটের মধ্যে। মানুষজন অনায়াসে চলাচল করতে পারে বৃষ্টি বাদলের পরও।
এই হালটটি এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে ডিস্ট্রিক বোর্ডের সরকারি পাকা সড়কের সাথে। আর সড়কটির পাশেই রয়েছে বিরাট বাঁধ। একসময় ধরলার জলে ভেসে যেত ধানের জমি, ফসলের ক্ষেত, উত্তর পাড়ার মেহানতি মানুষদের বাড়িঘর, মরিয়ম খালার সখের ফুল বাগান, করিম শেখের চায়ের চালা, ঝুপড়ি ঘর, কোন কিছুকেই ছাড় দিত না বন্যার প্লাবন। মুছে যেত কৃষকের মুখের হাসি, গোয়াল পাড়ায় গাভীরা জলে ভেসে দলা পাকিয়ে পা উপর দিকে দিয়ে নিথর শরীরে শুয়ে থাকতো। সেসব দৃশ্য ভেজা কাকের তীক্ষ্ণ চিৎকারে চৌচির হয়ে পড়তো চারদিকে। এখন বাঁধ হবার পর মরিয়ম খালার ফুল বাগানে বোতাম ফুল আর দোপাটি বাতাসে দোলে।
ফসলের ক্ষেত আর ধানের মাঠে ময়নাপাড়ার আদুরে মেয়ে ময়না খোলা চুলে লুটোপুটি খেলে বেড়ায়। ময়নার বড় বোন শ্যামা স্কুলে যায়। ময়নারও ইচ্ছা করে স্কুলে যেতে কিন্তু মা বলে আর একটু সবুর কর সামনের পৌষেই তুইও স্কুলে যাবি। ময়না জানে না সামনের পৌষ আর কত দিন। তবু সে ভাবে স্কুলে যাবে। স্কুলে গেলে যে কি হবে তাও সে জানে না। তবু মনেহয় শ্যামা যখন যায় সেও যাবে। সব কিছুতেই শ্যামার সাথে কেমন যেন একটা টানাপোড়েন আছে।
মরিয়ম খালা বহু দিন থেকে একা একা থাকেন। এক মেয়ে বিয়ের পর থেকে শহরে প্রবাসী। স্বামী, পুত্র, কন্যা, ব্যাবসা, বাড়ি, সবকিছু নিয়ে তার জমজমাট সংসার। দম নেবার সময় কই। আর এক ছেলে পাশ করার পরপরেই আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে সেখানেই সুখে সংসার করেছে। মরিয়ম খালার স্বামী সেলিম আলী কে জানে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। ৭১রের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে কেমন যেন সব সময় গুম মেরে বসে থাকতো। তখন সেলিম আলী মাত্র ১৯ বছরের দীপ্ত প্রাণ। যুদ্ধ করেছে ভুরঙ্গামারীতে।
একরাতে স্কুলের ভিটাতে লুকিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে গেরিলা যুদ্ধের সময় ঠিক সেলিমের পাশেই ছিল ওদেরই গ্রামের ছেলে টোকন। সুঠাম সাস্থ্য টোকেনের। হঠাৎ একটা গুলি কখন টোকেনের শরীর ভেদ করেছিল জানে না। শরীরটা ঝাঝরা হয়ে গিয়েছে। কি করে লাগলো বলতে পারবে না সেলিম, জানে না। নিজে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল কোন দিকে তাকাবার সুযোগ ছিল না। সেদিনের যুদ্ধ শেষে টোকনের রক্তাত্ব দেহটা নিশ্চল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না টোকনের শরীরে প্রাণ নেই। শুধু রক্ত আর রক্ত। ধুলা, মাটি আর ঘাস রক্তে মাখামাখি হয়ে একটা ভয়াবহ আবহ সৃষ্টি করেছিল।
সে রাতে সবাই প্রাণ পণ ছুটে যে যেদিকে পেরেছিল লুকিয়ে বেঁচেছিল। কিন্ত তারপর থেকেই কেমন একটা গভীর মর্ম ব্যাথা আর বীভৎস সব দৃশ্য তাড়া করে ফিরত সেলিমকে। মনকে শুধু ক্ষত বিক্ষত করতো। সে কেন বেঁচে রইল টোকন কেন মরে গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেলিম আলীর বাপ আজাহার আলী বলেছিল ‘বাপরে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করছো এখন আমার ব্যাবসা পাতি, জমিজমা দেখাশুনা কর তোর আর কি চিন্তা’। সেলিম আলীর মনে কি হয়েছিল তা কেউ জানে না। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নিজের মনেই ঘুরেফিরে থাকতো। মরিয়ম পাশের গ্রামের মেয়ে। তখন বি,এ পড়ছে নুর জাহান কলেজে। গ্রামের ফুলনের মা প্রস্তাব নিয়ে এল মরিয়মের বাপের কাছে। বিয়ে হয়ে গেল মরিয়মের সাথে সেলিম আলীর। দুটি সন্তান হবার পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলো না সেলিম আলী। অনেক চেস্টা করেও সেলিম মনোবৈকল্য থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে মরিয়ম দেখেছিল ঘরের দরজা খোলা, পাশের বিছানাটা খালি। সেদিন মধু পূর্ণিমার রাত্রি। শীতলকুঁচি গ্রাম, আনাচে কানাচে জোৎস্নার আলোতে ভরে উঠেছে। ধরলার শাীতল গভীর জলে চাঁদের রুপালী আলো ঝিকমিকি করছিল। সমগ্র গ্রাম জুড়ে হুহু করে ভরা ভাদরের ঠান্ডা বাতাসে উতলা হয়েছিল ঘরের কাছের আম গাছটা। হালটের বাঁশ ঝোপে শিরশির হাওয়া শরীরের সব রক্ত হিম করে দিয়েছিল। সেলিম আলী কোথায়, কখন, কেমন করে চলে গেল কেউ জানে না। ছেলে মেয়েরা তখন ছোট। নিজেরও বয়স কম। মরিয়মের বাপ মা বলেছিল ‘কি দরকার তোর এখানে থাকার চলে আয় আমাদের কাছে’। মরিয়ম রাজী হয়নি। সেলিম বাবা মার একমাত্র সন্তান। শ্বশুড় শাশুড়ি অনেক আদর দিয়েই মরিয়মকে বাড়ীতে রেখেছিলেন। আর মরিয়ম সব সময় ভেবেছে হয়তো সেলিম কোন একদিন ফিরে আসবে। এত উদাসীন মানুষটাকে নিজের অজান্তেই কখন ভালবেসেছে। অনেক দিন ঘরে বসে থেকে শেষে গ্রামেরই একটা স্কুলে কাজ নেয় মরিয়ম আর তারপর থেকে কেমন করে যেন সে সবার কাছে মরিয়ম খালা হয়ে গেল।
ঝর্ণারা যে বাড়িটাতে থাকে তা থেকে বের হয়ে বাঁ দিকে একটু মোড় নিলে এ গ্রামের এক খানা বড় মাঠ। এ মাঠটাকে বলা যায় গ্রামের একটা প্রাণ কেন্দ্র। এ মাঠেই রথের মেলা বসে, ভিন গ্রাম আর ভিন দেশ থেকে আসা যাত্রা দল রাত ভরে যাত্রা পালা করে, এ মাঠেই ঈদের জামাত নামাজ হয়, মাসে একবার হাট বসে। শীতলকুঁচির হাট। গ্রামের নামে নাম। এ হাট নাম করা হাট। দূর, দূর থেকে লোকজন আসে, প্রচুর বেচা কেনা হয়। গ্রামের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় এখানে। সেদিন শহর থেকে আসে অনেক বড় বড় হর্তা কর্তারা। পুরস্কার বিতরনের কত অনুষ্ঠান। শ্যামার গান, ময়নার নাচ, পাড়ার ছোট বড় বাচ্চারা মিলে মিশে পরিশ্রম করে, যত্ন করে তৈরি করে নাটক, গান আরো কত কিছু। মরিয়ম খালার কাছ থেকে নিয়ে আসে শাড়ি, ঝর্ণা তার মায়ের কাছ থেকে গোপনে লুকিয়ে নিয়ে আসে নাচের সাজ পোশাক, চুড়ি, মালা, কাজল, লিপস্টিক, আলতা। সবাই মিলে দিনটাকে সুন্দর আর সফল করার জন্য উৎসবে মেতে উঠে।
মাঠের শেষে দক্ষিণের সীমানার বাইরে একটা বিশাল তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছটাতে এত তেঁতুল হয় গ্রামের লোকজন ছাড়াও দু’চার গ্রামের মানুষ জন থেকে শুরু করে ভিন গ্রামের বৌ’ঝিরাও এসে তেঁতুল পেড়ে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলে না। গাছের ফল - সবারইতো হক আছে। অনেক দিন আগে কোন এক মাঘের শেষে তেঁতুল গাছে করিম শেখের বড় ভাই বাহার শেখের লাশ ঝুলতে দেখা গিয়েছিল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পর দিন। সে কি আত্মহত্যা করেছিল নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল সেটা নিয়ে করিম শেখ বেশি নাড়াচাড়া হতে দেয়নি। শুধু বড় ভাইয়ের সুন্দরী বৌ যখন গুন গুন করে কাঁদতো করিম শেখ তার কান্না মুছে দেবার জন্য ঐ বাড়িতেই রাতে থেকে যেত। গ্রামে কানাঘুসার করার জন্য বেশিদিন সময় দেয়নি সে। তিন মাসের মধ্যেই বাহারের বৌটাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুলে ছিল করিম শেখ। বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কি কারণে এরপর থেকে তেঁতুল গাছে আর পাখিরা বাসা বাঁধে না। আগে বিল থেকে উড়ে আসতো বক, দুপুরের রৌদ্রে ঝিম মেরে বসে রইত মাছরাঙ্গা পাখি। শালিখরাও আর কিচিরমিচির করে বাতাসকে তিক্ত করে না। মনে হয় রুপকথা রাজ্যের বেঙমা, বেঙমী চুপিসারে পালিয়ে যাবার সময় সব চুরি করে সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। কাওকে বলেনি তাদের চলে যাবার কথা।
মাঠটাকে পিছে ফেলে সোজা চলে গেলে সর্ষে ক্ষেত, আর একটু এগুলে তিসি ক্ষেতে ফুটে রয় সুন্দর নীল তিসি ফুল। মেঠো পথটার দুপাশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সবুজ ফসলের সমারোহ। মাঠের শেষ প্রান্তে শ্যামা আর ময়নাদের বাড়ি। শ্যামার মা বকুলবালা ভাল সেলাই জানে, ছোটদের জামা কাপড়, বালিসে ফুল তোলা, পেটিকোটের নিচে ঝালর দেবার জন্য ক্রুসে বোনা লেস। ভারী চমৎকার হয় দেখতে। গ্রামের বৌ’রা, মায়েরা আসে বকুলবালার কাছে সে সব কিনতে। তাতে সংসারে একটু হলেও সাশ্রয় হয়। বকুলবালার স্বামী নিতাই নিরীহ মানুষ। দিন মজুরীর কাজ করে, নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে, সময় অসময়ে গাঁয়ের নানান কাজে কর্মে ডাক পড়ে নিতাইয়ের। রোজগার নেহাতই খারাপ হয়না। বছরে দু একটা নতুন জামা কাপড় সে কিনতেই পারে। মাঝে মাঝে হাটবার দিন দরদাম করে আধা সের মাংস কিনে রাজা বাদশাহ মেজাজে চিকন চালের ভাত আর খাসা করে মাংস রাঁধতে বলে বকুলবালাকে। ভাঙ্গা ঘরে সেদিন চাঁদের আলো উপচে পড়ে।
তালতলা দিয়ে একটু সামনের দিকে এগুলে পুরনো মন্দিরটা দেখা যায়। যত্নের অভাবে মন্দিরটির বেশ জীর্ণ হাল হয়েছে। সংস্কার করার কথা থাকলেও হয়ে উঠছে না। ঝর্ণা ভাবে এবারের কালী পূজার সময় একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাই মিলে চেস্টা করলে মন্দিরটির শ্রী ফিরবে। মন্দিরের পিছনে ঝোপ ঝাড়ের ভিতর কুঁচ গাছে কুঁচ ফুল ফোটে। লাল রংয়ের আর মুখের কাছে একটু কালো। এক রত্তি এ ফুল। দেখতে অপূর্ব। ঝর্ণা কাপড়ের কোচড়ে এলোমেলো ভাবে কুঁচ গুলি নিয়ে ভরছিল। আর বার বার আড় চোখে হালটের দিকে চোখ রাখছিল। আকাশে বেশ জোর ঘনঘটার আভাস দেখা যাচ্ছে। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। হয়তো আর একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। বাতাস উঠবে। ঝর্ণার মনে পরলো আচারের বোতল গুলি রোদে দিয়েছিল। ওটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না। মনে হল এই যে একটা সময় তার জীবনের পটে আঁকা ছবির মতন, সে পারে রংয়ের মাধুরীতে ভরে দিতে অথবা নাই বা দিল সাদা কাগজে তুলির আঁচড়। জীবনের ছবি গুলিতে কতটা কম বা কতটা বেশী রং আর সাদাটে রাখবে তাতে কতটাই বা তার অধিকার আছে? মনে মনে যত ছবিই আঁকুক না কেন কোনটাই বা শেষ পর্যন্ত মনের মতন হয়ে উঠতে পারে। বেলি ফুলের শুভ্রতা সুরভিত হয় তারই সুরভিতে। অজানা অচেনা নিত্য নতুন মোড়কে জীবন প্রতিনিয়ত তছনছ হয় অথবা প্রাণসুধায় ভরে উঠে। এ এক আশ্চর্য বিস্ময়। এ শুধু অবাক হয়ে শুনার আর দেখার। এতই আনমনা ছিল ঝর্ণা বুঝতেই পারেনি কোন ফাঁকে রাইসুল এসে তার দু’চোখ চেপে ধরেছে।
-কি গো -কুঁচবরণ কন্যার মেঘ বরণ চুল কি কর নিমগ্ন হয়ে?
-কিছু না, হুঁম তোমারে দেখতে পাইনিতো। আমিতো তোমার জন্য বারে বারেই রাস্তার দিকে চোখ রাখছিলাম।
-ফাঁকি দিলাম তোমারে, আমি পিছন থেকে এসেছি।
-তাই বল। একটু হাসল সে।
-মন খারাপ?
-হ্যাঁ তুমি চলে যাবে আমার মন খারাপ হবে না?
-কিন্তু আবার ফিরে আসবতো।
দুই গ্রাম পরে বড় পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টারের ছেলে রাইসুল। ভাল বাঁশি বাজায়। শহরে এম এ ক্লাসে পড়ে। লেখা পড়াতে ভাল। পোস্ট মাস্টার অনেক আশা করে আছে রাইসুল পাস করে বড় চাকরী করবে। সুখের মুখ দেখবে। মধ্যবিত্ত জীবনে এ রকম আশা সব বাবা মা’রাই করে থাকে। এবারে পরীক্ষার জন্য দু মাসের উপর শহরেই থাকবে বাড়িতে আসবে না। মন্দিরের সিঁড়ির উপর বসে দুজন পাশাপাশি, কাছাকাছি। হাতে হাত। নীরবে পার করে দেয় কাছে পাবার এই বিরল মুহুর্ত গুলি। তখনই হঠাৎ বৃষ্টি নামে। মন্দিরটির ছাদের ঠিক নিচেই কড়িকাঠের ফাঁকে ফাঁকে জংলী কবুতরের বাসা। হঠাৎ বৃষ্টিতে কবুতর গুলি ডানা ঝাপটিয়ে ছটফট শুরু করে দেয়। বৃষ্টির ফোটা গাছের পাতার উপর পরে নেমে আসে ডগায়, ডালে আর ঝরে পরে মাটিতে। একটা সোঁদামাটির গন্ধে ভরে যার মন্দিরের আঙ্গিনা। বৃষ্টির জল ঝলাৎ ঝলাৎ ধরলা নদীতে। তেঁতুল পাতায় পাতায় জলের নাচন। ঝর্ণা আর রাইসুলের না বলা কথা গুলি ক্ষুব্ধ আকুলতায় বৃষ্টির জলে ভেসে যায়। মনে মনে দুজনায় জানে যেতে হবে অনেকটা পথ। আর সে পথের শেষে কি আছে সেটা তারা জানে না। জানলেও অস্বীকার করে। গুমরে উঠা অশ্রু একাকার হয়ে ধুয়ে চলে যায় কালের অতলে।
সেদিন গভীর রাতে দমকা হাওয়ায় ঘরের বন্ধ দরজা হাট করে খুলে যায়। চমকে খাটের উপর উঠে বসে মরিয়ম খালা। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে ঠিক বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে এলোমেলো করে দেয় বিছানার চাদর, কাগজ উড়ে যায় ইতঃস্তত। টিপায়ের উপর ফুলদানীটা মুখ থুবরে পরে মোঝেতে। বুকের ভিতর বহু যুগের ব্যাথাটা খামছে ধরে। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যায় মরিয়ম খালা। বারান্দাটা বৃষ্টির ঝাপটাতে ভিজে গিয়েছে। কি মনে করে পায়ে পায়ে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। বিদুৎ চমকানিতে চারপাশটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। মনে হল ঘরের পাশে আম গাছ তলায় কে দাঁড়িয়ে। বিদুৎ খেলে যায় নিজের শরীরে। সত্যি কি কাউকে দেখতে পেয়েছে? বৃষ্টি বাতাস উপেক্ষা করে পায়ে পায়ে মরিয়ম উঠানে নেমে আসে। ‘কে কে কে’... মরিয়মের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায় না। তখনই মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বক আকাশে উড়ে গেল মরিয়মের কথার প্রতিধ্বনি করে ‘কে কে কে...’। ঠিকই দেখেছে, ঠিকই চিনতে পেরেছে। জীবনের প্রতি পলে পলে অপেক্ষায় ছিল ফিরবে সে। আজ ফিরেছে ..। মরিয়মের জীবনে প্রথম ঊষার লগ্নে যে আলোর সম্ভাবনা নিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল হঠাৎ সে এক অজানা সংকেতে থমকে গিয়েছিল। আজ আবার নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দেখা দিল। সেলিম এসেছে ফিরে এই গ্রামে, তার শূন্য জীবনে।
জীবন বয়ে যায় জীবনের নিয়মে, তার নিজস্ব গতিতে। মানুষ খেয়ার কুলে মিছে ঘর বাঁধে। ধুলা মাটির খেলাঘরে সুখের খেলায় দিন পার করে আনন্দতো পায় না। তবু ছোট ছোট সুখ দুঃখের দোলায় দুলে দুলে ছোট্ট খেয়ার নৌকা আনন্দ সাগরে ভাসতে চায়। শীতলকুঁচি সাধারণ ক্ষুদ্র একটা গ্রামে অকিঞ্চিৎকর মানুষদের জীবনে আসে বৃষ্টির সুবাতাস, আসে ভালবাসার সুঘ্রাণ, আসে আগামির প্রতিশ্রুতি….।
ঝর্ণারা যে বাড়িটাতে থাকে তা থেকে বের হয়ে বাঁ দিকে একটু মোড় নিলে এ গ্রামের এক খানা বড় মাঠ। এ মাঠটাকে বলা যায় গ্রামের একটা প্রাণ কেন্দ্র। এ মাঠেই রথের মেলা বসে, ভিন গ্রাম আর ভিন দেশ থেকে আসা যাত্রা দল রাত ভরে যাত্রা পালা করে, এ মাঠেই ঈদের জামাত নামাজ হয়, মাসে একবার হাট বসে। শীতলকুঁচির হাট। গ্রামের নামে নাম। এ হাট নাম করা হাট। দূর, দূর থেকে লোকজন আসে, প্রচুর বেচা কেনা হয়। গ্রামের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় এখানে। সেদিন শহর থেকে আসে অনেক বড় বড় হর্তা কর্তারা। পুরস্কার বিতরনের কত অনুষ্ঠান। শ্যামার গান, ময়নার নাচ, পাড়ার ছোট বড় বাচ্চারা মিলে মিশে পরিশ্রম করে, যত্ন করে তৈরি করে নাটক, গান আরো কত কিছু। মরিয়ম খালার কাছ থেকে নিয়ে আসে শাড়ি, ঝর্ণা তার মায়ের কাছ থেকে গোপনে লুকিয়ে নিয়ে আসে নাচের সাজ পোশাক, চুড়ি, মালা, কাজল, লিপস্টিক, আলতা। সবাই মিলে দিনটাকে সুন্দর আর সফল করার জন্য উৎসবে মেতে উঠে।
মাঠের শেষে দক্ষিণের সীমানার বাইরে একটা বিশাল তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছটাতে এত তেঁতুল হয় গ্রামের লোকজন ছাড়াও দু’চার গ্রামের মানুষ জন থেকে শুরু করে ভিন গ্রামের বৌ’ঝিরাও এসে তেঁতুল পেড়ে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলে না। গাছের ফল - সবারইতো হক আছে। অনেক দিন আগে কোন এক মাঘের শেষে তেঁতুল গাছে করিম শেখের বড় ভাই বাহার শেখের লাশ ঝুলতে দেখা গিয়েছিল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পর দিন। সে কি আত্মহত্যা করেছিল নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল সেটা নিয়ে করিম শেখ বেশি নাড়াচাড়া হতে দেয়নি। শুধু বড় ভাইয়ের সুন্দরী বৌ যখন গুন গুন করে কাঁদতো করিম শেখ তার কান্না মুছে দেবার জন্য ঐ বাড়িতেই রাতে থেকে যেত। গ্রামে কানাঘুসার করার জন্য বেশিদিন সময় দেয়নি সে। তিন মাসের মধ্যেই বাহারের বৌটাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুলে ছিল করিম শেখ। বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কি কারণে এরপর থেকে তেঁতুল গাছে আর পাখিরা বাসা বাঁধে না। আগে বিল থেকে উড়ে আসতো বক, দুপুরের রৌদ্রে ঝিম মেরে বসে রইত মাছরাঙ্গা পাখি। শালিখরাও আর কিচিরমিচির করে বাতাসকে তিক্ত করে না। মনে হয় রুপকথা রাজ্যের বেঙমা, বেঙমী চুপিসারে পালিয়ে যাবার সময় সব চুরি করে সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। কাওকে বলেনি তাদের চলে যাবার কথা।
মাঠটাকে পিছে ফেলে সোজা চলে গেলে সর্ষে ক্ষেত, আর একটু এগুলে তিসি ক্ষেতে ফুটে রয় সুন্দর নীল তিসি ফুল। মেঠো পথটার দুপাশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সবুজ ফসলের সমারোহ। মাঠের শেষ প্রান্তে শ্যামা আর ময়নাদের বাড়ি। শ্যামার মা বকুলবালা ভাল সেলাই জানে, ছোটদের জামা কাপড়, বালিসে ফুল তোলা, পেটিকোটের নিচে ঝালর দেবার জন্য ক্রুসে বোনা লেস। ভারী চমৎকার হয় দেখতে। গ্রামের বৌ’রা, মায়েরা আসে বকুলবালার কাছে সে সব কিনতে। তাতে সংসারে একটু হলেও সাশ্রয় হয়। বকুলবালার স্বামী নিতাই নিরীহ মানুষ। দিন মজুরীর কাজ করে, নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে, সময় অসময়ে গাঁয়ের নানান কাজে কর্মে ডাক পড়ে নিতাইয়ের। রোজগার নেহাতই খারাপ হয়না। বছরে দু একটা নতুন জামা কাপড় সে কিনতেই পারে। মাঝে মাঝে হাটবার দিন দরদাম করে আধা সের মাংস কিনে রাজা বাদশাহ মেজাজে চিকন চালের ভাত আর খাসা করে মাংস রাঁধতে বলে বকুলবালাকে। ভাঙ্গা ঘরে সেদিন চাঁদের আলো উপচে পড়ে।
তালতলা দিয়ে একটু সামনের দিকে এগুলে পুরনো মন্দিরটা দেখা যায়। যত্নের অভাবে মন্দিরটির বেশ জীর্ণ হাল হয়েছে। সংস্কার করার কথা থাকলেও হয়ে উঠছে না। ঝর্ণা ভাবে এবারের কালী পূজার সময় একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাই মিলে চেস্টা করলে মন্দিরটির শ্রী ফিরবে। মন্দিরের পিছনে ঝোপ ঝাড়ের ভিতর কুঁচ গাছে কুঁচ ফুল ফোটে। লাল রংয়ের আর মুখের কাছে একটু কালো। এক রত্তি এ ফুল। দেখতে অপূর্ব। ঝর্ণা কাপড়ের কোচড়ে এলোমেলো ভাবে কুঁচ গুলি নিয়ে ভরছিল। আর বার বার আড় চোখে হালটের দিকে চোখ রাখছিল। আকাশে বেশ জোর ঘনঘটার আভাস দেখা যাচ্ছে। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। হয়তো আর একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। বাতাস উঠবে। ঝর্ণার মনে পরলো আচারের বোতল গুলি রোদে দিয়েছিল। ওটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না। মনে হল এই যে একটা সময় তার জীবনের পটে আঁকা ছবির মতন, সে পারে রংয়ের মাধুরীতে ভরে দিতে অথবা নাই বা দিল সাদা কাগজে তুলির আঁচড়। জীবনের ছবি গুলিতে কতটা কম বা কতটা বেশী রং আর সাদাটে রাখবে তাতে কতটাই বা তার অধিকার আছে? মনে মনে যত ছবিই আঁকুক না কেন কোনটাই বা শেষ পর্যন্ত মনের মতন হয়ে উঠতে পারে। বেলি ফুলের শুভ্রতা সুরভিত হয় তারই সুরভিতে। অজানা অচেনা নিত্য নতুন মোড়কে জীবন প্রতিনিয়ত তছনছ হয় অথবা প্রাণসুধায় ভরে উঠে। এ এক আশ্চর্য বিস্ময়। এ শুধু অবাক হয়ে শুনার আর দেখার। এতই আনমনা ছিল ঝর্ণা বুঝতেই পারেনি কোন ফাঁকে রাইসুল এসে তার দু’চোখ চেপে ধরেছে।
-কি গো -কুঁচবরণ কন্যার মেঘ বরণ চুল কি কর নিমগ্ন হয়ে?
-কিছু না, হুঁম তোমারে দেখতে পাইনিতো। আমিতো তোমার জন্য বারে বারেই রাস্তার দিকে চোখ রাখছিলাম।
-ফাঁকি দিলাম তোমারে, আমি পিছন থেকে এসেছি।
-তাই বল। একটু হাসল সে।
-মন খারাপ?
-হ্যাঁ তুমি চলে যাবে আমার মন খারাপ হবে না?
-কিন্তু আবার ফিরে আসবতো।
দুই গ্রাম পরে বড় পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টারের ছেলে রাইসুল। ভাল বাঁশি বাজায়। শহরে এম এ ক্লাসে পড়ে। লেখা পড়াতে ভাল। পোস্ট মাস্টার অনেক আশা করে আছে রাইসুল পাস করে বড় চাকরী করবে। সুখের মুখ দেখবে। মধ্যবিত্ত জীবনে এ রকম আশা সব বাবা মা’রাই করে থাকে। এবারে পরীক্ষার জন্য দু মাসের উপর শহরেই থাকবে বাড়িতে আসবে না। মন্দিরের সিঁড়ির উপর বসে দুজন পাশাপাশি, কাছাকাছি। হাতে হাত। নীরবে পার করে দেয় কাছে পাবার এই বিরল মুহুর্ত গুলি। তখনই হঠাৎ বৃষ্টি নামে। মন্দিরটির ছাদের ঠিক নিচেই কড়িকাঠের ফাঁকে ফাঁকে জংলী কবুতরের বাসা। হঠাৎ বৃষ্টিতে কবুতর গুলি ডানা ঝাপটিয়ে ছটফট শুরু করে দেয়। বৃষ্টির ফোটা গাছের পাতার উপর পরে নেমে আসে ডগায়, ডালে আর ঝরে পরে মাটিতে। একটা সোঁদামাটির গন্ধে ভরে যার মন্দিরের আঙ্গিনা। বৃষ্টির জল ঝলাৎ ঝলাৎ ধরলা নদীতে। তেঁতুল পাতায় পাতায় জলের নাচন। ঝর্ণা আর রাইসুলের না বলা কথা গুলি ক্ষুব্ধ আকুলতায় বৃষ্টির জলে ভেসে যায়। মনে মনে দুজনায় জানে যেতে হবে অনেকটা পথ। আর সে পথের শেষে কি আছে সেটা তারা জানে না। জানলেও অস্বীকার করে। গুমরে উঠা অশ্রু একাকার হয়ে ধুয়ে চলে যায় কালের অতলে।
সেদিন গভীর রাতে দমকা হাওয়ায় ঘরের বন্ধ দরজা হাট করে খুলে যায়। চমকে খাটের উপর উঠে বসে মরিয়ম খালা। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে ঠিক বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে এলোমেলো করে দেয় বিছানার চাদর, কাগজ উড়ে যায় ইতঃস্তত। টিপায়ের উপর ফুলদানীটা মুখ থুবরে পরে মোঝেতে। বুকের ভিতর বহু যুগের ব্যাথাটা খামছে ধরে। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যায় মরিয়ম খালা। বারান্দাটা বৃষ্টির ঝাপটাতে ভিজে গিয়েছে। কি মনে করে পায়ে পায়ে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। বিদুৎ চমকানিতে চারপাশটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। মনে হল ঘরের পাশে আম গাছ তলায় কে দাঁড়িয়ে। বিদুৎ খেলে যায় নিজের শরীরে। সত্যি কি কাউকে দেখতে পেয়েছে? বৃষ্টি বাতাস উপেক্ষা করে পায়ে পায়ে মরিয়ম উঠানে নেমে আসে। ‘কে কে কে’... মরিয়মের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায় না। তখনই মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বক আকাশে উড়ে গেল মরিয়মের কথার প্রতিধ্বনি করে ‘কে কে কে...’। ঠিকই দেখেছে, ঠিকই চিনতে পেরেছে। জীবনের প্রতি পলে পলে অপেক্ষায় ছিল ফিরবে সে। আজ ফিরেছে ..। মরিয়মের জীবনে প্রথম ঊষার লগ্নে যে আলোর সম্ভাবনা নিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল হঠাৎ সে এক অজানা সংকেতে থমকে গিয়েছিল। আজ আবার নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দেখা দিল। সেলিম এসেছে ফিরে এই গ্রামে, তার শূন্য জীবনে।
জীবন বয়ে যায় জীবনের নিয়মে, তার নিজস্ব গতিতে। মানুষ খেয়ার কুলে মিছে ঘর বাঁধে। ধুলা মাটির খেলাঘরে সুখের খেলায় দিন পার করে আনন্দতো পায় না। তবু ছোট ছোট সুখ দুঃখের দোলায় দুলে দুলে ছোট্ট খেয়ার নৌকা আনন্দ সাগরে ভাসতে চায়। শীতলকুঁচি সাধারণ ক্ষুদ্র একটা গ্রামে অকিঞ্চিৎকর মানুষদের জীবনে আসে বৃষ্টির সুবাতাস, আসে ভালবাসার সুঘ্রাণ, আসে আগামির প্রতিশ্রুতি….।
লেখক পরিচিতি
মলি আহমেদ একজন সাহিত্য অনুরাগী, গভীর রবীন্দ্র প্রেমী এবং মুক্তমনা ব্যক্তিত্ব। লিখতে ভালবাসেন, পড়তে ভালবাসেন আর প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান সারা পৃথিবী জুড়ে। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকায়, বর্তমানে সিডনি বাসী।
মলি আহমেদ একজন সাহিত্য অনুরাগী, গভীর রবীন্দ্র প্রেমী এবং মুক্তমনা ব্যক্তিত্ব। লিখতে ভালবাসেন, পড়তে ভালবাসেন আর প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান সারা পৃথিবী জুড়ে। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকায়, বর্তমানে সিডনি বাসী।
0 মন্তব্যসমূহ