দীপেন ভট্টাচার্যের গল্প : আমেনহোতেপের সময়



সূর্য ডুবে গেলে পরে রুক্ষ পাহাড়ের কোলে সম্রাজ্ঞী হাতসেপসুতের মন্দিরের খিলানগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে। সারা দিন বাটালের ওপর হাতুড়ি চালিয়ে লাল হয়ে থাকে আমার দুই হাত, গত কয়েকদিন ধরে বাম করতলে একটা ফোস্কা শান্তি দেয় না। দেবতা আমুন-রা’র স্তুতিগাথাকে খোদাই করি একটা বড় শিলায়, তার ওপর লাল ও সবুজ রঙের প্রলেপ দিই, রুক্ষ বাদামি-হলুদ পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শিলালিপি। বন্ধু আমেনাখত বলে, “আমেনহোতেপ, বাড়ি যাও, কাজটা শেষ করার জন্য আরো দু’দিন সময় আছে। ফোস্কাটার যত্ন নাও, নইলে পরে আর বাটালি ধরতে পারবে না।”

নীল নদে এখন বন্যার স্রোত, বন্যার প্রথম মাস মাত্র, বহু দক্ষিণে কুশ দেশের বৃষ্টির জল ভেসে আসে এই উত্তরে। নৌকায় নদী পার হই পশ্চিম থেকে পুবে। পার হতে হতে ফোস্কার ব্যথাটা তীব্র হতে থাকে। নৌকা পাড়ে ঠেকলে ভাবি হেকেত খেলে ব্যথার উপশম হতে পারে। নৌকার ঘাট থেকে পানশালা দু’মিনিটেরও পথ নয়, সেখানে মূলত রাজকীয় প্রতিনিধি আর ধনী ব্যবসায়ী আসে। শিক্ষিত লেখক হিসেবে পানশালার মালিক আমাকে সম্মান করে, তাই এখানে আমার ঢুকতে বাধা নেই। সেখানে যেয়ে দেখি বেশ ভীড়, অনেকে দাঁড়িয়ে, কেউ মেঝেতে বসে। কম্পিত তেলের প্রদীপ কেমন যেন অদ্ভুত আবেশ সৃষ্ট করেছে। মালিককে আমার বাটালিটা দিয়ে বললাম, “এক ঘটি হেকেত দাও।” ও ভাবেনি এমন মূল্যবান একটি জিনিস হাতছাড়া করব, বলল, “এর বদলে আপনাকে আমি দু ঘটি হেকেত দেব।” মালিক খুব ভাল মানুষ, নাম নেবনেফের।

মেঝেতে বসে নেবনেফেরের দু ঘটি হেকেত খেয়ে মাতাল হই, ফোস্কার কথা মনে থাকে না। হঠাৎ খেয়াল হয় আমার পাশে এক বুড়ো বসা, কখন সে এসেছে মনে করতে পারি না। আমি বিড়বিড় করে বলছিলাম, “আমার ছেলেটা হঠাৎ বড় হয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটা পাঁচ বছরের, এমন যদি হত যে, ও সবসময়ই ওরকমই থাকবে।” এটুকুই, সেদিন সেই বুড়োর প্রতি মনোযোগ দিইনি, কিন্তু মনে হয় সেও আমার মত বিড়বিড় করে বলেছিল, “বাহ, বেশ তো, এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট হলে মন্দ কী? আর কে থাকে তোমার সাথে?” ‘এক্সপেরিমেন্ট’ কথাটার অর্থ বুঝলাম না, কিন্তু মনে হয় উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, আর মা; ছেলে বড়, মেয়ে ছোট।”

“আর তোমার মেয়ের নাম?” “নাউনাখত! আমার চোখের মণি।” এরপরে আরো কত কী বলেছিলাম মনে নেই, হয়তো বলেছিলাম, “আমুন-রা’র দিব্যি, আর কেউ যদি বুড়ো না হয় তো আরো ভাল।”

বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হল, দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রণরঙ্গিনী সম্রাজ্ঞী হাতসেপসুত। না, ঠাট্টা করছি, আমার বউএর নাম হল মেনাতনাখত, কিন্তু তার মেজাজ মর্জি দেখে তাকে আমি মাঝে মধ্যে আমাদের ফারাও হাতসেপসুতের নামে ডাকতাম। তো তাকে হাতের ফোস্কার কথাটা বলে কিছুটা শান্ত করলাম, সহানুভূতি পেলাম। বাটালিটা যে হেকেতের বদলে দিয়ে এসেছি সেটা চেপে গেলাম, আর একটি বাটালি আছে আমার। মেনাতনাখত সেসময়ে ছিল আট মাসের অন্তঃস্বত্তা, ভরা পেট নিয়ে বেচারি আমার ওপর বেশি হম্বিতম্বি করতে পারল না। নাউনাখত দৌড়ে এসে কোলে চড়তে চাইল, তাকে তার মা বকা দিয়ে ঘরে কোনায় গিয়ে বসে থাকতে বলল। জিজ্ঞেস করলাম, “নেফেরহোতেপ কোথায়?” ছেলে নেফেরহোতেপের বয়স আট, সকালে ওকে দেবী হাথোরের একটা প্রার্থনা সঙ্গীত নকল করতে দিয়ে গিয়েছিলাম, আমেনহোতেপের ছেলে বড় হয়ে আমেনহোতেপের মতই লেখক হবে এই ছিল আমার অভিলাষ। মেনাতনাখত বলল, “তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছে।”

এই বয়সেই নেফেরহোতেপের হাতের লেখা চমৎকার, নলখাগড়ার কলম ঠিকমত ধরে, নিজে থেকেই কালি বানিয়ে নেয়। বাড়িতে পাপিরাসের কাগজ বেশি নেই, যা আছে তাতেই অনুশীলন করে। একটা প্রদীপ নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকি, প্রদীপের কম্পিত শিখায় নেফেরহোতেপের ঘুমন্ত মুখাবয়ব জীবন্ত হয়ে ওঠে, স্নেহের ছেলে আমার – প্রাণের প্রদীপ। পাশে পাপিরাসের পাতাটা কুণ্ডুলী পাকিয়ে আছে। হাতের প্রদীপ মাটিতে রেখে ছেলের পাশে বসি, পাতাটা তুলে নিয়ে পড়ি, নেফেরহোতেপের কাঁপা হাতের লেখায় –

হে পশ্চিম আকাশের সম্মিলিত প্রবীণগণ,
হে পশ্চিম আকাশের সম্মিলিত দেবগণ,
হে পশ্চিম আকাশকূলের অধিরাজেরা
আমরা হাথরের আগমনে উৎসব করি,
আমরা তার সৌন্দর্য অবগাহনে আনন্দ করি।

মিশরের খুব কম মানুষই এই লেখা পড়তে পারবে, ছেলের কাজে খুব গর্ব হয় আমার।

সেই রাতটি অন্য অনেক রাতের মতই ছিল বলব, কিন্তু হেকেতের প্রভাবেই হোক, কী অন্য কোনো কারণেই হোক আমার ঘুম হল না। সূর্য ওঠার আগে ঘর থেকে বের হয়ে আসি, পুব আকাশে লুব্ধক তারা জ্বলজ্বল করে, তার উদ্দেশ্য মনে মনে বলি, “হে দেবী সপদেত, আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখো।” আসলে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সপদেত, হাথোর বা আমুন-রা কারুর কাছেই হয়তো আর প্রার্থনার দরকার ছিল না, কারণ – এতদিন পরে যা মনে হয় – তার আগের রাতেই নেবনেফেরের শুঁড়িখানায় আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

সেই রাতের পরে কয়েক মাস কেটে গেল, কিন্তু বউ মেনাতনাখতের অন্তঃস্বত্তা ভাব যেমন ছিল তেমনই রইল, তার যে ভরা অবস্থা ছিল তার আর কোনো পরিবর্তন হল না, এমন যেন সময় তার জন্য থমকে গেছে। কী ধরণের কষ্ট বেচারিকে ভোগ করতে হচ্ছিল বুঝতেই পারছেন। মেনাতনাখতের গর্ভবতী অবস্থা থেকে নানান মুক্তির পথ আমরা চিন্তা করেছি, কিন্তু হিত করতে বিপরীত ফলের ভয়ে ওদিকে অগ্রসর হইনি।

আমার বয়স্কা মা আমাদের দুটি ঘরের উল্টোদিকে, উঠোন পেরিয়ে একটা ঘরে থাকতেন। বন্যার প্রথম মাসে মা মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন, উনি যে সে সময় কী শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তা বলে বোঝাবার নয়। পাঠকের নিশ্চয় এরকম নিকটজনের কষ্ট কাছ থেকে দেখবার অভিজ্ঞতা আছে, সেখানে মৃত্যু হল এক ধরণের মুক্তি। দুঃখের বিষয় মা মুক্তি পেলেন না, বরং অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে রইলেন। তাঁর নিরন্তর কোঁকানি শুনে মাঝে মধ্যে আমি ও আমার স্ত্রী ভাবতাম তাঁকে মুক্তি দেবার কোন উপায় আছে কিনা, কিন্তু সেই উপায়টি এমনই ভয়ানক যে সেই পদক্ষেপটি নিতে আমরা সাহস করতে পারিনি। একটি বছর এ’ভাবে কাটল।

এই একটি বছর যে কী ধরণের অস্বস্তি ও যন্ত্রণায় কেটেছে তা বলে বোঝানোর নয়। আর এদিকে ওয়াসেত জনপদে আমাদের সম্বন্ধে নানা কানাঘুষো শুরু হল, বাড়ির ঝি হেনেতসেনু খবর নিয়ে এল, বাজারে গুজব আমাদের বাড়িতে নাকি স্বয়ং অপদেবতা অ্যাপোফিস বাস করছে। বন্ধু আমেনাখত বলল, নদীর পশ্চিম পাড়েও খবরটি ছড়িয়েছে – জগৎ ধ্বংস করতে ওয়াসেত জনপদে অ্যাপোফিস নেমেছে, আর তার আবির্ভাবের প্রথম পর্যায়ে সে আমাদের বাড়িতে সময় থামিয়ে দিয়েছে। বাজারে অনেক দোকান আমাকে দ্রব্য বিক্রী করা বন্ধ করে দিল, হেনেতসেনুকে দিয়েই জিনিসপত্র কেনাতে হত। তবে ভাগ্য তাও ভাল বলতে হবে যে, ওয়াসেত নগরাধ্যক্ষ আমার কাজ পছন্দ করতেন, তাই কাজের ফরমাশ বন্ধ হয়নি, তাই বাড়িতে খাদ্যের অভাব হল না। অন্যদিকে দেখুন, মানুষের স্মৃতি এমন একটা অদ্ভুত জিনিস, এই বছরটিতে নেবনেফেরের পানশালার সেই বুড়োটির কথা আমার মাথায় আসেনি। অবশেষে এক রাতে যখন আবার ঘুম হচ্ছিল না, ভোরে উঠে ঘরের বাইরে গিয়ে পুব আকাশে লুব্ধককে দেখলাম, বললাম, “দেবী সপদেত, তোমার মনে কী এই ছিল?” ঠিক তখনই মনে পড়ল সেই কথাগুলি – “বাহ, বেশ তো, এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট হলে মন্দ কী?”

সেদিন আর তর সইছিল না, কখন নেবনেফেরের পানশালা খুলবে। সে তো দুপুরের পরে, এদিকে নদীর পুব পাড়ে আমুন-রা’র স্তুতিগাথাকে শীলাতে খোদাই করার জন্য ওয়াসেত নগরাধ্যক্ষ আদেশ দিয়েছে, ছেলেকে দিয়ে বার্তা পাঠালাম বউয়ের শরীর খারাপ করেছে, আসতে পারব না। দুপুরের পরে শুঁড়িখানায় গেলাম, কিন্তু নেবনেফের সেরকম বিশেষ কোনো বুড়োর কথা স্মরণ করতে পারল না, তবে বলল, “কত বুড়োই না আসে এইখানে, আপনি তো বেশ কিছুদিন আসেন না।” এই বলে সে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, বোধহয় যাচাই করতে চাইছিল আমার বয়স বেড়েছে কিনা, অ্যাপোফিস আমার কাঁধে ভর করেছে কিনা। সেদিন থেকে প্রতিদিন আবার নেবনেফেরের আড্ডায় যাওয়া শুরু হল, আর তাতে এত বছরের কষ্টার্জিত সোনার দেবেন খরচ হতে থাকল। মেনাতনাখত প্রথমে আপত্তি করেছিল, কিন্তু তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম এ’ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। অবশেষে দ্বিতীয় বছরের বন্যার চতুর্থ মাসের এক সন্ধ্যায় আর এক বুড়ো এসে পাশে বসল। আমি ইতিমধ্যে তিন ঘটি হেকেত খেয়েছি, এক ঘটি হেকেত বুড়ো এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, “আপনার কন্যাসন্তান কেমন আছে?” চমকে তার দিকে তাকাই, ঘন সাদা ভুরুর নিচে দুটি চোখ তারুণ্যে জ্বলছে। পাঠক, আমার বলতে লজ্জা নেই, সেই দোকানে, আরো অনেক লোকের ভীড়ের মধ্যে, আমি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম, কিন্তু বসে টাল সামলাতে পারলাম না, শুয়ে পড়লাম, দুটি হাত জড়ো করে বলার চেষ্টা করলাম, “প্রভু, আপনি আমাদের বাঁচান!” এটা বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে গেল, “প্লভনিমাচান” এরকম কিছু একটা আমার মুখ দিয়ে বের হল। সে আমার এই ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয়েছিল মনে হয়, এর পরে আমাকে আবার তার পাশে বেঞ্চে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করি (সেই-ই বোধহয় আমাকে টেনে তুলেছিল), মনে হল দূর থেকে তার কথা ভেসে আসছে – “এসব রৈখিকভাবে হয় না। আর আমাকে প্রভু বলবেন না, আমি সেই লোক নই, আপনার যাকে দরকার তার নাম হল ইমোতেহেপ। তিনি থাকেন উত্তরে - ইনেবু-হেজে।” এটুকুর পরে আর কিছু আমার মনে নেই। বেশি রাতে শুঁড়িখানা বন্ধ করে নেবনেফের আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। পরে এই দ্বিতীয় বুড়োরও কেউ খোঁজ দিতে পারল না।

ইনেবু-হেজ মিশরের প্রাচীন রাজধানী, ওয়াসেত থেকে ৬০ ইতেরু উত্তরে, সেখানে যেতে হলে নীল নদ ধরে নৌকায় অন্তত আট দিনের মত সময় নেব। বাড়ি ছেড়ে এতদূর কখনও যাই নি, মেনাতনাখত তো আমাকে যেতেই দেবে না, ছেলে নেফেরহোতেপ গম্ভীর মুখে আমাকে ইনেবু-হেজ নগর কীরকম বিপজ্জনক এই নিয়ে উপদেশ দিতে থাকল, আর নাউনাখত, কী বুঝল কে জানে, আমার গলা জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিল। এরকম একটা ব্যাপার, কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। মেনাতনাখত বলল, “ইমোতেহেপের হাতে যদি এত ক্ষমতাই থাকে, সে তো আমুন-রা’র সমান, আকাশ থেকে নেমে এসেছে, তোমার সামান্য মাতাল কথায় সে পৃথিবী বদলে দেবে? সে কি জানে না আমাদের কী অবস্থা, তুমি মনে করছ সে শুধু তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে?”

আমি বললাম, “তাহলে নেবনেফেরের শুঁড়িখানায় যে বুড়োর সঙ্গে আমার কাল দেখা হল সে আমাদের কথা কেমন করে জানে? নিশ্চয় আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ আছে?”

এই শুনে মেনাতনাখত তো হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়ে। বলে, “তুমি নিজেকে কী ভাবছ? আমুন-রা’র প্রতিনিধি?” আমি বললাম, “এসব বলো না, আমাদের সম্রাজ্ঞীই তাঁর একমাত্র প্রতিনিধি, তাঁর বংশধর।” “তাহলে?” মেনাতনাখত বলে, “সম্রাজ্ঞী হাতসেপসুতের ওপর ছেড়ে দাও, তিনি নিশ্চয় ইমোতেহেপকে খুঁজছেন। আমার এবার দ্বিতীয় বুড়োর কথা মনে পড়ল, বললাম, “সে বলেছিল, ‘এসব রৈখিকভাবে হয় না’, অর্থাৎ সবসময় যে আমুন-রা থেকে সরাসরি ফারাওর কাছে নির্দেশ আসবে এমন না।”

এমন সব বাদানুবাদ হতে থাকল, বেশ কিছুদিন যাবার পরে মেনাতনাখতকে রাজি করাতে পারলাম। হেমন্তের এক সকালে বন্ধু আমেনাখতের সঙ্গে নৌকা করে রওনা দিলাম উত্তরে। তীরের কাছে নলখাগড়া আর পাপিরাস, আর দূরের রুক্ষ বাদামি-হলুদ পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে খেজুর, বাবলা ও পারসিয়া গাছ, হঠাৎ করে দু-একটি পিরামিড, দেবী হাথোরের মন্দির দেখতে দেখতে এবং মাঝে-মধ্যেই রাজকীয় নৌবাহিনী ও স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদা দিতে দিতে দিন সাতেক পরে ইনেবু-হেজে পৌঁছে আমরা একটি পান্থশালা খুঁজে পেলাম, যেখানে সরকারি লেখক ও শিলালিপি খোদাইকারিরা সাময়িকভাবে বাস করতে পারে। সে রাতে আমার ঘুম এল না, নতুন একটি শহরের অট্টালিকা, আবহাওয়া, ঘ্রাণ আমাকে জাগিয়ে রাখল, পান্থশালার ছাদে উঠে দেখি লুব্ধক তারা মাথার ওপরে। তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “হে দেবী সপদেত, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো, ইমোতেহেপের সাক্ষাৎ যেন পাই।”

পরদিন সকাল সকাল উঠে আমেনাখাত আমাদের নৌকাটা কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে কিনা দেখতে চলে গেল, আর আমি শহরে বের হলাম ইমোতেহেপের খোঁজে। সারাদিন ইনেবু-হেজের অলিগলি খোঁজার পরে এক খেলনার ফেরিওয়ালা বলল ইমোহেতেপ নামে এক লেখককে সে চেনে। তখন সন্ধ্যা হয় হয় যখন ফেরিওয়ালা আমাকে একটা বড় বাড়ির সামনে নিয়ে এল। ভেতর থেকে ক্রন্দনরোল ভেসে আসছিল, আমি বড় দরজায় আঘাত করলে এক দাসী এসে দরজা খুলে দিল। বললাম, “আমার নাম লেখক আমেনহোতেপ, আমি দক্ষিণের ওয়াসেত থেকে আসছি লেখক ইমোতেহেপের খোঁজে।” সে আমাকে উঠোনে এনে দাঁড় করিয়ে ভেতরে দৌড়ে চলে গেল, সেখান থেকে কান্নার শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে এক বর্ষীয়ান নারী বের হয়ে এলেন, আমি দাসীকে যা বলেছি তারই পুনারাবৃত্তি করলাম। উনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “লেখক ইমোতেহেপ আজ সকালে মারা গেছেন।”

মারা গেছেন? আমি চিৎকার করে উঠলাম, “সে তো অসম্ভব এক ব্যাপার। পৃথিবীতে আমুন-রা’র প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ করতে পারেন না।” সেই বৃদ্ধা আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মেনাতনাখতের মতই হেসে উঠলেন, হাসতে হাসতে তার চোখ দিয়ে জল গড়ালো, মাটিতে বসে পড়লেন। ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন বের হয়ে এলো, এরাই যে এতক্ষণ কাঁদছিল সেটা বুঝলাম। তারা এসে বৃদ্ধাকে ধরে তুললো, আমার দিকে তির্যক দৃষ্টি দিতে দিতে। তাদের চোখ লাল, গালে জলের ধারা এখনও শুকায় নি।

বৃদ্ধা তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই নর কী বলে দেখো, তোমাদের বাবা নাকি আমুন-রা’র প্রতিনিধি ছিলেন।” ইমোতেহেপের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা তাদের পিতার এরকম একটি সম্মানীয় সম্বোধনে তাদের মা’র মতো হেসে উঠবে কিনা বুঝে পায় না। তারপর বৃদ্ধা বললেন, “ইমোতেহেপ লেখক ছিলেন বটে, কিন্তু লেখা থেকে অবসর নেবার পরে বাড়ির একটি কাজও করতেন না, করতে পারতেনও না, মানে কীভাবে বাড়ির কাজ করতে হয় জানতেন না। তো আজ সকালে আমাদের দাসীকে পাঠিয়েছি বাজারে, আমি আবার কিছু কাপড় জলে ধুয়ে রেখেছিলাম, ইমোতেহেপকে বললাম ছাদে এগুলো নিয়ে যেয়ে বিছিয়ে দাও, শুকাতে হবে। এই বলাটাই কাল হল, ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে নিচে পড়ে গেলেন, আমুন-রা’র কৃপায় সাথে সাথেই মৃত্যু হয়েছে, কষ্ট পান নি। আমুন-রা’র প্রতিনিধি? হুঁ, প্রতিনিধিই বটে!”

ইমোতেহেপ যে আমুন-রা’র মতো ক্ষমতা থাকতে পারে তা তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কাপড় শুকাতে যাওয়া এবং ছাদ থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু আমাকে বিস্মিত করল, ইনেবু-হেজে আমার এই বিশাল অভিযান পণ্ডশ্রমই হল। বললাম, “আপনাদের এই বিয়োগে আমার সমবেদনা জানাই, একজন লেখকের কাছ থেকে আর একজন লেখকের এই পরলোক যাত্রার জন্য সমস্ত শুভকামনা রইল। ওসিরিস যেন তার আত্মাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আমি কি তাঁর দেহকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি?”

ইমোতেহেপের সন্তানেরা আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়, চারদিকে চারটি প্রদীপ লম্বা স্তম্ভের ওপর জ্বলে, দেহটিকে সংরক্ষণ করার প্রস্তুতি চলছে। এই ইমোতেহেপকে বছর দেড়েক আগে পানশালায় দেখেছিলাম কিনা স্মরণ করতে পারি না। মৃতের মুখমণ্ডল তার জীবিত অবস্থা থেকে বদলে যায়।

বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসার সময় ইমোতেহেপের এক সন্তানকে তিনি ওয়াসেত নগরীতে কোনোদিন গিয়েছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করি। সে ‘হ্যাঁ’ বললে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। সেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বিদ্ধস্ত মন নিয়ে হাঁটি; বেচারি মেনাতনাখত, বেচারি মা, তাদের কষ্টের কি শেষ হবে না? হাঁটতে হাঁটতে নীল নদের পাড়ে পৌঁছাই, আমাদের নৌকা আমেনাখত পাহাড়া দিচ্ছিল। সেই রাতটা আমরা নৌকায় কাটাই, পরদিন সকালে পাল তুলে দক্ষিণে রওনা দিলাম, দিন আটেক পরে ওয়াসেতে ভিড়লে দেখি ঝি হেনেতসেনু অপেক্ষা করছে, আমাদের দেখে তার মুখ ঝলমল করে উঠল। “মেয়ে হয়েছে আপনার,” চিৎকার করে সে নৌকা ভিড়ানোর আগেই, “কন্যাসন্তান।” কী দুঃশ্চিন্তা যে মাথা থেকে নামল তা বলার নয়, মেনাতনাখত মুক্তি পেয়েছে। নাউনাখত আর পাঁচ বছরে আটকে থাকবে না, তার বড় হওয়াটা আমি দেখে যেতে পারবো।

পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবছিল পাহাড়ের পেছনে, পাহাড়ের সামনে সম্রাজ্ঞী হাতসেপসুতের মন্দিরের খিলান অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। নৌকা থেকে মাটিতে পা দিলাম, হেনেতসেনুর হাসিময় মুখমণ্ডল মুহূর্তে বদলে যায়, মাথা নিচু করে কাঁদে, বলে, “আপনার মা গতকাল দেহত্যাগ করেছেন, ওসিরিস তাঁকে নিয়ে এখন হাঁটছেন, তাঁর এই যাত্রা যেন সুগম হয়।”

পুবে পূর্ণ চন্দ্র উঠছিল, তিনি সময়ের দেবতা খোনস – তাঁর ঘড়ি আবার চালু করেছেন। মাকে ভালভাবে বিদায় জানাতে পারলাম না; আকাশের ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকাই, ওসিরিস সেখানে কোথাও হয়তো মা’র আত্মাকে বহন করছেন। আমি আমেনহোতেপ, লেখক, এই শিলালিপিতে এই অত্যাশ্চর্য কাহিনি লিখে যাচ্ছি আজ, সম্রাজ্ঞী হাতসেপসুতের শাসনের দশম বছরে, বন্যার চতুর্থ মাসে, ওয়াসেত নগরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. দারুণস্য দারুণ দীপেনদা! জানার কৌতূহল হচ্ছে, এই গল্পের বীজ আপনি কখন, কোথায় প্রাপ্ত হলেন? দারুণ উপভোগ্য গল্পের জন্য উত্তম জাঝা।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক ধন্যবাদ, তৃণা, সময় নিয়ে পড়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ। গল্পটির উৎস বেশ কয়েকটি। প্রাচীন মিশরে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার ছিল অনেক এটা শুনে কিছু প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যর সন্ধান করি। এছাড়া সময়কে বন্ধ করলে কী হতে পারে তাও ভাবছিলাম। মনে হল প্রাচীন মিশর এই কাহিনির জন্য যথার্থ যেখানে জীবন অনেক দেবতার আরাধনায় অতিবাহিত হত, দেখা গেল দেবতারাও সময়ের ব্যাপারে অসহায়। অথবা যাদের দেবতা ভাবা গিয়েছিল তারাও সাধারণ মানুষ যে দুর্ভোগ পোহায় তার থেকে মুক্ত নয়। এরকম একটা কিছু :-) দীপেনদা

    উত্তরমুছুন
  3. দীপেন'দা কখন যে কি নিয়ে লিখবেন সেটা বোঝা বড় মুশকিল। মিশরের লোকজনের নামগুলো এমন বদখাত্‌ কেন? পড়তে পড়তে আমার দাঁত ভেঙে যাচ্ছিল। দৃশ্যগুলো কল্পনা করছিলাম। এমন গল্পও লেখা যায়? চমৎকার,দাদা।

    উত্তরমুছুন
  4. ধন্যবাদ মৌসুমী। মিসরীয় নামগুলি বদখদ বটে, কিন্তু মোটামুটি যাকে বলে authentic, তাদের রেখে যাওয়া প্যাপিরাসের দলিল ও শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। কিচুটা প্রাচীন প্রাচীন ভাব আছে নামগুলিতে তাই না? :-) দীপেনদা

    উত্তরমুছুন