সরোজ দরবার : মরা মাছের গল্প

 

চোখ মারছে! তাও কিনা একটা পুটকে মাছ! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করা যায় না। মাছেদের, গরিষ্ঠসংখ্যক মাছেদের অন্তত এতকাল খুব বোকা মনে হত। নইলে এমন ঝাঁকে ঝাঁকে জালে ধরা পড়ে! অবশ্য তর্কের খাতিরে বলা যায়, যে, গভীর জলেও কেউ কেউ থাকে। তাদের চট করে ধরা যায় না| জলের যত ছোট বড় ঝাপটা যেন তাদের গায়ে লাগে না| ঠিক যেন নেতা আর সাধারণ মানুষ| যত দৈব-দুর্বিপাকের ভাগিদার তো কমন ম্যান|

- আহ! চটে যাচ্ছেন কেন ম্যাডাম মালিনী, না না, রাজনীতির প্যাঁচাল পাড়ব না| কিন্তু আপনি বলুন, মাছেরা কি সত্যিই তেমন খেলুড়ে!

- আপনি আমাকে মালিনী নামে ডাকছেন কেন?

- বেশ, তাহলে সৌদামিনী বলে ডাকি|

- আমি তো সৌদামিনী-ও নই|

- তাহলে আপনি নিশ্চিতই মন্দাকিনী, কিন্তু সেটা কথা নয়| আপনি আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন|

- কী আর বলব! দেখুন, মাছেরা খেলুড়ে কি-না জানি না, তবে আপনি মশায় বেশ খেলুড়ে| কেমন কথায় কথায় টেনে চুম্বকের মতো বসিয়ে রেখেছেন| বেশ মানুষ কিন্তু আপনি, দিবাকর বাবু|

- দিবাকর! সে আবার কে? আমি তো নই|

- বেশ, তাহলে আপনি দীনেশ্চন্দ্র|

- দেখুন, ম্যাডাম মালিনী, আপনি বিভ্রম তৈরি করছেন, আমি বুঝতে পারছি| কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মাছ যে চোখ মেরেছিল, যেটা রথীন দেখেছিল, সেটা একটা বিভ্রম মাত্র|

- প্রথমত, বিভ্রম যদি তৈরি কিছু হয়, তার দোষ আমার নয়| আমি সে খেলা শুরু করিনি| আপনি করেছেন| তা ছাড়া রথীন এখানে এল কোথা থেকে, বলবেন? তিনি কে?

আপনি তো দীনেশচন্দ্র|

- কিন্তু ম্যাডাম মালিনী, আপনাকে কষ্ট করে এবার রথীনের কথাই শুনতে হবে| ধরে নিন, দীনেশ্চন্দ্র এখন থেকে রথীন|

- আপনি বড় বাচাল| কেবল কথা দিয়ে কথার জাল তৈরি করেন|

- আপনি কি আমায় অপমান করলেন, না প্রশংসা করলেন, ম্যাডাম মালিনী?

- আপনি কি রথীনের কথাটা এগোবেন, নয়তো আমি উঠি...

- প্লিজ বসুন| এই তো ক-টা মুহূর্ত আপনাকে কাছে পাই| এত যাই যাই করবেন না|

রথীন বা দীনেশচন্দ্র, দীনেশচন্দ্র বা রথীন এযাবৎ মাছেদের, অন্তত গরিষ্ঠসংখ্যক মাছেদের বেশ বোকা মনে করত| তারা কি তেমন খেলুড়ে হয়ে উঠতে পারে! কোনও আন্দাজ ছিল না রথীনের| শুনছেন আপনি?

- থামলেন কেন আচমকা?

- বেশ, এখন থেকে ধরে নিন, দীনেশচন্দ্র বলে কেউ নেই| শুধু রথীন আছে|

তো এই রথীন, মানে রথীনের, ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটা সিগারেট খাওয়া অনেকদিনের অভ্যেস। কিন্তু ইদানীং কৃষ্ণা, মানে রথীনের বউ, এই নিয়ে এত চেঁচামেচি শুরু করছে যে, বালিশে হেলান দিয়ে বুকের উপর অ্যাশ-ট্রে রেখে সুখটান দেওয়ার সুখ শিকেয় উঠেছে।

বরং কৃষ্ণা শুয়ে পড়লে বেডরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে এই বাইরে এসে বসে। আর দিনের শেষ সিগারেটখানা ধরায়। পাশেই টিভির বাঁদিকে ছোট্ট অ্যাকোরিয়ামটা রাখা।

মানে, এই একটা কাচের গোল জারের মতো। তার ভিতরে একটাই মাছ চরে বেড়ায়। লাল রঙের। এই মাস কয়েক হল কৃষ্ণা এটাকে এনে হাজির করেছে। তাকে নিয়ম করে খাবার দেয়। জারের জল পালটায়। খেয়াল করে সুইচ অফ-অন করে। মানে, বেশ যত্নআত্তিই করে আর কী।

এমনিতে সেদিকে তাকানোর খুব একটা ফুরসৎ পায় না রথীন। তার ওসবে টানও নেই তেমন। কিন্তু সিগারেট খেতে রাতে এখানটায় বসলে, মাছটার দিকে ঠিক চোখ চলে যায়। প্রথম প্রথম তার এই ভেবে খারাপ লাগত যে, একটা মাছ কেমন একা একা ঘুরে বেড়ায়। কী সাংঘাতিক তার নিঃসঙ্গতা! যেন গোটা পৃথিবীতে সে একা। কিন্তু পরে রথীন ভেবে দেখেছে, আসলে একজন মানুষও, যদি একজন মানুষ বলে আদৌ কাউকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়, তবে সেই মানুষটাও তো ওই মাছটার মতোই গোল একখানা পৃথিবীতে একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে আর পাঁচটা মানুষ আছে বলে একটু ভাব-ভালোবসা, ঝগড়া হচ্ছে। আর পাঁচটা মাছ যদি অ্যাকোরিয়ামটায় থাকত,

তাহলে ওই মাছটারও একটা সমাজ হত। কিন্তু তার মানেই যে কেউ নিঃসঙ্গ নয়, তাই বা কী করে বলা যায়!

এই যে সে, রথীন বসাক, একটা কাজচালানো চাকরি করে। ঘরে বউ আছে। অফিসে বন্ধু-বান্ধব আছে। ফেসবুকে ফ্রেন্ড আছে। এমনকী একই মেট্রোয় যেতে যেতে কয়েকজনের সঙ্গে বেশ দোস্তি অবধিও হয়ে গেছে। কিন্তু তার মানে কি সে নিঃসঙ্গ নয়!

যাক, সে আলাদা কথা। কিন্তু আমাদের কথাটা ছিল মাছের চোখ মারা নিয়ে| একটা মাছ চোখ মারতে পারেই বা কী করে? মাছের চোখ মারার ব্যাপারটা এর আগেও, আর একদিন সিগারেট খেতে খেতে, রথীনের একবার মনে হয়েছিল। কিন্তু সে পাত্তা

দেয়নি। আজ অবশ্য স্পষ্টই দেখল, লাল পুটকে মাছটা তার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব! মাছের তো চোখের পাতাই নেই। অবশ্য রথীনের মনে পড়ল, চোখের পাতা অনেকেরই থাকে না। যেমন ধরা যাক সুদখোর। চশমখোর। রাজনীতি করা নেতা-ফেতা। লোকজন বলে, এদেরও নাকি চোখের পাতা থাকে না। তা বলে কি তারা চোখ মারে না? হয়তো মারে। কিন্তু সে নয় হল, তাই বলে একটা মাছও চোখ মারবে!

আর, সবথেকে বড়ো কথা যদি মারতেও পারে, তো কৃষ্ণাকে মারতে পারত। খামোকা তার দিকে এই ইঙ্গিত কেন? মাছটা কি তবে তাকে ব্যঙ্গ করছে!

সিগারেট পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। কেমন একটা খিঁচড়ে যাওয়া মন নিয়ে বিছানায় এল রথীন। ঘুম এল না তার।

(দুই)

শুয়ে শুয়ে আশকুড়-পাশকুড় ভাবছিল রথীন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুলেখাদির কথা। তখনও কলকাতায় মাথা গলায়নি সে। এখন ভাবলে অবাক লাগে যে, তারও একটা মফসসলের সরল চমৎকার জীবন ছিল। আর সেই জীবনের অপ্সরা ছিল সুলেখাদি।

এলাকার ডাকসাইটে সুন্দরী। ডানাকাটা পরি বললেই চলে। কত ছেলে যে তার পায়ের তলায় পড়তে রাজি ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কেবল রথীন জানত, পাখির চোখে তির মেরেছে একজনই। রথীনের হাত দিয়েই সুলেখাদি চিঠিপত্র দিত সেই অর্জুনটিকে। কিন্তু শর্ত ছিল একটাই, কেউ যেন ঘুণাক্ষরে জানতে না পারে।

সুলেখাদির বাড়ির বা এলাকার বড়োরা তো বটেই, সুলেখাদির অসংখ্য রূপমুগ্ধ পুরুষভক্তরাও যেন এ-ব্যাপারে কিচ্ছুটি না জানে। আজ বোঝে রথীন, একজনকে ভালোবাসলেও, বাকিদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকার ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগই করত সুলেখাদি।

চিঠিটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কখন, কোথায় কীভাবে দিতে হবে, তার প্রায় মুখের উপর ঝুঁকে বুঝিয়ে দিত সুলেখাদি। আর রথীনের, সেদিনের সেই কৈশোরের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছেলেটার কেবলই চোখ পড়ে যেত সুলেখাদির ভরভরন্ত শরীরের দিকে। রথীন কী করে যেন সেই বয়সেই জানত, ওদিকে তাকানো উচিত নয় তার। কেন উচিত নয়?

সুলেখাদি তো কোনোদিন আপত্তি করেনি। তবে কি সুলেখাদি আর-একজনকে ভালোবাসে– এই কথাটা জানে বলেই সে এটাকে গর্হিত মনে করত! অর্থাৎ, তেমন গুছিয়ে না পারলেও, সে এরকমই ভাবত যে, সুলেখাদি অন্য কারো। যেভাবে নারীকে একজন পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে আজীবন ভেবে আসা হয়েছে, সেভাবেই ভাবত সে।

অথচ কেউ তো কিছু শেখায়নি। সমাজ নিজেই কত কিছু হয়তো অজান্তেই শিখিয়ে- পড়িয়ে নেয়। তা সে ভালো হোক বা মন্দ! সবটাই একটা সুতোয় গাঁথার মতো করে চলে চলে আসে। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে - যখন ঈষৎ ঝুঁকে পড়ত সুলেখাদি, আর তার শরীরের কুমারী ঘ্রাণ, ঘাম-যৌবন মেশা এক অদ্ভুত গন্ধ একেবারে বিবশ করে ফেলত রথীনকে - সে কিন্তু সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়েই থাকত। 
সুলেখাদি বুঝত সবই, কিছু বলত না। একদিন শুধু মুচকি হেসে বলেছিল, রোজ রোজ হাঁ করে দেখতে হয়, অ্যাঁ?

- ম্যাডাম মালিনী, এইরকম কোনও মুহূর্তের কথা আপনি, মানে আপনার জীবন থেকেও কি মনে করতে পারেন?

- আপনি তো ভারী অসভ্য|

- প্রশংসা না অপমান!

- সে বোঝার মতো ঘটে বুদ্ধি আছে আপনার?

- আজ অব্দি কেউ তো বুদ্ধিমান বলেনি| ধরে নিন, নেই| বোকাই একরকম|

- তাই বুঝি ওরকম হাঁ করে রোজ তাকিয়ে থাকতেন?

- সে তো রথীন| আমি তো নই, আমি তো...

- দীনেশচন্দ্র| তাই তো? বেশ তবে রথীনের গল্পের বাকিটা বলুন...

- সে তো আমাকে বলতেই হবে| শুনুন তবে|

দারুণ বললে কম বলা হয়, জীবনে যেরকম লজ্জার মুহূর্ত খুব কম আসে, সেরকম লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল রথীন, সুলেখাদির থেকে। আর আজ এই প্রায় অন্ধকার, সেই লজ্জিত মুহূর্তটি, বুকপকেট হাতড়ে খুঁজে পাওয়া পুরনো কয়েনের মতো ফিরে পেতে পেতে, রথীনের অবধারিত মনে পড়ে, কথা বলতে বলতে মিষ্টি করে সেদিন কেমন চোখ টিপেছিল সুলেখাদি।

- ম্যাডাম মালিনী, এই মুহূর্তে, ঠিক যেখানে কথাটা শেষ হল, আপনিও কি চোখ টিপলেন?

- আপনি শুধু বাচাল, অসভ্য নয়, একটা অত্যন্ত ফাঁকিবাজ মানুষ|

- ধন্যবাদ ম্যাডাম, এটাকে আমি কম্পলিমেন্ট হিসেবে নিচ্ছি| এই জীবনের মস্ত অংশটাই একটা ফাঁকি কিনা!

- দেখুন রথীন, এমন করলে আমি কিন্তু উঠে যাব|

- আমি দীনেশচন্দ্র ম্যাডাম| উঠবেন না, রথীনের গল্পের বাকিটা আমি আপনাকে এখনই বলে দিচ্ছি|

দেখুন, জীবনে কিছু গোপন মুহূর্ত তো থেকেই যায়। এক্কেবারে নিজের। একলাটির। মাঝেমধ্যে এভাবে নেড়েচেড়ে দেখার ফুরসৎ মেলে। আবার এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা গোপন হলেই ভালো হত। সে-সব ঘটে একেবারে খোলা হাটে।

এই তো মাস কয়েক আগে, রবিবার ছিল সেটা। কচুরি কিনে ফিরছে রথীন। হঠাৎ, ঘরে ঢোকার সময় দেখে দরজার মুখে জটলা। কী হয়েছে? না, ভোটে এক অভিনেত্রী দাঁড়িয়েছেন এবার। তাঁর হয়ে এলাকার নেতারা প্রচার করতে এসেছেন। ফ্ল্যাটের আর-পাঁচজনেও দাঁড়িয়ে আছে। একটা হ্যান্ড মাইকে করে এলাকার মা-বোন-ভাই- জ্যাঠা-কাকাদের উদ্দেশে ভোটপ্রার্থনা জানিয়ে চলেছেন নেতাবাবু। তাদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়েও একই কথা বলছেন। উপরের তলার মাসিমা বারান্দায় বসেছিলেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে করজোরে, নতমস্তকে ভোট দিতে বলছেন। রথীন দেখল, কৃষ্ণাও জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে।

হঠাৎ, কী মনে হল, সে ফস করে বলে ফেলল, এত যে জল জমার সমস্যা, সে কি আর মিটবে না?

 নেতা বলেন, কে বলেছে মিটবে না? আমরা কত জোরালো পাম্প বসাচ্ছি, জানেন? এরপর দেখবেন আর ওসব সমস্যা থাকবেই না। গ্যারান্টি।

 রথীন ব্যাজার মুখে বলল, সে তো এর আগেও বলেছিলেন। কিছুই তো হয়নি। গেল বর্ষায় যা হল! রাতে অফিস থেকে ফেরা মানে একেবারে নরকে এসে দাঁড়ানো। নেতা এবার হাতের মাইকটা পাশের ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। বললেন, কী নাম আপনার?

রথীন বলল। পুরো নাম। নেতা বলেন, রথীনবাবু, বলছি তো হয়ে যাবে। এত চাপ নিচ্ছেন কেন? এত মানুষ আছেন এ-পাড়ায়। দেখেছেন কাউকে কোনও অভিযোগ জানাতে? নাকি কেউ কিছু বললে, আমরা তা করিনি। গোটা রাজ্য উন্নতিতে ঝাঁ-চকচকে আর আপনার সামান্য জল জমার প্রবলেম সলভ করতে পারব না! হয়ে যাবে... হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না। বলে চোখ টিপে ফের সামনে এগিয়ে গেলেন।

ফ্ল্যাটের লোকজন বলল, ভালো করেছ। কথাটা বলা দরকার ছিল। কিন্তু কৃষ্ণা তো রেগে ফায়ার। বলে, তোমার বলার দরকারটা কী ছিল? এতগুলো লোক তো ছিল ওখানে বলার জন্য। তোমারই একেবারে বিপ্লব উথলে উঠল!

রথীন তো হাঁ। আমতা আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু বর্ষায় তো সবারই সমস্যা হয়। আমি তো সবার জন্যই বললাম। কৃষ্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, বললে সবাই বলত।

তুমি একা বলার কে? রথীন মিউ মিউ করে বলে, কেউ তো কিছু বলছিল না। কাউকে না কাউকে তো বলতেই হত। কৃষ্ণা এবার আরো রেগে গেল। বলল, হ্যাঁ, বলির পাঁঠা তো তুমি একাই আছ। লোকট নাম-ধাম জেনে গেল। এবার কী করে দেখো? 

রথীন হাত উলটে বলে, কী আবার করবে? কৃষ্ণা বলে, হ্যাঁ একজ্যাক্টলি। কিছুই আর করবে না।

যদিও কিছু করত, হাটবাজারে অভিযোগ জানাতে গেলে, এবার আর কিছুই করবে না। কৃষ্ণা বাস্তব কথাই বলছে। তার রেগে যাওয়া সঙ্গত। বস্তুত, এই ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাই একটা করে মাছেরই মতো বন্ধ ঘরের ভিতর চরকিপাক খাচ্ছে। সেখানে সমষ্টির হয়ে একার বলতে যাওয়া ঝক্কিরই বটে! কে জানে এর আবার কী মাশুল দিতে হয়!

কিন্তু সে অবাক হল এই ভেবে যে, একটা দলকে সে ভোট দেবে। তার ভোট, তাদের ভোট পেয়েই ওরা জিতবে। নিজেদের জনপ্রতিনিধি বলবে। অথচ, তাদের সামনে দুটো সমস্যার কথা বলতে গিয়েও এত ভাবতে হবে? আজব কুদরতি!

এই যে লোকটা যাবার সময় হালকা করে চোখ টিপল, কী বলতে চাইল আসলে? একজন সাধারণ মানুষের এত কিছু চাওয়ার অধিকার নেই? নাকি, অনেক তো দেওয়া হয়েছে, সামান্য একটা জিনিসের জন্য অত চেঁচামেচি করছেন কেন?- এরকম গোছের কিছু বোঝাতে চাইল! নাকি বলে গেল, ছাপোষা লোকেদের অল্পেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

বেশি দাবি-দাওয়া থাকা ভালো নয়। জল জমলে প্যান্ট গুটিয়ে নেবেন। সবাই তো তাই-ই নেয়। তাহলে একা একা অমন সোচ্চার হওয়ার কী মানে! বিশেষত ভোটের মুখে?

এসবই কি বোঝাতে চাইছিল লোকটা? তবে কি এই একটা কথা বলার জন্য, তাকে ওদের বিরোধী দলের কেউ ভেবে বসল! তাই কৃষ্ণা ভয় পাচ্ছে যে, এরপর আর কিছুই হয়তো করবে না।

রহস্যময় সেই চোখ টেপা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল রথীনকে। যেমন এখন তার গা রি- রি করছে মাছটার কথা ভেবে। শালা, মাছেও নাকি চোখ মারে!

আর শুয়ে থাকতে পারে না রথীন| সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। মাছের কেসটা একবার ভালো করে পরখ করে নেওয়া দরকার। খুব, খুব দরকার।

(তিন)

অ্যাকোরিয়ামের একেবারে সামনে গিয়ে এবার বসল রথীন। মাছটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। কৃষ্ণার মাছ তো! মালকিন তো নিজেই বিছানায় নাক ডাকছে। আচ্ছা, মাছেরা কি নাক ডাকে! কে জানে! এখন আলো জ্বালাতে আর আশেপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই সম্ভবত হালকা হালকা ন্যাজ নাড়াচ্ছে।

রথীন একটা সিগারেট ধরিয়ে মাছটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সত্যিই মাছটা চোখ মারছে নাকি তার দেখার ভুল- সেটা এবার সে ভালো করে দেখে নিতে চায়। এবং ঠিক তিন টানের মাথায় তার সমস্ত ধন্দ দূর হয়ে গেল। যখন মাছটা তার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল! অথচ হ্যাঁ, মাছটার চোখের পাতা নেই। যেমন সুদোখোরের থাকে না,চশমখোরের কিংবা নেতাদের। অন্তত লোকে তাই-ই বলে। সেই মাছ কিনা অনায়াসে রথীনের দিকে তাকিয়ে চোখ মারছে।

কেন রে ভাই! রথিন কি এত ফ্যালনা! এত ছাপোষা যে তাকে ব্যঙ্গ করতে পারলে সবাই খুশি! সুলেখাদি যে সেদিন চোখ টিপেছিল, তার মানেটা কী? অর্থাৎ, যতই তাকাও, তোমার ওই দেখাই সার। পাখির চোখে তির তো মেরেছে কোনও এক অর্জুন।

অতএব যা তোমার হতে পারে না, তার দিকে তোমার তাকিয়েও লাভ নেই। সত্যিই তো! ঠিকই বোঝাতে চেয়েছিল সুলেখাদি। ওই নেতাও তো হরেদরে তাকে সেদিন এই কথাটাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল। আসলে, এই কথাটাই রথীনকে মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে নিতে হবে।

ছাপোষা ছাপোষার মত থাকো। অত ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই কীসের হে!

তাও ওদের অনেক ক্ষমতা। ওরা যদি ব্যঙ্গও করে, মেনে নেওয়া ছাড়া রথীনের কিছু করার নেই। ইন ফ্যাক্ট সে মেনেই নিয়েছে। কিন্তু এই পুটকে মাছটা কোন সাহসে তাকে ব্যঙ্গ করছে? তারই ঘরে থেকে, তারই বউয়ের হাতে খেয়ে, তাকেই চোখ টিপছে! এত সাহস এর হয় কোথা থেকে? কী হত যদি সেদিন সেই নেতাকে পালটা চোখ টিপত রথীন! যদি বলত, প্রতিবারই তো বলেন জল জমবে না। কত যে জল জমবে না,

সে আমাদের ভালোই জানা আছে। বলে যদি চোখটা টিপত! ছাড়ত সেই নেতা তাকে? যদি ঝুঁকে পড়া সুলেখাদির প্রতি চোখ টিপে সে বলত, রোজ এমন করে ঝুঁকে ঝুঁকে কথা বলো কেন? আমি কি কিছু বুঝি না, অ্যাঁ? তবে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় কি সেদিন কষাত না সুলেখাদি! নিশ্চিতই তাই-ই করত।

- ম্যাডাম মালিনী, আপনি কি আঁচ করতে পারছেন, এবার কী করবে রথীন?

- আপনার কি এমন ভুল জায়গায় ভুল কথা বলাই স্বভাব?

- না না মালিনী বলুন, আপনি সুলেখাদির জায়গায় থাকলে কি রথীনের সঙ্গে এরকমই করতেন?

- যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে| একটা কাজের সময় কি বোঝা যায়, তার প্রভাব কীভাবে

পড়তে চলেছে! আপনি মাইন্ড করবেন না, প্লিজ|

- আপনি কি তবে এখন ক্ষমা চাইছেন?

- আমি কেন ক্ষমা চাইব? আমি তো সুলেখা নই|

- হ্যাঁ, আপনি তো মালিনী, কিংবা সৌদামিনী| আচ্ছা সৌদামিনী, নেতারা কখনও কারও কাছে ক্ষমা চেয়েছে বলে শুনেছেন আপনি? ধরুন, কত প্রতিশ্রুতিই তো তাঁরা দেন, আবার চোখ টিপে, তারা সেসব ভেঙেও দেন| এসব নিয়েও কি আমার মাইন্ড না করাই উচিত, সৌদামিনী?

- আমি জানি না রথীন, বিশ্বাস করুন| আপনি আমাকে ডেকে এনে এমন কঠিন জায়গায় টানছেন কেন? আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে রথীন|

- আহ! ফের সেই একই ভুল করছেন, আমি রথীন নই ম্যাডাম মালিনী...

- বেশ বেশ, হ্যাঁ আপনি তো দীনেশচন্দ্র... রথীনের গল্পটা এবার তবে শেষ করুন|

- বলছি, শুনুন| তবে, আগেই বলে রাখছি, এ গল্প আমার নয়, এর পরিণতিও আমার হাতে নেই| তাই যা কিছু শেষে হোক না কেন, ম্যাডাম মালিনী, অনুগ্রহ করে

জাজমেন্টাল হবেন না|

- আপনি বলুন, দীনেশচন্দ্র...


ধীরে ধীরে এবার উঠে পড়ে রথীন। শান্ত, খানিকটা ঘোর লাগা অবস্থায় যে, দাঁড়িয়ে এখন সে| হাতে ধরা সিগারেটটায় বড় একটা টান দেয়। একেবারে ফিল্টারের কাছাকাছি তখন আগুন। লাল। ধকধক করছে। একবার বেডরুমের দিকে তাকায় সে। দরজা বন্ধ।

ভিতরে কৃষ্ণা ঘুমোচ্ছে অঘোরে।

রথীন পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে অ্যাকোরিয়ামের সুইচটা বন্ধ করে। তারপর রান্নাঘর থেকে চা-ছাঁকনিটা নিয়ে এসে কায়দা করে তুলে নেয় মাছটাকে। লাল রঙের মাছ। লালচে আগুন। খুব পাশাপাশি। রথীন ধীরে ধীরে সচেতনভাবে সেই আগুন গুঁজে দিতে থাকে মাছটার চোখে। প্রায় অস্ফূটে বলতে থাকে, আমারই খাবি, আমারই ঘরে থাকবি, আবার আমাকেই চোখ মারবি! ব্যঙ্গ হচ্ছে ব্যঙ্গ, অ্যাঁ! এত কি সহ্য করা যায়! এত বিপ্লবের সাহস কোথায় পেলে বাছাধন! এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, চোখ মারার অধিকার শুধু কাদের!

 কী রে বুঝতে পারছিস না!

মাছ উত্তর দেয় না। দিতে পারতও না। আর এমনিতেও ততক্ষণে সে মরে গেছে। রথীন মরা মাছটা ফেলে দেয় অ্যাকোরিয়ামেরই ভিতর। তারপর চা-ছাঁকাটা ভালো করে ধুয়ে রেখে এসে, আরাম করে একটা সিগারেট ধরায়। একটা বড়ো কাজ শেষে যেন তৃপ্তির সুখটান। মাছটার দিকে একবার তাকায়। চিৎ হয়ে ভেসে আছে ব্যাটা।

দ্বিতীয়বার তাকায়। হ্যাঁ, আগের মতোই চিৎ হয়েই ভেসে আছে।

নিশ্চিন্ত হয়ে বাকি সিগারেটটা শেষ করে রথীন। তারপর উঠে পড়ার সময় আর-একবার তাকায় মাছটার দিকে। আর আচমকা সে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। রথীন স্পষ্ট দেখে, সেই মরা মাছ আবার সোজা হয়ে নড়ছে চড়ছে। বীভৎস পুড়ে যাওয়া তার চোখ। তবু তা নিয়েই সে রথীনকে লক্ষ্য করে চোখ মারছে। একবার, দুবার... রথীন তাকে মেরে ফেলতে পারে জেনেও...আবার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ