দেবর্ষি সারগী'র গল্প : দ্বিতীয় জগৎ


মাঝরাতের আকাশ চিরে হঠাৎ যুদ্ধবিমান উড়ে গেল এবং ওটার তীক্ষ্ণ শব্দে তমালের ভাবনা একটু কেঁপে উঠল। সে ভাবছিল একটা মাটির ডেলাও গোটা বিশ্বের উপাদান নিজের ভেতর ধারণ করে আছে। একবিন্দু জলের ফোঁটায় গোটা সূর্য ঢুকে পড়ে। পাতার ছায়ায় শুয়ে আছে যে পোকা তার কাছে ওই পাতাটাই গোটা আকাশ। বলের চারপাশে ঘুরতে থাকা একটা পিঁপড়ে হয়তো ভাবে সে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করছে। সিংহের কাছে অরণ্যই সমস্ত জগৎ। সংক্ষেপে, মহাবিশ্ব ও অণুবিশ্বের মধ্যে মৌলিক তফাত বিশেষ কিছু নেই। তাই যদি হয়, তবে তার আঁকা এই ছবিটাও গোটা জগৎ। এবং আয়তনের দিক দিয়েও যেন অসীম। কারণ ছবির আকাশটা আকাশের মতোই অনন্ত দেখাচ্ছে। নদীটা দিগন্তরেখা ছাড়িয়ে বয়ে চলেছে। একপাশে ঘাসের এত সবুজ ডগা যে সে নিজেও গুনতে পারবে না। একটা দীর্ঘ ভাঙা প্রাচীর আঁকা হয়েছে, কিন্তু ইটগুলো যেন অসংখ্য। দিঘির জলটাও কি মাপা যাবে? কিংবা দিঘির পাড়ে অজস্র শেকড়বাকড়, ঝুরি, গভীর কোটর, ঘন ডালপালা ও গাঢ় কালো ছায়া বিছিয়ে যে বটগাছটা দাঁড়িয়ে সেটা নিজেই কি একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ব নয়? ছবিটায় সবই শান্ত, স্থির। হয়তো বেশ কিছুদিন ধরে হয়ে চলা যুদ্ধটাই তমালকে এরকম শান্ত প্রকৃতির ছবি আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছে। যে শান্তি বাইরে থাকে না মানুষ কল্পনায় সেটা সৃষ্টি করে নেয়। গত কয়েক মাস ধরে তমাল ছবিটা একটু একটু করে আঁকছে। রোজ মাঝরাত পর্যন্ত। তারপর ক্লান্ত, ঝিমঝিম করা মস্তিষ্ক ও স্নায়ু নিয়ে মাধবীর পাশে ঘুমোতে চলে যায়। অনেক শিল্পীর মতো তমালও একজন প্রেমিকা পেয়েছে। তার সৌভাগ্য, মাধবী তাকে সত্যি সত্যি বুঝতে পারে।

যুদ্ধবিমান গর্জন করে আরও কয়েকটা পাক দিল শহরটার আকাশে। ঘুমন্ত মাধবীকে জড়িয়ে তমাল ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন মেঘলা। একতলার বারান্দায় বসে নিজের হাতে বানানো চা খেতে খেতে তমাল দেখল বাক্স-প্যাটরা, আলমারি, খাট গাড়িতে তুলে তার আরও একজন প্রতিবেশী শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বোমার ভয়ে সবাই পালাচ্ছে। এই লোকগুলোর চোখমুখও বিষণ্ন, আতঙ্কিত। যাবার সময় তমালের দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ হাসল না। কোনো কথা বলল না। ওদের ওই ছোট্ট লোমশ কুকুরটাকে তমাল ভালোবাসত। ওটা একেবারে সামনে কর্তার কোলে নিশ্চিন্তে ও আয়েস করে বসে খুব আগ্রহের সঙ্গে চারপাশে তাকাচ্ছে।।

আমরা কবে যাব?’ ঘুম থেকে উঠে এসে বিষন্ন দৃষ্টিতে চলে যাওয়া পরিবারটার দিকে তাকিয়ে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

‘খুব শিগগির। হোটেলটা থেকে কনফার্মেশন এলেই।’

দূরের যে শহরটায় তারা আপাতত গিয়ে উঠবে বলে ঠিক করেছে সেখানে তাদের এক বন্ধু থাকে। বন্ধুটি নিজের বাড়িতে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু তমাল ও মাধবী হোটেলেই থাকতে চায়। বন্ধুটি হোটেলের চেষ্টা করছে।

দুপুরে তারা দেখল আরও একটা পরিবার ঘোড়ার গাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে চলে যাচ্ছে। বিকেলে আরও একটা পরিবার। তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল।

তমালের মনটা ছবির দিকে। ওটা শেষ হতে এখনও একটু দেরি। সন্ধে হতে সে স্টুডিয়ো ঘরটায় ঢোকে। একটু পরে মাধবীও আসে। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চার ফুট বাই চার ফুট চৌকো ক্যানভাসটার দিকে।

‘এরকম ছবি আমি দেখিনি’, মাধবী বলল আচ্ছন্ন গলায়। ‘মানে এরকম জায়গা। এরকম আকাশ, এরকম নদী। ঘাসপাতা বা দিঘি। এরকম উঁচু জংলি মহীরুহ। সব কিছুর রংও অদ্ভুত। পাতার রং এরকম নীলচে হয় নাকি? বা প্রাচীরের ইটের রং ওরকম উজ্জ্বল তামার মতো?’

‘সব মিলিয়ে কী মনে হচ্ছে?’

‘জায়গাটা চিনি না।’

‘তাই তো করতে চাইছি আমি’, তমাল বলল একটু উচ্ছ্বাসের সঙ্গে। ‘এমন একটা স্বর্গ। নির্মাণ করতে চাইছি যা নেই।’

সেদিন গভীর রাতে তমাল আরও একটু পালটে দিল ছবিটাকে। ব্রাশ ঘষে ঘষে আকাশ ও নদীকে আরও নরম করে দিল। সে শুধু একটা জায়গা সৃষ্টি করতে চায়, তাই ছবিতে কোনো প্রাণী আঁকল না। একটা পাখিও নেই। ব্রাশের ঘর্ষণের ফলে দিঘির জলটাকে আরও অতল ও শান্ত দেখাতে লাগল। বটগাছটার কোটরগুলোকে আরও গভীর ও কালো। প্রাচীরটাকে আরও প্রাচীন ও স্তব্ধ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে জানতে ইচ্ছে করবে প্রাচীরটার ওপাশে কী আছে। সেখানে হয়তো অপেক্ষা করছে অন্য একটা জগৎ, যা এই জগতের মতো অসীম। বা এই বৃক্ষের কোটরগুলোর ভেতর কী আছে। ওগুলোর অন্ধকারের ভেতর হয়তো আছে আরও কোনো বৃক্ষ এবং তার কোটর, এবং সেই কোটরের অন্ধকারের ভেতর আবার কোনো বৃক্ষ ও কোটর।

সেদিন রাতেও যুদ্ধবিমান পাক দিয়ে গেল আকাশে গর্জন তুলে। মাধবী জেগে ছিল। সে জড়িয়ে ধরল পাশে শুয়ে থাকা ক্লান্ত তমালকে।

‘তোমার বন্ধু কবে কনফার্ম করবে?’

‘এই সপ্তাহেই তো করার কথা ছিল। এত দেরি করছে কেন, বুঝতে পারছি না।’

‘কনফার্মেশন ছাড়াই চলো চলে যাই। কোনো হোটেলে ঠিক জায়গা পেয়ে যাব।’

তমাল চুপ করে থাকে।

‘কালই চলো’, মাধবী বলল।

তমাল কোনো কথা বলে না।

‘কিছু বলছ না যে?’

‘চলো’, তমাল বলল আস্তে আস্তে। ‘তবে ছবিটা নিয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ শুকোতে এখনও সময় লাগবে।’

‘আমরা তো কিছুই নিয়ে যাব না। ছবিটাও এখানেই থাকবে।’

‘সেই।’

‘ভাবছ, আর কখনো যদি না আসা হয় তাই না?’ একটু কাঁপা, ভিজে গলায় মাধবী বলে।

‘সেরকম তো হতেই পারে। যুদ্ধের সময় কে কোথায় ছিটকে যায়, কোনো ঠিক নেই।। অনেক সময় চিরকালের জন্য।’

পরদিন সন্ধেয় ওরা শহরটায় একটু ঘুরে বেড়াল। দোকান থেকে কিছু দরকারি জিনিস কিনল। সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য কিছু শুকনো খাবারদাবার। ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত টাকা তমাল আগেই তুলে নিয়েছিল। ভালো করে ভেবে দেখল কেউ তার কাছে টাকা পাবে কিনা। কেউই পাবে না। সে অবশ্য এক পুরোনো বই বিক্রেতার কাছ থেকে কিছু টাকা পাবে। একটা বইয়ের জন্য আগাম দিয়ে রেখেছিল। সেটা আর আদায় করতে ইচ্ছে করল না। যদি বইটা এসে থাকে? কিন্তু সেটা খোঁজ করতেও আর ইচ্ছে করছিল না।

শহরটায় ঘুরতে ঘুরতে তারা দেখল প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে। গাড়িও কম চলাফেরা করছে। তবে ঘোড়াগাড়ি চলছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলোকে নিঃসঙ্গ, বিষপ্নণ্ন দেখাচ্ছে। বাড়িগুলো ফাঁকা বলে সন্ধের পরও ভেতরে আলো জ্বলছে না। ফলে ওদের দেখাচ্ছে প্রাণহীন হাড়ের কাঠামোর মতো। একটা বাড়ির সবুজ খড়খড়ির জানলা তমালের ভালো লাগল। একটা বাড়ির সামনে একটা বেড়ালের ছানা মিঁউ মিঁউ করে কাঁদছিল। ওকে নিশ্চয়ই ফেলে। গিয়েছে। তমাল ওকে কোলে তুলে নিল।

‘বাড়ি নিয়ে যাবে?’ মাধবীকে জিজ্ঞেস করল।

‘কিন্তু আমরা নিজেরাই তো চলে যাব।’

‘যতক্ষণ না যাচ্ছি, সঙ্গে থাক।’

নির্জনতা ও শূন্য বাড়িগুলোর জন্য শহরটাকে খুব বড় দেখাচ্ছিল। বাড়ি ফেরার সময় দুজনেরই মনে হল অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। হঠাৎ যুদ্ধবিমানের গর্জনে তারা চমকে ওঠে। বেড়ালছানা অবশ্য নিশ্চিন্তে তমালের কোলে বসেছিল। আকাশের দিকে মুখ তুলে তারা দেখল কয়েক জোড়া রক্তাক্ত চোখ অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে ঢোকার আগে ডাকবাক্সের তালা খুলে তমাল দেখল আজ কোনো চিঠি নেই।

‘রঙের ব্রাশ-ট্রাশও থাক’,তমাল বলল। ‘ওগুলো পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। ওখানে আবার কিনে নেব।’

রাতে দুজনে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে।

‘এই স্কেচগুলো?’

না, কারণ এখন থেকে শুধু জায়গার ছবি আঁকব। এমন শহর, গ্রাম, অরণ্য, যা নেই।’

‘আচ্ছা, আমরা তো খুব ভোরবেলা বেরিয়ে যাব। বেড়ালছানাটাকে কী করবে?’

‘যাবার সময় ওই হোটেলঅলাকে দিয়ে যাব। ওকে যাতে রোজ একটু দুধ দেয় তার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে যাব।’

‘সেটাই ভালো হবে।’

রাতে দুজনে ঘুমোল না। গোছগাছ ও খাওয়াদাওয়া সেরে তারা স্টুডিয়োটায় এল।। ব্রাশের নরম ঘর্ষণে তমাল ছবিটাকে আরও শান্ত, আরও স্নিগ্ধ ও একটু কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলল। যেন ভোর হচ্ছে। বা ওখানে সব সময় যেন শুধু ভোরই থাকে। ওই ভোরে সব সমাহিত : নদীটা, মহীরুহটা, দিঘিটা, ছায়াঘন ঘাসের বিস্তারটা বা তামার প্রাচীরটা। জায়গাটায় কোনো প্রাণী নেই। যদি থাকত, তবে কেমন জীবন কাটাত সেই প্রাণী? যদি মানুষ থাকত, তবে কেমন জীবন কাটাত সেই মানুষ?

‘ওরকম কোনো জায়গায় গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে,’ ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে হঠাৎ মাধবী বলে।

চমকে উঠে তমাল তাকিয়ে থাকে মাধবীর দিকে। এবং তখনই প্রথম বোমাটা পড়ল শহরে। গোটা শহরটা যেন কাচের কোনো জিনিসের মতো খান খান করে ভেঙে গেল। মাধবী চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল তমালকে। তমাল তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। দুজনেই থিরথির করে কাঁপছিল। জানলাগুলো বন্ধ করার জন্য তমাল একটা জানলার কাছে আসতেই দেখতে পেল বাইরের আকাশ, শহরের রাস্তা, বাড়িগুলো, গাছগুলো, ঘোড়াগুলো যেন অভ্রের মতো উজ্জ্বল আলোয় স্থির হয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত অন্ধকার হচ্ছে। তারপর আবার ওই আলো।

মাধবীর হাত ধরে তমাল এ ঘর থেকে সে ঘর দৌড়তে লাগল। এরপর ভাবল বাইরে বেরিয়ে যায়, ওদের লক্ষ্য হয়তো বাড়িগুলোই, রাস্তায় থাকলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যাবে।

‘কোথাও যেতে হবে না তমাল!’ ডুকরে উঠে মাধবী বলল। ‘শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরো! আমার কাছে থাকো!’

তমাল তাই করল। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা দাঁড়িয়ে থাকল। বেড়ালছানাটা কোথাও কেঁদে যাচ্ছিল। শহরটায় অবিরাম বোমা পড়ছিল। একটা বোমা পড়ল তমালদের বাড়ির ওপরেও। নিমেষে সব চুরমার হয়ে গেল, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে সব পুড়তে লাগল। শুধু ওই ছবিটাই নষ্ট হয়নি, কারণ ওটা তো অন্য কোনো জগতের ছবি। সেখানে তো বোমা পড়েনি। সেখানে তো যুদ্ধ হয়নি। তাই বোমায় গোটা জগৎ ধ্বংস হয়ে গেলেও ওই ছবিটা ধ্বংস হবে না।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ