শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য : হাসান আজিজুল হকের গল্প



হাসান আজিজুল হক : নির্বাচিত গল্পের প্রাককথন

এই উপমহাদেশে বাংলাভাষায় কথা বলি এমন মানুষের সংখ্যা দশ বারো কোটি হবে। বেশিও হতে পারে। নেহরু জিন্না মানচিত্রে পরিবর্তন আনলেও মনের জগতে, মুখের ভাষায় এতগুলি মানুষের যোগাযোগ এবং ইতিহাস নানাভাবে এক। আমাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম লোক একদা ইংরেজিতে কথা বলতেন। কিন্তু তাদের রণতরী ছিল, বাণিজ্যপোত ছিল—ছিল রবার্ট ক্লাইভ জাতীয় মানুষ। তাই তাদের শাসনবিস্তারের পাশাপাশি ভাষারও বিস্তার ঘটে। বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শেকসপিয়ার-এর পাঠক সংখ্যাও বাড়ে। আমরা, বাঙালিরা, এসব নেই বলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ওদের মতো অত ছড়ায়নি। একথা বলতে চাই না যে, রাজশক্তি, বাণিজ্যশক্তির দাপটেই শুধু ইংরেজি সাহিত্য শক্তির প্রসার ঘটেছে। সেই সাহিত্যের ভেতরে জিনিস আছে বলেই অমনভাবে প্রসারিত হয়েছিল—দেশে দেশে ভিন্ন ভাষাভাষী পাঠকের কাছেও ইংরেজি ভাষার মহৎ রচনার কদর হয়েছে।


বলতে চাই, বাংলা ভাষাতেও যথেষ্ট সংখ্যায় ভালো সাহিত্যকর্ম রয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে। হবে। কিন্তু আমাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা বিস্তারের বা বিকাশের ক্ষেত্রটি সংকীর্ণ বলেই গুণসম্পন্ন রচনাও মানচিত্রের গণ্ডির বাইরে খুব কমই স্বীকৃতি পেল। গুণগতভাবে উঁচুদরের লেখা দুনিয়া জুড়ে কদর পেল না। কারণ, ভাষাটি বাংলা। উপমহাদেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষই তার খবর পেলেন না। অন্য দেশের পাঠক পাওয়ার ভাগ্য তো দূরের কথা।

এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। এটি একটি ঐতিহাসিক দুঃখ। যখন শুনি অমুক লেখাটি আহা মরি। তখন প্রায়ই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে পড়ে দেখি, আহা! এর চেয়ে অনেক ভালো রচনা তো বাংলায় মাত্র কয়েক সংস্করণের অবহেলায় বিস্মৃত হয়ে আছে। তখন খুব কষ্ট হয়। এই দুঃখ কোনও ভাষাগত গর্ব বা সংকীর্ণ আঞ্চলিকতা থেকে নয়। নেহাত সত্য বলেই এমন খোলাখুলি লিখছি।

হাসান আজিজুল হকের কয়েকটি গল্পগ্রন্থ পড়ে এই কথা আবার বিশেষভাবে মনে পড়ল। আবার সেই পুরনো কষ্ট বোধ করলাম। আহা! কী লেখা। একা একা পড়ে তাতে নিমজ্জিত হতে হয়। তাঁর এই গল্পগুলি গত ১৩৭১ থেকে ১৩৮০-র মধ্যে প্রকাশিত। মোটামুটিভাবে একজন লেখকের দীর্ঘ দশ বছরের কর্মকালের চিন্তাভাবনা, আবেগ, দুঃখ, সহানুভূতি, নিসর্গস্মৃতি—সবই এই লেখাগুলিতে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। মনে রাখতে হবে একজন লেখকের জীবনের দশ বছর—এবং কোন দশবছর? -- যে সময়টাকে লেখকের জীবনের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ, শ্রেষ্ঠ সময় বলা যায় সেই দশ বছরে হাসান আজিজুল হক এই গল্পগুলি লিখেছেন।

বছর কয়েক আগে তার একটি গল্প—‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ কলকাতায় বসে পড়ার সুযোগ পাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে যে শহরে আমার জন্ম সেখানে যাই—এবং কানাঘুষোর উপর নির্ভর করে আন্দাজে খোঁজাখুঁজি করে হাসান আজিজুল হকের দেখা পাই।

সেই দেখা এবং পরিচয় থেকে যতদূর জানি হাসানের ২২/২৩ বছর বয়স থেকে ৩১/৩২ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি এই গল্পগুলি লিখেছেন। তাঁর রচনা সম্পর্কে আমাকে আগ্রহী করে তোলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ এবং কলকাতার মতি নন্দী মহাশয়।

তার সম্পর্কে গোড়ায় আমার সম্বল ছিল এই একটি গল্পই একটি সংকলন। থেকে সেই ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। তারপর একে একে হাতে পেলাম— সমুদ্রের স্বপ্ন : শীতের অরণ্য (১৩৭১), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৩৭৫) এবং জীবন ঘষে আগুন (১৩৮০)।

হাসান দর্শন পড়ান। বয়ঃসন্ধিক্ষণে বর্ধমানের স্মৃতি মাথায় নিয়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। সেখানকার সময়, মানুষ এবং নানান প্রবল স্রোতে তিনি পূর্ণ ভালোবাসায় অবগাহন করেছেন। সেখানকার জীবনকে জীবন করে নিয়েছেন। যেমন পশ্চিমবাংলায় বহু সাহিত্যসেবীর জীবনে ঘটেছে—যাঁরা বয়ঃসন্ধিক্ষণে অখণ্ড বঙ্গের স্মৃতি মাথায় নিয়ে এপারে চলে এসেছিলেন। তাঁদের কষ্টটিই সবচেয়ে দুর্বহ। তীক্ষ্ণ এবং তাই গ্রহণের ক্ষুধাও অনিবার্য ও প্রবল। এটা বিপুল ইতিহাসের পরিহাস হলেও নিদারুণ সত্য।

দেশ বিভাগের পর ওপারে যে-নতুন শক্তিশালী মধ্যবিত্ত সমাজের জন্ম হয় হাসান তার আদ্যন্ত জানেন। জানেন ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপর যার দাপট তার নাম। শ্রেণিগত পার্থক্য—যার অনেকটাই আর্থিক সংগতির উপর নির্ভরশীল।

শিশুর হিংসা কতখানি সরল আর অবুঝ, কতখানি নিস্পাপ আর হিংস্র -- তাও তার অজানা নয়। পৃথিবীর ভেতরকার অনন্ত আগুনের মতোই যে বয়স ও শারীরিক বৃদ্ধি বেসামাল—তার পরিণতি যে কতখানি অমোঘ এবং সেখানে মৃত্যু যে বৃক্ষপতনের মতোই ভয়াবহ ও মহৎ সেকথা তিনি আমাদের ভেতরে সঞ্চারিত করতে চান। তার পাশাপাশি তিনি বলেছেন, নারী তুমি দুর্জ্ঞেয়ে। সেখানে প্রমত্ত পুরুষও শিশু, নিরুপায়, দিকহীন। আবার এই নারীর পাশেই কৈশোর একটি তীক্ষ্ণ শলার মতো নিজেকে বাঁচিয়ে চলার জন্যে আমূল বিদ্ধ করে সেই নারীকেই।

এসবের সঙ্গে মিশে আছে নিসর্গ। তার রং। তার বীর্য। তার অন্ধ নিস্পৃহ দিকটিও।

অন্ধ প্রকৃতি, দুর্জ্ঞেয় নারী, শিশুর হিংস্র সারল্য, কোটি কোটি বছরের জনজীবন—তার বিশ্বাস, ভীতি, পাগলামো কী নয়? এই সবই হাসান একজন পাকা, রসিক, নির্মোহ রিং-মাস্টার বা ক্লাউনের স্টাইলে চাবুক হাতে এগারোটা বাছুরকে ছেড়ে দিয়ে দর্শক ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতের নিষ্ঠুর, নির্বেদ চাবুকটি পড়ছে আমাদেরই পিঠে। আমরা তার বিদ্যুৎ দেখে চমকাচ্ছি। বাঘের মুখের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি আমাদের সারা শরীর মুচড়ে দিচ্ছেন। আমরা বলছি : আর পারি না। তুমি থামো এবার।

তাই বলে হাসান আজিজুল হক দেশকাল সম্পর্কে আদৌ অনবহিত নন। দেশ ভেঙে খান খান করার পর ভাঙা টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছিটকে পড়লেও তাদের হদিশ লেখকের নখদর্পণে।

তবে এই সমগ্রজীবন এবং জীবনের বাইরেটাও তিনি ধরেছেন একজন দার্শনিকের স্বভাবজ দৃষ্টিতে। সেখানে এই দৃষ্টির সামনে সূর্য, নদী, উত্তরের বাতাস, হিমরাত্রি—সবাই তাদের স্ব স্ব ভূমিকা পালন করে। ধাপ ওঠা সিঁড়ি বেয়ে বঙ্কিম রৌদ্ররশ্মি যেন।

হাসানের বিষয়বস্তু কেমন? একপাল কিশোর সন্ধ্যার অন্ধকারে একটি পথ হারানো আহত-ডানা শকুনকে তাড়া করে খুন করে। কে জিতবে তারই ফয়সালা করতে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ। কিংবা বয়স আন্দাজে অসম্ভব দীঘল একটি জারজসন্তানের অন্নের ক্ষুধা-প্রবৃত্তির ক্ষুধা হাসানের বিষয়বস্তু। হামিদাকে দখল করার জন্য গাঁয়ের এক প্রমত্ত প্রেমিক শুধুই বীরত্ব প্রমাণের জন্য আরেকজনের কোমর ভেঙে দেয় শব্দ করে--সামান্য মল্লযুদ্ধে। আঠারো বছরের সদ্য যুবা স্বামী-পরিত্যক্তা শিক্ষয়িত্রীর যৌন আকর্ষণে ধরা দিতে দিতে ফিরে আসে শিশুর চিৎকারে সংবিত ফিরে পেয়ে। তখন সে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে নেয় তার নিজের বিবেককেই।

সাপ, চাষের জমি, কৃষক নেতা, শহরবাসী বলশালী শোষক, অন্ধ বিশ্বাস এবং বিলের বুকে প্রবল বর্ষণের ভেতর বজ্রপাত—এসবকে কেন্দ্র করে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার কোটি কোটি বছরের জনজীবন! তার পাশাপাশি রয়েছে এই প্রবহমান জনজীবনের নিদারুণ কৌতুকের মতো অবিরাম ষণ্ডযুদ্ধ, বিষ প্রয়োগে মিরাকলের মতো কবিরাজের জীবনলাভ। ঠিক এক কথায় এভাবে হাসানের লেখার বিষয়বস্তু গুছিয়ে বলা কঠিন। কারণ, সে একজন দার্শনিক। সাধারণ জিনিসকে ধরে সে ঈশ্বরের মতো করুণায়, পরিহাসে, নির্মোহে বিগলিত মানুষের ইতিহাস বলতে চেয়েছে।

দেশবিভাগে ছিন্নমুল মানুষের কথা অনেকেই লিখেছেন। হাসানের দৃষ্টি অন্যরকম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা ওপারে গিয়েছেন এবং যারা ওপার থেকে এপারে আসতে চান তাদের কথা কত গভীর করে বলা যায় তার প্রমাণ ধরে রাখার জন্য আমি দুটি গল্প বেছে নিয়েছি। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক কারণে। সেই পাকিস্তানেরই সৃষ্টি বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের নতুন মধ্যবিত্ত সমাজ। তার জ্ঞানস্পৃহা, তার ক্ষুধা তরুণ গরুড়সম। সে গরুড়ের মতোই বিশাল পাখা বিস্তার করে এগোতে চায়। সেখানে মনুষ্যত্ব, ধর্মের উপরে কিন্তু নিদারুণ দাপট অর্থ ও সংগতিভিত্তিক শ্রেণিবিভেদের। এই করুণ ও কঠিন সত্যটিই হাসানের বিষয়বস্তু।

লক্ষ করার বিষয়, সব কটি গল্পতেই তিনি ধ্রুবলক্ষ্যের নিরিখ রেখেছেন চিরন্তনতাকে। সেখানে কোনও মায়া দয়া নেই। সেখানে তিনি তার দ্বিতীয় বিশ্বে স্বয়ং ব্রহ্মর মতো বসে আছেন। তখন তাঁর এক মুখ হাসে-- অন্যমুখ যখন ভাবে— আবার আরেক মুখের কাঠিন্য পাঠককে ভয়ত্রস্ত করে তোলে। ফলে তার কোনও রচনাই সময়ের আঁচড়ে বাসি হয়ে যাবার ভয় নেই। দশ বছর আগে লেখা তার কয়েকটি গল্প আমার তো মনে হল এই সবে কালকে লেখা হয়েছে—এত টাটকা, এত তেজি। তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিই এমন দুরূহ কাজ সম্ভব ও সফল করে তুলেছে।

হাসান আজিজুল হক এসব কথা কোন ভাষায় লেখেন? তার অবলম্বন কী ?

এক কথায় বলতে পারি-- তার অবলম্বন চিরায়ত নিসর্গ। আর সেই নিসর্গকে তুলে ধরতে যে-ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তা তার নিজেরই। তিনি নিজের শক্তিকে প্রকাশের জন্য যোগ্য স্টাইল খুঁজে পেয়েছেন। এ জন্য নির্দ্বিধায় বলা যায়-- হাসান আজিজুল হক বাঙালির সাহিত্যসেবায় নিজেই একটি বনের পত্তন করলেন যে বনের বৃক্ষগুলি তার নিজেরই হাতে বসানো। তিনি স্বয়ং একটি ধারার প্রবর্তক হিসেবে বাঙালি পাঠকের কাছে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। তিনি আমাদের একজন বরেণ্য, আদরণীয় লেখক এবং বড়োমাপের লেখক। আমি বলতে চাই, তিনি একালের একজন বিশিষ্ট মানুষ।

গল্পওয়ারি ভাষা, স্টাইল এবং তার নিসর্গ চিন্তা নিয়ে এবার কথা বলতে পারি। যেমন :

১] ‘একটা মাটির ঢেলার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নিঃশেষে শক্তির বেদনা বোধের অতীত অবস্থায়, আচ্ছন্ন চেতনাহীন তন্দ্রার মধ্যে শকুনিটা শুধুই চলছে। তখন ছেলেরা বিশ্রাম নিচ্ছে, কথা বলছে নিজেদের মধ্যে-- ক্ষতের রস মুছছে প্যান্টে, শকুনিটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে।’ (শকুন)

২] ‘একটু ভালো করে লক্ষ করলেই বোঝা যায় ভারি পছন্দ করে সে বেঁচে থাকতে। শিষ কুড়োতে, ধুলো গায়ে হেঁটে বেড়াতে, কাদা ঘেঁটে মাছ ধরতে; পাখির বাচ্চা জবাই করতে, এটা ওটা চুরি করতে। অত্যন্ত শখ তার বাঁচতে। যেভাবে বাঁচলে সে আনন্দ পায় সেভাবে সে বাঁচতে চায়। একদিন অন্ধকারে তাকে সাপে কামড়াল। কী যে হতাশ হয়ে সে বলল, আমি তাইলে বাঁচব না, লয় মা। আমি মরে যাব!’ (তৃষ্ণা)

৩ ] ‘আমার ইচ্ছে করে তোমাদের সবাইকে, তোমাদের সোশিওলজি সুদ্ধ ধরে নিয়ে এসে আমাদের গ্রামের প্রান্তে মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতো পানিভর্তি বিলটায় পুঁতে ফেলি। ওখান থেকে দোজখের রাস্তা শর্টকাট হয়।' (বিমর্ষ রাত্রি : প্রথম প্রহর)

৪] ‘দুজনে দুটো বুনো মোষের মতো সামনাসামনি দাঁড়াল। ঘাড় বাঁকিয়ে ছোটো ছোটো লাল চোখে রক্তাক্ত দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল ওরা। যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করতে করতে শাদু লড়াই করে, হারও স্বীকার করে না, লড়াইও বন্ধ করে না। -- সে যেন সুযোগের অপেক্ষা করে বনবেড়ালের মতো।' (মন তার শঙ্খিনী) ৫] ‘দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। ঠিক তেমনি করে কাঁপা পায়ে উঠে রেজার মুখটা দুহাতে গ্রহণ করে চুমু খেলেন বার বার। ... কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনের শেষে যেন ভূমিকম্প হল-- সেই প্রচণ্ড ঝড়টা রেজার পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে এল। এই প্রথম সে প্রতিচুম্বন করল। দৈত্যের মতো শক্তিতে আঁকড়ে ধরল রাহেলাকে’। (একটি আত্মরক্ষার কাহিনি)।

৬) ‘আর ছবিগুলো চলে গেল যেন ট্রেনটা যাচ্ছে পুল পেরিয়ে ....সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামীকাল পর্যন্ত বলবে। ... আর মামির বোনেরা যা সোন্দর সে আর কলাম না। ...না হয় সরকারদের পড়োবাড়ির ভেঙে পড়া সিঁড়ি-ঘরের মধ্যে বেচারির চকচকে পালক, হলদে ঠ্যাঙ কিংবা ঠোঁটের খণ্ডাংশ পাওয়া যাবে। ...মার খাওয়া শিখতি হয় বুঝিছো বাপধনু-- ওস্তাদের কাছে শিখতি অয়।' ...সে বলছে এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মতো লাগে মেয়েডারে।’ (আত্মজা ও একটি করবী গাছ)

৭] ‘ধান বেড়ে উঠছিল, কোথাও হয়তো কুমুদ ফুটেছিল আর এই আদিম অফুরন্ত আয়োজনের ভাঁজে ভাঁজে বিশালতা সাজানো ছিল ও অনিঃশেষ প্রাণ ছিল-- অমর মৃত্যু ছিল, শ্রেণিবদ্ধ হাতিয়ার হাতে মানুষেরা ছিল এবং মুখোমুখি তাদের শত্রুরাও ছিল।’ (আমৃত্যু আজীবন)

৮] ‘কারণ তার ষাঁড়-জন্মের জন্যে সাংঘাতিক দৈহিক শক্তি এবং অকুতোভয় স্বভাবটি তো সে ঠিকই পেয়েছিল। অবলার আবার ব্যাপার আলাদা— তার শরীরে এতটুকু বিদেশি রক্ত ছিল না। সে দেহাতি গোছের। কোনও গৃহস্থের সম্পত্তি। ঠ্যাঙানি-পিটুনি তার দৈনন্দিন বরাদ্দ।

– সে এ অঞ্চলের নামকরা চোর এজন্যে তার কথা শোনবার গরজ ছিল না কারো।' (শশাণিত সেতু)।

৯] ‘আমরাও যাব-- আমরাও যাব। বাজে। বুকের মধ্যে। এই সব পরিত্যাগ করে, এই সবের মধ্যে মরে গিয়ে। একটা সজল আকাশ, একটি ঠান্ডা বাড়ি, পুকুর ঘাট, সাদা পথ, লতার মিষ্টি গন্ধ, জমির শেখ, পদ্মপিসি এই সবের মধ্যে মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠা! নতুন আলোয় চোখ রেখে।’ (খাঁচা)

উদাহরণ দীর্ঘ হল। উপায় ছিল না। আরও বহু উদাহরণ দেওয়ার লোভ সম্বরণ করলাম। দীর্ঘ দশ বছরের রচনার উদাহরণ দীর্ঘ তো হবেই। তা ছাড়া হাসানের জীবনের নানা সময়ের গদ্য কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে ঋজু, তীব্র, রসিক, নিস্পৃহ হয়েছে সে কথা বোঝাতে আমি শ্রেষ্ঠপথ ভেবেছি—তারই গদ্যের নমুনা পর পর সাজিয়ে দেওয়াকে।

শকুন’ গল্পের গদ্য “শোণিত সেতু’ গল্পের গদ্য থেকে ভিন্ন। কারণ এর ভেতর একটি দশক কেটে গিয়েছে। ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের যে অংশটি তুলে ধরেছি সেখানে আমার বার বার মনে হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ বুঝিবা এই ভাবেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্বিধান্বিত অর্জুনকে জ্ঞাতি-নিধনে প্রবৃত্ত করিয়েছিলেন। সে ভাষায় ছিল পৃথিবীর সত্য ও সমর। নিষ্করুণ দার্শনিকের সত্যসম্ভব আহ্বান।

আরেকটি কথা, হাসান কথ্য ভাষাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন—তার উদাহরণ পাই –‘বোনরা যা সোন্দর তা আর কলাম না’ (৬ নম্বর)।

এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। কথ্যভাষায় করমালি (আমৃত্যু আজীবন) যখন তার ছেলেকে সাপের উপস্থিতির কথা জানায়—তখন সমগ্র মানববিশ্বাস সেই কথ্যগদ্যে চলকে ঢলে পড়ে। ‘তানারে দেহিছিস? তানারে দেখলি না?’ এখানে তিনি মানে সেই অমর বিষধর সাপটি।

হাসানের নিসর্গে তিনটি ঋতু আছে। শরৎ, হেমন্ত, শীত। আর উত্তরের বাতাস। তার রচনায় বাতাস কথা বলে। রৌদ্র বাঙ্ময়। তক্ষক জীবন্ত। আশাহত প্রৌঢ়া খুকির সারল্যে পাগলিনীপ্রায় অবস্থায় স্বামীকে আক্রমণ করে।

উপরন্তু সমগ্র রচনার ভেতর হাসান আজিজুল হক একটা পাগলাটে ফিক ফিক হাসি ছড়িয়ে দেন মাঝে মাঝেই। তা আপনা-আপনিই আসে। এই রসিকতা বা চাপা কৌতুক আমরা ইতিপূর্বে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথে পেয়েছি। পেয়েছি তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিকে। আরও পেয়েছি বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ে, সতীনাথ ভাদুড়িতে। তারপর তা একরকম বিরল হয়ে পড়ে বলা যায়। আবার তা পেলাম হাসানে।

জানি, আমি এতখানি লিখেও বলতে পারিনি হাসান কেমন। এ প্রয়াস অক্ষম। আরও জানি, হাসানকে জানার শ্রেষ্ঠ উপায়- হাসানকে পড়ে ফেলা।


সেপটেম্বর, ১৯৭৫



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ