অহনা বিশ্বাসের গল্প : কাঠচাঁপা


রা আসার আগে পর্যন্ত আমি গাছটার দিকেই সকালসন্ধে তাকিয়ে কাটাতাম। আমাদের উঠোনে ওই একটাই গাছ। কাঠাচাঁপা। বুড়ো হয়ে গেছে। পাকানো পাকানো কাঠ হয়ে যাওয়া গুঁড়ি। একটা দিক মরেও এসেছে। অথচ অন্য দিকটা রসালো, মোটাসোটা ডালে কালো কালো সতেজ পাতা। পাতার মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ পাঁচ পাপড়ির হলুদের আভা মেশানো নরম সাদা ফুল। সকালের প্রথম রোদে সে একরকম, সন্ধে বেলায় আরেক রকম, মেঘ করলে সে তখন গোটা পাড়ার মধ্যমণি। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে তাকে ছাড়া কাকে দেখি। সন্ধেবেলাতে আঁচল ভরে ফুল কুড়োই। এক আশ্চর্য গন্ধ নাকের কাছে, মুখের কাছে চেপে ধরি। একটা কীরকম স্পর্শসুখ আমার ভেতর দিয়ে সিরসির করতে করতে নেমে যায়। কোথাও কখনও আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে গেলে বাড়ি বলতে আমার ওইটিই ভেসে উঠত। ওই কাঠচাঁপা গাছ, তার আকাশমুখী কালো মসৃণ পুরুষালি পাতা, পাতার বুকে ধরে থাকা নরম নরম একরাশ ফুল। বৃন্ত থেকে খসার যন্ত্রণা যার বেশিক্ষণ সয় না, অন্যের হাত সয় না, খয়েরি হয়ে নষ্ট হয়। অথচ ওরা আসার পর থেকে, বিশেষত উনি আসার পর থেকে আমি গাছটার কথা ভুলেই গেলাম।

গাছটার জন্ম কবে আমরা জানতাম না। বাবা যখন বাড়িটা কেনেন তখনই গাছটা ছিল। মায়ের শখ ছিল বাইরের অনেকটা জায়গা জুড়ে যে উঠোন, সেখানে বাগান করার। বড় বড় গাছ থাকবে। অন্তত আম, নারকেল, কাঁঠাল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কয়েকটা ফলের গাছ থাকবেই। বাবা লাগাতে দিলেন না। দুই মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। আজ বাদে কাল তাদের বিয়ে হবে। কত পরিচিত, কত আত্মীয়স্বজন আসবে। প্যান্ডেল করতে হবে। তা সামনের উঠোন ছাড়া হবে কী করে? ওইসব গাছ তখনও বড় হয়ে উঠবে না, কত সমস্যা। তা ছাড়া সময় তো চলে যাচ্ছে না। দুই মেয়ে চলে যাক শ্বশুরবাড়ি, তারপর বুড়োবুড়ি না হয় শুধু বাগানই করবে। বাবা তো ভেবেছিলেন ওই কাঠাচাঁপা কেটেই ফেলতে হবে। তো আমি জেদ ধরলাম। দেওয়ালের ধারে আছে, কী ক্ষতি হচ্ছে। প্যান্ডেল হলে অনায়াসে তার পাশ দিয়েই হতে পারে। বাবা বলতেন, না এখন থাক। তবে প্যান্ডেল হলেই কাটব, নিশ্চয় কাটব।

প্যান্ডেল আর হয়নি। কদাচিৎ দু-একজন দেখতে এসেছে, সেও অনেক দিনের কথা। দিনের পর দিন হাওয়ায় ভেসে ভেসে গেছে। বাবার টাকা ছিল, পয়সা ছিল, হাত ভরে বাবা দিতেনও, তবু আমার বিয়ে হল না। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেল, বয়সে, অসুখে। প্রথমে মা, তারপর বাবা। ঘরের মধ্যে আমি, বোন ঘুরঘুর করি। বোন বাইরে যায়, একটা চাকরি করে। আমি ঘরে থাকি। ওর অফিসের ভাত রাঁধি, ওর জন্য সন্ধেবেলায় অপেক্ষা করি, টিভি সিরিয়াল দেখি। বাকি সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকি। সূর্যের গা পোড়ানো রোদ কীভাবে শুষে নিচ্ছে কাঠচাঁপা তাই দেখতে থাকি। রাত্রে ঘুম না এলে বাগানে বেড়াই। কাঠচাঁপার কাণ্ডে হাত রাখি, কখনও ওর কাঠিন্যকে নিজের মধ্যে অনুভব করার চেষ্টায় দু হাতে ওকে প্রাণপণে অকড়ে ধরি। আর একদিন ওই গাছে ঠেস দিয়ে দেখতে পাই পাশের বাড়িতে বহুদিন পর জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ বহুদিন তালাবন্ধ থাকার পর নতুন ভাড়াটে এসেছে।

আমি চটপট ব্যালকনিতে উঠে আসি, আর উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘরে শুধু আলোই জ্বলছে, কোনও লোক নেই, আসবাবপত্রও নেই। আমাদের পাশের বাড়িটি দোতলা। বাড়ির মালিক মারা যাবার পর বাড়িটা পোড়ো হয়ে যাচ্ছিল। মালিকের ছেলে নাগপুরে ব্যবসা করে। কয়েক মাস আগে লোক লাগিয়ে সে আগাছা ছেঁটেছে, ফাটাফুটো প্লাস্টার করিয়েছে, রঙ করিয়েছে। তবু এতদিন কেটেছে কোনও লোক আসেনি। এখন আবার কে এল? আমার মনের মধ্যে খচখচ শুরু হল। নতুন ভাড়াটেরা কীরকম লোক হবে কী জানি। আমরা বয়স্ক দুই মেয়ে থাকি। আমাদের সম্পর্কে নতুন লোকের কৌতূহল স্বাভাবিক, আর মহিলা বলে তো কথাই নেই। এইসব কৌতূহল যে পীড়া দেয় না এমনটা বলতে পারি না। এইসব পুরুষেরা আমাদের দিকে অন্যভাবে তাকায়। যেন কী একটা জীব আমরা। তাদের বউরা পাঁচজনকে দেখিয়ে শুনিয়ে স্বামীকে সতর্ক করে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। পাশের বাড়িতে কেউ আসুক, কেউ আমাদের দিকে নজর দিক, এ আমি কখনও চাইনি।

সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম। ঘুম এল না ভালো করে। রাত্রে বাথরুমে যাবার সময় ব্যালকনির দরজা খুলে বাড়িটা দেখি। লাইট নিবে গেছে। অর্থাৎ, আলো জ্বালিয়ে কেউ তালাবন্ধ করে যায়নি। বাড়িতেই সবাই আছে। কী জানি তারা কারা? ভদ্রলোক মহিলার বয়স কী রকম ? ছেলেমেয়ে কজন? ঘরে স্বশুর-শাশুড়ি আছে কি না কে জানে!

পরের দিন রবিবারের ভোর। দেরি করে ঘুম ভাঙলেও চলে। বোনের অফিস নেই। সে ঘুমে মরা। আমি ঘুম থেকে উঠলাম। সমস্ত শরীরে ঘুম না হবার চাপ চাপ ব্যথা। আমি ভোরের ঠান্ডা হাওয়া নেবার জন্য ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। আর তখনই তাঁকে দেখতে পেলাম। ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে তিনি নাচছেন। মধ্যবয়সী লোক, ধপধপে রঙ, মাথার সামনেটা একবারে চুল নেই, একটা ভিন্‌ভাষার গানের সঙ্গে নাচছেন। দেখতে দেখতে আমার শরীরময় হিল্লোল উপস্থিত হল। কী নাচ, কী শরীরের ভঙ্গি, কী হাতের মুদ্রা। পায়ের দিকটা ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলাম না। নইলে তার নগ্ন জীব বা পিঠের প্রতিটি মাংসপেশীর তিলমাত্র সংকোচনও যেন আমি স্পষ্ট দেখছিলাম। সে যদি মেয়ে হত তবে আমি বলতাম তুমি সত্যিই দেবদাসী, সার্থক তুমি। কিন্তু ইনি পুরুষ। পুরুষের এমন নাচ আমি জন্মেও দেখিনি। এর প্রতি আমার কী বিশেষণ প্রয়োগ করা উচিত এ আমি সারাদিন ভেবেও ঠিক করতে পারলাম না। কিন্তু মনে হতে লাগল নৃত্য ভিন্ন যেন পুরুষের পৌরুষ আর কোথাও সেভাবে ধরা দেয় না। পৌরুষের অপার মহিমা আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে টানতে লাগল। এভাবে একটা জানালা আমার সারাদিনের ধ্যানের বিষয় হয়ে গেল।

আমি চারদিক থেকে তার খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। ভদ্রলোক প্রতিদিন ভোর চারটে থেকে অভ্যাস করেন। আমিও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমি যেন তার সকল স্বেদবিন্দুর স্বাদ পর্যন্ত অনুভব করতে থাকি। বিকেলবেলায় তাঁর ছাত্রছাত্রী আসে দলে দলে। আমি সবার মাঝখানে তার পায়ের শব্দ আলাদা করে বুঝতে পারি। বিকেল হতে না হতেই গেটের কাছে চলে যাই। কিশোরকিশোরী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করি। মিষ্টি করে হাসি। তাদের ঘরের কথা জিজ্ঞেস করি। তারপরই গুরুজির কথায় আসি। ওরা তেমন কিছুই বলতে পারে না। আগে যে জায়গায় থাকতেন সেখানে ভালোই ছিলেন, কেন এখানে এত দূরে এলেন তা তারা বলতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের যে অসুবিধা হচ্ছে এ তারা জানাতে কসুর করে না।

এদের কাছ থেকে তেমন কিছু খবর সংগ্রহ করতে না পেরেও আমি দমে গেলাম। না। একদিন একজন তুলনামূলক বয়স্ক মহিলাকে ঘরে ডাকলাম। চা খাওয়ালাম। নানাবিধ সঙ্গী ত ও নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আমিও অল্প বয়সে গান শিখতাম। ইতিমধ্যে সেইসব বই, খাতাপত্তর ধুলো ঝেড়ে নামিয়েছি। কাজেই সেইসব কথাবার্তা দিয়ে কথা শুরু করতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। এরপর আমি কথায় কথায় গুরুর কথা শুরু করলাম। যে-গুরু আমার দিনরাত্রের সব সময় অপহরণ করে নিয়েছেন। এই মহিলা আমার চেয়ে ছোট। কিন্তু গুরুর ব্যাপারে স্বাভাবিক কৌতুহল অল্পবয়সীদের থেকে বেশি। গুরুর স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হবার পর যে তিনি এই বাড়িতে উঠে এসেছেন সেটা সে জানাতে কসুর করল না। এরপরেই অবশ্য শুরু করল বিগত স্ত্রীর বহির্মুখী নানা গুণপণার কথা, আমার সে বিষয়ে কোনও আগ্রহ ছিল না।

আমার বিয়ে হয়নি। ভাই, দাদা, জামাইবাবু কেউ চারপাশে ছিল না বলে পুরুষমানুষ সম্পর্কে কোনও একটা ধারণাই নিটোলরূপে গড়ে ওঠেনি। বিয়ে হয়নি বলে বিয়েটাকে গুরুত্ব কম দিতাম এমন নয়। ডিভোর্স-টিভোর্স কল্পনা করতে পারতাম না। এই মানুষ, যে অত সুন্দর নাচে, সে ডিভোর্সি ভাবতে খারাপ লাগল। ভাবলাম আর সকালে দাঁড়াব না। বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নেব।

কিন্তু ভোরবেলায় সেই অচেনা ভাষার গান আর পায়ের আওয়াজ আমাকে মন্ত্রের মতো টানতে লাগল। আমি বিছানার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একসময় ছুটে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এ দিনে তাকে জ্বলন্ত আগুনের শিখা বলে মনে হচ্ছিল। এই নৃত্যকে তান্ডব বলে কিনা জানা নেই। তিনি যেন নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে চলেছেন। তাঁর নাচ দেখতে দেখতে আমার গাল বেয়ে জল নামছিল। আমার মনে হচ্ছিল ও শিবের গা থেকে সমস্ত তাপ আমি শুষে নিই। ঠান্ডা করে দিই তাকে। কী মাথায় চাপছিল আমার। মনে হচ্ছিল ডিভোর্সি বলে তো পাপ কিছু করেনি। |

আস্তে আস্তে ও বাড়িতে আরও একজন পুরুষ দেখলাম। পুরুষটি কেমন আলগা হয়ে ঘুরছে। একদিন আর একজন মহিলাকে দেখলাম। নাকে একটা বড় নাকছাবি, মোটা ভ্রূ, টান করে বাঁধা লম্বা চুল, রাস্তার নেড়িকুত্তাকে আদর করছে। গুরুর আত্মীয়স্বজন হবে। একদিন ওদের বাগানে তিনজনকে দেখলাম মুখোমুখি বসে আছে। কথা বলছে। মহিলাকে বিশেষ দেখা যায় না। অন্য পুরুষটি দোকানবাজার যায়, মহিলার সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে বের হয়। এই লোকটির মধ্যেও একধরনের ছেলেমানুষি আছে যেটা প্রতিদিন কুকুরকে খাওয়ানোর সময়, কুকুরের পিছনে ছোটার সময় টের পাই। এই লোকটিকেও আমার ভাল লাগে। একে অবশ্য লোক না বলে ছেলে বলাই ভাল। আমার থেকে বয়সে বেশ ছোটই হবে।

আমি মনে ভাবি আমাদের দুই বাড়ির মধ্যেকার নড়বড়ে প্রাচীরটা কবে ভেঙে পড়বে। আমরা দুই বোন দুটো বেনারসি পরব। মায়ের মুক্তোর কলারটা বোনকেই দেব। আমার বয়স বেশি, আমার জন্য সরু হারটাই যথেষ্ট হবে। একতলা দোতলা দুই বোনে ভাগ করে নেব। বিকেলবেলায় ছাত্রছাত্রী আসার আগে স্নান করে ফিটফাট হয়ে গায়ে একটু সেন্ট ঢেলে ওদের বাগানের বড় বেতের সোফাটায় বসে থাকব। অফিস থেকে ফিরে বোন ওর সঙ্গে বেড়াতে যাবে।

সেই মহিলা, যার কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম তাকে অনেকদিন দেখিনি। ওদের বাড়ির নাকে বড় নাকছাবি পরা মেয়েটি মাঝেমাঝে ছাতে একলা ঘোরে। আমি ছাতে থাকলে আমার দিকে বারবার তাকায়। আমি পাত্তা দিই না।

একদিন আরও দুটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে এল। বাড়িময় যেন উৎসব ফুটে উঠল। সেদিন ছাত্রছাত্রীরা ফিরে গেল। নাচ বন্ধ। গাড়ি করে দুটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে গুরু কোথায় গেলেন। নাকছাবি পরা মেয়েটি সেই ছেলেটিকে নিয়ে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ছাতে ঘুরল। আমি ছাতে উঠলাম। ছেলেটি আমার কার্নিসের কাছাকাছি আসতেই আলাপ করার জন্য কথাবার্তা শুরু করলাম। ছেলেটি যেন আমার সঙ্গে কথা বলতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমি সঙ্গের মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, আমার দিদি। তাদের বাড়ি অনেক দূরে, কানপুরে। প্রবাসী বাঙালি, ছেলেটি ব্যবসা শুরু করেছে। বাপ-মা নেই। দিদির সঙ্গে থাকতে চায়। আমার এটুকু শুধু জানার দরকার ছিল না। তারা গুরুর ঠিক কে হয় এটা জানার জন্য আমার মন বড় আগ্রহী ছিল। কিন্তু ওর দিদি পাশে এসে দাঁড়াতে আমি কেমন একটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলাম। ছেলের দিদির মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল যা আমার ব্যাকুলতার সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওর ঠান্ডা চাউনি, মুখ, ভাঙা ভাঙা বাংলা, মনের মধ্যে কেমন একটা ভাব জাগিয়ে তুলছিল। এরকম মেয়ে আমি আমার চেনা গন্ডির মধ্যে দেখিনি।

অল্পবয়সী ছেলেটি যেমন তেমন, সঙ্গের মেয়েটিও আমার চোখে কেমন বেহায়া ধরনের লাগল। দুজনের প্রায় একই পোশাক। অটো জিনস্ আর গেঞ্জি পরনে। ছিপছিপে সুন্দরী বলে মেয়েটাকে মানাচ্ছিল না এমনটা বলব না। কিন্তু গুরুর বাড়ি, তার পরিবেশ, শাস্ত্রীয় নৃত্যশিক্ষার আবহাওয়ায় এই যুগল বড়ই বেমানান ছিল। একদিন ভরদুপুরে জানালা খোলা রেখে ওদের নির্লজ্জপনাও চোখে পড়েছিল। আমার সবচেয়ে রাগ হত যখন দেখতাম গুরু ওদের নিয়ে মাতামাতি করছেন কিংবা রেওয়াজ কমিয়ে দিয়েছেন। আমার মনে হত আমি দৌড়ে গিয়ে গুরুকে শাসন করি। কারণ গুরুর নাচে আর আগেকার মতো ঔজ্জ্বল্য ছিল না। গুরুকে অন্য সময় কেমন বয়স্ক দেখাত। আর আমি নানা ভাবে নানা সময়ে গুরুকে দেখতাম বলে আমার চোখে তার প্রতিমুহূর্তের পরিবর্তন ধরা পড়ত।

একদিন ছাতে উঠেছি। জিনস পরা ছেলেমেয়ে দুটো সমানে বেহায়াপনা করছে। আমি নাকছাবি পরা মহিলাকে দেখছি নীচে রাস্তার কুকুরদের রুটি খাওয়াচ্ছে। আম সমানেই হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি, যাতে সে হাতে আসে এবং এই ছেলেমেয়ে দুটো চলে যায় এবং আমার সান্ধ্যভ্রমণ নিরুপদ্রব হয়। আমি যেন কেবল তাঁর নৃত্যভঙ্গি দেখি মনে মনে।

ভদ্রমহিলা এল। ওর চলাফেরা, কথা বলা, সবকিছুর মধ্যে ধীরস্থির ভাব। কার্নিস ধরে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। প্রশ্নচিহ্নহীন চোখ। একটু হাসার চেষ্টা করল। নমস্কার জানাল। ছেলেমেয়েগুলোর পাশ দিয়ে আসার সময়ও মহিলা তাদের দিকে চেয়ে একটু হেসেছে। আমি ডাকছি বলে ও সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটা ওদিকে চলে গেছে। আমি প্রথমটায় কী বলব ভেবে না পেয়ে বললাম: বিকেলবেলায় একা লাগে, আপনার সঙ্গে গল্প করব বলে ডাকলাম। আপনার কাজ ছিল?

কী কাজ আর! এ বাড়িতে কাজের লোক অঢেল। বাড়ির মেম্বারের চেয়ে বেশি।

গুরুজির সবদিকে চোখ, ব্যবস্থা খুব ভাল। আমি বললাম। ভদ্রমহিলা মোটা ভুরুর তলায় চোখ তুলে আবার আমার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, এখানে আসার পর আমাকে কিছুই করতে হয় না। আমাদের কানপুরে কত কাজ ছিল সারাদিনে, একটা বাচ্চাদের ইস্কুলে পড়াতাম। বাড়িতে একটা অ্যালসেসিয়ান ছিল, সারাদিন তার পিছনেও কম কাজ!

সেসব ছেড়ে এখানে এলেন কেন ? বেড়াতে?

মহিলার হাসি মুখময় ছড়িয়ে গেল। একটু চঞ্চল হয়ে উঠল যেন। বেণীটা অহেতুক সামনে নিয়ে এল। পিছন ফিরে ওদের দেখল, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় মগ্ন ওরা।

উনি ডাকলেন যে।--ভদ্রমহিলা এ কথা বলার ফাঁকে বারবার পিছন ফিরে ওদের দেখছিল।

উনি ডাকলেন যে—এই কথাটির মর্ম সেই মুহূর্তে আমার কানের ভেতর ঢুকলেও মাথায় ঢোকেনি। আমার চোখের সামনে ছেলেটি মেয়েটির পরস্পর লগ্নতার ছবি বড় বিব্রত করছিল। আমি ওদের দিকে দৃষ্টি রেখে খানিকটা বিরক্তির সুরে বললাম: ওরা কারা ?

ওরা? মহিলা একটু থতমত খেল। মনের মধ্যে যেন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে নিচ্ছে। ওরা আমার ছেলেমেয়ে।

এত বড় বড় ? আমি হা করে মহিলার দিকে তাকালাম। এই মায়ের এই ছেলেমেয়ে! এই সম্পর্ক চোখের সামনে!

মহিলা দু হাতে বেণীর চুল পাকাতে পাকাতে আমার দৃষ্টির উত্তরে বলল, ওঁর প্রথম স্ত্রীর ছেলে আর বউ। নতুন বিয়ে হয়েছে। ওরা দিল্লিতে যাবার পরই তো আমাদের রেজিস্ট্রি হল।

আমার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সহস্র সূচ যেন রক্তের শিরা উপশিরা বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল নীচে যাই, ঘরের দরজা বন্ধ করে বালিশ আঁকড়ে দুদন্ড বসি। কিন্তু ওকে ডেকে ওর সামনে থেকে চলে যাওয়া কীরকম বিশ্রী হবে সেটা ভাবতেই আমার পা সরছিল না।

মহিলা ছাত থেকে আমাদের বাগানের দিকে তাকিয়েছিল। কাঠচাঁপা গাছ অন্য দিনের মতো ফুলে ভরে আছে। মহিলা জিজ্ঞেস করল, ওটা কী গাছ। আমাদের ওখানে এত সুন্দর গাছ দেখিনি। সেই মুহূর্তে গাছটার দিকে আমি তাকিয়েছিলাম ঠিকই। তাকিয়ে আমার যেন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল সময় শরীরের শক্তি দিয়ে আমি গাছটাকে ধ্বংস করে ফেলি। বলা বাহুল্য, ভদ্রতা রক্ষা আমি বেশিক্ষণ করতে পারিনি। দৌড়ে ঘরের ঘেরাটোপে নিজের খাটের ওপর লুটিয়ে পড়ে কেঁদেকেটে বিছানা তোলপাড় করেছিলাম।

আস্তে আস্তে এই কান্না রাগে রূপান্তরিত হল। ওরা কেউ থাকলে আমি ছাতে যেতাম না। মুখোমুখি হলে এড়িয়ে যেতাম। আমার বোন ওদের সঙ্গে গল্প করত, কথা বলত, এতেও আমি খুশি হতাম না। মহিলা আমার বয়েসি হয়তো হবে, কিন্তু আমার বোনের সঙ্গে ভালই গল্প করে, কথা বলে। কখনও কখনও ভোরবেলায় হাঁটতে যায়। আমার পছন্দ অপছন্দতে আমার বোন বিশেষ গ্রাহ্য করে না বলে ওর সঙ্গে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলা যায় না। কিন্তু আমাদের দু বোনের কথাবার্তায় স্পষ্ট পক্ষপাত দেখা যায়। আমার বোন গুরুজির এই দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আমি গুরুজির।

আমরা দুজনেই লক্ষ করেছি গুরুজির সঙ্গে এই মহিলা (নাম কাবেরী, বোনের কাছ থেকে শোনা)-র খুব একটা মাখোমাখো ভাব নেই। দুজনকে একসঙ্গে বেড়াতে দেখি না, গল্প করতে দেখি না। গুরু নিজের মনেই থাকেন। দরজা বন্ধ করে নাচ করেন, ছাত্রছাত্রীদের তালিম দেন, কখনও বই পড়েন।

আর ঘরের মধ্যে আমি, আমার বোন দুজন দুই পক্ষের হয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করি। গুরুজির জন্য কাবেরীকে তার কুকুরটাকে পর্যন্ত রেখে আসতে হয়েছে। অথচ ওদের নাকি প্রেমের বিয়ে। গাদা গাদা চিঠি লিখেছেন নাকি গুরুজি।

আমার শেষ কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। আমি তো ওর সারাদিনের ব্যস্ততা দেখেছি। চিঠি লেখার সময় কোথায় ওঁর? এত সুন্দরী সুন্দরী ছাত্রী গুরুজির। ওকে চিঠি লিখতে যাবেই বা কেন?

বোন বলে, সুবিধা আর কী! ওরা প্রবাসী বাঙালি। সাদাসিধে মেয়ে। মাথার ওপর গার্জেন নেই। পেয়েছে সুবিধা। এত বুড়ো লোক, ঘরের দরজা বন্ধ করে নাচ করে আর এদিকের জানালা সব খোলা। লোককে দেখাচ্ছে।

ভেতরে ভেতরে আমি চমকে উঠি। আমি প্রতিদিন ভোরে উঠে কখনও নিজেকে আড়াল করে, কখনও প্রকাশ করে নাচ দেখি বলে কি এত কথা হচ্ছে। গুরুজির নিন্দে হচ্ছে ।

আমার রাগ হয়। অভিমান হয় বোনের ওপর। ও চাকরি করে। নানা জায়গায় যায়। মাঝেমাঝে দু একটা মেয়ে বন্ধু ঘরে আসে। কোনও কোনও পুরুষ সহকর্মী ফোন করে। লোকে ওকে আমার চাইতে দেখতে সুন্দরও বলে। ও তো বিয়ে-থা করে চলে যেতে পারে। আমার কী আছে? আমার মতো মেয়ের সঙ্গে থাকে কেন ও? চারপাশ বন্ধ বলেই না ওঁকে দেখি। বুকের মধ্যে তাল বাজে। বোনকে একটু শ্লেষ নিয়ে বলি, কাবেরীর ভাইকে বিয়ে কর না তুই। ভালই থাকবি তিনজনে কি চারজনে। আমার বোন আমার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ধরতে পারে না। বিষণ্ন গলায় বলে, না রে দিদি। ওরা দুজনে ঠিক আমাদের মতো। একসঙ্গেই থাকবে ভাবে। ছেলেটার ওখানে ভাল ব্যবসাপাতি ছিল। ছেড়েছুড়ে এসেছে। কিন্তু এখানটা ওর স্যুট করছে না। হয়তো ভেতরে কিছু গন্ডগোল আছে। সব কি মানুষ লোককে খুলে বলে, বল।

আমি ঘাঁটাই না। একে একে সব চলে গেছে। এই বোনটা যদি চলে যায়, সব শূন্য হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে তো ওকে বলতাম, একটা বিয়ে কর। আরেকজন নিয়ে আয় আমাদের মধ্যে। একতলা দোতলা যেখানেই হোক বাগিয়ে সংসার কর। কিন্তু ও কী ভাবে কে জানে? ওর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করি, ওকে ছাড়া থাকা সম্ভব হয় না। মাঝে মাঝে আমি কাঁদি, সবার অলক্ষ্যে কেঁদে ভাসাই। ।

বহুদিন সকালে কাঠচাঁপার দিকে তাকাই না। রাত্রে গিয়ে কাঠচাঁপার গুঁড়িতে পা দুলিয়ে বসি না। পাতা ঝরার আওয়াজ কানের মধ্যে ভাসে না। কখনও চোখ পড়লে দেখি সে সেইরকমই আছে। ফুল ফোটাতে অকৃপণ হয়নি। আমার ছোটবোনের সঙ্গে সখ্যের দৌলতে গুরুজির স্ত্রী কাবেরী ভোরবেলায় বাগানে আসে, ফুল কুড়োয়। আমি গুরুজির নাচের মগ্নতা থেকে খানিক দৃষ্টি সরিয়ে তাকে দেখি। একধরনের উল্লাস হয়। গুরুজি বিয়ে করেছে অথচ কী বেপাত্তা করে। ও নাকি একসময় ভাল নাচত। কোনও এক ফাংশনে গিয়ে আলাপ। অথচ তাঁর নাচই দেখতে পায় না। দরজা বন্ধ করে গুরু নাচেন। খোলা জানলা দিয়ে, আমার বোনের মতে, সবাইকে দেখান। শুধু বউকে নয়। এভাবে কাবেরীর ওপরে উঠে যাবার একটা মনোবাসনায় খুব তৃপ্তি পাই।

একদিন বোন এসে বলল, জানিস, কাবেরী তোর গানের খুব প্রশংসা করছিল। আমি বললাম, সে কী, ও আমার গান শুনল কোথায় ? বোন বলল, দুপুরবেলায় তুই নাকি ঘরে বসে গান গাস, ও শুনেছে। আমি অবাক হবার ভান করলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে লজ্জায় ম্লান হয়ে গেলাম। বোন অফিস চলে গেলে ওদের দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে গান গাই। গুরুজি যদি শোনেন। যে লোক নাচে, সে কি আর গানের সমঝদার হবে না? সেই গানের খবর কাবেরীর মাধ্যমে ওর কাছে এসে পৌঁছাল। আমি বললাম, আমার ঘরে আমি একটু গান গাইব, তারও যদি উপায় থাকে! আমাদের এদিকে তোর কাবেরী কি দু চোখকান লাগিয়ে বসে থাকে নাকি ?

এভাবে বলিস না দিদি। আসলে ও বাচ্চাদের ইস্কুলে পড়াত তো! ও বলছিল। তোমাদের নিচে যদি একটা স্কুল করো তো এদিককার যত বাচ্চা আছে তাদের নাচ গান শেখানো যাবে। সেই প্রসঙ্গেই বলছিল তোর গানের কথা। ও তো ভাল নাচে।

সে কী, একেবারে আমাদের ঘরের দিকে চোখ পড়েছে যে। একবার দখল হলে কী হবে বল তো, উঠবে? বোন এই কথা একেবারেই চিন্তা করেনি। আস্তে আস্তে ওর করুণ মুখটা দেখে আমার মায়া হল। বিয়ে-থা করল না, নিজের বলে কিছু নেই, মাঝেমাঝে গল্প করে। পাশের বাড়িতে না হয় একটা প্রাণের বন্ধুই হয়েছে, তাতে আমার এত গা জ্বলছে কেন?

আমি ওকে আদর করে বললাম, দিদির দিকে তো একটুও মন নেই, শুধু কাবেরী কাবেরী। তা ওদের বাড়ির একতলাতেও তো একটা বড় ঘর পড়ে আছে। সেখানেও করতে পারে। আমার বোনের মুখ থেকে ঘন কালো ছায়া নামল না। খানিক পরে চা খেতে খেতে বললঃ মনটা বড় খারাপ হয়ে রয়েছে রে। কাবেরী আর ওর ভাইয়ের সঙ্গে এমন এমন কথা হল। আমি উৎসুক হলাম।

বোন বলল, কাবেরী এমন করে সব বাচ্চাদের কথা বলছিল যে আমি বুঝতে পারছিলাম ও এখনও ওদের মধ্যেই আছে। এই গুরুজির বাড়ি, এদের ঠাটঠমক কিছুই মানতে পারছে না। জানিস দিদি, আমি তখন বলেই ফেললাম তোমার তো একটা ছেলেমেয়ে হতেই পারে, হলে দশটা বাচ্চার বদলে অন্তত একটা বাচ্চা পাবে। ওর ভাইও আমার কথায় সায় দিল। ওর ভাই তো খুব চায় ওর একটা কিছু হোক। একটা ভাগনে ভাগনি পেলে অন্তত সময়টা ভাল কাটে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যাপারে কী বলল কাবেরী ?

কিছুই বলল না। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, গুরুজির অত বড় ছেলে আছে। আমরা দুজনেই বলে উঠলাম: তাতে কী হয়েছে? তোমাকে তো বাঁচতে হবে। চাকরি করো না, কিছু করো না।

কাবেরী আবার বলে উঠল, ওনার বয়স হয়েছে।

তখন ওর ভাই ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করল কাবেরীর বয়স এখনও যথেষ্ট কম। যে টাকাপয়সা কাবেরীর নিজস্ব আছে তাতেই চলে যাবে, এমন কি সে নিজেও তার বোনের সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারে।

কাবেরী এসব কোনও যুক্তিতে না গিয়েই ‘সম্ভব নয়' বলে কথা শেষ করে দিল। আর তারপর তোর কথা, স্কুলের প্রসঙ্গ এসব তুলল। আমাদের আর কোনও কথা বলার সুযোগই দিল না।

আমি বোনকে বললাম সব তো ঠিকই আছে। তো মনখারাপের কী হল। কাবেরীর যুক্তি ঠিকই। কাবেরী গুরুর ছেলের ও মা। অত বড় সন্তানের পাশে—না, না, এটা ভাবাই উচিত নয়।

তুইও এক কথা বলছিস, দিদি। বোন রেগে উঠল। ওই অসভ্য ছেলেটা সম্পর্কে তুই তো একসময় খারাপ কথা বলতিস। আজকে কাবেরীকে একেবারে ওর মা বানিয়ে দিলি।

বানিয়ে দিইনি। ও নিজেই বলেছে।

ওটাই তো দুঃখের দিদি। যা মানতে পারে না, তা কিছুতেই মুখ ফুটে বলবে না। গুরুটা ওকে কী দিয়ে যে বশ করেছে কে জানে। একেবারে দাসীবাদি করে রেখেছে।

ওর কথার ধরনের হাসি পেল। বললাম, ও সুখ পাচ্ছে বলেই না দাসীগিরি সইছে। আমি হলেও তাই করতাম। ও বলল, কক্ষনও না। সারা জীবন একা বেঁচে থাকার অনেক সুখ। ওইভাবে থাকব না। দিদি, তুই যদি কাবেরীর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখতিস তো বুঝতে পারতিস মেয়েটার কত কষ্ট। অথচ গুরুজির কী নাম দেখ। শহরসুদ্ধু লোক ধন্য ধন্য করছে।

একদিন বিকেলে আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এল। অল্প অল্প ঝড় শুরু হল। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। আমি ছাতের ওপর কাপড় তুলতে গেলাম। কাপড় তুলতে তুলতে ওদের ছাতের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম কাবেরী দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাগানের দিকে মুখ করে। আমাকে দেখতে পেল না। বৃষ্টি বেশ জোরে নেমেছে। ছাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে সিঁড়ির ঘর থেকে ওকে দেখতেই লাগলাম। বৃষ্টিকে কোনও পরোয়াই নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজছে। কিন্তু আমি জানি ওর চোখ আমাদের কাঠচাঁপার দিকে। মেঘ করলে ফুলন্ত গাছ একেবারে রাজরানি হয়ে ওঠে। কিন্তু কাবেরীর ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ধরনটিকে বড় খারাপ লাগল। কত বয়স হবে? তেত্রিশ, চৌত্রিশ, খুব বেশি হলে সাঁইত্রিশ। এই বয়সেই এমন কেন? একটু তো হাসিখুশি হবে। চারদিকে এতসব সুন্দরী ছাত্রী।

আমি সাত তাড়াতাড়ি ব্যালকনির দরজা খুলে দিলাম। ঘরে জল আসবে আসুক। কারণ আমি বুঝেছি ওঘরে নাচ হচ্ছে। সেই ছাত্রীটি বসে সামনে, গুরু নাচছেন। একেবারে ময়ূরের মতো কলাপ তুলে। তার সমস্ত ভঙ্গিতে অল্প বয়সের আভা। কী রূপ! কী ফিগার ! সাধারণত বিকেলবেলায় ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর সময় গুরুজি পাঞ্জাবি পরেন। আজ ওঁর ঊর্দ্ধাঙ্গ একেবারে অনাবৃত। তার শরীরে মেঘের আভা লেগেছে। সেইসময় কী করে আমার কাঠাচাঁপার দিকে চোখ পড়ল, একসময় বৃষ্টিদিনে, যাকে দেখে আমার চোখ ভরত না। আজ দেখি বৃষ্টির তোড়ে ফুলের ডাল সমেত লুটিয়ে লুটিয়ে চোখের জল ফেলছে। এরকম কখনো আগে মনে হয়নি। গাছটাকে দেখে কাবেরীর দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা চোখের সামনে এল। আমি কোনওমতে তাকে মুছে ফেলে গুরুর দিকে মন দিলাম। আমি তার পায়ের পাতা দেখতে চাইলাম। তার হাঁটুর নীচে যে শরীর তা সবসময় আমার চোখে স্পষ্ট হয় না। তা দেখতে চাইলাম। আমার রাগ হতে লাগল মেয়েটা সামনে বসে আছে বলে। আমার মনে হল আমি যাই গুরুর কাছে ছুটে যাই। তাঁর পায়ে মুখ রেখে পড়ে থাকি। আমার বাপ-মার ওপর রাগ হয়। কেন ছোটবেলা থেকে আমাকে নাচ না শিখিয়ে গান শিখিয়েছে। নাচ শিখলে আর কিছু না হোক, গুরুজির সামনে বসার অধিকারটুকু পেতে পারতম। আমি অবাস্তব অবাস্তব কল্পনা করতে লাগলাম, কাবেরীর সঙ্গে যা সম্পর্ক তাতে ডির্ভোস হতে দেরি হবে না। তখন আমি নিজেই যাব। নিজেই গিয়ে বলব। আমি কাবেরীর মতো নই। আমি খুবই সাধারণ। সাধারণ মেয়ে হয়ে সব মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারব।

বিয়ে করে যদি নাচ শুরু করি! গুরুজিকে দেখে আমার ভেতরে যে স্পন্দন আরম্ভ হয়েছে তা তো থামার নয়। যদি আমি নাচতে জানতাম, কিংবা খুব সাহসী হতাম, ওই কাঠচাঁপার তলায় গিয়ে নাচ আরম্ভ করতাম। আমার সুন্দর হাতের আঙুলগুলো ফুলের ডাঁটি, লতাপাতা, ঘাসের পাশে প্রকৃতির একটি নতুন সৃষ্টি হয়ে জেগে থাকত। গুরু জানালা দিয়ে দেখতেন। তারপর নীচে নেমে এসে ডাকতেন। দৃশ্যটার মধ্যে নিজেকে ভাসতে ভাসাতে ভাবলাম, কবে ওদের বাড়ি যাব, কবে গুরুকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হবে।

মাসখানেক আমার বোনের খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। ইলেকশন সরকারি অফিসের একটি বড় পর্ব। নাকে মুখে চোখে কাজ। কোনওদিকে তাকানোর সময় নেই। কখন ঘরে ফেরে তার ঠিক নেই। কাজেই কাবেরী বা তার ভাইয়ের সঙ্গে ওর দেখা হয় না। আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি কাবেরীর দেখাই পাই না। বোনের এরকম কাজ আছে জানে বলে হয়তো বাগানে ফুল কুড়োতেও আসে না। কাবেরীর প্রতি আমার আগ্রহ থাকলেও গুরুজিকে দেখতে আমার একদিনও বাদ যায় না। দিনদিন গুরুজি উজ্জ্বল হচ্ছেন। লাবণ্য ঠিকরে বের হচ্ছে। একদিন উনি সাজছিলেন রাজার মতো সাজ। কোথায় যেন অনুষ্ঠান আছে। সেজেগুজে গাড়িতে চড়লেন। হতে অসংখ্য পাথরের আংটি ঝলসে উঠছে। কিন্তু সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তাকে মণিহারা ফণীর মতো লাগছিল। মণি হল রানি, যা ছাড়া রাজাকে মানায় না। কাবেরী ছিল না। কিন্তু কাবেরীকে ওঁর পাশে ঠিক মানায় না। তাই আমি নিজের মনে কেবলই রূপকথা বানাতাম। সব রাজা রানির গল্প। তাদের অসাধারণ প্রেমকাহিনী। মনে হত এরকম একজন পুরুষকে ভালবাসার জন্যই আমার এতদিনের কুমারিত্ব সার্থক।

আমার বোনের কাজকর্ম মিটলে সে কাবেরীর জন্য বড় উতলা হল। ছাতে ওঠে না, রাস্তায় ঘোরে না, মেয়ের হল কী ! আমাদের ধারণা ও কানপুর গেছে। কিন্তু বোন তো ছাড়ার পাত্র নয়। একদিন ওদের বাড়ি গিয়ে কলিংবেল টিপল। বাড়ির নিত্যসময়ের কাজের মেয়েটি জানলা খুলে উঁকি দিয়ে জানাল বউদি বাড়ি নেই। কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলল, কী জানি। নাছোড়বান্দা বোন সাহসে ভর করে গুরুজিকে ডাকতে চাইল। গুরুজি নীচে নেমে যার-তার সঙ্গে দেখা করেন না। বোন দমে গেল, গুরুজিকে গালাগাল দিতে লাগল। ছোটলোক, অমানুষ, আরও মুখে আনার অযোগ্য সব ভাষা। আমি গুরুর গর্বে গর্বিণী। আমি ভাবলাম, উনি কি যেমন তেমন মানুষ যে, যে-কেউ ডাকবে আর উনি হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। তবে আমার বোন নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে সত্যি কাবেরী বাড়ি নেই।

এর কদিন পর তখনও পূর্ব দিকে ভাল করে আলো ফোটেনি। গুরুর নৃত্যদর্শনের আশায় আমি সাততাড়াতাড়ি উঠি, তখনও সেসময় আসেনি। কেন কে জানে, আমি বিছানা ছেড়ে উঠব উঠব ভাবছি। আর আমার বোন ঘুমে কাদা। একটা চিৎকার আমাকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। চিৎকারটা যেন রাতের কুকুরের কান্নার মতো একবার হয়েই হাওয়ায় মিশে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কী? আমাদের পাড়া শান্তশিষ্ট। তার মধ্যে অদ্ভুত ধরনের আঁ আঁ আওয়াজ। আমি আওয়াজ ধরে যেখানে পৌঁছালাম সেটা গুরুজির বাড়ি। গেট খোলা, দরজার বাইরে গুরুজির গাড়ি। আমার একটু সংকোচ হল। তারপর সেই ভোরের স্তব্ধতাকে কেটে কেটে তীক্ষ্ণ আওয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গুরু বসে আছেন মাথা নিচু করে। সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা শরীর, লাশ। কাবেরীর ভাইয়ের সেই পশুর মতো কান্না। আমাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল। কী করে সব শেষ হয়ে গেল, দিদি।

আমি টলতে টলতে বাইরে এলাম। কী জানি ভেতরে কে আছে। মুখ পর্যন্ত ঢাকা। আমার মনে হল চাদর খুললে বুঝি কাবেরী বের হবে না, অন্য কেউ বের হবে। আমার বোধহয় খুব প্রিয়জন কেউ-যেমন আমার বোন।

চারদিকে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কেননা গুরুর ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে হাজির হচ্ছিল। গেটের কাছে যেতেই সেই ছাত্রীকে দেখলাম, যে ডিভোর্সের গল্প শুনিয়েছিল। পরিচিতির হাসি হাসল ছাত্রীটি। তারপর বলল, এরকম বোকামো কেউ করে বলুন তো। শিক্ষিত শিক্ষিত লোকজন। বউটা নাকি পি এইচ ডি-ও করেছিল। জাস্ট মাস দুয়েক কনসিভ করেছিল। গুরুজি চাইলেন না। বাইরে ভাল জায়গায় গিয়ে অ্যাবরশনও করালেন না। এত বড় মানী লোকের নাকি মান যাবে। সবাই তো ওঁকে চেনে।

কাউকে জানতে দেননি, জানেন। কাজের লোকের কাছে সব শুনলাম। তা আমাদেরকে একবার বললেও তো হত। পাশে তো আপনারাও আছেন। কোন এক উল্টোপাল্টা মহিলাকে ডেকে নাকি করিয়েছেন। ইনফেকশন হয়ে গেছে। যত সব আনসায়েন্টিফিক ব্যাপার। শেষরক্ষা করতে না পেরে নার্সিংহোমে দিয়েছিলেন। তা মহিলাকে বলা, তুই রাজি হলি কেন? তুই কি এর ফল জানতিস না!

গুরুর ঘর ছাত্রছাত্রীতে ভর্তি। সাত-তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও পাকা। গুরু আমার সঙ্গে আলোচনারত ছাত্রীকে ডেকে বললেন, দেখো তো কোথাও সাদা ফুলটুল পাও কিনা, একটু দিয়ে দাও।

ছাত্রীটি আমাকে টানল। চলুন, আপনাদের বাগানে কাঠচাঁপা আছে না, দুটি ফুল নিয়ে আসি চলুন। ওর পিছুপিছু আমি চললাম। গেট খুললাম। গাছের তলায় দাঁড়ালাম। গাছের দিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে দেখলাম, ও কী, সব ফুল লাল কেন? রক্তবর্ণ সব টকটক করছে। মেয়েটা তার নৃত্যকুশলী একটা পা গাছেরগুঁ রেখে, আর একটা পা শূন্যে ভাসিয়ে পটাপট সেই লাল ফুল তুলতে লাগল। আমি দেখলাম ছেঁড়া ফুলের ডাঁটি থেকে সাদা রক্ত কাঠচাঁপার গা বেয়ে আমার দিকে গড়িয়ে নেমে আসছে।
 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ