ভাষান্তর: উৎপল দাশগুপ্ত
নভেম্বরের মাঝামাঝি এক মধ্যাহ্নে সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে ভুট্টা সেদ্ধ, শুকনো হাকলবেরি আর জোয়ার মিশিয়ে ম্যামির তৈরি করা ডেজ়ার্টের অবশেষ খাচ্ছিল। বাতাসে একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব –বছরের প্রথম শীতল দিন। পোর্ট স্কারলেটের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুটা উল্লসিত হয়ে হাত ঘসতে ঘসতে জিজ্ঞেস করল, “এবার কি একটা শুয়োর মারার সময় হয়ে গেল ম্যাম?”
স্কারলেট একটু হেসে বলল, “বুঝেছি, তোমার শুয়োরের নাড়িভুড়ি খাবার ইচ্ছে হয়েছে! বেশ, আমারও টাটকা পোর্ক খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। যদি আবহাওয়া কদিন এরকমই থাকে, তাহলে – ”
মেলানি মাঝপথে বাধা দিল। চামচটা মুখের সামনে ধরা। “ওই শোনো! কেউ এল মনে হচ্ছে!”
“একটা চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি যেন,” পোর্কের গলায় অস্বস্তি।
হেমন্তের ঝিরঝিরে বাতাসের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ভীত সন্ত্রস্তভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে কেউ আসছে! একজন মহিলার ভয়ার্ত চিৎকার, “স্কারলেট! স্কারলেট!”
কয়েক মুহুর্তের জন্য ভয়ে ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর চেয়ার ঠেলে সবাই উঠে পড়ল। আওয়াজ শুনে ভয় পেলেও ওটা যে স্যালি ফোনটেনের গলার আওয়াজ সেটা সবাই চিনতে পেরেছিল। মাত্র এক ঘন্টা আগে জোনসবোরো যাবার পথে স্যালি অল্প সময়ের জন্য এখানে থেমে একটু আড্ডা মেরে গেছিল।তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় চলে সকলে মিলে। স্যালি জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের বাড়িতে আসছে। হাওয়ায় ওর চুল উড়ছে। বনেটটা মাথার একপাশে কাত হয়ে পড়েছে। ঘোড়াটার মুখ থেকে ফেনা ঝরছে। ঘোড়া থামাল না। যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে পাগলের মত আঙুল তুলে দেখাল।
“ইয়াঙ্কিরা আসছে! আমি ওদের দেখলাম! ওই রাস্তা ধরে আসছে! ইয়াঙ্কিরা – ”
সিঁড়ির ধাপে ধাক্কা খাওয়ার আগেই স্যালি কোনও মতে ঘোড়াটা ঘুরিয়ে নিয়ে একটা চার ফুট উঁচু হেজের বেড়া একজন শিকারির মত টপকে ক্যাবিন কোয়ার্টারের ধার ঘেঁসে মিমোসার রাস্তা ধরল।
কিছুক্ষণ সকলেই একেবারে হতভম্ব। স্যুয়েলেন আর ক্যারীন দুজনের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করল। ছোট্ট ওয়েড স্থানুর মত দাঁড়িয়ে। আতঙ্কে কাঁদতেও ভুলে গেছে। অ্যাটলান্টা থেকে তাড়া করে আসা আতঙ্ক এবার সত্যি হতে চলেছে? ইয়াঙ্কিরা ওকে ধরে নিয়ে যাবে!
জেরাল্ড অস্পষ্টভাবে বললেন, “ইয়াঙ্কিরা? কিন্তু ওরা তো এখানে আগেই এসেছিল।”
“হে ভগবান!” স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। মেলানির ভয়ার্ত চোখে ওর চোখ পড়ল। মুহুর্তের জন্য অ্যাটলান্টার শেষ রাতের আতঙ্কের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারি সারি বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। অত্যাচার,ধর্ষণ আর খুনের গল্প। ইয়াঙ্কি সৈন্য এলেনের সেলাইয়ের বাক্স হাতে হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছবি। প্রচণ্ড হতাশায় মনে মনে ভাবল, “মরেই যাব এবার! এখানেই আমাকে মরতে হবে! ভেবেছিলাম আতঙ্কের দিন চুকেবুকে গেছে। আমি মরেই যাব! আর সহ্য করতে পারছি না!”
“লাগাম দেওয়া ঘোড়াটার দিকে চোখ পড়ল। টার্লটনদের বাড়ি কিছু কাজ নিয়ে পোর্কের যাবার কথা। ওর ঘোড়া! ইয়াঙ্কিরা ওটা নিয়ে চলে যাবে! গরু আর বাছুরও নিয়ে চলে যাবে! আর ওই মা শুয়োর ওর বাচ্চাদেরও! কত পরিশ্রম করে ওগুলোকে ধরা হয়েছে! মোরগটা আর মুরগি আর হাঁসগুলোও নিয়ে যাবে! ফোনটেনরা ওগুলো দিয়েছিল! আর আপেল, কন্দমূল, বীনস। ময়দা, চাল, শুকনো মটরশুঁটি। ইয়াঙ্কি সৈন্যের সেই টাকার ব্যাগটাও! সব নিয়ে যাবে ওরা! আর ওদের উপোস করে মরতে হবে!
“ওরা ওসব নিতে পারবে না!” স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ভাবল হতাশায় ওর মাথা কাজ করছে না। “আমি আর উপোস করতে পারব না! ওরা ওসব কিচ্ছু নিতে পারবে না!”
“কী সব, স্কারলেট? কী নিতে পারবে না?”
“ঘোড়া! গরু! শুয়োর! ওরা নিয়ে যেতে পারবে না! আমি কিছুতেই ওদের নিয়ে যেতে দেব না!”
ক্ষিপ্রগতিতে চার নীগ্রোর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা দরজার সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। কালো কালো মুখগুলো ভয়ে ছাইয়ের মত সাদা।
“ওই জলার ধারে!” দ্রুত বলে উঠল।
“কোন জলা?”
“আরে বোকা, নদীর ধারের জলা! শুয়োরগুলো ওখানে নিয়ে যাও। সবাই যাও! এখুনি! পোর্ক, তুমি আর প্রিসি গুঁড়ি মেরে শুয়োরগুলো নিয়ে বেরিয়ে যাও! আর স্যুয়েলেন – আর ক্যারীন – তোরা ঝুড়ি ভরে যতটা পারিস খাবার জিনিস ভরে নিয়ে জঙ্গলে চলে যা। ম্যামি রুপোর বাসনপত্র আবার কুয়োতে ডুবিয়ে দাও। পোর্ক! প্রিসি! ওরকম থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকো না! বাপীকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। কোথায় যেতে হবে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না! যেখানে নিয়ে যেতে পারো। বাপী, লক্ষ্মী বাপী, তুমি পোর্কের সঙ্গে যাও।”
মনের এরকম অবস্থার মধ্যেও ও বুঝে গেছিল ওই নীল কোটগুলো বাপীর মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে কী ভাবে কাজে লাগাতে পারে। এত কথা বলে চুপ করে হাত কচলাতে লাগল। মেলানির স্কার্ট ধরে ওয়েডের ভয় পাওয়া কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে ওর আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল।
“আমি কী করতে পারি, স্কারলেট?” মেলানি শান্ত গলায় জানতে চাইল, যখন চারপাশে সবাই হাহুতাশ করে চলেছে। ওর শরীর কাঁপছে, মুখটাও ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। তবুও ওর শান্ত গলা শুনে স্কারলেট নিজেকে একটু সামলে নিতে পারল। সবাই ওর মুখের পানে তাকিয়ে আছে, নির্দেশের জন্য, পথ দেখানোর জন্য।
“গরু আর বাছুর,” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলে উঠল। “ওগুলো পুরোনো চারণভূমিতে আছে। ঘোড়াটা নিয়ে যাও আর ওদের জলাভুমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে …”
কথা শেষ হবার আগেই, মেলানি ওয়েডের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের সিঁড়ি বেয়ে ঘোড়ার দিকে দৌড়ে চলে গেল। যেতে যেতে স্কার্টটা সামলে নিল। স্কারলেট ওর রোগা রোগা পাগুলো দেখল, স্কার্টটার হাওয়া লেগে পতপত করা লক্ষ্য করল আর তারপরেই দেখল মেলানি ঘোড়ার ওপর উঠে পড়েছে। পাদানি পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে ওর পা ঝুলে রয়েছে। ঘোড়ার পেটের কাছে গোড়ালি দিয়ে আঘাত করার পরেই ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে উঠল।
“আমার বাচ্চা! ওকে আমাকে দিয়ে দাও! ইয়াঙ্কিরা ওকে মেরে ফেলবে!”
ও ঘোড়া ছোটানোর জন্য তৈরি হয়েই আছে। স্কারলেট চেঁচিয়ে বলল, “তুমি চলে যাও! গরুটাকেও নিয়ে যেও। আমি কথা দিচ্ছি তোমার ছেলেকে আমি দেখব। তুমি কী ভাব যে অ্যাশলের ছেলেকে ওদের নিয়ে যেতে দেব? যাও আর দেরি কোরো না!”
মেলানি একবার হতাশ চোখে পেছনের দিকে তাকাল, তারপর গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে আঘাত করে গোচারণভূমির দিকে চলে গেল।
স্কারলেট ভাবল, “মেলানি হ্যামিলটন ঘোড়ার দুদিকে পা করে বসবে এটা আমি কখনও ভাবিনি!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওয়েড ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে, ওর স্কার্ট ধরার চেষ্টা করছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তিনজনকে দেখতে পেল। স্যুয়েলেন আর ক্যারীন দুটো ঝুড়ি হাতে রান্নাঘরের দিকে দৌড়াচ্ছে। পোর্ক জেরাল্ডকে ধরে পেছনের উঠোনের দিকে এগোচ্ছে। যদিও ধরার ভঙ্গীতে কমনীয়তার ছোঁয়া আছে বলা যাবে না। জেরাল্ড ছেলেমানুষের মত রাগ করে বিড়িবিড় করে কিছু বলতে বলতে চলেছেন।
পেছনের উঠোন থেকে ম্যামির খড়খড়ে গলা শোনা গেল, “এই প্রিসি জালির তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ওই বাসনপত্রগুলো বের করে দে। তুই ভাল করেই জানিস, এই বিশাল শরীর নিয়ে আমি তলা থেকে ওগুলো বের করতে পারব না! ডিলসি এসে এই অপদার্থ মেয়েটাকে …”
“আর আমি কিনা ভাবছিলাম শুয়োরগুলোকে খোঁয়াড়ে রাখলেই কেউ চুরি করতে পারবে না!” স্কারলেট নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে ভাবল। “কেন যে ওই জলার মাঝেই ওদের জন্য খোঁয়াড় তৈরি করলাম না?”
টেবিলের ওপরের ড্রয়ারটা টেনে খুলে হাতড়ে হাতড়ে কাপড়ের তলা থেকে ইয়াঙ্কির সেই ওয়ালেটটা বের করে নিল। সলিটেয়ার আঙটি আর হীরের তৈরি কানের দুলও লুকিয়ে রাখা সেলাইয়ের বাক্স থেকে বের করে ফেলে ওয়ালেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু এগুলো কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? তোশকের তলায়? চিমনির ভেতরে? কুয়োয় ফেলে দেবে? বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখবে? না ওখানে নয়। ইয়াঙ্কিরা ঠিক বুঝে যাবে ওখানে কিছু লুকোনো আছে। তখন ওকে উলঙ্গ করে তল্লাশি করবে।
“তাই যদি করে তো মরেই যাব!” উদ্ভ্রান্তের মত ভাবতে লাগল।
নীচের তলা থেকে ছোটাছুটির আর কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াহুড়োর মধ্যেও মেলানির কথা মনে হল। এখন পাশে থাকলে মনে জোর পাওয়া যেত। যেদিন ইয়াঙ্কিটাকে খুন করল সেদিন মেলির সাহস দেখে ও অবাক হয়ে গেছিল। মেলি একাই ওদের তিনজনের সমান! ও হ্যাঁ, কী যেন বলেছিল মেলি – মনে পড়েছে – ওর বাচ্চার কথা!
ওয়ালেটটা হাতে ধরেই হল পেরিয়ে যে ঘরে বিউ একটা নীচু দোলনায় ঘুমোচ্ছে সেখানে চলে এল। ওকে কোলে তুলে নিতেই বিউ জেগে উঠল। ওর মুখ থেকে টস টস করে লাল গড়িয়ে পড়ল।
শুনতে পেল স্যুয়েলেন অধৈর্য গলায় বলছে, “চলে আয় ক্যারীন – চলে আয়! অনেকটাই নেওয়া হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি চল বোন!” পেছনের উঠোন থেকে জানোয়ারদের চীৎকার, ক্ষোভ আর দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। তুলোর খেতের ভেতর দিয়ে দুটো শুয়োরছানাকে বগলদাবা করে ম্যামি জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছে। দুটো শুয়োর নিয়ে পোর্কও ওর পেছন পেছন যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে জেরাল্ডকেও ঠেলে নিয়ে চলেছে।
জানলা থেকে ঝুঁকে পড়ে স্কারলেট চেঁচিয়ে বলল, “ডিলসি মা শুয়োরটাকে নিয়ে যাও। প্রিসিকে বল, ওটাকে বের করে দেবে। তারপর ওটা তুমি তাড়িয়ে মাঠের ওদিকে নিয়ে যাও!”
ডিলসি নাকাল মুখে স্কারলেটের দিকে তাকাল। অ্যাপ্রন ভরে এক রাশ রুপোর বাসনপত্র। বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “প্রিসি মা শুয়োরটাকে বাড়ির তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।”
“শুয়োরটার ব্যবস্থাটা ঠিকই হয়েছে,” ভাবল স্কারলেট। তারপর দ্রুতপায়ে ঘরে ফিরে এসে ইয়াঙ্কির কাছে থেক পাওয়া ব্রেসলেট, ব্রুচ, পেয়ালা এবং অন্য সব জিনিসপত্র লুকোনো জায়গা থেকে বের করে এক জায়গায় রাখল। কিন্তু কোথায় লুকোবে এগুলো? এক হাতে বিউকে নিয়ে অন্য হাতে এত জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ওকে আবার বিছানায় শোয়াতে গেল।
কোল থেকে নামাতে যেতেই বাচ্চাটা কেঁদে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা সম্ভাবনার কথা ওর মনে এসে গেল। বাচ্চার ডায়াপারের থেকে ভাল লুকোনোর জায়গা আর কী হতে পারে? তাড়াতাড়ি বাচ্চাটার পোশাক তুলে ওর ডায়াপারের পেছনদিকে ওয়ালেটটা চালান করে দিল। এতে বাচ্চাটা আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল। ওর দুপায়ের মাঝখান দিয়ে তিনকোনা কাপড়টা টাইট করে বেঁধে দিল।
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে ভাবল, “এবারে জলাতে যেতে হবে!”
বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। এক হাত দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। অন্য হাতে গয়নাগাটি সামলে ওপর তলার হলের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে না! ভয়ে ওর হাঁটু কাঁপতে লাগল। তবে কি ওরা ওকে একা ফেলেই চলে গেছে? ওকে একা ফেলে চলে যাবার কথা ও তো বলেনি! খালি বাড়িতে – একলা মেয়েমানুষ – আর ইয়াঙ্কিরা আসছে – যা কিছু হয়ে যেতে পারে …”
একটা হালকা আওয়াজ পেয়ে ও একেবারে চমকে উঠল। ঘুরে গিয়ে দেখল ওর ছেলে একটা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখে ত্রাস। কিছু বলবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না।
“চলে এস, ওয়েড হ্যাম্পটন,” আদেশের সুরে বলল। “ আমার পায়ে পায়ে চলে এস। অনেক বড় হয়ে গেছ। মা তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারবে না!”
ছেলেটা দৌড়ে ওর কাছে চলে এল, আতঙ্কতাড়িত এক পশুর মত।স্কার্টটা হাতের মুঠো দিয়ে আঁকড়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল। ওর ছোট ছোট হাতের স্পর্শ স্কার্টের ভাঁজের মধ্য ওর পায়ে কাছে অনুভব করল। ওয়েডের আঁকড়ে ধরায় ওর চলায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল। রেগে গিয়ে বলল, “আমাকে ছেড়ে দাও, ওয়েড। আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে হাঁটো!” ছেলেটা উলটে আরও ঘেঁসে এল।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিরপরিচিত আসবাবপত্রগুলো নজরে এল। কত প্রিয় মুহুর্তের স্মৃতি জড়িয়ে আছে! ওরা যেন কানে কানে বলতে লাগল, “ বিদায়! বিদায়!” গলা ঠেলে কান্না উঠে আসল। এলেনের অফিস – যেখানে বসে এলেন দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতেন – দরজাটা খোলা। পরিচিত পুরোনো টেবিলটা দেখতে পেল। ডাইনিং টেবিলের আশেপাশে চেয়ারগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। প্লেটে এখনও কিছু অভুক্ত খাবার পড়ে আছে। মেঝেতে পাতা এলেনের নিজের হাতে বোনা আর রঙ করা শতছিন্ন কার্পেট। রোবিল্যার দাদুর পোর্ট্রেটটা ঝুলছে। বুকখোলা পোশাকে, চুল উঁচু করে আঁচড়ানো, চোখের ভাষায় আভিজাত্যের তাচ্ছিল্য। সবাই ওর কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “ বিদায় স্কারলেট! বিদায়!”
ইয়াঙ্কিরা এগুলো সব পুড়িয়ে দেবে – সব!
শেষবারের মত বাড়িটা দেখে নিল। আবার দেখতে পাবে বনের ভেতর থেকে। আগুনের শিখায় বাড়িটা জ্বলে যাচ্ছে। চিমনির ভেতর দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ছে।
“আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না!” ভাবতে ভাবতে ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল। “না আমি কিছুতেই তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না। বাপি কখনওই তোমাদের ছেড়ে যেতে পারতেন না। উনি বলেছিলেন, যদি জ্বালিয়ে দিতেই হয় তাহলে ওঁকে নিয়েই জ্বালাতে হবে। আমাকেও তোমাদের সঙ্গেই জ্বালিয়ে দিতে হবে। আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না! কিছুতেই না! তোমরা ছাড়া আর আমার কী আছে!”
সিদ্ধান্তটা নেবার পরেই ওর ভয় অনেকটাই কমে গেল। শুধু বুকের মধ্যে একটা জমাট বাধা অনুভূতি যা আশা আর আশঙ্কা সব কিছুর ঊর্ধে। অনেক ঘোড়ার সম্মিলিত খুরের আওয়াজ কানে এল। রাস্তার বাঁক থেকে। লাগামের আর তরবারির ঝনৎকার, আর আদেশ, “নেমে পড়!” ওয়েডের দিকে ঝুঁকে পড়ে খুব কোমল স্বরে বলল, আমাকে একটু ছাড় সোনা! তারপর তুমি পেছনের দরজা দিয়ে জলার দিকে দৌড়ে চলে যাও। ম্যামি থাকবে ওখানে। তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাও! একদম ভয় পেয়ো না, লক্ষ্মীটি!”
মায়ের কোমল গলা শুনে ওয়েড চোখ তুলে মাকে দেখল। ছেলেটার করুণ ভয়ার্ত মুখ দেখে স্কারলেটের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল।
“হে ভগবান,” ও প্রার্থনা করতে লাগল। ছেলেটা যেন ভয়ে মূর্চ্ছা না যায় – অন্তত ইয়াঙ্কিদের সামনে! কিছুতেই ওদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমরা ভয় পেয়েছি! হারামজাদার দল!”
নীচে নেমে গেল ওদের মুখোমুখি হতে।
অ্যাটলান্টা থেকে জর্জিয়া হয়ে শেরম্যান সৈন্যবাহিনী নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জনপদের পর জনপদকে লুন্ঠন করে, শত শত নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে। প্রায় তিনশ মাইল অঞ্চল অরক্ষিত। মাইলের পর মাইল জুড়ে প্ল্যান্টেশন। মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অতিবৃদ্ধদের বাস। স্থানীয় বাহিনী আর হোমগার্ডদের ওপর ভরসা করে। অনেক জায়গায় সেটুকুও নেই। সামনের হলে নীল কোটদের ঢুকতে দেখে স্কারলেট ভুলেই গেল যে ইয়াঙ্কিরা প্রত্যেক শহর, শহরতলী আর গ্রামেই এই বহ্ন্যুৎসবে মেতেছে। ওর মনে হল ওদের এই উৎপীড়নের মূল লক্ষ্য হল ও নিজে। যেন এটা ইয়াঙ্কিদের ওর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ।
সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে স্কারলেট। কোলে মেলানির বাচ্চা। ওয়েড ওর স্কার্টে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। ইয়াঙ্কিরা দঙ্গল বেঁধে বাড়িতে প্রবেশ করল। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওপর উঠে আসবাবপত্র টেনে এনে বাইরের উঠোনে জমা করতে লাগল। ছুরি আর বেয়নেট দিয়ে পর্দাগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিতে থাকল। আলমারি আর ড্রয়ার টেনে খুলে ফেলে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান জিনিসপত্রের অনুসন্ধান করতে লাগল। ওপর তলায় গদি তোষক বালিশ ছিঁড়েখুঁড়ে খোঁজ চালাতে লাগল। ঘরের বাতাস পালক তুলো আর ধুলোয় ভারি হয়ে উঠল। স্কারলেটের মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল। ভয়ের লেশমাত্র আর অবশিষ্ট রইল না। অসহায়ভাবে ওদের বেপরোয়া দাপাদাপি দেখতে লাগল।
ওদের সার্জেন্ট বেঁটেখাটো, পলিতকেশ একটা লোক। মুখে একদলা তামাক চিবোচ্ছে। অন্যদের আগেই ও স্কারলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একদলা থুতু পিচ করে মেঝের ওপর ফেলল। খানিকটা স্কারলেটের স্কার্টের ওপরও এসে পড়ল। বলল,
“তোমার হাতে যা আছে আমাকে দিয়ে দাও মিস।”
হাতের কবচটা লুকিয়ে ফেলতে ভুলে গেছিল। ওটা খুলে নিয়ে অবজ্ঞার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে লোকটার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিল।ওটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝন্ করে আওয়াজ তুলল। মুখের ভাবে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল – যা প্রায় দাদু রোবিল্যারের ছবিতে আঁকা তাচ্ছিল্যেরই সমতুল।
“ওই কানের দুল আর আঙটিটাও খুলে দিলে ভাল হয়।”
স্কারলেট বাচ্চাকে নিজের বাহুতে শক্ত করে ধরল, যাতে ওর মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে থাকে। ও কেঁদে অস্থির হয়ে উঠল। কান থেকে গারনেটের দুলদুটো খুলে ফেলল। জেরাল্ড বিয়ের পর এলেনকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর হাত থেকে চার্লসের দেওয়া বাকদানের আংটিটাও খুলে ফেলল।
“ওগুলো ছুঁড়ে ফেল না। আমার হাতে দাও,” হাত বাড়িয়ে সার্জেন্ট বলল। “ওই বেজন্মাগুলো আগেই অনেক কিছু সরিয়ে নিয়েছে। আর কী আছে?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর বুকের ওপর এসে স্থির হল।
এক মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের মনে হল ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। এই হারামজাদা কি ওর শরীরে হাত দিয়ে তল্লাশি করবে নাকি?
“এই যা আছে। নাকি শিকারকে বিবস্ত্র করেও তল্লাশি চালানো আপনাদের প্রথা!”
“ঠিক আছে, তোমার কথাই বিশ্বাস করলাম,” লোকটা ভালমানুষের মত মুখ করে বলল। তারপর আবার একদলা থুতু ফেলে অন্যদিকে চলে গেল। স্কারলেট বাচ্চাটাকে ঠিকমত নিয়ে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাত দিয়ে ডায়াপারটা ঢেকে রাখল, যেখানে ও ওয়ালেটটা লুকিয়ে রেখেছিল। মনে মনে ঈশ্বরকে মেলানির বাচ্চা আর তার ডায়াপার থাকার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা জানাল। ওপরের ঘরে মূল্যবান কিছু না খুঁজে পেয়ে লোকগুলো অশ্রাব্য গালাগালি করতে লাগল। বাইরে থেকে হাঁস আর মুরগির কোলাহল ভেসে আসছে। “ওগুলোকে উড়িয়ে দাও। একটাও ছেড়ে দিও না!” একটা মর্মান্তিক চিৎকার – তারপর গুলি চলবার আওয়াজ – স্কারলেটের বুক কেঁপে উঠল। মা শুয়োরটাকে মেরে ফেলল! হারামজাদা প্রিসি! ওটাকে ফেলে রেখেই নিজে পালিয়ে গেছে। বাচ্চা শুয়োরগুলোর কী অবস্থা কে জানে! পরিবারের বাকি সবাই জলার ধারে নিরাপদে পৌঁছতে পেরেছে তো? জানার কোনও উপায় নেই!
হই হল্লা আর গালাগালি করতে করতে সৈন্যগুলো ঘরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। স্কারলেট চুপ করে হলে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে ওয়েড ওর স্কার্টটা শক্ত মুঠোয় ধরে আছে।ওর ছোট্ট শরীরটা ওর সঙ্গে সেঁটে আছে। বুঝতে পারছিল ও ভয়ে কাঁপছে। ভয়টা ভাঙানোর জন্য কথা বলা দরকার। কিন্তু স্কারলেট মনের জোর পেল না। ইয়াঙ্কিদেরও কিছু বলে উঠতে পারল না। কাকুতি মিনতি, প্রতিবাদ বা রাগ দেখানো, কিছুই। ঈশ্বর যে ওর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু কেড়ে নেননি, মাথা উঁচু করে রাখার মত মনের জোর রাখতে দিয়েছে, সে জন্য মনে মনে বারবার তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। তবু ওপর থেকে একদল দাড়িওয়ালা লোক চোরাই মালগুলো ধরাধরি করে নামাচ্ছিল, তাদের একজনের হাতে চার্লসের তরবারিটা দেখতে পেয়ে ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
তরবারিটা ওয়েডের। আগে ওটা ওর বাবার ছিল। তার আগে ওর ঠাকুর্দার। গত জন্মদিনে স্কারলেট ওটা ওয়েডকে উপহার দিয়েছিল। বেশ একটা অনুষ্ঠান করে। মেলানি কেঁদে ফেলেছিল। গর্ব আর দুঃখের স্মৃতিতে। ওকে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিল যেন ওয়েড ওর বাপ ঠাকুর্দার মত বীর হয়। তরবারিটা পেয়ে ওয়েডের খুব গর্ব হয়েছিল। মাঝে মাঝে টেবিলের ওপরে উঠে ওটার গায়ে হাত বোলাতো। নিজের জিনিস লুট হয়ে যাওয়াটাও স্কারলেটে সহ্য করে নিয়েছিল, কিন্তু ওর শিশুপুত্রের গর্বের সম্পত্তি এই চোরদের নিয়ে যাওয়াটা আর ও মেনে নিতে পারল না। স্কার্টের ফাঁক দিয়ে তরবারিটা দেখতে পেয়ে ওয়েডের গলায় আওয়াজ ফিরে এল। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“ওটা আমার!”
স্কারলেটও হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, “ওটা আপনারা নিয়ে যেতে পারবেন না!”
“হেঁ হেঁ তাই নাকি?” নির্লজ্জভাবে হেসে যে লোকটার হাতে তরবারিটা ছিল, সে বলল। “নিশ্চয়ই পারি! এটা এক বিদ্রোহীর তরবারি!”
“না – মোটেই না! এটা মেক্সিকোর যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে! ওটা আপনি নিতে পারেন না! ওটা আমার ছেলের। ওটা ওর ঠাকুর্দার ছিল! ওহ্ ক্যাপটেন,” সার্জেন্টের দিকে ঘুরে গিয়ে স্কারলেট মিনতি করল, “ওই তরবারিটা আমাকে দিয়ে দিতে বলুন!”
প্রোমোশন পেয়ে সার্জেন্ট মনে মনে ভারি খুশি হয়ে এগিয়ে এল।
“দেখি বাব্, ওটা আমার হাতে দাও।”
অনিচ্ছা সহকারে প্রাইভেট সৈন্যটা তরবারিটা ওর হাতে দিয়ে দিল। বলল, ওটার বাঁটটা খাঁটি সোনার তৈরি।
সার্জেন্ট ওট হাতে নিয়ে বাঁটটা সূর্যের আলোর দিকে তুলে ধরে খোদাই করাটা লেখাটা পড়তে লাগল।
“কর্নেল উইলিয়াম আর হ্যামিল্টনকে,” লোকটা মর্মোদ্ধার করল।অসমসাহসিকতার জন্য, তাঁর বাহিনীর কর্ত্তৃক প্রদত্ত হল। বুয়েনা ভিস্তা। ১৮৪৭।”
“মহাশয়া, বুয়েনা ভিস্তায় আমি নিজেও ছিলাম!” লোকটা বলল।
“তাই নাকি?” খুব শীতল গলায় স্কারলেট বলল।
“ছিলামই তো! কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, বলছি আপনাকে! এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আর কখনও দেখিনি! এই তরবারি এই বাচ্চাটার ঠাকুর্দার, তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“ওটা ও রাখতে পারে,” জুয়েলারি আর তাবিজ রুমালে বেঁধে নিতে পেরে সার্জেন্ট বেশ খুশিই হয়েছে বোঝা গেল।
“ওর বাঁটটা যে খাঁটি সোনার!” প্রাইভেটটা বোঝানোর চেষ্টা করল।
“আমাদের কথা মনে রাখবার জন্য, ওটা আমরা রেখে যাব,” সার্জেন্ট মৃদু হাসল।
স্কারলেট তরবারিটা নিল। ধন্যবাদ দেবার কথা মুখেও আনল না। এই সব চোরদের অযথা ধন্যবাদ দিতে যাবেই বা কেন? ওরই সম্পত্তি ওকেই ফেরত দিচ্ছে, ধন্যবাদ কেন দিতে যাবে! তরবারিটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। ওদিকে প্রাইভেটটা সার্জেন্টের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে শুরু করল।
“এই বিদ্রোহীগুলোকে এমন শিক্ষা দেব না – দেখাচ্ছি – দাঁড়াও!” প্রাইভেটটা চেঁচিয়ে বলল। সার্জেন্টটা তখন রেগে গিয়ে লোকটাকে গালি দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেছে। লোকটা দাপাতে দাপাতে বাড়ির পেছনের দিকে চলে যেতেই স্কারলেট একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বাড়িটা পুড়িয়ে দেবার কথা অন্তত ওরা বলেনি। তাহলে তো ওদের বের হয়ে যেতে বলত, যাতে আগুন লাগাতে পারে! হয়ত – হয়ত – ওপর থেকে লোকগুলো এলোমেলোভাবে নীচে নেমে এসে বাড়ির বাইরে চলে গেল।
“আর কিছু নেবার আছে?” সার্জেন্টটা জিজ্ঞেস করল।
“একটা শুয়োর আর কয়েকটা হাঁস আর মুরগি।”
“অল্প কিছু শস্য, কন্দমূল আর বীনস। ওই যে মেয়েটা বুনো বেড়ালের মত ঘোড়ায় চেপে ছুটে এলো না – মনে হয় ওই আমাদের আসার খবরটা দিয়ে দিয়েছে!”
“রেগুলার পল রিভিয়ার, তাই?”
“হ্যাঁ, এখানে আর কিছু পাওয়া যাবে না সার্জেন্ট। মাল পেয়ে গেছেন। আমাদের আসার খবর চাউর হবার আগেই যাওয়া ভাল।”
“স্মোকহাউজ়টা দেখেছো? ওখানে ওরা জিনিসপত্র পুঁতে রাখে অনেক সময়।”
“না কোনও স্মোকহাউজ়ই নেই।”
“নিগারদের ক্যাবিনের মাটি খুঁড়ে দেখে নিয়েছো?”
“তুলো ছাড়া কিছু ছিল না। আগুন ধরিয়ে দিয়েছি।”
মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের গরমে ঘামতে ঘামতে দিনের পর দিন মাঠ থেকে তুলো ওঠানোর স্মৃতি ফিরে এল। সেই কোমরভাঙা খাটুনি। কাঁধে ফোসকা পড়ে যাওয়া। সব পরিশ্রম ধুলোয় মিশে গেল। তুলো জ্বলে গেল।
“তেমন কিছু তোমাদের কাছে পাওয়া গেল না, মিস!”
স্কারলেট শীতল গলায় জবাব দিল, “আপনাদের সৈন্যরা আগেও এখানে এসেছিল।”
“তা অবশ্য সত্যি। এদিকে সেপ্টেম্বরেও আমরা এসেছিলাম,” একজন বলে উঠল। তারপর হাতে রাখা একটা জিনিস দেখাল, “ওহ ভুলে গেছিলাম!”
স্কারলেট দেখল এলেনের সেই সোনার অঙ্গুলিত্র লোকটার হাতে। কতদিন এলেনের হাতে সেলাইয়ের কাজ করার সময় ওটাকে চকচক করতে দেখেছে! সেই ছিপিছিপে হাত যাতে ওটা পরা থাকত, তার স্মৃতি ওর মনে জ্বলজ্বল করে উঠল। সেই জিনিসটা আজ কিনা ওই লোকটার কড়া পড়া নোংরা হাতে ধরা! খুব তাড়াতাড়ি ওটা উত্তরে চলে যাবে, কোনও ইয়াঙ্কি মেয়ের হাতে পরা থাকবে! চুরি করা জিনিস পরে যার খুব গর্ব হবে। এলেনের অঙ্গুলিত্র!
স্কারলেট চোখ নামিয়ে নিল। শত্রুরা যাতে ওর কান্না দেখে না ফেলতে পারে। চোখের জল টপ টপ করে বাচ্চার মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগল। জলে ভেজা ঝাপসা চোখে দেখল লোকগুলো বেরিয়ে গেল। সার্জেন্ট কর্কশ গলায় ওদের আদেশ দিচ্ছে। ওরা চলে যাচ্ছে। টারা আবার নিরাপদ। তবুও এলেনের স্মৃতি ওকে বেদনাতুর করে তুলল। তরবারির ঝনঝন আওয়াজ, অপস্রিয়মাণ ঘোড়ার খুরের শব্দ, দুপাশে গাছের সারির মাঝখানের রাস্তা ধরে ওদের মিলিয়ে যাওয়া, কিছুই ওকে স্বস্তি দিতে পারল না। ওদের প্রত্যেকে চুরি করা মালে বোঝাই হয়ে চলেছে, পোশাক পরিচ্ছদ, কম্বল, ছবি, হাঁস, মুরগি, শুয়োরের বাচ্চা।
হঠাৎ পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পেল। পেছন ফিরল। হয়ত ছুটে গেলে কিছু তুলোর পেটি বাঁচানো যেতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি সংগ্রহ করে উঠতে পারল না। ডাইনিং রুমের খোলা জানলা দিয়ে ধোঁয়া এঁকেবেঁকে ঘরে ঢুকে পড়ছে। নীগ্রো ক্যাবিনগুলো থেকে। সব তুলো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। কর দেবার টাকা থাকল না। প্রবল শীতে লড়াই করার মত সংস্থানও চলে গেল। দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। তুলোর গুদামে আগুন লাগতে আগেও দেখেছে ও। জানে সেই আগুন নেবানো কতটা অসম্ভব, এমনকি অনেকে মিলে হাত লাগালেও। ওই কোয়ার্টারগুলো বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে, এই যা রক্ষে। তেমন হাওয়াও চলছে না, যে আগুনের শিখা টারার ছাদ স্পর্শ করবে।
হঠাৎ কী ভেবে ঘুরে দাঁড়াল। ভয়ার্ত চোখে দেখল হল আর প্যাসেজ ধোঁয়ায় ভরে গেছে। হে ভগবান আগুনটা আসছে রান্নাঘর থেকে!
হল আর রান্নাঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে রাখল। ওয়েডের হাত ছাড়িয়ে ওকে দেওয়ালে ঠেসে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ধোঁয়ায় অন্ধকার রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। পরমুহুর্তেই কাশতে কাশতে বেরিয়ে এল। ধোঁয়া ঢুকে চোখ থেকেও দরদর করে জল বেরোচ্ছে। স্কার্ট দিক্যে নাক ঢেকে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল।
একেবারে অন্ধকার। শুধু একটা ছোট জানলা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। ধোঁয়ার অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আগুন জ্বলার হিস্ হিস্ শব্দ শুধু কানে এল। ভুরু কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল। মেঝের ওপর দিয়ে আগুনের শিখা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন কিছু জ্বলন্ত কাঠের টুকরো ঘরজোড়া খোলা ফায়ারপ্লেসে গুঁজে দিয়ে গেছে। পাইন গাছের তক্তা দিয়ে বানানো মেঝেতে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে – ঠিক জলের মত।
দৌড়ে গিয়ে ডাইনিং রুম থেকে একটা ছেঁড়া কার্পেট তুলে আনল। দুটো চেয়ার শব্দ করে উলটে পড়ল।
“এই আগুন আমি কিছুতেই একা নেভাতে পারব না – কিছুতেই না! হে ভগবান কেউ যদি একটু সাহায্য করার মত থাকত! টারা আর থাকল না! ওহ্, তাহলে বদমাশটা এটাই বলতে চেয়েছিল! যাতে ওকে আমরা মনে রাখতে পারি! ইশ্, শুধু যদি ওকে তরবারিটা দিয়ে দিতাম!
হলঘরে ওর ছেলে তরবারিটা আঁকড়ে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ। মুখে প্রগাঢ় শান্তির ছোঁয়া।
খুব ব্যাকুল হয়ে ভাবল, “হে ভগবান, ও কি মরে গেছে! ওই বদমাশগুলোর ভয়েই ও মরে গেল!” তারপর এক বালতি হাবার জল নিয়ে রান্নাঘরে দৌড়ে গেল। এই জলটা হল থেকে রান্নাঘরে যাবার প্যাসেজে সব সময় আখা থাকে।
কার্পেটটা জলে চুবিয়ে জোরে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ধোঁয়াভরা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। দরজাটা বন্ধ করে দিল। কতক্ষণ ধরে যে কাশতে কাশতে ওই কার্পেট ভিজিয়ে ভিজিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসা আগুনের ওপর দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছে, তা বলতে পারবে না। দু’দুবার ওর স্কার্টের প্রান্তে আগুন লেগে গেছে। হাত দিয়ে চাপড় মেরে নিবিয়েছে। মাথা থেকেও চুলপোড়ার গা গুলোনো গন্ধ আসছে। হাতের ধাক্কায় খোঁপা করে রাখা চুল খুলে গেছিল। আগুনের স্রোত ওকে অতিক্রম করে জ্বলন্ত সাপের মত এঁকেবেঁকে বাইরের দিকে ধাওয়া করছে। শরীর অবসন্ন। ক্রমশ ও নিরাশ হয়ে পড়ছিল।
তারপর সহসা দরজা এক ঝটকায় খুলে গেল। বাইরের থেকে দমকা হাওয়া এসে আগুনের শিখায় প্রাণসঞ্চার করল। দরজা আবার দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল। পুঞ্জিভূত ধোঁয়ার রাশির মধ্যে প্রায় অন্ধ স্কারলেট মেলানিকে দেখতে পেল। আগুনের ওপর দিয়েই হেঁটে মেলানি কালোমতো ভারি একটা কিছু দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগল। ওর টলতে টলতে হাঁটা দেখতে পেল। খুক খুক করে কাশির আওয়াজও কানে এল। ফ্যাকাসে মুখ। চোখ কুঁচকে অবস্থার আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। কার্পেট নিয়ে ওর রুগ্ন শরীরটা আগুপিছু করছে। তারপর আবার যে কতক্ষণ ধরে দুজনে পাশাপাশি বসে আগুন নেভাতে থাকল, তারও আন্দাজ থাকল না। দেখল আগুন আস্তে আস্তে নিবে আসছে। তারপর মেলানি হঠাৎ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠে সজোরে ওর কাঁধে ধাক্কা মারল। ধোঁয়ার রাশি আর অন্ধকারের মধ্যে স্কারলেট পড়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পর দেখল, পেছনের উঠোনে মেলানির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সূর্যাস্তের আলো ওর মুখে এসে পড়ছে।হাত, মুখ আর কাঁধে আগুনে পুড়ে যাওয়ার জ্বালা। কোয়ার্টারগুলো থেকে এখনও ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে। বাতাসে তুলোপোড়ার তীব্র গন্ধ। রান্নাঘর থেকেও পাক খেয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। স্কারলেট ধড়মড় করে উঠতে গেল।
মেলানি ওকে আবার শুইয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “শুয়ে থাক সোনা। আগুন নিভে গেছে।”
চুপচাপ চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকল। কী স্বস্তি! মেলানির বাচ্চার মুখ থেকে লাল গড়িয়ে পড়ার শব্দ। কাছাকাছিই আছে। ওয়েডের হেঁচকি তোলার শব্দ। হে ঈশ্বর অনেক ধন্যবাদ! ও মরে যায়নি। চোখ খুলে মেলানির মুখের পানে চাইল। কোঁকড়া চুলগুলো ঝলসে গেছে। কালিঝুলি লেগে ফর্সা মুখ কালো। শুধু চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। আর ও হাসছে।
“তুমি কি জানো তোমাকে একেবারে নীগ্রোদের মত লাগছে!” অনুচ্চস্বরে স্কারলেট বলল। মেলানির কোলে মাথাটা আরও ঢুকিয়ে দিল।
“আর তোমাকে কি রকম লাগছে জান? কবিগানের লড়াইতে যে লোকটা জিতে যায়, তার মত।” মেলানি ওর কথার খেই ধরে জবাব দিল।
“আমাকে অত জোরে ধাক্কা মারতে হল কেন?”
“তার কারণ, সোনা, তোমার পিঠ আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল। তুমি যে ওভাবে অজ্ঞান হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। তবে ঈশ্বর জানেন, আজ তোমার ওপর দিয়ে যা বয়ে গেছে, তাতে তুমি মরে যেতেও পারতে! সবাইকে জঙ্গলের মধ্যে নিরাপদে রেখেই আমি ফিরে এলাম। বাচ্চা নিয়ে তুমি একলা আছে – আমি তো দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম! আচ্ছা – মানে ইয়াঙ্কিরা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তো?”
“যদি জানতে চাও আমাকে ধর্ষন করেছিল কিনা – না,” যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে স্কারলেট বলল। মেলানির কোল খুবই নরম, কিন্তু যে জায়গায় শুয়ে আছে সেটা একটু এবড়োখেবড়ো। “কিন্তু ওরা সব চুরি করে নিয়ে গেছে – সব কিছু! আমাদের আর কিছুই নেই – খুশি হবার কোনও প্রশ্নই নেই!”
“আছে, স্কারলেট। আমরা একে অপরকে তো হারিয়ে ফেলিনি। আমাদের বাচ্চারাও সুস্থ আছে। মাথার ওপর ছাদ আছে,” মেলানি নরম করে বলল। “আর কী চাই? এই মুহুর্তে … এ – হে বিউ একেবারে ভিজে গেছে! ইয়াঙ্কিরা নিশ্চয়ই ওর বাকি ডায়াপারগুলোও তুলে নিয়ে গেছে? আরে স্কারলেট – ওর ডায়াপারে এগুলো কী রেখেছো?”
ভয় পেয়ে বাচ্চার পিঠের দিকে আঙ্গুল চালিয়ে মেলানি ওয়ালেটটা বের করে আনল। ওয়ালেটটা প্রথমে চিনতেই পারেনি। তারপর মনে পড়তেই এক গাল হেসে ফেলল। শরীরের পরতে পরতে সংযত আনন্দের প্রকাশ।
“এভাবে লুকোনোর কথাটা তুমি ছাড়া আর কারও মাথায়ই আসত না,” বলে স্কারলেটকে দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। “তুমি হলে আমার সব চেয়ে আদরের বোন!”
স্কারলেট ওর বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল না। ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করার মত বল ছিল না। তাছাড়া নিজের প্রশংসা শুনে পরাজিত মনোবল ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রান্নাঘর থেকেই মেলানির প্রতি ওর শ্রদ্ধা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল আর সহযোদ্ধাসুলভ নৈকট্য বোধ করছিল।
কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েও মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল, “এটা তো মানতেই হবে, দরকারের সময় ওকে সর্বদা পাশে পাওয়া যায়।”
মেলানি মাঝপথে বাধা দিল। চামচটা মুখের সামনে ধরা। “ওই শোনো! কেউ এল মনে হচ্ছে!”
“একটা চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি যেন,” পোর্কের গলায় অস্বস্তি।
হেমন্তের ঝিরঝিরে বাতাসের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ভীত সন্ত্রস্তভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে কেউ আসছে! একজন মহিলার ভয়ার্ত চিৎকার, “স্কারলেট! স্কারলেট!”
কয়েক মুহুর্তের জন্য ভয়ে ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর চেয়ার ঠেলে সবাই উঠে পড়ল। আওয়াজ শুনে ভয় পেলেও ওটা যে স্যালি ফোনটেনের গলার আওয়াজ সেটা সবাই চিনতে পেরেছিল। মাত্র এক ঘন্টা আগে জোনসবোরো যাবার পথে স্যালি অল্প সময়ের জন্য এখানে থেমে একটু আড্ডা মেরে গেছিল।তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় চলে সকলে মিলে। স্যালি জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের বাড়িতে আসছে। হাওয়ায় ওর চুল উড়ছে। বনেটটা মাথার একপাশে কাত হয়ে পড়েছে। ঘোড়াটার মুখ থেকে ফেনা ঝরছে। ঘোড়া থামাল না। যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে পাগলের মত আঙুল তুলে দেখাল।
“ইয়াঙ্কিরা আসছে! আমি ওদের দেখলাম! ওই রাস্তা ধরে আসছে! ইয়াঙ্কিরা – ”
সিঁড়ির ধাপে ধাক্কা খাওয়ার আগেই স্যালি কোনও মতে ঘোড়াটা ঘুরিয়ে নিয়ে একটা চার ফুট উঁচু হেজের বেড়া একজন শিকারির মত টপকে ক্যাবিন কোয়ার্টারের ধার ঘেঁসে মিমোসার রাস্তা ধরল।
কিছুক্ষণ সকলেই একেবারে হতভম্ব। স্যুয়েলেন আর ক্যারীন দুজনের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করল। ছোট্ট ওয়েড স্থানুর মত দাঁড়িয়ে। আতঙ্কে কাঁদতেও ভুলে গেছে। অ্যাটলান্টা থেকে তাড়া করে আসা আতঙ্ক এবার সত্যি হতে চলেছে? ইয়াঙ্কিরা ওকে ধরে নিয়ে যাবে!
জেরাল্ড অস্পষ্টভাবে বললেন, “ইয়াঙ্কিরা? কিন্তু ওরা তো এখানে আগেই এসেছিল।”
“হে ভগবান!” স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। মেলানির ভয়ার্ত চোখে ওর চোখ পড়ল। মুহুর্তের জন্য অ্যাটলান্টার শেষ রাতের আতঙ্কের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারি সারি বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। অত্যাচার,ধর্ষণ আর খুনের গল্প। ইয়াঙ্কি সৈন্য এলেনের সেলাইয়ের বাক্স হাতে হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছবি। প্রচণ্ড হতাশায় মনে মনে ভাবল, “মরেই যাব এবার! এখানেই আমাকে মরতে হবে! ভেবেছিলাম আতঙ্কের দিন চুকেবুকে গেছে। আমি মরেই যাব! আর সহ্য করতে পারছি না!”
“লাগাম দেওয়া ঘোড়াটার দিকে চোখ পড়ল। টার্লটনদের বাড়ি কিছু কাজ নিয়ে পোর্কের যাবার কথা। ওর ঘোড়া! ইয়াঙ্কিরা ওটা নিয়ে চলে যাবে! গরু আর বাছুরও নিয়ে চলে যাবে! আর ওই মা শুয়োর ওর বাচ্চাদেরও! কত পরিশ্রম করে ওগুলোকে ধরা হয়েছে! মোরগটা আর মুরগি আর হাঁসগুলোও নিয়ে যাবে! ফোনটেনরা ওগুলো দিয়েছিল! আর আপেল, কন্দমূল, বীনস। ময়দা, চাল, শুকনো মটরশুঁটি। ইয়াঙ্কি সৈন্যের সেই টাকার ব্যাগটাও! সব নিয়ে যাবে ওরা! আর ওদের উপোস করে মরতে হবে!
“ওরা ওসব নিতে পারবে না!” স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ভাবল হতাশায় ওর মাথা কাজ করছে না। “আমি আর উপোস করতে পারব না! ওরা ওসব কিচ্ছু নিতে পারবে না!”
“কী সব, স্কারলেট? কী নিতে পারবে না?”
“ঘোড়া! গরু! শুয়োর! ওরা নিয়ে যেতে পারবে না! আমি কিছুতেই ওদের নিয়ে যেতে দেব না!”
ক্ষিপ্রগতিতে চার নীগ্রোর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা দরজার সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। কালো কালো মুখগুলো ভয়ে ছাইয়ের মত সাদা।
“ওই জলার ধারে!” দ্রুত বলে উঠল।
“কোন জলা?”
“আরে বোকা, নদীর ধারের জলা! শুয়োরগুলো ওখানে নিয়ে যাও। সবাই যাও! এখুনি! পোর্ক, তুমি আর প্রিসি গুঁড়ি মেরে শুয়োরগুলো নিয়ে বেরিয়ে যাও! আর স্যুয়েলেন – আর ক্যারীন – তোরা ঝুড়ি ভরে যতটা পারিস খাবার জিনিস ভরে নিয়ে জঙ্গলে চলে যা। ম্যামি রুপোর বাসনপত্র আবার কুয়োতে ডুবিয়ে দাও। পোর্ক! প্রিসি! ওরকম থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকো না! বাপীকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। কোথায় যেতে হবে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না! যেখানে নিয়ে যেতে পারো। বাপী, লক্ষ্মী বাপী, তুমি পোর্কের সঙ্গে যাও।”
মনের এরকম অবস্থার মধ্যেও ও বুঝে গেছিল ওই নীল কোটগুলো বাপীর মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে কী ভাবে কাজে লাগাতে পারে। এত কথা বলে চুপ করে হাত কচলাতে লাগল। মেলানির স্কার্ট ধরে ওয়েডের ভয় পাওয়া কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে ওর আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল।
“আমি কী করতে পারি, স্কারলেট?” মেলানি শান্ত গলায় জানতে চাইল, যখন চারপাশে সবাই হাহুতাশ করে চলেছে। ওর শরীর কাঁপছে, মুখটাও ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। তবুও ওর শান্ত গলা শুনে স্কারলেট নিজেকে একটু সামলে নিতে পারল। সবাই ওর মুখের পানে তাকিয়ে আছে, নির্দেশের জন্য, পথ দেখানোর জন্য।
“গরু আর বাছুর,” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলে উঠল। “ওগুলো পুরোনো চারণভূমিতে আছে। ঘোড়াটা নিয়ে যাও আর ওদের জলাভুমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে …”
কথা শেষ হবার আগেই, মেলানি ওয়েডের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের সিঁড়ি বেয়ে ঘোড়ার দিকে দৌড়ে চলে গেল। যেতে যেতে স্কার্টটা সামলে নিল। স্কারলেট ওর রোগা রোগা পাগুলো দেখল, স্কার্টটার হাওয়া লেগে পতপত করা লক্ষ্য করল আর তারপরেই দেখল মেলানি ঘোড়ার ওপর উঠে পড়েছে। পাদানি পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে ওর পা ঝুলে রয়েছে। ঘোড়ার পেটের কাছে গোড়ালি দিয়ে আঘাত করার পরেই ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে উঠল।
“আমার বাচ্চা! ওকে আমাকে দিয়ে দাও! ইয়াঙ্কিরা ওকে মেরে ফেলবে!”
ও ঘোড়া ছোটানোর জন্য তৈরি হয়েই আছে। স্কারলেট চেঁচিয়ে বলল, “তুমি চলে যাও! গরুটাকেও নিয়ে যেও। আমি কথা দিচ্ছি তোমার ছেলেকে আমি দেখব। তুমি কী ভাব যে অ্যাশলের ছেলেকে ওদের নিয়ে যেতে দেব? যাও আর দেরি কোরো না!”
মেলানি একবার হতাশ চোখে পেছনের দিকে তাকাল, তারপর গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে আঘাত করে গোচারণভূমির দিকে চলে গেল।
স্কারলেট ভাবল, “মেলানি হ্যামিলটন ঘোড়ার দুদিকে পা করে বসবে এটা আমি কখনও ভাবিনি!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওয়েড ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে, ওর স্কার্ট ধরার চেষ্টা করছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তিনজনকে দেখতে পেল। স্যুয়েলেন আর ক্যারীন দুটো ঝুড়ি হাতে রান্নাঘরের দিকে দৌড়াচ্ছে। পোর্ক জেরাল্ডকে ধরে পেছনের উঠোনের দিকে এগোচ্ছে। যদিও ধরার ভঙ্গীতে কমনীয়তার ছোঁয়া আছে বলা যাবে না। জেরাল্ড ছেলেমানুষের মত রাগ করে বিড়িবিড় করে কিছু বলতে বলতে চলেছেন।
পেছনের উঠোন থেকে ম্যামির খড়খড়ে গলা শোনা গেল, “এই প্রিসি জালির তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ওই বাসনপত্রগুলো বের করে দে। তুই ভাল করেই জানিস, এই বিশাল শরীর নিয়ে আমি তলা থেকে ওগুলো বের করতে পারব না! ডিলসি এসে এই অপদার্থ মেয়েটাকে …”
“আর আমি কিনা ভাবছিলাম শুয়োরগুলোকে খোঁয়াড়ে রাখলেই কেউ চুরি করতে পারবে না!” স্কারলেট নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে ভাবল। “কেন যে ওই জলার মাঝেই ওদের জন্য খোঁয়াড় তৈরি করলাম না?”
টেবিলের ওপরের ড্রয়ারটা টেনে খুলে হাতড়ে হাতড়ে কাপড়ের তলা থেকে ইয়াঙ্কির সেই ওয়ালেটটা বের করে নিল। সলিটেয়ার আঙটি আর হীরের তৈরি কানের দুলও লুকিয়ে রাখা সেলাইয়ের বাক্স থেকে বের করে ফেলে ওয়ালেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু এগুলো কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? তোশকের তলায়? চিমনির ভেতরে? কুয়োয় ফেলে দেবে? বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখবে? না ওখানে নয়। ইয়াঙ্কিরা ঠিক বুঝে যাবে ওখানে কিছু লুকোনো আছে। তখন ওকে উলঙ্গ করে তল্লাশি করবে।
“তাই যদি করে তো মরেই যাব!” উদ্ভ্রান্তের মত ভাবতে লাগল।
নীচের তলা থেকে ছোটাছুটির আর কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াহুড়োর মধ্যেও মেলানির কথা মনে হল। এখন পাশে থাকলে মনে জোর পাওয়া যেত। যেদিন ইয়াঙ্কিটাকে খুন করল সেদিন মেলির সাহস দেখে ও অবাক হয়ে গেছিল। মেলি একাই ওদের তিনজনের সমান! ও হ্যাঁ, কী যেন বলেছিল মেলি – মনে পড়েছে – ওর বাচ্চার কথা!
ওয়ালেটটা হাতে ধরেই হল পেরিয়ে যে ঘরে বিউ একটা নীচু দোলনায় ঘুমোচ্ছে সেখানে চলে এল। ওকে কোলে তুলে নিতেই বিউ জেগে উঠল। ওর মুখ থেকে টস টস করে লাল গড়িয়ে পড়ল।
শুনতে পেল স্যুয়েলেন অধৈর্য গলায় বলছে, “চলে আয় ক্যারীন – চলে আয়! অনেকটাই নেওয়া হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি চল বোন!” পেছনের উঠোন থেকে জানোয়ারদের চীৎকার, ক্ষোভ আর দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। তুলোর খেতের ভেতর দিয়ে দুটো শুয়োরছানাকে বগলদাবা করে ম্যামি জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছে। দুটো শুয়োর নিয়ে পোর্কও ওর পেছন পেছন যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে জেরাল্ডকেও ঠেলে নিয়ে চলেছে।
জানলা থেকে ঝুঁকে পড়ে স্কারলেট চেঁচিয়ে বলল, “ডিলসি মা শুয়োরটাকে নিয়ে যাও। প্রিসিকে বল, ওটাকে বের করে দেবে। তারপর ওটা তুমি তাড়িয়ে মাঠের ওদিকে নিয়ে যাও!”
ডিলসি নাকাল মুখে স্কারলেটের দিকে তাকাল। অ্যাপ্রন ভরে এক রাশ রুপোর বাসনপত্র। বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “প্রিসি মা শুয়োরটাকে বাড়ির তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।”
“শুয়োরটার ব্যবস্থাটা ঠিকই হয়েছে,” ভাবল স্কারলেট। তারপর দ্রুতপায়ে ঘরে ফিরে এসে ইয়াঙ্কির কাছে থেক পাওয়া ব্রেসলেট, ব্রুচ, পেয়ালা এবং অন্য সব জিনিসপত্র লুকোনো জায়গা থেকে বের করে এক জায়গায় রাখল। কিন্তু কোথায় লুকোবে এগুলো? এক হাতে বিউকে নিয়ে অন্য হাতে এত জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ওকে আবার বিছানায় শোয়াতে গেল।
কোল থেকে নামাতে যেতেই বাচ্চাটা কেঁদে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা সম্ভাবনার কথা ওর মনে এসে গেল। বাচ্চার ডায়াপারের থেকে ভাল লুকোনোর জায়গা আর কী হতে পারে? তাড়াতাড়ি বাচ্চাটার পোশাক তুলে ওর ডায়াপারের পেছনদিকে ওয়ালেটটা চালান করে দিল। এতে বাচ্চাটা আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল। ওর দুপায়ের মাঝখান দিয়ে তিনকোনা কাপড়টা টাইট করে বেঁধে দিল।
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে ভাবল, “এবারে জলাতে যেতে হবে!”
বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। এক হাত দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। অন্য হাতে গয়নাগাটি সামলে ওপর তলার হলের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে না! ভয়ে ওর হাঁটু কাঁপতে লাগল। তবে কি ওরা ওকে একা ফেলেই চলে গেছে? ওকে একা ফেলে চলে যাবার কথা ও তো বলেনি! খালি বাড়িতে – একলা মেয়েমানুষ – আর ইয়াঙ্কিরা আসছে – যা কিছু হয়ে যেতে পারে …”
একটা হালকা আওয়াজ পেয়ে ও একেবারে চমকে উঠল। ঘুরে গিয়ে দেখল ওর ছেলে একটা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখে ত্রাস। কিছু বলবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না।
“চলে এস, ওয়েড হ্যাম্পটন,” আদেশের সুরে বলল। “ আমার পায়ে পায়ে চলে এস। অনেক বড় হয়ে গেছ। মা তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারবে না!”
ছেলেটা দৌড়ে ওর কাছে চলে এল, আতঙ্কতাড়িত এক পশুর মত।স্কার্টটা হাতের মুঠো দিয়ে আঁকড়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল। ওর ছোট ছোট হাতের স্পর্শ স্কার্টের ভাঁজের মধ্য ওর পায়ে কাছে অনুভব করল। ওয়েডের আঁকড়ে ধরায় ওর চলায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল। রেগে গিয়ে বলল, “আমাকে ছেড়ে দাও, ওয়েড। আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে হাঁটো!” ছেলেটা উলটে আরও ঘেঁসে এল।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিরপরিচিত আসবাবপত্রগুলো নজরে এল। কত প্রিয় মুহুর্তের স্মৃতি জড়িয়ে আছে! ওরা যেন কানে কানে বলতে লাগল, “ বিদায়! বিদায়!” গলা ঠেলে কান্না উঠে আসল। এলেনের অফিস – যেখানে বসে এলেন দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতেন – দরজাটা খোলা। পরিচিত পুরোনো টেবিলটা দেখতে পেল। ডাইনিং টেবিলের আশেপাশে চেয়ারগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। প্লেটে এখনও কিছু অভুক্ত খাবার পড়ে আছে। মেঝেতে পাতা এলেনের নিজের হাতে বোনা আর রঙ করা শতছিন্ন কার্পেট। রোবিল্যার দাদুর পোর্ট্রেটটা ঝুলছে। বুকখোলা পোশাকে, চুল উঁচু করে আঁচড়ানো, চোখের ভাষায় আভিজাত্যের তাচ্ছিল্য। সবাই ওর কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “ বিদায় স্কারলেট! বিদায়!”
ইয়াঙ্কিরা এগুলো সব পুড়িয়ে দেবে – সব!
শেষবারের মত বাড়িটা দেখে নিল। আবার দেখতে পাবে বনের ভেতর থেকে। আগুনের শিখায় বাড়িটা জ্বলে যাচ্ছে। চিমনির ভেতর দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ছে।
“আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না!” ভাবতে ভাবতে ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল। “না আমি কিছুতেই তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না। বাপি কখনওই তোমাদের ছেড়ে যেতে পারতেন না। উনি বলেছিলেন, যদি জ্বালিয়ে দিতেই হয় তাহলে ওঁকে নিয়েই জ্বালাতে হবে। আমাকেও তোমাদের সঙ্গেই জ্বালিয়ে দিতে হবে। আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারব না! কিছুতেই না! তোমরা ছাড়া আর আমার কী আছে!”
সিদ্ধান্তটা নেবার পরেই ওর ভয় অনেকটাই কমে গেল। শুধু বুকের মধ্যে একটা জমাট বাধা অনুভূতি যা আশা আর আশঙ্কা সব কিছুর ঊর্ধে। অনেক ঘোড়ার সম্মিলিত খুরের আওয়াজ কানে এল। রাস্তার বাঁক থেকে। লাগামের আর তরবারির ঝনৎকার, আর আদেশ, “নেমে পড়!” ওয়েডের দিকে ঝুঁকে পড়ে খুব কোমল স্বরে বলল, আমাকে একটু ছাড় সোনা! তারপর তুমি পেছনের দরজা দিয়ে জলার দিকে দৌড়ে চলে যাও। ম্যামি থাকবে ওখানে। তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাও! একদম ভয় পেয়ো না, লক্ষ্মীটি!”
মায়ের কোমল গলা শুনে ওয়েড চোখ তুলে মাকে দেখল। ছেলেটার করুণ ভয়ার্ত মুখ দেখে স্কারলেটের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল।
“হে ভগবান,” ও প্রার্থনা করতে লাগল। ছেলেটা যেন ভয়ে মূর্চ্ছা না যায় – অন্তত ইয়াঙ্কিদের সামনে! কিছুতেই ওদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমরা ভয় পেয়েছি! হারামজাদার দল!”
নীচে নেমে গেল ওদের মুখোমুখি হতে।
অ্যাটলান্টা থেকে জর্জিয়া হয়ে শেরম্যান সৈন্যবাহিনী নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জনপদের পর জনপদকে লুন্ঠন করে, শত শত নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে। প্রায় তিনশ মাইল অঞ্চল অরক্ষিত। মাইলের পর মাইল জুড়ে প্ল্যান্টেশন। মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অতিবৃদ্ধদের বাস। স্থানীয় বাহিনী আর হোমগার্ডদের ওপর ভরসা করে। অনেক জায়গায় সেটুকুও নেই। সামনের হলে নীল কোটদের ঢুকতে দেখে স্কারলেট ভুলেই গেল যে ইয়াঙ্কিরা প্রত্যেক শহর, শহরতলী আর গ্রামেই এই বহ্ন্যুৎসবে মেতেছে। ওর মনে হল ওদের এই উৎপীড়নের মূল লক্ষ্য হল ও নিজে। যেন এটা ইয়াঙ্কিদের ওর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ।
সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে স্কারলেট। কোলে মেলানির বাচ্চা। ওয়েড ওর স্কার্টে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। ইয়াঙ্কিরা দঙ্গল বেঁধে বাড়িতে প্রবেশ করল। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওপর উঠে আসবাবপত্র টেনে এনে বাইরের উঠোনে জমা করতে লাগল। ছুরি আর বেয়নেট দিয়ে পর্দাগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিতে থাকল। আলমারি আর ড্রয়ার টেনে খুলে ফেলে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান জিনিসপত্রের অনুসন্ধান করতে লাগল। ওপর তলায় গদি তোষক বালিশ ছিঁড়েখুঁড়ে খোঁজ চালাতে লাগল। ঘরের বাতাস পালক তুলো আর ধুলোয় ভারি হয়ে উঠল। স্কারলেটের মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল। ভয়ের লেশমাত্র আর অবশিষ্ট রইল না। অসহায়ভাবে ওদের বেপরোয়া দাপাদাপি দেখতে লাগল।
ওদের সার্জেন্ট বেঁটেখাটো, পলিতকেশ একটা লোক। মুখে একদলা তামাক চিবোচ্ছে। অন্যদের আগেই ও স্কারলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একদলা থুতু পিচ করে মেঝের ওপর ফেলল। খানিকটা স্কারলেটের স্কার্টের ওপরও এসে পড়ল। বলল,
“তোমার হাতে যা আছে আমাকে দিয়ে দাও মিস।”
হাতের কবচটা লুকিয়ে ফেলতে ভুলে গেছিল। ওটা খুলে নিয়ে অবজ্ঞার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে লোকটার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিল।ওটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝন্ করে আওয়াজ তুলল। মুখের ভাবে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল – যা প্রায় দাদু রোবিল্যারের ছবিতে আঁকা তাচ্ছিল্যেরই সমতুল।
“ওই কানের দুল আর আঙটিটাও খুলে দিলে ভাল হয়।”
স্কারলেট বাচ্চাকে নিজের বাহুতে শক্ত করে ধরল, যাতে ওর মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে থাকে। ও কেঁদে অস্থির হয়ে উঠল। কান থেকে গারনেটের দুলদুটো খুলে ফেলল। জেরাল্ড বিয়ের পর এলেনকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর হাত থেকে চার্লসের দেওয়া বাকদানের আংটিটাও খুলে ফেলল।
“ওগুলো ছুঁড়ে ফেল না। আমার হাতে দাও,” হাত বাড়িয়ে সার্জেন্ট বলল। “ওই বেজন্মাগুলো আগেই অনেক কিছু সরিয়ে নিয়েছে। আর কী আছে?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর বুকের ওপর এসে স্থির হল।
এক মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের মনে হল ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। এই হারামজাদা কি ওর শরীরে হাত দিয়ে তল্লাশি করবে নাকি?
“এই যা আছে। নাকি শিকারকে বিবস্ত্র করেও তল্লাশি চালানো আপনাদের প্রথা!”
“ঠিক আছে, তোমার কথাই বিশ্বাস করলাম,” লোকটা ভালমানুষের মত মুখ করে বলল। তারপর আবার একদলা থুতু ফেলে অন্যদিকে চলে গেল। স্কারলেট বাচ্চাটাকে ঠিকমত নিয়ে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাত দিয়ে ডায়াপারটা ঢেকে রাখল, যেখানে ও ওয়ালেটটা লুকিয়ে রেখেছিল। মনে মনে ঈশ্বরকে মেলানির বাচ্চা আর তার ডায়াপার থাকার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা জানাল। ওপরের ঘরে মূল্যবান কিছু না খুঁজে পেয়ে লোকগুলো অশ্রাব্য গালাগালি করতে লাগল। বাইরে থেকে হাঁস আর মুরগির কোলাহল ভেসে আসছে। “ওগুলোকে উড়িয়ে দাও। একটাও ছেড়ে দিও না!” একটা মর্মান্তিক চিৎকার – তারপর গুলি চলবার আওয়াজ – স্কারলেটের বুক কেঁপে উঠল। মা শুয়োরটাকে মেরে ফেলল! হারামজাদা প্রিসি! ওটাকে ফেলে রেখেই নিজে পালিয়ে গেছে। বাচ্চা শুয়োরগুলোর কী অবস্থা কে জানে! পরিবারের বাকি সবাই জলার ধারে নিরাপদে পৌঁছতে পেরেছে তো? জানার কোনও উপায় নেই!
হই হল্লা আর গালাগালি করতে করতে সৈন্যগুলো ঘরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। স্কারলেট চুপ করে হলে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে ওয়েড ওর স্কার্টটা শক্ত মুঠোয় ধরে আছে।ওর ছোট্ট শরীরটা ওর সঙ্গে সেঁটে আছে। বুঝতে পারছিল ও ভয়ে কাঁপছে। ভয়টা ভাঙানোর জন্য কথা বলা দরকার। কিন্তু স্কারলেট মনের জোর পেল না। ইয়াঙ্কিদেরও কিছু বলে উঠতে পারল না। কাকুতি মিনতি, প্রতিবাদ বা রাগ দেখানো, কিছুই। ঈশ্বর যে ওর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু কেড়ে নেননি, মাথা উঁচু করে রাখার মত মনের জোর রাখতে দিয়েছে, সে জন্য মনে মনে বারবার তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। তবু ওপর থেকে একদল দাড়িওয়ালা লোক চোরাই মালগুলো ধরাধরি করে নামাচ্ছিল, তাদের একজনের হাতে চার্লসের তরবারিটা দেখতে পেয়ে ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
তরবারিটা ওয়েডের। আগে ওটা ওর বাবার ছিল। তার আগে ওর ঠাকুর্দার। গত জন্মদিনে স্কারলেট ওটা ওয়েডকে উপহার দিয়েছিল। বেশ একটা অনুষ্ঠান করে। মেলানি কেঁদে ফেলেছিল। গর্ব আর দুঃখের স্মৃতিতে। ওকে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিল যেন ওয়েড ওর বাপ ঠাকুর্দার মত বীর হয়। তরবারিটা পেয়ে ওয়েডের খুব গর্ব হয়েছিল। মাঝে মাঝে টেবিলের ওপরে উঠে ওটার গায়ে হাত বোলাতো। নিজের জিনিস লুট হয়ে যাওয়াটাও স্কারলেটে সহ্য করে নিয়েছিল, কিন্তু ওর শিশুপুত্রের গর্বের সম্পত্তি এই চোরদের নিয়ে যাওয়াটা আর ও মেনে নিতে পারল না। স্কার্টের ফাঁক দিয়ে তরবারিটা দেখতে পেয়ে ওয়েডের গলায় আওয়াজ ফিরে এল। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“ওটা আমার!”
স্কারলেটও হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, “ওটা আপনারা নিয়ে যেতে পারবেন না!”
“হেঁ হেঁ তাই নাকি?” নির্লজ্জভাবে হেসে যে লোকটার হাতে তরবারিটা ছিল, সে বলল। “নিশ্চয়ই পারি! এটা এক বিদ্রোহীর তরবারি!”
“না – মোটেই না! এটা মেক্সিকোর যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে! ওটা আপনি নিতে পারেন না! ওটা আমার ছেলের। ওটা ওর ঠাকুর্দার ছিল! ওহ্ ক্যাপটেন,” সার্জেন্টের দিকে ঘুরে গিয়ে স্কারলেট মিনতি করল, “ওই তরবারিটা আমাকে দিয়ে দিতে বলুন!”
প্রোমোশন পেয়ে সার্জেন্ট মনে মনে ভারি খুশি হয়ে এগিয়ে এল।
“দেখি বাব্, ওটা আমার হাতে দাও।”
অনিচ্ছা সহকারে প্রাইভেট সৈন্যটা তরবারিটা ওর হাতে দিয়ে দিল। বলল, ওটার বাঁটটা খাঁটি সোনার তৈরি।
সার্জেন্ট ওট হাতে নিয়ে বাঁটটা সূর্যের আলোর দিকে তুলে ধরে খোদাই করাটা লেখাটা পড়তে লাগল।
“কর্নেল উইলিয়াম আর হ্যামিল্টনকে,” লোকটা মর্মোদ্ধার করল।অসমসাহসিকতার জন্য, তাঁর বাহিনীর কর্ত্তৃক প্রদত্ত হল। বুয়েনা ভিস্তা। ১৮৪৭।”
“মহাশয়া, বুয়েনা ভিস্তায় আমি নিজেও ছিলাম!” লোকটা বলল।
“তাই নাকি?” খুব শীতল গলায় স্কারলেট বলল।
“ছিলামই তো! কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, বলছি আপনাকে! এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আর কখনও দেখিনি! এই তরবারি এই বাচ্চাটার ঠাকুর্দার, তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“ওটা ও রাখতে পারে,” জুয়েলারি আর তাবিজ রুমালে বেঁধে নিতে পেরে সার্জেন্ট বেশ খুশিই হয়েছে বোঝা গেল।
“ওর বাঁটটা যে খাঁটি সোনার!” প্রাইভেটটা বোঝানোর চেষ্টা করল।
“আমাদের কথা মনে রাখবার জন্য, ওটা আমরা রেখে যাব,” সার্জেন্ট মৃদু হাসল।
স্কারলেট তরবারিটা নিল। ধন্যবাদ দেবার কথা মুখেও আনল না। এই সব চোরদের অযথা ধন্যবাদ দিতে যাবেই বা কেন? ওরই সম্পত্তি ওকেই ফেরত দিচ্ছে, ধন্যবাদ কেন দিতে যাবে! তরবারিটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। ওদিকে প্রাইভেটটা সার্জেন্টের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে শুরু করল।
“এই বিদ্রোহীগুলোকে এমন শিক্ষা দেব না – দেখাচ্ছি – দাঁড়াও!” প্রাইভেটটা চেঁচিয়ে বলল। সার্জেন্টটা তখন রেগে গিয়ে লোকটাকে গালি দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেছে। লোকটা দাপাতে দাপাতে বাড়ির পেছনের দিকে চলে যেতেই স্কারলেট একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বাড়িটা পুড়িয়ে দেবার কথা অন্তত ওরা বলেনি। তাহলে তো ওদের বের হয়ে যেতে বলত, যাতে আগুন লাগাতে পারে! হয়ত – হয়ত – ওপর থেকে লোকগুলো এলোমেলোভাবে নীচে নেমে এসে বাড়ির বাইরে চলে গেল।
“আর কিছু নেবার আছে?” সার্জেন্টটা জিজ্ঞেস করল।
“একটা শুয়োর আর কয়েকটা হাঁস আর মুরগি।”
“অল্প কিছু শস্য, কন্দমূল আর বীনস। ওই যে মেয়েটা বুনো বেড়ালের মত ঘোড়ায় চেপে ছুটে এলো না – মনে হয় ওই আমাদের আসার খবরটা দিয়ে দিয়েছে!”
“রেগুলার পল রিভিয়ার, তাই?”
“হ্যাঁ, এখানে আর কিছু পাওয়া যাবে না সার্জেন্ট। মাল পেয়ে গেছেন। আমাদের আসার খবর চাউর হবার আগেই যাওয়া ভাল।”
“স্মোকহাউজ়টা দেখেছো? ওখানে ওরা জিনিসপত্র পুঁতে রাখে অনেক সময়।”
“না কোনও স্মোকহাউজ়ই নেই।”
“নিগারদের ক্যাবিনের মাটি খুঁড়ে দেখে নিয়েছো?”
“তুলো ছাড়া কিছু ছিল না। আগুন ধরিয়ে দিয়েছি।”
মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের গরমে ঘামতে ঘামতে দিনের পর দিন মাঠ থেকে তুলো ওঠানোর স্মৃতি ফিরে এল। সেই কোমরভাঙা খাটুনি। কাঁধে ফোসকা পড়ে যাওয়া। সব পরিশ্রম ধুলোয় মিশে গেল। তুলো জ্বলে গেল।
“তেমন কিছু তোমাদের কাছে পাওয়া গেল না, মিস!”
স্কারলেট শীতল গলায় জবাব দিল, “আপনাদের সৈন্যরা আগেও এখানে এসেছিল।”
“তা অবশ্য সত্যি। এদিকে সেপ্টেম্বরেও আমরা এসেছিলাম,” একজন বলে উঠল। তারপর হাতে রাখা একটা জিনিস দেখাল, “ওহ ভুলে গেছিলাম!”
স্কারলেট দেখল এলেনের সেই সোনার অঙ্গুলিত্র লোকটার হাতে। কতদিন এলেনের হাতে সেলাইয়ের কাজ করার সময় ওটাকে চকচক করতে দেখেছে! সেই ছিপিছিপে হাত যাতে ওটা পরা থাকত, তার স্মৃতি ওর মনে জ্বলজ্বল করে উঠল। সেই জিনিসটা আজ কিনা ওই লোকটার কড়া পড়া নোংরা হাতে ধরা! খুব তাড়াতাড়ি ওটা উত্তরে চলে যাবে, কোনও ইয়াঙ্কি মেয়ের হাতে পরা থাকবে! চুরি করা জিনিস পরে যার খুব গর্ব হবে। এলেনের অঙ্গুলিত্র!
স্কারলেট চোখ নামিয়ে নিল। শত্রুরা যাতে ওর কান্না দেখে না ফেলতে পারে। চোখের জল টপ টপ করে বাচ্চার মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগল। জলে ভেজা ঝাপসা চোখে দেখল লোকগুলো বেরিয়ে গেল। সার্জেন্ট কর্কশ গলায় ওদের আদেশ দিচ্ছে। ওরা চলে যাচ্ছে। টারা আবার নিরাপদ। তবুও এলেনের স্মৃতি ওকে বেদনাতুর করে তুলল। তরবারির ঝনঝন আওয়াজ, অপস্রিয়মাণ ঘোড়ার খুরের শব্দ, দুপাশে গাছের সারির মাঝখানের রাস্তা ধরে ওদের মিলিয়ে যাওয়া, কিছুই ওকে স্বস্তি দিতে পারল না। ওদের প্রত্যেকে চুরি করা মালে বোঝাই হয়ে চলেছে, পোশাক পরিচ্ছদ, কম্বল, ছবি, হাঁস, মুরগি, শুয়োরের বাচ্চা।
হঠাৎ পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পেল। পেছন ফিরল। হয়ত ছুটে গেলে কিছু তুলোর পেটি বাঁচানো যেতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি সংগ্রহ করে উঠতে পারল না। ডাইনিং রুমের খোলা জানলা দিয়ে ধোঁয়া এঁকেবেঁকে ঘরে ঢুকে পড়ছে। নীগ্রো ক্যাবিনগুলো থেকে। সব তুলো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। কর দেবার টাকা থাকল না। প্রবল শীতে লড়াই করার মত সংস্থানও চলে গেল। দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। তুলোর গুদামে আগুন লাগতে আগেও দেখেছে ও। জানে সেই আগুন নেবানো কতটা অসম্ভব, এমনকি অনেকে মিলে হাত লাগালেও। ওই কোয়ার্টারগুলো বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে, এই যা রক্ষে। তেমন হাওয়াও চলছে না, যে আগুনের শিখা টারার ছাদ স্পর্শ করবে।
হঠাৎ কী ভেবে ঘুরে দাঁড়াল। ভয়ার্ত চোখে দেখল হল আর প্যাসেজ ধোঁয়ায় ভরে গেছে। হে ভগবান আগুনটা আসছে রান্নাঘর থেকে!
হল আর রান্নাঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে রাখল। ওয়েডের হাত ছাড়িয়ে ওকে দেওয়ালে ঠেসে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ধোঁয়ায় অন্ধকার রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। পরমুহুর্তেই কাশতে কাশতে বেরিয়ে এল। ধোঁয়া ঢুকে চোখ থেকেও দরদর করে জল বেরোচ্ছে। স্কার্ট দিক্যে নাক ঢেকে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল।
একেবারে অন্ধকার। শুধু একটা ছোট জানলা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। ধোঁয়ার অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আগুন জ্বলার হিস্ হিস্ শব্দ শুধু কানে এল। ভুরু কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল। মেঝের ওপর দিয়ে আগুনের শিখা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন কিছু জ্বলন্ত কাঠের টুকরো ঘরজোড়া খোলা ফায়ারপ্লেসে গুঁজে দিয়ে গেছে। পাইন গাছের তক্তা দিয়ে বানানো মেঝেতে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে – ঠিক জলের মত।
দৌড়ে গিয়ে ডাইনিং রুম থেকে একটা ছেঁড়া কার্পেট তুলে আনল। দুটো চেয়ার শব্দ করে উলটে পড়ল।
“এই আগুন আমি কিছুতেই একা নেভাতে পারব না – কিছুতেই না! হে ভগবান কেউ যদি একটু সাহায্য করার মত থাকত! টারা আর থাকল না! ওহ্, তাহলে বদমাশটা এটাই বলতে চেয়েছিল! যাতে ওকে আমরা মনে রাখতে পারি! ইশ্, শুধু যদি ওকে তরবারিটা দিয়ে দিতাম!
হলঘরে ওর ছেলে তরবারিটা আঁকড়ে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ। মুখে প্রগাঢ় শান্তির ছোঁয়া।
খুব ব্যাকুল হয়ে ভাবল, “হে ভগবান, ও কি মরে গেছে! ওই বদমাশগুলোর ভয়েই ও মরে গেল!” তারপর এক বালতি হাবার জল নিয়ে রান্নাঘরে দৌড়ে গেল। এই জলটা হল থেকে রান্নাঘরে যাবার প্যাসেজে সব সময় আখা থাকে।
কার্পেটটা জলে চুবিয়ে জোরে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ধোঁয়াভরা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। দরজাটা বন্ধ করে দিল। কতক্ষণ ধরে যে কাশতে কাশতে ওই কার্পেট ভিজিয়ে ভিজিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসা আগুনের ওপর দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছে, তা বলতে পারবে না। দু’দুবার ওর স্কার্টের প্রান্তে আগুন লেগে গেছে। হাত দিয়ে চাপড় মেরে নিবিয়েছে। মাথা থেকেও চুলপোড়ার গা গুলোনো গন্ধ আসছে। হাতের ধাক্কায় খোঁপা করে রাখা চুল খুলে গেছিল। আগুনের স্রোত ওকে অতিক্রম করে জ্বলন্ত সাপের মত এঁকেবেঁকে বাইরের দিকে ধাওয়া করছে। শরীর অবসন্ন। ক্রমশ ও নিরাশ হয়ে পড়ছিল।
তারপর সহসা দরজা এক ঝটকায় খুলে গেল। বাইরের থেকে দমকা হাওয়া এসে আগুনের শিখায় প্রাণসঞ্চার করল। দরজা আবার দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল। পুঞ্জিভূত ধোঁয়ার রাশির মধ্যে প্রায় অন্ধ স্কারলেট মেলানিকে দেখতে পেল। আগুনের ওপর দিয়েই হেঁটে মেলানি কালোমতো ভারি একটা কিছু দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগল। ওর টলতে টলতে হাঁটা দেখতে পেল। খুক খুক করে কাশির আওয়াজও কানে এল। ফ্যাকাসে মুখ। চোখ কুঁচকে অবস্থার আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। কার্পেট নিয়ে ওর রুগ্ন শরীরটা আগুপিছু করছে। তারপর আবার যে কতক্ষণ ধরে দুজনে পাশাপাশি বসে আগুন নেভাতে থাকল, তারও আন্দাজ থাকল না। দেখল আগুন আস্তে আস্তে নিবে আসছে। তারপর মেলানি হঠাৎ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠে সজোরে ওর কাঁধে ধাক্কা মারল। ধোঁয়ার রাশি আর অন্ধকারের মধ্যে স্কারলেট পড়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পর দেখল, পেছনের উঠোনে মেলানির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সূর্যাস্তের আলো ওর মুখে এসে পড়ছে।হাত, মুখ আর কাঁধে আগুনে পুড়ে যাওয়ার জ্বালা। কোয়ার্টারগুলো থেকে এখনও ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে। বাতাসে তুলোপোড়ার তীব্র গন্ধ। রান্নাঘর থেকেও পাক খেয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। স্কারলেট ধড়মড় করে উঠতে গেল।
মেলানি ওকে আবার শুইয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “শুয়ে থাক সোনা। আগুন নিভে গেছে।”
চুপচাপ চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকল। কী স্বস্তি! মেলানির বাচ্চার মুখ থেকে লাল গড়িয়ে পড়ার শব্দ। কাছাকাছিই আছে। ওয়েডের হেঁচকি তোলার শব্দ। হে ঈশ্বর অনেক ধন্যবাদ! ও মরে যায়নি। চোখ খুলে মেলানির মুখের পানে চাইল। কোঁকড়া চুলগুলো ঝলসে গেছে। কালিঝুলি লেগে ফর্সা মুখ কালো। শুধু চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। আর ও হাসছে।
“তুমি কি জানো তোমাকে একেবারে নীগ্রোদের মত লাগছে!” অনুচ্চস্বরে স্কারলেট বলল। মেলানির কোলে মাথাটা আরও ঢুকিয়ে দিল।
“আর তোমাকে কি রকম লাগছে জান? কবিগানের লড়াইতে যে লোকটা জিতে যায়, তার মত।” মেলানি ওর কথার খেই ধরে জবাব দিল।
“আমাকে অত জোরে ধাক্কা মারতে হল কেন?”
“তার কারণ, সোনা, তোমার পিঠ আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল। তুমি যে ওভাবে অজ্ঞান হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। তবে ঈশ্বর জানেন, আজ তোমার ওপর দিয়ে যা বয়ে গেছে, তাতে তুমি মরে যেতেও পারতে! সবাইকে জঙ্গলের মধ্যে নিরাপদে রেখেই আমি ফিরে এলাম। বাচ্চা নিয়ে তুমি একলা আছে – আমি তো দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম! আচ্ছা – মানে ইয়াঙ্কিরা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তো?”
“যদি জানতে চাও আমাকে ধর্ষন করেছিল কিনা – না,” যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে স্কারলেট বলল। মেলানির কোল খুবই নরম, কিন্তু যে জায়গায় শুয়ে আছে সেটা একটু এবড়োখেবড়ো। “কিন্তু ওরা সব চুরি করে নিয়ে গেছে – সব কিছু! আমাদের আর কিছুই নেই – খুশি হবার কোনও প্রশ্নই নেই!”
“আছে, স্কারলেট। আমরা একে অপরকে তো হারিয়ে ফেলিনি। আমাদের বাচ্চারাও সুস্থ আছে। মাথার ওপর ছাদ আছে,” মেলানি নরম করে বলল। “আর কী চাই? এই মুহুর্তে … এ – হে বিউ একেবারে ভিজে গেছে! ইয়াঙ্কিরা নিশ্চয়ই ওর বাকি ডায়াপারগুলোও তুলে নিয়ে গেছে? আরে স্কারলেট – ওর ডায়াপারে এগুলো কী রেখেছো?”
ভয় পেয়ে বাচ্চার পিঠের দিকে আঙ্গুল চালিয়ে মেলানি ওয়ালেটটা বের করে আনল। ওয়ালেটটা প্রথমে চিনতেই পারেনি। তারপর মনে পড়তেই এক গাল হেসে ফেলল। শরীরের পরতে পরতে সংযত আনন্দের প্রকাশ।
“এভাবে লুকোনোর কথাটা তুমি ছাড়া আর কারও মাথায়ই আসত না,” বলে স্কারলেটকে দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। “তুমি হলে আমার সব চেয়ে আদরের বোন!”
স্কারলেট ওর বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল না। ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করার মত বল ছিল না। তাছাড়া নিজের প্রশংসা শুনে পরাজিত মনোবল ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রান্নাঘর থেকেই মেলানির প্রতি ওর শ্রদ্ধা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল আর সহযোদ্ধাসুলভ নৈকট্য বোধ করছিল।
কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েও মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল, “এটা তো মানতেই হবে, দরকারের সময় ওকে সর্বদা পাশে পাওয়া যায়।”
উৎপল দাশগুপ্ত
অনুবাদক। আলোকচিত্রী
কলকাতায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ