প্রতিদিন রাত দশটার পর এই এলাকার পুকুরগুলির ওপরে কুয়াশার সরের মধ্যে দিয়ে মৃত্যু নেমে আসে। ঠিক কীভাবে নেমে আসে মৃত্যু, পা’টা কতটা ভাঁজ করে রাখে, এই কথা অনেকবার ভাবার চেষ্টা করেছে সে। রাত দশটার পর কোনও নির্দিষ্ট সময়েই কি নেমে আসে মৃত্যু? নাকি, রাত দুটো সতেরো মিনিটে আসে প্রতিদিন? যে সময়টায় একটা বড় পালকিতে বসে বাহকহীন দোল খেতে খেতে রাতের জটিল বর্গক্ষেত্রের মধ্যে মিলিয়ে গেল মা? একটা পা অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটা মানুষের হাতের হ্যারিকেন যেভাবে দোল খায়, বাহকহীন পালকিতে সেভাবেই দোল খাচ্ছিল মা…
ঠাকুমাকে রাতের খিচুরি আর আলুর দম খাইয়ে দিয়ে সিঁদুর পরিয়ে বড় ঝুড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিল সে। ওখানেই সারারাত শুয়ে থাকে বুড়ি। এই শোওয়ানোর আগে ঠাকুমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে হয়। ঠাকুমার নাম আরতিরানি। বিরানব্বই পেরিয়ে গিয়েছে গত অঘ্রাণ মাসে। শীত বাড়লে সিগারেটের প্যাকেটের মত কুঁচকে যায় শরীরটা নিয়ে। তখন ওই ঝুড়িটা থেকে বের করে আনা মুশকিল হয়। বিরানব্বই বছর বয়সী আরতিরানির আটত্রিশ কেজির দেহটা নিয়ে তিন বছর আগে পৌষের মেলা থেকে কেনা বিশাল ঝুড়িটা দোল খায়। দিনের বেলা জানলা দিয়ে ঝুড়ির উপর রোদ এসে পড়লে আরতিরানির অনেকগুলো বছরের কথা পর পর মনে পড়ে। চোখের পাতা পিটপিট করে রোদ নিতে নিতে তার মনে তখন একটাই হিসেব- পুজো কবে আসবে… কথাটা ভাবতে ভাবতে মাঝেমাঝেই ঝুড়ির মধ্যেই পেচ্ছাপ-পায়খানা করে দেয়।
একতলা বাড়ির মূল দরজায় তালা দিতে দিতে মুহূর্তের জন্য থেমে একটু শ্বাস নিল। রাস্তায় নেমে দেখল, বাড়ির সামনের সাইকেলের দোকানটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দোকানের সাইনবোর্ডের উপর একটা ময়ূর বসে আছে। ময়ূরটিকে সে রোজই দেখে। তবে, রোজই যে সাইকেলের দোকানের সাইনবোর্ডের উপরেই বসে থাকতে দেখে, তা নয়। ময়ূরটি কখনও রাস্তার ধারের নর্দমার পাশে বসে ফেলে দেওয়া ভাত-তরকারি খায়। কখনও ইলেকট্রিকের তারে বসে একটু উত্তরদিকের কোনও আবর্জনাস্তূপের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দোল দোল দুলুনি করে। ময়ূরটি ঠিক প্রমাণ সাইজের নয়। কোনও অঙ্ক খাতায় এই ময়ূরটির পাশে ব্র্যাকেটে কেউ ‘প্রমাণিত’ লেখেনি কখনও। তার ডানা নেই। তার প্রাণান্তকর চিৎকারও নেই। এই ময়ূরটি ডাকে না। সে ময়ূরটিকে দেখে। ময়ূরটি তাকে কখনও দেখে কি না, সেটা দেখা হয়নি তার।
এই সাইকেলের দোকান পেরিয়ে সে ক্রমশ এগোতে থাকে। আর মিনিট দেড়েকের মধ্যেই একটা-দুটো বাঁক নিয়ে সে যেখানে পৌঁছবে, যে রাস্তাটিতে পৌঁছাবে, তার নাম ‘কমলা রঙের রোদ’।
তার আকাঙ্ক্ষা তার ক্রোধ ভয় সমবেদনা কল্পনা সবই এই ‘কমলা রঙের রোদ’ নামের রাস্তাটিকে ঘিরে। রাস্তার দু’পাশে অল্প কয়েকটি দোতলা বাড়ি। এলাকাটি ফাঁকা। তা বহু বসবাসে পুরনো হয়ে ওঠেনি কখনও। এই বাড়িগুলিতে কোনও মানুষ থাকে কি না, তা সে জানে না। থাকলেও, তাদের শব্দ পাওয়া যায় না কখনও। তার মনে হয়, এই বাড়িগুলিতে মানুষ থাকলেও, তারা নির্বিবাদে মড়ার মতোই পড়ে থাকে। অতি বিপদেও তাদের জাগিয়ে তোলা কঠিন। এই বাড়িগুলোর জানলাতে কোনও মেঘলা পর্দা ওড়ে না। অতি বেগুনী রশ্মি কখনও স্পর্শ করেনি তাদের ঘরের ভিতরের কাঁসার বাসনকে। কেবল মাঝে মাঝে এই বাড়িগুলির মধ্যের কোনও একটি বাড়ি থেকেই হারমোনিয়ামের সুর ভেসে আসে। কোন বাড়িটি থেকে আসে তা, সে জানে না।
বহু বছর আগে এই রাস্তাটি দিয়ে একটা বিকেলবেলা মায়ের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল সে। প্রথম কালবৈশাখী আসবে সে দিন। তার মধ্যেই তাদের মাথার উপর দিয়ে কয়েকটা সাদা রঙের পাখি উড়ে গেল। বোধহয় বালিহাঁস। বোধহয় সারস। জোরে হাওয়া দিচ্ছিল। ক্ষিতি মরুৎ ব্যোম শুধু হাসছে। কয়েকটা মৃত ফড়িং ও বাঁশপাতা বাতাসে উড়ে উড়ে গেল। মা ওই দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ওই দেখ, কমলা রঙের রোদ’!
তার তখন বারো বছর বয়স। প্রথমবার রজঃস্বলা হতে তখনও কিছুদিন বাকি। সে একটু অবাক হয়ে মা’কে জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?
ওই যে, দেখলি না!
না। আমি তো কিছুই দেখলাম না মা! রোদ কোথায়? অন্ধকার হয়ে এসেছে তো!
কিন্তু, কমলা রঙের রোদটা প্রস্তুত করার ইচ্ছেটা তো তৈরি করেছিল প্রকৃতি। দেখলি না চারপাশটা? আলো থাকলেই তো রোদ হয় না। ইচ্ছেটাও তো দরকার। ওই ইচ্ছেটা তো দেখাল প্রকৃতি… সে দেখল, কথাটা বলতে গিয়ে মায়ের চোখটা অল্প আঁচে জ্বলে উঠল।
ওই আঁচটা নিয়েই সেই দিনটিতে ফাঁকা রাস্তাটা পেরোল মা আর সে।
মায়ের সঙ্গে ওই একবারই আসা এই রাস্তায়। তারপর যে কোনও কারণেই হোক আর এই রাস্তায় মা আসেনি। যে আটটা দোতলা বাড়ি রয়েছে এই রাস্তাটিতে, তাদের প্রতিটির রং-ই এক রকম। অনেকখানি লাল শাক দিয়ে মাখা ভাতের রং। তবে, এই রং কোনও বাড়িতেই সম্পূর্ণ হয়নি। কোন এক অচেনা তাড়াহুড়ো নিয়ে এসেই যেন রং মিস্ত্রী বেশ খানিকটা করে একইরকম রং সব বাড়ির কিছু অংশে লাগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে।
রাস্তাটায় রাতে কেউ আসে না। কেন আসে না কেউ, তার কয়েকটি কারণ অবশ্যই থাকতে পারে, যার কোনওটাই সে জানে না। তার ঠাকুমা আরতিরানিও নয়। রাতে ঝুড়ির ভিতর শুতে যাওয়ার আগে ঠাকুমাকে ভাল করে সিঁথি আর কপালে মাখামাখি করিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দেয় সে। বুড়ো মানুষের আবদার! রোজই একটু খিচুড়ি আর আলুরদম খেতে চায়। সেই খাবার আবার চাই ঠিক রাত ন’টার মধ্যেই। সময়ে খাবার না পেলে বুড়ি রেগে যায় খুব ইদানিং। কথা বলতে পারে না। রেগে গেলে নাভি থেকে কুকারের শিসের মতো একটা শব্দ টেনে এনে বাতাসে মিশে দেয়। ঝুড়িটা ধরে বলের মতো গড়িয়েও যায় শানের ওপর দিয়ে। খুর দিয়ে ষাঁড় যেভাবে মাটি আঁচড়ায়, ঠিক সেভাবেই ওই ঝুড়িটা দিয়েই শানটাকে খুঁড়ে ফেলে তার ভিতর থেকেই খিচুড়ি আর আলুরদম তখন বের করে আনবে যেন বুড়ি! নিশ্চিত ক্ষুধার সামনে দাঁড়িয়ে সে আর স্থির থাকতে পারে না তখন। যতক্ষণ না চৌকির পায়া বা চৌকাঠে ঠোকা খাচ্ছে ততক্ষণ ওই নাটক চলে। ছ্যাঁতলা পড়া জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে তারপর আরতিরানি জুলজুল করে ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে নাতনির জন্য চেয়ে থাকে।
ঠাকুমার কষ্টটা সে জানে। বহু ভুলভ্রান্তি এবং উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে আরতিরানি বিরানব্বই পার করেছে। শরীর ছোট হয়ে গিয়েছে। স্তন বলে আর কিছু নেই। সেই জায়গায় কেবল বৃন্তটুকু জেগে থাকে। ঠাকুমাকে রোজ রাতে খিচুড়ি খাওয়ানোর সময় সে ঝুড়ি থেকে বার করে। খেতে খেতে আরতিরানি মাঝেমাঝে নাতনির স্তনে হাত দেয়। তারপর খাবারের শেষ গ্রাসটিতে পৌঁছানোর আগের মুহূর্তে যে একফালি কাপড় দিয়ে তার শরীরটা ঢাকা থাকে, সেটি সরিয়ে দিয়ে শীর্ণ, প্রায় জীবনহীন স্তনবৃন্তটি বাড়িয়ে দেয়।
সে বুঝতে পারে, ঠাকুমার আর কোনও যন্ত্রণার বোধ নেই। কোনও ভাবনা বা চিন্তার বলয় নেই। কোনও শব্দও তাঁর শ্রবণে নেই। যা আছে, তা কেবল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। তা সত্ত্বেও, এই দুর্বল অসুস্থ বৃদ্ধাটি নারীর অন্তরের সমস্ত দৃঢ়তা দিয়ে স্তনবৃন্তটুকুকে অনুভব করতে চায়। রাতের খাবারের শেষ গ্রাসটি ওই জীবন ফুরিয়ে আসা স্তনবৃন্তটির কাছেই দিয়ে রাখতে চায়।
‘কতটা পথ যাব আজ?’, ফাঁকা রাস্তাটিতে চলতে চলতে এই প্রশ্নটা নিজেকেই করে সে।
‘এই রাস্তায় আর কখনও যদি না আসি আর, এই হারমোনিয়ামের সুর, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছের পাতা, এই বাড়িগুলোর বন্ধ জানলা, অল্প কয়েকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো- এরা আমাকে মনে রাখবে কখনও? যে রং মিস্ত্রী পুরো কাজ শেষ না করে চলে গিয়েছিল, সে কখনও জানতে পারবে, তার এমন গাফিলতিগুলোকেও আমি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম হাত বুলিয়ে বুলিয়ে?’, এই কথাগুলোর কিছুটা সে নিজেকে বলে। কিছুটা বলতে পারে না।
গত এক মাস ধরে আরতিরানির খাবারে অল্প অল্প করে একটি নির্দোষ বিষ মিশিয়ে দিয়ে আসছে সে। বিষটি নির্দোষ নয়। পরিমাণের হেরফেরে সেটিকে অমনটা মনে হয়। এতই সামান্য পরিমাণ যে, শরীরটি জন্তুর মতোও হয়ে পড়ে না কখনও। যে মানুষ বলতে পারে না, যে মানুষ শুনতে পারে না, একমাত্র খিদে ছাড়া যার কোনও অনুভবও নেই, অথচ আর একটি মানুষের সঙ্গে নিবিড় হয়ে রয়েছে, ওটুকু বিষ তার প্রাপ্য বলেই মনে করে সে। কেবল স্তনবৃন্তের কাছে নিয়ে যাওয়া গ্রাসটুকুকে আলাদা করে রাখে। বিষটা ওতে ছোঁয়ায় না।
ঠাকুমার কষ্টটা সে জানে। কুড়ি বছর বয়সে বিধবা হয়ে যায়। কথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে একবার বলেছিল, ‘কপালে সিঁদুর নিয়ে মরতে পারব না’। এই আপশোসটুকু যাতে না থাকে, তাই বিষমেশানো খাবারের পর ভালো করে আরতিরানির কপালে সিঁদুর লাগিয়ে দেয় সে।
রাস্তাটা অল্প। তবে, অনেকক্ষণ ধরে চলাফেরা করলে খুব বড় ছড়ানো মাঠের মতো দেখায়। মনে হয়, সেই ছড়ানো মাঠ যেন আরও বড় এক নৌকোর মধ্যে ঢুকে গেল…
মাঘ মাসের রাত এগারোটার কুয়াশার পাটালিকে টুকরো করে দুনিয়ার শেষতম ছোট ও ফাঁকা রাস্তাটি দিয়ে মূক অথচ চেতনাময় চলাফেরা চলতে থাকে তার।
রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটতে হাঁটতে সে টের পায়, আগুনকে যেভাবে মোহগ্রস্ত পোকা অনুসরণ করে, ঠিক সেভাবেই ওই ময়ূরটা প্রায় নিঃশব্দে তার পিছন পিছন আসছে। অপার নিঃসঙ্গতার মধ্যেই ভেসে আসছে হারমোনিয়ামের সুর। এই রাস্তাটিকে লণ্ডভণ্ড করে কোন এক স্তব্ধ রঙিন দেশের দিকেই চলে যাচ্ছে সেই সুর।
ময়ূরটি কি তার উপর যে কোনও সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে? ডানা গজানোর লোভে কি খুবলে খাবে তার দেহের কোমল মাংস? কত কাছে এসেছে তা সে ঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারছে না। আরতিরানির মতোই এই ময়ূরটিরও স্বর নেই। এই ময়ূরটি ডাকে না। তবে, ময়ূরটিকে দু’একটা নিজের কথা তো বলা যায়।
কয়েক মুহূর্ত বাদে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার একবার মনে হল, কমলা রঙের রোদটা এখন যে কোনও সময়েই উঠতে পারে।
2 মন্তব্যসমূহ
লেখায় গুণ রয়েছে। টান আছে। কিন্তু গল্পকারের এই লেখাটি লেখার উদ্দেশ্য ক্লিয়ার হল না। কোনও একটা অনুভূতি তো পাঠককে হন্ট করবে , তা করল না । কয়েকটি অভূত ঘটনা এবং চরিত্র অবশ্যই বিস্ময় জাগায়।
উত্তরমুছুনলেখকের হাতে যে লেখা আছে তা যে কোনও পাঠকেরই উপলব্ধি করতে আটকাবে না।
সমীরদা লিখে জানালো। তোমার কাছে তো অকপট হতেই হবে। ভান করলে চলবে না। অনেক বছর পর তোমার লেখা পড়লাম। এটাই সবচেয়ে আশ্বস্তের। ভালবাসা নিয়ো।
উত্তরমুছুন