--এ্যাই বাজারি মাগী এহানে কি করে? পাগলা চোদা
বুড়ি, বাজারেরগলিতে গলিতে ঘুইরা বেড়ায়। রাস্তার ধারে
শুইয়্যা থাহে। যার তারচোদন খাইয়্যা প্যাড বাজায়। অরে এহানে কাম দিছে কেডা?
গোলাপি
ব্রিক ফিল্ডে আছিয়ারে কাম করতে দেখে জোগানদাররা বুকসোজা করে খাড়ায়। স্বররে
তালগাছের মাথায় চড়ায় --‘এ্যাই বাজারীমাগীর লগে মোরা
কাম করমু না।’
ইটভাটায়
চলে আগুনের খেলা, জল ও
মাটির কুস্তি লড়াই আর কাস্তে-কোদালের কোলাহল। তাদের সামলায় জোয়ান-মরদ
শ্রমিক-মজুররা।তবে কেবল মাটিরে ময়দার মতো দলাইমলাইয়ে কাবু করার কাজে আছেকয়েকজন
কোমলাঙ্গী। নাজুক দেহী রমণী। খাতা-কলম তাদের নীরবেডাকে জোগানদার বলে।
এ
পদে আজ আছিয়ার অভিষেক। কিন্তু প্রথম দিনে তারে কামে দেখেবাকি জোগানদাররা
তেলে-বেগুনে জ্বলে। কেননা তারা সবাইস্বামীঅলী। আপন আপন মরদের সাথেই তারা ঘুমায় এবং
বছর বছরনা হলেও দু চারের পর পর পুত্র-কন্যা আমদানি করে। তাদের নিয়া ঘর-সংসারে
মাতে। কিন্তু আছিয়া ঠিক তার বিপরীত। তার স্বামী-সোয়ামিরঠিক-ঠিকানা নাই।
পুত্র-কন্যাদের হদিস অজানা। তাই বাজারের পোড়োঘরে একলা একলা রাত কাটায়। সুতরাং তার
সাথে কী করে বাকিদেরমেলে? তেলে
জলে খাপ খায়?
তাদের
প্রতিবাদ ভাটার দন্ডমুন্ডের কর্তা,
শ্রমিক-মজুর-জোগানদারগোভাষায় মা ও বাপ-- লতিফ কারিগরের কানে ঘা
দেয়। তার কোমর সজাগহয়। সোজা হয়ে খাড়ায়-- কেডা, আছিয়ারে
কামে বাধ সাধে কোনহউরের ঝি? যার উছিলায় দুইদিন পর ভাটা
রক্ষা পাইবে। মরতে বসাগোলাপি ফিল্ড জীবন ফেরত পাবে। তার কামে আগল ফেলে কোনশালী?
দ্যাহি........।
ভাটার
উম্মুক্ত ময়দানজুড়ে কাঁচা ইটের সমাবেশ। তাদের নধর দেহ, নাজুক অঙ্গ। পাজা কিংবা স্তূপের মতো গরিবি আয়োজনে
তাদের চলেনা। তাই একজনের ঘাড়ে আরেকজন মাথা রেখে শুয়ে জাফরি কাটাজানালার মতো রূপ
ধরে আছে তারা। তাদের দু সারির মাঝখানেরগলিপথ দিয়া লতিফ কারিগর ভাটার দক্ষিণ মাথা
পানে আগায়।সেখানে মাটির স্তূপ মাথা উঁচা করে খাড়া। তার গতর কেটে পানিতেমিশায়ে
ছুঁয়ে-ছেনে খামি তৈরি করায় মশগুল জোগানদারা। তাদেরমুখোমুখি হয় লতিফ কারিগর -- ‘আছিয়ার কী হাত-পাও নাই? গা-গতরেতাগতে কি কমতি আছে? হ্যায় কাম করলে তোমাগো কী অ্যাঁ? যার
রাস্তাহ্যায় মাপো। অরে কাম করতে দাও।’
হ, কারিগরের কথায় ক্ষুরধার যুক্তির জোরদার বসত। তারে
ঠেলে তোলাযায় না। কেননা আছিয়ার শরীর সুস্থ ও সবল। গা-গতরে তাগতেরবহর। তা চালায়ে
যদি দুইটা পয়সায় আঁচলের খুটরে তুষ্ট করে তাহলেকার কী ক্ষতি। সে তো আর কারো বাড়া
ভাত কেড়ে নিতে আসে নাই।কাউরে ছাঁটাইয়ের ঘরে ফেলে তো আর তারে বহাল করা হয়
নাই।সুতরাং তার কামে বাগড়া দেবার কী আছে। তবে সবচেয়ে বড়ো কথালতিফ কারিগরের সায়।
আছিয়ার প্রতি মুঠা পাকানো সমর্থন। ফলেআর কোনো পলেস্তরার দরকার পড়ে না। বরং তাতেই
মসৃণ হয়ে যায় সবখানাখন্দ। ঢাকা পড়ে সব ওজর-আপত্তি। তাই জোগানদারদের ফনাহাত-পা
গুটায়, নামায়ে নিয়া তারা নিজ নিজ কামে থিতু হয়।
লতিফ
কারিগর আগেও দু-চারবার আছিয়ারে দেখছে। আসা-যাওয়ারপথে বাজারের পোড়ো ঘরটাতে চোখ
পড়ছে। কিন্তু তাতো বাস-ট্রেনেচলার পথে আশপাশ দেখার মতো চোখের আগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে
যাওয়াকেবল। তাতে কী পথ-পাশের গাছপালা ভূঁই-ক্ষেতের সক্ষমতা মাপাসম্ভব? অথচ লতিফ কারিগরের চাই তা। আছিয়া উর্বরক্ষম
কতোখানি, তার দেহে বীজন রুইলে সে কেমন ফলন দেবে তার
নিখুঁত ও চুলচেরাহিসাবটাই তার দরকার। তাই সে দু চোখের পুরা ফোকাস মারে আছিয়ারগতর
পানে। তারা গজ-ফিতা হাতে তীক্ষ্ন থেকে তীক্ষ্নতর রূপনিয়া ছোটাছুটি করে। আছিয়ার
দেহের আনাচ-কানাচ মাপঝোপেরচেষ্টায় দৌড়ঝাপ জুড়ে দেয়।
শেষে
সিদ্ধান্ত নেয়-- না, আছিয়া
আর তন্বী-তরুণী নাই। পুরাদস্তুরমেয়েমানুষ। গা-গতরের স্থূলতার পথে দু-চার কদম
আগানো।একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন গুজরান করলেও শরীরের গোস্ত-মাংসরাবিরূপ না। তারা বেশ
যুৎসই মতো বসা। তবে ফর্সা-আলতার উঁকিঝুঁকিনাই গতরের এতোগুলা অঙ্গ-প্রতঙ্গের
কোনোটায়। আর পুরা দেহরেকাদা-মাটিতে ভেজা শাড়ি-ব্লাউজ প্রাণপণে জাপটে ধরে থাকায়
বুকেরসাইজ সহজেই চোখ মেলে তাকানো। কারিগর ভালো মতে দেখে নেয়-- সুডৌলের ঘরে তার বসত
না হলেও আবার জাঙলার কদুর রূপ ধরানাই।
তবে
এরে দিয়াই হবে। লতিফ কারিগর তার সিদ্ধান্তের পাকা খুঁটি গাড়ে।এই গাঁও-গেরামে এর
চেয়ে ভালো ফ্যাক্টরি আর কোথায় পাওয়া যাবে?
এতেই পেরান প্রোডাক্ট হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই।
কেননাচেহারা-সুরত যা-ই হোক, গতরের প্রোডাকশন কন্ডিশন
যুৎসই আছে।বাজার থেকে ডেকে এনে কাজে বহাল করার আগেই ভাটার লেবার সর্দারনজির মিয়া
পাকা খবর নিছে-- যন্ত্রপাতিতে কোনো ঘুণ নাই। মাসিকেরজোয়ার-ভাটা নিয়মিত চলছে। আর
তার আগের গোটা চারেকপ্রোডাক্টের প্রত্যেকটাই আছিল নিখুঁত। ল্যাংড়া-খোড়া, বোবা-কানাআছিল না একটাও।
।। দুই।।
সন্ধ্যার
স্বভাব খারাপ। সে সোজা পথে হাঁটে না,
নীরবে চলে না। বরংবানারিপাড়া-স্বরূপকাঠির বুক চিড়ে বাঁকের পর
বাঁকে ফেলে কলকল স্বরতুলে তার খরস্রোতা চলা। আর যে বাঁকে দীঘলকাঠি হাট, তার কোলঘেঁষা চরে গোলাপি ব্রিক ফিল্ড। দূর আকাশ পানে মুখ উঁচা করা
ইটতৈরির কারখানা।
তার
গোড়পত্তনি দিনে উদ্বোধনী আসর বসে চরজুড়ে। লম্বা সামিয়ানারউত্তর মাথায় পিঠ উঁচা করা
স্টেজ। এতো বড়ো চর, তারে
কী কম চেয়ারেবাগে আনা, বগল তলায় রাখা সম্ভব? তাই এমপি, ইউএনও, টিএনও,
চেয়ারম্যান-মেম্বর কেউ আর বাদ থাকে না। তাদের জন্য ঘাড়
তোলাচেয়ারের লম্বা সারি পড়ে স্টেজের এমাথা-ওমাথা জুড়ে। ভাটার মহাজনকবির বেপারিরে
দিয়া আসরের বক্তৃতার পালা শুরু হয়-- ‘মোরা
এ্যাইভাডায় দ্যাশের সেরা ইড তৈয়ার করতে চাই। হ্যার দেহো অইবে লোহারনাহান শক্তপোক্ত।
শতো শতো ঝড়-বাদল, বান-ভূমিকম্পেও
ভাঙবেনা। গতর অইবে গোলাপের নাহান লাল টকটকে। হাজার বছরেও ঘুণধরবে না। তার লাইগা
ভাডার নাম দিছি গোলাপি। ঐযে দ্যাহেন বিরাটসাইনবোর্ড-- গোলাপি ব্রিক ফিল্ড। দূর
থাইকা দ্যাহা যায়। নদীর ওপারথাইকাও নজরে পড়ে।
দুই
দুইটা গরু জবাই করা সারা। তাদের রান্নাবাড়ার আয়োজনও জোরকদমে আগানোর পথ ধরা। সুতরাং
সামিয়ানার তলে শ তিনেক লোকেরহাততালিতে আর বাধা কোথায়? তারা সজোরে সোৎসাহে করতালিবাজায়। তবে গোস্তের
ঘ্রাণে বেপারির জেয়ারের বউয়ের সাথে ফিল্ডেরনামের মিলের কথা হয়তো তারা ভুলে যায়। এ
সুযোগে বেপারির স্বরআরো জোয়ারি পথ ধরার, উৎসাহে ফেটে পড়ার
সুযোগ পায়-- ‘হেরলাইগা রাজধানী থাইকা কারিগর আনছি। হ্যার হাতের
লীলা অপূর্বো।ছোঁয়া পাইলেই ইড দেহো শক্ত করে। গোলাপি বরণ লয়।’
বেপারি
মঞ্চে লতিফ কারিগররে ডাকে। সবাই তারে দেখে--
ছোটখাটোমানুষ। তয় শক্তপোক্ত দেহ-কাঠামো। বয়স চল্লিশের ওপারে,
তাইবোধহয় চুলের অর্ধেকের বেশি সাদার ঘরে। তারে বেপারি সবার
সাথেপরিচয় করায়ে দেয়-- ‘রাজধানীর পাশের কালিয়াকৈরে
বাড়ি। ইড-ভাডার ঝানু কারিগর। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের হাজারখানেকভাডায় সাত দিন ধইরা
খুঁইজা খুঁইজা হ্যারে পাইছি। বড়ো কিমতি দিয়াআনতে অইছে। মোডা মাইনের লগে থাকা-খাওয়া
বিলাস-ব্যসনেরকোনো কিছু হ্যার লাইগা বাদ রাখি নাই।’
কবির
বেপারি দীঘলকাঠি হাটের নামজাদা ব্যবসায়ী। তার করতলে নানাকিসিমের গোটা দশেক দোকান।
আড়তদারি থেকে ফইরালি, মহাজনিথেকে
দালালি কোনোটাই আর বাদ নাই। তাই তার ব্যবসার অভিজ্ঞতারখুতি হাতিগেলা সাপের মতো
ফোলা-ফাঁপা। কিন্তু ভাটা সম্পর্কিত অংশচিমটা, সাতদিন
না-খাওয়া পেট যেনবা। অথচ ভাটা গড়া, সোনারবারের বলবান বড়ো
ভাই বানানোর শখ ষোলআনা। তাই দিন-রাতেরপথের ওপারে সুদূর কালিয়াকৈর থেকে
হাই-পেমেন্টে লতিফ কারিগররেভাড়া করে আনা।
উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানের ঝুট-ঝামেলা শেষে তার কাঁধে বেপারি হাত রাখে--‘গোড়াপত্তনি
অইয়্যা গেলো। এহন এরে, এ্যাই
ভাডারে আদর-যতনকইরা, দরকারে পিটাইয়্যা-পাটাইয়্যা মানুষ
করা গইড়া তোলার দায়িত্বতোমার। মোর বহু দিনের শখ ভাডা গড়মু। এ্যাই এলাকায়
এ্যাকটাওজাতের ভাডা নাই। অজাত-কুজাতে ভরা। তাগো গরভের জিনিসদ্যাখলে ঘৃণা করে।
ছুঁইতেও ইচ্ছা করে না। ইড তো নয় য্যানো চৌকোনামাডির ঢেলা। তাই মোর বাড়িতে বিল্ডিং
তোলার সময় শহর থাইকাট্রলার বোঝাই দিয়া ইড আনা লাগছে। তয় এহন যারা ঘর তুলবে,
দালান-কোডা বানাইবে তাগো কারো য্যানো আর শহরে ছুটতে না অয়।গোলাপি
ফিল্ডে আইয়্যা য্যানো হগোলে ধরনা দ্যায়। হেই বেবস্থা করো।তা অইলেই মোর শখ পুরন।
দ্যাশের উপকার দশের খেদমত।’
কারিগরও
সোৎসাহে ভাটার চাবিকাঠি হাতে নেয়। নিজের ঘাড়ে বসায়।কেননা তার ভালো করেই জানা, জাতের ভাটা গড়ে তুলতে পারলেমহাজন যে-ই হোক,
সাইবোর্ডে গোলাপি-টোলাপি যা-ই লেখা থাকুক নাকেন নাম হবে তার।
মুখে মুখে ছড়ায়ে পড়বে লতিফ কারিগরের ভাটা।তার ইটের জাতই আলাদা। সবার চেয়ে উঁচা।
নিজের গাঁও-গেরাম থেকেহাজার মাইল দূরে এমন একটা কীর্তি খাড়া করা গেলে আর কী লাগে?
এক জীবনে আর কোন কৃতিত্বের দরকার পড়ে? তাই
কারিগর আদাজলখেয়ে নামে। এখানে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র
বন্ধু-বান্ধবনাই। নাই মনোযোগ দাবি করার কেউ। তাই কারিগর পুরাটাই ভাটায়থিতু করে।
তারে গড়েপিঠে মানুষ করায় মনপ্রাণ ঢালে।
তবে
খেলা শুরু হয় ইট তৈরির পর। ভাটার গোড়াপত্তন শেষে যুৎসইমাটি সংগ্রহ, তারে যাচাই-বাছাই করা, তারপর
ইট বানায়ে পোড়াতেমাসখানেক কাটে। কিন্তু তার চেহারা-সুরত দেখে সবার চোখ
ছানাবড়া--হায়! এ কী অদ্ভুত দশা ইটের। যার না আছে কোনো লগইত, যুৎসইআকার-আকৃতি, না আছে সুশ্রী রং। শোনা যায়
মানুষের গর্ভে কখনোকখনো কিম্ভূতকিমাকার সন্তান জন্মে। তিন মাথাঅলা, দুই দেহ বিশিষ্ট।আরো যে কতো কিসিমের রূপ ধরে তারা জগতে পা দেয়। তেমনি
দ্যাখো, এই ভাটা একি বিচিত্র চেহারা-সুরতের ইট জনম দিছে।
খবর
শুনে সাত-সকালে মহাজন এসে হাজির। রাস্তার উপর মোটরবাইকদাঁড় করায়ে সে সরাসরি খোলার
মুখ পানে ছোটে। কারিগর তার পিছুনেয়। চুল্লির আগুনে জল ঢালা হয়েছে আগেই। গুটিয়ে
গেছে তারলেলিহান জিহ্বা। তারপর শিশির জলের হাতে পড়ে এখন সব ঠান্ডা।কাছে যাওয়ার, হাতে ধরে দেখায় আর কোনো বাধা নাই।
কবির
বেপারি পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূর থেকে ইট পানে তাকায়। অবাক বিস্ময়েতার চোখ বড়ো হয়ে যায়।
কপালে অসংখ্য ভাঁজ কেঁচোর মতো রূপ ধরেএমাথা ওমাথা জুড়ে শোয়।
পুরা
হাড়ির খবর লেখা থাকে প্রতিটা ভাতের গা-গতর জুড়ে। একটাটিপলেই সবার নাড়ি-নক্ষত্র
জানা হয়ে যায়। তাই বেপারি দু কদমআগায়ে খোলার মুখ থেকে একটা ইট হাতে নেয়। নেড়েচেড়ে
দেখে--কইতার স্বপ্নের ইট? লোহার
মতো শক্ত, গোলাপের মতো রং। এতো চকেরমতো ভঙ্গুর। চাপ দেবার
আগেই ভেঙ্গে ছত্রখান। আর রঙে তো একেবারেগোবর। কালশিটে গতর। ‘কারিগর! এ্যাই ইড কোন কামে লাগবে? কেডাকিনবে, অ্যাঁ?
এ্যাতো দিনের খাডাখাডনি সব বরবাদ। ট্যাহা-পায়সা সবমাডি। পুরাডাই
লোকসান।’
কী
জবাব দেবে লতিফ কারিগর। তার মুখও যে লা-জবাব-- এতো বছরধরে, বলা যায় জীবনের পুরাটাই কেটেছে ভাটায় ভাটায়। কতো
হাজারোরকমের ইট দেখা হয়েছে। কিন্তু তাদের এমন অদ্ভুত আকার-আকৃতিকখনো নজরে পড়ে নাই।
ভাটার গর্ভে এমন পোড়ামাটির ঢেলা জনমনিতে দেখা হয় নাই কোনো দিন।
কবির
বেপারি সে ঢেলা ছুড়ে দেয়-- অনেক হয়েছে ভাটা গড়ার শখ পুরণ।আর কতো? সে হনহন করে হেঁটে ভাটার বাইরে পা দেয়।
দীঘলকাঠিতেতার আরো কতো ব্যবসা পথ চেয়ে বসে আছে, তাদের
পানে বাইকছোটায়। দুপুরের মধ্যে হাটের আগামাথায় রটে যায়-- মহাজনের
ভাটায়বিকট আকারের ইট জন্ম নিছে। তার কোমর বাঁকা, চলতে
ফিরতেঅক্ষম। পিঠে উঁচা কুজো--ঠিক মতো দাঁড়ানোর সাধ্য নাই। আবারমুখজুড়ে কালশিটে
তিলের সমাহার। দেখলেই গা শিউরে ওঠে। চোখফিরায়ে নিতে হয়।
ভাটার
উত্তরপাশে টিনে ছাওয়া দুটো ঘর। তার একটায় বসে মকবুলম্যানেজার। হিসাব-পত্তর রাখা, মজুরি বন্টন করা তার কাজ।আরেকটায় লতিফ কারিগর
বসে। তার দরজা-জানালা পথে পুরো ভাটাখাড়া। চোখ রাখলেই সব নজরে পড়ে।
শ্রমিক-মজুর-জোগানদাররাকোথায় কী কাম করে সব চোখে ধরা দেয়।
মহাজান
চলে গেলে কারিগর এসে সে ঘরে বসে। নিজের সন্তান যতোইল্যাংড়া-খোড়া হোক, কুৎসিত-কদাকার হোক তার চেহারা-সুরত, তারেতো আর ফেলে দেয়া কিংবা গঙ্গাজলে বিসর্জন দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়াখোলা
খালি করার বিষয় আছে। আছে তাতে আবার নতুন করে কাঁচাইট সাজায়ে তাদের পাকা করার
উদ্যোগ আয়োজনে নামা। তাই কারিগরইট তুলে খোলা খালি করার অর্ডার দিয়া এসেছে। ঘরে
ফিরে জানালাপথে চোখ রেখে দেখে-- মজুররা খোলা থেকে তুলে ঝুড়ি বোঝাই করেগাঙপাড়ে নিয়া
রাখছে চৌকোনা মাটির ঢেলা। তারা একটার উপরআরেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্তূপ দিয়া উঠছে।
মহাজন
মুখ ফুটে না বললেও, ভদ্রতায়
মুখ এঁটে থাকলেও কারিগরবোঝে-- ঘাসপাতা খেয়ে তো আর নয়, ভাত-মাছ
খেয়েই তো বড়ো হওয়া, তাই না বোঝার কী আছে-- ইটের এই প্রতিবন্ধী দশার দায়ভার পুরাটাইতার। আবার তারে সারিয়ে তোলা,
আগামী খোলারগুলাকে সুস্থ-সবলকরার উদ্যোগ-আয়োজনের পথে হাঁটাহাঁটি
কিংবা দৌড়াদৌড়ি সবটাতার-ই করতে হবে। তবে সে পথে পা দেবার আগে বোঝা দরকার--পুরাএকখোলা, প্রায় হাজার পাঁচেক ইট কোন
দুঃখ-কষ্টে প্রতিবন্ধী হয়ে জনমনিলো? অর্টিস্টিক হয়ে জগতে
এলো ক্যান? তার কীর্তিস্তম্ভের মাথায়, একেবারে শুরুতেই এমন আজদাহা ঘায়ের কারণ কী?
কারিগর
তার হিসাব মেলাতে গিয়া উৎসে হাত দেয়--
তাহলে কী মূলেই, মানে বীর্যেই ঘুণ ছিল?
মাটিতে কোনো দূষণ? কিন্তু তা কী করে হয়?
মাটিতো পরীক্ষা করা। গা-গতরজুড়ে সরকারি অফিসের সিলমোহর আঁকা।
মনে
আছে ভাটার গোড়াপত্তনের পর মাটি দেখে সে মাথা নেড়েছে-- এ্যাইচরের মাটিতে বালুর আধিক্য। তারা গায়ে গায়ে
মেশে না। ছাড়াছাড়াভাব নিয়া জীবন পার করে দেয়। এ দিয়া জাতের ইট হবে না। তার জন্যচাই
আঁঠালো, সদ্য বিয়া করা বউ-জামাইয়ের মতো গায়ে গায়েজাড়াজড়ি
ধরে থাকা মাটি।
তখন
দূর থেকে ট্রলার বোঝাই করে মাটি আনা হয়। তারা ভাটার দক্ষিণমাথায় ঢিপ দিয়া ওঠে।
পাহাড়ের রূপ নিয়া খাড়ায়। তারে নিজ হাতেছেনেছুনে দেখেও তার মন পোষে নাই। তাই দুই
ঝুড়ি জেলা সদরেরঅফিসে পাঠায়। তারা তারে উল্টে-পাল্টে দেখে, গা-গতর টিপে যাচাই-বাছাই করে। মেশিনে ফেলে
অন্তরের খোঁজ-খবর নেয়। তারপরে গিয়াসার্টিফিকেট বানায়-- নো
অবজেকশন। ইটের জন্য পারফেক্ট।
সে
মাটিই তো ছেনেছুনে খামি বানায়ে কাঠের বাক্সে ভরে সাইজ করা।ইটের আকার-আকৃতি দেয়া।
তারপর পোড়ানো। তাহলে তার মধ্যে ঘুণথাকে কী করে?
এতোটুকু দুষণের সম্ভাবনা কোথায়? কারিগরের
হিসাবমেলে না। তাকে তাই নতুন পাতা খুলতে হয়--তাহলে কী গর্ভে থাকতেপুষ্টিকর
খাবার-দাবারের ঘাটতি আছিল? খোলার ভেতরে আগুনেরতাপ-উত্তাপে
কমতি? তাই ল্যাংড়া-খোড়া হয়ে জন্ম ?
কারিগর
কর গোনে-- গর্ভাবস্থায়, ইট
পোড়ানোর সময়কালে কখন কীখাবার লাগে, কতটুকু তাপ-উত্তাপের
দরকার হয় তা কী আর তারঅজানা? বরং এতো বছর ধরে হাজারো
গর্ভাবস্থার সেবা-যত্ন তত্ত্ব-তালাফির করায় এখন তা তার নখের আগায় খোদাই করা।
হাতেরতালুর রেখায় রেখায় আঁকা। তা দেখে দেখেই তো ব্যবস্থাপত্র দেয়া।আগুনের
তাপ-উত্তাপ বাড়ানো কিংবা কমানো। আর তাতে কোনোঘাটিত না পড়ে, কোনো গাফলতি দেখা না দেয় তাই নিজে টানা সাতদিনভাটায় কাটানো।
এমনিতে
কারিগরের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মহাজনের বাড়িতে।দীঘলকাঠি হাটের পুব মাথায় দোতলা
ভবনের এক রুমে। সেখান থেকেসকালে ভাটায় আসে,
আবার সন্ধ্যায় ফিরে যায়। কিন্তু খোলায় আগুনজ্বালানো, ইট পোড়ানোর পালা শুরু হলে সে আর সন্ধ্যায় ফিরে নাই।রাত-দিন চব্বিশ
ঘন্টাই ভাটায় কাটাইছে। নিজে আগুনের তাপ-উত্তাপমাপছে। কখনো কোথাও এতটুকু ঘাটতি
দেখলে সাথে সাথে পুরণ করেদিছে। সুতরাং খাবার-দাবারে কোনো কমতি, পুষ্টিতে কমতি হবার কথানয়। বরং গর্ভে বসে পেট পুরে খাবার জোগান,
আগুনের উত্তাপ পাইছে।কিন্তু তারপরও কেন তেরা-বাঁকা শরীর, মুখজুড়ে কালশিটে দাগ নিয়াজন্ম নেয়া, অ্যাঁ?
একটা
দুইটা না, শুধু
আগাটুকু কিংবা গোড়ামূল নয় বরং পুরা ঝাড়রে, খোলার এমাথা
থেকে ওমাথারে নিজের আয়ত্বে নিয়া ইচ্ছামতো বাঁকা-তেরা করার ক্ষমতা আর কার থাকতে
পারে? কারিগরের গালের হাতআর সরে না। তাহলে কী কোনো
দুষ্টগ্রহ, অশুভ আত্মা অসুচির ছিদ্রপথে, অযত্ন অবহেলার সুযোগে ঢুকে পড়ে ওদের মুখ-চোখ গা-গতরবিকৃত করে দিছে?
কারিগর এদেশে নতুন, এখানকার মানুষজন,
আত্মা-প্রেত্মাদের মতিগতি হাব-ভাব তার অজানা। তাই সে বড়ো হুজুর,
দীঘলকাঠি হাটের তিনতলা মসজিদের ইমাম সাহেব পানে ছোটে।
যদি
অশুভ আত্মাই ভর দেয়, তার
কারসাজিতে ইটেরা বাঁকা-তেরা রূপ নেয়। তাহলে তো সে আগামীতেও হানা দেবে। ধরালো
নখ-দাঁতে হামলাচালাবে। ভাটার একটা ইটরেও রেহাই দেবে না। সুস্থ-সবল হয়ে
জন্মাতেপারবে না একটা আধলাও। এমনকি যারা বানায়, শ্রমিক-মজুর
কারিগরতাদের উপরও চড়াও হতে পারে। পাশের গাঙে তাদের চুবাইয়্যা জাননিতেও কসুর করবে
না তখন। কারিগর তাই জোর কদম চালায়। বড়োহুজুরে কামেল লোক। শুক্কুরবার শুক্কুরবার
এমন বয়ান দেন, মুসল্লিগোচোখে পানি থৈ থৈ করে ওঠে। কারিগর
নিজেও দুইদিন অশ্রুজলে সামিলহইছে। রোজগারের ধান্দায় বউ-বাচ্চা রেখে এতো দূর দেশে
এসে চোখেরজল আর ধরে রাখতে পারে নাই। হুজুরের সাথে মোনাজাতে ফোঁপায়েউঠছে। এমন
জবরদস্ত হুজুর হাত বাড়ায়ে এক হাউডি দিলেই সবআত্মা-প্রেত্মারা ধরা পড়ে যাবে। তাই
তার পায়ের কাছে কারিগর হুমড়িখায়-- ‘হুজুর মোগো বাঁচান।
ভাডারে রক্ষা করেন। তার এ্যাকটা ইডওসোজা দেহে,
রঙিলা মুহে জনমায় নাই। তারে দুষ্ট আত্মায় পাইছে।শয়তানের ফেরে
পড়ছে। তারে আটকান।’
কারিগররে
ইমাম সাহেব পদতল থেকে তুলে পাশে বসান--‘শোনো
মিয়া! তুমি তো এ্যাই দ্যাশে নতুন। কয়দিন অয় আইছো। ওই চরের ইতিহাসতোমার জানার কথা
নয়। মোরা জানি। নিজের চোহে দ্যাহা। তারেদখলে নিয়া বগলতলায় রাখতে কতোজনের জান
গ্যাছে? বল্লমের ঘায়েরামদার কোপে কতোজন
পেরান হারাইছে? এগুলা সব অপঘাতে মরণ।তাগো আত্মারা কী আর
সুইস্থো আছে। হগোল অসুইস্থো প্রেতাত্মাঅইয়্যা গ্যাছে। তারা সুইস্থো-সবল কিছু
দ্যাখতে পারে না। হগোলরেঅসুইস্থো বানাইয়্যা দ্যায়। তাই ইডগুলা ব্যাঁকা-ত্যারা
অইয়্যা জনমাইছে।বুঝলা মিয়া।’
-- তাগো
বোতলবন্দী কইরা দ্যান।
-- ক্যামনে
অ্যাঁ? আত্মা অইলো আল্লার নিজের হাতের তৈয়ার। তাগোতাই মরণ
নাই। হ্যারা অমর। তাই আগুনে পোড়ে না। পানিতে ডোবেনা। হাওয়ায় হাওয়ায় ভাইসা বেড়ায়।
-- তাগো
তাড়াইয়্যা দূর করি কী উপায়ে?
-- মাহফিল
দাও। তিনদিনের ওয়াজ মাহফিল। বড়ো বড়ো আলেম-ওলামাগো ডাকো। তাগো আদর-যতন করো। খুশি
কইরা দ্যাও। দ্যাখবাতাগো মুহের পাক-পবিত্র কথায়, আল্লা-রসূলের
বয়ানে হগোলপ্রেতাত্মারা দূর অইয়্যা গ্যাছে। মাইকে হ্যাগো মুহের আওয়াজ যতোদূরযাইবে
হ্যার মইদ্যে আর আওয়ার সাহস পাইবে না। তারপর শ্যাষদিনআখেরি মোনাজাতে দাও। পির
সাবরে ডাকো। গাঙের ওপাড়েই তোআছেন কামেল পির। হ্যায় আখেরি মোনাজাত ধরলে বদআত্মাগো
আররক্ষা নাই। আওয়াজ যতোদূর যাইবে খুডি পোতা অইয়্যা যাইবে। কোনোবদআত্মা আর আগাইতে
পারবে না। ভাডার হাওয়া পাক-পবিত্র অইয়্যাযাইবে। ইডেরাও তহন কেতাদুরস্ত অইয়্যা
জনমাইবে। হেয়া বেচলেমহাজনের খুতি ফুইল্যা উডবে দ্যাখবা। যাও, আয়োজন করো। আরআল্লার উপর ভরসা রাখো। সব মুসকিল আসান অইয়্যা
যাইবে।ইনশাল্লা।
ওয়াজ
মাহফিল! মহাপুন্যের কাম। সওয়াবের ঢল। কবির মহাজনএকবাক্যে ঘাড় কাতায়। জেলা-উপজেলা ও
সদর থেকে আলেম-ওলামাভাড়া করে। গাঙের ওপার থেকে পির সাবরে।
গ্রামসংলগ্ন
চর তাই আশপাশের চৌদ্দগাঁও থেকে লোকজন সমবেত হয়।ট্রলারে গাঙ পাড়ি দিয়াও আসে। ফলে
ভাটার দক্ষিণে খাড়া করাসামিয়ানার খুঁটি পায়ে পায়ে আগায়। আখেরি মোনাজাতের দিন
জোরকদম চালায়। তারা যতোদূর আগায় তার পুরাটাই মহাজনের বগলতলায় চলে আসে। এমাথা ওমাথা
জুড়ে বিঘা পাঁচেক চর-জমি ভাটারসাথে জয়েন করে। গলাগলি দিয়া শুয়ে আগামী মৌসুমে তরমুজ
চাষেরজন্য উম্মুখ হয়ে থাকে।
।। তিন।।
সঙ্গমের
শীর্ষে আরোহণ করে নগ্ন আছিয়ার বুকের ওপর গোড়াকাটাকলাগাছের মতো ধসে পড়ার পর লতিফ
কারিগর নিশ্চিত হয়-- পেরানপ্রোডাক্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়ে গেছে। কেননা একে
তো দিনক্ষণহিসাব করে, মাস-পিরিয়ড
হাতের মুঠায় পুরে আসা। তারপর শুরুথেকেই আছিয়া যেভাবে শরীর মোচরাইছে, সাগরের ঢেউয়ের মতোউথাল-পাথালে নাচাইছে, মুখে
শীৎকার-চেচামেচি ধ্বনিতে গলা তুলছেতাতে সন্দেহ-সংশয়ের আর কোনো জায়গা নাই। চার
চারটা প্রাণপ্রোডাকশনের অভিজ্ঞতায় সম্মৃদ্ধ কারিগর নিশ্চয়তার খুঁটি গাড়ে--
কেল্লাফতে! ভিত্তিপ্রস্তর একেবারে মূলে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন শুরু হবেআল্লার কুদরত,
তার অপার মহিমা। তিনি ভিত্তির উপর একটু একটুপলেস্তরা ফেলবেন,
গা-গতরের আকার দেবেন। তবেই দশমাস দশদিনপর একেবারে ফিনিশড
প্রোডাক্ট, চার হাতপাঅলা সজীব প্রাণ হাজিরহবে।
কারিগর
তাই নিশ্চিত মনে আছিয়ার বুক থেকে ওঠে। খুলে রাখাজামাকাপড়ে কেতাদুরস্ত হয়। শেষে
আছিয়ার পানে এক গোছা নোটআগায়ে দিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের ইতি টানে--‘নে ধর।ভালোমন্দ যা মন চায় খাইস। তয় সাবধানে চলাফেরা
করবি। য্যানোঝইড়া না যায়। এ অমূল্য ধন। এরে যতনে ধইরা রাখবি।’
আছিয়ার
ঘর থেকে বার হয়ে কারিগর হাটের ওমাথায় চাল পট্টির পথধরে। সেখানে লম্বা ঘরে করিব
মহাজনের টাকার কারখানা-- হাটেরবৃহত্তম
আড়ত। টিনে ছাওয়া ঘরের ছাদঘেঁষা চালের বস্তার মাঝে পাতাচৌকিতে মোটা গদি। এখন
নিশ্চয়ই তাতে বসে ক্যাশবাক্স আগলেদিনের হিসাবে ব্যস্ত মহাজন। তারে সুখবরটা দেয়া
দরকার-- বেপারিসাব! আরেকটু ধৈর্য ধরেন। দশটা মাস মাত্তর। তারপরই আপনারভাটায় সোনা
ফলবে। আপনার দু চার খোলা বাঁকা-তেরা ইটের ক্ষতি, গন্ডা
কয়েক লোকসান তহন সব সুদেমূলে আইয়্যা আপনার খুতিতেবসত নিবে। ব্যাংক একাউন্টে বুক
ফুলায়ে খাড়াবে। সে ব্যবস্থা কইরাআইলাম এ্যাই মাত্তর। আলেম-ওলামা দিয়া দোয়া-দরুদের
জোয়ারবসাইলেন, তিনদিনের মাহফিল দিলেন, তাতে কাম হয় নাই। কিন্তুএ্যাইবার অইবে। তাজ ওস্তাদের মাসুম ও নিষ্পাপ
দাওয়াইয়ের ব্যবস্থাকরছি। মূল অনুপানের চারা রোপন কইরা আইলাম এ্যাই মাত্তর। ফলদিবে
দশ মাস দশ দিন পর। এ্যাই কয়ডা দিনের অপেক্ষা কেবল।তারপর ফলডা ভাটারে খাওয়াইলে
দ্যাখবেন তার কারিসমা, দাওয়াইয়ের তাকত। ভাটা ক্যামনে
খোলার পর খোলা আপনার স্বপনেরইট, লোহার নাহান শক্ত,
গোলাপের নাহান রঙিন চারকোনা বার জনমদ্যায়।
তয়
স্বীকার করতেই হয় হুজুর সাহেবরা, আলেম-ওলামা-পিরগণখাটাখাটনি কম করেন নাই। চেষ্টারে তারা তাদের সাধ্যের
চূড়ায় নিয়াগেছিলেন। টানা তিনদিন তারা গলা ফাটাইছেন। অশুভ আত্মারপিছনে দৌড়ে
বেড়াইছেন। তারপর খোলায় নতুন করে কাঁচা ইটসাজানোর পর চুল্লির মুখে আগুন দেবার দিন
আবার ফুঁ দিয়া গেছেন।দোয়া-দরুদ পড়ে খোলার মুখে মুখ ঘুরাইছেন। কিন্তু কামের কাম
কিছু হয়নাই। পোড়ানো শেষে হলে দেখা যায়-- যে কে সে-ই। আগের
মতোই ইটেরবাঁকা-তেরা দেহ। কালশিটে মুখাবয়ব।
তাদের
চেহারা-সুরত দেখে তো করিব মহাজন রীতিমতো হাউমাউ করেওঠে। দিনে দুপুরে কপাল চাপড়ায়-- ‘হায় খোদা! একী অইলো? আগেরখোলার এ্যাকটা ইটও বেচা অয় নাই। গাঙপাড়ে থুপ
দিয়া আছে।আবার এ্যাই খোলাও কানা-খোড়া। হায় আল্লা! বেবসাপাতি হগোলশ্যাষ। লোকসানের
উপর লোকসান।’
বিলাপের
মাথায় গিয়া মহাজন কারিগররে ডাকে-- ‘শোনো!
দোয়া-দরুদ, ওয়াজ-মাহফিল
গিট্টু বান্ধে নাই। ফসকাইয়্যা গ্যাছে। এহন দাওয়াইধরো। ডাক্তার ডাকো, ধন্বন্তরী করিরাজরে খবর দাও। তাগো ভাডাদেহাও। জিগাও, ভাডার মাথার কোন খতিয়ান খারাপ, প্যাডের
কোনখাতে কী গন্ডোগোল।’
ওস্তাদের
যেমন ওস্তাদ থাকে লতিফ কারিগরের তেমন তাজ মিয়া। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের হাজারো
কারিগরের গুরু। তার নামে ভাটারজগতে সালামের জোয়ার বয়। আবার তার দাওয়াই ধন্বন্তরী।
নামশুনলেই সাত বছরের মরা ভাটা সোজা হয়ে খাড়ায়। তার দুই ডোগদাওয়াই খেয়ে খোলার পর
খোলা সোনার বরণ ইটের জন্ম দেয়। তারাএকটু চিত-কাত হয়ে শুলে তবেই রাজধানীর উঁচা উঁচা
বিল্ডিংগুলাশিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
আর
কোনো উপায়ের খোঁজ-খবর না পেয়ে শেষে গুরুরেই ফোন দেয়লতিফ কারিগর--‘ওস্তাদ! মোরে বাঁচান। আইছিলাম কীর্তি খাড়া করতে।ইচ্ছা
আছিল এমন ভাটা গড়মু ভূ-ভারতে তার নাম ছড়াইয়্যা পড়বে।হগোলে এ্যাক নামে চিনবে। এহন হে
স্বপন তো ধুলায় মিইশ্যা গেছেইবরং নিজের জান লইয়্যা টানাটানি শুরু অইছে।’
-- ক্যান
কী অইছে আবার?
-- কাইল
রাইতে মহাজনে খাস কামরায় ডাইকা নিয়া হুমকি দিছে।আঙুল উঁচা কইরা কইছে--ভাডা ঠিক কইরা, হ্যার অসুখ-বিসুখ দূরকইরা না
দিলে মোর জান আস্তো রাখবে না। কবজ কইরা ফালাইবে।এ্যাই কয়দিনেই বুঝতে পারছি
দক্ষিণের এরা চউর্যা জাত। বেপারিরমুখোশ পইরা থাহে। আদতে হগোল ডাকাইত। খুন-খারাবি
পেশা। দিনেদুপুরে যে কাউরে ফিনিশ কইরা দিতে পারে। মোর জান লইয়্যা চরেরমইদ্যে
পুইত্যা ফালাইলে কিংবা গাঙে ভাসাইয়্যা দিলে কারো কিছু করারথাকবে না।
-- তুই
ভাইগা পর। চইল্যা আয়।
-- ক্যামনে
যামু? মোর লগে ফেউ লাগাইছে। সারাক্ষণ পিছে পিছে
থাইকানজরদারি করে। আপনে আহেন, ভাডারে দ্যাইখা-শুইন্যা
দরকার অইলেটেস্ট-টোস্ট কইরা দাওয়াই দ্যান। মহাজনে কইছে খরচাপাতি যা লাগেদিবে।
অনুপান যা দরকার হয় জোগাড় কইরা আনবে। আপনে আহেন।মোরে উদ্দার করেন।
শিষ্য
ডাকলেই কি ওস্তাদে ছুটতে পারে? তাতে কি তার ওস্তাদি ভাঁজথাকে? তাই লতিফ
কারিগরের আরো দুইবার কল দিতে হয়। তিনবারেরমাথায় গিয়া এক সন্ধ্যায় তাজ ওস্তাদ
সদরঘাট থেকে জলযানের আশ্রয়নেয়। তা আবার মেঘনায় পা দিতেই শিষ্যরে কল লাগায়--‘কীরেলতিফ্যা! তুই মোরে কই ডাকতাছো। এ্যাতো দ্যাহি
গাঙের সীমা-সদ কিছুই নাই। এপার ওপার দ্যাহা যায় না। জাহাজ ডুবলে আর বাঁচারউপায়
নাই। এ্যাই বুড়া বয়সে মোরে গাঙে ডুবাইয়্যা মারার মতলবআঁটছো, অ্যাঁ?
-- না
ওস্তাদ, জাহাজ ডুববে না। এহন শীতের রাজত্ব। তার কড়া
শাসনেমারা সাপের নাহান দশা এহন গাঙের। কোনো ঝড়-তুফান ঢেউ নাই।আপনে নিশ্চিন্তে ঘুম
দ্যান। সাত-সকালেই দীঘলকাডি আপনার সামনেখাড়াইবে। মুই ঘাডে হাজির থাকুম নে।
জলযানে
চলাচলে অনভ্যস্ত তাজ ওস্তাদ পরদিন সকালে মাটিতে পাদিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে--কই তোর ব্যামোঅলা ভাডা? ল’ দেহি হ্যারচেহারা-সুরত ক্যামন?
তাজ
ওস্তাদে তিনদিন ধরে তার রোগী দেখে। গোলাপি ভাটার গা-গতরটেপে। এমাথা ওমাথায় সায়ের
করে বেড়ায়। জিহ্বায় চোখ রাখে। খোলারমুখে চুল্লির ভেতরে মনোযোগে তাকায়। হৃদকম্পনের
খোঁজ-খবর নেয়।হাতের মুঠোয় মাটি নিয়া পরখ করে। তারপর গিয়া পুরা এক রাতঅবজারভেশনে
নামে। সারাটা রাত ভাটায় কাটায়। নির্জন নিশিতেরোগীর সাথে নিভৃতিতে কথা কয়। খোলামেলা
আপাদমস্তক বাতচিতযারে বলে। পরদিন সকালে শিষ্য লতিফ কারিগরের কাঁধে হাত রাখে--‘নতুন মাটিতে নতুন ভাটা। ভোগ ছাড়া তার তুষ্টি হয় কী
কইরা? ব্যামোছাড়ে ক্যামনে? জ্যান্ত পেরান তার ভোগ চাই।’
গুরু
কথায় লতিফ কারিগরের চোখ বড়ো হয়-- ‘অ্যাঁ, ওস্তাদে কী কয়? একেবারে
জ্যান্ত পেরান?’
--ভোগের
কথায় য্যানো অবাক হইলি? দ্যাশজুড়ে যে এ্যাতো বড়ো বড়োভাটা,
নামী-দামী ইটের কারখানা। তার একটাও কী ভোগ ছাড়াখাড়াইছে? কিন্তু তোর ভাটার ব্যামো বড়ো কঠিন। মনোবিকার ভয়ংকর।তারে তৃপ্ত করার,
তার ব্যামো দূর করার লাইগা চাই দামী প্রসাদ। নামীনৈবেদ্য। ক্যান
তোর মনে নাই খদরপুর ভাটার কথা। তুই তো পুরাডামৌসুম মোর লগে আছিলি। দ্যাখছো সব
কিছু।
মনে
না থাকার কোনো কারণ নাই। লতিফ কারিগরের সে ভাটাতেইপ্রথম এ লাইনে কাম শুরু। গাজীপুর
সদর থেকে ভেতরে বনের কোলঘেঁষে খদরপুর। তার খোলা মাঠে ধানের জমি কেটে ভাটা পাতে
আয়নালমহাজন। তাজ ওস্তাদরে হায়ার করে নিয়া মেইন কারিগর বানায় আরলতিফরে লেবার
সর্দার। সে কতো সাল আগের কথা। লতিফ কারিগরকর হিসাব করে গুনে গুনে দেখে-- উনিশ পার, বিশে পা।
কিন্তু
খেতের মাঝখানে একলা ভাটা। আশপাশে আর কেউ নাই।একেবারে নিঃসঙ্গ। তাতেই বোধহয় তার
মনোবিকার দেখা দেয়। তাইতার প্রোডাক্ট ইট হয় শিখিল, শক্তপোক্তবিহীন। আবার তাপ-উত্তাপেজোর দিলে,
দুদিন বেশি চুল্লিতে রাখলে হয় দোমড়ানো মোচড়ানো কালোপিন্ড। এক
কথায় ঝামা।
--তার
মনোবিকার কাটে কী কইরা ওস্তাদ?
-- কী
করে আবার ভোগে। এ্যাকেবারে জ্যান্ত প্রসাদ পাইয়্যা তবেই তারতুষ্টি হয়। মনে নাই,
ভাটায় যে নাদুস-নুদুস ছেলেটা আছিল। রাস্তাথাইকা তুইলা আইনা
লেবারিতে বহাল করছিলাম। খোঁজ নিয়া দ্যাহিতিন কূলে তার কেউ নাই। ছয় মাসেও কেউ তার
খোঁজ-খবরে আসেনাই। তাই এক নিশুতি রাতে তারে চুল্লিতে দেই। সামান্য
ধাক্কাতেইএকেবারে মুখের ভেতরে চালান অইয়্যা যায়। দ্যাহি, আগুনের
লকলকেজিহ্বা তারে টাইনা নেয়। মুখের গহ্বরে নিয়া চাইটাপুইটা খায়। নরম কচিহাড্ডিও
হজম কইরা ফালায়। তারা সব ছাইয়ে রূপ নেয়। ...... তোরএহানে বাপ-মাবিহীন ঘরছাড়া কেউ
নাই? কোনো কুলি-মজুর? নাথাকলে
নিজেই বানাইয়্যা ল। পেরান প্রোডাক্ট কইরা নে। ইবরাহিম নবিরপথ ধর। নিজের ঔরসের
জাতরে কোরবানী দে। তাতে ফায়দা বেশি।দেবতাকূলের তুষ্টি বিপুল। ল্যাওড়ায় জোর আছে না?
না থাকার কীআছে? বয়স তো পঞ্চাশও পার হয়
নাই। তাহলে এহনই নাইমা পর।হাডের কোনায় দ্যাখলাম এক ছাড়া মাগী। লগে মরদ কেউ নাই।
তারেকব্জা কর। ভাটায় কাম দে। হাতের মুডায় লইয়্যা ল’।
হেরপর সুযোগমতো, গোন
বুইজা, পিরিয়ডের হিসাব-নিকাশ কইরা পেরানের ভিত্তিগইড়া দে।
হেরপর তোর আর কিছু করতে অইবে না। বাকিডা আল্লায়কইরা দেবে। দশ মাস দশদিন পর আস্তো
পেরান তোর হাতে আইয়্যা ধরাদেবে। একবারে খাঁটি নিষ্পাপ মাসুম ভোগ অইবে। ভাটায় একবার
তারস্বাদ পাইলে জীবনে আর ভুলবে না। জনমভর সোনার বরণ চারকোনাবার জনম দিয়া যাইবে।#
লেখক
পরিচিতি
জিয়া
হাশান-এর জন্ম ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের পিরোজপুর শহরে।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্সপাস করে সাংবাদিকতায় পা দেন। আট বছর নানা
পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতা শেষে তিনি বিভিন্ন সংস্থায় যোগাযোগ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ
করেছেন। বর্তমানে আছেন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল স্কলাসটিকায়।
তার
লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: সোনায় সোহাগা কাহিনি ( গল্পগ্রন্থ)জোছনার সাথে মোলাকাত
ও অন্যান্য ( স্মৃতিগদ্য) খেয়ালি ভুঁই ও তারফসল বিন্যাস (গল্পগ্রন্থ), সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথাহয়
(গল্পগ্রন্থ), শোনো বাতাসের সুর ( হারুকি মুরাকামির
উপন্যাসেরঅনুবাদ) পাসপোর্ট (হার্তা মুলারের উপন্যাসের অনুবাদ) বাঁক বদল (মোইয়ানের
উপন্যাসের অনুবাদ) চোর দেখার ফাঁদ (কিশোর গল্পগ্রন্থ) বুড়িগঙ্গায় কালো জাহাজ
(কিশোর গল্পগ্রন্থ) এবং নির্বাচিত ছোটগল্প ( সম্পাদনা)।
1 মন্তব্যসমূহ
অনেক কসরত ছিলো গল্পে, আপনার ভালো লিখার শক্তি টের পাওয়া যায়, যদিও এটা খুব ভালো লিখিত গল্প বলা যাবে না। শুভ কামনা।
উত্তরমুছুন