আমি তখন পাশের ঘরেই ছিলাম। সে যদি চিৎকার করত, চলে আসতাম, কাপড় পোড়ার গন্ধ বিকট হয়ে ধুপের গন্ধ ছেয়ে ফেলল যখন, আমি টের পেলাম।
ধুপের গন্ধ ?
হ্যাঁ। কমল সরকার অন্যদিকে ফিরে কথাটা বলল।
ঘরে কি ধুপ জ্বলছিল ?
হ্যাঁ, চামেলি ধুপ, আমার বউ ওই ধুপ ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করত না, খুব উগ্র গন্ধ, ধর মরা ইঁদুরের গন্ধও ঢেকে দিতে পারে । কমল সরকার বললেন।
কমলের বয়স ৬০-৬২-র আশপাশে। অনেক টাকা নিয়ে রিটায়ার করেছেন। ছেলে আর তার বউ থাকে দিল্লি। কমলের স্পন্ডিলাইটিস খুব বেশি। এতে তার মাথা ঘোরে। চোখ অন্ধকার করে আসে। নিচের দিকে তাকানর উপায় নেই। শীর্ণকায় মানুষ, গলায় কলার লাগানো। কলার খোলা ছিল তখন। কিন্তু যখন দেখলেন নীলা পুড়ে যাচ্ছে মেঝেয় পড়ে, মাথা ঘুরে গিয়েছিল। মাথা ঘুরে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। মাথার সামনে ক্ষত হয়েছিল। রক্তপাত হয়েছিল। তিনি আর্তনাদ করে ডেকেছিলেন কাজের লোক নিভাকে। নিভা ছুটে এসেছিল উঠন থেকে। সে ছিল কুয়োতলায়। সেই আগুন ছিল চতুর্থবার।
কমল সরকার কথাগুলি বলছিলেন তাঁর বাল্যকালের বন্ধু অখিলকে। অখিল এসেছেন কলকাতা থেকে। অখিল লেখেন। অখিলের লেখা কমল কিছু পড়েছে। একটা লেখা পড়ে কমল সংবাদপত্রে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠি অখিলের কাছে গিয়েছিল। তারপর অখিলের আসা আজ এতদূরে। অখিল যে এত দূরে, এই ন’পাহাড়ি আসবে তা কমল ভাবেননি। এই রুখাসুখা জায়গায় যে কমলের বাড়ি হাঁকিয়ে বসে আছে তা অখিল ভাবেনি। ন’পাহাড়ি নামটি তাকে টেনে এনেছে এখানে। বেশ বড় বাড়ি কমলের। পরিকল্পনা ছিল একতলায় তাঁরা থাকবেন, দোতলায় ছেলে। একটিই সন্তান তাঁর। এখন দিল্লিতে। ফলে দোতলা বন্ধ থাকে। একতলায় নেমে এসেছেন তিনি স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে। না হলে দোতলা তাঁর পছন্দ ছিল। দোতলার ঘরের জানালা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। পাহাড়ি এক ঝোরা আছে অনেক দূরে। বালিতে ঢাকা তার শাদা বুক দেখা যায় জানালা দিয়ে। ওই নদীর একটা শাখা নাম তমালি। এ তো শাল-পিয়ালের দেশ। পলাশের দেশ। অখিল তাঁর সঙ্গে ঘুরছিল, ন’পাহাড়িকে চিনে নিতে চাইছিল।
এখন বেলা পড়ে গেছে। কমলের বড় বাগান আছে। বাগানে নিম, আম, কাঠাল গাছ আছে। বাজপড়া একটি তাল গাছ। কমলের কাছে অখিলের আসার উদ্দেশ্য অন্য। ন’পাহাড়ি নিয়ে একটা লেখা হবে, কমলের সঙ্গে দেখা হবে। কমল কলকাতা ছেড়ে এখানে চাকরি করতে এসে সস্তায় পেয়ে গোটা একটা বাড়িই কিনে নিয়েছিল। তার বাড়ি ছিল না। উত্তর কলকাতার এক বাসাবাড়িতে সে বড় হয়েছে। তার বউ ছিল এক উদ্বাস্তু কলোনিতে দর্মার বেড়া আর টালির চালের নিচে বড় হওয়া মেয়ে। ন’পাহাড়ি জায়গাটি তাদের খুব পছন্দ হয়েছিল। উপরি পাওনা এই বাড়ি। বাড়ির মালিক একা থাকতেন। বিক্রি করে বাঁকুড়া চলে গেলেন। অখিল নেমেছিল ছাতনা রেল স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেকার নিয়ে এসেছে তাকে এখানে। অখিলের মনে হচ্ছিল তার এমন একটি বাড়ি থাকতে পারত। কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে চলে আসত। কদিন থেকে আবার ফিরে যেত। নিজের এমন বাড়ি হবে কমল বা তার স্ত্রী নীলা ভাবেনি কখনো।
অখিল বলল, সে ধুপের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
কমল সরকার বলল, সে-ও না, তারপর আর ধুপ এবাড়িতে ঢোকে না। আসলে নীলার জোরাজুরিতেই এই বাড়ি কেনা হয়েছিল। বাড়ির মালিক বিক্রি করে ন’পাহাড়ি ছেড়েছিলেন। তিনি ছিলেন ব্লক অফিসের বড়বাবু। রিটায়ার করে দম্পতি চলে গিয়েছিলেন নিজের দেশ রাণাঘাটে। এই বাড়িতে তারা যখন আসে তখন তাদের পুত্র সন্তানের বয়স তিন মাস। সেই সময়ই প্রথম ঘটে ঘটনাটি। এই বাড়িতেই ঘটে।
অখিল দেখলেন ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। বৈশাখের দীর্ঘ বেলার অবসান হল। তাঁরা ঘরে ফিরে এলেন। দোতলায় উঠলেন। তাঁরা এখন উপরেই থাকবেন। বড় বড় জানালা, প্রচুর বাতাস। ঘরে এসে বসলেন। অখিল ও কমল উত্তর কলকাতার একই অঞ্চলে বড় হয়েছিলেন। অখিল যান সাংবাদিকতায়, কমল যান সরকারের চাকরিতে। দূর থেকে অখিলের লেখা পড়েছেন কমল অনেক। কিন্তু কোনোদিন তাঁকে চিঠি লেখার কথা ভাবেননি। নীলার মৃত্যুর পর একা হয়ে গিয়ে কী মনে করে খবরের কাগজের ঠিকানায় লিখলেন। নীলার কথা বলবেন।
এই পাহাড়ি অঞ্চল দিবাভাগে পাথরের কারণেই তেতে উঠতে উঠতে আগুনের কুন্ড হয়ে থাকে। রোদ পড়লে সেই আগুনের তেজ কমতে থাকে। পাথর ঠান্ডা হয় একটু একটু করে। রাত বাড়লে আরো। তখন বাতাসও ঠান্ডা। অখিল দত্ত জানালা দিয়ে দেখলেন দূরে চাঁদের আভাস। আজ কি পূর্ণিমা ?
হ্যাঁ। বললেন কমল। অখিল তাকিয়ে ছিলেন চাঁদের দিকে। তখন কমল বললেন, আমরা যখন এই বাড়িতে আসি, তার সাতদিন বাদে এক সন্ধ্যায় চাঁদ দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিল নীলা, ‘আগুন আগুন, কোথায় আগুন ধরেছে গো।’ সেই প্রথম।
অখিল দেখলেন কমল অতি শীর্ণকায়। গলায় কলার জড়ান। চোখ দুটি ঘোলাটে। বয়স যা তার চেয়ে বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। পায়জামা পাঞ্জাবি পরা কমলকে কাক-তাড়ুয়ার মতো লাগছে। কত রুগ্ন! কমল বলছে, ভয় পেয়েছিল নীলা। তারপর অবশ্য স্বাভাবিক হয়ে হেসেছিল। তার মনে হয়েছিল সত্যিই আগুন লেগেছে দূরে কোথাও। চাঁদ তেমনিই আগুনের গোলা হয়ে ভেসে উঠেছিল পুব আকাশে। সেই প্রথম জানল কমল যে আগুনে খুব ভয় নীলার। কিন্তু আগুনে কারই বা ভয় নেই মৃত ব্যতীত! খুব ছেলেবেলায় নীলাদের উদ্বাস্তু কলোনিতে আগুন দিয়েছিল জমিখোরের নিয়োগ করা মাস্তানরা। স্মৃতিতে তা ছিল। আগুনে সব ছাই হয়ে যায় যদি। সেই বছর চৈত্রের এক দুপুরে নীলা আবার ডেকেছিল কমলকে, ‘দেখে যাও, আগুন লেগেছে ওদিকে, ইস, সব ছাই হয়ে যাবে’।
আগুন নয়। পলাশবন সিঁদুরে লাল হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছিল। কী তার রূপ। তুমি ক’দিন বাদে এসেছ অখিল। পলাশ আর নেই। আমি পলাশ বনের রূপ দেখি একা। কিন্তু এবার আর দেখিনি। জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ওই সময়, ছ’ মাস হয়েছে তখন, নীলা চলে গেছে।
কাজের জন্য একটি ছেলে আছে, সে সাজিয়ে দিল সব। হুইস্কি, সোডা, চিকেন ফ্রাই, শসা, আপেল কুচি। কমল বললেন, নীলা পছন্দ করত না, কিন্তু আমি বন্ধুর সঙ্গে নিয়ে বসলে কিছু বলতও না।
নীলার কী হয়েছিল ?
কমল বললেন, আগুন।
আগুন মানে ?
পুড়েই মারা গেল শেষ পর্যন্ত, দেখ অখিল, আগুন ছাড়া কি জীবন চলে ?
অখিল জিজ্ঞেস করল, আগুন ছাড়া জীবন চলে কি না আমি জানি না।
আগুন আবিস্কারের পর মানুষ সভ্যতার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসেছিল, কাঁচা মাংস খাওয়া বন্ধ হলো, তাই তো। কমল বলল।
অখিল শুনছিল। ঘাড় কাত করে সায় দিল।
আমি খুব রাগি মানুষ, নীলারও রাগ ছিল, কিন্তু অখিল আমাদের ভিতরে কলহ হতো না।
তাহলে একজনের ভিতরে আগুন ছিল না।
কমল সরকার বলল, ছিল না আমার ভিতরে, থাকলেও দপ করে জ্বলে উঠে নিভে যেত, আমি সংসার করতে খুব ভালোবাসি অখিল।
অখিল ধীরে ধীরে সিপ করছিল। কমলও তাই। অখিলের মনে হচ্ছিল ছাদে যায়। কিন্তু কমলের অসুবিধে হবে। সে নিচের দিকে তাকাতে ভয় পায়। মাথা ঘোরে অথচ দোতলায় উঠলেই ব্যালকনি তাকে টানে। সে বলছিল, অখিল আমি যদি ব্যালকনির দিকে যেতে চাই, তুমি আটকাবে। আমি নিচেই থাকি, উপরে উঠি না ওই ভয়ে।
ছাদে যাবে, আমি নিয়ে যাই।
কমল বলল, আকাশে তাকালেই মনে হবে আমি পড়ে যাচ্ছি, কী খারাপ অসুখ আমার!
অখিল জিজ্ঞেস করল, তোমার বউ শেষ পর্যন্ত ! বাক্য অর্ধ সমাপ্ত রাখে অখিল।
না পারেনি অখিল, সারাদিন পুজো-আচ্চা নিয়েই থাকত, বাড়িতে শুধু ধুপের গন্ধ, অখিল আমি পাশের ঘরে ছিলাম, সে কেন ডাকেনি আমাকে?
তোমার বউকে তোমার পছন্দ ছিল ? অখিল জিজ্ঞেস করল।
ভালোবাসতাম, তবে আমি একটু উদাসীন ছিলাম যে তা সত্যি, কেন উদাসীনতা, তাও জানি না।
সে তোমাকে ভালোবাসত ?
জানি না, মনে হয় ভালোবাসত, আমাকে ভালোবাসত, আগুনকে ঘৃণা করত, বাড়ি কেনার পর যখন আমার ছেলের দেড় বছর, স্টোভের আগুন তার গায়ে এসে লাফ দেয়, পাম্প করতে দপ করে জ্বলে উঠেছিল, ধরে নিয়েছিল আঁচল, তাকে সদর হাসপাতাল থেকে কলকাতায় পাঠাতে হয়েছিল, বেঁচে ফিরে আসে, সে এক দিন গেছে, সে যে ফিরবে ভাবিনি, সিক্সটি পারসেন্ট বার্নট কেস ছিল।
দুর্ঘটনা। অখিল মন্তব্য করল।
হ্যাঁ তাই, সে বলেছিল, সে জানতে পারেনি কখন আগুন এসে তাকে ধরেছিল।
তোমার সঙ্গে সেদিন মনোমালিন্য হয়েছিল ?
একদম না, আমি তখন অফিসে, খবর পেতে ছুটে এসেছিলাম।
অখিল চুপ করে থাকে। অখিল এই গঞ্জে পা দেওয়ার আগে জানতই না এমন এক কাহিনির মুখোমুখি হতে হবে। কমল সরকার বলে, তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল মাস্তানরা, তারপর থেকে আগুনে খুব ভয়, সেই সময় ন’পাহাড়িতে বর্ষার মেঘ আসছে, বৃষ্টি আসবে আসবে করছে, বর্ষায় সে ভালো থাকত, তবে বলত বন্যা হলে সব ভেসে যাবে।
এই পাহাড়ি এলাকায় বন্যা হবে কী করে ?
হুঁ, আমি তাইই বলেছিলাম, ১৯৭৮-এর বন্যায় দর্মার ঘর ছেড়ে ইস্কুল ঘরে তাদের দেড় মাস থাকতে হয়েছিল, সে জলে খুব ভয় পেত, আর তাই ন’পাহাড়িকে পছন্দ করেছিল, এখানে বন্যা হবে না, বর্ষায় ভেসে যাবে না ঘরবাড়ি।
আর?
তার এক ভাই নাকি জলে ডুবে মারা গিয়েছিল।
আগুনে ?
না, আগুনে তেমন মৃত্যুর কথা জানত না সে, তাদের পল্লীতে আগুন লাগলেও কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি।
কমল তাহলে সে দু দুবার আগুনে...।
দুবার নয় অখিল, তিনবারও নয় চারবার।
আর দুবার ?
এখানেই, জল নেই তাই আগুন তাকে যেন লক্ষ করেছিল, ন’পাহাড়ি আগুনের কুম্ভ, তখন রাজনৈতিক হানাহানিরও সময়।
বলো দেখি কীভাবে হয়েছিল।
কমল সরকার বলল, গ্যাস ওভেন থেকে সিন্থেটিক শাড়ি ধরে নিয়েছিল।
তুমি তখন কোথায় ?
আমি বাজারে ছিলাম, একটু আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আমি কতবার বলেছি সিন্থেটিক শাড়ি না পরতে, বিশেষত কিচেনে। বলতে কমল অখিলের গ্লাসে মাপ মতো হুইস্কি ঢালে। নিজেই সোডা মিশিয়ে দেয়। ঘাড় উঁচু করে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে, ও কথা শুনত না, সিন্থেটিক শাড়ি কেন পরেছিল?
অখিল বলে, কতটা পুড়েছিল?
বেশি না, আসলে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কেমিক্যাল শাড়ির ভস্ম নীলার গায়ে জল বসন্তের মতো দাগ করে দিয়েছিল।
অখিল চুপ করে থাকে কমলের পরের কথার জন্য। কমল চুপ করে ছিল। অখিল দেখল চাঁদ আকাশ বেয়ে অনেকটা উঠে এসেছে। কমল বলছে, আসলে ন’পাহাড়িতে এমনিই আগুন জ্বলে, চৈত্র থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়, সারাদিন পৈছা বাতাস, পশ্চিমা হাওয়া গুমগুম করতে থাকে টিলা, কাঁকুরে মাটির ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে। নীলা জানালা বন্ধ করেই রাখত। সে বলতে আরম্ভ করল ভয় করে, দেশটা আগুনের ভিতর বসে আছে যেন।
তুমি যে বললে নীলার খুব পছন্দ হয়েছিল এই জায়গা?
কমল বলল, হয়েছিল, যখন আসি, তখন ছিল কার্তিকের আরম্ভ, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ, তখনই এখানে শীত পড়ে গেছে, দিনমান চমৎকার রোদ, ঝকঝকে নীল আকাশ, সন্ধে হতে হিম হিম ভাব নামে, মেলা বসছিল পাহাড়্গোড়ায়, সার্কাস বসেছিল ধানকাটা মাঠে, যাত্রার আসর, রাত বাড়লে শীত, তখন তো ভালো লাগার কথা, ফাল্গুন অবধি ঠিক ছিল, তারপর চৈত্র পূর্ণিমা, ভয়ানক চাঁদ, পলাশের আগুন, তারপর আগুনের হল্কা নিয়ে আসা বাতাস তাকে ভয় পাওয়াতে লাগল, একদিন আমাকে বলল, ন’পাহাড়ি ছেড়ে চলে গেলে হয়, এখেনে লুকিয়ে থাকা আগুন আছে, আগুন যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই একটা লোকের কথা মনে পড়ে তার।
কে, কার কথা বলেছিল।
তার নাম লালমোহন দাস।
সে কে ?
উদ্বাস্তু কলোনির একজন, তার চোখ লাল হয়ে থাকত সব সময়, আগুনের গোলা।
তারপর ?
সে শুনেছিল সেই লালমোহনই উদ্বাস্ত কলোনিতে আগুন লাগানোর একজন, যে মাড়োয়াড়ি কিনেছিল ওই জমি, তার সঙ্গে লালমোহনের ওঠাবসা।
তারপর? অখিল জিজ্ঞেস করে।
লালমোহনই যেন তাকে নজরে নজরে রাখে, কলোনির মানুষ সমেত কলোনিতে আগুন লাগাবে।
তোমাকে এইসব বলেছিল ?
হ্যাঁ, বলত লালমোহন আছে কোথাও।
অখিল বলল, আড়ালে আছে ?
কমল বলল, আগুন আড়ালে থাকতে পারে না।
অখিল চুপ করে থাকে। কমল যা শোনায় তা বিশ্বাস্য নয়। লালমোহনকে দেখেছে নাকি নীলা এখানে। সেই অগ্নিকুন্ড চক্ষু নিয়ে লালমোহন। শৈশবের লালমোহন। লোকটাকে হাঁইহাঁই করে হেঁটে যেতে দেখেছে নীলা এদিক থেকে ওদিকে। একদিন একটা লোক দুপুরে ঢলে পড়ল ন’পাহাড়ি বাজারে। পড়েই মরে গেল। তখন ঘোর বৈশাখ মাস। একদিন একটা লোক হাঁপাতে লাগল জিভ বের করে। মরতে মরতে বেঁচে গেল ইস্কুলের সামনে রাস্তায়। ন’পাহাড়িতে তখন এমন হচ্ছিল। একটা লোক তাপে তাপে উন্মাদ হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল ন’পাহাড়ির রাস্তা দিয়ে। নীলা বলল, প্রত্যেকদিন সেই লালমোহনকে দ্যাখে সে। তারই মতো, কিংবা সে। নীলা বলতে লাগল, এখানে আগুন, মাটির নিচে কয়লা, কয়লা তো আগুন ধারণ করে, নীলা বলতে লাগল, আমি বোঝাতে লাগলাম, এখানে কত মানুষ সুখে বাস করে, আমরাও বাস করব সারাজীবন।
তারপর ?
নীলা আর কিছু বলেনি, বরং এক বিকেলে প্রবল শিলাবৃষ্টি হলো, চৈত্রের শেষাশেষি, আগুন নিভে গেল এক ঘন্টাতেই, রাতে শীত পড়ে গেল, নীলার খুব পছন্দ হয়েছিল সেই সময়টা, বলেছিল সেই কোন ছোটবেলায় এমন শিলাবৃষ্টি দেখেছিল…, তুমি নেবে আর ?
অখিলের গ্লাসে মাপ মতো হুইস্কি ঢেলে দিল কমল। সোডা দেয় হিশেব করে। নিজেও নেয়, বলে, তার নেশা হয় না, কেন যে হয় না, সে দেড়মাস বাদে মদ্যপান করছে।
তুমি একা খাও ?
কখনো, একা হয়ে গেছি এতবড় একটা বাড়ি আর এতবড় একটা গঞ্জ, আর অগ্নিকুন্ড নিয়ে একা থাকা যায়! কেউ কেউ সান্ধ্য আড্ডার কথা বলেছিল, আমি সায় দিইনি, একা থাকি সে ভালো, অভ্যেস হয়ে গেছে, কিন্তু সন্ধে থেকে স্থানীয় বুড়োরা এসে গোলযোগ করবে, চলে গেলে বাড়িটা হয়ে যাবে কবরের মতো নিঝুম, তার চেয়ে যেমন আছে তেমন থাক।
অখিল দত্ত বলল, তোমার বাড়িকে আমার খুব শান্ত মনে হচ্ছে।
কমল বলল, ছাইচাপা আগুন এই বাড়ি, নীলা চারবার আগুনে পুড়েছিল এখেনে, মনে করো তৃতীয়বার হয়েছিল ফুলঝুরির সামান্য ফুলকিতে, ফুলকি দেখলে ধরা যায় না সে কী করতে পারে।
অখিল বলল, সে জানে। কলকাতায় কত বস্তি পুড়ল, তারপর সেখানে হাই রাইজ।
সে আগুন লাগিয়েছে কেউ, নীলার গায়ে কেউ লাগায়নি, আর সে আগুনকে ভয় পেত, জল ভয় পেত, তাকেই গ্রাস করতে চেয়েছে আগুন বারবার।
দুর্ঘটনা না অন্য কিছু ?
অন্য কী হতে পারে ?
সুইসাইড নয় তো ? অখিল সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
না, সংসার করতে ভালোবাসত, কিন্তু বারবার একই হতে লাগল, বারবার আগুন, দ্যাখো অখিল শেষবার সে আর ফিরল না, সামান্য প্রদীপের নিবু নিবু শিখা, তা-ই আচমকা দপ করে তার আঁচল ধরে নিল, সে টেরও পায়নি, আমিও না, ধুপের গন্ধ ঘিরে ধরেছিল তাকে, আমাকেও, বাঁকুড়া যখন নিয়ে যাই, তখন আর আশা ছিল না, নব্বই ভাগ পুড়ে গিয়েছিল, আগুন পারল শেষ পর্যন্ত।
তুমি ? অখিল এমনিই জিজ্ঞেস করল।
কমল সরকার শান্ত হয়ে থাকল। তারপর বলল, সে ছিল সেপ্টেম্বর মাস, তখন ন’পাহাড়ি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে বছর খুব বৃষ্টি হয়েছিল। মাটির আগুন নিভে গিয়েছিল, ও সারাদিন পুজোপাঠ নিয়ে থাকত, তার ভিতরেই অমন হয়ে গেল। আগুনে পোড়া দেহ ফিরে এল সদর থেকে। দুদিন মর্গে ছিল। আমার ছেলে তখন শিকাগো গেছে। ও আসতে পারেনি। সেদিন যখন ওই তমালি নদীর ধারে শ্মশানে নিয়ে যাই, মেঘ করে এল, তারপর বজ্রপাত আরম্ভ হলো, একের পর এক, আকাশের দেবতা যেন ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন ঝরাতে লাগল, সামনের শালবনে আগুন ধরে গেল, একটা বটগাছ পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেল, আমরা ভগবানের নাম নিচ্ছি তখন, চোখের সামনেটা ঝলসে গেল, চিতা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, আগুনের হল্কায় পুড়ে গেল যেন সব, অখিল বাড়ি ফিরে দেখলাম সব শান্ত, শুধু একটা তালগাছ , তালগাছটিকে তুমি দেখতে পাবে বাড়ির পেছনে, বাজপড়া...।
অখিল বলল, এত ক্রোধ !
আগুন।
অখিল বলল, আগুনের এত ক্রোধ!
কমল বলল, কেন জানি না।
আচ্ছা কেন তোমার পুত্র আসে না এখানে?
ওরা ভাবে…, না অখিল না।
তাহলে ? অখিল সরাসরি তাকিয়েছে কমল সরকারের চোখের দিকে, এখান থেকে চলে যাও।
কমল বলল, না।
না কেন ?
আগুন আমাকে নিক, না হয় বজ্রপাত হোক মাথার উপর।
তুমি তো ওকে ভালোবাসতে?
হ্যাঁ অখিল, ভালোবাসতাম।
তবে ? অখিল আবার জিজ্ঞেস করল। তাকিয়ে থাকল চোখে চোখ রেখে। কমল মাথা নামিয়ে নিতে পারে না। সে উপায় নেই। তার গলায় কলার। সে বিড়বিড় করে বলল, আগুন, আগুনে বিশ্বাস নেই অখিল, কী থেকে কী হয়ে যায়, আমার মনে হয়, একদিন এই বাড়িতে আগুন লাগবে, আগুনে ভস্ম হয়ে যাব আমি, অখিল না পুড়লে আমার শেষ নেই, নিজের আগুনই আমাকে পোড়াবে একদিন।
অখিল বলল, না।
কমল তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করার উপায় নেই।
অখিল বলল, আগুন তোমাকে ছুঁয়ে দেখবে না।
তুমি জান না। কমল বলল।
তোমার উপর বজ্রপাত হলেও তুমি বেঁচে যাবে।
না অখিল, না। যেন আর্তনাদ করে উঠল কমল।
অখিল বলল, সেদিন যখন হয়নি, বজ্রপাতে জঙ্গলে আগুন ধরে গেল, তাল গাছ জ্বলে গেল, তুমি তো অক্ষত রয়েই গেলে, হবে না, এক এক জীবনের ভবিতব্য এক একভাবে লেখা হয়, মানুষের সাধ্য নেই সেখানে ব্যত্যয় ঘটায়, ভবিতব্য সে নিজেই তৈরি করে, না হয় কেউ তৈরি করে দেয়।
কমল সরকার চুপ করে রয়েছে। অখিল একটি সিগারেট ধরায়, আগুনের বিন্দু দেখা যায় সিগারেটের মুখে। অখিল বলল, কেউ আসে আগুনে পুড়তে, কেউ পোড়াতে, কমল তোমার ভয় নেই, আগুন তোমাকে না দেখে চলে যাবে।
শীর্ণকায় কমল সরকার, রোগ জর্জরিত কমল সরকারের চোখ দেখছে অখিল। অগ্নিকুন্ড।
3 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগল
উত্তরমুছুনবাহ। অদ্ভুত এক গা শিরশিরে অনুভব চারিয়ে দিলেন অমরদা। দারুণ লাগল।
উত্তরমুছুননির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়
মুছুন